হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২৩

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২৩
Tahrim Muntahana

ঝকঝকে সাদা ফ্লোর, আলোর আগমনী জানালা টা সাদা পর্দায় ঢাকা। গোছানো, পরিপাটি মাঝারি সাইজের ঘরটি। মাঝখান টাই ছোটখাটো একটি বেড। ঘরটা পরিচিত মনে হচ্ছে! ছোট ছোট চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে আদিল। মাত্র‌ই জ্ঞান ফিরেছে‌। কাল রাতে যেখানে নিজের শত্রুকে শুয়ে থাকতে দেখে পৈচাশিক আনন্দে পুলকিত হচ্ছিল, আজ সেই বেডেই নিজেকে দেখে অনুভূতি শুন্য আদিল। যদিও তার অনুভূতি আছে কিনা ঢের সন্দেহ। নিয়তি বুঝি এমন ই লিখে রেখেছিল? উঠে বসে আদিল। পড়নে ধূসর টিশার্ট। নিজেকে ভালো মতো পরখ করতেই আদিলের কপালে ভাঁজ পড়ে। শার্ট কে পাল্টালো? মুহূর্তেই মুখশ্রীতে পরিবর্তন আসে খুব করে‌। হুংকার ছেড়ে ডেকে উঠে,
~ ডক্টর, ডক্টর, নার্স! আমার শরীরে হাত দেওয়ার স্পর্ধা কি করে হলো?

রাগে ফুঁসতে থাকে আদিল। যতবার নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ততবার যেন ক্রোধের অনল বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত চলে গেল, কারোর সাড়া শব্দ নেই। দাঁড়িয়ে পড়লো সে।‌ ঘর থেকে বেরোতে পা বাড়ানোর পূর্বেই ঠকঠক পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। থেমে যায় সে, গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে আবার বসে পড়ে। শব্দ টা আস্তে আস্তে নিকটবর্তী হয়, আদিলের বুকটা হুট করেই ধক করে উঠে। কেমন একটা জ্বালাময়ী অনুভূতি তার অন্তর কে গ্রাস করছে, বুঝে উঠতে পারে না। হাঁসফাঁস করে , ভাবনায় নিমজ্জিত আদিল অপ্রতিভ হয় মেয়েলি ভৎসর্নায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~ অনুভূতি কেমন মি. আদিল মাহমুদ?
কন্ঠ পরিচিত। আদিল শান্ত দৃষ্টি মেলে দরজায় তাকায়। ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে মিরা। ঠোঁটের ভাজে হাসি। আদিল গম্ভীর সরে বললো,
~ মিস মিরা যে!
ঠকঠক আওয়াজ তুলে আদিলের পাশে দাঁড়ায় মিরা। ফুলের তোড়া টা আদিলের হাঁটুতে রেখে বললো,
~ আপনার শান্ত দৃষ্টি আমাকে কাবু করতে যথেষ্ট মি. আদিল!
চোখে চোখ পড়ে। মিরা’র চোখ যেন আজ রহস্যময়ীর লীলা দেখাতে উদ্যত হয়েছে। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না আদিল। তড়িৎ গতিতে ফুলের তোড়াটা ফ্লোরে ফিকে মারে। আছড়ে পড়ে তাজা ফুল গুলো, থেতলে যায়। মিরা দৃশ্য টা সম্পূর্ণ ইগনোর করে আদিলের পাশে বসে। একদম মুখোমুখি। তর্জনী আঙ্গুল বুকে ঠেকিয়ে শান্ত তথচ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

~ এখানে কেউ আছে বলেই হয়তো আমার বুলেট আপনার বুক ভেদ করতে পারে নি!
ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে আদিল। ক্রমশ‌ই চোখ তার রক্তিম হয়ে উঠে। তাহলে এই মেয়েই তার শার্ট চেন্জ করেছে‌? তড়িৎ বেগে মিরার আঙ্গুল নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নেয়। মিরা কিছু বুঝে উঠার আগেই হাত মুচড়ে ধরে বুকের সাথে চেপে ধরে। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে র‌ইলো মিরা। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে চুপ র‌ইলো আদিলের কন্ঠস্বর শোনার আশায়। হিসহিসিয়ে আদিল বললো,

~ তুমি মেয়ে আদিল মাহমুদ কে ঠিকঠাক চিনতে পারো নি, যদি চিনতে নাম নেওয়ার স্পর্ধাও করতে না।
চুপচাপ হজম করে নিলো ব্যাথাটা। আড়চোখে একবার মুখশ্রী দেখার চেষ্টা করলো মিরা। ব্যর্থ সে, তবে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করে নিজেকে দুর্বল ভাবার পাঁয়তারা করেও দিলো না। অদ্ভুত মিশ্র কন্ঠে বললো,
~ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছি, অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেয়েছি, দীর্ঘদিন যত্নের অভাবে কঙ্কালসার হয়েছি; এখন তো দেখছি আপনার প্রেমে পড়ে উষ্ণতার জন্য ছটফট করতে হবে, আমৃত্য!
কথাটার সমাপ্ত ঘটতেই আদিল মিরা কে আরেকটু কাছে টেনে নিল। মিরা’র ভেতর টা অসম্ভব কাঁপছে, পুনরায় ভুলের দিকে ধাবিত করছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আজ যেন নিজের সাথেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। কন্ঠে রসিকতা টেনে আদিল বললো,

~ আমার উষ্ণতা আগুনের ন্যায়, সহ্য হবে তো?
~ ছাই কে দ্বিতীয় বার পুড়াবেন কোন আগুনে? বিষে বিষে বিষক্ষয় নাহয় এবার হলো!
ধাক্কা দিয়ে বন্ধন থেকে মুক্ত করলো মিরা কে। রক্তিম চোখ নিয়ে আদিল গর্জে বলে উঠলো,
~ নাও, গেট লস্ট!
মিরা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। এলোমেলো পা ফেলে হাঁটা ধরলো। প্রতিটা পায়ের ভাঁজে ভাঁজে যেন বিষাদের নীল নকশা ফুটে উঠছে। মিরা’র প্রস্থান নিশ্চিত হতেই আদিলের সব কঠোরতা উবে গেল। চোখে মুখে ভর করলো একরাশ নিরবতা। আকস্মিক ডান হাতটি বুকের বাম পাশে রেখে মুচকি হাসলো। খানিক ব্যাথা পেল। তাজা ক্ষত, ব্যথা পাওয়া অস্বাভাবিক নয়! এইটুকু ব্যাথাকে অবহেলায় ছুড়ে ফেলে অনেক সময় বুকের বা পাশে ডান হাতের বিস্তার বজায় রাখলো। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

~ আপনি একান্তই আমার না পাওয়া ফুল। সহস্য মানুষের ভিড়ে একছত্র অধিকারী হয়ে আমার বুকের বামপাশে বিরাজমান। আমার আঁধারে ঢাকা আকাশের আঁড়ালে জ্বলতে থাকা মিটিমিটি তারা। জ্বলতে থাকুন প্রতিনিয়ত, হাজার বছর!
একাকিত্ব বরণ করে জানালা’র কাছে ছুটে গেল আদিল! পর্দা সরিয়ে কিঞ্চিৎ ফাঁক করলো জানালা। ছোট, বড় গাছ, লতাপাতা, আগাছার আঁটসাঁটে জঙ্গল ই মনে হচ্ছে এদিকটাই। দীর্ঘদিন হয়তো এদিকে কেউ পা বাড়ায় না, অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ভয় যাদের আছে তারা কি করে এই জঙ্গলে পা ফেলে? এই জঙ্গল তো তার মতো অন্ধকারে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া মানুষদের! হসপিটাল টি অনল মাহমুদের! তার ইশারা ছাড়া কাক পক্ষীও মনে হয় উড়ে যেতে পারে না! পুরো রাজত্ব তার! যার ক্ষমতায় এককালে সেও ছিল, নিজ ইচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে‌। এরপর আর এদিকে পা বাড়ানো হয় নি। তবে হসপিটালের পেছনে এত বড় জঙ্গল আগে চোখে পড়ে নি! ভাবাচ্ছে খুব!

~ আসতে পারি?
ভাবনায় ফোড়ন কেটে কেউ অনুমতি চাইছে। ভ্রু যুগল কুঁচকে ঘাড় ঘুরায় আদিল। পুলিশ ইউনিফর্ম পড়ে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আদিল বেডের কাছে আসতে আসতে বললো,
~ আপনি?
~ ইন্সপেক্টর নোমান! আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমি জরুরি কেস সমাধান করতে বেরিয়েছিলাম, তাই দেরী হলো। আপনি এলাউ করলে আপনার মুখ থেকে বিতান্ত শুনে আমরা এগোবো!
কথাটা বলেই নোমান ভেতরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে‌। আদিল বিরক্ত দৃষ্টি ফেলে নোমান কে দেখে। পুলিশকে ইনফর্ম করলো কে সেটাই ভাবছে। বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,

~ আপনাকে কে আসতে বলেছে?
~ উপর থেকে ফোন এসেছিল, এমন ভাবে বললো কেউ হয়তো খুন হয়ে ইতিমধ্যে কঙ্কাল ও হয়েছে গেছে! এসে দেখি হাতে সামান্য লেগেছে!
অতিরিক্ত কথা আদিল পছন্দ করে না। তবুও কিছু বললো না। এর পেছনে যে তার বাবা রয়েছে ঢের বুঝতে পারছে সে। কাটকাট গলায় বললো,

~ আপনাদের হেল্প আমি চাইছি না। আদিল মাহমুদ নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করতে পারে!
বিরক্ত নোমান ও হচ্ছে। আতিকুরের খু* নের ব্যাপারে গিয়েছিল। মাথাটা যে কাগজে প্যাকেজিং করে পাঠানো হয়েছে তার কাগজে একটি ব্রান্ডের নাম ছিল। সেখানেই গিয়েছিল। আশানুরূপ কিছু পায় নি। এমন প্যাকেজ অহরহ মানুষের কাছে আছে। খড়ের বোঝায় সুঁই খোঁজার মতো! সেখান থেকে ফেরার সময়‌ই বসের হম্বিতম্বিতে মনে হয়েছিল কেউ হয়তো মৃত্য পথযাত্রী। তবে এখানে এসেও সে নিরাশ! আজ শুধু সে নিরাশ‌ই হচ্ছে। আদিলের কথায় ভাবনা থেকে বের হয় সে,

~ মি. নোমান আমি কিছু বলেছি, আপনি এখন আসতে পারেন। আর হ্যাঁ প্রথম বার আদিল মাহমুদের অনুমতি ছাড়া তার‌ই সামনে বসে যে ভুল করেছেন দ্বিতীয় বার দেখা হলে পুনরাবৃত্তি করবেন না। বিষয়টা আপনার জন্য মুটেও ভালো হবে না!
নোমান চমকিত দৃষ্টিতে আদিলের দিকে তাকায়। মাথা কেমন ঝনঝন করে উঠে। তার কি রাগ হচ্ছে? জবাবে নিজেও গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ ইন্সপেক্টর নোমান এখানে জবানবন্দি নিতে এসেছে, আপনাকে গার্ড দিতে নয়! তাই আপনার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নি।
আদিল হাসলো। কিছু বললো না। নোমান জানে এই হাসির কারণ। হয়তো পুলিশ স্টেশন গিয়ে দেখবে সাসপেন্ড লেটার, নাহয় বদলি! এসবের ভয় সে করে না! দু টাকার চাকরি সে ছেড়ে দেওয়ার পথেই রেখেছে! আদিল জবাব না দিলেও তার জবাব দিল অন্য কেউ,

~ গার্ড দিতে আসেন নি, তবে গভার্নমেন্ট নির্দেশে এসেছেন! আপনার আইন অন্যায়ের সামনে আপোষ করতে মানা করে। সম্মানীয় লোকের সাথে নিশ্চয় নয়?
কন্ঠস্বর শুনে আদিলের হাসি চ‌ওড়া হলো। নাদিয়া এসেছে! মেয়েটা হয়তো একটু আগেই জেনেছে, তাড়াহুড়ো করে এসেছে। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলছে কেমন! মেয়েলি এমন কথায় নোমান অবাক হয়ে দরজায় তাকায়। অবকতা বেড়ে যায় পাশের মেয়েটিকে দেখে। আফরা ইবনাত এখানে কেন? নাদিয়া আফরা’র হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আদিলের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আবার বললো,

~ মি. নোমান! সে সামথিং!
নোমানের টনক নড়ে‌। নাদিয়া’র প্রশ্নের উত্তর সে দেয় না। তার দৃষ্টি ঘুরে আফরা আদিলের ডান হাতে। এক‌ই হাত, এক‌ই স্থান, প্রায় এক‌ই সময়, আবার দুজন পরিচিত! কেমন একটা রহস্য গন্ধ পাচ্ছে! নোমানের এমন দৃষ্টির কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না আফরা’র। আদিলের পাশে ধপ করে বসে একপলক আদিলের ডান হাতে নজর বুলায়। মুচকি হেসে বলে উঠে,

~ সব‌ই ভালোবাসা মি. নোমান!
নোমানের চোখে মুখে বিস্ময়। ভালোবাসা? কথার মিনিং একটু হলেও বুঝেছে সে। তবে আঘাত টা কে আগে পেয়েছে বুঝতে পারে না। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
~ ভালোবাসা? ঠিক কি হয়েছিল?
কন্ঠটা কেমন শোনায়। আফরা শব্দ করে হেসে উঠে। রসিকতা করে বলে উঠে,

~ প্রচন্ড ভালোবাসে তো! আঘাত সহ্য করতে পারে নি! তাই‌ মনের জ্বালা মেটাতে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে!
আফরা কাকে মিন করে কথাটি বললো আদিল ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারলো না। দুজন শুধু ভ্রু কুঁচকেই তাকিয়ে রইলো। নোমান উঠে দাঁড়ালো। আর কিছু না বলেই গটগট করে বাইরে চলে গেল। ভালোবাসা শব্দটাই কানে বাজছে বারবার। হিসেব মিলছে না!
নোমান যেতেই ভাইয়ের নিকটে চলে গেল নাদিয়া। ডান হাতে হাত বুলিয়ে বললো,
~ কে করেছে?
কন্ঠে কেমন ঝাঁঝ। মনে হচ্ছে সত্য টা জানলে এখন‌ই কিলা*রের মাথা কেটে ঝুলিয়ে রাখবে। আদিল পাল্টা প্রশ্ন করে বললো,
~ তোমার মনে হয় তোমাকে উত্তর দেওয়ার গুরুত্ব আমার কাছে আছে? অযথা প্রশ্ন করো না! এমন আঘাত প্রথম নয়!
~ এমন আঘাত প্রথম না হলেও; স্থান, পরিস্থিতি মনে হয় এটাই প্রথম!
নাদিয়ার ঝটপট জবাব। কন্ঠে অবাকতা। আদিল বিরক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। ধমকে কিছু বলার আগেই পকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে। রিসিভ করে কানে ধরে। অপর পাশের মানুষ টা কিছু বলতেই আদিল শান্ত স্বরে বলে উঠে,

~ আসছি!
কেটে দেয় ফোন। সময় ব্যয় না করেই মেয়ে দুটোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। নাদিয়া কিছু বলার ও সুযোগ পায় না! সাথে সাথে আফরা’ও বলে উঠে,
~ আমাকেও যেতে হবে নাদিয়া। টা টা!
আফরাও বেরিয়ে যায়। কেবিনে একা রয়ে যায় নাদিয়া। থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে সেও ধীরে ধীরে পা ফেলে হাঁটতে থাকে! সন্ধ্যা এখনো হচ্ছে না কেন? আরো কয়েক ঘন্টা বাকি!

চারদিক শুধু সবুজ আর সবুজ। যেদিকে চোখ যায়, খোলা চোখে যতটুকু দেখা যায় সর্বত্র‌ই সবুজের রাজত্ব। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য! চোখ বড় বড় করে উপভোগ করছে আফীফ ও তার মা‌। সৃষ্টিকর্তা কি অপরূপ রূপেই না সৃষ্টি করেছেন বান্দরবান কে। সকল ক্লান্তির অবসান ঘটবে, বিষাদগ্রস্ত মন নিমিষেই পুলকিত হয়ে যাবে এমন প্রকৃতির ছায়া পেলে।
আফীফ এসেছে মিলনছড়ি। থানচি যাওয়ার পথেই পড়ে মিলনছড়ি,
নীলগিরি ও চিম্বুক। বান্দরবান শহর থেকে চিম্বুক যাওয়ার রাস্তা ধরে ৪ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই সবুজের সমারোহের দেখা মিলবে!

নিজ ফোনে জিপিএস ট্র্যাকিং সেট করে নিয়েছে সে। তিনমাসের ছুটিতে পুরো বান্দরবান নিজ চোখে ধারণ করবে।
প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযে ভরপুর মেঘের রাজ্য ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে পূরণ করতেই মিলনছড়িতে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে। চারপাশটায় নানান গাছের সমাহার, বিশাল বাঁশ ঝাড়, হরেক রকমের ফুল।সর্পিল গতিতে বয়ে চলছে সাঙ্গু নদীটি।
পানির কলকল ধ্বনি, অকৃত্রিম বাতাস, দুপাশে গাছপালা; প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের অপূর্ব এক প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে। কামিনী বেগম সবুজের বুকে দু হাত মেলে শ্বাস নিচ্ছেন। অনেক বছর পর সকল প্রশান্তি যেন একত্রে বুকে বিঁধে গেল। ছেলের দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখতে পেলেন, হাতে ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ক্যাপচার নিয়ে যাচ্ছে আফীফ। খানিক লজ্জা পেলেন তিনি, মুখশ্রী রক্তিম হয়ে উঠতেই আফীফ হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বললো,

~ আম্মা আপনি তো নতুন ব‌উদের মতো লজ্জা পাচ্ছেন। একদম টুকটুকে সুন্দরী ব‌উ! এভাবে থাকেন তো আরো কয়েকটা ছবি তুলে নিই!
ছেলে তাকে হুটহাট আদর করে আম্মা আর আপনি বলে ডাকে‌। তখন কি যে প্রশান্তি বয়ে যায় মনে! কামিনী বেগম আর থাকতে পারলেন না। লজ্জা পেয়ে রিসোর্টের ভেতর চলে গেলেন। আফীফ ও সময় ব্যয় না করে ছোটখাটো ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো।

রাতটা আজ মিলনছড়ি হিলসাইড রিসোর্টেই কাটাবে। রিসোর্টটির নির্মানশৈলী এবং উপস্থাপনার নান্দনিকতা বিশেষ স্বতন্ত্রতা উপহার দিয়েছে। প্রকৃতি প্রেমীদের নজর কাড়তে বাধ্য। এছাড়া বান্দরবানের জনপ্রিয় অথেন্টিক আদিবাসী খাবার পাওয়া যায় এই রিসোর্টে। এর ডরমেটরিতে ৬ থেকে ১০ জনের জনপ্রতি ভাড়া ৯০০ টাকা। স্বল্প খরচে দল নিয়ে থাকার জন্য উপযুক্ত। এছাড়াও রিসোর্টের অন্যান্য এসি, নন-এসি রুমের ভাড়া ২৫০০ থেকে ৫৬০০ টাকা পর্যন্ত। বেশ গরম থাকায় আফীফ নিজেদের জন্য এসি রুম ই নিয়েছে। যদিও কামিনী বেগম বলেছিলেন নন-এসি ঘরে জানালা খুলে প্রাকৃতিক হাওয়ায় ঘুমাবে। আফীফ রিস্ক নেয় নি। বন্য প্রাণী,পোকামাকড় ঘরে ঢুকে পড়লে?
আফীফ নিজ ঘরে প্রবেশ করতেই টের পেল তার ফোন বেজে চলছে। আনন্দে ফোন নেওয়ার কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। ফোন হাতে তুলতেই জিয়া নামটা দেখে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে। এই ছেলেটা কে বলেছিল, এখন থেকে তাদের রাস্তা আলাদা! অথচ ছেলেটা তার কথা অমান্য করে আবার ফোন দিয়েছে! বড়সড় এক ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফোন তুলতেই অপর পাশ থেকে তড়িঘড়ি করে জিয়াউল বলে উঠলো,

~ স্যার আপনি কোথায় আছেন? আমার অবস্থা বেগতিক!
কন্ঠটা কেমন শুনালো‌। চিন্তিত কন্ঠে ঝটপট বললো,
~ আমি কোথায় তা শুনে কি করবে? তোমার কি হয়েছে সেটা বলো।
জিয়াউল আবারো হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
~ আপনি কোথায় তা বললেই আমার হবে। তারপর বলতেছি স্যার!
মিলনছড়ি রিসোর্টে আছি! এখন বলো কে…
টুট টুট শব্দে ফোন কেটে গেল। আফীফের ভীষণ রাগ হলো। এই ছেলে সে কোথায় জানার জন্য মিথ্যে বললো। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটা বিছানায় ঢিল ছুড়লো। শান্তির মাঝেও শান্তি নেই! বিড় বিড় করে বলে উঠলো,
~ একবার হাতের কাছে পাই, খালেদা জিয়া’র পুরুষ ভার্সন তোর পিন্ডি চটকাবো আমি!

কিছুক্ষণ পর এশা’র আযান দিবে। আশরাফ উদ্দিনের লাশ ঘন্টা খানেক হলো হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে‌। প্রতিবেশী কিছু আগ থেকেই কবর দেওয়ার সকল ব্যবস্থা করে রেখেছিল। লাশ আনা মাত্র‌ই গোসল করানো হয়েছে। ঘরের মধ্যে চুপটি করে বসে আছে মনিরা, মিহি আর সাহেলা বেগম। ড্রয়িং রুমে কিছু আত্মীয় স্বজন রয়েছে, সেখানেও যায় নি তারা। মানুষের মিছে কান্না দেখতে ইচ্ছে করে না। এমন মানুষের জন্য তো নয়‌ই। এখন পর্যন্ত সালেহা বেগম এক ফোঁটা চোখের জল ও ফেলেনি। নিত্য দিনের মতোই নিজ কর্ম করে গেছেন।
নিচ থেকে ডাকার শব্দ। সালেহা বেগম শাড়ির আঁচল মাথায় ফেলে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। হয়তো লাশ এখন কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। সালেহা বেগম কে নিচে আসতে দেখে মনিরা’‌ও পিছু নিয়েছে। শেষ যাত্রা টা কেন জানি দেখতে ইচ্ছে করছে‌। সালেহা বেগম কে দেখেই একজন মুরব্বি বললেন,

~ ভাবীসাহেবা আপনাদের কি নিকটবর্তী আত্মীয় স্বজন নেই? খাঁটিয়া ধরতে হবে তো!
কি কপাল! লাশ টাকে কবরস্থানে নেওয়ার আপন মানুষ নেই। বড় ছেলে মৃত, মেজ ছেলে নিখোঁজ, এক ছেলে পলাতক! তিনটি ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েও খাঁটিয়া ধরার মানুষ খুঁজে পেলেন না। সালেহা বেগম তাচ্ছিল্য করে বললেন,

~ নাহ নেই। বাবার একমাত্র সন্তান ছিল! তার সন্তান তো একটাও নেই! আপনারাই দেখুন কি করতে পারেন!
ঘরেই চলে যাচ্ছিলেন সালেহা বেগম। অনুমতি পেয়ে মুরব্বিটাও হাঁটা ধরেছে। কেউ ই আর যেতে পারলেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২২

~ খাঁটিয়া ধরার জন্য আমি এখনো রয়েছি!
তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরলেন সালেহা বেগম। অতি পরিচিত মুখশ্রী দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি! কত দিন পর চোখ জোড়া সজীব হলো! এবার বুঝি অপেক্ষা’র অবসান ঘটলো?

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২৪