মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২১
মির্জা সূচনা
সকালবেলার রোদের আলো তখন ঠিক যেন সোনালি গালিচা বিছিয়ে রেখেছে গ্রামের পথজুড়ে। ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে কুয়াশার আঁচল এখনো লেগে, হালকা হাওয়ায় গন্ধ ছড়াচ্ছে তাজা মাটির। মেহরিন, চুমকি, আরফা আর মাহির হাঁটছে মাটির পথ ধরে, কেউ গুনগুন করে গান ধরেছে, কেউ আবার ফোঁটা ফোঁটা রোদে সেলফির জন্য পোজ দিচ্ছে।
আরশ ভাই একটু এগিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, এমন সময় ফোনে কল আসায় সরে গিয়ে পাশের বটগাছটার আড়ালে দাঁড়ায় কথা বলতে।
ঠিক সেই ফাঁকে, হঠাৎ পাশের একটা ছোট গলিপথ থেকে কয়েকটা বখাটে ছেলে এসে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। একজন ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছিল আগেই ওদের নজরে রেখেছিল। সে বাঁকা হেসে বলে উঠল,
সকাল সকাল এত রূপসী রোদে হাঁটছেন কোথায় আপারা?
চুমকি অবাক হয়ে থেমে যায়, মাহির সামনে এসে দাঁড়ায়। আরফা আঁচল ঠিক করে বলল,
পথ থেকে সরে দাঁড়ান,
একজন আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,
একটু কথা বললেই কী এমন ক্ষতি? গ্রামের ছেলে আমরা, এমন অতিথিদের সঙ্গে একটু আলাপ তো চলতেই পারে!
মেহরিনের চোখে রাগের ঝিলিক। সে গম্ভীর গলায় বলল,
এইরকম আলাপের যোগ্যতা থাকলে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন না।
আলাপ করার ইচ্ছে থাকলে- বাড়ি আসুন একদিন চা বা কফি খেতে খেতে আলাপ করা যাবে। এমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বখাটেদের সঙ্গে আমরা আলাপ করি না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একটা ছেলে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে অবাঞ্ছিত চাহনি, মুখে বেয়াদবি ঝরানো কথা।
— এই শুনেন আপারা, এই রূপ তো গ্রামের বাতাসে সইবে না। একটু কাছে এসে পরিচয় দেন না আজ! অন্য একদিন না হয় বাড়ি গিয়ে আলাপ আলোচনা করে আসবো।
মেহবুবা আর চুমকি থমকে দাঁড়ায়। মাহির দাঁত কড়মড় করে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ঠিক তখনই, মেহরিন চোখ নামায় না, সরাসরি ছেলেটার চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে:
— তোমার মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বাজে ছেলেদের মতো রুচি আমাদের না। আর একটা শব্দ বললে জুতোর নিচে মুখ যাবে।অথবা জুতা যাবে মুখে।
ওদের কথায় অন্য ছেলেটার রাগ বেড়ে যায়। সে আগ বাড়িয়ে মেহরিনের হাত টেনে ধরে।বলতে থাকে,রূপের অনেক দেমাগ তাই না আজ সেই দেমাকশূন্য করে দিব।
আর তখনই আশপাশ থমকে যায়। মেহবুবা, চুমকি, মাহির—তিনজনই বাকা হাসে, যেনো তারা জানে কী হতে যাচ্ছে এখন। ওদের মুখের কোণে খেলা করে আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি।
চুমকি মাহিরার মেহবুবা কে ফিসফিস করে বলে, ছেলেগুলোর জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বেচারারা সকাল সকাল এমন কেলানি খাবে না বাড়ির ঠিকানা মনে থাকবে কিনা এটা নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত।
আরফা ভয় পেয়ে বলে ওঠে,
— ছেড়ে দাও ওকে! আরে দয়া করো ভাই তোমরা!
কিন্তু দয়া শব্দটা মেহরিনের অভিধানে আজ নেই। সে হঠাৎই প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়, তারপর দুমদাম করে সেই ছেলেটাকে একের পর এক চড়-থাপ্পড় দিতে শুরু করে।
— তুই ভাবছিস মেয়ে দেখে কিছু বলবি আর আমি চুপ করে থাকব? আজ তোকে শিখাবো মেয়েদের কি করি সম্মান করতে হয়। জাতে এই রাস্তা দিয়ে আর কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে ও ভয় পাস!
এক ঘুষি, তার পর ছেলেটার মেন্ট পয়েন্ট বরাবর একটা লাথি—ছেলেটা পড়ে যায় মাটিতে।
ওর সাথের আরেকজন কিছু বলতে যাবে, কিন্তু মাহির গম্ভীর গলায় বলে,
— যদি আর এক পা বাড়ানোর চেষ্টা করো… খুব খারাপ হবে।
চুমকি আর মেহবুবা তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছে।
মেহরিন শেষবার আরেকটা লাথি দিয়ে বলে,
— এবার উঠ, আর যা এখান থেকে। যদি আবার চোখে পড়িস, পরের বার পুলিশে দেব না—গ্রামের মেয়ের হাতে তুলে দেব!
সাথে থেকে ছেলেগুলো খুব ঘাবড়ে যায়, ওদের দৌড় ঐ মেদের ডিস্টার্ব করা পর্যন্তই, তাই নিজেদের বিপদ না বাড়িয়ে। বখাটেরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
আরফা তখনো ভয়ে স্তব্ধ, আর চুমকি হেসে বলে,
— এই জন্যই বলি, মেহরিন থাকলে ভয় পাওয়ার দরকার নেই!
সবাই হেসে ফেলে। মাহির বলে,
— সকালটা জমে গেল!সকাল সকাল খেজুরের রস সুন্দর প্রকৃতি তারপর আমার বইনের এমন ফাইটিং ।
মাহিরের কথাই সবাই হেসে ফেলে তাদের হাসির মধ্যে গ্রাম আবার তার সোনালি সকাল ফিরে পায়।
সবার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। সকালটা একেবারেই অ্যাডভেঞ্চারসে কেটেছে।
তখন আর এস আসে মূলত সে দূর থেকে দেখছিল সব ।
আরশ হেসে বলে,
— ওরে বাস! আমাদের মেহরিন রানি তো দেখি বখাটের পিঠে ঘোড়ার চাবুক চালিয়ে এল! ভাই হিসেবে আমি গর্বিত!
মেহরিন চোখ ঘুরিয়ে বলে,
— এই সব নাটক বাদ দাও, ভাইয়া! বেশি গর্ব করতে গেলে আবার গর্বে গর্বে গর্ভবতী হয়ে যাবে।
মেহরিনের এমন কথাই সবাই হেসে ফেলে।
চুমকি হাসতে হাসতে বলে,
— আচ্ছা মেহরিন, একবার ভাব! তোর এমন রাগ দেখে যদি আমাদের দুভাই বেগে যায়।
সবাই মিলে হেসে ওঠে। আরফা একটু গম্ভীর, বলে,
— তোমরা এত নির্ভীক কিভাবে হও? আমি তো ভয়েই কাঁপছিলাম!
মেহবুবা বলে,
— আস্তে আস্তে তুইও শিখে যাবি, আরফা। আমাদের মেহু মেম একটু আলাদা!সে অবলা নারী না।
হাসতে-ঠাট্টা করতে করতে তারা জমিদার বাড়ির মূল ফটকে পৌঁছায়। কিন্তু ওরা বুঝতেই পারেনি এতক্ষণে ঘর ভর্তি লোক চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে। ওদের না পেয়ে চারদিকে খোঁজখুঁজি চলেছে।
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই, মেহরিনের মা মালিহা মির্জা রীতিমতো গর্জে ওঠেন—
—মেহরিন! কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?তোমাদেরকে একটু কাণ্ডজ্ঞান নেই!এই সময় কেউ বাইরে যায়? কোনো খবর না দিয়ে উধাও? জানো ঘর ভর্তি মানুষ চিন্তায় পড়ে গেছে!
মেহরিন একটু ভীতু হেসে বলে,
— মা, গ্রামে এসেছি বলেই তো একটু ঘুরতে গেলাম।আসলে সকালে সৌন্দর্যটা একটু উপভোগ করতে চেয়েছিলাম।
তখন মেহরিনের ফুপা আকরাম চৌধুরী সামনে এগিয়ে এসে হালকা হেসে বলেন,
— আরে ভাবী, অত রাগ কিসের! ওরা তো সবাই মিলে একসাথে একটু মজা করেছে। গ্রামের হাওয়াতে এইটুকু না হলে চলে?
মালিহা মির্জা একটু বিরক্ত মুখে তাকিয়ে থাকেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
— আচ্ছা, চল খেতে বসো। তারপর কিন্তু আর না বলে বাইরে যাওয়া চলবে না।
মাহির চুপিচুপি বলে,
— এইটা মা না, হেডমিস্ট্রেস!
আর সবাই আবার হেসে ওঠে।
এইভাবেই এক সুন্দর গ্রাম্য সকালের গল্প শেষ হয় এক হাসি আর পরিবারভরা উষ্ণতায়।
বিকেলের নরম আলোয় জমিদার বাড়ির উঠোনটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। শিউলি আর গাঁদার মালা দিয়ে সাজানো বারান্দা, আর চারপাশে ইতিমধ্যেই লোকজন আসতে শুরু করেছে। সারা রাজবাড়ি সুন্দর সাজে সজ্জিত হয়েছে।বাড়িতে যেন উৎসবের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।
ফাইজাহ চৌধুরী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে গম্ভীর মুখে বললেন,
— আর কতো দেরি? অনুষ্ঠানের সময় হয়ে এল! মেয়েগুলোকে দেখো এখনো তারা হাসির মধ্যে আছে। এই তোরা আমার সাথে আয় তো।
চুমকি, মেহরিন, মেহবুবা আর আরফাকে ডেকে তিনি নিজের ঘরে নিয়ে আসেন,আলমারি থেকে চারটা শাড়ি বের করেন।হাতে আনা চারটা শাড়ি ধরিয়ে দিলেন। একেকটা যেন একেকটা রঙিন গল্প—চারটা শাড়ির ডিজাইন একই রকম, একটা ধবধবে সাদা পাড়ে হলুদ সূচি, একটা জ্যামদানি প্যাটার্নে নীল আর গোলাপি, আর একটা বেগুনি-সোনালি কম্বিনেশনে সিল্ক আর একটা মিষ্টি কালার।
— এই শাড়িগুলো পরো তো তোমরা চারজন। আমি নিজে পছন্দ করে এনেছি ঢাকার বুটিক হাউস থেকে। পরেই দেখো কেমন লাগো!—ফাইজা হেসে বললেন।
মেয়েগুলো শাড়ি হাতে একে একে রুমে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় শাড়ি পরার কসরত। চুমকি বলে,
— মেহরিন,আমার আঁচলটা ঠিক করে দে না, পারছিনা ঠিকঠাক…
মেহবুবা আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের খোঁপা ঠিক করতে করতে বলে,
—আরফা, তোর কানের দুল কই? ওই গোলাপি শাড়িটার সাথে ওই ঝুমকোটা দারুণ মানাবে।
আরফা একটু লজ্জা পেয়ে হেসে বলে,
— আমার না এইটাই প্রথমবার শাড়ি পরছি গো! একটু নার্ভাস লাগছে।
মেহরিন ঠাট্টা করে বলে,
— তাহলে হাঁটিস সাবধানে। না হলে সবার সামনে যদি উষ্টা খেয়ে পড়ে যায় মান-সম্মান আর থাকবে না।
হাসতে হাসতে সাজগোজ শেষ হয় সবার। সবাই যখন একসাথে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, যেন চারটি রঙিন গল্প এক ছবিতে মিলেমিশে গেছে।
ফাইজাহ আবার এসে চোখ বুলিয়ে দেখে বলে,
— বাহ মাশাল্লাহ, আমার চার পরী তো একদম রূপকথার রাজকন্যা লাগছে।মনে হচ্ছে তোরা ফটোশুটের জন্য রেডি !
পেছন থেকে মাহির বলে ওঠে,
— এইবার ফটোশুটও হোক! আমি ক্যামেরা রেডি করছি!
সন্ধ্যা নামার আগেই জমিদার বাড়ির উঠোন আলোয়, রঙে আর সুরে জমে ওঠে আনন্দঘন আয়োজন।
রাত আটটা। জমিদার বাড়ির উঠোন আলোয় ঝলমল করছে। আঙিনার মাঝখানে রঙিন লাইটিং আর ফুলের সাজে একটা অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি হয়েছে। পাশেই গানের দল সুর তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্যান্ডেল ভর্তি মানুষ—আত্মীয়, প্রতিবেশী, দূরের অতিথি। কেউ কারো সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত, কেউ বা খাওয়া-দাওয়ার টেবিলে হাত পুড়িয়ে নিচ্ছে গরম গরম চপ, কাটলেট, আর শরবত।
মালিহা মির্জা ও ফাইজা চৌধুরী আর জাহানারা বেগম অতিথি আপ্যায়নে রীতিমতো ব্যস্ত। আর মেয়েরা—মেহরিন, চুমকি, আরফা, মেহবুবা—সবাই সাজগোজে ঝলমল করছে। চারপাশে যেন রঙ আর হাসির বন্যা।
এই সময় আকরাম চৌধুরী এক পাশে দাঁড়িয়ে মাইকে কিছু বলার জন্য এগিয়ে যান। উপস্থিত সবাই একটু কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকায়।
তিনি মুচকি হেসে বলেন,
—আজকের এই আনন্দঘন সন্ধ্যায় আমার দুটি বিশেষ অতিথি আসছে। আমার দুই ভিআইপি গেস্ট।
লোকজনের মধ্যে হালকা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে—ভিআইপি? কে আসছে? তারকা নাকি?
আকরাম চৌধুরী একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে বলেন,
—ওয়েলকাম, মাই বয়েজ!
সবাই যখন অপেক্ষা করছে, তখনই উঠোনের পশ্চিম দিকের বড় ফটক খুলে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে পড়ে দু’জন যুবক।
সবার দৃষ্টি একসাথে তাদের দিকে ঘুরে যায়।
একজন লম্বা, গম্ভীর চেহারার, পরনে কালো ফরমাল ড্রেস। চোখে গভীরতা, মুখে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস মুখে মৃদু হাসি—তিনি শিকদার।
আর তার পাশেই আরেকজন, একটু হালকা মেজাজের, তীক্ষ্ণ চোখ, হালকা দাড়ি, গা ছমছমে চেহারা। পরনে তারও ফরমাল ড্রেসআপ। তিনি লাবিব চৌধুরী।
সবার চোখ ছানাবড়া। মেহরিন, চুমকি সবাই হতবাক এরা কারা?
আকরাম চৌধুরী মঞ্চ থেকে হাসতে হাসতে বলেন,
— এই দুই ছেলেকে আমি আমার ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। একটাকে আমি নিজের মস্তিষ্কের বুদ্ধি বলি, আরেকটাকে বলি সাহসের প্রতিচ্ছবি।
তারপর রাজ আর লাবিব এগিয়ে গিয়ে জাহানারা বেগম ও ফাইজা চৌধুরীর পা ছুঁয়ে সালাম করে। আর উপস্থিত জনতা করতালিতে ফেটে পড়ে।
তাদের আগমনে যেন পুরো জমিদার বাড়িতে একটা আলাদা আবহ তৈরি হয়—যেখানে পুরনো দিনের জমিদারী গৌরব আর আধুনিক সময়ের সম্মান মিলেমিশে এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করে।
আলো ঝলমলে উঠোন, সজ্জিত মঞ্চ, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আকরাম চৌধুরী। তার পাশে রাজ আর লাবিব, দুই যুবক। কারও চোখে আত্মবিশ্বাস, কারও চোখে স্নিগ্ধ গম্ভীরতা। অতিথিদের চোখ এখন ওদের দিকেই স্থির।
আকরাম চৌধুরী মাইক্রোফোনে আবার বললেন, এবার তাঁর কণ্ঠে একরকম আবেগ মিশে গেল,
— আপনারা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন, কারা এই দুই যুবক—রাজ আর লাবিব?হয়তো ভাবছেন কারা এর যাদের আমি ভিআইপি গেস্ট বললাম।আজ আমি আপনাদের সাথে আমার জীবনের একটা বিশেষ অধ্যায় ভাগ করে নিতে চাই।
তিনি রাজের দিকে ইশারা করে বলেন,
— এই ছেলেটা, রাজ, আমার একমাত্র বোনের সন্তান। আমার আদরের ফারজানা আপার শেষ স্মৃতি। ছোটবেলা থেকেই হার না মানা এক যোদ্ধা। মনের জোর ওর মধ্যে ছিল। আজ যা হয়েছে, ওর নিজের চেষ্টায়।
তারপর তিনি হাত রাখলেন লাবিবের কাঁধে।
—আর এই ছেলেটি, লাবিব, আমার একমাত্র ছোট ভাই আসলামের ছেলে। ওর চোখে আমার ভাইয়ের স্বপ্ন, আর মনের ভেতরে একটা অসম্ভব জেদ।
একটু থেমে, চোখের কোণ মুছলেন তিনি।
— আমার ভাই, আমার বোন…আজ তারা নেই। একটা দুর্ঘটনায় আমি আমার ভাই বোন আর দুলাভাইকে হারিয়েছি কিন্তু এরা আছে। ওরা দুজন শুধু ভাইয়ের বা বোনের সন্তান না, ওরা আমার আত্মার অংশ। ওরা দুজন দুজনের পরিপূরক। একজন আগুন, একজন ঠান্ডা জলের মতো। আজ ওদের আমি আপনাদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিতে পেরে গর্বিত।
ওরা বিগত ১৮ বছর মালয়েশিয়াতে ছিল। কিছু দিন হয়েছে বাংলাদেশে এসেছে।মালয়েশিয়াতে ওরা দুজনে সফল বিজনেসম্যান। বাংলাদেশে এসেও নিজেদের বিজনেসের ভালোই উন্নতি করেছে।
তারপর শুরু হলো পরিচয়ের পর্ব।
— এই যে, এ হচ্ছেন আমার আম্মাজান রাজ লাবিব তোমাদের নানিমা আর দাদিমা আর এ আমার স্ত্রী ফাইজা চৌধুরী … রাজ তোমার মামি, লাবিব তোমার বড় মা। আর এদিকেই ও হচ্ছে তোমার বড়মার ভাই এবং তার স্ত্রী মেহরিনদের দিকে দেখিয়ে বলল আর ওরা হচ্ছে ওদের ছেলে মেয়ে। আরফা আর আরশ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। লাবিবা আর রাজ আরশের সাথে কোলাকুলি করলো।
আর রাজ? সে তখন সবার দিকে মাথা নিচু করে সৌজন্যে সালাম দিচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে লাবিব শান্ত চোখে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আকরাম চৌধুরী হাত তুললেন,
— আজকের এই আনন্দে আমাদের পরিবারকে আরও আপন করে নিই। কারণ পরিবার মানেই বন্ধন… আর বন্ধন মানেই ভালোবাসা।
হঠাৎ জাহানারা বেগম রাজ আর লাবিবকে দেখে ছুটে এলেন সামনে।
দুটো ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
— আমার রাজ… আমার লাবিব… তোরা এত বড় হয়ে গেছিস… আমি যে চোখে দেখেও চিনতে পারতেছি না…
লাবিব আর রাজ দুজনেই জড়িয়ে ধরলো জাহানারা বেগম কে। তারপর লাবিব বলে, তো তুমি কি আমাদের সারা জীবন ছোট থাকতে বলছো। নিজে তো বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে গেছো এমনকি নাতি নাতনি ও দেখে ফেলেছো। আর আমাদের ছোট রাখতে চাও বলি কেন গো! আমরা কি বিয়ে শাদী করব না।অবাক হওয়ার ভান করে বলে, তুমি মনে মনে এত বড় ষড়যন্ত্র করে রেখেছো দাদিমা? ইটস নট ফেয়ার।
জাহানারা বেগম লাবিবের কান টেনে ধরে, বলে ছোটবেলার মতো দেখে এখন আমাকে খই ফুটে তোর। লাবিব সামান্য হাসলো। জাহানারা বেগম ওদের ধরে কান্না করে যাচ্ছে এখনো।
লাবিব এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে এক গলা চিৎকার করে উঠল,
— উফফ দাদিমা! এমন করে কান্না করতেছো কেন? এমন কান্না তো টেলিভিশনে সিরিয়ালের বউ মরলে করে!
চারদিকে ফিসফাস হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
লাবিব থামল না।
— একটা কথা বলি?
জাহানারা বেগম চোখ মুছে বলেন, কি কথা?
_এমন কাঁদতেছ যেনো তোমার জামাই মারা গেছে!
এক সেকেন্ড চুপ… তারপর নিজের কথা নিজেই ধরল,
—ও হ্যাঁ, মারা তো গেছেই! ঠিকাছে ঠিকাছে, আমরা দুই জামাই রিপ্লেসমেন্ট তো আছিই!
রাজ তখন মুখ ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বলল,
—লাবিব চুপ করবি তুই !একটু সিরিয়াস হ…”
লাবিব কনুই দিয়ে ওকে খোঁচা দিয়ে বলল,
— ব্রো, সিরিয়াস তো তোমাকে দেখতে বলল কেউ? আমি তো সবার মন ভালো করার মিশনে আছি! দেখছো না সেই কখন থেকে পরিবেশটা কেমন জানি হয়ে গেছে! সেটাকেই এগুলো ঠিক করছি।
চুমকি হেসে বলে,
— এই মিশন খুব বিপজ্জনক মনে হচ্ছে!
আরফা বলল,
— আমি তো ভাবছি, লাবিব ভাইকে নাটকে নামিয়ে দিই—‘দাদি ও দুই জামাই’- নামে!
জাহানারা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
— চুপ কর মুখ-পুরি।
কিছু একটা মনে করে জাহানারা বেগম একবার লাবিবের দিকে তো একবার রাজের দিকে তাকায়।
তারপর সন্ধিহান গলায় জিজ্ঞেস করে, এই ছেমড়া, তোরা আবার কোন বিলেতি সাদা চামড়ার মাইয়ার লগে প্রেরেম ট্রেরেম করস নাই তো? দেখ বাপু আমি কইলাম ওই সব মাইন্না লমু না। আমার নাতি বউ আমি খুজমু।
রাজ আর লাবিব এক সাথে বলে উঠে,না না তেমন কিছু না আমরা তো কাজে বেস্ত থাকতাম অসবের সময় ছিলো না।
লাবিব দুখী দুখী মুখ করে বলে, ব্রো তো একটা মেশিন দাদিমা। কি আর বলবো তোমাকে দুঃখের কথা।নিজে তো মেশিনের মতো সারাদিন কাজ করে গেছে সাথে আমাকেও কাটিয়েছে। একটু বসার টাইম পাইনি সেখানে প্রেম-ট্রেম করবো কি করে।
আমার ব্যাপারটা একদম শিওর যে আমি কোনো প্রেম-টেমের চক্করে নেই তবে ব্রো’র টা বলতে পারলাম না। কথা টা মেহরিনের দিকে তাকিয়ে
জাহানারা বেগম রাজ কে বলে, তুই কি কাউরে পছন্দ করিস বাছা?
রাজ মেহরিনের দিকে তাকায় তার পর জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে, পছন্দ করলে ও এমন কাউকেই করবো যাকে তোমার ও পছন্দ হবে।
তারপর লাবিবের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙানি দিলো। লাবিব মিটিমিটি হাসছে সাথে আরশ আর মাহির ও।
তার পর
লাবিব সোজা জাহানারা বেগমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
— দাদিমা, তুমি চাইলে আমরা এখানে থেকে যাই। তবে একটা শর্ত আছে!
— কি শর্ত? সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল।
— আমাকে সকাল-বিকাল পায়েস খাওয়াইতে হবে।আর ব্রো কে একটু নরমাল হওয়া শিখাতে হবে।
রাজ চোখ বড় বড় করে বলল,
— হোয়াট? এনি চান্স তুই কী বলতে যাচ্ছিস আমি নরমাল না।
লাবিব হেসে বলে,
— দেখছো ব্রো তুমি এখনো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো।আমি এটা বলছি তার কারণ তুমি মায়ের কোল থেকে নেমেছো সিরিয়াস হয়ে, আর আমি নামছি হাস্যকৌতুকে!
সবাই হেসে লুটোপুটি।
আরশ তো বলে বসে,
— এইটা তো দেখছি জমিদার বাড়ির গ্যাদারিং না, পুরা কমেডি ফেস্টিভ্যাল!
এমনই হাসির রোল, আবেগের ছোঁয়া আর অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে শুরু হয় জমিদার বাড়ির সেই রাতের মধুর উৎসব।
রাত তখন পুরো জমজমাট। জমিদার বাড়ির বিশাল উঠোনে সাজানো হয়েছে একটি মনোরম স্টেজ। চারপাশে বর্ণিল আলোর রোশনাই, রঙিন ফুলের বাহার আর চমৎকার সংগীতের সুরে চারদিক মুগ্ধ। অতিথিরা যার যার সিটে বসে, কেউ আবার দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে। বড় পর্দায় ভেসে উঠছে একের পর এক পারিবারিক ছবি—আকরাম চৌধুরী ও ফাইজা চৌধুরীর জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো।
স্টেজে মাইকে ভরাট কণ্ঠে ঘোষক জানালেন,
— এখন আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে আজকের সন্ধ্যার মূল নায়ক-নায়িকা, আমাদের প্রিয় আকরাম চৌধুরী ও ফাইজা চৌধুরীকে!
এক মুহূর্তে আলোর স্পট স্টেজে পড়ে। হালকা সোনালি পোশাকে ফাইজা চৌধুরী, আর পাশে সাদা-পান্না সবুজ পাঞ্জাবিতে আকরাম চৌধুরী উঠে এলেন স্টেজে। করতালির ঝড় উঠলো চারপাশে।
আকরাম চৌধুরী মাইকে নিয়ে এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন,
— এই ভালোবাসায় ভরা মুহূর্তের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আজ যারা এখানে আছেন, তারা কেবল অতিথি নন—আমার পরিবারের অংশ। এই বাড়ির প্রতিটি স্মৃতি আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে পেরে আমি ধন্য।
এক এক করে কিছু ঘনিষ্ঠ অতিথি মাইক হাতে তুলে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলেন। কেউ বললেন কীভাবে আকরাম চৌধুরী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কেউ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ছোটবেলার গল্প শোনালেন। ফাইজা চৌধুরীর সহপাঠিনী বললেন,
— ওনারা ছিলেন তখনকার প্রেমের আদর্শ জুটি!
তারপর আরশ বলল,
— এবার আমাদের অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ: পারফরম্যান্স বাই চুমকি, মেহরিন, মেহবুবা ও আরফা!
চারজন একসাথে মঞ্চে উঠল। পরনে ঘিয়ে, সবার শাড়ি, মুখে স্নিগ্ধ হাসি। প্রথমে তারা করল এক চমৎকার রবীন্দ্রনৃত্য—‘আমার পরান যাহা চায়’। তারপর মেহরিন চুমকি আর আফরা করল একটি ফিউশন ফোক-ডান্স, বিজলি কি রানী মে হু আয়ি! যা দেখে পুরো স্টেজ যেন প্রাণ ফিরে পেল।
তালিতে মুখরিত হয়ে উঠল উঠোন। অতিথিরা মোবাইল ক্যামেরা হাতে ব্যস্ত, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে তালি দিচ্ছে। মেহরিন ঘুরে তাকাল স্টেজের এক পাশে—মাহির দাঁড়িয়ে হালকা চোখ টিপে বলল,
— সাবাশ আমাদের নাচের রাণী!
পারফর্ম্যান্স শেষে ফাইজা চৌধুরী নিজেই মঞ্চে এসে চারজনকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখে জল, মুখে হাসি।
— তোমরা আমার দিনটাকে সোনায় মাখিয়ে দিলে।
রাত গভীর হচ্ছিল, কিন্তু সেই আলোর মাঝে যেন হৃদয়ের উষ্ণতা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।
চুমকি, মেহরিন, মেহবুবা আর আরফার পারফরম্যান্স শেষ হয়েছে। পুরো জমিদার বাড়ির উঠোন তখনো করতালের গুঞ্জনে মুখর। দর্শকরা যেন চোখ সরাতে পারছে না স্টেজ থেকে। আলো নিভে এসেছে সামান্য, কিন্তু মেহরিনের হাসির ঝিলিক এখনো উজ্জ্বল।
স্টেজ থেকে নেমে আসার সময় হঠাৎ মেহরিন চোখে পড়ে—রাজ দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে, একেবারে স্থির হয়ে। চোখ-মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই, যেনো সময় থেমে গেছে সেই মুহূর্তে।
চুমকি কনুই দিয়ে গুঁতো দেয় মেহরিনকে, ফিসফিস করে বলে,
— দ্যাখ, কে হা করে তাকিয়ে আছে!
মেহরিন গালের পাশটা চেপে হালকা লাজ্জা পেলেও এটা তুমি কি কে বুঝতে না দিয়ে বলল,
— আজব আমি দেখে কি করব। তাকিয়ে আছে তাই বলে কি আমি গিয়ে চোখে গুতা দিয়ে বলবে এই ব্যাটা আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?হুহ…
ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাবিব হেসে বলে ওঠে,
— ব্রো মুখটা বন্ধ করো নয়তো মাছি ঢুকে যাবে, তুমি যে এভাবে কেবলাদের মত তাকিয়ে আছ তা কিন্তু ওরা দেখছে। দ্যাখো চেহারার কি অবস্থা!
রাজ তখনো কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ওর চোখ শুধু মেহরিনের দিকেই, একদৃষ্টিতে। তখনই পাশে থাকা মাহির বলে এভাবে তাকিয়ে থেকো না। সে কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস ! রেগে গেলে কিন্তু এসে চোখের ঘুসি মারবে। রাজের ধান ভাঙ্গে হীরের কথা শুনে হেসে ফেলে। লাবিব, রাজ, মাহির হেসে হেসে কথা বলছে।
মেহরিন একটু ভ্রু কুঁচকে চুমকিকে বলে,
— দেখো তো চুমকি, মাহির ওর সঙ্গে কীভাবে কথা বলছে, মনে হচ্ছে যেনো বহুদিনের চেনা!
চুমকি ভ্রু তুলে বলল,
—হ্যাঁ রে! আমিও সেইটাই ভাবছিলাম। কেন যেনো এমন সহজ কথাবার্তা…! আমার ঠিক হজম হচ্ছে না।
আচ্ছা বাদ দে, পরে জিজ্ঞেস করে নিবো।
তখনই মাইক হাতে নিয়ে স্টেজে উঠে আসে আরশ। জমিদার বংশের নাতি হলেও ছেলেটার মুখে সদা হাসি, কণ্ঠে প্রাণ। সে মাইকের দিকে এগিয়ে যায়, একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সবার উপর, তারপর বলে:
— আমার দারুণ পারফরম্যান্স দেওয়া বোনদের জন্য আরেকটা ছোট্ট উপহার আছে। এবার মঞ্চে আসছে আমার বড় ভাই রাজ। ও আমাদের জন্য একটা গান উপহার দেবে।
মঞ্চের আলো আবার ছড়িয়ে পড়ে। দর্শকরা চমকে ওঠে—রাজ গাইবে? কেউ জানত না!
মেহরিন হালকা চমকে বলে,
— উনি গানও গাইতে পারে?
লাবিব ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে পাশ থেকে বলে,
—এইটা ব্রো’র গোপন প্রতিভা। সেই প্রতিভা আজ কারো জন্যই সব উজাড় করে দিবে মনে হচ্ছে।
আলোয় উজ্জ্বল। মানুষে মানুষে ভরে উঠেছে আঙিনা, জমিদার বাড়ির এই প্রাণবন্ত সন্ধ্যায় সব চোখ এখন মঞ্চের দিকে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রাজ, হঠাৎ করেই মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিল। তার ঠোঁটে এক চাপা হাসি। আশপাশ নিস্তব্ধ। তারপর…
একটা মৃদু সুর বাজে পেছনে।
আর রাজ গাইতে শুরু করে—
“দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না”
“দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না”
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন যে আর মানে না….
কাছে আইসো বন্ধু প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো রে বন্ধু আমায় যতনে….
নিশি ভোরে জোনাক নাচে মনের গহীন বনে
স্বপ্ন দেখ বন্ধু তুমি নিগুঢ় আলিঙ্গনে
নিশি ভোরে জোনাক নাচে মনের গহীন বনে
স্বপ্ন দেখ বন্ধু তুমি নিগুঢ় আলিঙ্গনে
তোমায় মায়া দিলাম সোহাগ দিলাম
নিলাম আপন করে
পাশে থাকব রে বন্ধু তোমার কারণে
ভালোবাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
আমার মনের ঘরে চাঁদের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে
পুষে রাখবো রাখবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
ভালোবাইসো রে বন্ধু আমায় যতনে
ভালোবাইসো রে বন্ধু আমায় যতনে…..
মেহরিন থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ জেগে ওঠে।
এই গান এই গলার সুর… এই আবেশ… এই ঝরঝরে অনুভব…
মেহরিনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
— এই গান … এই গলাটা তো কবি সাহেবের!
সে ঠিক সেদিন রাতে শুনেছিল,তার আগেও একদিন শুনেছে,ঘরের এক কোনায় বসে কে যেন সেই একই ভঙ্গিতে এই গানটা গেয়েছিল।
মেহরিন কাউকে দেখেনি কিন্তু সুরটা এটা তো কবি সাহেবের—সেই কবি-সাহেব, যার লেখা কবিতায়, হঠাৎ-করা কথায়, মেহরিন বহুবার নিজেকে খুঁজে পেয়েছে।
পাশ থেকে মেহবুবা হঠাৎ মেহরিনের হাত চেপে ধরে।
সে ফিসফিসিয়ে বলে,
— এই গলা… সরি… সেদিন রাতে…
কথাটা আর শেষ হয় না।
মেহরিন তাকিয়ে থাকে স্টেজের দিকে। রাজ গাইছে এখনো, কিন্তু মেহরিনের ভেতরে যেন এক বিস্ফোরণ ঘটে গেছে।
শরীর কাঁপছে, হাত ঠান্ডা হয়ে এসেছে।
তার মনে হচ্ছে, যেনো চেনা এক মানুষ হঠাৎ অচেনা রূপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সে আর চোখ সরাতে পারছে না। কণ্ঠের প্রতিটি সুরে তার বুকের ভিতর কাঁপছে।
রাজ তখনো গাইছে, আর মেহরিন টের পাচ্ছে—এই ছেলেটা শুধু গাইছে না, তার মনের সমস্ত কথাগুলো যেনো সে গানের সুরে ঢেলে দিচ্ছে।
এটাই কি কবি-সাহেব?
এটাই কি সেই অচেনা, অথচ এত চেনা কণ্ঠ?
এটাই কি… আমার কবি সাহেব?
গান শেষ হতেই রাজ হালকা করে হাসল। তার চোখে একরাশ স্নিগ্ধ আলো। সেই হাসি ছুড়ে দিল ঠিক মেহরিনের দিকে। যেনো গানের প্রতিটি শব্দের অর্থ জানে সে, আর জানে—এই মুহূর্তে মেহরিন ঠিক কতটা এলোমেলো।
মেহরিন কাঁপা ঠোঁটের কোণে নিজের অনুভূতি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে—
—পেছনে কোথা থেকে যেনো ছায়ার মতো এগিয়ে এল একটা ছেলে।
চেহারায় অদ্ভুত এক ঘৃণিত স্পর্শের আগ্রহ।
সে মেহরিনের একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যেনো সুযোগ নিয়ে ছুঁয়ে দেবে তাকে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই… হঠাৎ এক ঝড় নেমে এল।
রাজ, যার চোখ সেদিকেই আটকে ছিল, মুহূর্তেই সুর আর নরম আলো ভুলে এক দৌড়ে স্টেজ থেকে নেমে এল।
পায়ের নিচে মেঝে যেনো তার রাগের তাপেই কেঁপে উঠল।
লোকজন কিছু বোঝার আগেই রাজ ছেলেটার হাতটা খপ করে চেপে ধরল।
চোখ দুটো লাল, যেন আগুন জ্বলছে!
—”রাস্কেল!”—গর্জে উঠল রাজ।
—মেয়েদের সুযোগ নিচ্ছিস? সাহস কোথায় তোদের?
তারপরই ধপাস!
এক ঘুষি পড়ল ছেলেটার নাক বরাবর।
ছেলেটা আর্তনাদ করে কুঁকড়ে গেল। লোকজন ছুটে এল, চিৎকার শুরু হয়ে গেল চারপাশে।
রাজ আরেকটা মারতে যাচ্ছিল, তখনই আরশ আর লাবিব এসে তাকে জাপটে ধরল।
—ভাই! শান্ত হও! এটা পাবলিক প্লেস! — আরশ বলল।কি হয়েছে কি করেছো বলো আমাকে?
—”তুই ছাড় আমাকে! তুই জানিস ও কি করতে চেয়েছিল! যদি আজ ওর গায়ে একটা আঁচড়ও পড়তো, আমি তোকে খু’ন করে ফেলতাম ব্লাডি বিচ নিচে পড়ে থাকার ছেলেটাকে লাথি দিয়ে বলল রাজ!—রাজের গর্জনে মাইক্রোফোন ছাড়াই সবাই থেমে গেল।
মেহরিনার অসভ্যতা করতে চেয়েছিল শোনা মাত্রই আরে গিয়ে দুটো লাথি মারলো ছেলেটাকে।আশেপাশের মানুষ আরশ কে ধরল।
রাজ এখনো রাগে গজগজ করছে,
লাবিব কানে কানে বলল,
—ব্রো কুল ডাউন,এখানে অনেকেই আছে।
রাজ বলে, আই ডোন্ট কেয়ার! চারপাশের পরিবেশ দেখে রাজ একটু শান্ত হয়।
তার পর রাজ দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
—”তোদের মতো জানোয়াররা এই সমাজে মানুষের মুখ কালো করে। আজ তো তুই বেঁচে গেলি… সামনে যদি চোখে পড়িস, হাত-পা ভেঙে দেবো!
সবার চোখ তখন রাজের দিকে।
মেহরিন স্তব্ধ। তার হৃদস্পন্দন যেন রাজের সেই ঘুষির মতোই শক্ত, তীব্র আর গর্জনময়।
ঠিক তখনই ভিড় ঠেলে সামনে এসে দাঁড়াল আকরাম চৌধুরী। চোখ জ্বলছে রাগে, কণ্ঠ নরম হলেও তাতে চাপা বিষ।
তিনি ছেলেটির সামনে এসে একবার তাকালেন…
—এই ছেলে, তোকে কে দিয়েছে এত বড় সাহস?
তারপর কারো কিছু বোঝার আগেই ঠাসসস!
করে এক চপেটাঘাত করলেন ছেলেটার গালে। সেই শব্দে মাইকের আওয়াজ থেমে গেল যেন, ভিড়ের মাঝে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।
—আমার পরিবারের মেয়েদের দিকে বাজে নজর, আর তা-ও এই বাড়িতে দাঁড়িয়ে? তুই বেঁচে গেছিস রাজ আগে দেখেছে তোকে। আমি দেখলে আর হাত ছাড়তাম না।
তারপর ওনি পুলিশকে ডাকতে বললেন,
— ছেলেটাকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হাতে তুলে দিন। এই ধরনের লোক সমাজে ঘুরে বেড়ানোর যোগ্য না।
পুলিশ এসে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে গেল। মানুষজন প্রশংসা আর গুঞ্জনে ব্যস্ত, কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে। এর মাঝেই আকরাম চৌধুরী এগিয়ে এসে রাজের কাঁধে হাত রাখলেন।
—তুমি আজ প্রমাণ করে দিলে,তুমি তোমার বাবার আদর্শ ছেলে।তোমার বাবা ও একজন এমন মানুষের ছিল।আমি তোমার ওপর গর্বিত রাজ।
রাজ নিচু গলায় মাথা নোয়ালো,
—এই বাড়ির মেয়ে-দের সম্মান আমার নিজের সম্মানের চেয়ে কম নয়।
চোখে ভেজা আবেগ, চারপাশে গর্ব আর গুঞ্জন…
আর দূরে দাঁড়িয়ে মেহরিন, যার বুকের ভেতরটা তখনো ধুকধুক করে কাঁপছে। কিন্তু চোখে এখন ভয় না—শ্রদ্ধা। রাজকে সে এক নতুন আলোয় দেখছে… একজন যোদ্ধা, একজন নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে।
অনুষ্ঠানের উষ্ণতা ধীরে ধীরে আগের ছন্দে ফিরছে। আলোর ঝলকানি, মানুষের হাসি, আর বাদ্যের তালে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে চারপাশ। কিন্তু এই হইহুল্লোড়ের মাঝেও মেহরিন একা। একেবারে একা।
চোখে তার একধরনের নিরব ঝড়। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, ঠোঁট কামড়ে ধরে ভীড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বলছে—
এই লোকটা… ইচ্ছে করেই আমার সামনে আসেনি। ইচ্ছে করে আমায় কষ্ট দিয়েছে। এখানে এসে, একবারও বলে না—‘আমি আসছি’। আমায় জানাতে পারত না? আমি কি এতটাই অবাঞ্ছিত? আমার কোন মূল্যই নেই তার কাছে!
অভিমান তার বুকের ভিতর চেপে বসেছে। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে উঠেছে কষ্ট, আর চোখের কোনা ভিজে উঠছে অজান্তেই।
ঠিক তখনই রাজ এগিয়ে আসছিল মেহরিনের দিকে। ধীর পায়ে, চোখে মিশ্র আবেগ—অপরাধবোধ, অনুভব, আর একরাশ অনুশোচনা।
মেহরিন হঠাৎ রাজকে দেখতে পেয়ে থমকে গেল। একটা মুহূর্তের জন্য চোখে চোখ পড়ল দুজনের। রাজ এগিয়ে আসে, যেনো কিছু বলবে… হয়তো “তোমার চোখের জল আমি চাইনি” —এমন কিছু।
কিন্তু মেহরিন আর দাঁড়ায় না। সেই চেনা রাগ, সেই পুরনো অভিমান তার সমস্ত শরীর জুড়ে তীব্র হয়ে উঠল।
এক দৌড়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে যায় সে। তার চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ছে, কাঁধে আঁচলটা ঝুলে পড়ছে, আর চোখের পানি গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে।
রাজ থেমে দাঁড়ায়। তার চোখে বিস্ময়, আর সাথে বুকের গভীরে হালকা একটা খালি শূন্যতা।
সে শুধু ফিসফিস করে বলে ওঠে,
—“আরিওনা…”
কিন্তু উত্তর আসে না। কেবল সিঁড়ির ধাপে ধাপে মেহরিনের কান্না মেশানো পায়ের শব্দ হারিয়ে যায় জমিদারবাড়ির দোতলার নীরবতায়।
দৌড়ে যেতে দেখে মালিহা মির্জা বলে ওঠেন,মেহু আস্তে যা পড়ে যাবি তো। এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারিনা হাতে পায়ে বড় হয়েছে, একটু বুদ্ধিশুদ্ধি যদি থাকতো।
দোতলার করিডোর ধরে ছুটে যাচ্ছে মেহরিন, চোখের পানি আর অভিমানের জ্বালায় তার মুখখানা লাল হয়ে উঠেছে।
মেহরিন থমকে যায়। চোখে জল, মুখ ঘুরিয়ে রাখে—কান্না যেন না দেখে কেউ।
মেহরিনের দাঁড়ানো দেখে চুমকি আর মেহবুবা ছুটে আসে ওপরে।
আর মেহবুবা মুচকি হাসি, কিন্তু চোখে গভীর দৃষ্টি। সিঁড়ির ধাপে থেমে গিয়ে একবার নিচে তাকিয়ে থাকা রাজের দিকে, আর একবার কাঁদতে থাকা বোনের চলের দিকে তাকিয়ে বলে—
—এতদিন আমার বোনের ভালোবাসা দেখেছেন, এখন ওর অভিমানটাও দেখুন। খুব রেগে গেছে ও… আর আপনি, কাজটা একদমই ঠিক করেননি। আজ আপনি এখানে আসবেন—এটা একবার বলেই দিতে পারতেন না?আমার বোনের কবি সাহেব!
শেষ কথাটা একটু টেনে বলে মেহবুবা। তারপর আর দাঁড়ায় না—এক দৌড়ে চুমকির সাথে চলে যায় দোতলার দিকে।
রাজ একবার মাথা নিচু করে হাসে। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো অভিমান মেশানো প্রশ্রয়—সে এক দারুণ দৃশ্য।
ঘাড় একটু কাত করে ফিসফিস করে বলে—
—বুঝেছি, ম্যাডামের অভিমান ভাঙাতে হবে। তবে সমস্যা নাই… অভিমান তো আমি ভাঙাবই। রেডি থাকবেন, ম্যাডাম!
তার চোখে এখন আর দ্বিধা নেই, শুধুই অদম্য একটা সংকল্প।
পুরো ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা বাতাসে কাঁপছে পর্দা, আর বিছানার একপাশে চুপচাপ শুয়ে আছে মেহরিন। মুখটা বালিশে গুঁজে রেখেছে, চোখের পানি এখনও শুকায়নি। মন ভরা অভিমান, মন ভরা কষ্ট—একটু ভালোবাসার প্রতীক্ষা।
চুমকি আর মেহবুবা পাশে বসে। কেউ ওর পিঠে হাত রাখছে, কেউ চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে—কিন্তু তবুও কিছুতেই মেহরিনের কান্না থামছে না।
মেহবুবা একটু বিরক্ত হই-হই গলায় বলে,
—এই মেয়ে, কাঁদলে কিন্তু চোখ ফুলে যাবে! কবি সাহেব যদি এখন আসে,তখন তোর চোখ মুখ ফোলা দেখে তখন না ভাবে যে তোকে ভূতে ধরেছে।
মেহরিন বালিশে মুখ গুঁজে গোঁ গোঁ করে কিছু একটা বলে, বুঝাই যায় না কিছু।
চুমকি তখন উঠে দাঁড়ায়। একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,
—ঠিক আছে, এখন আমি গান গাই। দেখি এই মেয়ে হাসে কিনা!
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে চুমকি গাইতে শুরু করে—
কেমন করে এতো নিঠুর হইলো তোমার মন
তুমি মনটা আমার ভাংঙা দিলা
করিয়া আয়োজন
হেই….
কেমন করে এতো নিঠুর
হইলো তোমার মন
তুমি মনটা আমার ভাংঙা দিলা
করিয়া আয়োজন
মনেতে গুরে গুরে আমার এ অন্তরে
প্রেমেরি আকাঙা, ও পাংখা
গানের গলা যেমনই হোক না কেন, মেহরিন ঠিক চিনে ফেলে এই গলাটা কাদের অনুকরণে গাওয়া। সে এক ঝটকায় উঠে বসে, চোখ বড় বড় করে চুমকির দিকে তাকায়,
_তুই কি গান গাচ্ছিস, হ্যাঁ? থামবি তুই? থামবি?
চুমকি গান থামায় না, বরং গলার স্বর আরও নাটকীয় করে,
—”কেমন করে এতো নিঠুর হইলো তোমার মন
তুমি মনটা আমার ভাংঙা দিলা
করিয়া আয়োজন
—চুপ!!
বলেই মেহরিন ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমকির ওপর, বালিশ দিয়ে পেটাতে থাকে।
চুমকি কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসে, আহা বাঁচাও, মেহবুবা ! আমাকে বাঁচা!
মেহবুবা পাশে বসে হেসে কাঁপছে। এক পর্যায়ে মেহরিনও আর রাগ ধরে রাখতে পারে না, হেসে ফেলে। তিনজন একসাথে হেসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। হাসির মধ্যে কষ্টটা কোথাও মিলিয়ে যায়।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২০
চুপচাপ বাতাসে ভেসে আসে সেই পুরনো বন্ধুত্বের গন্ধ, সেই নির্ভরতার অনুভব, যে অনুভবে কোনো রাজের না বলা কথা আর কোনো অভিমান টিকতে পারে না বেশিক্ষণ।
কিন্তু কবি সাহেবর উপর ভারি অভিমান জমে রইলো মেহরিনের। মনে মনে পন করলো আর কথাই বলবে না।