হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২৬+২৭
Tahrim Muntahana
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে আকাশ, পাহাড় আর মেঘের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কাছ থেকে উপভোগ করছে মিরা, মিহি! এই প্রথম তারা এতদূর পর্যন্ত এসেছে, খোলা চোখে নিজে জন্মভূমির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছে! ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আহিশ। তার দৃষ্টি সম্মুখে। নজর ঘুরলেই যেন খাদে পড়ে যাবে। মিহি সামনে বসে একটু পর মা কে এটা সেটা দেখাচ্ছে। মেয়ের হাসি খুশি মুখটা দেখে মনিরা প্রকৃতির থেকে হাসি তে বিমোহিত হচ্ছে বেশী। বাঁধন ছাড়া হাসি এই প্রথম যে। সালেহা বেগম চুপচাপ বসে আছেন। বিয়ের পর একবার এসেছিলেন স্বামীর সাথে ঘুরতে। কি আনন্দ টাই না হয়েছিল। ওইযে বাড়ি ফিরে ঘর বন্দি হলেন এরপর বাইরের রোদ বৃষ্টি দেখতেও কসরত করতে হতো। আজ কাছ থেকে প্রকৃতির উদারতা দেখেও যেন শান্তি পাচ্ছেন না। মনের মধ্যে বন্দিদশার করুণ দৃশ্য গুলো ভাসছে। মিররে মায়ের মুখ ভঙ্গি পরখ করছে আহিশ। একটু হলেও হয়তো বুঝতে পেরেছে। গম্ভীর স্বরে বললো,
~ অতীত তোমাকে শুধুই কষ্ট দিবে মা। অগোছালো অতীত না ভেবে সাজানো গোছানো বর্তমান নিয়ে ভাবো। এই যে তোমার পাশে তোমার মেয়ে বসে আছে, যে তোমাকে সবচেয়ে বেশী ভরসা করে। এইযে ছোট নাতনি তোমার, যে তোমাদের দুজনের আশ্রয়ে বেঁচে আছে! ওদের দুজনের কথা ভেবে বর্তমান হাসি খেলে কাটিয়ে ভবিষ্যত সুন্দর করো। দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও না! কালো রাতের কালো থাবা আজ বহুদূরে!
তিনজনই আহিশের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। সালেহা বেগমের যেন এক ছুটে মনটা ভালো হয়ে গেল। ছেলেটা এত গুছিয়ে কথা বলতে পারে, মন ভরে যায়।হাসলেন তিনি। হাসলো না মনিরা। ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
~ আর আপনি? আপনি নেই?
আড়চোখে মনিরা কে দেখার চেষ্টা করলো আহিশ। ঝাঁপসা মুখশ্রী দেখে আবার সামনে দৃষ্টি ফেরালো। হেসেই বললো,
~ সে তো এক যাযাবর!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কমলা রঙের সূর্য টা পশ্চিম দিগন্তে ঝুলে আছে। আকাশে বিদ্যমান দুটো রঙ। সাদার নিচে নীল আচল পেতে ঢেকে রেখেছে আকাশ কে। দুটো রঙ কেই খুব জলদি আলাদা করা যায়। ইশ কি দৃশ্য। এই মুহূর্তটার জন্যই কি জায়গাটার নাম নীলাচল রাখা হয়েছে? সূর্যাস্ত দেখছে আফীফ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কামিনী বেগম। সূর্য বিদায় ক্ষণে শুধু নিজেকেই রাঙায় নি, রাঙিয়েছে সকল প্রকৃতি প্রেমীদের। মুখশ্রীতে লেপ্টে আছে সাঁঝের মায়া। ছেলেকে দেখেই কামিনী বেগম হাসলেন। চোখ বড় বড় করে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছে। এমন দৃশ্য এত কাছ থেকে আগে দেখেনি বলেই হয়তো এমন বিস্ময় ভাব। তবে ছেলে যে কাউকে দেখাবে না নিজের অবাক মুখশ্রী। বাইরের মানুষের সামনে নিতান্তই গম্ভীর, কঠোর মনের একজন নির্দয় মানুষ! কামিনী বেগম পাশের তিনজন মেয়েকে অনেকক্ষণ হলো পরখ করছেন। কারোরই মুখ তিনি দেখতে পান নি, তবে দূর থেকে তিনজনেরই কেশের বাহার দেখেছেন মুগ্ধ হয়ে। ছেলের ভয়ে সামনে এগোনোর সাহস হচ্ছে না। আফীফ আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। ডান হাত টা আকড়ে ধরে বললো,
~ ওই দিক কি দেখছো মা?
কামিনী বেগম দুবার মাথা নাড়ে। কিছু দেখছে না সে। আফীফের ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে। হেলায় একপলক দৃষ্টি ফেলে সাথে সাথেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মায়ের মতলব বুঝতে সময় লাগে না। বিরক্তি প্রকাশ করে বলে উঠে,
~ উফফ মা, তোমার এমন বাজে স্বভাব কবে থেকে হলো? আমাকে রাগিও না, ঘুরছি ঘুরতে দাও!
মায়ের হাত ধরেই হাঁটা ধরে সে। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। অঘটন বলে কয়ে আসে না!
সূর্যের দিকে বিদ্বেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাদিয়া। মন তার মুটেও ভালো নেই! কিসের জন্য এত তাড়া দিয়ে আসলো? এই প্রকৃতির মায়া তার আছে? না সৌন্দর্যে চোখ চিক চিক করে? আফরা’র দিকে একপলক তাকিয়ে দেখলো আফরা গম্ভীর দৃষ্টি ফেলেই আকাশ দেখছে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ইনিবিনিয়ে বললো,
~ এই আফরা, তুমি না বললে তোমার ছাত্রীও আজ ঘুরতে আসবে। আসে নি?
কথাটা বলেই নাদিয়া অন্যদিকে তাকায়। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়েই হয়তো। আফরা মুচকি হাসে। নাদিয়া কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
~ এসেছে তো! ওই যে তাকাও!
নাদিয়ে ঝট করে আফরা’র দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায়। চোখে মুখে ফুটে উঠে মুগ্ধতা। ওইযে দেখা যাচ্ছে, সুদর্শন এক পুরুষ। নাদিয়া’র চাহনীতে বাঁকা হাসে মিরা! আফরা’র আড়ালেই! নাদিয়া ইতস্তত করে বলে,
~ কথা বলবে না ওদের সাথে? তোমাকে দেখে খুশি হবে চলো চলো!
আফরা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নাদিয়া হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল মনিরা আহিশ মিহি! ম্যাম কে দেখেই মিহি মৃদু চিৎকার করে উঠে,
~ ম্যাম, তুমি এখানে?
দৃষ্টি পড়ে সবার। মনিরা এগিয়ে এসে আফরা’র গাল টেনে ধরে। মিষ্টি হেসে বলে,
~ আরে আফরা। তোমরা আসবে বলতে, একসাথে আসা যেত!
অপ্রস্তুত হাসে আফরা। কি বলবে? পরিস্থিতি থেকে ঝট করে নাদিয়া বাঁচিয়ে নেয়। উল্লাসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
~ আহিশ ভাইয়া তুমি এখানে? কবে আসলে?
বিব্রত হয় আহিশ। নাদিয়ার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো,
~ মাতাল যে, তুই এখানে কি করিস?
সম্বোধনে তুই শুনে নাদিয়ার চোখ মুখ লাল হয়ে আসে। মাতাল না হয় ঠিক ছিলো, তাই বলে সোজা তুই? চোখ মুখ লাল করে কিছু বলবে তার আগেই আহিশ বলে উঠলো,
~™কিরে পিনিক উঠেছে নাকি? চোখ মুখ লাল কেন? লাগবে মদ? আদিবাসী রা বাংলা মদ বানায়, নিয়ে আসবো?
ভৎসর্না! নাদিয়ার কান্না পায়। লোকটা জেনে বুঝে তাকে এসব বলছে। আহিশের মুখে ফুটে উঠে অদ্ভুত হাসি। চট করে একপলক আফরার দিকে তাকায়। তার পর মিহির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
~ চলো আম্মা, ওইদিকে যাই!
দু পা এগিয়েই আবার দাঁড়িয়ে যায় সে। পিছু ঘুরে তীক্ষ্ম কন্ঠে মনিরা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
~ এই মেয়ে, সংবর্ধনা জানিয়ে আহ্বান করতে হবে তোমাকে? সাথে এসো!
মনিরা কটমট করে তাকায়। তবে আহিশের তীক্ষ্ম দৃষ্টির সাথে পেরে উঠে না। অগত্যা আফরা’র থেকে বিদায় নিয়ে আহিশের পিছু নিতে হয়। সালেহা বেগম ছেলের কাজে তেমন কিছু মনে করেন না। ভেবেই বসেন পূর্ব পরিচিত বা বন্ধু। তাই তিনিও বিদায় নিয়ে চলে যায়। নাদিয়া রাগান্বিত ঈর্ষা চোখে আহিশ মনিরা কে দেখে। পাশ থেকে আফরা ফিসফিস করে বলে উঠে,
~ জেলাসি ইস দা প্রুফ অফ লাভ!
আড়াল থেকে খিলখিল করে হেসে উঠে মিরা। নাদিয়া কিছুটা চমকায়। পরক্ষণেই লজ্জাভাব ফুটে উঠে মুখশ্রীতে। মিরা’র হাসি দীর্ঘ হয়। আফরা খানিক বিচলিত হয়ে মিরা হাত চেপে ধরে। থামে না মিরা’র হাসি। হাসতেই থাকে সে, তবে হাসিতে প্রাণ খুঁজে পায় না আফরা। কি এক অসহ্য ব্যাথার ছোঁয়া পায়, আফরা নিজেই কেঁপে উঠে। সময় বুঝি হয়ে এলো? জয় কার হবে?
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ছয়শ ফুট উচ্চতায় অবস্থান করছে সবাই! পর্যটন কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে চারপাশ ভালো করে পরখ করলেই সাঙ্গু নদী এবং দূরের বান্দরবান শহর দেখা যায়। প্রকৃতি প্রেমীদের উল্লাস এতে হয়তো দ্বিগুন হয়। সবুজ গাছপালার আবরণে ছোট ছোট ঘর, সরু রাস্তা, সরু নদী! প্রাণ জুড়িয়ে যাবে না?
নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে রাত্রিযাপনের জন্য তৈরী করা হয়েছে নীলাচল নীলাম্বরী রিসোর্ট। এখানেই রাত্রীযাপন করবে আফীফ। সকালে মেঘ ছুঁয়ে দেখবে! রিসোর্টে পৌঁছেই আফীফ জিয়াউল কে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখে। কামিনী বেগম পা চালিয়ে এগিয়ে যান। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জিয়াউল আফীফের পা ধরে বসে। গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে আফীফ। এর আগেও অনেকবার জিয়াউলের আচরণ দেখেছে, তাই চমকায় নি! নাকে কান্না করে জিয়াউল বলে উঠে,
~ স্যার আপনি আমার স্যার, আমার বস, আমার কর্তা, আমার ভাই। আপনাকে আমি কত সম্মান করি আপনি নিজেও জানেন না। কত ভালোবাসি আপনি তাও জানেন না। সময় করে বলবো একদিন। আপনি কত ভালো আপনি….
চুপ হয়ে যায় রক্তিম চোখ দেখে। আফীফ ধমকে বলে উঠে,
~ নাটক করো না জিয়া! সোজাসাপ্টা বলো কি হয়েছে, কি দরকার?
~ স্যার আমার কোনো দোষ নেই। আমি প্রকৃতির ছবি তুলছিলাম। কোথাকার এক মেয়ে এসে ফোন টা কেড়ে নিয়ে বললো আমি নাকি লুকিয়ে তাদের ছবি তুলছিলাম। বিশ্বাস করেন স্যার, আমি এমন কিছু করি নি। ফোন নিয়ে চলে গেছে স্যার, এখন কি হবে?
আফীফের রাগ এবার চরমে পৌঁছে যায়। ফোন নিয়ে গেছে মানে? দ্বিগুন ধমকে বলে উঠে,
~ তুমি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো? তোমার ফোনে কত ইনফরমেশন আছে? একটা মেয়ে তোমার ফোন নিয়ে গেল আর তুমি আমার পা জড়িয়ে বসে আছো? আমার সামনে থেকে না সরলে আমি থাপ্পড় দিয়ে বসবো জিয়া। কোনো তথ্য লিক হলে, ইমিডিয়েট আমি এ্যাকশন নিবো! নিজের ডিউটিতে আমি আমার বাবাকেও মানি না! কথাটা মনে রেখ!
জিয়াউলের এতক্ষণে মনে পড়লো বিষয়টা। ক্রমশই গলা শুকিয়ে আসে তার। চুল খামচে ধরে মৃদু চিৎকার করে। কি করে ফেললো? চিন্তায় পড়ে নিজের ডিউটি ভুলে গেল? ভুলে গেল কি জন্য এসেছে? ফোনের লক কেউ খুলতে পারলে তার চাকরী নিয়ে টানাটানি হবে নিশ্চিত। তবে সে এসব নিয়ে চিন্তা করছে না। করছে টিম নিয়ে। একটু আগেই তো স্যার তাকে কতগুলো লিস্ট দিলো! এসব লিক হলে এই অপারেশন ফিনিশিং এখনি করতে হবে! হার নিশ্চিত! দুশ্চিন্তায় পাইচারি করতে থাকে জিয়াউল। বিড়বিড় করে বলে,
মেয়েটা ইচ্ছে করে এমন করে নি তো? শত্রুপক্ষের কেউ?
প্রকৃতির নিস্তব্ধতা কাটিয়ে তুলেছে শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক, বেওয়ারিশ কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। কানে বিঁধছে যেন। নিশাচরের মতো জেগে আছে দুটো মানুষ। একজন বন্দি, আরেকজন বাঁধন হারা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের এক কোণ থেকে অপর কোণে। কিছুক্ষণ পর পর মৃদু শব্দ হচ্ছে। কেউ লোহা জাতীয় কিছুর সংঘর্ষে মত্ত। পিট পিট চোখ নিয়ে নিজের মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ দেখছে আরাফ। ভেতরটা ভয়ে ফেটে যাচ্ছে, চোখ মুখে ফুটে উঠেছে বাঁচার আকুতি। হাত নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে আরাফ, মুখ যে বাঁধা। আজ আর কোনো মুখোশধারী নয়, কেউ নিজেকে মুক্ত ভাবে উপস্থাপন করে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে এসেছে। অথচ ক্রোধে ফেটে পড়ে দু ঘা লাগানোর মতো শক্তি তার মাঝে নেই। সেই যে পুলিশের থেকে পালিয়ে পেট ভরে খেয়েছিল। তারপর একটা দানাও জুটেনি। পানি পিপাসায় গলা যেন খরায় পরিণত হয়েছে, এক ফোঁটা পানিও পায়নি। নাক দিয়ে গোঙানির চেষ্টা করে আরাফ। ক্ষীণ শব্দ হয়, যা কারোর পৈশাচিক হাসির অতলে তলিয়ে যায়। হাসি থামে অনেকক্ষণ পর । এগিয়ে আসে লোকটি। আরাফের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে উঠে,
~ গলা শুকিয়ে গেছে? ওকে, নো প্রবলেম। ওয়েট!
লোকটি হেলতে দুলতে বাইরে চলে যায়। ফিরে আসে মদের বোতল নিয়ে। চেয়ারে বসে মদের বোতল টা শব্দহীন ফ্লোরে রাখে। বাম হাতে থাকা দুটো গ্লাসে তরল পানীয় ঢেলে এগিয়ে দেয় আরাফের দিকে। কিছুক্ষণ হাত বাড়িয়েই রাখে, বিনিময় হয় না। আরাফের হাত যে বাঁধা। লোকটি ভ্রু কুঁচকে বললো,
~ কি হলো? নিচ্ছেন না কেন? ইচ্ছে নেই? আচ্ছা সমস্যা নেই, আমিই খাচ্ছি।
কথাটি শেষ করে আয়েশ করে চুমুক বসায় গ্লাসে। তৃপ্তিতে চোখ বুজে নেয়। বলে উঠে,
~ আহ! অমৃত! অফার টা মিস করে গেলেন।
আরাফ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মদের গ্লাসের দিকে। পিপাসা টা বেড়ে যাচ্ছে। লোকটা বেশ খানিকটা সময় আরাফ কে দেখিয়ে দেখিয়ে মদ পান করে। নেশা ধরে যাচ্ছে! তবে সেটা মদের নাকি রক্তের বুঝে উঠতে পারে না। চেয়ারের পেছনে থাকা চাপাটি টা হাতে তুলে নিয়ে বিকট শব্দে হাসতে থাকে। ভয়ে জমে যায় আরাফ। পাকস্থলীও যেন গুলিয়ে উঠে। লোকটি কোনো রকম বাক্য ব্যয় না করেই ধারালো নখ বসিয়ে দেয় আরাফের চক্ষুকোটরে। মৃগী রোগীর মতো ছটফট করে আরাফ। ইতিমধ্যে চোখ বেয়ে রক্তিম অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম। লোকটি রক্তের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। রক্তে রক্তিম হওয়া বাম হাতটি নাকের সামনে ধরে। নাসিকা পথের ছিদ্র দিয়ে অক্সিজেনের সাথে প্রবেশ করে রক্তের মিষ্টি ঘ্রাণ! উন্মাদ হয়ে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
~ রক্তের পিপাসা তীব্র হচ্ছে!
তারপর লোকটি আবার চেয়ারে বসে যায়। ঝিম মেরে মাথা নিচু করে বসে থাকে। আরাফের ছটফটানি বেড়েই চলছে। হয়তো ছেলে টা এখন অজ্ঞান হয়ে যাবে। লোকটি গলা পরিষ্কার করে সরল গলায় বলে উঠে,
~ তোকে আমি মুক্ত করে দিবো। বাঁধন খুলে দরজায় রেখে আসবো, পাঁচ মিনিট দৌড়াবি! পাঁচ মিনিট পর তোকে যদি আমি ধরতে পারি তবে তোর রক্ত দিয়ে আজ আমি গোসল করবো! যদি ধরতে না পারি, তুই বেঁচে যাবি! খেলাটা জব্বর না? আমার কিন্তু বেশ মজা লাগছে!
আরাফ ক্ষীণ আশা খুঁজে পায়। লোকটি হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। মুখের বাঁধন খুলতে গিয়েও হাত নামিয়ে ফেলে। আরাফ কে দরজা পর্যন্ত রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে পেছনে। এক মুহুর্ত সময় ব্যয় করে না আরাফ, লোকটি কে ধাক্কা মেরে দৌড়াতে থাকে। জমিনে লুটিয়ে পড়েই লোকটি উন্মাদের মতো হাসতে থাকে। চিৎকার করে বলে উঠে,
সময় শুরু হলো এখন। টিক টিক টিক…
প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে আরাফ। কখনো গাছের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছে, কখনো লতাপাতা, আগাছায় পা বেজে মুখ থুবড়ে পড়ছে জমিনে। তবুও সে থেমে নেই। জানে না কোথায় আছে, শুধু বুঝতে পারছে এটা একটা জঙ্গল। নাহলে এত গাছ, লতাপতা, আগাছা থাকতো না। ক্ষীণ সন্দেহ থেকে সে দৌড়াচ্ছে, রাস্তা খুঁজে পেলেই জীবন বেঁচে যায়! কতক্ষন সময় সে দৌড়িয়েছে জানে না, হিসেব কষা হয়নি। কান খাড়া করে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করে আরাফ। কারোর পায়ের শব্দ, গতিবেগে দৌড়ে এদিকেই আসছে। আরাফ দিশেহারা হয়ে যায়, চোখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। হয়তো বাঁচার আশাতেই জোর করে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে। খানিক মুহূর্ত ভাবে আরাফ, হাতড়ে দেখে জায়গা টা। ঝোঁপঝাড়, গাছপালায় হাঁটা মুশকিল। পায়ের শব্দ নিকটে আসতেই তাক বুঝে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মুখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে। পারে না। ধৈর্য হারিয়ে ব্যাথাতুর শব্দ করতে গিয়েও চুপ মেরে যায়। হৃদয় ভয়ের কবলে পড়ে সেই কখনই মুর্ছা গেছে। বাঁচার আশা না থাকলে হয়তো শরীরটাও নেতিয়ে পড়তো! কেউ শিস বাজাচ্ছে, বেসুরো শিস! কয়েকপা দূরেই আরাফ বুঝতে পেরে আরেকটু গুটিয়ে নেয়। ভেসে আসে কারোর হাসির শব্দ। বলছে,
~ আরাফ, বেবি কোথায় তুমি? লুকোচুরি খেলছো কেন? দিস ইজ নট ফেয়ার ম্যান। কথা ছিল দৌড়াবে, তুমি তোমার কথা রাখোনি। কেন রাখো নি? আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। আমার হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! ভাঙা চোরা হৃদয় টা কে জোড়া লাগাবে?
কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো লোকটি। হাসির ধমকে শরীর নড়ে উঠে, দু হাত প্রসারিত ঘুরতে থাকে। কিছুটা সময় পর আবার নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে উঠে,
~ আমার ভাঙাচোরা হৃদয় টা আর্তনাদ করে বলছে রক্ত চাই, রক্ত চাই, রক্ত চাই। বিষাক্ত রক্তের ছোঁয়ায় আমার হৃদয় জোড়া লেগে যাবে। মানুষ হয়ে মানুষের উপকার করা তোমার কর্তব্য আরাফ। প্লিজ কাম!
নাটকীয়তা বজায় রেখেই লোকটি বুকের বাম পাশে হাত রেখে বসে পড়ে। ঠিক আরাফের পাশ ঘেঁষে। শরীর ছুঁই ছুঁই, আরাফের মতো হাত পা জড়োসড়ো করে শুয়ে কান বরাবর মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠে,
~ আরেকটু পথ গেলেই বড় রাস্তা টা পেতে। তোমার ভাগ্যের উপর বড়ই মায়া হচ্ছে। তুমি তোমার কথা রাখো নি আরাফ, আমিও রাখতে পারছি না। গুড বাই!
কথাটির সমাপ্তি ঘটার আগেই লোকটি আরাফের কন্ঠনালী বরাবর ছু* রি ঢুকিয়ে দেয়। হাত পা ছুটোছুটি করে আরাফ, লোকটি হাসতে হাসতেই আরাফের ডান হাত মুচড়ে ধরে। চোখ থেকে অশ্রু বিসর্জন দিতে পারে না আরাফ, সে তো রক্ত হয়েই ঝরে পড়ছে। কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করে চুপ হয়ে যায় আরাফ। মাটির দেহ মাটিতেই কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। লোকটি থেমে নেই। দক্ষ হাতে শরীরের পার্টস গুলো কা* টতে থাকে। চোখে মুখে তৃপ্তি, রক্তের নেশা। পুরো শরীর যখন খন্ড খন্ড, মাথাটা আলাদা করে গাল চেপে ধরে। হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
~ কথা বলো। একটু কথা বলো। আগে না কত কথা বলতে। মুখ দিয়ে কত নোংরা কথা মা জাতিকে শোনাতে, এখন একটু কথা বলো। বলবে না? একটু বলো!
নিচের ঠোঁট এক আঘাতেই কে* টে ফেলে। হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে দেখে। মুখে হাসি বজায় রেখে বললো,
~ কত সুন্দরীদের উপর নিজের কুনজর ধরে রাখতে। চোখ গুলো কই তোমার? আমার ছোট ছোট নখ ই তুলে নিলো? নাক দিয়ে মা জাতির শরীরের ঘ্রাণ নিতে না!
যত্ন নিয়ে নাকের পাটা কে* টে দু টুকরো করে। হাড় টা মাঝখানে রেখে দেয়। কিছুক্ষণ দেখে ফট করে এক কান কে* টে নিয়ে হেসে উঠে বিকট শব্দে। মাথাটা হাতে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। এটা কি আরাফ? উম হাম! একদম ই চেনা যাচ্ছে না। ঠোঁট নাক চোখ কান ছাড়া মানুষ চেনা যায়? উঠে দাঁড়ায় সে, কাটা মাথাটার চুলে হাত গুঁজে হাঁটতে থাকে। রক্ত গড়িয়ে পড়ে, মাটি ভিজে যায়। লোকটি বিড়বিড় করে বলে,
~ তুই যদি আমার কলিজায় নজর না দিতি বিশ্বাস কর এত সুখের মৃত্য তোর হতো না। আরো কয়েকটা দিন নিঃশ্বাস নিতে পারতি! বেড লাক!
শাশুড়ির ঘরে বসে ছিল মনিরা। সালেহা বেগমের নাকি আজ গল্প করে রাত কাটানোর ইচ্ছে হয়েছে। মনিরাও না করেনি। দু দন্ড বসে গল্প করার লোক বড়ই অভাব। একবার যেহেতু সুযোগ পেয়েছে, হাতছাড়া করেনি। নানান রকম শুকনো খাবার নিয়ে বসেছে। সালেহা বেগম গল্প করছে নিজের বাবা-দাদার আমলের। ছোট বেলা কেমন কেটেছে, স্কুল কলেজে কটা বন্ধু ছিলো সেসবই। মন দিয়ে শুনছে মনিরা। এসব উদাসীন গল্প গুলোও ভালো লাগছে তার। হুট করেই সালেহা বেগম নিশ্চুপ হয়ে যান। চাপা শ্বাস ফেলে বলে উঠেন,
~ সেসময় আমি ক্লাস এইটে পড়ি। লাফালাফি দাপাদাপি করেই দিন কেটে যেত। সকালে উঠেই মক্তবে যাওয়া, এসে মায়ের হাতে কটা কিল খেয়ে খাওয়া শেষ করে ছুটতাম স্কুলে। দলবেঁধে যেতাম, গল্প করতাম আর এক জন আরেক জনের উপর হেসে ঢুলে পড়তাম। গল্প গুলো কি ছিলো জানো? কে কয়টা প্রস্তাব পেয়েছে, কার প্রেম কেমন চলে। কে কোথায় দেখা করতে গিয়ে বাবা মায়ের হাতে ধরা পড়েছে। কি আমোদে ছিল দিন গুলো।
দীর্ঘশ্বাস আর গোপনে রইলো না। প্রকাশিত হয়ে শাশুড়ির বুকের আলোড়ন ও টের পেল মনিরা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ির দিকে। সালেহা বেগম হঠাৎ করেই মুচকি হেসে বললো,
~ রমিজ’দা! নামটা যেমন সুন্দর মানুষ টার সৌন্দর্যও ছিলো চোখ ধাঁধানো। গাঁয়ের রং ফর্সা ছিলো না, কুচকুচে কালো রং। অন্ধকারে মানুষ বুঝা যেত না। কিন্তু ছিলো নজর কাড়া চেহারা। উঁচু নাক, বড় বড় চোখ, কালো মোটা ভ্রু যুগল, কালো কুচকুচে পুরু ঠোট! যখন সাদা দাঁত গুলো দেখিয়ে হাসতো মনে হতো জনম ভরে শুধু দেখেই যাই!
সালেহা বেগম যেন চোখের সামনে মানুষটা কে দেখে রূপের বর্ণনা দিলেন। কে হয় মানুষ টা? যার শরীরের প্রতিটা ভাঁজ মনে রেখেছেন! কাছের কেউ? মনিরার ভাবনা গুলো সত্য প্রমাণ করে দিয়ে সালেহা বেগম বললেন,
~ উঠতি বয়সে ছন্নছাড়া এ পাড়া ও পাড়া দৌড়ে বেড়ানো রমিজ’দার প্রেমে পড়লাম। বয়স ছিলো আমার বয়সের দ্বিগুন। ছোট বেলা থেকে রমিজ’দা বলে ডাকতাম। আমাদের বাড়ির গেটে এসেই ডেকে উঠতো, “ও সালু, আছিস নি? রমিজ’দা আইছে রে, আয় আয় বাইর হো। দেখ তোর জন্য কি নিয়াইছি!” কি সুন্দর আদুরে ডাকে ডাকতো। আমি কাজ, পড়া ফেলে দৌড়ে যেতাম। আর দেখতাম বরাবরের মতো আটআনার চকলেট নিয়ে ঘাসের উপর বসে আছে। তখন তো আটআনার দাম অনেক। খুশিতে খিলখিল করে হেসে হাত পেতে দিতাম। বলতো, মাথা টিপে দে, ঘাড় টিপে দে, পা টিপে দে নাহলে চকলেট পাবি না। আমিও চকলেটের লোভে হাত পা টিপে দিতাম। এমন করতে করতে কখন যে কিশোরী সালু রমিজ’দার প্রেমে পড়লো বুঝেই উঠতে পারলো না। শুরু হলো নতুন পাগলামি।
ইনিয়েবিনিয়ে রমিজ’দার সাথে কথা বলতাম, কারণ ছাড়া তার চারপাশে ঘুরতাম, পড়ায় মন ছিলো না। একদিন টের পেলাম কিশোরী সালু তার রমিজ’দার মনেও জায়গা করতে পেরেছে। ভালোবেসে তাকিয়ে থাকতো, ঘন ঘন আমাদের বাড়ি আসতো। আমি বুঝেও চুপ থাকতাম। তার মুখে শোনার অপেক্ষা করতাম। কিন্তু রমিজ’দা পাল্টে গেল। আগের মতো সালু বলে ডাকে না, আমাদের বাড়ি আসে না, আমাকে দেখেই কোথায় যে চলে যেত সারা দুপুর অপেক্ষা করও দেখা পেতাম না। সদ্য প্রেমে পড়া মন বিরহ ব্যাথা মেনে নিতে পারেনি। এক সন্ধ্যায়..
থেমে গেলেন সালেহা বেগম। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন। মনিরা বিচলিত না হয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। কৌতুহল জাগছে ভীষণ। কি এমন ঘটেছিল সেই সন্ধ্যায়? সালেহা বেগম নিশ্চুপে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। চোখের পানি মুছে মুখে হাসি ফুটালেন। খোলা জানালা ভেদ করে অদূরের পাহাড়ে উদাসীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বললেন,
~ এক সন্ধ্যায় মা কে লুকিয়ে বের হলাম বাড়ি থেকে। গ্রামের পথ, ঝোঁপঝাড়। মনের মধ্যে ভয়ের থেকে রমিজ’দা ঘুরছিলো বেশী। কয়েকবাড়ি পার করলেই রমিজ’দার বাড়ি। দেখলাম কাকি ওযু করছে, নামাজ পড়বে। কাকি কে না বলেই সোজা রমিজ’দার ঘরে ঢুকে পড়লাম। কালো কুচকুচে দেহ খানা বিছানায় মিশে আছে। কতদিন পর চোখ জুড়ালো। রমিজ’দা তখনো বুঝতে পারেনি। মা ভেবে বলে উঠলো,
“আম্মা আমার ভালা লাগতেছে না কিছু। একটু মাথায় হাত বুলাইয়া দিবা?”
লোভ সামলাতে পারিনি। গুটিগুটি পা ফেলে রমিজ’দার মাথার কাছে বসলাম। হাত ভীষণ কাঁপছিলো। কি যে কান্না পাচ্ছিলো। সাহস করে হাত টা মাথায় রাখতেই আমাকে চমকে দিয়ে রমিজ’দা বললো,
“বাড়ি ফিরা যা সালেহা। কেউ দেইখা ফেললে তোরেই মন্দ কইবো।”
আমার কান্নারা এবার বাঁধ ভেঙে গেল। ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদলাম রমিজ’দার বুকে। একটুও না করেনি রমিজ’দা। আবার আগলেও নেয়নি। যখন কান্না ভেজা কন্ঠে বললাম,
“তোমার মুখে সালেহা নামটা অপরিচিত লাগে রমিজ’দা। সালু বলে ডাকো না একটু। কতদিন শুনি না।”
আমার বুকের উচাটন হয়তো রমিজ’দার বুকেও ছিল। সারাদিন হেসে খেলে বেড়ানো রমিজ’দার চোখের কোণে সেদিন জল দেখেছিলাম আমি। প্রথম মৃত্য তো আমার সেদিন ই হয়েছিল। মাথায় হাত রেখে রমিজ’দা বললো,
“সবার মুখে সব কিছু শোভা পায় না। তুই ফিরা যা সালেহা। আর আহিস না কোনোদিন।”
আমার হাতের বাঁধন আলগা হয়নি, আরো শক্ত হয়েছিল। জেদ ধরে বসে রইলাম। কাকি আমাকে দেখেই ঘরে খিল দিয়েছে। রমিজ’দা আমার সাথে না পেরে হার স্বীকার করে নিলো। সেদিন আমাদের প্রথম কাছে আসা। মানুষ টা পরম যত্নে আমার কপালে, গালে, থুতনিতে, নাকে চুমু খেয়েছিল।
মনিরা বেশ লজ্জা পেল। সালেহা বেগম একদম নিজের গোপন সত্যতে ঢুকে গেছেন। তাই হয়তো বুঝে উঠতে পারেন নি কাকে কি বলছেন। একবার থামাতে চাইলো মনিরা। আবার কি ভেবে যেন থামালো না। সালেহা বেগম আবার বললেন,
~রমিজ’দা বাড়ি দিয়ে গেল। বাড়ির উঠোনে পা পড়তেই আমার মাথায় খেললো আজ কি হতে পারে। আম্মা জানলে মেরেই ফেলবে। দুরুদুরু বুকে ভেতরে ঢুকতেই টের পেলাম যা ভেজাল হওয়ার হয়ে গেছে। ভয়ে অন্তর্মন বারবার কেঁপে উঠছে। আমাকে দেখেই আব্বা গর্জে বলে উঠলো, “এই সন্ধ্যা বেলা কোথায় গিয়েছিলি।”
আব্বা ছিলো প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার। তাই সব কথায় শুদ্ধ করে বলতো। আমি কোনোরকম বললাম,
“আব্বা তন্নিদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আর এমন হবে না আব্বা।”
কথাটাই যেন বলা ভুল হয়েছে। ইতিমধ্যে আম্মা তন্নিদের বাড়ি খোঁজ নিয়ে এসেছে।
মিথ্যাটা শুনেই আম্মা এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো। আব্বা মাষ্টার মানুষ, গাঁয়ে হাত তুলেনা। আবার রাগও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলো না। তাই বাড়ির বাইরে চলে যায়। আম্মায় বিশ্রী বিশ্রী গালি দিয়ে বলতে লাগলো,
“কোনখানে গেছিলি ক, নাইলে আইজ তোরে মাইরার ফেলমু। মুখ পুড়ি কই গিয়া মুখ পুড়াই আইলি ক।”
কথাটা বলেই আম্মা আমারে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো। যখন খারাপ কিছু দেখলো না তখন শান্ত হলো। নরম করেই বললো,
“রমিজের বারি গেছিলি তাইতো? রমিজ রে আমি মানা করছিলাম তোর সাথে কথা না কইতে তারপরও রমিজের সাহস হয় কি কইরা?”
আমার বুঝতে বাকি থাকলো না রমিজ’দার এমন করার পেছনে আম্মা দায়ী। রাগ হলো। কথা বলা বাদ দিলাম আম্মার সাথে। ঘর থেকে বের হতাম না, আব্বার সাথে কথা বলতাম না। আম্মায় কতবার যে এটা সেটা বলতে আসছে, সব সময় মুখ ফিরিয়ে রাখতাম। তখন তো আমি রমিজ’দার মাঝে ছিলাম, আম্মার ভয় কি বুঝতে পেরেছিলাম? আম্মা সবকিছু বুঝে আব্বাকে বললো। আব্বা ছিলো বিচক্ষণ মানুষ, বেকার অশিক্ষিত ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে? আমাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করলো। ঠিক করলাম গলায় ফাঁস দিবো। দিয়েছিলাম ও, কাকা দেখে বাঁচিয়ে নিলো। দ্বিতীয় বার ভুল আর আব্বা করলো না। রমিজ দা’র সাথেই বিয়ে ঠিক করলো। দুজনের মুখেই কি হাসি, ডানা মেলে উড়ছিলাম যেন। ঠিক হলো বিয়ে সামনের সপ্তাহে হবে। শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে আমি রমিজ’দার বউ হলাম। সুখের যেন সীমা নেই।
একটু পর পর শুধু সালু বলে ডাক দিতো। সাত পাড়ার মানুষের সামনে থাকলেও আমি দৌড়ে চলে যেতাম রমিজ’দার কাছে। গ্রামবাসী কত হাসাহাসি করতো। অনেকেই তে লাইলি-মজনুও নাম দিয়েছিল। আবার অনেকে মুখ বেঁকাতেও। রমিজ’দার সাথে সংসারের দুই বছর কেটে গেল। বিয়ের পর রমিজ দা কাঠমিস্ত্রি, কারেন্টের কাজ করে টাকা আয় করতো। আমার পড়াশোনার সব খরচ দিতো। আর বলতো,
“তুই একদিন মস্ত বড় অফিসার হইবি সালু। তখন আমি সবাইরে কমু তোমাগর অফিসার আমার বউ, আমার সালু!”
মানুষ টার কালো রংয়ের জাদুতে মোহিত হতাম বারবার। শুধু তাকিয়েই থাকতাম। ভালোবেসে কত সময় তো কালাচাঁদ বলেও ডাকতাম। রমিজ’দা নামটা শুনে কি খুশিই হতো। মেট্রিক পরীক্ষার পর জানলাম আমার আর রমিজ’দার ভালোবাসার ফসল আসতে চলছে। রাত দিন কাজ করে টাকা যোগাড় করে দু গ্রাম মিষ্টি বিতরণ করেছিল। যাকেই দেখতো তাকেই ডেকে বলতো,
“হুনছো গো তোমরা আমার সালু মা হইবো, আর আমি বাপ!”
সে কি যত্ন। মাটিতে পা পড়তে দিতো না যেন। সব কাজ নিজের হাতে করতো। শাশুড়ি আম্মা ছেলের সুখ বেশিদিন দেখতে পারলেন না। অতিরিক্ত খুশিতেই হয়তো পরপারে চলে গেলেন। ওই সময়ে মানুষ টা পেটে থাকা আমাদের সন্তানের সাথে কথা বলতো। মেয়ের শখ ছিলো ভীষণ। কিন্তু হলো ছেলে। বেজার হয় নি। মসজিদে টাকা দিলো, ফকির খাওয়ালো। বাচ্চার বয়স যখন দেড় বছর, রমিজ’দা পড়লো টাইফয়েড জ্বরে। কালো কুচকুচে আমার ভালোবাসার দেহখানা মিশে যেতে লাগলো বিছানায়। মন কু ডাকতে লাগলো বারবার। বিছানায় শুয়ে থেকেও মানুষ টা বলতো,
“এই সালু, আমার আদরের বউ, কানতাছো কেন তুমি? আমার কিছুই হইবো না। মেল্লাদিন বাঁচমু আমি তোমার লগে। পোলারে বিয়া করামু, নাতি নাতনি হইবো। কত সুখ আমাদের। তুমি কান্দিলে আমার বড় দুঃখ লাগে সালু। কাইন্দো না! আমি তোমারে অনেকখানি ভালোবাসি সালু, আমার বউ!”
এটাই যে আমাদের শেষ কথা হবে তা কি জানতাম। জানলে আমি আমার রমিজ’দা কে ছেড়ে কোথাও যেতাম না। রান্না ঘর থেকে এসে দেখি আমার রমিজ’দা নেই। দেহটা বিছানায় পড়ে আছে অবহেলায়! কতশত অভিযোগ করলাম। কত অভিমান করলাম। আমার রমিজ’দা উঠলো না। সালু বলে ডাকলো না। নিষ্ঠুর মানুষ রা রমিজ’দা কে নিয়ে মাটিতে শুয়িয়ে রাখলো। আর আমাকে দিয়ে গেল অসীম বেদনা। আমার রমিজ’দা কে আর পেলাম না কোথাও!
কান্নায় কথা বলতে পারছেন না সালেহা বেগম। মনিরা’র চোখের পানিও বাঁধ ভেঙেছে। সত্যিকারের ভালবাসা গুলো এভাবেই হেরে যায়? সমাজের কাছে হেরে যায়, পরিবারের কাছে হেরে যায়, একতরফা’র কাছে হেরে যায়, নয়তো হেরে যায় বিধাতার নিয়মের কাছে। বিছানার চাদর খামচে কাঁদছে সালেহা বেগম। পুরোনো ক্ষত, তাজা ভালোবাসা গুলো মনের কোণে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গাঁয়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে মনিরা বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। একা থাকতে দেওয়াটাই শ্রেয় মনে করলো সে। পরের ঘটনা টুকু নাহয় পরেই শুনবে। তবে মনিরার মাথায় ঘুরছে অন্য বিষয়! পরে নাহয় আশরাফ উদ্দিনের সাথে বিয়ে হয়েছে, ছেলেটা কার কাছে আছে? আশরাফ উদ্দিন কি ছেলে সহ সালেহা বেগম কে গ্রহণ করেছে? তাহলে কি আতিকুর আগের পক্ষের সন্তান? নাকি এখানেও লুকানো আছে সত্য? ভাবতে পারে না মনিরা। চোখের কোণে থাকা জল টা মুছে এগিয়ে যায় রিসোর্টের সামনের দিকে। বেশ গতিতে হাওয়া বইছে। বসার জায়গা রয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। হঠাৎ ই মনে হলো কিছুটা দূরে কোনো ছায়া হেঁটে যাচ্ছে। কৌতুহল বশত উঠে দাঁড়ালো সে। ভয় ও করছে! আস্তে আস্তে পা ফেলে সামনে যেতেই পরিচিত দুই মুখ দেখে অবাক হলো ভীষণ। কান পাতলো ফিসফিসানি কথা শোনার আশায়।
গম্ভীর মুখশ্রী, তেজি দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহিশ। এই গভীর রাতে বারবার ম্যাসেজ করে ডেকে আনার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। নাদিয়া সেই কখন থেকে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। আড়চোখে তাকে দেখছেও। আরামের ঘুম বাদ দিয়ে এমন তামাশা বরাবরের মতোই অপছন্দ আহিশের। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ ডেকেছো কেন? এই রাতের বেলা তোমার কি প্রয়োজন পড়লো? মদের খোঁজ করছো? তুমি ভালো করেই জানো আমি মদ খাইনা।
নাদিয়া’র চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। এই লোক তার মদ নিয়ে পড়েছে কেন? নিজেও ফিসফিস করে বললো,
~ আমার ব্যাগে এখনো এগারো বোতল মদ পড়ে আছে। ডেকেছি অন্য কারণে।
কথাটা বলেই নাদিয়া আবার পাইচারি করা শুরু করলো। ভীষণ বিরক্ত হলো সে। হুট করেই নাদিয়া চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ তোমার সাথে আমার তুইয়ের সম্পর্ক? তুমি আমাকে সবার সামনে তুই ডাকলে কেন?
~ তো তোমার সাথে আমার কোন রসের সম্পর্ক? সবার সামনে তোলা তোলা করতে হবে? দেখ নাদিয়া আমি এখানে এনজয় করতে এসেছি, নিজের বোকামো দিয়ে আমার মেজাজ খারাপ করো না। তোমার জন্যই মঙ্গলজনক!
অপমানিত হলেও গাঁয়ে মাখলো না নাদিয়া। আহিশের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,
~ তুমি আমার সাথে এমন করো কেন আহিশ? আমার মনের কথা সত্যিই কি বুঝতে পারো না?
আহিশের রাগ যেন চরমে পৌঁছে গেল। হাতের উপর হাত রাখার জন্য বাড়ানো হাত টা চেপে ধরে বললো,
~ তোমার সাহস অতিরিক্ত বেড়েছে। ভুলে যেও না তোমার আর আমার সম্পর্ক টা জাস্ট এ ডিল। তুমি আমাকে সাহায্য করেছো বিনিময়ে আমি তোমাকে মাহমুদ সাম্রাজ্য দিবো। এর থেকে বেশী এগোতে যেও না, তোমার নিঃশ্বাস আটকে দিতে আমার এই বলিষ্ঠ হাতই যথেষ্ঠ!
ভয় পেল না নাদিয়া, রাগ তারও হচ্ছে। আহিশের হাতের বাঁধন থেকে হাত ছাড়িয়ে কটমট দৃষ্টি ফেলে বললো,
~ আমাকে ভয় দেখিও না, সম্পদের পরোয়া আমি করি না। তোমাকে সাহায্য করতে চাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো আমি তোমাকে ভালোবাসি আহিশ। ইয়েস আই লাভ ইউ ভেরী মাচ! তোমার কাছাকাছি থাকতে, তোমার সাথে কথা বলতে আমি তোমার সাথে যুক্ত হয়েছি। এর বাইরে কিছু না। মাহমুদ সাম্রাজ্যের একাংশ আমার ভুলে যেও না।
আহিশের রাগ নিভে এলো। শান্ত দৃষ্টি ফেলে নাদিয়ার চোখের দিকে তাকালো। সময় চলে গেল কিছু মুহূর্ত। নাহ! ভালোবাসা, মায়া, অপেক্ষা ছাড়া ওই চোখে কোনো ছল সে দেখতে পাচ্ছে না। সে আগেই কিছুটা টের পেয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে মেয়েটাকে সাথে নেওয়া ভুল হয়েছে। আহিশ কে চুপ থাকতে দেখে নাদিয়া আবার বললো,
~ তোমার যেযন রক্তের নেশা, আমার তেমন তোমার নেশা। মদ কে আমি ছুড়ে ফেলতে পারি কয়েক সেকেন্ডেই। তোমাকে ছাড়তে পারিনি, গত তিনটা বছর ধরে ভালোবেসে যাচ্ছি। বিনিময়ে কষ্ট, যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই পাইনি। কিছুই না!
আহিশ দু পা পিছিয়ে আসে। ভাবালেশ বলে,
~ মস্তিষ্কে মদ ঢালো। পিনিক ছেড়ে যাবে। আজ থেকে তোমার আর আমার পথ আলাদা। সম্পূর্ণ আলাদা। তোমার সাহায্য আমার লাগবে না। তুমি আমার বুকের ক্ষত আবার তাজা করে দিলে। ফল ভুগতে হবে তোমাকেই!
হনহন করে রিসোর্টে ঢুকে পড়ে আহিশ। নাদিয়া বসে পড়ে মাটিতে। চুল খামচে ধরে মৃদু চিৎকার করে কেঁদে উঠে। শরীর দুলে কান্নার ছলকে। এসবের কোনো কিছুই মনিরার কানে পৌঁছায় না। এতটাই ধীরে কথা বলছিলো দুজন ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে মনিরা শুনতে পায় না। তবে নাদিয়ার রিয়েকশন দেখে কিছুটা আন্দাজ সে করতে পেরেছে। এত সব না ভেবে নিজেও রিসোর্টের দিকে হাঁটা ধরলো। ত্রিকোণ রিয়েকশনের কাহিনী দেখে ফিক করে হেসে উঠলো মিরা। এতক্ষণ নিজ ঘরের জানালা দিয়ে সবই পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখছিলো সে। নাদিয়ার কান্না দেখে তার হাসি কেমন চওড়া হলো। ফোন বের করে ফোন লাগালো চেনা পরিচিত এক নম্বরে। প্রথম বারই রিসিভ হলো, হয়তো ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো। মিরা মৃদু চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ হেই মেরা দিল, এখনো জেগে আছেন যে?
ভ্রু কুঁচকে নম্বর টা আবার পরখ করলো আদিল। বাবার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। রং নম্বর দেখে বাবা ভেবেই রিসিভ করেছিল। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে। বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,
~ হোয়াট ইজ মেরা দিল?
~ আদিল- দিল। আপনি তো আমার দিল। অবশ্যই আমি মেরা দিল বলবো, অন্যরা মিরাদিল বলবে। সিম্পল বিষয়টা বুঝতে এত সময় লাগে? আপনাকে বেশ চালাক ভেবেছিলাম মি. আদিল মাহমুদ!
বলেই হেসে উঠলো মিরা। আদিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। রাগ কমে এলে মুচকি হেসে বললো,
~ মিরার ই কার কেটে দিলে মরা! এমনও হতে পারে আদিমরা! আদিল আপনার জন্য মৃত। আবার এমনও হতে পারে আপনি আদিলের জন্য মরা আই মিন মৃত! হতে পারে না মিস মিরা? তবে আপনার সারনেইম কোথায়?
ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মিরা। অপরপাশে আদিল কিটকিট করে হাসছে। শরীর জ্বলছে মিরার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ অবশ্যই হতে পারে। আপনার জন্য আমি মরতেও পারি। এমন ও হতে পারে মিরা,আদিল- মরাদিল! আপনার মৃত দিল আমার রঙিন ভালোবাসা দিয়ে তাজা করে তুলবো। সারনেইম হবে তো। মিসেস মিরা মাহমুদ! সুন্দর না?
বাবার ফোন আসছে। সময় নেই বলে আদিল চুপ মেরে যায়। তর্কহীন বলে উঠে,
~ সুন্দর-অসুন্দরের উত্তর পরে পাবেন। অপেক্ষা শুধু!
সাথে সাথেই কল কেটে দেয়। যা বলতে ফোন দিয়েছিল তা না বলতে পেরে রাগ হয় মিরা’র, বিড়বিড় করে রাগ প্রকাশ করতে করতে ঘরে চলে যায়। মিরা’র ফোন কেটে আদিল বাবাকে কল ব্যাক করে। রিসিভ করেই অনল মাহমুদ রাগী কন্ঠে বলে উঠেন,
~ এত রাতে ফোন বিজি, এইসময় আমি ফোন দেওয়ার কথা ছিলো তারপরেও অন্যকারোর সাথে কথা বলছো কি করে?
বাবার কথা শুনতেও যেন বিরক্ত লাগছে আদিলের। তবুও শান্ত স্বরে বললো,
~ ক্ষমা করবেন আব্বু্। পার্সোনাল ইস্যু। আপনি বলুন কি বলবেন? বের হবো আমি?
রাগ হজম করে নেন অনল মাহমুদ। উপযুক্ত সময় এখন নয়। শান্ত স্বরে বলেন,
~ অবশ্যই। একদম কনফার্ম করে তারপর ফিরবে। সে হোক একমাস দেরী! সাবধানে!
হু হা কিছু না বলতেই অনল মাহমুদ ফোন কেটে দেন। আদিল কিছুটা মনক্ষুণ্ণ হয়। আমলে না নিয়ে প্যাকিং করে লাগেজ নিয়ে হাঁটা ধরে বাইরে। যেতে সময় লাগবে অনেক টা!
বারবার বন্ধ দরজায় টোকা পড়ায় ঘুম ভেঙে যায় আফীফের। গভীর রাত, কে এলো? ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলতেই একজন মেয়েকে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে ভাজ পড়ে তার। ঘুমের রেশ কেটে গেছে। গম্ভীরতা বজায় রেখেই বলে উঠে,
~ ইয়েস! কি চাই?
চোখ তুলে আফরা। সুদর্শন এক যুবক কে দেখে আবার ফোনের দিকে তাকায়। মুচকি হেসে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠে,
~ এটা মনে হয় আপনার। ওয়ালপেপারে তো আপনার ছবিই!
হাতে নেয় আফীফ। সত্যিই তার ছবি। অফিশিয়াল ইউনিফর্ম পড়ে বাবার দিকে স্যালুট দিয়ে তাকিয়ে আছে। নুরুল আলম সিদ্দিকী কে সেভাবে দেখা না গেলেও আফীফ এক নিমিষেই বুঝে ফেলেছে। একপলক বিছানায় বালিশের পাশে থাকা নিজের ফোন টা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না এটা জিয়াউলের ফোন। হাসে সে, ছেলেটা পাগল। তবে পরক্ষণেই ফোন হারানোর ঘটনা মনে করে ধমকে উঠে,
~ ফোন ধরে রাখলেই যে প্রকৃতি বাদে আপনাদের ছবি তুলবে এমন লেইম ভাবনা এখনো আপনাদের মাঝে আছে? রিডিকিউলাস!
বুঝতে পারে না আফরা। একজন মেয়ে তাকে দিয়ে বললো এই ফোনের মালিক কে দিতে। তাই সে দিতে এসেছে। এই লোক কি পাগল? নিজের তেজী কন্ঠে বললো,
~ মেয়েদের নিয়ে বিশ্লেষণ করার আগে নিজেদের নিয়ে বিশ্লেষণ করুন। একজন উপজাতি মেয়ে আমাকে ফোন টা দিয়ে বললো মালিক কে ফেরত দিতে। মস্তিষ্ক খাটিয়ে কাজ করবেন। প্রমাণ আমার হাতে বলেই যে খু* ন টা আমি করেছি ভাবা আর্মিদের স্বভাব নাকি?
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ২৫
~ আর্মিদের ভাবনা আপনার মস্তিষ্কের সাথে পড়বে না। প্রমাণ হাতে মানে আপনি ওই খু*নের সাথে প্রত্যক্ষ হোক, পরোক্ষ হোক জড়িত। হোক সেটা খু*নি, সাক্ষী, ভিক্টিম! যাই হোক, এবার আসতে পারেন। ধন্যবাদ!
খট করে দরজা বন্ধ করে দেয় আফীফ। রাগে আফরা’র চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। দরজায় লাথি বসিয়ে হাঁটা ধরে সে। বিড়বিড় করে বলে উঠে,
~ আপনার শাস্তিও পাওনা রইলো মি. আফীফ মুনতাসির!