হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৮

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৮
Tahrim Muntahana

আলো-আঁধারি পরিবেশ। ঘর টা বেশ বড়। তিনটি বেড রাখা, তার ঠিক মাঝখানের বেড টাই কেউ একজন শুয়ে আছে। ডান হাতে সাদা ব্যান্ডেজ। বর্তমানে ব্যান্ডেজ আর সাদা নেই। কারো ছন্নছাড়া আঁকিবুঁকি তে অদ্ভুত রূপ নিয়েছে। বেডের পাশে বসে এক মনে ব্যান্ডেজের উপর কলম চালাচ্ছে আদিল। কলমের লাল কালি ঠিক যেন রক্তের প্রতিরূপ। বেডে শুয়ে থাকা লোকটি নড়ে উঠে, আদিলের হাত থেমে যায়। সম্পূর্ণ জ্ঞান ফেরার পর্যন্ত ঠিক শিউরে বসে থাকে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই নিজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ায় আদিল। বড় বড় পা ফেলে সুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে যায়। সুইচে আঙ্গুলের চাপ পড়তেই অন্ধকার যেন পালিয়ে যায়, সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আলো। পিটপিট করা চোখটি আলো সহ্য করতে না পেরে বন্ধ‌ হয়ে যায়। আদিল হয়তো এটাই চাইছিল, এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

~ কেমন লাগছে মিস আফরা ইবনাত?
আফরা চট করে চোখ খুলে। পাশে তাকাতেই আদিলের মুখশ্রী ভেসে উঠে নয়ন যুগলে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। এবার যেন বুঝ এলো। সে এখন হসপিটালে অবস্থান করছে। তবে এই লোকটি এখানে কি করছে? বললো,
~ আপনি এখানে কেন? মিরা কোথায়?
কথাটা বলতে বলতেই উঠার চেষ্টা করে আফরা। ডান হাতে চাপ লাগতেই ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। আদিল চোখ মেলে দৃশ্য টা দেখে, উপভোগ করে। শত্রুর ব্যাথায় এত সুখ লাগে কেন? হিসহিসিয়ে বললো,
~ আমিই তো নিয়ে এসেছি। সামান্য বুলে* টের ঘা সহ্য করতে পারলেন না? এই সাহস নিয়ে আদিল মাহমুদের সাথে লাগতে আসেন?
আফরা’র চোখ জ্বলে উঠে। তীব্র ক্ষোভে চোখ দিয়েই যেন ভস্ম করে দিবে আদিল কে। আদিল হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~ আমি চেয়েছিলাম আপনার বুক বরাবর বু* লেট ছুড়তে। তবে আপনার বান্ধুবী যেভাবে সামনে এসে দাঁড়ালো ট্রেলর দেখাতে হাতকেই নিশানা করতে হলো। আদিল মাহমুদ রিভল* বার তাক করেছে অথচ বু* লেট বের হয় নি, তা কখনোই হয় নি। প্রথম বার গু* লি খেয়ে অনুভূতি কেমন?
রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে আনে আফরা। আদিল যখন তার দিকে রিভল* বার তাক করে দাঁড়িয়েছিল, তার মনে হয়েছিল লোকটি তাকে এখনি মারবে না। শুধু নিজের রাগ কে কন্ট্রোল করতে না পেরে ছুটে এসেছে। তাই সে ভাবালেশ দাঁড়িয়েছিল। তবে বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন মিরা বেশী বুঝে আফরা’র সামনে এসে দাঁড়ায়। অন্যকেউ থাকলে হয়তো এমন ভালোবাসা দেখে আপ্লুত হয়ে যেত তবে আফরা যে ভিন্ন। বরং তার কাছে এটা আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। সে সুযোগে আদিল‌ও সুযোগটা লুফে নিয়ে বুকে টার্গেট করা রিভলবার হাতে চালিয়ে দেয়। মিরা’র চিৎকারে পরিবেশ ভারী হলেও বুলেটের আঘাত আফরা কে কাবু করতে পারে না। শক্ত থেকে নিজের এক রোখা জেদের প্রমাণ দিয়ে আদিলের চোখে চোখ রেখে হেসেছিল। তারপর আর মনে নেই! জ্ঞান ফিরে নিজেকে এমন বন্দি দশায় দেখলো। আদিলের দিকেই তাকিয়ে আফরা হেসে বললো,

~ কে বললো আপনাকে প্রথম বুলেট হজম করলাম?
আদিল চমকায়। মেয়েটা কি তার ভাবনার বাইরেও বিপজ্জনক? আফরা আবার বললো,
~ যে মেয়ে নিজের শরীরে নিজের হাতে বুলেট চালান করতে পারে, তাকে আপনি এই দু টাকা’র রিভলবার দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন। বিষয়টা কমেডি অফ দা ইয়ার হয়ে গেল‌ না?
আদিলের এমন মজা সহ্য হয় না। দু পা এগিয়ে এসে আফরা’র গলা চেপে ধরে। আফরা শুধু তাকিয়েই থাকে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তবে ছাড়ার আকুতি করে না। আদিল বললো,
~ আপনাকে কিভাবে ভাঙতে হয় তা নিশ্চয়‌ই আদিল মাহমুদ জানে। অপেক্ষা করুন!
চলে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরে আদিল। আফরা কেশে গলা ঝেড়ে নেয়। আদিল কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
~ মিরা কোথায়?
আদিল উত্তর দেয় না, ঘুরেও তাকায় না। চলে যায়। আফরা কিছুক্ষণ দরজার দিক তাকিয়ে থাকে‌ অনুভূতি শূন্য দৃষ্টিতে। তারপর চোখ বুজে নেয়! রাত তো ঢের বেশী, চোখ জ্বলে কেন? ঘুম নাকি জ্বালা?

ড্রয়িং রুমে বসে আছে নাদিয়া। টি-টেবিলে তার প্রিয়দের রাজত্ব। দৃষ্টি টিভির দিকে। ঘড়ি দেখা হয় নি, তাই ঠিক বলা যাচ্ছে না রাত কতদূর। আনুমানিক দু’টো তো বাজবেই। আজ কেন জানি ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করলো না। হয়তো বাবা নামক মানুষ টা বাড়ি নেই বলেই আজ সে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিসেস নুরিও আজ ঘরে খিল দিয়েছেন। স্বামীর অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছেন, নাহয় কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফেলছেন! মুখ বাঁকায় নাদিয়া। কবে যে এসব থেকে মুক্তি পাবে! মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ভাবনা গুলো শূন্যে উড়িয়ে দেয়। টুং টুং শব্দ করে ফোন বেজে উঠে‌। মুখশ্রীতে আনন্দের ছাপ দ্বিগুন হয়। চট জলদি ফোন তুলে কানে ধরেই বলে উঠে,

~ খুব মিস করছিলাম মনে হলো!
~ কাজের কথায় এসো!
~ মন খারাপ তোমার? এই আজকে কি তুমি কেঁদেছো? কন্ঠ এমন লাগছে কেন?
নাদিয়ার বিচলিত কন্ঠ। অপর পাশের মানুষ টি বিরক্ত হয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
~ আদিখ্যেতা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না? তোমার কি মনে হয়, এসব ফালতু আলাপের সময় আমার আছে? ফোন দিয়েছিলে কেন সেটা বলো।
নাদিয়ার মুখটা ছোট হয়ে আসে। তার চিন্তা গুলো লোকটার আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে? করুণ কন্ঠে বলে,
~ আমি যাদের আপন ভাবি, তারাই কেন আমাকে সহ্য করতে পারে না? আমি মেয়েটা কি খুব খারাপ, বাজে?
লোকটা নরম হয়। মেয়েটা কি আজ একটু বেশীই কষ্টে আছে? শান্ত কন্ঠে বলে,
~ তোমার জানার কথা আমার মন কেমন থাকবে! প্রশ্ন করা বোকামো নয়? যা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলে সেটা বলো।আমার হাতে সময় কম!

~ তুমি কি আমাকে শত্রু ভাবছো ঠিক আগের মতো?
~ তোমাকে শত্রু ভাবার কোনো কারণ নেই নাদিয়া। আমি আমার শত্রু দের কাছে ঘেঁষতে দিই না। দূর থেকেই টপাটপ আউট করে দিই। মাঝখানে অতিরিক্ত বুঝে কাজ না করলে আমার তিক্ত কথাও তোমার শুনতে হতো না!
~ অতিরিক্ত বুঝে কোনো কাজ‌ই আমি করিনি!
~ আফরা ইবনাত কে আমাদের মাঝে যুক্ত করার কোনো দরকার ছিলো? মেয়েটাকে কেন সিংহের গর্তে ফেললে? অন্যের জীবন কে মূল্যবান মনে হয় না? নাকি এর মধ্যেও কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো?
নাদিয়া হেসে উঠে। আজ প্রথমবার লোকটি তার সাথে এত কথা বলছে‌। ডানা মেলে আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে তার। সোফায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে বললো,

~ লুকিয়ে ছিলাম। আজ সত্য বলবো। বলি?
লোকটা জবাব কাটে না। নাদিয়া নিজের মতোই বলতে থাকে,
~ ছোট ভাইয়া এতিম একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে, যার একটা বড় বোন ছাড়া এই দুনিয়ায় কেউ নেই। অনল মাহমুদের কি প্রেস্টিজ নেই? সে কিছুতেই চালচুলো হীন মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবে না। ছোট ভাইয়াও ভাবী কে ছাড়বে না। শুরু হলো বাবা-ছেলের গৃহযুদ্ধ। ভাবীর সাথে আমার বেশ ভাব ছিল। তার বড় বোনের কথা কত বলতো। আমার বেশ আগ্রহ হতো দেখার। দেখতে চাইলেই ভাবী শুধু এড়িয়ে চলতো। কারণ বুঝতাম না। কৌতুহলের বশেই আমি একদিন ভাবীর ফোন চুরি করি, ভাগ্য ভালো ছিল ওয়ালপেপারেই দু বোনের ছবি ছিল। বড় বোন টা কে জানো?

~ আফরা?
অপর পাশ থেকে অবাক কন্ঠ ভেসে আসে। নাদিয়া খিলখিল করে হেসে উঠে। কিছুক্ষণ হেসে বলে,
~ কয়েকটা মাস চলে গেল। হুট করে ভাবী কোথায় হারিয়ে গেল, এত খুঁজেও পেলাম না। সময় চলতেই থাকলো, ছোট ভাইয়া দিন দিন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। বাবা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতো। জেগে গেলেই ব‌উ ব‌উ বলে চিৎকার করতো। একসময় পাগল নাম উপাধি পেল। আমিও আর সেদিকে মাথা ঘামায় নি, ভার্সিটিতে যাওয়া আশা করছি। একদিন লাইব্রেরী তে বসে হাসাহাসি করছিলাম। তখন‌ই একটা মেয়ে গম্ভীর কন্ঠে আমাদের থামতে বলে। জেদী আমি মেনে নিতে পারি নি। এর পর থেকে একটু একটু রেষারেষি চলতেই থাকে আমাদের। কি তেজ এই মেয়ের। তখনো আমি চিনতে পারেনি। চিনতে পারলাম কখন জানো? যখন রাগের বশে আমি মেয়েটার ডিটেলস বের করলাম। তখন থেকে মেয়েটা আমার অধিক প্রিয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম মেয়েটা সেই সদূর চট্টগ্রাম শহর থেকে কেন বান্দরবান আসলো! প্ল্যান করে ভাবী হ‌ওয়ার অফার করি। এর মধ্যেও কিন্তু স্বার্থ রয়েছে‌। আমি চাই বড় ভাইয়া বাবা’র উপরের ভালো মানুষীর মুখোশ টা দেখুক! যা আফরা’ই পারবে! যে মেয়েটা বোনের জন্য এত টুকু আসতে পেরেছে, সে মেয়েটা আমার বড় ভাইয়া কে ভালোবাসলে কতদূর যাবে! আমার ভাইয়া ভালো থাকুক সেটাই চাই যে।

নাদিয়ার কি আজ নেশা হয়েছে? নাহলে এমন ভুলভাল বকবে কেন? কথা গুলোও এমন ছন্নছাড়া কেন? মনের কথা গুলো মুখোশধারী কেই বা কেন বলছে? অপর পাশের লোকটি ফোন কেটে দেয়। নাদিয়া আরো কিছুক্ষণ নিজের মতো বকবক করে ঢুলে পড়ে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। ফোন ধরে রাখা হাতটা কান থেকে নামায় না! মাতাল হয়ে মনের কথা গুলো বলে আজ যেন সে তৃপ্তিতে ঘুমাবে। কিন্তু সে কি জানে, কথাগুলো পেট থেকে বের করে কতটা ভুল সে করেছে? তার জন্য‌ই না এই কথাগুলো কাল হয়ে দাঁড়ায়!

চুপিচুপি আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে আসমানী। এতক্ষণ সে পিলারের পেছনে লুকিয়ে ছিল। কথা গুলো শুনেছে কিনা, শুনলেও বুঝেছে কিনা তার মুখের ভঙ্গিমায় বুঝা যায় না। নাদিয়া ঘুমিয়ে যেতেই ধীরে ধীরে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায় সে। মিসেস নুরি তাকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন উপরে যেন তার পা না পড়ে। তাই দিনের বেলা সে দেখতে পায় নি! আজ অনল মাহমুদ বাড়ি না ফেরায় উপরের গেইট লক করা নেই। এই সুযোগ টাই কাজে লাগিয়েছে। উপরে উঠে মাথায় থাকা ঘোমটা টা ঝামটা মেরে ফেলে দেয়। সাথে মুখ বেঁকাতেও ভুলে না।
মিসেস নুরি’র রুমে একপলক নজর ঘুরিয়ে তাড়াহুড়ো করে সরে আসে আসমানী। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে যায়। কত সুন্দর জিনিস গুলো! হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেয়। সময় চলে যায় ঘড়ির কাঁটায় তিনটের কাছাকাছি। হুট করেই আসমানী’র পা থেমে যায়। চমকায়, ভড়কায়! কার কন্ঠ ভেসে আসে? ভয় নিয়ে অনুসরণ করে। কিছুটা দুরত্বের ওই ঘর থেকে আসছে‌। পা চালিয়ে এগিয়ে গিয়ে কান পাতে দরজায়। চাপা গলায় কেউ বলছে,
~ ব‌উ, কোথায় তুমি? শুনতে পারছো না ব‌উ? এখানে খুব অন্ধকার, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? সামনে এসো না ব‌উ, এত লুকোচুরি আমার ভালো লাগে না। ব‌উ?

ইশ কি আদুরে কথাগুলো। আসমানী’র খুব কান্না পায়। একটু আগের কথা’র সাথে যে খুব ভালো করেই মিলিয়েছে সে বুঝতে পারছে। এই তাহলে নাদিয়ার ছোট ভাইয়া? ছলছল চোখ নিয়ে দরজা খুলে আসমানী। ভয় হলেও এগিয়ে যায়। শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ফোন বের করে ফ্লাস জ্বালিয়ে নেই। বিছানা’র ঠিক মাঝখানে একজন বসে আছে, হাঁটুতে হাত ভাঁজ করে মাথা নিচু করে। শুকনো ঢুক গিলে আসমানী বিছানার কোণায় দাঁড়ায়। ফিসফিস করে বলে উঠে,

~ তুমি তোমার ব‌উ রে খুজতাছো? আমি জানি তোমার ব‌উ কোনখানে আছে! যাবা আমার সাথে?
অনিক চমকে মাথা তুলে। চোখের পলক ফেলে ঘনঘন। আসমানীর ছলছল চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অনিক অনেকটা সময় চেয়ে থাকে, হুট করেই হেসে বলে,
~ তুমি নিয়ে যাবে আমাকে? সত্যি? আমি আমার ব‌উয়ের কাছে যাবো। এখনি নিয়ে চলো, এখনি যাবো আমি।
গমগম কন্ঠ। আসমানী ভয় পেয়ে মুখ চেপে ধরে। কারো কানে পৌঁছালে তাকে কে বাঁচাবে? ফিসফিস করে বলে,
~ তুমি যদি ব‌উয়ের কাছে যাইতে চাও, তাইলে আমার কথা শুনতে হ‌ইবো তোমার। ক‌ও রাজি আছো। ন‌ইলে আমি তোমারে রাইখাই চ‌ইলা যামু।

অনিক ঘন ঘন মাথা নাড়ায়। সে আসমানীর সব কথা শুনবে। আসমানী মুখে হাসি ফুটে। অনিকের একদম কাছে বসে, কানে কানে কিছু বলে। অনিক‌ও যেন ব‌উ কে পাওয়ার আশায় সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দিবে। আসমানী’র কথা মতো চুপ করে থাকে। অনিকের ঝাঁকড়া চুলে আদুরে ভাবে হাত বুলিয়ে আসমানী বের হয়ে যায় ঘর থেকে। বৈচিত্রময় পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় মানুষ। হাসিগুলোও যেন বৈচিত্র্য রূপে অধরে খেলা করে!

ভোর সাড়ে পাঁচ টার মতো বাজে‌। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে জিয়াউল। সেই রাত ১২ টা থেকে এক টানা গাড়ি চালাচ্ছে সে। তবুও কোনো রকম ক্লান্তি ভাব ফুটে উঠে নি তার মুখশ্রীতে। ঘুমে বার বার চোখ ঢলতেও হয় নি। তাকে দেখে বেশ বুঝা যাচ্ছে, আরো পাঁচ-ছয় ঘন্টা ড্রাইভিং সে অনায়েসেই করতে পারবে‌। সূর্য কেবল পূর্বাকাশে উঁকি দিয়েছে, রক্তিম সূর্য টার সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে। মোড ঘুরানোর সময় আয়নাতে কেমন ঝিলিক দিয়ে চোখ মুখে বারি খায়। স্নিগ্ধতার এক অপার দৃশ্য চোখ মেলে উপভোগ করে আফীফ। যদিও সে সকালের সূর্যের আগমন কোনো দিন ই মিস করে না। অনেক সময় দেখা গিয়েছে কোনো এক লড়াইতে গিয়েছে, একটানা কাজের মধ্যেও নজর ঘুরিয়ে সকালের সূর্যটা চোখে, মনে ধারণ করে নিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আফীফ মাথা ঘুরিয়ে পাশে ঘুমিয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকায়‌। তার কাঁধে মাথা রেখে মানুষ টা কেমন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। এরকম শান্তি তো সেও পেত। গাড়ি চালানোর ফাঁকে জিয়াউল স্যারের মোভমেন্ট গুলোও দেখে নিচ্ছে। কে জানে কখন কোন বিষয়ে রেগে যায়। আফীফ
জিয়াউলের দিকে না তাকিয়েই বললো,

~ আর কতক্ষন লাগবে?
সম্মানের সহিত নিম্ন স্বরে জিয়াউল বললো,
~ পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে স্যার।
আফীফ আর কথা বলে না। মা কে আস্তে আস্তে ডাকতে থাকে। কামিনী বেগম ঘুম থেকে জাগেন। চোখ খুলেন, তবে ওভাবেই চুপ করে থাকেন। কিছুটা সময় যেতেই ছেলের কাঁধ থেকে মাথা তুলে মিষ্টি করে হাসেন। আফীফের মন যেন শান্ত হয়ে যায়। এমন ঝলমলে হাসি এখন থেকে সে প্রতিদিন প্রতিটা ক্ষণ দেখতে পারবে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বললো,

~ হালকা ফ্রেস হয়ে নাও মা, এরপর আমরা বাসে করে যাবো।
কামিনী বেগম বোতল তুলে নেন হাতে। জানালা খুলে মাথা বের করে সকালের মিষ্টি হাওয়া গাঁয়ে মাখেন। এমন ভাবে হা করে নিঃশ্বাস নেন, যেন হাওয়া খেয়েই সে পেট ভরিয়ে ফেলবে। আর কিছু খেতে হবে না। মায়ের বাচ্চামোতে আফীফ হেসে উঠে। হাত ধরে গাড়ির ভেতরে এনে বলে,
~ হয়েছে অনেক হাওয়া খেয়েছো, এখন দুটো রুটি আর একটা ডিম জলদি করে শেষ করো তো! বাসের মধ্যে খেতে পারবে না।

কামিনী বেগমের ডিম খুব প্রিয়। একপ্রকার লুফেই নেন তিনি, এদিকে রুটি খেতে বড্ড গড়িমসি করেন। তবে ছেলের ভয়ে দুটো রুটি তাকে শেষ করতেই হয়। মায়ের খাওয়া শেষ হতেই আফীফ মুখের কাছে ঔষধ ধরে। চোখ মুখ কুঁচকে কামিনী বেগম ঔষধ খান। মুখটা এমন গম্ভীর করে রাখেন, যে কেউ দেখলেই হয়তো ভাববে মহিলাটা বেশ মুডি। গোমড়া মুখ দেখেও আফীফ কিছু বলে না। টিফিন বক্স বের করে পর পর ছয়টা ডিম পেটে চালান করে দেয়। অসহায় চোখে ছেলের খাওয়া দেখে কামিনী বেগম। তাকে আর একটা ডিম দিলে কি এমন হতো? কত টাকা উপার্জন করে ছেলে, অথচ তার জন্য খরচ করতে এত গড়িমসি! কষ্ট করে জন্ম দিয়ে কি লাভ হলো, লালন-পালনের‌ও দাম দিল না ছেলে। নানান রকম ভাবনা সাজিয়ে গোমড়া মুখেই বসে থাকেন তিনি। এ নতুন না, প্রত্যেক দিনের সকালের দৃশ্য এটাই। তবে মা ছেলের জন্য মুহূর্ত গুলো যেন নিত্য নতুন তাজা হয়ে উঠে।

গাড়ি থামে বহদ্দারহাট টার্মিনালে। বহদ্দারহাট দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরের একটি উপশহর।
এখান থেকে বাসে করে বাংলাদেশের যেকোন প্রান্তে যাওয়া যায়। নিচু এলাকা হ‌ওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই এখানে পানি জমে যায়। জনগণের কত‌ই না ভোগান্তি পোহাতে হয়! ভাগ্যিস কালবৈশাখীর তান্ডবের মুখোমুখি এখনো পড়তে হয় নি! নাহলে তাদের সফর টা পাংশুটে হয়ে যেত। গাড়ি থামিয়েই জিয়াউল নেমে দাঁড়ায়। গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে হাসে, আফীফ বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,

~ এখন আমি ডিউটিতে নেই জিয়া। ফর্মালিটি বাদ দাও!
কথাটা শুনেই জিয়াউল বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে হেসে আফীফের কাঁধ চেপে ধরে।
শক্ত হাতের থাবা শক্ত হাতে। আফীফ চোখ রাঙিয়ে তাকায়। জিয়াউল তখনো নিজের মতো হেসে কাঁধ চাপড়াচ্ছে। যখন‌ই স্যারের রাগী চোখ দেখে হাসি থেমে যায় তার। কাঁধে থাকা হাতের দিকে একপলক তাকায়। এর পর তাকায় স্যারের দিকে। শুকনো ঢুক গিলে জলদি করে হাত সরিয়ে নেয়। হেসে আমতা আমতা করে বলে উঠে,
~ ফরমালিটি করি তো, তাই একটু আরকি..
~ হয়েছে থামো। ব্যাগে দুটো টিফিন বক্স আছে‌। নাস্তা করে, কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবে। এবার আমাদের গন্তব্য আলাদা।

কথাটি বলেই আফীফ মায়ের হাত ধরে। আরেকহাতে ট্রলি ধরে এগিয়ে যায় টার্মিনালের দিকে। ঢাকা থেকে বান্দরবান বাসে যেতে সাধারণত ৬ ঘণ্টা- ১০ঘণ্টা সময় লাগে। তবে ঢাকা থেকে সরাসরি বান্দরবান রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। ঢাকা থেকে প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর সেখান থেকে পূরবী বা পূবার্নী বাসযোগ সরাসরি বান্দরবান যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে আফীফ নিজের চাহিদা মতো ব্যবস্থা নিয়েছে‌। চট্টগ্রাম পর্যন্ত নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করলেও বান্দরবান গাড়ি নিয়ে ঢুকবে না। এক অচেনা আগন্তক হয়েই মা -ছেলে ঘুরে বেড়াবে। মনের ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে সারা শহর।

বাসের হর্নের শব্দ। আফীফ নজর ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাক করে। ছয়টা বাজতে আরো দশমিনিট বাকি। পূর্বাণী বাস দাঁড়িয়ে আছে যাত্রী তোলার জন্য। ঠিক ছয়টাই গাড়ি ছাড়বে। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এক ঘন্টা পর পর গাড়ি ছাড়ায় যাত্রীদের সুবিধায় বটে। নন এসি বাস বলে আফীফ গড়িমসি করলেও কামিনী বেগম মিষ্টি হেসে সায় দিয়েছেন। জানালা খুলে দিলে প্রকৃতির অকৃত্রিম যে বাতাস নাকে মুখে বারি খায় তা এসি’র কাছে কিছুই নয়।
ভরপুর বাস। তীব্র হর্ন দিয়ে ছুটে চলে। বাস কন্ট্রাক্টর ড্রাইভার সহ সকল যাত্রীদের যখন শুদ্ধ বাসায় শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে উঠে,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৭

~ চট্টগ্রাম টু বান্দরবান জার্নিতে আপনাদের স্বাগতম। যাত্রা শুভ হোক!
কামিনী বেগম কেঁপে উঠেন। ছেলের হাত শক্ত করে ধরে ভীতু চোখে কন্ট্রাক্টরের দিকে তাকান। কি নাম শুনলো সে? বান্দরবান? আবার সেই শহর? এই শহর কি তার পিছু ছাড়বে না? এ শহর যে ভালো না।

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ১৯