আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে সারপ্রাইজ পর্ব ২
লেখনীতে সালমা চৌধুরী
বিকেলের শেষভাগ। একটা বাগানবিলাস গাছের নিচে আবির- মেঘ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে নিরবতা বিরাজমান। আবিরের শক্তপোক্ত হাতে মেঘের ছোট্ট, কোমল হাতটা বন্দী হয়ে আছে। কোনোমতেই ছাড়াতে পারছে না। মেঘের ফর্সা আদল ধীরেধীরে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। অকস্মাৎ মুখ ফুলিয়ে চোয়াল শক্ত করল। মেঘের গভীর দৃষ্টি আবিরের চোখে নিবদ্ধ। আবিরের হাতে থাকা হাতটাকে ছাড়ানোর সব চেষ্টা বৃথা গেল। আবির দু কদম পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। ঠোঁট বেঁকিয়ে মৃদু হেসে পরপর দু’বার ভ্রু নাচাল। মেঘ আলগোছে ভেঙচি কেটে কটমট করল,
” ছাড়ুন, বাসায় যাব।”
আবির গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল,
” বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মনে ছিল না? এখন বাসায় যাওয়ার কোনো দরকার নেই৷ আজ সারারাত এখানেই থাকবে।”
মেঘ নিজের ভুল বুঝতে পেরে চাপা স্বরে বলল,
” আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি নামবে।”
” নামুক, বৃষ্টিতে ভিজবো দু’জন। সমস্যা আছে কোনো?”
“আব্বু বকা দিবেন। একদিন ভিজে গিয়েছিলাম তারপর কি হয়েছিল মনে নেই?”
“তখন তুমি আমার প্রেমিকা ছিলে আর এখন বউ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আবিরের মুখে কথাটা শুনামাত্র মেঘের বুকের বাঁ পাশটা কেঁপে ওঠল৷ অনুভূতিরা হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে। আবিরের মুখে প্রেমিকা শব্দটা খুব কমই শুনেছে মেঘ। বরাবরই তীব্র অধিকার নিয়ে আবির “বউ” বলেই ডেকে এসেছে। বিয়ের পর সেই ডাকের তীব্রতা বেড়েছে হাজার গুণ। সর্বক্ষণ সবার সামনে মুখে , “আমার বউ” লেগেই থাকে। এখন খান বাড়ির প্রতিটা ইট-পাথরেরও নখদর্পনে “মেঘ আবিরের বউ”। যেন “আমার বউ” না বললে আবিরের মস্ত বড়ো পাপ হবে। আবিরের মুখে আমার বউ, আমার বউ শুনতে শুনতে ইদানীং মেঘ নিজের নামই গুলিয়ে ফেলে। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে মুখ ফস্কে বলে দেয়,
” আবিরের বউ।”
সেদিন ভার্সিটিতেও এমন এক কাণ্ড করে বসে। বৃষ্টির দিন ছিল। ভার্সিটিতে যাওয়ার পথে বৃষ্টি কমেছিল। ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছি যেতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দিশাবিশা না পেয়ে এক দৌড় দিয়েছে। ব্যালকনিতে গিয়ে থামতেই অন্য ডিপার্টমেন্টের এক স্যারের সাথে ধাক্কা। হুড়মুড়িয়ে “সরি স্যার” বলতে বলতে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয় নি৷ স্যার মুখের উপর ধমক দিয়ে বলেন,
” এই মেয়ে, স্যার-ম্যাডাম দেখো না? নাম কি তোমার? কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো?”
মেঘ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে জবাব দিল,
” আবিরের বউ।”
তৎক্ষনাৎ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতেজ হলো। দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল। স্যার গম্ভীর কণ্ঠে আওড়ালেন,
” কি নাম বললে?”
মুখ থেকে হাত সরিয়ে মেঘ আমতা আমতা করে বলল,
” স্যার, মাহদিবা খান মেঘ। উদ্ভিদবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্ট।”
স্যারের চেহারার গম্ভীর ভাব তখনও বহমান। কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলেন তখনই কেউ একজন স্যারকে ডাকলেন। মেঘ সে যাত্রায় খুব করে বেঁচেছে।
মেঘ মনে মনে বিড়বিড় করল,
” আবির ভাইয়ের প্রেমিকা। ইস, শুনতেই কত ভালো লাগছে।”
মেঘের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি দেখে আবির তপ্ত স্বরে বলল,
“শুনো, তোমার উপর আমার অধিকার এখন সবচেয়ে বেশি। এক বাড়িতে থাকি বলে এটা ভেবো না আমি আমার শ্বশুরের কথায় উঠব আর বসব।”
আবিরের কথায় মেঘের ভাবনায় ছেদ পড়ল। ভ্রু উঁচিয়ে মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করল,
” কথাটা কি আপনার শ্বশুরআব্বাকে জানাবো?”
“তোমার-আমার মাঝে শ্বশুরআব্বাকে টানার কি দরকার। ওনারা মুরুব্বি মানুষ, থাকুক না ওনাদের মতো।”
“ও তাই?”
আবির মৃদু হেসে বলল,
“জি, ম্যাডাম।”
মেঘ আশেপাশে নজর বুলিয়ে আস্তে করে বলল,
” স্যার, অনুগ্রহ করে এখন চলুন৷ না হয় সত্যি সত্যি ভিজতে হবে।”
আবির আর কথা বাড়াল না। আবহাওয়া সত্যি খারাপ। যেকোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। আবির মেঘের হাত ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল৷ মেঘ গুটিগুটি পারে হাঁটছে আর অতীতের স্মৃতিগুলো ভাবছে।
একটা সময় ছিল আবিরের সঙ্গে বাইরে বের হওয়ার জন্য, ঘুরার জন্য, একটু গল্প করার জন্য কতই না ছটফট করত। বৃষ্টিতে ভিজতে কত বায়না করত। সে সবই এখন অতীত। এখন মানুষটাকে দেখার জন্য এত ছটফট করতে হয় না৷ ঘুম ভাঙলে সবার প্রথমেই এই মানুষটার মায়াবী মুখটা নজরে পরে।
আগে আবিরের সাথে দুই মিনিট কথা বলতে গেলে হার্টবিট কয়েকগুণ বেড়ে যেতো। সেই মেঘ এখন আবিরের বুকে মাথা রেখে আবিরের হার্টবিট গুনে। ভাবা যায়!
“ভালোবাসা কতই না অদ্ভুত। অপূর্ণতায় অশান্তি মিলে আর পূর্ণতায় প্রশান্তি।”
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নজরে পড়ল আবির অনেকটা সামনে চলে গিয়েছে। কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত তারজন্য মেঘকে খেয়াল করে নি। মেঘ এক ছুটে আবিরের পাশে গিয়ে থামল। মেঘের উপস্থিতি টের পেয়ে আবির যেই ঘাড় ঘুরাবে ওমনি মেঘ দুহাতে আবিরের বাহু চেপে ধরল। আবির রাকিবের সাথে কথা বলছিল৷ আড়চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। রাকিবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ফোন রাখ, এখন বউকে সময় দিতে হবে।”
ওপাশ থেকে রাকিব বলল,
” বিগত ৩ ঘন্টা ৫৭ মিনিট যাবৎ সে কাজটাই করছিস, ভাই। বিয়ের তো অনেকদিন হলো। বউয়ের প্রতি ভালোবাসাটা এবার একটু কমা।”
” তোর কি সমস্যা? ”
“আমার হিংসে হয়। এত প্রেম সহ্য হয় না।”
” কেনো?”
“আমার বউটা সারাদিনে আমাকে একবার কলও দেয় না। আমি যখনই কল দেয় তখনই বলে এখন খাচ্ছি, এখন ঘুমাচ্ছি, এখন সাজতেছি, এখন কাজ করছি। ভুলেও একবার বলে না আমি রাগ করে আছি, অভিমান করেছি, আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাও, সময় দাও। উল্টো আমি ঘুরতে যাওয়ার কথা বললে বলে,
‘বিয়ে হয়ে গেছে এখন আবার কিসের ঘুরাঘুরি। কাজ নেই তোমার? অফিসের কাজ ফেলে আমাকে ডিস্টার্ব করলে আমি আবির ভাইয়াকে কল দিয়ে বলব তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিতে। এই পাগলকে কে বুঝাবে, সে যাকে দায়িত্বশীল বস ভাবছে সে বস ছুঁতো পেলেই বউয়ের কাছে ছুটে। তার কাছে মিটিং এর থেকেও বউ বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।”
আবির তেজঃপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
” তোর বকবক রাতে শুনবো৷ এখন রাখছি।”
রাকিব মনমরা ভঙ্গিতে বলল,
” কেউ আমাকে বুঝলো না।”
আবির মুচকি হেসে কল কেটে দিল। মেঘের মনোযোগ তখনও আবিরের হাতের দিকে৷ খুব শক্ত করে হাতটা ধরেছে। যতটা শক্ত করে আবির একটু আগে ধরেছিল। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” কি ভাবছো?”
” চা খাবেন?”
” এই না বললে বৃষ্টি আসবে, বাসায় যেতে হবে।”
” আসুক বৃষ্টি৷ অনেকদিন হলো আপনার সাথে চা খাওয়া হয় না। একসাথে সন্ধ্যার আকাশ দেখা হয় না।”
আবির কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
” তোমাকে কতবার বলেছি, চলো আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকি। নিজের মতো করে সময় দিতে পারব। প্রতিদিন ভোরের আকাশ দেখব, চায়ের কাপের সাথে গোধূলির সময় কাটাবো। মাঝরাতে নির্জন রাস্তায় দুজন হাতে হাত রেখে হাঁটব।”
“তারপর কুকুরে দৌড়ানি দিলে এলোপাতাড়ি ছুটব। ছুটতে ছুটতে ধপাস করে পুকুরে পড়ব। ”
আবির রাগে চোখ গোল করে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তোর মাথায় কি ভালো কিছু আসে না? যতসব ফালতু চিন্তাভাবনা।”
” না মানে, মাঝরাতে কুকুর ছাড়া আর কেউ তো রাস্তায় থাকে না। অবশ্য পাগলও ধরতে পারে।”
“তোকে দেখলে পাগলও ভয় পাবে। দূর থেকে সালাম দিয়ে পালাবে।”
মেঘ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
” বলেছে আপনাকে!”
আবির শান্ত কণ্ঠে বলল,
” তুমি তো আমার কোনো কথায় মানো না। একদিনের জন্যও ঐ বাসায় যেতে চাও না৷ তোমার জন্য এত কষ্ট করে বাড়ি করলাম কেনো ?”
” এভাবে বাসা থেকে চলে গেলে আব্বু-আম্মু কি ভাববে? বড়ো আব্বু, বড়ো আম্মু ওনারাও তো কষ্ট পাবেন। ভাববেন ছেলে পর হয়ে গেছে। বউ নিয়ে আলাদা থাকতে চাই৷”
” এটাকে আলাদা থাকা বলে না। ঘুরতে যাওয়া বলে। একপ্রকার হানিমুনও বলতে পারো।”
” হানিমুন মানুষ কতবার করে? কাউকে না বলে কক্সবাজার গিয়েছিলাম বলে আমার বন্ধুরা এখনও আমাকে খোঁচায়। ফাজলামো করে। আমি আর হানিমুনে যাব না।”
” কে খোঁচায় নামটা বলো শুধু। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি! মিনহাজ, তামিম নাকি অন্য কেউ?”
“বন্যা।”
আবির হুঙ্কার দিতে গিয়েও থেমে গেল। বন্যা নাম শুনে নিশ্চুপ হয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ধীর গলায় বলল,
” ওহ আচ্ছা। তাই না? শুনবে তবে!”
“কি?”
” তুমি, পরিবার, ব্যবসা, তানভীরের বিয়ে সবকিছুর কথা ভেবে আমি দ্রুত ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম। তোমার ভাই মানে তানভীর অলরেডি আমার থেকে দুইমাসের ছুটি নিয়ে রেখেছে৷ দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করতেছে। কমপক্ষে একমাস কারো সাথে যোগাযোগই রাখবে না।”
“সত্যি?”
” হ্যাঁ, তোমার বান্ধবী ফিরলে তারপর তুমিও বলতে পারবে।”
মেঘ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তে আস্তে বলল,
” আমাদের হানিমুনের সময়টা কম হয়ে গেল না?”
” হুমমম। সেজন্য ভাবছি সামনের মাসে একটা ট্যুর দিব। কোম্পানির কিছু কাজ আছে, সাথে তোমাকেও নিয়ে যাব। তানভীরের আগে দেশের বাইরের হানিমুনটা আমরাই করে আসবো, ইনশাআল্লাহ। ”
“কোথায়?”
“এখন কিছু বলব না। আগে তোমার পাসপোর্ট করতে হবে।”
” ভাইয়া জানে?”
“না। কেউ কিছুই জানে না৷ তুমিও আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলবে না। তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড বন্যাকেও না। মনে থাকবে?”
“জি। ”
আবির আর কিছু বলে নি৷ চুপ করে হাঁটছে। মেঘ চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশের মানুষদের দেখছে। ব্যস্ত শহরের সকল ব্যস্ততার মাঝেও মেঘের নজর শুধু কাপলদের দিকে৷ কেউ কেউ শাড়ি পড়েছে, চুলে ফুল দিয়ে বয়ফ্রেন্ড কিংবা হাসব্যান্ডের হাতে হাত রেখে রাখছে। কত স্নিগ্ধ সে দৃশ্য! মেঘ নিজের দিকে এক নজর তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। মনে মনে বিড়বিড় করল,
” আজকের পর রাগ করলেও শাড়ি পড়ে বের হতে হবে। চুলে ফুল দিয়ে সেজেগুজে ঘুরতে হবে। তবেই না মানুষ আমাদের দিকে তাকাবে। না হয় আবির ভাইয়ের পাশে আমাকে বড্ড বেমানান লাগবে।”
আবির-মেঘ চা খেতে খেতে গল্প করছিল। মেঘ অন্যমনস্ক চোখে দূরে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহুর্ত পর হঠাৎ ডাকল,
” আবির ভাই……”
“জি আপু……”
আপু শব্দটা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র চোখ বড় করে তাকাল। শক্ত কণ্ঠে বলল,
” আপু বললেন কাকে?”
“তোমাকে।”
” আমি আপনার আপু হই?”
আবির উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল,
” আমি তোমার ভাই হই?”
মেঘ দাঁত দিয়ে জিভ কেটে আওড়াল,
” ভাই বলে ফেলেছি নাকি! সরি সরি।”
“হ্যাঁ, প্রতিবার ভাই বলবে আর সরি বলবে। তাই না? কিন্তু তা আর হচ্ছে না। এখন থেকে তুমি ভাই বললে আমিও আপু বলবো। এখন দেখব দিনে কতবার ভাই ডাকো।”
মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
” আমি আবির ভাই বলে অভ্যস্ত কিন্তু আপনি তো আপু বলে অভ্যস্ত না।”
” অভ্যাস করব। তোমাকে হাজার বার বলেছি আবির ডাকো। কিন্তু না! সে তুমি পারবে না। ঠিক আছে, আমিই আপু বলছি৷ মেঘ আপু, আপনি কি আরেক কাপ চা নিবেন?”
“ছিঃ কি বলছেন এসব! প্লিজ, আমাকে আপু ডাকবেন না।”
” মানতে পারি তবে একটা শর্তে।”
” কি?”
” আবির বলো।”
“আবার…”
“এখন থেকে প্রতিবার।”
” আমি পারব না।”
আবির ধমকের স্বরে বলল,
” বলো।”
মেঘ ঠোঁট উল্টিয়ে কোনোমতে ‘আবির’ বলেই দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল। মেঘের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠেছে। লজ্জায় ভেতরটা হাস ফাঁস করছে। আবির মেঘকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে উদগ্রীব হয়ে বলল,
“ম্যাম, এখনও এত লজ্জা পেলে হবে! সংসার করতে হবে না? আমাকে আহিয়ার আব্বু হতে হবে না?”
লজ্জায় মেঘের চিবুক আরও নেমে গেছে৷ ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় কম্পন অনুভব হচ্ছে। মেঘ মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। অকস্মাৎ তানভীরের কল আসায় মেঘের দিক থেকে আবিরের দৃষ্টি খানিক সরলো। এতেই মেয়েটা স্বস্তি ফিরে পেল। আবির জিজ্ঞেস করল,
” কিরে কোথায় আছিস?”
“আছি তোমাদের আশেপাশেই।”
“আশেপাশে থাকার কি দরকার! খুব বেশি সমস্যা না হলে চল একসাথে বসি। চা খাই, গল্প করি৷ এখন তো অবৈধ সম্পর্ক না৷ বৈধ সম্পর্কে আছিস।”
“তোমরা বসো। আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।”
“ঠিক আছে।”
মেঘ লজ্জায় সেই যে চোখ সরিয়েছে আর তাকানোর নামই নিচ্ছে না৷ আবির কয়েকবার ডেকেছে কিন্তু সাড়াশব্দ নেই। আবির কিছু সময় নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল। আবিরের কণ্ঠস্বর শান্ত। কোমল গলায় বলতে শুরু করল,
“প্রিয় কাদম্বিনী,
আমার প্রণয়কাব্যের না লেখা এক কবিতার শেষ…”
মেঘ তৎক্ষনাৎ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“প্লিজ আমাকে কাদম্বিনী ডাকবেন না।”
আবির থামল৷ সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কেনো?”
মেঘের কণ্ঠস্বর নিরেট৷ গম্ভীর গলায় বলতে লাগল,
“আপনার মুখে মেঘ ব্যতীত অন্য কোনো মেয়ের নাম শুনতে চাই না। ডাইরেক্ট কিংবা ইন্ডাইরেক্ট কোনোভাবেই না। আপনি আমার মানে শুধুই আমার৷ আপনার মনের ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত সবটাই আমার দখলে। কথাটা মাথায় রাখবেন।”
আবির হতভম্ব হয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড নীরবে মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা প্রশ্ন করল,
“ বাই এনি চান্স, তুমি কি কারো প্রতি জেলাস?”
“না। আপনি আমাকে কাদম্বিনী বলেছেন যার অর্থ মেঘমালা। মেঘ আমি হলে, মালা কে? নিশ্চয়ই আপনার মামাতো বোন। যাকে আপনি এখনও মিস করেন৷ শয়নেস্বপনে তার কথা ভাবেন। আর সেজন্যই ইন্ডাইরেক্টলি আপনি আমাকে মেঘমালা বলে সম্বোধন করছেন।”
আবির কপালে ভাঁজ ফেলে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছিল। মেঘের কথা শেষ হতেই ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। ডান হাতে নিজের মাথা চেপে বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
“তানভীর! ভাই রে কোথায় তুই?”
মেঘ রাগী স্বরে বলল,
” ভাইয়াকে ডাকছেন কেনো? ভাইয়া কি করেছে?”
এরমধ্যে তানভীর এসেছে। পেছনে বন্যা বসা। বন্যা বাইক থেকে নেমে আবিরকে সালাম দিল। আবির সালামের উত্তর দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তানভীরের দিকে তাকাল। মেঘের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বন্যা নিঃশব্দে হাসল। কিন্তু বিপরীতে মেঘের ঠোঁটে হাসির লেশমাত্র দেখা গেল না৷ বন্যা
চোখের ইশারায় জানতে চাইল,
” কি হয়েছে!”
মেঘ এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে বুঝাল,
” কিছু হয় নি।”
বন্যাকে ইশারা দিতেই বন্যা চুপচাপ মেঘের পাশের চেয়ারে বসল। আস্তে করে জানতে চাইল,
” ভাইয়া কিছু বলেছেন?”
মেঘ ধীর গলায় বলল,
” না।”
আবির তখনও অসহায় দৃষ্টিতে তানভীরকে দেখছে। বিষয়টা তানভীরের নজরে পড়তেই ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল,
কি হলো, ভাইয়া?”
আবির ভাবুক স্বরে বলল,
” ভাই, তুই ঠিকই বলেছিলি।”
তানভীর আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” আমি আবার কবে কি বললাম?”
“আমি যখন দেশের বাইরে ছিলাম। তোকে ফোন দিলে প্রায়ই বলতিস, আমার বোন খুব একটা সুবিধার না। মনে হয় ওর মাথায় কোনো ছিট আছে৷ ও কখন কি বলে, কি করে সে নিজেই জানে না। আমার বোনকে সামলাতে তোমার খুব কষ্ট হবে। তোমার জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছে ভাইয়া। আমি উল্টো তোকে ধমক দিয়ে বলতাম,
আমার বউয়ের ব্যাপারে আজেবাজে কথা বলার সাহস কোথায় পাস। ও যেমন আমি ওঁকে তেমনই ভালোবাসব। ও পাগল হলে আমিও ওর জন্য পাগল হবো। আমার ভালোবাসা দিয়ে সব ঠিক করে ফেলব। আরও কত কিছুই না তোকে বলেছি৷ ভাই প্লিজ, আমাকে মাফ করে দিস। ভাই তুই মহান, ২০ বছর যাবৎ এই মেয়ের পাগলামি সহ্য করতেছিস। তোর মতো ভাই প্রতিটা ঘরে ঘরে দরকার।”
মেঘ চোখ রাঙিয়ে একবার আবিরের দিকে তাকাচ্ছে আবার তানভীরের দিকে৷ তানভীর চোখের ইশারায় আবিরকে চুপ করতে বলছে। কিন্তু আবির কথা বলেই যাচ্ছে। তানভীর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
” কোথায়! কি যা-তা বলছো! বনুর মতো ভালো মেয়ে দুইটা পাবে না৷ তোমার ভাগ্য ভালো আমার বনুর মতো বউ পেয়েছো। নয়তো তুমি যে বদরাগী ভাই, কপালে বউ জুটতো না৷ সারাজীবন অবিবাহিত ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরা লাগতো।”
” তবুও ভালো ছিল। এখন মনে হচ্ছে ১৬ বছর কার জন্য লড়াই করেছি আমি! কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি নি। প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা বলি নি৷ সর্বক্ষণ মনে মস্তিষ্কে শুধু তোর বোন ছিল। ওঁকে বিয়ে করার জন্য কত কি না করলাম। সেই মেয়ে কি না বলে আমি শয়নেস্বপনে মালার কথা ভাবি। মালাকে মিস করি। মালার কথা স্মরণ করে ওঁকে কাদম্বিনী ডাকি। ”
তানভীর প্রশ্ন করল,
” কাদম্বিনীর সাথে মালার কি সম্পর্ক?”
” কাদম্বিনী অর্থ মেঘমালা।”
” ওহ। আমি বাংলায় খুব কাঁচা। তাই অর্থ বুঝে ব্যাখ্যা দিতে পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করো ভাইয়া।”
মেঘ এখনও অগ্নিদৃষ্টিতে তানভীরকে দেখছে। মেঘের হাবভাব দেখে বন্যা মেঘকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সামান্য বিষয় নিয়ে মেঘ আবিরের সাথে রাগারাগি করেছে এটা ভেবেই বন্যার হাসি পাচ্ছে। সকালে কফির বিষয় নিয়ে রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়েছে সে রাগ কমতে না কমতেই আরেক বিষয়। হাসিতে বন্যার পেট ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ্যে হাসতে পারছে না। তানভীর মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” এভাবে কি দেখছিস?”
“তুমি আমার নামে এসব বলেছো ওনাকে?”
“না না, আমি কিছু বলি নি। আমার বোন কত ভালো! আমি কি জানি না? শুধু রাগটা একটু বেশি। আর কোনো সমস্যা নেই। রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না, এইতো।”
মেঘ রাগে কটমট করতে করতে বলল,
” ঘরের শত্রু বিভীষণ।”
বন্যা মেঘকে থামাতে ধীর গলায় বলল,
” কি সব বলছিস! সামান্য বিষয় নিয়ে কেউ এত রাগ করে?”
“তুই ওঁদের চিনিস না৷ আমি ওঁদের হাড়ে হাড়ে চিনি৷ পুরুষ জাত মানেই খারাপ। তাদের মনে এক, বাইরে আরেক৷ দেখাবে খুব ভালো মানুষ। আদোতে কিছুই না।”
আবির আড়চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” আমিও কি তেমন?”
মেঘ ঘনঘন উপরনিচ মাথা নাড়ল। তানভীর আবিরকে সান্ত্বনা দিতে বলল,
” থাক ভাইয়া, মন খারাপ করো না। ছেলে মানুষ ঝামেলা মানে পুরো পৃথিবীর সব পুরুষই খারাপ। তুমি একা ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। যেই তুমি মালাকে মিস করো সে তো আরও বেশি খারাপ।”
ওঁদের কথোপকথন শুনে বন্যা নিঃশব্দে হাসছে। কি এক বিষয় নিয়ে মেঘ, আবির, তানভীর সিরিয়াসভাবে ঝগড়া করছে। হাসিও পাচ্ছে আবার লজ্জাও লাগছে। আশেপাশের মানুষজন কেমন করে তাকিয়ে আছে। তানভীর বন্যার দিকে এক নজর দেখল। মেঘকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করে বলল,
” ভাগ্যিস! আমার বউটা ম্যাচিউর। এ দিক থেকে আমি নিশ্চিন্ত। ”
আবির আড়চোখে মেঘকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। মেঘ যে রাগে আগুন হচ্ছে সেটা বুঝার বাকি নেই। মেঘ চোখ লাল করে
তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে। তানভীর মেঘকে ভেঙাচ্ছে। এতে মেঘের রাগ আরও বাড়ছে। বন্যা দু’হাতে মুখ চেপে হেসেই যাচ্ছে। কয়েক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে মেঘের গর্জনের মতো হঠাৎ বলে ওঠল,
” ছিঃ ভাইয়া৷ তুমি এখনও তোমার এক্সকে মিস করো?”
তানভীর চমকে ওঠল। সেই সাথে বন্যাও। তানভীর বলল,
” মানে?”
” সরি ভাইয়া, অতীত ভুলতে না পারলে তোমার কাছে আমার বান্ধবীকে দিতে পারছি না। আমি আগেই বলেছিলাম পুরুষ জাতই খারাপ। দেখলি বন্যা, সেই দলে আমার ভাইও আছে।”
বন্যার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেছে। মেঘের কথা ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। তানভীর, আবির দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে৷ তানভীর প্রশ্ন করল,
” আমি কি করলাম?”
” তুমি করো নি তোমার অতীত করেছে। কি যেন নাম! আয়েশা না?”
বন্যার মুখ ভার হয়ে আছে। হাসির ছিটেফোঁটাও নেই মুখে। তানভীর বক্রদৃষ্টিতে বন্যাকে একবার দেখল। মেয়েটা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।তানভীর ভ্রু কুঁচকে বলল,
” অতীত থাকাটা কি দোষের? হঠাৎ সেই নাম কেনো উঠছে ?
“কারো অতীত থাকাটা দোষের নয়। তবে অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে, তাঁর নামের প্রথম অক্ষরের টি-শার্ট পড়ে ঘুরঘুর করাটা দোষের। আর এই দোষ ক্ষমার অযোগ্য। ”
তানভীর চমকে উঠে নিজের পড়নের টিশার্ট দিকে তাকাল। ডিজাইনিং টিশার্টের মাঝখানে A লেখা। স্পষ্ট তাকালে বুঝা যায় না। তবে কেউ সূক্ষ্ম নজরে চাইলে ঠিকই বুঝবে। মেঘ বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে অক্ষরটা খুঁজে পেয়েছে। বন্যা, আবির, তানভীর তিনজনের নজরই টিশার্টে। আবির শান্ত কণ্ঠে বলল,
” বউ, আমার সম্বন্ধি তোমার মতো এত বিচক্ষণ না। টিশার্টের ডিজাইনের ভেতর A লেখা নাকি S লেখা সেসব দেখার সময় আছে নাকি তার!”
” সময় না থাকলে এক কালার টিশার্ট পড়বে। দরকার হয় সাদা পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরবে তাই বলে A লেখা টিশার্টই কেনো? B লেখা টিশার্ট বাজারে ছিল না? আপনি আবার ভাইয়ার হয়ে সাফাই গাইতেছেন।”
” কি মেয়ে রে বাবা!”
তানভীর বন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোমার ননদকে একটু বুঝাও।”
এতক্ষণ বন্যার মুখে হাসি থাকলেও এবার সে নির্বাক। মেঘকে বুঝানোর চেষ্টাও করল না। ছোটখাটো বিষয়ে মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি কষ্ট পায়। এতক্ষণ মেঘের কথাগুলো ফাজলামো মনে হলেও এবার না চাইতেও বন্যা সিরিয়াস হয়ে গিয়েছে। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। বুঝাতে চাচ্ছে সে একদম ঠিক আছে। কিন্তু চোখে মুখে ফুটে উঠছে সে ঠিক নেই। মিনিট দশেক চলল তানভীর আর মেঘের ঝগড়া। মাঝখানে মাঝখানে আবির দুয়েকটা কথা বলে সেটাতেও হাজারটা দোষ ধরছে মেঘ। সকালের রাগটা এখনও পুরোপুরি কমে নি। দশ মিনিট যাবৎ বন্যা নিশ্চুপ বসে আছে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে মেঘ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বন্যার হাত ধরে বলল,
” চল আমার সাথে। ওঁদের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। পুরুষ জাতই খারাপ। একজন মালাকে ছাড়া বাঁচবে না আরেকজন আয়েশাকে ছাড়া। শুধু শুধু তোর আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।”
আবির বসা থেকে উঠে বলল,
” এই দাঁড়াও, আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব।”
তানভীরের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
” এই তানভীর, ওঁকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আয়।”
মেঘ গর্জে ওঠে বলল,
” কোনো দরকার নেই। আমরা বাসা চিনি৷ একায় যেতে পারব।”
আবির গম্ভীর কণ্ঠে ডাকল,
” মেঘ।”
মেঘ রাগে কটমট করে বলল,
” খান বাড়িতে আপনাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমি এক্ষুনি বাসায় গিয়ে আব্বু, বড়ো আব্বুকে সব বলব। বাসার আশেপাশেও যেন আপনাদের না দেখি।”
মেঘ বন্যাকে টানতে টানতে নিয়ে একটা রিক্সায় উঠে বসল। তানভীর হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। মেঘের রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না৷ তাই বলে বন্যাও! বন্যা মুখ ফুলিয়ে চলে গেল৷ ওর কি উচিত ছিল না তানভীরের সাথে যাওয়া?
রাত ৯ টার উপরে বাজে। তানভীর বন্যাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বন্যাকে একের পর পর এক কল দিচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না৷ নতুন জামাই অসময়ে বাসায় যেতেও লজ্জা লাগছে। অনেকগুলো কল দেওয়ার পর অবশেষে কল রিসিভ করেছে।
” বলুন।”
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কতগুলো কল দিয়েছি তোমাকে।”
” আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। দেখি নি।”
” আমার কেনো যেন মনে হচ্ছে না। তুমি নিচে আসো তো। দেখি একটু!”
বন্যা চমকে ওঠে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কোথায় এখন?”
” অফিস থেকে কল দিতে দিতে এখন তোমাদের বাসার নিচে আছি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুটো ব্যথা হয়ে গেছে। আসো, প্লিজ।”
বন্যা কিছু বলার সাহস পেল না। বেড়িয়ে এলো বাসা থেকে। রাত গভীর। পরিবেশ একদম শান্ত৷ তানভীরের পড়নে এখন কালো রঙের টিশার্ট। যার মাঝখানে সাদা রঙে বড় করে লেখা ‘ B’ বন্যা টিশার্টের দিকে একবার দেখল কিন্তু তানভীরকে কিছু বুঝতে দিল না।বলল,
” এত রাতে আপনি এখানে?”
“নিজের বিয়ে করা বউকে দেখতে আবার সময় লাগে নাকি? ইচ্ছে হয়েছে এসেছি। বাসায় নিতে পারছি না বলে কি বউকে দেখতেও আসতে পারব না?”
“আমি সেটা বলি নি।”
” তখন রাগ করে চলে এলে কেনো?”
বন্যা মলিন হেসে বলল,
” রাগ করিনি।”
“তা তোমার চোখ- মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বনু রাগের মাথায় কি কি বলল তুমিও ওর সঙ্গে সিরিয়াস হয়ে গেলে। এটা কি হলো?”
বন্যা উত্তর দিচ্ছে না।৷ তানভীর আবারও বলল,
” বনু বাসায় গিয়ে কি বলেছে জানো?”
” কি?”
“বলেছে, আমি নাকি তোমার সাথে সিরিয়াস ঝগড়া করেছি। বনুকেও বকা দিয়েছি। আরও কি কি বলেছে কে জানে। আব্বু আমাকে কল দিচ্ছে ইচ্ছে মতো বকা দিয়েছে। ওর জন্য সকালে একবার ধমক খেলাম৷ একটু আগে আবার। বাসায় যাওয়ার পর নিশ্চয়ই আবার খাবো। কিন্তু বনু.. সে তো দিব্যি আছে।”
বন্যা চাপা স্বরে বলল,
” অনেক রাত হয়েছে বাসায় যান। ”
“যাব৷ তার আগে A লেখা টিশার্ট টা পুড়িয়ে তোমার মনের ভেতরের ক্ষোভ, অভিমান, কষ্টগুলো দূর করে নেই।”
“কিছু পুড়াতে হবে না।”
“পুড়াবো তো অবশ্যই। দেখো ব্যাগে করে টিশার্ট নিয়ে এসেছি।”
হঠাৎ রাস্তার পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন,
” আগেই বলেছিলাম, এই ছেলেকে বিয়ে করো না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে। আমার কথা মানলে না। আজ যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হতে তাহলে আমার মনে জায়গা পেতে৷ চায়ের দোকান তোমার নামে করে দিতাম। ”
তানভীর বন্যা দু’জনেই সেদিকে তাকালো। মোখলেস মিয়া এক বালতি পানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তানভীর রাগে ফোঁস করে ওঠল৷ বন্যা তৎক্ষনাৎ তানভীরের হাত চেপে ধরে বলল,
” রাগ দেখাবেন না, প্লিজ।”
মোখলেস মিয়া আবার বললেন,
” আমি এখনও তোমাকে ভালোবাসি৷ আমার মনের দরজা তোমার জন্য এখনও খুলা।”
তানভীর রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
” আমি কি দাদিকে খবর দিব? আমার বউয়ের দিকে কুনজর দিলে আপনার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিব। ফায়ার সার্ভিসের ৩ টিম এসেও সে আগুন নেভাতে পারবে না। এই আমি বলে রাখলাম।”
মোখলেস মিয়া হাসতে হাসতে বলছেন,
” দাদিরে আর কওন লাগতো না। আমি যাইতাছি। চা খাইয়া যাইয়ো।”
বন্যা তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এত ভালোবাসেন আমাকে?”
“জি।”
“তবে A লেখা গেঞ্জি পড়লেন কেনো?”
“আবার? এরপর থেকে যা কিনব সব তোমাকে সাথে নিয়ে কিনব। দরকার হয় অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখে নিব A অক্ষর আছে কি না!”
বন্যা মুচকি হেসে বলল,
” আমি মজা করেছি।”
তানভীর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” কিন্তু আমি সিরিয়াস।”
★
রাত ১০ টা বেজে ২৬ মিনিট৷ মেঘ সদর দরজার কাছে পায়চারি করছে। মোজাম্মেল খান সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। হঠাৎ আবির এসে দরোজায় দাঁড়াতেই মেঘ বলল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
আবিরের সহজসরল জবাব,
” বাসায়।”
মেঘ চাপা স্বরে বলল,
“বলেছি না, এই বাসায় আপনার প্রবেশ নিষিদ্ধ।”
আবির চোখ ঘুরিয়ে মোজাম্মেল খানের দিকে এক নজর দেখলেন৷ পরপর মেঘের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলল,
“আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি। এবার কিছু বলবেন?”
মোজাম্মেল খান ভেতর থেকে ডাকলেন,
” আবির, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে আসো।”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে আলগোছে চোখ মারল। মুচকি হেসে বলল,
” শ্বশুরআব্বু ডাকছেন। আমি কি যাব?”
মেঘ আর কথা বাড়াল না। ভেঙচি কেটে বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল। মোজাম্মেল খান শান্ত গলায় বললেন,
” বসো।”
আবির সঙ্গে সঙ্গে বসল। মৃদুস্বরে আওড়াল,
” চাচ্চু, আপনার শরীর কেমন এখন?”
” আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভালো।”
“কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না। মেঘের কি হয়েছে? সন্ধ্যা থেকে রেগে আছে। এত ডাকতাম পাঁচ মিনিট বসলোও না, কথাও বলল না। ঝামেলা হয়েছে কোনো?”
” না৷ তেমন কোনো সমস্যা নেই৷”
মোজাম্মেল খানের কণ্ঠস্বর গম্ভীর । বললেন,
” দেখো আবির, তোমার পাগলামির জন্য আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি৷ এখন তোমার জন্য যদি আমার মেয়ে কষ্ট পায় তাহলে এর ফল খুব খারাপ হবে।”
আবির মাথা নিচু বলে বলল,
” আমার আচরণের কারণে মেঘ কখনও কষ্ট পাবে না, ইনশাআল্লাহ।”
আলী আহমদ খান রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন,
” কি ব্যাপার, আমার ছেলেকে একা পেয়ে তোর শাসন করা শুরু হয়ে গেল?”
“শাসন করছি না ভাইজান। সাবধান করছি। মেয়ে কিন্তু আমার একটায়।”
আবির বিড়বিড় করতে করতে বলল,
” বউও আমার একটাই।”
“কি বললে?”
আবির থতমত খেয়ে বলল,
” এভাবে থ্রেট না দিয়ে আমাদের জন্য একটু দোয়া করবেন।”
“আমি তোমাকে থ্রেট দিচ্ছি?”
আলী আহমদ খান হাসতে হাসতে সোফায় এসে বসলেন। আবির অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
” মুখ ফস্কে সত্যি কথা বেড়িয়ে গেছে, দুঃখিত।”
” কি?”
আবির মৃদুস্বরে বলল,
” আমার সাথে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই৷ আপনার মেয়ের সাথে চলতে চলতে আমিও ওর মতো হয়ে যাচ্ছি।”
মোজাম্মেল খান হতাশ ভঙ্গিতে আলী আহমদ খানের দিকে চেয়ে বললেন,
” ভাইজান, ওঁরা বড়ো হবে কবে? ভেবেছিলাম আবিরের মনে হয় একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে। বিয়ে দিলে সংসারটা মনোযোগ দিয়ে করতে পারবে। আমি নানা হবো, আপনি দাদা। কতই না ভালো লাগবে। কিন্তু এঁদের লক্ষ্মণ তো ভালো না।”
আবির মলিন চোখে তাকিয়ে আবারও বিড়বিড় করল,
” শ্বশুরআব্বু, আপনার মেয়েই এখনও বাবু। তাঁকে বাবু থেকে বাবুর মা বানানোটা আমার কাছে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের সমতুল্য।”
“কি হলো? বিড়বিড় করে কি বলো?”
” কিছু না।”
মালিহা খান রান্নাঘর থেকে ডাকলেন,
” কিরে আবির, খাবি না?”
“আসছি, আম্মু। ”
আবির ঝটপট উঠে গেল। আব্বুর সামনে নিজের বাবা হওয়ার কথা শুনা সত্যিই লজ্জাজনক। যদিও সেই লজ্জাবোধ আবিরের একটু কমই আছে।
আবির খাওয়াদাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গেল। রুম অন্ধকার। আবির রুমের আলো জ্বালাতেই দেখল রুম একদম ফাঁকা। কোথাও কারো অস্তিত্ব নেই। মেঘ মেঘ বলে কয়েকবার ডাকল৷ কিন্তু কোনো সাড়া নেই৷ ব্যালকনিতেও কেউ নেই। আবির চুপচাপ ফ্রেশ হতে গেল। মিনিট কয়েক পর একটা বালিশ নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা মেঘের রুমে গিয়ে ঢুকল। মেঘ টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই পড়ছিল। আবির বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বালিশটা বিছানায় রাখতেই মেঘ চমকে উঠল,
“আপনি এখানে কেনো?”
” ঘুমাতে এসেছি।”
“আপনার রুম নেই?”
আবির স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
” তখন না বললাম, আমি শ্বশুরবাড়িতে এসেছি। শ্বশুরবাড়িতে আসলে বউয়ের রুমে থাকব এটায় কি স্বাভাবিক না?”
“থাকুন আপনি আপনার শ্বশুরবাড়িতে ৷ আমিও আমার শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছি।”
আবির মেঘের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এই না না। একদম না। রাত কয়টা বাজে দেখেছো? কোনো ভদ্রবাড়ির মেয়ে এত রাতে শ্বশুরবাড়িতে যায় না। তুমি বরং আগামীকাল সকালে যেও। কেমন?”
মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি আসলেই একটা…..”
“কি? বলো..”
“কিছু না।”
মেঘ আবিরের হাত ছাড়িয়ে উঠে যেতে লাগল। আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু হেসে গান শুরু করল,
“ও বউ….
তুমি আমায় কি ভালোবাসোনা??
ও বউ….
কেন আমার কাছে আসোনা??”
আবিরের কণ্ঠে এমন গান শুনে মেঘ হাসি থামিয়ে রাখতে পারছে না৷ তবুও গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে। আবির আবারও বলল,
” ও বউ……
তুমি রাগটা কি কমাবে না?
ও বউ……
একটুও কি হাসবে না?”
এবার বার হাসি চেপে রাখতে পারল না। মেঘের হাসতে সময় লাগলেও মেঘকে নিজের কাছে টেনে নিতে আবিরের এক মুহুর্ত সময় লাগে নি। এক টানে মেঘকে শুইয়ে দিয়েছে। আবিরের বাহুর উপর মেঘের মাথা। আবির মেঘের দিকে পাশ ঘুরে শুয়েছে। মেঘের কপালের উপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো আলতো হাতে ঠিক করে দিচ্ছে আবির। মেঘের দুচোখ বন্ধ, হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। আবির অকস্মাৎ মেঘের লালচে গালে চুমু খেল৷ মেঘের শরীরের প্রতিটা কম্পন আবির উপলব্ধি করছে৷ হঠাৎ মেঘের কানের কাছে ঠোঁট এগিয়ে ডাকল,
আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে সারপ্রাইজ পর্ব ১
” বউ…”
মেঘ জবাব দিতে পারছে না। শরীর কাঁপছে। লজ্জায় চোখ খুলতে পারছে না। আবির আবার ডাকল,
“ও বউ……”
“হু”
আবির নরম স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
” আমার শ্বশুরআব্বু এবং তোমার শ্বশুরআব্বু দু’জনের খুব ইচ্ছে নানা-দাদা হওয়ার। একটু আগেই আমাকে বলছিলেন। আমারও খুব ইচ্ছে আহিয়ার আব্বু হওয়ার। তোমার কি আহিয়ার আম্মু হতে ইচ্ছে করে না?”