হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৪
Tahrim Muntahana
দরজা আটকে বসে আছে মনিরা। চোখে মুখে স্তব্দতা, হাত পা মৃদু কাঁপছে তার। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না এই দুনিয়ার কোনো কিছু তার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে, মনের মধ্যে অনুভূতির সৃষ্টি করছে! সে নির্বাক খাটে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। দৃষ্টি ঘুরতে থাকা ফেনের দিকে। যখনি একটু আগের দৃশ্যটা চোখে ভাসছে তখনি তার কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছে! মনের মধ্যে মিশ্র এক অদ্ভুত অনুভূতি কড়া নাড়ছে। একদিকে মুক্তির স্বাদ পাওয়ার আগ মুহূর্তের ডানা মেলে উড়ে চলার অনুভূতি, আরেকদিকে ভয়! না পারছে ঠিক ভাবে আনন্দ প্রকাশ করতে, না পারছে ভয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে! এ যেন অনুভূতির আত্মবলিদান।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। শুনেও নির্বাক মনিরা। পরপর চারবার দরজায় বারি পড়ে। অপাশের মানুষ টা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। মনিরা চোখ বুজে মুখ হা করে শ্বাস ফেলে। কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। গুটি গুটি পায়ে আলমারির দিকে যেতে নিতেই মেয়ের কন্ঠ শুনে আপনাআপনি তার পা থেমে যায়। এতক্ষণ মুখশ্রী, মনে যে অনুভূতি ছিল না; মেয়ের কান্না ভেজা কন্ঠ শুনে মনিরার মুখশ্রীতে ব্যাথার ছাপ ফুটে, নয়নযুগলে ফুটে উঠে অসহায়ত্ব। বুকটা কেমন হুহু করে উঠে। পা চালিয়ে দরজা খুলে দেয়, সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মিহি। শব্দ করে কেঁদে দেয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আহা কত আহাজারি! আট বছর বয়সে বাবার কা* টা মাথা দেখে মেয়েটা যে এখনো সশরীরে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে পারছে, হয়তো তাই অনেক! মেয়েকে ভেতরে নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দেয় মনিরা। প্রতিবেশীর তোয়াক্কা সে করে না। মিহিকে বিছানায় বসিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রয়। মনের মধ্যে অগোছালো কথামালা সাজায় নিজের মতো, বারংবার ঢোক গিলে সে। মেয়ে সহ্য করতে পারবে তো? সময় পেরিয়ে যায় নিজ গতিতে। মনিরা বলে উঠতে পারে না, ব্যর্থতা নিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে। মনে হচ্ছে ভেতরে লুকিয়ে থাকা রাগী সত্তাটা বেরিয়ে আসতে চায়ছে। মিহির কান্না বাড়ছে বলে কমছে না। তার মুখে একটাই শব্দ,
‘আমার বাবা!’
এই একটা কথায় বার বার রিপিড় করছে সে। মনিরা এবার রাগ দমিয়ে রাখতে পারলো না, চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ স্টপ মিহি! একদম কাঁদবে না। একদম না, অমানুষের জন্য একদম কাঁদবে না। তোমার মুখে যদি আরেকবার বাবা নামটা শুনি একদম জ*বাই করে ফেলবো। চুপ করো!
ভয় পেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো মিহি। আকস্মিক চিৎকার, মায়ের রাগ, তিক্ত কথা গুলো মিহির মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তেই মেয়েটা ঢুলে পড়লো মনিরা’র কোলের উপর। ততক্ষণে খেয়াল হলো, মনিরা কি করছিল! কিন্তু তার মধ্যে বিচলিত হওয়ার কোনো ছাপ খুঁজে পাওয়া গেল না। বিছানায় মেয়েকে শুয়িয়ে দিয়ে পানি ভর্তি গ্লাস টা হাতে তুলে নিলো। সময় নিয়ে পুরো পানিটা চোখ মুখে ছিটিয়ে দিল, যেহেতু সামান্য ভয় পেয়েই জ্ঞান হারিয়েছে তাড়াতাড়িই জ্ঞান ফিরবে। তাই হলো, খানিক পরেই পিটপিট করে চোখ খুললো মিহি, আবছা চোখে মায়ের শান্ত মুখশ্রী দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আগের মতো কাঁদলো না। মনিরা এবার রাগ দেখিয়ে ভুল করলো না বরং নরম কন্ঠে বললো,
~ আমি তোমাকে আজ অনেক গুলো কঠিন কথা বলবো। জানি না কতটুকু বুঝবে, আমার মনে হয় তোমার বুঝার কথা। সেরকম পরিবেশেই তুমি বড় হয়েছো। তবে কাঁদবে না কিন্তু, মা ভীষণ রেগে যাবে!
মিহিকে কিছু বলার সুযোগ সে দিল না, মাথার কাছ থেকে উঠে আলমারির সামনে দাঁড়ালো। খুঁজে খুঁজে কয়েকটা খাম বের করে আবার মেয়ের পাশে বসলো মনিরা। ততক্ষণে মিহি উঠে বসেছে। মনিরা খাম গুলো মিহির হাতে দিয়ে বললো,
~ খুলে দেখ! চিৎকার করবে না!
মিহি ভয় নিয়ে খাম গুলো খুলতেই চোখ বন্ধ করে ফেলবো। আট বছরের মেয়ে নিশ্চয়ই বুঝবে কোনটা জুলুম, কোনটা অত্যাচার, কোনটা ভালোবাসা! মিহিও বুঝেছে! সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজের বাবা কে মা ব্যতিত অন্য মেয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে মেয়ের অনুভূতি কেমন তা নিশ্চয়ই মনিরা কে বলে দিতে হবে না। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো সে। মিহির হাত থেকে ছবি গুলো নিয়ে নিলো। তারপর একটা করে মিহির চোখের সামনে ধরে বলতে লাগলো,
~ এই মেয়েটা সবে ইন্টারে পড়ে। গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল স্বপ্ন পূরণ করতে, কিন্তু পারেনি। তোমার বাবার শকুনের চোখ যে এই মেয়ের উপর পড়েছিল। নষ্ট করে, মারধর করে সাতটা দিন একটা ঘরে আটকে রেখেছিল। মেয়েটা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি, হোস্টেল ফিরেই গ*লায় দ* ড়ি দিয়েছে!
~ এই মেয়েটা দেখ, কুচকুচে কালো, পুরুষের চোখে অসুন্দর। তবে তোমার বাবার চোখে না! বাইশ বছর বয়সী মেয়েটা কে তিনদিন একটানা অত্যাচার করেছে। মেয়েটা কিন্তু মরেনি, আত্মহত্যাও করতে যায়নি! প্রতিবাদী মেয়েটা শুধু বিচার চেয়েছিল। তোমার বাবা কি করেছে জানো? কু* পিয়ে কু* পিয়ে মেরেছে করেছে।
~ আর এই যে, এই মেয়েটাকে দেখ। তোমার থেকে কত বড়? ধরো পাঁচ বছরের। এই মেয়েটাও বাদ যায় নি তোমার বাবার থেকে। তাকেও মে* রে ফেলেছে!
এভাবে পর পর আরো কয়েকটা ছবি মেলে মেয়েকে জা* লিম বাবার চরিত্রহীনতার প্রমাণ দিল মনিরা। মিহি শুধু চোখ বড় বড় করে শুনে যাচ্ছে। শেষমেষ মনিরা আরেকটা ছবি মিহির হাতে তুলে দিয়ে বললো,
~ এই মেয়েটাকে চিনতে পারো? তোমার পছন্দের ম্যাম, দেখ! তোমার ইতি ম্যাম। হুট করে ঘায়েব হয়ে গেল না? কেন জানো? নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা মেয়েটা নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে তোমাকে পড়াতে এসেছিল। কিন্তু মেয়েটা কি জানতো এই বাড়িতে তিন তিনটা মুখোশধারী চরিত্রহীন শকুন থাকে? প্রথম তোমার চাচ্চুর হাতে ধ* র্ষণ হয়েছে, চুপ করে ছিল। তোমাকে পড়াতে আসতো, তারপরেও এদের স্বাদ মিটলো না। তোমার বাবাও মেয়েটাকে ছাড়লো না। মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা ছিল, তোমার বাবাকে অনুরোধ করতে এসেছিল তাকে বিয়ে করতে। তোমার বাবা যা তা বলে অপমান করে বের করে দিয়েছে। তারপর কি করেছে জানো? কয়েক গজ দূরে বড় ব্রিজ টা আছে না? ওখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মরে গেছে! তোমার বাবা একটা চরিত্রহীন নর*পশু। তোমার বাবা জা…
মনিরা আর উচ্চারণ করতে পারে না। মিহি তার ছোট্ট হাত দিয়ে মনিরার মুখ চেপে ধরে। আর শুনতে চায় না সে, পরিচিত সেই বাবা টার এমন রূপ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মনিরা হেসে উঠলো। মিহির থেকে সরে এসে গায়ের আঁচল টা ফেলে দিয়ে বললো,
~ শরীরের দাগ গুলো দেখেছো মিহি? তাজা না? এগুলো তোমার বাবা’র ভালোবাসা মিহি। বিশ্বাস হচ্ছে না মা কে? মা মিথ্যে বলছে? ছবি গুলো দেখ, কতটা নির্মম! তোমার আফরা ম্যাম কে জিজ্ঞেস করবে? তোমার বাবার কুনজর যে তার উপরেও ছিল। দেখ, মেয়েটা ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেল। তোমাকে এসব বলার কারণ কি জানো? যার জন্য তুমি তোমার মূল্যবান চোখের পানি ফেলছো সেই লোকটাই কত মেয়ের কষ্টের কারণ হয়েছে, মৃ*ত্যর কারণ হয়েছে, কয়েক পরিবারের ভেঙে পড়ার কারণ হয়েছে। সাবধান চোখের জল ফেলবে না।
মনিরার কেন জানি হাসি পেল খুব। ইচ্ছে টাকে দমিয়ে না রেখে কিছুটা শব্দ করেই হাসলো। হেলতে দুলতে বিছানায় কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,
~ তুমি ছোট, বাস্তবতা বুঝার বয়স তোমার হয় নি। তবে তুমি যে পরিবেশ, পরিস্থিতি তে বড় হয়েছো তোমাকে জোর করে হলেও বুঝতে হবে মিহি। আমাদের পরের পথটা সুগম নয় রে মা। অনেক লড়াই করতে হবে। সমাজ যে একটু বেশীই জটিল। এই সমাজ এখন থেকেই আমাদের বুঝিয়ে দিবে স্বামী হারা আমি, আর তুমি বাবা হারা। অপদস্থ করতে চাইবে, তবে মা চোখের জল ফেলে তাদের সুযোগ করে দিও না। কেউ যদি তোমাকে একটা কথা শুনায় চুপ করে থাকবে, দুটো বললেও চুপ করে থাকবে কিন্তু যখন সে নিজের লিমিটেশন ভুলে তৃতীয় কথাও তোমাকে শুনানোর স্পর্ধা করবে; একদম গলার মাঝখানটাই চে*পে ধরবে! কথা যেন বের করতেও না পারে, গিলতেও না পারে। এই দুনিয়া নরমের যম, শক্তের ভক্ত। নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করবে, এমন ভাবে গুছিয়ে নিবে তোমার মায়ের জীবনের একাংশ যেন তোমার জীবনেও প্রভাব না ফেলে। মা-মেয়ের লড়াই যে কঠিন রে মা! শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত করে যেতে হবে!
থামলো মনিরা। জোরে জোরে দু’বার নিশ্বাস নিলো। হাঁপিয়ে গেছে, তার আজকের কাজ সে করে ফেলেছে। এবার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।
মিহির কান্না ভেজা কন্ঠ শুনেই মনিরা মিহির জায়গায় নিজেকে বসিয়েছিল। সেও অল্প বয়সে বাবা কে হারিয়েছে। মায়ের চিন্তিত মুখ আজ ও চোখে ভাসে। সমাজের মানুষের কটু কথা, অবজ্ঞা, পুরুষের কুদৃষ্টি দেখে দেখেই বেড়ে উঠছিল সে। তার মায়েরও অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর কত ঘটক ই না আসলো বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। তবে তাদের দাবি ছিল মেয়ে কে নিতে পারবে না। নিজের সুখ বলিদান দিয়েই তো মনিরার মা মরিয়ম বেগম মেয়েকে মানুষ করেছে। মনিরা যখন কিশোরী, মরিয়ম বেগম তখন যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ। কোনো পুরুষ কে বাড়ির আশেপাশে দেখেই জ্বলে উঠতেন। কথা দ্বারাই যেন তাদের জ্বালিয়ে দিতেন।
কি এক লড়াই বাবাহীন মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। ইচ্ছে ছিল মেয়েকে পড়াবে, মস্ত বড় অফিসার বানাবে। তার আগেই তো আশরাফ উদ্দিনের চোখ পড়েছিল। অনুরোধ, হুমকি কত কি করে মরিয়ম বেগম কে রাজি করালো। মরিয়ম বেগম ও ভালো পরিবার দেখে আর না করেননি। এখন যদি বেঁচে থাকতেন নিশ্চয় বাঁচার আশা আর করতেন না। মেয়ের পরিণতি দেখে নিশ্চয়ই কঠোর মহিলাটাও মরার কথা ভাবতেন। ভাগ্যিস বেঁচে নেই! মনিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মায়ের জীবন টা ঘুরে ফিরে তার জীবনের প্রতিরূপ হয়েছে।
প্রার্থক্য এটাই মরিয়ম বেগমের স্বামী ছিল সৎ, ভালো মানুষ। মনিরার স্বামী তার উল্টো। মরিয়ম বেগম মেয়ে কে বিরুপ পরিবেশে কঠোর হওয়ার বুঝ দেয়নি, সে তার ছোট্ট মেয়েকে দিয়েছে। আরো দিবে, প্রতিনিয়ত বারবার মনে করিয়ে দিবে। নাহলে তার মতোই হয়তো তার মেয়ে অন্যায় দেখেও চুপ থাকবে, ঘুরে দাঁড়াবে না, প্রতিবাদ করবে না। সে দেরী হলেও বুঝেছে! মিহির হাতের ছোঁয়ায় চোখ খুলে মনিরা। পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে মেয়েকে দেখে। এই যে মিহির চোখমুখে একটু আগের কষ্ট, সন্দেহ নেই বরং রয়েছে বাবার প্রতি ঘৃণা। মেয়েটা কি জানে এই একটু অনুভূতি মনিরার মনে কতটুকু সুখ ঢেলে দিল। দু হাত বাড়িয়ে মিহিকে আগলে নেয় মনিরা। মিহিও চুপচাপ মায়ের বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে। হুট করেই কিছু একটা ভেবে মনিরা বললো,
~ চলো নিচে যাওয়া যাক। নিচে যা হবে, ভয় পাবে না একদম। আমাদের গোপন কথা যেন কেউ না টের পায়। বুঝতে পেরেছো?
মিহি মাথা নাড়ায়। মনিরা নিজেকে একটু গুছিয়ে দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথেই কেউ এসে মনিরা কে জড়িয়ে ধরে। মনিরা বুঝতে পারে, হালকা হাসে। বলে উঠে,
~ বাবাহ, হঠাৎ কি হলো মেয়ের ম্যামের?
~ লজ্জাজনক হলেও বলতে হচ্ছে আপনাদের সব কথাই শুনে ফেলেছি। তবে ব্যাপারটা আপনাদের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়, এটা নিশ্চয়ই জানেন?
~ আমি তো আগেই টের পেয়েছিলাম দরজার অপাশে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। তাই তো সাহস করে এতগুলো কথা মেয়েকে বলতে পেরেছি। তুমি দাঁড়িয়ে আছো মানে আর কারোর শুনে ফেলার ভয় নেই!
আফরা মুচকি হাসে, মিহির দিকে এক পলক তাকিয়ে মনিরার হাত ধরে। বাঁকা হেসে বলে উঠে,
~ যাওয়া যাক? পুলিশের জেরা থেকে বাঁচতে হলে একটু অভিনয় করতেই হবে। আপনার শশুড়ের মস্তিষ্ক ভালো না।
তিনজনই বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতেই তিনজনেরই চোখ মুখে অবাকতা ফুটে উঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে এত পরিবর্তন! সরকারী পোশাক পড়া লোকজন কিলবিল করছে। সাংবাদিক দেরও দেখা যাচ্ছে। যদিও আফরা এমনই ভেবেছিল, তবে এত তাড়াতাড়ি ভাবেনি। হওয়ার ই কথা, একজন পুলিশ অফিসার কে নির্মম ভাবে হত্যা করে তারই কা*টা মাথা পার্সেল করা হয়েছে তারই স্ত্রীর কাছে। ব্যাপারটা যেমন ভয়ংকর তেমনি রহস্যময়। অনেকের বক্তব্য কোনো দাগী আসামির পরিবার এমন করেছে, আবার অনেকের বক্তব্য ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে হ*ত্যা করা হয়েছে। এটা নিয়ে যে বিশদ ইনভেস্টিগেশন হবে বুঝাই যাচ্ছে। তরুণ পুলিশ অফিসার নোমান আশেপাশের মানুষদের জেরা করছিলেন, মনিরা ওদের নিচে নামতে দেখে এগিয়ে আসে সে। আফরা কে দেখিয়ে বললেন,
~ ইনি কে?
মনিরা কিছু বললো না, মিহি ছোট স্বরে উত্তর দিলো,
~ আমার ম্যাম।
নোমানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হয়ে এলো। আফরা কে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
~ কতদিন ধরে এ বাড়ির সাথে সম্পর্ক আপনার?
~ এ বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সম্পর্ক শুধু মিহির সাথে। আমি মিহিকে তিনমাস যাবৎ পড়াচ্ছি।
গম্ভীর স্বরেই উত্তর দিলো আফরা। নোমান হাসলো। আবার প্রশ্ন করলো,
~ ইন্সপেক্টর আতিকুরের সাথে আপনার যোগাযোগ আছে?
আফরা’র ভ্রু কুঁচকে এলো, লোকটা কি ইঙ্গিত করছে? অবাক কন্ঠে বললো,
~ আপনি কি মিন করতে চাইছেন? আমি মিহিকে পড়াতে আসি দুপুরে। আপনার নিশ্চয়ই জানা সে সময় স্যার বাড়িতে থাকেন না। আর আমি যতদূর জানি পারিবারিক ব্যাপারে স্যার থাকেন না। আপনার প্রশ্নটা কতটা অযৌক্তিক বুঝতে পারছেন?
নোমান আফরা’র দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে, মেয়েটা তার প্রশ্ন ঠিক কিভাবে উল্টে দিতে পারছে। তবে মুখে প্রকাশ করলো না। আফরা’র থেকে নজর ঘুরিয়ে মনিরা’র দিকে তাকাতেই আফরা সরে আসলো সেখান থেকে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করলো। তবে হতাশ হতে হলো তাকে। কোনো রূপ চিহ্ন ই সে দেখতে পারছে না। কিন্তু থাকার কথা তো!
~ চলো একটা ডিল করি!
কারো হেঁয়ালি কথায় আফরা নিজের দৃষ্টি সংযত করে নেয়। পেছন ঘুরতেই আরাফকে দেখতে পায়। যে তার দিকে তাকিয়েই হাসছে। তবে কথার মানে সে বুঝতে পারলো না। আরাফ আফরা’র কাছাকাছি এসে বললো,
~ অফিসার বলছিল, কাদের সাথে ভাইয়ার ঝামেলা ছিল বলতে। এখন আমি যদি কায়দা করে তোমার নামটা বলে দিই, কি হবে তোমার বুঝতে পারছো?
~ হ্যাঁ পুলিশ অফিসার তো গান্জা খেয়ে ডিউটি করতে আসছে, আপনার কথাতেই আমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে।
আফরা’র ভাবালেশ উত্তর। আরাফের রাগ হলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ টাকার কাছে এসব পুলিশ অফিসার কিছুই না। তোমাকে ফাঁসাতে আমার সময় লাগবে না। এমন কি আমার অবস্থাকেও সংযোগ করে এমন ভাবে ফাঁসিয়ে দিতে পারি, বাইরের আলো-বাতাস আর শরীরে মাখতে পাবে না।
আফরা বিচলিত হলো। টাকার কাছে এসব পুলিশ অফিসার আসলেই কিছু না। টাকায় পারে না কি, ইদানিং তো টাকায় ভালোবাসা ও পাওয়া যায়। নিজেও ছোট স্বরে বললো,
~ আপনার ডিল টা কি?
জয়ীর হাসি হাসলো আরাফ। সবার অগোচরে আফরা’র দিকে কুদৃষ্টি ফেলতেও ভুললো না। রসিয়ে বলে উঠলো,
~ আমি যেটা চাই তা তুমি ভালো করেই জানো! আপোষে রাজী হও নতুবা আমার কাছে অন্য পদ্ধতি আছে!
আফরা’র গা যেন গুলিয়ে আসলো। চোখ মুখে রাগ আর ঘৃণার মিশ্র ছাপ। তবে আরাফ কে বুঝতে না দিয়ে বললো,
~ কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে তো তাহলে মস্ত বড় বিষ দাঁতয়ালা সাপ বের হয়ে যাবে! আপনার অবস্থা কি করে হলো, কোন জায়গায় হলো এসব বের হলে তো আপনি ফেঁসে যাবেন! ভুলে গেছেন সেদিন রাতের কথা?
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৩
আরাফ ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। কিছু বলার আর সাহস হলো না। আফরা আবার মনিরা’র পাশে এসে দাঁড়ালো। নোমান মনিরা কে এতক্ষণ অনেক প্রশ্নই জিজ্ঞেস করেছে, তবে একটা উত্তর ও পায়নি। তার জানা ছিল, তবে কেন জানি মনে হচ্ছে প্রশ্ন করতে থাকলেই মহিলাটি কিছু একটা বলে উঠবে। মনিরা অফিসার নোমানের কথা শ্রবণ করছিল ঠিকই, তবে তার দৃষ্টি ছিল আরাফ-আফরার দিকে! আরাফের মুখের বাঁকা হাসি, পরমুহূর্তেই ভয় পেয়ে যাওয়া সবটাই পরখ করেছে। তার মনে হলো এবার মুখ্য কাজ টা করা দরকার। নোমানের প্রশ্ন ধরেই মনিরা দৌড়ে গিয়ে আরাফের কলার ধরে ফেললো শক্ত হাতে। চোখে জল নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
~ এ আমার স্বামীর খুনী। এই শয়তান টাই আমার স্বামীকে মেরেছে। ছাড়বো না আমি তোকে, তুই আমাকে স্বামী হারা করলি!