ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১২
অবন্তিকা তৃপ্তি
উপরে যিনি থাকেন; তিনি সম্ভবত সিদ্দিক রমণীর কষ্টটুকু সইতে পারলেন না। সেই বিকেলে আকাশ-বাতাস কাপিয়ে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি এলো; ভাসিয়ে নিয়ে গেল সাজেকের অলি-গলি…সঙ্গে কুহেলিকা সিদ্দিক কুহুর হৃদয় ভাঙার অশ্রু!
কাব্য ভেবেছিল; এই ঝড়ে কখনোই কুহু বাইরে এভাবে ঘুরে বেড়াবে না..এতক্ষণে হয়তো রিসোর্টে চলেও গেছে। তাই কাব্য নিজেও নিশ্চিন্তে রিসোর্টের দিকে এগোয়। এটাই কাব্যের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো!
কাব্য ওইদিন রিসোর্টে গিয়ে শোনে; কুহু নাকি এখনো ফিরেইনি। কথাটা শোনামাত্রই কাব্যের মাথাতে বাজ পড়ল যেন। এই ঝড়ে কোথায় চলে গেল? ও হতবম্ব হয়ে মেঝো চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললো——‘কুহু ফিরেনি মানে?’
মেঝো চাচ্চু হাপাচ্ছেন; চিন্তায় অস্থির ভাবে কাব্যের হাতটা ধরে ফেললেন! কাব্য হা করে ওর হাতের দিকে তাকালো; যা সাদাত কম্পিত হাতে চেপে ধরে আছেন! সাদাত মেয়ের চিন্তায় প্রায় কান্নাই করে দিবেন যেন; পুরুষ মানুষ হয়েছেন বিধায় কান্না আটকে কেমন ধরা গলায় বললেন——-‘আমার মেয়েটাকে যেখান থেকে পারো খুঁজে আনো কাব্য। কই আছে আমি জানিনা; আমার কল ধরছে না। এই ঝড় বাদলের দিন…আমার ভীষন ভয় হচ্ছে। তোমার চাচী শুনতে পেলে—-‘
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাদাত আটকে গেলেন; আবার জোরে-জোরে শ্বাস ফেলে কাব্যের হাতটা ছেড়ে দিলেন। কাব্য ঢোক গিলে.. অপরাধবোধে ওর মুখটা তেতো লাগতে শুরু করে। কুহু..এই ঝড়ে কই আছে? কোথায় যেতে পারে ভাবতে থাকে কাব্য!
নিজেকে সামলে..নিজের চিন্তাটুকু সাদাতকে বুঝতে না দিয়ে কাব্য কোনরকমে সাদাতের কাঁধে হাতটা রাখল! সাদাত সঙ্গেই ফিরে তাকালেন; কাব্য তার চোখে-চোখ রাখতে পারলো না তখন কেন যেন। চোখ নামিয়ে রেখে বলল——‘আমি যাচ্ছি; খুঁজে আনছি চাচ্চু ওকে। টেনশন নিবেন না।’
কথাটা বলে সাদাতকে কাব্য একটা সোফাতে কোনরকমে বসিয়ে দিল; হাঁপানির রোগ থাকায় তিনি হাপাচ্ছিলেন ভীষণ। কাব্য উনার কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বলল——‘আমি নিয়ে আসছি কুহুকে। আপনি বসুন এখানে! শান্ত হয়ে বসুন, ওকে? হাঁপানি বাড়ছে আপনার; বেশি চিন্তা করা বন্ধ করুন।’
সাদাত টলমলে চোখে কাব্যের দিকে তাকিয়ে মাথায় আবার নামিয়ে ফেললেন; বুকের ভেতরটা আজ কেমন যেন করছে উনার সকাল থেকে। কেন হচ্ছে এমন জানেন না। কোথাও কুহুর জন্যেই কি এমনটা হচ্ছিল উনার সকাল থেকে?
কাব্য উনাকে বসিয়ে রেখে যেমন ভেজা গায়ে এসেছিল; তেমনই ভেজা গায়েই এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। পুরোটা সাজেকের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ডাকছে অনবরত——‘কুহু…কুহু! কুহু তুই কই?’
কেউ জবাব দিল না। কুহুর চিন্তায় এইবার কাব্যের নিজেরই কেমন পাগল-পাগল লাগতে শুরু হয়েছে। কাব্য কিছুক্ষণ মাঝ-রাস্তায় দাড়িয়ে রইল! কিছু একটা ভেবে এইবার কুহুর একটা ছবি বের করে করে লোকদের দেখাতে লাগলো; কেউ কি ওকে দেখেছে কিনা। পর্যটকদের কেউই বলতে পারছে না ঠিকঠাকমত।
কাব্য দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে গেছে..তবুও কুহুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।কাব্য এত দৌড়েছে যে এখন শ্বাস আটকে আসছে! এই মুহূর্তে কুহুকে পেলে এখন কি যে করবে কাব্য নিজেও জানে না; আছাড়ও মারতে পারে মাথায় তুলে..আস্ত বেয়াদব একটা।
কাব্য আবার দৌড়াতে দৌড়াতে কিছুদূর গিয়ে হাঁটুতে দুহাত চেপে নিচু হয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে আবার ক্লান্ত চোখে এখানের চারপাশটা খুঁজলো, দেখল। কেউই নেই; কুহুর কোনো সাড়া নেই। কাব্য উঠে দাঁড়াল আবার; খুঁজে বের করতে হবে এই ফাজিলটাকে। কতটা কান্ডজ্ঞানহীন হলে এভাবে একটা অচেনা জায়গায় হারিয়ে যেতে পারে..অসভ্য! কাব্য আবার দৌড়ানো শুরু করল; ডাকতে থাকতে সঙ্গে—-‘কুহু; কুহু!’
বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ! কাব্য এতক্ষণে পুরোই কাকভেজা হয়ে আছে। একটু সামনে এসে একটা টংয়ের দোকান দেখে কাব্য হাপাতে হাপাতে ধীর পায়ে দোকানির কাছে গিয়ে কুহুর ছবি দেখালো। ভেবেছিল; এবারেও এই লোকটা ‘না বোধক’ উত্তর দিবে। কিন্তু কাব্যকে অবাক করে দিয়ে টংয়ের দোকানি ভ্রু কুচকে কাব্যের দিকে একবার তাকাল। কাব্যও তাকালো তখন! দোকানি এইবার আঙুল দিয়ে একপাশটা দেখিয়ে দিল। কাব্যও চমকে, উনার আঙুলের ইশারায় সেদিকটায় তাকাল। একটা মেয়ে বসে আছে ওখানে; লাল গাউন পড়া। কাব্য কুহুকে চিনতে পেরে তড়িৎ দোকানদারের দিকে তাকাল। পরপর খুশিতে ঝুপঝুপিয়ে উঠে সঙ্গেসঙ্গে মানিব্যাগ বের করে ভেজা কতগুলো টাকার নোট দোকানির হাতে ধরিয়ে দিয়ে অসম্ভব খুশি নিয়ে বলল——‘থ্যাংক ইউ সো মাচ আংকেল; এটা আপনার সম্মানী। এগেইন থ্যাংক ইউ! টাকাগুলো শুকিয়ে নিবেন প্লিজ।’
বলে কাব্য আবার দৌড় লাগাল ওইদিকে।দোকানি অবাক চোখে হাতে ধরিয়ে দেওয়া ভিজে টাকাগুলোর দিকে চেয়ে রইল!
কাব্য এক দৌড়ে কুহুর পেছনটায় এসে দাঁড়াল! এতক্ষনে হাটুতে হাত চেপে ঝুঁকে বুকটা ভরে শ্বাস ফেলে কুহুকে দেখতে লাগলো।সেভাবেই কাব্য রাগী গলায় ডাকলো——‘ক…কুহু!’
কুহুর জবাব এলো না। কাব্য এইবার উঠে সোজা হয়ে দাড়িয়ে মেজাজ দেখালো——-‘এই মেয়ে; তোর কাণ্ডজ্ঞান হবে না কোনোদিন? এভাবে সবাইকে পেরেশান করে কি পাওয়া হলো? মাথায় নাই; বাসার সবাই টেনশন করতে পারে? এতবড় হয়েও এটুকু বুদ্ধি নাই?’
কুহুর কোনও নড়চড় নেই। কুহুকে ওভাবে চুপ থাকতে দেখে কাব্য এইবার সন্দেহ নিয়ে এইবার ভ্রু কুচকে ফেলল! ও ধীর পায়ে এগিয়ে কুহুর কাঁধে হাত রাখল——‘ক..কুহু!’
সঙ্গেসঙ্গে কুহুর দেহটা এলিয়ে পড়ল কাব্যের হাতের উপর। রীতিমত চমকে উঠল কাব্য। কুহু অজ্ঞান হয়ে ছিলো এতক্ষণ? কাব্য দুহাতে তড়িৎ ভঙ্গিতে কুহুকে আকড়ে ধরল! কুহুর পুরো গা সাদা হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে! পুরো গা অসম্ভব ঠান্ডা! কতক্ষণ ধরে এই পাগল এখানে বসা ছিলো? ওহ; নো! কাব্য কুহুর গালে হাত দিয়ে থাপ্পড় দিতে দিতে ডাকে——‘কুহু; এই কুহু! তাকা আমার দিকে.. কুহু! শুনতে পারছিস? এই কুহু?’
কুহু জবাব দিল না! অজ্ঞান হয়ে নিথর ভঙ্গিতে ওভাবেই পড়ে রইল কাব্যের দুহাতের আজলায়। কাব্য অস্থির বোধ হচ্ছে। কুহু এই প্রবল ঝড়ের মধ্যে ঠিক কতক্ষণ এভাবে ছিলো?
কাব্য কোনরকম উঠে দুহাতে কুহুকে পাজকোলে তুলে নিলো। হঠাৎ চোখ গেল একপাশে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রাখা ওর জ্যাকেটটার দিকে! ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর।ছোট একটা শ্বাস ফেলে সেটাও তুলে নিলো নিজের আরেকহাতে. তারপরে কুহুকে কোলে নিয়ে ওভাবেই এগুলো রিসোর্টের দিকে!
প্রায় ক-ঘন্টা, কুহুর জ্ঞান ফিরছে না এখন অব্দি। তিন-তিনটে কম্ফোরটার দিয়ে ওর শীতে কাপতে থাকা শরীর ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ভীষণ জ্বরও এসেছে সঙ্গে। সাদাত রিসেপশন থেকে থার্মোমিটার এনে দেখলেন; ১০৪৽ জ্বর। এটা দেখেই তো সবার চোখ মাথায়; এতটা সময় ঝড়ে পরে থাকলে তো এভাবে আকাশচুম্বী তাপমাত্রা দেখাবেই।
ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে কুহুর বেডের আশেপাশে পুরো সিদ্দিক পরিবার দাড়িয়ে আছেন। কুহুর মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন কবিতা। পাশেই সাদাত ডক্টরের সাথে আলাপ সারছেন ফোনে। এতসবের মধ্যে কাব্য দুহাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে রুমের এককোণে দাড়িয়ে রয়েছে, নিশ্চুপ-গম্ভীরমুখে! ও একদৃষ্টিতে কুহুর দিকে চেয়ে রয়েছে; যার চোখ-মুখ অসুস্থতায় ফ্যাকাশে; যার মূল হোতা স্বয়ং কাব্য নিজে।
সাদাত কল শেষ করে কবিতার দিকে তাকালেন। এতক্ষণ কেঁদেও এখনো এই ভদ্রমহিলাকে কাঁদতে দেখে ধমকালেন—‘কি একটা অবস্থা! কান্না থামাবে তুমি কবিতা?’
কবিতা আরো জোরে ফুপালেন! টিকির জাদুর মতো মেয়ের এই অবস্থা; আর সে কি না থাকবে শান্ত-পাষাণের মতো। ওতো মজার শক্তি নেই কবিতার মধ্যে। কবিতা কান্না আটকে ঠোঁট দাবিয়ে, মেয়ের কপালটায় চুমু খেলেন। কপালটাও কি অসম্ভব গরম!
কবিতা সেটা দেখে এবার আরো জোরে কেদে ফেললেন। বলতে লাগলেন——‘আমার জাদু, ওর কিসের কষ্ট কুহুর বাবা? আমরা ওকে কেউ কম ভালোবাসি? কেন ও এভাবে ঝড়ে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকল? আমার জানা লাগবে এসব। আজ ও উঠুক; আমার মেয়ের কষ্ট আমি শুনতে চাই।’
বলে কবিতা আবার ফুপিয়ে উঠলেন। মেয়েকে দুহাতে আগলে ওর মুখটা ছুয়ে দিতে দিতে ডাকলেন আদুরে কণ্ঠে—-‘আম্মু; ও আম্মু! আম্মু উঠো; মা ডাকছি তো তোমাকে।’
কুহু নীরব! জ্ঞান যে এখনো ফিরেনি; মায়ের ডাকে জবাব দেবে কিকরে? সাদাটের চোখেও টলমলে জল।পুরুষ হওয়ায় উনি সেটা ঝটপট লুকিয়ে কায়ার দিকে ফিরে তাকিয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন——‘তোমরা কিছু জানো? তোমাদের সাথেই তো থাকে সবসময়।’
কায়া কি বলবে? ও আড়চোখে এসবের মূল হোতা একবার কাব্যের দিকে তাকাল। কাব্যের চোখ-মুখ বিমর্ষ! ও তখনো স্থির চেয়ে রয়েছে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকা কুহুর দিকে! কায়া চোখ ফিরিয়ে নিলো; মাথাটা নিচু করে কোনরকমে বলল——‘আ..আমি জানিনা ফুপা।’
সাদাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ত্রীর পাশটায় বসলেন। বড় চাচ্চু এইবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন——-‘সবাই যার যার রুমে যাও। এখানে গ্যাদারিং করে লাভ নেই। কুহুর জ্ঞান ফিরলে খবর দিয়ো সাদাত।’
সাদাত উত্তরে মাথা নাড়ালেন।তিনি এটাই ভেবে পাচ্ছেন না এতক্ষণ ধরে; তার চঞ্চল মেয়ে; কত শখ করে সাজেক এনেছেন— মেয়ে ঘুরতে চেয়েছে বলে। আর আজ…ওভাবে ঝড়ের মধ্যে একা একা ছিলো; কেঁদেছেও; নাক-চোখ তো এটাই বলছে! ওর কিসের ভালোবাসা-আদরের কমতি; আজ সাদাত সেটা জানতে চাইবেন কুহুর কাছে। মেয়েটা এভাবে কেন কষ্ট পাবে? কার জন্যে পাবে? ওর বাবা-মা ওকে আদর করে না? ভালোবাসে না?
কাব্য সেই কখন থেকে ওভাবেই দাড়িয়ে ছিলো, একমনে; নিরবে। কুহুর ফ্যাকাসে মুখটার দিকে যতবার তাকাচ্ছে; ততবার নিজেই নিজেকে বারবার গালি দিচ্ছে— কেন ও এই বেয়াদব; অবাধ্য মেয়েকে এই বৃষ্টিতে একা ছেড়েছে। কাব্যের মাথায় কেন আসেনি— কুহুর মনস্থাত্বিক অবস্থা ভালো নয়। কাব্য সুন্দর ভাবে বোঝানোর পরে মনে হয়েছে কুহু বুঝেছে। কিন্তু এটা বুঝেনি কুহুর মনে সেটা কতটা বিরূপ প্রভাব পড়ে গেছে; কাব্য না চাইতেও কুহু এটাকে বিরহ ভেবেছে। কাব্য আজ অনেক বড় একটা করে ফেলেছে। মেঝো চাচ্চু-চাচী কুহুর কাছে জানতে চাইলে— কুহু সত্যটা বলে দিলে? কাব্য কি করে মুখ দেখাবে ওদের সামনে? ওরা হয়তো ভেবে বসবেন— কাব্য ফায়দা তুলেছে তাদের মেয়ের; কুহুকে আশকারা না দিলে কুহু এতদূর এগুলো কি করে— এটাই ভাববেন তারা।
অথচ কাব্য জানে— ও কুহুকে এসব ব্যাপারে কখনোই কোনো ধীরনের আশকারা-লাই দেয়নি! ইনফ্যাক্ট এসব; এসব কিভাবে হয়ে গেল ও তো নিজেই জানতো না, যদি না কুহু আজ ওকে বলতো।
কাব্যের বাবার কথা অনুযায়ী সবাই বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। কাব্যও একসময় বেরিয়ে এলো। দুই ভাইয়ের জন্যে বরাদ্দ রুমটায় এসে কাব্য আগে দেখে স্নিগ্ধ কোথায়! আশেপাশে ওকে কোথাও দেখতে না পেয়ে এবার সবার আগে কল লাগাল ওর একটা সাইকিয়াট্রিক বন্ধুকে! ওপাশ থেকে রিং হলে মেহেদী কল রিসিভ করল।
কাব্যের গলা ভীষণ অন্যরকম; ও কথা তুলে—‘হ্যালো! কেমন আছিস মেহেদী?’
ওপাশ থেকে জবাব এলো———‘এইতো যাচ্ছে দিনকাল। তোর অবস্থা কি? স্পোর্টস ম্যান হয়ে যাচ্ছো দিনদিন। দেখি তো তোর ভার্সিটির ম্যাগাজিনে; ইয়া বড় বড় ফটো ছাপে!’
মেহেদী মজা নিচ্ছে। কাব্য ওসব খোশগল্পে গেলোই না আজ। বরং সরাসরি বলে বসলো—-‘একটা প্রবলেমে ফেসে গেছি ভাই। প্লিজ হেল্প কর বন্ধু।’
মেহেদী ভ্রু কুচকাল—-‘তুই আর প্রবলেম?’
কাব্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু। মেহেদী সেটা শুনে মজা ছেড়ে বলল——-‘আচ্ছা বল, কি প্রবলেম?’
কাব্য বলে যায়—-‘আমার কাজিন; কুহুকে তো চিনিস! ফ্যামিলি ফাংশনে দেখেছিস মনে হয়।’
‘হ্যাঁ; হ্যাঁ! ওই ছুটাছুটি করে সবসময়! বাবা মার আদরের দুলালী: কিছু বলা যায় না; বিচার দিয়ে বসতো সবসময়।’——— মেহেদী মনে করে হেসে উঠে মজা পেয়ে।
কাব্য হতাশ শ্বাস ফেলে; ছোট একটা শ্বাস ছেড়ে একসময় বলে উঠে—-‘ইয়াহ! সি লাভস মি ম্যান।’
‘হোয়াট?’—- মেহেদী চমকে উঠে চেঁচায়।
‘হ্যাঁ!’ —— কাব্য চোখ উল্টে অসহায় শ্বাস ছাড়ে!
মেহেদী অবাক হলো; মনে করার চেষ্টা করে বলল——‘ওহ; আই সি। এইজন্যেই ও তোর পেছনে ওভাবে ছুটত; তোর সাথেই থাকতো সবসময়। আমার তখনই সন্দেহ হয়েছে। তুই গালি দিবি দেখে তোরে বলিনাই।’
কাব্য এইবার স্পষ্ট গলায়; সিরিয়াস হয়ে বলল——‘ ভাই আমি ওকে বুঝিয়েছি অনেক। কিন্তু ও সেটা নেগেটিভ ওয়েতে নিয়ে নিয়েছে। আজ কেদেকেটে অজ্ঞান হয়ে অবস্থা কাহিল। আমার ভয় লাগছে যদি উল্টাপালটা কিছু করে ফেলে। তুই ওর সাথে একবার দেখা করবি? আমার ফ্রেন্ড হিসেবে না; ও বুঝতে পারলে হাইপার হয়ে যাবে আমার উপর। ওর সামনে তুই যাবি আমাদের মেহমান হিসেবে। ওকে কিছু ভারবাল থেরাপি দিবি, আমার হয়ে ট্রিটমেন্ট করবি। তোদের তো এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে।’
মেহেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলল ——‘আচ্ছা, যাব। কবে যেতে হবে?’
‘আমরা এখন সাজেকে। তিন-চারদিন পরে আমি তোকে কল করছি।’ —— কাব্যের জবাব এলো।
‘ওকে; জানাস আমাকে!’ —- মেহেদীর জবাব!
কাব্য ফোন কেটে দিবে; হঠাৎ মেহেদী বলে উঠে—-‘কাব্য শোন!’
কাব্য ফোনটা আবার কানে ধরে। মেহেদী আমতা-আমতা করে বলে——‘তোর ওই কাজিন তো সুন্দরী; তারউপর তোর চাচাতো বোন; চরিত্র ভালো বলা যায়। তোকে ভালোবাসে পাগলের মতো; তাহলে তুই ওকে নিয়ে তো ভাই ভাবতেও পারিস। সমস্যা কি?’
কাব্য ভ্রু কুচকে ফেলল এমন আজগুবি কথা শোনে——‘তো এখন কি করবো? ওর পাগলামির জন্যে ওকে বিয়ে করে নেব দয়া দেখিয়ে?’
মেহেদী চুপ! কাব্য এইবার শান্ত গলায় শোনায়—-—‘আমার এসব বিয়ে-রিলেশনশিপের উপর থেকে ভরসা উঠে যাচ্ছে দিনদিন! অনেক কথা আছে এর পেছনে। এখন এসব বাড়িয়ে লাভ নেই; কোনোদিন সামনাসামনি দেখা হলে বলব। শুধু জেনে রাখ: কুহু আমার মতো লুজারকে ডিজার্ভ করে না। ওকে আমরা আরো ভালো জায়গায় বিয়ে দেব।’
মেহেদী আর কথা বাড়াল না; চুপচাপ ফোন কাটল। কাব্য ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে নিজের ভেজা টিশার্ট খোলায় মন দিল। টিশার্ট খোলার সময় ওর সহসাই চোখ গেল ভেজা জ্যাকেটটার দিকে; যা কুহু ফেলে দিয়েছে সম্ভবত ওর উপর রাগ করেই। কাব্য ভেজা টিশার্ট, আর ওই জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গোসল করতে গেল।
কুহুর জ্ঞান ফিরেছে প্রায় তিন ঘণ্টা পর। আদো-আদো চোখ খুলে যখন ও তাকাল; সর্বপ্রথম কবিতার উৎকণ্ঠিত মুখটাই ওর চোখে ধরা দিল। কবিতা কুহুর জলপট্টি দিতে দিতে হয়তো ঘুমে একপাশে শুয়ে পড়েছেন।
কুহু মাকে ডাকতে চাইল! অথচ গলায় যেন পাথর বাধা,কেমন যেন কথা আসছে না ভেতর থেকে। শুধু কোনোরকম অস্ফুটে ডাকলো——‘ম..ম…ম—-
বাকিটা আর বলতেও পারলো না; কথা আসছে না আর। কুহুর দুর্বল হাতটা কবিতার আঙুল আকরে ধরতে চাইল। কবিতা কুহুর হাতের গরম-আগুন সমান স্পর্শ পেয়ে তড়িৎ চোখ খুলে মেয়ের দিকে তাকালেন। কুহু মাকে দেখে অপলক তাকিয়ে আঙুলটা আরো শক্ত করে ধরলো চেপে।
কবিতা মেয়ের চুল গুছিয়ে দিতে দিয়ে কম্পিত গলায় ডাকলেন——‘কুহু; এইতো মা। তোমার পাশে! কি লাগবে আম্মু?’
কুহুর জ্ঞান ফিরেছে শুনে সাদাতও দৌড়ে এলেন মেয়ের পাশে। কুহু কথা থামায়; অপলক তাকিয়ে রইল বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠায় ছেয়ে যাওয়া মুখ-দুটোর দিকে।
কবিতা আবার কুহুর কপাল ছুয়ে দিতে দিতে সাদাতকে বললেন——‘জ্বরটা একটু নেমেছে মনে হচ্ছে। থার্মোমিটারটা কোথায়? একটু দিন; মেপে দেখি।’
সাদাত এনে দিলেন থার্মোমিটার। কবিতা মাপলেন; তবুও ১০১৽ জ্বর এখনো গায়ে। কবিতা থার্মোমিটার রেখে আবার কুহুর পাশে বসলেন।
কুহু মায়ের হাতটা আবারো চেপে ধরে দুর্বল হাতে. কবিতা চুপ করে মেয়ের পাশটায় বসে মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিয়ে দিয়ে বললেন——-‘কিছু খাবে আম্মু? ক্ষুধা পায়নি?স্যুপ দেই মা?’
কুহু এইবার বাবা-মা দুইজনের দিকে তাকাল! সাদাত একটু দূরে দাড়িয়ে ছিলেন; কুহু তাকেও হাতের ইশারায় ডাকল। সাদাত মেয়ের পাশে এসে বসলেন।
সাদাত-কবিতার দিকে চেয়ে কুহু অস্ফুটে বলল——‘আ…আম স..সরি!’
কবিতা-সাদাত মেয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকেন শুধু। কুহু কোনরকম কান্না আটকে রেখেছে; নাকের পাটা বারবার ফুলেছে কান্নার তোপে! কুহু চায়না, এই মানুষ-দুটোকে অহেতুক চিন্তা দিয়ে; কষ্ট দিতে। এরা এসব শুনলে পাগল হয়ে যাবে!
কুহু তাই বাবা-মায়ের হাতটা ধরল আলতো করে; দুজনের হাতের উপর হাত রেখে ঢোক গিলে একটা! মুখটা জ্বরের তোপে তেতো হয়ে আছে; ঢোকটাও তাই আজ তেতো। কুহু সেসব পাত্তা না করে; দুর্বল গলায় বলে উঠল——-‘আ..আব্বু!’
সাদাত মেয়ের হাতটা ধরে অপরহাত ওর গালে রাখেন——‘বলো।’
কুহু থেমেটি-থেমে বলতে চাইল——-‘আ..আমরা ঢ..ঢাকা যাব; আ…আজ; এ-এক্ষুনি!’
সাদাত-কবিতা দুজনেই অবাক; একে অন্যের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলেন শুধু। কবিতা মেয়ের হাতে ছাপ দিয়ে বললেন——‘সাজেক ঘুরবে না আর?’
কুহু স্রেফ ‘না বোধক’ মাথা নাড়ায়। মিনমিন করে স্রেফ বলল——‘শ…শখ ম..মরে গেছে।’
কুহুর মিনমিন করে বলা কথা সাদাত-কবিতা শুনতে পেলেন না। কবিতা সাদাতের দিকে চেয়ে এবার বললেন——‘মেয়েটার জ্বর বাড়ছে। কিছু হয়ে যাওয়ার আগে ঢাকায় ফিরে ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত না?’
সাদাতও এতে সায় দিলেন।পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললেন——‘ভাইদের খবর দেই তাহলে; ব্যাগ গোছানো লাগবে।’
ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ১১
কুহু উনাকে দুর্বল হাতে তখুনি আটকে দিল। সাদাত মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। কুহু দুর্বল গলায় এবার জেদ নিয়েই বলল—-‘শ..শুধু আমরা আব্বু। আ..আমি- তুমি-আম্মু। আ..আর কেউ না; কেউ না।’
বলতে বলতে কেশে উঠল কুহু। কবিতা দ্রুত কুহুকে পানি দিলেন। ওদিকে কুহুর এত জেদ-গলার জোর দেখে সাদাত ফোন হাতে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে!