হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৭

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৭
Tahrim Muntahana

রাত একটা কি দেড় টা বাজে! ঘড়ি দেখা হয়নি, তাই ঠিক ঠাক বলতে পারবে না। ভীষণ ব্যস্ত আফরা। নিরিবিলি এই জায়গাটায় থাকার ব্যবস্থা সে নিজে করেছিল। কোলাহল থেকে দূরে। পেছনের কয়েক মাইলে আর কোনো বাড়ি, যা আছে ঘন জঙ্গল আর সরু রাস্তা! সামনে যদিও দু তিনটা বাড়ি চোখে পড়ে, বড়‌ই‌ নিম্নবিত্ত! নিজেদের মতোই থাকতে ভালোবাসে তারা। না কখনো অন্যের বাড়ি ঘুরতে যায়, না কখনো অন্যকে নিয়ে সমালোচনার আসর বসায়!

অনেকটা দিন খুঁজে খুজে বাড়িটা পেয়েছে আফরা। এর জন্য অবশ্য‌‌ই তাকে প্রথম তিনমাস দ্বিগুণ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে তবে না করেনি! এরকম সুযোগ কে হাত ছাড়া করতে চায়! বাড়ির সামনে প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস্ত হাতে বোনের জিনিসপত্র গোছাচ্ছে সে। বোন কে রেডি করিয়ে হুইল চেয়ার বসিয়ে দেয়! বাড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে ছুটে যায় গাড়ির কাছে। একাই বোন কে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও চেপে বসে। গাড়িওয়ালা অবশ্য‌ই মেয়ের শরীরের জোর দেখে অবাক হয়েছে। তবে প্রশ্ন করেনি। দ্বিগুন ভাড়া দিয়েছে যে, শর্ত ছিল কোনো রূপ প্রশ্ন করা যাবে না! টাকার লোভে সে মেনেও নিয়েছে। তার প্রশ্ন করে লাভ কি!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গাড়ি এসে থামে নামবিহীন এক রাস্তায়। যাত্রীর ইঙ্গিতেই ড্রাইভার গাড়ি থামিয়েছে। আফরা নেমে দাঁড়ায়। বোন কে নামিয়ে ভাড়া পরিশোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির আলো যখন আর চোখে বাজে না তখন আফরা হাঁটা ধরে! গন্তব্যের বহু মাইল আগে সে নেমেছে। বোন কে এমন জায়গায় লুকিয়ে সে রাখবে, তাকে ছাড়া কাকপক্ষীও যেন টের না পায়। সময় পেরিয়ে তিনটা তে ঠেকে, আফরা তখন‌ও হাঁটছে। কোনো রকম ক্লান্তি তার চোখে মুখে নেয়, বরং আলো-আঁধারি এই পরিবেশে প্রকৃতির হাওয়া গাঁয়ে মাখতে মাখতে বোনের সাথে নানান কথার ঝুলি সাজিয়েছে! আফরা চলছে গ্রামের এক সরু পথের ধার ঘেঁষে, এবড়োথেবড়ো রাস্তায় সতর্ক দৃষ্টি ফেলে এগোচ্ছে। হঠাৎ করেই কারো অবয়ব টের পায় আফরা। ঘাবড়ে যায় না‌ সে, বরং মুচকি হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠে,

~ কিরে ঘুমাস নি মনে হয়?
~ ঘুমানো যায় বুঝি?
~ আমি থাকলে দিব্যি ঘুমাতাম!
আফরার কথায় অবয়ব টি হেসে উঠে। রাতের গভীরে হাসিটাও একসময় ছন্দ মিলিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। বলে উঠে,

~ আমি যে ঘুমাতে পারি না। ঘুমালেই চোখের সামনে দৃশ্য গুলো ভেসে উঠে। কেউ আমাকে বলে, “ঘুমাস না মিরা, ঘুমাস না। তুই ঘুমালে আমার হাহাকার শুনবে কে? তুই ঘুমালে কার কাছে মনের কথা বলবো, কার কাছে যন্ত্রণা শেয়ার করবো? তুই ঘুমালে আমার ভয় লাগে, অন্ধকারে বড্ড ভয় লাগে। মাটির নিচে খুব অন্ধকার রে, একটু আলো নিয়ে আয় না! তাই তো দেখিস না? সবটা সময় আলো জ্বালিয়ে রাখি!

মিরার কথা শুনে আফরা’র চোখ কেমন ছলছল করে উঠে। জল ভর্তি চোখ নিয়েই সে অদূরের ওই আবছা বাড়িটা দেখতে পায়। আলো ঝলছে হারিকেনের, ছোট প্রদীপের ছটা টা কেমন নিজ উদ্যোগে তার ক্ষমতা অনুযায়ী আলো দিচ্ছে! ঘাড় ঘুরিয়ে আফরা মিরার দিকে তাকায়। আবছা আলোয় মেয়েটার জল ভরা চোখের আকুতি টের পায়। হাত আকড়ে ধরে ভরসা দেয়। মেয়েটার সাথে বন্ধুত্বের সময়সীমা তিন বছর। বোন‌ বাদে এই ধরণীতে এই মেয়েটাই তার সঙ্গী। আর এই মেয়েটার তো সে ছাড়া কেউ নেই! নরম সুরে বললো,

~ বোকা’রা নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে। বুদ্ধিমান রা তো ভেতরের সত্তা টাকে রাতের অন্ধকারের‌ মতোই ধরণীতে বিলিয়ে দেয়! মানুষ দেখতে পায়, অনুভব করতে পারে। কিন্তু ধরতে পারে না, ছুঁতে পারে না!
নিরবতা নেমে আসে‌। শুধু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ টা কর্ণকুহুরে পৌঁছে মস্তিষ্ক কে নাড়িয়ে দেয়। চলতে চলতে আফরা এসে দাঁড়ায় হারিকেন জ্বালানো সেই জায়গা টায়। কি সুন্দর লাগছে। বড়লোকের কোনো দুলাল-দুলালি দেখলে হয়তো বলেই বসবে; ‘ওয়াও, আউটস্ট্যান্টিং, আমার জীবনে এমন জায়গা প্রথম দেখলাম!’ অথচ গরিবের শেষ সম্বল এইটুকু জমিই! আফরা কিছুক্ষণ ফুল দিয়ে সাজানো, গোছানো কবর টার দিকে তাকিয়ে রয়, বামপাশ টায় কেমন চিনচিনে ব্যাথা টের‌ পায়। যেন নিজের কোনো এক অতিত কে মনে করিয়ে দিচ্ছে! কবর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বোনের দিকে তাকায় সে। অথৈয়ের দৃষ্টিও কবরে। হেসে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। দুটো রুম নিয়ে বাড়িটা তৈরি করা হয়েছে। সবকিছু কেমন নিপুণ হাতে সাজানো। মিরা আফরার পাশে বসে বলে উঠে,

~ কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি চলে আসবে। তবে অচেনা মেয়ের উপর বোন কে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে?
~ অচেনা কেন বলছিস? তিন দিনের পরিচয়! আমাদের মতোই এতিম! ভিক্ষা করে খেত, অনেকের বাজে কথা শুনতো। আমি সুযোগ দিয়েছি, মাসে মাসে এক্সট্রা টাকাও পাবে। এখন সে যদি হেলায় আমার দেওয়া সুযোগটা হারায়, আমার তো দায় থাকবে না!
আফরার এমন কথায় কিছুটা হলেও ভড়কে যায় মিরা। এই মেয়েটার যে হঠাৎ হঠাৎ কি হয়, সে বুঝতে পারে না।‌ এই মনে হয় প্রচন্ড ভিতু, আবার মনে হয় মেয়েটার মতো সাহসী আর দুটো নেই, একসময় বোকা মনে হয় তো আরেক সময় চালাকের রাজাকেও হারিয়ে দিতে সক্ষম মনে হয়, আবার কখনো সহজ-সরল ঘরকুনো মেয়ে তো আবার কখনো হয়ে উঠে রহস্যময়ী! এক জনের আর কত রূপ দেখবে সে? আরো কি রূপ রয়েছে? কথাটা ভাবতে ভাবতেই আফরা বললো,

~ আমার এক রূপ ই! সবাই নিজ স্বার্থে বাঁচে, আমিও আমার স্বার্থেই বাঁচি। এখন যদি কেউ আমার স্বার্থে, আমার ভালোবাসার মানুষটার গাঁয়ে থাবা বসায়, আঁচড় কাটে; আমার ছেড়ে কথা বলা উচিত? একদম গলা টা আলাদা করে দিবো না?
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে মিরার। মেয়েটার কথা শুনেই কেমন ভয় লাগছে! আফরা মিরার দিকে তাকিয়ে হাসে। আর কোনো কথায় হয় না। বোনের ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে করতেই উপস্থিত হয় পনেরো বছরের এক‌ কিশোরি। পড়নে সাদামাটা সেলোয়ার কামিজ। এসেই এক গাল হাসে, আফরা তীক্ষ্ম চোখে মেয়েটা কে পর্যবেক্ষণ করে। নাহ, তেমন কোনো ভয় এই মেয়ের থেকে নেই। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

~ কয়েকদিনের মধ্যে তোমার ভালোলাগা, মন বসানোর জন্য সরঞ্জাম চলে আসবে আঁখি। তুমি শুধু আমার বোনের দিকে খেয়াল রেখ। এতটুকু অযত্ন কিন্তু আমি বরদাস্ত করবো না!
~ আপনে কোনো চিন্তাই করবেন না আপু। আমি একটুও অযত্ন করমু না। আপনে আমারে নয়া জীবন দিছেন, বিনিময় আমি এইটুকু করতে পারমু না?
~ বাড়ি থেকে বের হ‌ওয়া নিষেধ কিন্তু! হঠাৎ করে কেউ আসলে যেন টের‌ই না পায়, এখানে দুটো মানুষ বসবাস করে।
আফরা’র কথায় আঁখি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এ আবার কেমন কথা। চঞ্চল সুরে বলে উঠে,

~ আপনারা আবার কোনো আসামি না তো, নাইলে এমন পলাই কেন থাকতাছেন?
~ সেসব তোমার ভাবতে হবে না। বিপদে তুমি না পড়লেই হলো। তোমার ফোকাস শুধু আমার বোন। ওকে?
আঁখি মাথা নাড়ায়। তার খেতে পারলেই হলো। মিরা এগিয়ে এসে আঁখির হাত ধরে বলে,
~ শুনো আমরা দুজন ছাড়া কেউ এসে যদি দরজা খুলতে বলে বা আমরা পাঠিয়েছি এমন কিছু বলে তাহলে টু শব্দ করবে না। কারণ আমরা দুজন ছাড়া এখানে আর কেউ আসবে না। তোমার যেন ঘর থেকে বের হতে না হয় তার সকল ব্যবস্থা করা আছে। বুঝেছো তুমি?

আঁখিকে এমন অনেক কিছু শিখিয়ে আফরা মিরা বের হয়ে আসে বাড়ি থেকে। একটু পর হয়তো ফযরের আযান দিবে। দুজনে হাত ধরে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। আঁখি তাকিয়েই থাকে। তার কাছে মনে হয় সে ছাড়া তিনজন মেয়েই রহস্যময়ী। এই যে একজন শুয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম এক হাসি সে দেখতে পাচ্ছে! তা রহস্যময় নয়?

ভোরের আলো ফুটেছে সবে, পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম সেই কখন ভেঙেছে। মনিরা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। পাশেই স্বামী নামক মানুষটা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। যার এক হাত বিচরণ করছে তার নরম পেটে! হাত সরিয়ে মনিরা উঠে বসে। একপলক স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসে। ছুঁয়ে দেয় কপাল, গাল, ঠোঁট, গলা। ঘুমে বিভোর আতিকুর একটুও টের পায় না! মনিরা আরেকটু কাছে এসে আতিকুরের গালে ঠোঁট স্পর্শ করে সরে আসে। নরম সুরে আপন মনেই বলে উঠে,

~ আমি তোমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছিলাম আতিকুর তবুও কেন? কেন তোমার মনে অন্যকেউ ঘুরে? ব্যর্থতা আমার নাকি আফসোস তোমার? বলো বলো!
অদ্ভুত সেই চোখের দৃষ্টি, গলার স্বর! ঠোঁটের হাসিটাও কেমন অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে। মেয়েটা কি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে? স্বামীর অবহেলা, প্রহার পেয়ে কি ভেতরের সত্তা টা হারিয়ে ফেলেছে? নাকি মেয়েটার মনে অন্য কিছু আছে? চলছে ভয়ানক কোনো পরিকল্পনা? নাকি নিতান্তই অবহেলিত বাঙালি স্ত্রী তার দুঃখ বিলাসে নিজের উপরের খোলস পরিবর্তন করেছে?

ফ্রেশ হয়ে মনিরা নিচে চলে যায়। অনেক দিন হলো শাশুড়ির সাথে গল্প করা হয় না। আজ গল্প করবে, কেন জানি একটু বেশীই মন পুড়ছে গল্প করায়! দু কাপ চা নিয়ে শাশুড়ির রুমে ঢুকে পড়ে মনিরা। শশুড় আর শাশুড়ি এক সাথে থাকে না অনেক বছর হলো। কারণ টা মনিরা ধরতে পারে নি। বাড়িতে আসলে তো একসাথে থাকাই যায়, তবে কেন বিপরীতে দু রুম? বৃদ্ধ বয়সে এমন ঘটনা তার কাছে রং তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। তবে চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা কিছু জিজ্ঞেস করতে নারাজ। শাশুড়ি কে ফ্রেশ হয়ে বসে থাকতে দেখে মনিরা হেসে তার পাশে বসলো। চায়ের কাপ হাতে তুলে দিয়ে বললো,

~ এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছেন আজ?
~ আরাফের জন্য মনটা কেমন করছে ব‌উমা। ঘুমাতে পারি নি। একটু বেশীই চিন্তা হচ্ছে আজ।
মনিরা শাশুড়ির দিকে বিরক্ত দৃষ্টি ফেলে। ভালো মুড তার নষ্ট হয়ে গেল। মনিরার শাশুড়ি আতিয়া বেগম যেন বুঝে ফেললেন ব্যাপার টা। শান্ত স্বরে বললেন,
~ সন্তান যত‌ই খারাপ হোক না কেন, মায়েদের মন সন্তানের জন্য পুড়বেই। মা তো আমরা, জন্ম দিয়েছি, লালন-পালন করেছি।

~ আচ্ছা মা, আপনার মনে হয় না এবার আমাদের একটু ভালো ভাবে থাকা উচিত?
চমকায় আতিয়া বেগম। মনিরা দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়। এই মেয়েটা তাকে এমন কথা বলছে? শাশুড়ির এমন চাহনি তে খানিক লজ্জা পায় মনিরা। এই মহিলা তাকে কতবার বলেছে চলে যেতে, অথচ সে আশায় আশায় থেকে গেল। তবুও যখন আশা টা আর বাসা বাঁধলো না তখন কি আর করার। বললো,
~ আপনার কষ্ট হয় না মা? এই যে বাবা আপনাকে ছেড়ে কম বয়সী একটা মেয়ের সাথে থাকছে।
আতিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে র‌ইলেন। কোন মেয়ে নিজের স্বামীর সাথে অন্যকেউ কে দেখতে পারে? বয়স হয়েছে, চামড়ায় ভাজ পড়েছে, শরীর বসে গেছে; পুরুষ মানুষের তো আর এসবে মন ভরে না! তাই তো মেয়ের বয়সী একজন কে নিয়ে দিব্যি ঘুরে ফিরে খাচ্ছে! নিজের ভাবনা থেকে বের হয়ে আতিয়া বেগম বললেন,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬

~ তবে চলো না শাশুড়ি ব‌উমা মিলে একটা সংসার সাজাই! মা-মেয়ে দিব্যি চলে যাবে!
মনিরা’র চোখ চকচক করে উঠলো। তবে প্রকাশ করলো না। শেষ হ‌ওয়া চায়ের কাপ টা শাশুড়ির হাত থেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
~ কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন‌ মা, আপনার না পাওয়া সুখ গুলো আমি ফিরিয়ে দিবো নতুন ছন্দে! আর আমার না পাওয়া হাহাকার গুলো!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৮