মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৬
মির্জা সূচনা
ঠিক তখনই হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। ভিতরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চাইছে May I come in sir,
ভেতর থেকে কবি সাহেবের গলা ভেসে আসে—
Coming…
দরজা খুলে ভেতরে আসে এক যুবক। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। পরনে পরিপাটি পোশাক, চোখে পেশাদারিত্বের ঝিলিক। হাতে একটা ফাইল মুখে বিনয়ী অথচ দায়িত্বশীল ভঙ্গি।
সে বলে,
Sir, সব রেডি। সবাই চলে এসেছে। আপনি অনুমতি দিলেই, ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে মিটিং শুরু করতে পারব।
কবি সাহেব জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললেন,
ঠিক আছে… তুমি সব ব্যবস্থা করো, লাবিব। আমি আসছি।
লাবিব মাথা নেড়ে সম্মান জানিয়ে বলল,
Oky sir.
তারপর বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
কবি সাহেব ধীরে ধীরে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আয়নার দিকে তাকায়।
তার চোখ—দুটো যেনো মায়ার রাজ্য।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চোখ দুটো গভীর, শীতল, কিন্তু শুষ্ক নয়—তাদের ভেতর লুকিয়ে আছে বহু অপূর্ণ কবিতা, বহু বিনিদ্র রাত। এই চোখ দুটো অনায়াসে মানুষের চোখের ভাষা পড়ে ফেলতে পারে।
চোখ দুটো অনায়াসে অন্য কোন মানুষের চোখের ভাষা পড়ে ফেলতে পারে।
তার নাক—সোজা, ছুঁচালো আর আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। যেন শৈল্পিক নিখুঁত এক রেখা, যা মুখের ভারসাম্য ধরে রেখেছে নিঃশব্দে।
তার ঠোঁট—পাতলা আর গোলাপি, ঘন আর সংযত। ওপরের ঠোঁট একটু বাঁকা, যেন মৃদু বিদ্রুপ লুকিয়ে রাখে।
তার কপাল—প্রশস্ত, মসৃণ, চিন্তার ভাঁজে কালি জমেছে যেন। আলো পড়লে চকচকে লাগে, কিন্তু কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়—এখানে দিন, রাত, পেন ও পেইনের জটিল একচেটিয়া বসবাস।
মুখে তার চাপ দাড়ি। দাড়ির রেখাগুলো যেন তার ব্যক্তিত্বের প্রতীক।
দীর্ঘ, সুগঠিত, পুরুষালী। তার আকর্ষণীয় একটা দিক হলো, অ্যাডামস অ্যাপল স্পষ্টভাবে ওঠানামা করে যখন তিনি কথা বলেন—যেন প্রতিটি শব্দ তার ভেতরের থেকে উঠে আসে।
চুল—আঁচড়ানো, তবু খোলা। অল্প ঢেউখেলানো, একটু কপালে পড়ে থাকে ইচ্ছেমতো। মাঝে মাঝে আঙুল চালিয়ে তোলেন সেটা কপাল থেকে, কিন্তু তা যেন অভ্যাসে পরিণত হওয়া এক অনিচ্ছা।
তিনি আয়নায় নিজের চোখে চোখ রেখে বললেন,
ক’দিন ছাড় দিয়েছি, আর তাতেই আমায় ভুলে গেলে? That’s not fair…
তার গলা নিচু, নরম, কিন্তু এক অদ্ভুত শীতল রেশ বইছিল প্রতিটি শব্দে।
“Moonbeam…” নামটা উচ্চারণ করলেন তিনি যেন চুমু ছোঁয়াচ্ছেন বাতাসে।
তোমায় আমি আকাশে ওড়ার ডানা দিয়েছি— শুধু এই আশায়, সময়মতো সেই ডানাগুলো কেটে, নিজের খাঁচায় ফিরিয়ে আনবো।
তিনি এগিয়ে গিয়ে আয়নার কিনারা ধরে থেমে গেলেন।
“আর তুমি? তুমি তো আমার ভালো মানুষির সুযোগ নিয়ে, আমাকে ভুলে যেতে বসেছো… এটা কি মেনে নেওয়া যায়, Moonbeam?
তার চোখে এখন অদ্ভুত এক দীপ্তি। হঠাৎ মনে হচ্ছিল, তার চোখের সামনে শুধু আয়না নয়, বরং সেখানে দেখা যাচ্ছে কোনো এক গোপন জগত— যেখানে ভালোবাসা, নিয়ন্ত্রণ আর প্রতিশোধ একই সাথে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কবি সাহেব ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা গুনগুন করতে থাকেন। গলার স্বর নরম, কিন্তু ব্যথাভেজা। সেই গুনগুনানি এক সময় গানে রূপ নেয়—
সে যে এখন আমায়
ভালোবাসে না…
জোনাকি গায় ফিসফিস
হাওয়া দিয়ে যাই শিস…
তাতে আমার কিছু যায় আসে না
সে যে এখন আমায়,
ভালোবাসে না…..
উঠে আনন্দ চাঁন
গলায় গলায় গান শুধু
গলায় সুর আসেনা …
সে যে এখন আমায়
ভালোবাসে না …….
গানের শেষ লাইনে গলা কেঁপে ওঠে। তিনি থেমে যান। আয়নায় নিজেকে দেখেন— চোখে একরাশ অভিমান, একটুখানি রাগ, আর অনেকখানি অপেক্ষা।
তারপর হাত-মুখে পানির ছিটা দেন। আচরণে কোনো ব্যস্ততা নেই— যেন প্রতি অঙ্গভঙ্গিতেই ব্যক্তিত্ব ঝরে পড়ে।
পরানের সাদা শার্ট তার ওপর কালো ব্লেজার, হাত দিয়ে সামান্য চুল ঠিক করেন। মুখে আবার সেই আত্মবিশ্বাসের রহস্যময় হাসি ফিরিয়ে আনেন।
হলঘরে একটানা কথাবার্তা চলছিল। কেউ হালকা হাসছিল, কেউ নিঃশব্দে ফোন স্ক্রল করছিল, কেউ বা আবার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে ঘড়ি দেখছিল। ঠিক তখনই দরজা খুলে গেল—মৃদ শব্দে, কিন্তু যেনো সবার হৃদয়ে ঘন্টা বাজিয়ে।
প্রথমে ঢুকল লাবিব—চোখে গম্ভীরতা, পরনে নিখুঁত ফর্মাল পোশাক। পেছনে সে হালকা মাথা ঝুকিয়ে দাঁড়ালো।
তার পেছনেই এলেন কবি সাহেব।
ঘরটা মুহূর্তে নিস্তব্ধ। যোন বাতাস থেমে গেল। কথা থেমে গেল, নিঃশ্বাস জমে উঠলো কারও কারও। সবার চোখে এক অনুভূতির ঝলক—ভয়, সম্মান আর বিস্ময়। তাঁর উপস্থিতিই যোন এক অদৃশ্য চাপে মাটির ওপর কাঁপন তুলে দিল।
তিনি ধীরে পা ফেলছিলেন, মাথা সোজা, চোখ দুটি সামনের দিকে স্থির—যোন সব জেনে বুঝেই এগোচ্ছেন। তাঁর হাবভাব বোঝা কারো সাধ্যে নেই—তবে সেই নিস্তব্ধতা ভয়ংকর। কারও মুখে শব্দ নেই। চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ যেন দাঁড়িয়ে যায়।
আর কবি সাহেব, ধীর পায়ে সামনে এসে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে বললেন—হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে বললো,
তার পর লাবিবকে বললো!
Meeting start now..
কবি সাহেব টেবিলের মাথায় বসে ছিলেন নিঃশব্দে। চোখ দুটি একেকবারে সবার মুখের ওপর ছায়া ফেলে যাচ্ছিল। সবাই নতুন প্রজেক্ট নিয়ে মিটিংয়ে ব্যস্ত।
লাবিব হঠাৎ কবি সাহেবের কানে কিছু একটা বললো।
কিন্তু হঠাৎ কবি সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠে বজ্রের ঝাঁজ —
“Mr. Rofiq…”
ঘরের বাতাস থমকে গেল।
শুনলাম আপনি আমার পেছনে, আমার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন?কথাটা কি সত্যি?
ঘরটা এক লহমায় জমে গেল বরফে। রফিক সাহেব, যিনি একটু আগে হালকা হেসে কথা বলছিলেন পাশের সহকর্মীর সঙ্গে, হঠাৎ তার গলা শুকিয়ে গেল। গাল বেয়ে ঘাম পড়তে শুরু করল। তিনি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পা কাঁপছে।
রফিক সাহেব কে ভয় পেতে দেখে কবি সাহেব কৌতুকের সাথে বললেন,
বুঝলেন তো রফিক সাহেব,আমি কিন্তু প্রতিশোধ নেই না…
আমি শুধু অপেক্ষা করি—
ভুলটা যেনো নিজেই দরজা খুলে বলে, ‘ভেতরে আসব?’
আর তখন আমি শুধু হেসে বলি, ‘তুমি তো দেরি করে ফেললে… চা ঠান্ডা হয়ে গেছে।’
কবি সাহেবের কথা শুনে অন্যদিকে ঘুরিয়ে হাসে। কারণ সে জানে এখন কি হতে চলেছে,
রফিক সাহেব বলেন,
“না না, Sir… আমি… আমি…” — কথার মাঝেই জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে।
সাহস করে কবি সাহেবের দিকে এগিয়ে এসে হঠাৎ তাঁর পা জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
Sir, আমায় মাফ করে দিন… আমি ভুল করেছি… একবারের জন্য সুযোগ দিন… আমার পরিবার আছে, বাচ্চারা আছে… আমি জীবনেও আর এমন কিছু আর করব না…
তার গলায় কাঁপুনি, চোখে জল।
ভয়ে কাঁপছে সে, চোখে মুখে হতাশা আর কাকুতি-মিনতি।
কবি সাহেব অবাক হয়ে নিচের দিকে তাকালেন। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে মুখ কুঁচকে বললেন—
আরে!আরে! কি করছেন, মেয়ে মানুষের মতো এভাবে ধরাধরি করছেন কেন, রফিক সাহেব?
এই শুনুন, আমি জানি আমি হ্যান্ডসাম।তাই বলে সুযোগে সৎ ব্যবহার করে আপনি আমাকে টাচ করবেন। আমাকে টাচ করার অনুমতি শুধু আমি আমার বউকেই দিই,
আর এখন আপনি আমার পা ধরে নাটক করছেন—
মানে কি? আপনার চরিত্র নিয়ে তো আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম!”
একটু থেমে চোখ গোল করে আবার বলে,
এই আপনি আবার আমার প্রেমে টেমে পরে যাননি তো?
ইসস এই হ্যান্ডসাম হয়েও যে কি বিপদে আছি, সবাই এসে আমার বউ এর হোক এ নজর দিচ্ছে।
“ওহ! আমি তো এখনো বিয়েই করিনি…
তবে ভেবে দেখি, এক অর্থে সেটাই বোধহয় আমার ভাগ্য!
ভাবুন তো, যদি আমার বউ থাকতো—
আর সে যদি আপনাকে আমাকে এভাবে স্পর্শ করতে দেখত!
তখন তো ও ভাবতো, আমার বর নিশ্চয়ই এই ভদ্রলোকের সাথে পরকীয়া করছে!
আর পরিণতি?
বউটা রেগে গিয়ে ঠাস করে একটা ডিভোর্সের কাগজ আমার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে চলে যেত।
তারপর আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, নিঃস্ব, নিঃসহায়!এতিমের মত।
আচ্ছা বলুন তো, তখন কি আপনি আমার বউয়ের দায়িত্ব নিতেন, হ্যাঁ?
সকালে গরম চা, দুপুরে ভুনা খিচুড়ি আর রাতে আমার ঘুম আসা পর্যন্ত গল্প—
সব করতেন তো?
হঠাৎ করে কবি সাহেব বলে ওঠে,
না না… রিক্স নেওয়া যাবে না—
আপনাকে নিয়ে প্রবলেম হতেই পারে!
তাই এক কাজ করি,
আপনাকেই টপকে দেই!
মানে, আপনি থাকবেন না—
তাহলেই না আমার সংসারটা বেঁচে যাবে!
না আপনি থাকবেন, না আমার ঘর ভাঙার সম্ভাবনা থাকবে!
আমি বউয়ের ক্ষেত্রে কোন রিক্স নিতে পারবো না।
তাই… টপকেই দিই!
ঘরও থাকবে, শান্তিও থাকবে, আপনি না থাকলেই মঙ্গল!
ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা। যেন বাতাসও থেমে গেছে কবি সাহেবের চোখের দৃষ্টিতে। সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে কারণ তারা জানে এখন কি হতে চলেছে,এমন সিরিয়াস মুহূর্তেও কবি সাহেবের এমন কথা শুনে, কেউ কেউ নিজেদের হাসি আটকে রাখতে পারছে না।
রফিক সাহেব আহাজারি করে বলছি স্যার ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন।
কবি সাহেব ধীরে ধীরে নিচু হয়ে রফিক সাহেবের মুখের সামনে এসে বললেন, একদম থমথমে গলায়—
ভুল? ভুল মানুষ হঠাৎ করে করে না, রফিক সাহেব। এই ভুলটা ধীরে ধীরে গড়ে তোলে… বিশ্বাস ভাঙার মতন ভুল একদিনে হয় না। আপনি সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন… তাই তো?
রফিক কাপাকাপা গলায় বলল,
“Sir, আমি… আমি ভুল….
রফিক সাহেব হাউমাউ করে উঠে দাঁড়ায়,ভয়ে রীতিমতো তার হাত-পা কাঁপছে, সে বুঝতে পারছে তার মৃত্যুরসময় ধ্বনি এসেছে।ভয়ে প্যান্ট খারাপ করে ফেলেছে,
কবি সাহেব হঠাৎ হেসে উঠলেন—
একটা ঠান্ডা, গা শিউরে ওঠা হাসি।
“ভয়…!” — একপা পিছিয়ে গিয়ে বললো —
আপনার ভয় পাওয়ার সময় এখনো আসেনি, মিস্টার রফিক।
কবি সাহেব হাতের কলমটা বের করলেন। একটা কালো, ধাতব পেন। খুব সাধারণ মনে হলেও তার ওজন যেন অন্যরকম ভার বহন করে। ঘুরে ঘুরে রফিক সাহেবের পাশ দিয়ে হাঁটছেন সে, যেনো শিকারি একটা দুর্বল হরিণকে চারদিক থেকে পরখ করছে।
তারপর আচমকা থেমে গেলেন রফিকের পাশে দাঁড়িয়ে।
চোখে দগদগে আগুন। মুখে ঠাণ্ডা হাসি।
আপনি জানেন, বিশ্বাসঘাতকদের জন্য আমার একটা উপহার থাকে। সাইনচিহ্ন রেখে দিই আমি, যেনো মনে থাকে কার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চেয়ে ছিলো।
এই বলেই কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে—
কলমটা ধীরে ধীরে ঠেসে দিলো রফিক সাহেবের বুকে। ঠিক বাম পাশে।
রফিক চিৎকার করতে চাইল—কিন্তু পারল না। ঘরটা গমগম করে উঠল। ঘুমন্ত দানব যেন এক মুহূর্তে জেগে উঠল।
রফিক দুলে পড়ে গেল মেঝেতে। কেউ দৌড়ে এগিয়ে এল না।
কবি সাহেব—
চোখ মুছলো রুমালের কোণে। হেঁটে গেলো সামনে রাখা চেয়ারে। বসে গম্ভীর গলায় বললেন—
আসুন, এখন মিটিং শুরু করা যাক। সময় বাঁচান। কেউ যদি বেরিয়ে যেতে চায়, এখনই সুযোগ।
ঘরে কেবল নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। সবাই ভয়ে কাঁপছে,কারো মুখে কোন রা নেই। সবাই তাড়াহুড়ো করে যে যার জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে।জানের মায়া সবারই আছে।
ঘরটা তখনো স্তব্ধ। রফিক সাহেবের নিথর দেহকে দুইজন টানতে টানতে বের করে নিচ্ছে, আর চারপাশে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে।
কবি সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। একবার হাত দিয়ে কোটের ভাঁজটা ঠিক করে বললেন—
কি হলো? মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললেন নাকি আপনারা? —বিশ্বাস ভাঙলে গায়েও আঁচ পড়ে!
সবাই নিঃশব্দে তাকিয়ে।
হঠাৎ কবি সাহেব একটু ঝুঁকে বলে—
চিন্তা করবেন না, আজকের কোটাটা কালো… রংটা ধরবে না।
তার ঠোঁটে একপাশে টেনে তোলা এক ঠাণ্ডা হাসি।
তারপর গম্ভীরভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন—
লাবিব, শুরু করো। বেশি সময় নেই।রাত বাড়ছে।
লাবিব সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে প্রজেক্টরের সুইচ অন করলো, এবং মিটিং শুরু হয়ে গেল।
দুঘণ্টা পর—
মিটিং শেষ।
কবি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন চুলে হাত বুলিয়ে, পকেটে হাত দিয়ে এগোচ্ছেন দরজার দিকে।
ঠিক তখন পেছন থেকে একজন সাহস করে বলে উঠল,
“Mr. Sikdar আশা করেছেন এই প্রজেক্টে এ আমাদের প্রফিট ভালোই হবে।
কবি সাহেব থামলেন। কিন্তু পেছনে ঘুরলেন না।
তিনি সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন—
সেটা আপনাদের কাজের উপর ডিপেন্ড করছে।প্রফিট ভালো হলে তো ভালো,
আর যদি ব্যর্থ হন—
তাহলে শুধু প্রফিট না, প্রস্থানের পথটাও নিজেরাই তৈরি করে রাখবেন…
তারপর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই হন হনিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।
তার পেছনে কেবল একটা শব্দ বাজছিল সবার মনে—
এই লোকটা মানুষ তো? নাকি গিরগিটি মিনিটে মিনিটে রং পাল্টাই। চোখের পলকে একটা মানুষকে খু’ন করে ফেললো, আবার সেই ঘরেই বসে মিটিং ও করল।
একটা নতুন দিনের সূচনা রোদের কোমল আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকছে, কাঁচে লেগে যেন সোনা ঝরছে। বাতাসে ছিল কফির মিষ্টি ঘ্রাণ আর বিদায়ের এক হালকা দমক।
তিন দিনের ট্যুর শেষে আজ সবাই বাড়ি ফিরছে। একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো যেন চোখের পাতায় আটকে আছে, কিন্তু ব্যাগগুলো গুছিয়ে নেবার সময় এসে গেছে।
ঘরজুড়ে হালকা গুঞ্জন—কে কোথায় কী রেখে এসেছে, কে কোনটা ভুলে যাবে না তা নিয়ে শেষ মুহূর্তের হাঁকডাক। কেউ চুপচাপ বসে, হাতের মুঠোয় ধরে আছে শেষ স্মৃতি। কেউ আবার ব্যস্ত হইচইয়ে, যেন মনটা বিদায়ের ভার বুঝতে চায় না।
নাস্তা টেবিলে চায়ের কাপ, আর হাসির রেশ এখনো বাতাসে ভাসছে। কারো ব্যাগে গুঁজে রাখা আছে শ্যাম্পু, কারো টুথব্রাশ পড়ে আছে বাথরুমে—তবু তাড়াহুড়ি চলছে, যেন সময় আর চায় না অপেক্ষা করতে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সবাই বিদায় জানাচ্ছে।
হাসিমুখে কেউ বলছে—”আবার আসবো!”
আর কারো মুখে নিঃশব্দে জমে থাকা আবেগ—এই কয়েকটা দিনে গড়ে ওঠা এক অদ্ভুত বন্ধন যেন।
সকাল ১০টার এই বিদায়ের ক্ষণটা হয়ে থাকলো এক টুকরো মিষ্টি স্মৃতি, যা ঠিক করে দেওয়া যায় না—শুধু অনুভব করা যায়।
বাসটা ঠিক ১০.২০ এ ছেড়ে দিয়েছে। জানালার পাশে বসে আছে চুমকি, মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে পেছনে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো—যেখানে একটু আগেও ছিল হাসি, খুনসুটি আর হৃদয়ের আলতো স্পর্শ।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে রাহি আর মেহরিন তো আসে, কাল এত বড় একটা কান্ড হওয়ার পরেও চুপ থাকার মেয়ে ওরা না!
চুমকির দুই পাশে বসে তারা শুরু করেছে খোঁচাখুঁচি।
— চুমকি আপু… সেই যে ‘ভালোবাসি’ বলার সময় তোর মুখটা দেখে আমার তো মনে হচ্ছিল তুই মাটিতে গলে পরবি!— রাহি ফিসফিস করে বলে উঠে।
— আরে না না, রাহি, চুমকি তখন মনে মনে ঠিক এই গানটা গাইতেছিল—
কাব মাম্মি ড্যাডি মেরি তু পাটায়েগা
লেকে ব্যান্ড-বাজা মেরে ঘার এয়েগা
কাব তাক মুজে এছেহি মুজে ঘুমায়েগা
তু বাত বারহা তো সাহি……
মেহরিন আরেক ধাপ বাড়ায়, মুখে নকল প্রেমিকের অভিব্যক্তি এনে।
চুমকি হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলে— তোরা থামবি?
কিন্তু গালটা লাল হয়ে গেছে, চোখের কোণে এক টুকরো হাসিও লুকাতে পারেনি।
— এই চুমকি আপু, বল না… কবে বিয়ে করছিস, প্লিজ! আমরাই গায়ে হলুদের গান ঠিক করবো! — রাহি হাসতে হাসতে বলে, আর মেহরিন বলে — না আগে বল, পাঞ্জাবিটা কেমন লাগছিল তোমার শান্টু?
চুমকি মুখে রাগের ভাব আনলেও, সেই লজ্জায় লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার দীপ্তিটুকু ওদের চোখ এড়ায় না।
বাসের জানালা দিয়ে হাওয়ার সাথে উড়ছিল চুমকির ওড়না, আর পেছনের সিট থেকে ভেসে আসছিল খিলখিল হাসির আওয়াজ—এই সফরটা সত্যিই স্মরণীয় হয়ে থাকবেই।
বাস থেমেছে ভার্সিটির মূল ফটকের সামনের মাঠে। নামার পরেই যেন আবার একটা ছোটখাটো উৎসব শুরু হয়ে গেল। কারও ব্যাগ উল্টে পড়ছে, কেউ পানি খুঁজছে, কেউ আবার হাসতে হাসতে আগের রাতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
চুমকি মেহরিনার রাহি তিনজন একসাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।ওরা মূলত দাড়িয়ে আছে রাহির জন্য। রাহি চলে গেলে ওরাও চলে যাবে।
রিদ স্যার ম্যামদের সাথে কথা বলছে।তাই রাহি এখনো যেতে পারছে না।
হঠাৎ করেই,
শান্ত একদম সামনে এসে চুপচাপ চুমকির হাতটা ধরল। চোখে অদ্ভুত এক স্থিরতা, কণ্ঠে নরম অথচ দৃঢ় স্বর—
—আমি চুমকিকে ওর বাসাতেই নামিয়ে দেব। তোরা সবাই বাড়ি যা।
চারপাশটা হঠাৎ একটু স্তব্ধ। রাহি অবাক চোখে চেয়ে থেকে হেসে ফেলল,
— উফফ! কী রোমান্টিক!
ঠিক তখনই রাকিব ফোনে কিছু বলে বিদায় জানিয়ে চলে গেল—
— “মা ফোন করেছিল, আমাকে এখনই ফিরতে হবে। তোমরা ঠিকঠাক পৌঁছেও।
রাহি এবার হাততালি দিয়ে বলল,
— তাহলে মেহু আপু, তুই এখন আমার পার্টনার ইন ক্রাইম! চল, আমরা একসাথে যাই।
মেহরিন একটু হাসল, চোখ গেল শান্তর হাতে ধরা চুমকির হাতে। কিছু একটা যেনো বুকের ভেতর ফড়ফড় করে উঠল, মনে পড়ে গেল কাল রাতে কথা। সে তা লুকিয়ে বলল,
— চল শেষ যাত্রাটাও দুষ্টুমি দিয়ে রঙিন করি!”
চুমকি শান্তর দিকে চেয়ে মাথা নিচু করল। আর শান্ত ওর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলল—
— চলো, আজ থেকে তোর গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া আমার দায়িত্ব…
রিদ স্যার ম্যামদের সাথে কথা বলা শেষ করে বের হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে তখন অনেকটাই নির্জন, শুধু হালকা হাওয়াটা গাছের পাতায় পাতায় শব্দ তুলে যাচ্ছে। সে দেখল মেহরিন আর রাহি সামনের দিকে দাঁড়িয়ে, হাসিমুখে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। তবে আশেপাশে কোথাও রাকিব, শান্ত বা চুমকির দেখা নেই।
রিদ একটু ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এল ওদের দিকে, কিন্তু মেহরিনের হালকা হাসি আর রাহির চঞ্চল ভঙ্গিমা দেখে কিছু বলল না। হঠাৎ যেনো তার মনে পড়ে গেল কিছু, মুখে একরকম নরম ভাব ফুটে উঠল।
তারপর সে নরম গলায় বলল,
রাকিব, শান্ত আর চুমকি…?
রাহি পেছনে তাকিয়ে বলল,
ওরা তো অনেক আগেই চলে গেছে দাদাভাই, শান্ত ভাইয়া তো চুমকি আপুকে নামিয়ে দেবে। রাকিব ভাইয়া বাসা থেকে কল করেছিল তাই সেও চলে গেছে।
রিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর এক দৃষ্টিতে মেহরিনের দিকে তাকাল, যেনো অনেক কিছু বুঝে ফেলার চেষ্টা করছে।
মেহরিন একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল, চোখ নামিয়ে ফেলল।
রাহি একটু মিষ্টি মুখ করে বলল,
— দাদাভাই, চলো না, আমার তো পায়ে ব্যথা হয়ে গেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে!”
তার কথায় রিদ হালকা হাসল, মাথা নেড়ে বলল,
— চলো।
ওরা গাড়িতে উঠল। রিদ ড্রাইভ করছে, রাহি আর মেহরিন পিছনের সিটে। রাহি শুরু করল তার চিরচেনা বকবক—
চুমকি-শান্ত, রাকিবের হুটোপুটি, আর মেহরিনের নাকি সবার প্রিয় হয়ে ওঠার রহস্য।
মেহরিন হেসে হেসে শুনছে, মাঝে মাঝে চোখ বড় করে তাকাচ্ছে রাহির দিকে — যেনো বলছে, আর কিছু বলেই দেখ শুধু!
এই ফাঁকে রিদ মাঝেমধ্যে ভিউ মিররে তাকাচ্ছে… আর তার দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে মেহরিনের চুপচাপ, নরম হাসিমাখা মুখে।
রাহি হঠাৎ থেমে গিয়ে খুশি গলায় বলে উঠল,
— আরে আরে! দাদাভাই, এই যে আপনি বারবার পিছনে তাকাচ্ছেন… কী ব্যাপার? কেউকে কি আজ খুব সুন্দর লাগছে নাকি?
রিদ হঠাৎ করে চোখ সরিয়ে নিল, আর মেহরিন তো লাল হয়ে মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল।
রাহি খিলখিল করে হাসতে লাগল —
— “উফফফ লজ্জা তো দুইজনেরই কম না! আমি বুঝি না, আমি নাকি ছোট!
মেহরিন ফিসফিস করে রাহিকে ঠেলে বলল,
— চুপ কর বুইন, আর কিছু বলিস না…
তার চোখ রিদ এর দিকে, কারণ বুঝেই নিচ্ছে সে কিছু একটা বলবে।
রিদ আস্তে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
— রাহি, behave yourself. তুমি আজকাল খুব বেশি কথা বলছো।
রাহি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
— “Okay okay, কিছুই বলবো না আর।
তারপর দুই সেকেন্ড চুপ থেকে মুখ টিপে হেসে বলে,
— সুধু একটা ছন্দ বলবো… সান্ধ্য উপহার!
তারপর সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল—
গাড়ির চাকা ঘুরছে ধীরে,দাদাভাই তাকায় প্রেমের নীড়ে।
মেহু আপু লাজে মুখ ঢাকে, রাহির কথা?লজ্জাই আগুন জ্বলে পাকে!
গাড়ির ভেতর হঠাৎ এক মুহূর্তের নীরবতা… তারপর রিদ কেশে উঠে, তার পর হালকা হাসি চেপে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে,
আর মেহরিন লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে,
— রাহি!! থামবি?
রাহি হেসে বলে —
— আমি তো কিছুই বলি নাই, সুধু ছন্দ পড়ছিলাম!
গাড়ি মেহরিনদের বাসার সামনে থামে।মেহরিন দরজা খুলে নামতে যাবে, এমন সময় রাহি তার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে হালকা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে—
—তুই যদি আমার ভাবি হোস, খারাপ হতো না, বুঝলি?
ওই কথাটা শুনে মেহরিন থমকে যায়। চোখ বড় বড় হয়ে তাকায় রাহির দিকে, তারপর এক লাফে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। মুখ লাল হয়ে গেছে লজ্জায়। পেছন ফিরে না তাকিয়েই গেটের দিকে হাঁটতে থাকে। যাওয়ার সময় একবার চোখ রাগিয়ে দেয় রাহির দিকে।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৫
রাহি হেসেই লুটোপুটি খায় আর বলেই ওঠে— —এই মেয়েটা, এমন লজ্জা পায় ক্যান রে!
রিদ তখন সবটাই শুনলেও ভান করে যেন কিছুই শোনেনি, চোখ নামিয়ে ড্যাশবোর্ডে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে যে এক চিলতে হাসি— সেটা আর লুকানো যায় না।