মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২২

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২২
মির্জা সূচনা

রাজ এখনও দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির পাশে । হঠাৎ পাশ ফিরে দেখে লাবিব তার দিকে এক ব্রু উচুঁ করে তাকিয়ে আছে।
_ হোয়াট?
_কিছু না, দেখছি।
_কী?
_কিভাবে তুমি একটা অবলা মেয়েকে চোখ ধুয়ে গিলে খাচ্ছো।এটা বলেই নিজের মুখ চেপে ধরে লাবিব।
_হোয়াট রেগে বলে রাজ।
_না না মানে,আসলে কথা টা আমি বলি নি!আমার মুখ বলছে ব্রো। বিশ্বাস মি ব্রো। আজ কাল আমার মুখ আমার কথা শুনছে না, অটো হয়ে গেছে,আমি চেয়ে ও কিছু করতে পারছি না। ব্রো আমার মনে হয় বড় কোনো বেমো হয়েছে।

_অল রাইট! তোকে থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি, জাস্ট ওয়েট।তখন তোর মুখ হাত-পা বডির প্রত্যেকটা পার্ট তোর কথা শুনবে।
_লাবিব শুকনা ঢোক গিলে বলে,ব্রো একটু টেনে বলে। আমি আমার না হওয়া বউয়ের কসম করে বলছি, আমার মুখ হাত পা আর অটো হবেনা , অটো হতে চাইলে আমি প্রয়োজনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো বিশ্বাস মি ব্রো।
রাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বলে, তুই কখনো ভালো হবি না।
লাবিব হেসে বলে,আই এম গুড বয়। ইউ নো ব্রো।
রাজ মুখ শক্ত করে বলে উঠল,
—ওই রাস্কেলটাকে আমার চাই।
লাবিব একটু চমকে বলল,
—কাকে কথা বলছো ব্রো? একটু ভেবে বলে ওহ ওই ছেলেটা, যে ভাবিকে টাচ করতে যাচ্ছিলো?
রাজ চোখ সরু করে একটা ধীর হেসে বলল,
— আমার সাথে থাকতে থাকতে তোর বুদ্ধির দরজা খুলে গেছে।তুই আর মাথামোটা নেই, একদম ওকেই বলছি।
লাবিব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—ওরে ব্রো! কিন্তু তুমি কি করবি ওর সাথে?
কণ্ঠে অদ্ভুত কৌতূহল।
রাজ মুখে ঠান্ডা একটা ডেভিল হাসি এনে বলল,
—তুই নিজেই দেখে নিস।এখন যেটা বললাম এটা কর ফার্স্ট। আমি কাউকে বুঝিয়ে বলি না, দেখিয়ে দিই।
লাবিব ওর এই হাসি দেখে নিজেই হেসে ফেলে
—উফ বেচারা ও জানেই না, কেউ রাজ শিকদারের শখের নারীর দিকে তাকানোর সাহসও করে তার চোখ উধাও হয়ে যায়। আর ওই ব্লাডি বিচ টা তো ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে।ইউ নো ব্র! ওই বেচারার জন্য আই ফিল ভেরি ভেরি কষ্ট।
দুইজন আরো বেশ কিছু কথা বলে।

রাত তখন বেশ গভীর। অনুষ্ঠানের ঝলমলে আলোর ভিড় কমে এসেছে। অতিথিরা একে একে বিদায় নিয়েছে। জমিদার বাড়ির ডাইনিং টেবিলে এখন কেবল পরিবারের সদস্যরা আর কাছের লোকজন।
সাজানো খাবারের ঘ্রাণে চারপাশ ভরে গেছে।
চেয়ার টেনে সবাই বসে পড়েছে। ফাইজা চৌধুরী হেসে হেসে বলছেন,
—আজকের পারফরম্যান্স দেখে তো আমি অবাক! আর রাজ বাবার গানের গলা… আহা! কিন্তু সব কিছু মাটি করে দিলো ওই বেয়াদপ টা কথা টা বলে রাগে গজ গজ করছেন ফাইজা চৌধুরী।
মালিহা মির্জা বলেন,যা বলেছেন আপা।আজ কালকার কিছু ছেলে মেয়ে একদম উচ্ছন্নে গেছে। কপাল ভালো যে খারাপ কিছু ঘটেনি তার আগেই রাজ দেখে ফেলেছিলো।

ফিরোজ মির্জা বলেন,আাহা তেমন কিছু তো হয় নি, তোমরা খামোখাই চিন্তা করো না। আর ভুলে যেওনা আমার মেয়ে ভিতু নয়। সে নিজেকে প্রোটেক করতে জানে।গর্ব করে বলেন উনি। কিন্তু রাজের কাছে আমি কৃতজ্ঞ ও সময় মত দেখেছিল বলেই আমার মেয়েকে কোন অপরিস্থিতিকর সিচুয়েশন পরতে হয়নি।
মালিহা মির্জা বলে,তা যা বলেছো।
রাজ মেহরিনের দিকে তাকায় তার পর আবার ফিরোজ মির্জার দিকে তাকিয়ে বিনার সাথে বলেন,এটা আমার কর্তব্য আঙ্কেল।আপনারা চিন্তা করবেন না আর যা হওয়ার হয়ে গেছে এ ব্যাপারে আর কিছু না বলাই ভালো।
জাহানারা বেগম বলেন,হ সক্কলে এই আলাপ বাদ দেও। যা হওয়ার তা হইয়া গেছে এ নিয়ে আর কথা কইও না বাপু কেউ।

সবাই ওনার কথাই মাথা নারে।
খেতে খেতে ফিরোজ মির্জা বলেন, তা বাবা রাজ তোমার বিজনেস কেমন চলে?
রাজ বলে, জ্বী আঙ্কেল আল্লাহর রহমতে ভালোই চলছে। নতুন একটা প্রজেক্টে কাজ করছি আশা করছি প্রফিট ও ভালো আসবে।
ফিরোজ মির্জা হেসে বলেন, ইনশাআল্লাহ। তা বিয়ে শাদীর কি প্লেন? কাউকে পছন্দ করো নাকি আমরা মেয়ে দেখবো?
এই প্রশ্ন শুনে সবার রাজের দিকে চায় , কী বলে তা শুনার আশায় সবাই।

লাবিব বলে,লে কাকে দিলো রাজার পাঠ।আরে আঙ্কেল আপনি যদি জানতেন, আপনার মেয়ের প্রেমে পড়ে আছে তিন বছর ধরে তাহলে আর একটু প্রশ্নটা করতেন না।খুব আস্তে করে বলো কথাটা লাবিব আর মাহির পাশে পাশেই শুনে ফেলে মাহির মিটিমিটি হাসে।আর রাজ ওর দিকে তাকাতেয় আবার খাওয়াতে মনোযোগ দেয় ভাব টা এমন যেনো তাই পৃথিবীতে শুধু খাওয়ার জন্য এসেছে ও পৃথিবীতে শুধু খাওয়ার জন্য এসেছে।
রাজ মুচকি হাসে, ফিরোজ মির্জার দিকে তাকিয়ে বলে, একজন আছে যাকে আমার ভালো লাগে।
মেহরিন তারক করে রাজের দিকে তাকায়! চোখে কৌতুহল মনে ভয় যদি এখন সবার সামনে বলে দেয়।
তুমি কি আর মেহবুবা হাসছে।

ফিরোজ মির্জা বলেন, বাহ বেশ ভালো কথা তো। কে সে আমাদের সাথে পরিচয় করাবে না।
রাজ মেহরিনের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বলে,তবে আঙ্কেল আমি তার কথা জানিনা তাকে আমার ভালো লাগলে ও তারা আমাকে ভালো লাগে কিনা এটা আমি জানিনা।
মেহেরিন একটা ভেংচি কাটে, রাজ তা দেখে মাথা নিচু করে হাসে।
আর এদিকে ফিরোজ মির্জা বলেন, অবশ্যই তোমাকে পছন্দ হবে কেন হবেনা। পছন্দ হওয়ার মতই একজন পুরুষ তুমি।আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না তুমি তার ঠিকানা আমাকে জোগাড় করে দিও আমি ওর বাবার সাথে কথা বলবো।
নিজের বাবার মুখে এই কথা শুনে কাশতে শুরু করল মেহরিন। রাজ বাঁকা হেসে মাহিরকে ইশারায় পানি দিতে বলে। মাহির পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয় মেহরিনের দিকে। মেহরিন পানিটা কোনো মতন খায়।
মালিহা মির্জা বলেন,আস্তে খাবি তো দেখলি? কেমন হলো বিষম উঠে গেলো।তোকে নিয়ে আর আমি পারিনা।
রাজ এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে ফিরোজ মির্জা কে বলে, আঙ্কেল আপনার হেল্প লাগবে আমার। আমাকে সাহায্য করবেন তো।

ফিরোজ মির্জা হেসে বলে, অবশ্যই ।
লাবিব ফিসফিসিয়ে বলে, বাহ ভাই বাহ,নিজের মেয়ের জন্য নিজেই ঘটকালি করতে চাইছে!আহা কি মানবতা!
রাজ পা দিয়ে একটা লাথি মারে লাবিবকে।লাবিব “আউউচ” বলে ওঠে!
সবাই লাবিবের দিকে তাকায় লাবিব ক্যাবলা হাসি দিয়ে বলে, ম মশা মশা, মশা কামড়াচ্ছে?
জাহানারা বেগম বলেন, মরজিনার মা, এই সকিনা এই কে কডাই আছোস, কয়েল লইয়া আয়! দেখসনা মুখ-পরীরা আমার নাতিন ডারে মশায় কামড়ায়। আহারে! আমার সুন্দর নাতি ডারে মশাই কামড়াতে কামড়াইতে লাল বানাই ফেলছে।
সবাই হাসে।
আরফা হঠাৎ হেসে বলে,

—তোমরা যাই বলো আজ কিন্তু আর আমাদের চুমকির ডান্স! ও মাই গড! ভাইরাল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে!
চুমকি বলে, কি যে বলিস না, ভাইরাল হলেই সবার সাথে ছবি তুলতে হবে। আর আমাকে যেখানে দেখবে সেখানেই সবাই ছবি তুলে নিবে তখন যদি আমার পোস ভালো না হয়, যদি উল্টাপাল্টা এঙ্গেল থেকে ছবি তুলে নেয়, তখন আমাকে শাকচুন্নির মত লাগবে। নো ওয়ে না বাবা থাক আমার ওসব ভাইরাল টাইরাল হতে হবে না। আমজনতাই ঠিক আছে ।
লাবিব বলে, আরে তা বললে হবে! তুমি ভাইরাল হলে তোমার নাম বেঁচে আমরাও কিছু কামাই করতে পারব। তুমি কেনো গরিবের পেটে৷ লাথি মারছো। পিলিজ তুমি ভাইরাল না হলেও একটু ভাইরাস হয়ে যাও।
সবাই হেসে ওঠে। হাসির রোল পড়ে যায় টেবিলে।
কিন্তু ওই কোন এক কোণে, খাবারের প্লেটের পাশে নিঃশব্দে বসে আছে মেহরিন। চোখ নিচু, শুধু খাবারে নাড়াচাড়া করছে, মুখে কিছু তুলছে না।

মেহবুবা একবার চোখ তুলে মেহরিনের দিকে তাকাল, আবার মাথা নামিয়ে হাসতে হাসতে আস্তে বলে উঠল,
—তুই আবার বোবা হয়ে গেলি কেন সামনে কবি সাহেবকে রেখেও মুখটাকে এমন পেঁচাদের মত করে রেখে কেন?
চুমকি মুখ চেপে হাসছে। আর মেহরিন কোনো জবাব না দিয়ে শুধু কপালের একটা কোণে চুল সরিয়ে রাখে—চোখের দিকে কেউ তাকালে টের পেত, ওখানে এখনও লুকিয়ে আছে কিছু অভিমান আর না বলা অনেক কথা।
খাওয়া শেষের দিকে যখন সবার মুখে হাসি, গল্প, মজার রেশ, তখন রাজ শুধু এক কোণে বসে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা পুরো খাবারের সময়টা একদম নীরব। হঠাৎ কেউ ডাকলে জবাব দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চোখে-মুখে এক অদ্ভুত অভিমান আর নিরব ক্ষোভ।

রাজ সেটা টের পেল।
ওর ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি খেলে গেল।
রাগে যখন মেহরিনের চোখ চিকচিক করে আর নাকের পাটা একাটু পর পর ফুলে যায়, তখন তাকানো যায় না। অথচ চোখ ফেরাতেও ইচ্ছে করে না, মনে মনে বলল রাজ।
কিন্তু কিছু বলল না।
কিছু করলও না।
শুধু ভেতরে ভেতরে একটা চিন্তা পাক খাচ্ছে—
ম্যাডামের এই রাগ ভাঙাতে হবে, তবে ঠিক আমার মতো করে। এমনভাবে, যেনো মনে থাকে… আবার যেনো ভালোবাসাও লুকিয়ে থাকে।

সবাই যার যার রুমে চলে গেছে।
জমিদার বাড়ির মেয়েদের ঘরে এখন আলো নরম হয়ে এসেছে। দেয়ালে ঝুলছে পর্দা, মেঝেতে ছড়িয়ে আছে শাড়ির খুঁচরানো পাড় আর কিছু জুতো।বিছানার শুয়ে আছে মেহরিন। মুখটা বালিশে গুঁজে রেখেছে, চোখে এখনও অভিমানী জল।
চুমকি ওর পাশে বসে হাত নেড়ে বলল,

—”এই তুই এমন মুখ করে বসে আছিস কেন? মনে হচ্ছে কেউ তোকে কেউ বনবাস দিয়ে গেছে আর বলেছে, সারাদিন মুখ টাকে পেঁচার মতো করে রাখতে!
মেহরিন কিছু বলল না।
মেহবুবা হেসে বলল,
—ঠিক,কবি সাহেব এসএমএস না দিলে মুখ ফুলিয়ে রাখিস, দেখা দেয় না বলে কত না কল্পনা জল্পনা করিস তাকে নিয়ে, আর এখন সামনে এলো তাও এমন করছিস আসলে তুই চাস টা কি মেরি মা?
চুমকি হেসে বলে উঠল,
—তোর সেই কবি সাহেবকে ফোন করে বলি, তার জন্য মেহরিন আপা ঠিক কতখানি ডিপ্রেশনে চলে গেছে!
তখন মেহরিন উঠে চুমকিকে বালিশ মেরে বলল,
—চুপ! একদম নাম নিস না ওই বাদরের!
চুমকি নাক টেনে বলল,

—আরে, নাম তো নিইনি! তুইই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?পিলিস আপা আপনি উত্তজিত হবেন না।
মেহবুবা বলে, আরে তখন ওর আবেগ কাজ করছে, বিবেগ কাজ করেনি! তখন ওর বিবেগ শশুর বাড়ি গুরতে গেছিলো।
এই কথায় তিনজন একসাথে হেসে পড়ে বিছানার ওপর। হাসি গড়ায় বালিশে, কাঁধে, চুলের ভেতর, আর সেই হাসির ভেতরেও একটু লুকিয়ে থাকে অভিমানী চোখের জল।

আর এই মুহূর্তে—বাড়ির অন্য এক কোনায়, রাজ নিজের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ভাবে,
রাগ ভাঙাবো… তবে এমনভাবে, যেন ওই চোখ থেকে হাসি বের হয়। পানি নয়।
জমিদার বাড়ির দোতলার দক্ষিণ কোণের রুমটা আলোয় ভরা। খাওয়াদাওয়া শেষে এখন একটু হালকা হাওয়া। জানালার বাইরে রাতের তারা জ্বলজ্বল করছে, আর ভেতরে চলছে তিনজনের কথার আড্ডা।
রাজ বিছানার একপাশে হেলান দিয়ে বসে আছে। লাবিব বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসেছে, আর আরশ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মাঝে মাঝে হাসছে।

হঠাৎ মাহির দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
—ভাইয়া, আমি কী একটু আসতে পারি?
রাজ তাকায়, হালকা হাসি দেয়।
—আয়, বস। এখন বুঝি হুমকি দিবি?
মাহির ঘরে ঢুকে গম্ভীর মুখে বলে,
—হুমকি না, ওয়ার্নিং।
লাবিব হেসে গড়িয়ে পড়ে বিছানায়,
—মাহির এখন ফিল্মি ভাইয়ের চরিত্রে!
মাহির গম্ভীর মুখেই বলে,

—দেখেন ভাইয়া, আমার আপু যেমন বাইরে থেকে নরম, তেমনই ভেতরে খুব স্ট্রং। একবার রাগ করলে সহজে ভাঙে না। আবার যে ভালোবাসে, তার জন্য অন্ধও হয়ে যায়। তাই কেয়ারফুল, খুব কেয়ারফুল থাকতে হবে।
রাজ ঠোঁটের কোণে একটুখানি চওড়া হাসি টেনে বলে,
—ভালো কথা বলেছিস… আমার তো শোনার শখ হয়েছে—কী করলে রাগ ভাঙে? সেটা বল।
আরশ হেসে বলে,
—ভাই, আগে রাগ করার কারণটা বুঝতে হবে। তারপর হাফ ঘণ্টা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে!
লাবিব আবার বলে,

—আর একটা চকলেট দিলে যদি ভাঙে, তবেই না সোজা! মেয়েদের তো আবার চকলেট খুব প্রিয়।
মাহির একটু হেসে বলল,
—চকলেট, গান এসব কাজ করবে না। ও চোখে যদি সত্যি কিছু দেখতে পায়, তবে মাফ করে দেবে। নইলে ধরা খেয়ে যাবেন ভাইয়া! আর যদি সিরিয়াস রাগ হয় তবে তা এত সহজে ভাঙবে না।
রাজ হালকা মাথা ঝাঁকায়।
“চ্যালেঞ্জটা করছিস? তবে শুনে রাখ তোর বোনের রাগ আজ রাতেই ভাঙাবো। সেটা যেবাবেই হোক। হোক সেটা সোজা পথে বা ছলনা করে।
তারপর সবাই হেসে ওঠে।
বাহিরে রাত গভীর হয়, আর ভেতরে রাজের মনে জন্ম নেয় এক শান্ত, পরিকল্পিত যুদ্ধে জেতার সংকল্প—
আরিওনা কে আমি রাগাতে পারি, কিন্তু হারাতে না।

রাত তিনটা।
চারপাশে নিস্তব্ধতা। পুরো জমিদার বাড়িটা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে রাতের শান্ত আঁধারে।
কিন্তু কারো মন তেমন শান্ত না—
মেহরিনের ফোনে হঠাৎ এক টুং শব্দ।
ঘুম ভেঙে যায় মেয়েটার। চোখ আধা মেলে দেখল, কবি সাহেব লিখা নাম্বার টা থেকে মেসেজ।
একটা শব্দ মাত্র—
“Sorry…”
তার নিচে আবার লেখা—

তোমার অভিমান রঙের মতো সুন্দর। কিন্তু আমি চাই না সেই রঙ বিলিন হোক আমার জন্য।
আরও নিচে ছোট্ট একটা কবিতার ছন্দ—
“তোমার অভিমান আমাকে ছুঁয়ে গেছে।
আমি দোষী, ঠিক কথা।
তবুও, আমি ভুলে যেতে পারি না—
তুমি আমার প্রিয় কবিতার মতো,
যাকে পড়লেও শেষ হয় না,
শুধু মনে পড়ে যায় আরও বেশি।”
মেহরিন ফোনটা রেখে দিতে চায়, কিন্তু পারছে না। অভিমান থাকলেও ওই ছেলেটার কবিতার প্রতি দুর্বলতাও যে অস্বীকার করা যায় না।

ঠিক তখনই আবার একটা মেসেজ:
“একটু ছাদে এসো প্লিজ। কথা না বললেও চলবে, শুধু একবার দেখা দাও।”
মেহরিন মনে মনে বলল,
“এই লোকটা কেন এমন? এখনই? রাত তিনটায়!”
ঠোঁট বাঁকায়, মনে মনে বলে আমি কেনো যাবো, এতই সোজা ও বললেই আমার যেতে হবে নাকি যাবো না আমি। বলে সুয়ে পরে আবার কিছু খন এপাশ ওপাশ করে তার পর উঠে বসে চুল গুলো হাত খোপা করে উড়না টা পরে নেয় । যাবে না যাবে না করে কিন্তু পা দুটো নিজের মতোই বেরিয়ে পড়ে।
উড়না টা গায়ে জড়িয়ে ধীরে ধীরে ছাদের দিকে এগিয়ে যায়।
হৃদয়ের ভিতরটা একটু কাঁপছে।
অভিমান এখনো আছে, কিন্তু তলায় একটা টানও জমে উঠছে।
ছাদে উঠে দেখে—

রাজ দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, আকাশের দিকে তাকিয়ে।
হাওয়ায় তার চুল একটু এলোমেলো, চোখে একরাশ অপেক্ষা।
মেহরিন এসে দাঁড়ায় একটু দূরে। রাজ ধীরে তাকায় তার দিকে—চোখে কোনো কথা নেই, শুধু গভীর একটা অনুশোচনা আর ভালোবাসা।
দুজনের মাঝে কিছু শব্দের অভাব, কিন্তু উপস্থিতিটাই এখন সবচেয়ে বড় ভাষা।
ছাদে রাজ দাঁড়িয়ে, দুই হাত পকেটে, চোখ আকাশে।
পায়ের শব্দে সে ফিরে তাকায়—চোখে বিস্ময়, স্বস্তি আর একরাশ অপরাধবোধ।
রাজ ধীরে বলে:

“জানি না কীভাবে মুখোমুখি হবো তোমার।
তোমাকে না বলেই এখানে আসাটা আমার ভুল।
কিন্তু আমি আসতে চেয়েছিলাম একজন হয়ে,
যে তোমার পাশে দাঁড়াতে চায় সব সময়,
না শুধু কবিতায়, বাস্তবেও।”
মেহরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। চোখ তার জলের রেখায় টলমল।
রাজ বলে:
“তুমি কাঁদছিলে, আমি জানি…
তোমার কান্না আমি কাঁধে নিতে পারি না।
তোমার অভিমান আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর,
কিন্তু আমি চাই—তোমার ঠোঁটে ফিরুক সেই হাসি,
যেটা একদিন আমায় ভিজিয়ে দিয়েছিলো।”
এই কথা শুনেই মেহরিনের বুক ফেটে কান্না আসে।
সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, চোখের জল লুকাতে চায়—
কিন্তু রাজ কাছে এসে ধীরে ধীরে তার হাত ধরে।
রাজ ধীরে ফিসফিস করে বলে:

“আর যদি কখনো কষ্ট দিই…মারও কাটো তবে এই হাতটা ছেড়ে দিও না।
তবে আজ শুধু একবার বলো—
তোমার চোখের জল আমার নয়… কেবল মেঘের বৃষ্টি ছিলো।”
মেহরিন আর কিছু বলতে পারে না। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে। রাজ তার গালে হাত রাখে।
চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে দুজন,
একটা অভিমান গাল বেয়ে পরে, একটুকরো ভালোবাসা গড়ে ওঠে।
ছাদটা নিস্তব্ধ।
চাঁদের আলো পড়ে আছে মেহরিনের মুখে, চোখে-মুখে অভিমান আর ঘুম না আসার ক্লান্তি।
তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায় রাজ।

দূরত্বটা আর এক ফুটও না। এতটাই কাছে, যে রাজের নিঃশ্বাস লাগে মেহরিনের গালে।
মেহরিন একটু চমকে ওঠে। রাজের এত কাছে আশায় অস্বস্তিতে পরে যায়।
ভাগতে চায়, কিন্তু পা যেন পাথর।
হাতটা বুকের কাছে এনে চোখ বন্ধ করে নেয়—অভিমান, ভয়, লজ্জা আর কিছু একটার জন্য।
কিন্তু রাজ কিছুই করে না।
সে মেহরিনকে ছোঁয় না, ছুঁয়ে দেওয়ার মতো সাহস করে না।
শুধু গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
তারপর, ধীরে পেছনে গিয়ে ছাদের দরজাটা বন্ধ করে দেয়—হাওয়াটা বন্ধ হয়ে যায়, রাতটা হয়ে ওঠে আরও গাঢ়।
মেহরিন চোখ খুলে তাকায়।
রাজ তার সামনে, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে।
চোখে লজ্জা নেই, আছে এক ধরনের নরম গর্ব, যে গর্ব ভালোবাসার, শ্রদ্ধার।
রাজ ধীরে ধীরে বলে:

“তোমার চোখ বন্ধ করে নেয়া মানে আমি বুঝি না যে তুমি কেমন ভয় পাও?
তোমার কাছে আসা মানে ছোঁয়া নয়,
তোমার পাশে দাঁড়ানো মানে তোমার রাগ বোঝা…
তোমার চোখের জল ধরে রাখা,
আর তোমার নীরবতায় নিজের নাম খোঁজা।”
মেহরিন কিছু বলে না।
তার চোখ জলে চিকচিক করে।
রাজ একটু এগিয়ে আসে, কিন্তু ছোঁয় না—শুধু বলে:
“তুমি যদি অনুমতি দাও, আমি চুপচাপ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।
না ছুঁয়ে, না দাবি করে…
শুধু তোমার সামনে—তোমার হাওয়ার পাশে।
তোমার অভিমান ভাঙা অবধি।”
মেহরিনের ঠোঁটে এক বিন্দু কাঁপুনি, চোখে জমে থাকা জলটুকু ঝরে পড়ে।
রাজ ধীরে বলে,

“তুমি চাইলে আমি চলে যাব।
তবে যাওয়ার আগে শুধু বলো—
তোমার হৃদয়ে আমার জন্য এখনো একটু জায়গা আছে তো?”
মেহরিন চুপ কিছু বলছে না,আসলে ও কিছু বলতে পারছে না সব কথা যেনো কন্ঠ নালিতে আটকে গেছে।
ছাদটা আবার নীরব হয়।
তারা দুজন দাঁড়িয়ে থাকে এক নিঃশব্দ আবেগের ভেতরে—
যেখানে ভালোবাসা বলে না, কিন্তু বুক জুড়ে বাজে।

ছাদের বাতাসে এখনো রাজের কণ্ঠ ভেসে বেড়াচ্ছে।
“আমি স্যরি, আরিওনা অনেক গুলে সরি। আমার বলা উচিত ছিল… আমি জানতাম না তুমি এতটা কষ্ট পাবে। আমি আসলে… তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। জানি না কেনো ভাবিনি তুমি রেগে যাবে।”
মেহরিন ধীরে এগিয়ে আসে, চোখে আগুন।
তার মুখে কথা নেই, চোখ জ্বলছে।
তারপর—ঠাসস***
একটা চড় রাজের বাম গালে।
রাজ চমকে ওঠে, কিন্তু মুচকি হেসে বলে,
এইটা বুঝি সেই অভিমান পর্বের ট্রেলার?
মেহরিন থেমে না।
আরেকটা ঘুসি—এবার বুকের মাঝে।
আরও কয়েকটা থাপ্পড়—হালকা, কিন্তু রাগে ঠাসা।
“আপনি খুব খারাপ! খুব খুব খুব খারাপ!

আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ভুলে গেছেন! আপনি জানেন কত কষ্ট পেয়েছি আমি।
আপনি আমার সামনে না এসে আড়ালে ছিলেন! আমি ভাবতাম আপনি বেস্ত,
আমি কাঁদেছি! আমি কষ্ট পেয়েছি!”
মেহরিন কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে।
রাজ তখন হাত দুটো বাড়িয়ে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে।
শুরুতে মেহরিন সরে যেতে চায়, কিন্তু রাজ শক্ত করে ধরে রাখে।
তার কণ্ঠে নরম সুর—
“তুমি কাঁদলে আমি মরব।
তোমার চোখে জল মানেই আমার বুক খালি।
তুমি মারো—আমি হাসব।

তুমি যদি এভাবেই ভালোবাসো, তাহলে আমি হাজারবার মার খাবো।”
মেহরিন ধীরে ধীরে থেমে যায়।
চোখ ভেজা, গাল গরম, বুকের মাঝে রাজের ধড়ফড় ধড়ফড় শব্দ।
রাজের কণ্ঠ আবার জড়িয়ে ধরে:
“এই বুকটা শুধু তোমার জন্য।
তোমার রাগের , তোমার কান্নার সঙ্গী,
আর তোমার চুপ করে থেকে আমাকে তুচ্ছ করে দেওয়া—সব কিছুতেই আমি আছি।”
মেহরিন চুপ। কিছু বলছে না শুধু চোখের পানি ফেলছে নিরবে।
তার মাথাটা রাজের বুকে এসে ঠেকে।
আর রাজ নিজের কপালটা রাখে মেহরিনের চুলে।
ছাদে তখন নীরবতা, চাঁদের আলোয় এক জোড়া হৃদয় একসাথে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
নতুন এক শুরু, নতুন এক মূহূর্ত—
যেখানে ভালোবাসার ভাষা শুধু স্পর্শ আর চোখের ভেতর।
ছাদের কোণায় একপাশে বসে আছে রাজ আর মেহরিন।
সামনের আকাশে তারারা জ্বলছে, কিন্তু রাজের চোখ শুধু মেহরিনেই আটকে।
চারপাশে হালকা বাতাস, নীরবতা আর ধুকপুক ধুকপুক হৃদস্পন্দন।
রাজ ধীরে বলে:

খুব কষ্ট পেয়েছো… তাই না?
মেহরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে বলে:
হুম… অনেক।
রাজ মুচকি হেসে মেহরিনের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে:
সরি ম্যাডাম, আর এমন হবে না।
আপনার চোখে জল মানেই আমার পৃথিবীটা ঝাপসা।
মেহরিন মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
তবুও সে বলে,
আপনার ওপর আমার রাগ বেশি খন থাকে না।
তাই বারবার আপনি…
রাজ হঠাৎ মৃদু কণ্ঠে বলে ওঠে—
“তুমি অভিমান করলে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত লাগে,তুমি চোখ ফিরালে, আমার দিনগুলো কেবল আঁধারে হাঁটে।

তুমি কাঁদলে আমি মরতে মরতে বাঁচি,
তুমি হাসলে, আমি নতুন করে বাঁচতে শিখি…”
মেহরিন হঠাৎ গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ায়, মাথা নিচু করে পেছন ফিরে যায় এক পা… দুই পা…
তারপর হঠাৎ একটা জটকায় ছুটে যায় দূরে—লজ্জায় গাল লাল।
আর রাজ পেছন থেকে বলে:
আরে ম্যাডাম, লজ্জা কিসের! কবি লোক তো কবিতা বলবেই!
তবুও তার গলায় একটুকরো মায়া।
ঠিক সেই সময়—

ঢ্যাশ!
ছাদের দরজাটা খোলে।
আর ভেতরে পড়ে যায় দুই বালিকা সেনা—মেহবুবা আর চুমকি!
চুমকি পড়ে গিয়ে বলে
উফ আমার কমর! এই আমি বলছিলাম, ওরা নিশ্চিত ছাদে আছে।
আর মেহবুবা গম্ভীর মুখে বলে:
আমি তো শুধু কবি সাহেবের প্রেম আর মেহুর অভিমান দুইটাই দেখতে এসেছিলাম, এবার দেখলাম কবিতা সেশনও চলছে! বলে উঠে দাড়াই দুজন,
তারপর ও দুজন হেসে গড়িয়ে পড়ে, মেহরিন লজ্জায় ওড়নাই মুখ ঢাকে।
রাজ একটু এগিয়ে এসে হেসে বলে:

আমার প্রিয় দর্শকরা উপস্থিত, তাহলে এবার নাটকের বিরতি!
মেহরিন চোখ মুখ লাল করে, লজ্জা আর রাগ একসাথে মিশিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো ছাদ থেকে। ওর ওড়না বাতাসে একটু ওড়লো, আর রাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মেহবুবা হালকা হাসি নিয়ে বলে উঠলো
জিও কবি সাহেব! আজ সত্যিই বুঝলাম কবিতার কলম প্রেমে ছোঁয়া পায়,
তার কণ্ঠে ছিল একরাশ মজা আর খুশির সুর।
চুমকি পিছন থেকে একটা ভাঙা হাসি দিয়ে বলে:
দুলাভাই! আপনি তো দেখি একদম সিনেমার হিরো!
শুধু বাকি আছে ‘Background Music’
রাজ একটু নাক সিটকিয়ে বলে:
তোমরা দুই জন একসাথে হও মানেই আমার সর্বনাশ!একজন ঠেলা দেয়, আরেকজন ধাক্কা খায়!
চুমকি বলে:

আর আপনি তো বেচারা!
আমার বেস্টফ্রেন্ডকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কাঁদিয়ে দিলেন, আর এখন শো অফ করছেন!
চুমকির চোখে ঝিলমিল দুষ্টুমি।
রাজ চোখ কুঁচকে হেসে বলে:
আমি শো অফ করি না, শালিকা সাহেবা।
আমি তো প্রেমিক… কবিতায় কথা বলি, আর অনুভবে বাজাই।
আপনার বেস্টফ্রেন্ডটা একটু বেশিই স্পেশাল, কী না!
চুমকি নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
উহহ… মাই গড! এতো প্রেম?
আপনার এই প্রেমে তো ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে!
রাজ ভ্রু তুলে বললো:
না না! তোমার ঝাঁপ যদি আমার আরিওনা দেখে, তাহলে তো আমাকে সত্যিকারের কবরে পাঠিয়ে দেবে! মেয়ে মানুষ তার সখের পুরুষের বেলাই খুব পজেসিভ। আমি ভাই বিয়ে না করে,বাচ্চার বাবা না হয়ে কবরে যেতে চাই না।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২১

এই বলে তিনজন হেসে ওঠে।
দূরে কোথাও দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ, হয়তো মেহরিন এখনো লজ্জায় মুখ গুঁজে রেখেছে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৩