হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩২+৩৩+৩৪

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩২+৩৩+৩৪
Tahrim Muntahana

এখন গভীর রাত। চারপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত। খোলামেলা স্থান হ‌ওয়ায় চাঁদের আলো খানিক হলেও পৌঁছেছে। মাঝারি সাইজের এক তাবু। চারজনের ছোট খাটো দেহ ঠিক চলে যাবে। কাঠ জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়েছে আফরা। কামিনী বেগম তাবুর কাছ ঘেঁষে বসে আছেন। সময় টা তার এতটা ভালো যাচ্ছে, সে যে বান্দরবান রয়েছে ঠিক ভুলে গেছেন। ফোন নিয়ে একদিক থেকে আরেকদিক ছুটে চলছে নাদিয়া। বিশেষ প্রয়োজন। তবে নেটওয়ার্কের বালাই নেই। মিরা তাবু তে চুপটি করে শুয়ে আছে। মুখ বেশ গম্ভীর। তার কেবল‌ই মনে হচ্ছে আফরা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লুকিয়েছে। সেটা কি ধরতে পারছে না। সন্দেহের বশে প্রশ্ন করার স্বভাব ও তার নেই। মনের খচখচানি টা যাচ্ছে না।
আফরা আস্তে আস্তে পা ফেলে কামিনী বেগমের পাশে বসলো। কামিনী বেগম একপলক তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আফরা প্রশ্ন করলো,

~ আপনার অসুবিধা হচ্ছে না, অপরিচিত তিনটে মেয়ের সাথে থাকে?
কামিনী বেগমের হাসি চ‌ওড়া হয়। হাত বাড়িয়ে আকড়ে ধরে আফরার হাত। আফরা বুঝে যায় উত্তর। তবে মাথায় আসে না এ পর্যন্ত একটা কথাও কেন বলেনি কামিনী বেগম। ব্যাপারটা এখন সন্দেহের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আফরা বুদ্ধি খাটিয়ে আবার প্রশ্ন করলো,
~ আপনার ছেলের কথা মনে পড়ছে না?
কামিনী বেগমের হাসি স্থিরতায় ঢেকে যায়, আষাঢ়ে কালো মেঘের মতো মুখশ্রী না হলেও সাদা মেঘের উপর হালকা কালো মেঘেদের ছড়াছড়ি! কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। আফরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই কামিনী বেগম প্যান্টের পকেটে থেকে ছোট নোটপ্যাড বের করে। জলদি হাতে কিছু লিখে আফরা’র সামনে ধরতেই আফরার চোখে মুখে বিষ্ময় ফুটে উঠলো। সুন্দর বিন্যস্ত হাতের লিখা,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~ আমি কথা বলতে পারি না।
সন্তান তো মায়ের গর্ভ থেকে রক্তের সাথে মিশে যায়। বাবা-মা কখনো ভুলতে পারে?
আফরা’র মনে হচ্ছে সে অন্ধকার দেখছে। এত তথ্য যোগাড় করেছে এটা কোনো ভাবেই বুঝতে পারেনি! কামিনী বেগমের কুঁচকানো ভ্রু দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় আফরা। কিছু বলবে তার পূর্বেই বিকট আওয়াজ ভেসে আসে। দৃষ্টি চলে যায় শূণ্যে। মাটি থেকে খুব বেশী উঁচু তে নয়, বিমান ছুটে যাচ্ছে। আফরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে র‌ইলো। হুট করেই গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,

~ এবার অন্তত তাবু থেকে বের হো, তোর খুশি তো চলে এলো!
খোঁচা টা বেশ ধরতে পারলো মিরা। তবে উত্তর কাটলো না। না বাইরে গিয়ে দেখার স্বাদ জাগলো। চুপটি করেই পড়ে র‌ইলো। আফরা উত্তরের আশা করলো না বরং একপলক জলন্ত চোখে শূন্যে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কামিনী বেগম কিছুই ধরতে পারলো না, চুপ করেই র‌ইলো। শব্দ হীন কাটতে থাকলো সময়। চারটে মানুষের মনে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা। তবুও যেন ভাবনা গুলোর সমাপ্ত একটিমাত্র শিকড়েই! যে শিকড় গোড়া সহ উপড়ে ফেললে দন্ডায়মান বৃহৎ বৃক্ষ টাও লুটিয়ে পড়বে জমিনে!

চলন্ত বিমান থেমে যায় জঙ্গলের মধ্যভাগে। বেল্ট পরিহিত আদিল দক্ষতার সহিত নেমে আসে পাহাড়ের চূড়ায়। পর পর তিনটে লোক নেমে আসতেই বিমান টা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ঘুরে যায়। ঢেউ তীরে বারি খেয়ে সাগরে ফিরে যাওয়ার মতো ব্যাপারটা। হয়তো ঢেউয়ের মতো আবারো কোনো আধুনিক উড়ো যন্ত্র এসে বারি খাবে পাহাড়ের চূড়ায়। নামিয়ে দিবে অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিশাচর কে!

দানবীয় পাহাড় গুলো মানব সভ্যতার ছোঁয়া পেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে। চূড়া থেকে নামতে কোনো অসুবিধায় হলো না তাদের। ট্র্যাকিং সু অদ্ভুত শব্দ করে চলছে আগাছা মিশ্রিত অরণ্যের ভাজে‌। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। নির্দিষ্ট এক রাস্তায় আসতেই লোকগুলো আদিল থেকে আলাদা হয়ে গেল। একাকিত্ব কে বরণ করে কৃত্রিম আলোর সাহায্যে হাঁটছে সে। হাঁটতে হাঁটতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দৃষ্টিতে ধরতেই ঠোঁটের ভাজে অদ্ভুত হাসি খেলে গেল। আরেকটু এগোতেই দৃশ্যমান হলো তিনজন নারীকে। দুরত্ব বজায় রেখে আপন খেয়ালে বসে আছে। চারপাশ নজর ঘুরালো আদিল। কাঙ্ক্ষিত নারী টিকে সে দেখছে না কোথাও। তাবুটা চোখে পড়লো। কারো দিকে না তাকিয়েই হনহন করে তাবুর ভেতর ঢুকে পড়লো সে। চমকে গেছেন কামিনী বেগম, নাদিয়া’র চোখ মুখে ভয়-অবাকতা। আফরা ভাবালেশ তাকিয়ে র‌ইলো তাবুর দুলতে থাকা অংশের দিকে! নাদিয়া সম্মতিতে ফিরতেই ছটফট করে উঠলো। ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললো,

~ ভাইয়া! এখানে?
~ তুমি তো জানতে নাদিয়া! অভিনয় করছো কেন? নিঃসন্দেহে তুমি একজন ভালো অভিনেত্রী!
ভয় ছুটে গিয়ে রাগ হলো নাদিয়া’র। মেয়ে দুটো তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে বলতে সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ ক্ষণিকের দুনিয়ার অভিনয় সবাই করে! কেউ অন্যের সাথে, কেউ বা নিজের সাথে! আমি নাহয় নিজের সাথেই করছি। তুমি কার সাথে করছো আফরা?
আফরা হয়তো এই সময়ে এমন জবাব আশা করিনি। রাগ তার চোখেও ফুটে উঠলো। দুজনের মুখ কাছাকাছি, কঠোরতা-তেজি ভাব অদ্ভুত মেশালো বাক্যযুদ্ধ! আফরা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~ যেমন ধরো তোমার সাথেই করছি! এই যে নিরপেক্ষ কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না, অথচ মুখোমুখি বসে আছি! অভিনয় ই বটে!
নাদিয়া মুচকি হাসলো। সরে আসলো আফরা’র থেকে। সেকেন্ড ঘুরতেই আফরা মুখশ্রী তে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনলো। নাদিয়া আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাবুর দিকে তাকালো। উঠে যাওয়া ধরতেই হাত ধরে আটকে দিলো আফরা। গম্ভীর কন্ঠে বললো,

~ চুপচাপ বসো!
~ আমি তোমাকে ভাবী করতে চেয়েছি, মিরা কে নয়। বাঙালি বসতে বললে শুতে চায় তোমারাই তার প্রমাণ!
নাদিয়ার তাচ্ছিল্য কন্ঠস্বর আফরা’র মাঝে কোনো পরিবর্তন আসলো না। সহজ গলায় বললো,
~ বিয়ে তুমি করছো না, না সংসার তুমি করবে। তোমার কোনো অধিকার নেই আমার বা মি. আদিলের উপর তোমার ভালো লাগা, তোমার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিবে। আর তা যে আমরা মানবো এর কোনো সাক্ষরতা‌ও নেই। সৎ সাহস অর্জন করে তারপর এসো। নাহয় চুপটি করে বসে থাকো!
রাগে ফুঁসতে থাকে নাদিয়া। আফরা মুচকি হেসে তাবুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কামিনী বেগম কিছুই বুঝতে পারে না। তবে প্রশ্ন করে না, করতে পারে না। লেখার জন্য শক্ত হাতের প্রয়োজন। এখন তেমন শক্তি তার মাঝে নেই। ঘুম তাকে জড়িয়ে নিয়েছে।

কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলো মিরা। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে তার। চতুর মস্তিষ্ক বুঝতে বাকি রাখে কোনো পুরুষ এসেছে। কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে এসে বারি খাচ্ছে যে‌। চোখ বন্ধ রেখেই বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখা ছু* রিটা চেপে ধরে। ঘ্রাণটা খুব কাছে টের পেতেই ফট করে চোখ খুলে সে। বড় বড় রক্তিম চোখ নিয়ে ধপ করে দাঁড়িয়ে যায়। ডান হাতে থাকা ছু* রিটা বুক বরাবর চেপে ধরলো। থেমে গেল আদিলের পা! শান্ত চোখের দৃষ্টি পড়ে আছে কঠোর মুখশ্রীতে। আদিল মুচকি হেসে দু হাত উপরে তুলে নেয়। নরম কন্ঠে বলে উঠে,

~ বিগেস্ট ফাইটার! আ’ম ইমপ্রেসড!
কথাটা বলে এগিয়ে আসতে চায় আদিল। তবে বুকের উপর বসানো ছু* রির মাথাটা মাংসে ডেবে যেতেই দাঁড়িয়ে যায়। মিরা শক্ত কন্ঠে বললো,
~ এখানে কেন?
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না আদিল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠে,
~ আপনার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি কেন?
শক্ত মুখশ্রীতে বিচলিত ভাব ফুটে উঠে। মিরার ভেতর টা কেমন কেঁপে উঠলো। লোকটা তাকে দুর্বল করতে এসেছে? তার হাতিয়ার তার‌ই উপর বর্তাতে এসেছে? তাহলে কি আদিল মাহমুদ জানে না, আজকের মিরা আর দু বছর আগের মিরা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হয় মিরা। আদিল মাহমুদ জানবে কি করে? তার আসল পরিচয় সে যে সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছে! মিরা বললো,

~ আপনার যেমন গ* লা কা* টতে হাত কাঁপে না, আপনার বুকে ছু* রি ঢু* কাতে আমার‌‌ও হাত কাঁপবে না! পার্থক্য শুধু উদ্দেশ্য! নিজেকে খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়!
উঁচু তে তোলা হাত নামিয়ে ছু* রিতে রাখে আদিল। এবার একটু এগিয়েই আসে, বুকেতে ব্যাথার সৃষ্টি করে। পাত্তা দেয় না, ঠোঁটের ভাজে অদ্ভুত হাসি ধরে রেখে বললো,
~ কথা ঘুরাচ্ছেন কেন মিস মিরা? ময়দান থেকে প্রসঙ্গ পাল্টে পালিয়ে যাচ্ছেন?
ভীষণ রেগে যায় মিরা। কিছুটা উঁচু গলায় বলে উঠে,

~ আমার হাতিয়ার আমার উপরে এপ্লাই করবেন না। আপনি এখন আমার কব্জায়, সাবধান! চলে যান এখান থেকে!
শব্দ করে হেসে উঠলো আদিল। মেয়েটার চোখ অন্য কথা বলছে। তবে সে ধরতে পারছে না। মিরা ছু* রি টা শব্দ করে নিচে ফেলল। আদিল শান্ত দৃষ্টি তে কিছুক্ষণ মিরার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই ঘুরে দাঁড়ালো। শব্দ বিহীন কয়েক পা এগিয়ে মিরা’র উপর দৃষ্টি ফেললো‌‌। দুর্বোধ্য রহস্য কন্ঠে বললো,
~ আপনার ওই কঠোর হরিণী চোখে আদিল মাহমুদের মরণ হলো রাজনন্দিনী!

হনহন করে বেরিয়ে গেল আদিল। মিরা কে ফেলে গেল অসীম অস্বস্তির ভিড়ে। আদিলের চোখে কুটিলতা খুঁজে পায় নি মিরা। যদিও ওই চোখ সর্বোপরি পড়ে ফেলা তার সাধ্যে নেই। তবে আজ কেন ওই চোখ তাকে পুড়াচ্ছে। সম্বোধন টা কয়েকবার অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করলো সে। টের পেল নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। হাঁপানি রোগীর মতো ছটফট করতে লাগলো সে। নিজের সাথে লড়াইতে যখন সে বুঝলো একেবারে সর্বশান্ত হয়ে হেরে যাচ্ছে, এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো তাবু থেকে। আফরা জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে তাকিয়ে মনের আগুন টা নিভিয়ে রাখছিল। ঠিক তখন‌ই মিরা ঝাঁপিয়ে পড়লো আফরা’র বুকে। চোখ বুজে নিলো আফরা। হৃদপিন্ড তার কাঁপছে। মিরা’র ভবিষ্যত তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে বারংবার। আফরা’র বুকে লুকিয়ে থাকা শরীর টা খানিক পর পর কেঁপে উঠছে। অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে লুকিয়ে। তারা তো অশ্রু ঝরাতে এসেছিল, কোন ঝড়ে দিক পাল্টে গেল?

মিহি ঘুমিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মনিরা। একটু পর পর বাইরের দিকে নজর দিচ্ছে। আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে আহিশ। মনিরা’র মন চাচ্ছে আহিশের পাশে বসতে। কাঁধে মাথা রেখে রাত্রিটা যাপন করলে মুহূর্ত গুলো দাগ কাটার মতো হবে? নিজের মনোবাসনা’র উপর নিজেই বিস্মিত মনিরা। এরকম ভাবনা আজ সে ভাবছে? সে কি নিজের জীবনের সত্যটা ভুলে গেছে? তার মতো বিধবা, এক মেয়ের মা কে কেউ ভালোবাসবে? সে ভালোবাসা’র যোগ্য? আবার হুট করেই মনে হলো তার কি ভালো থাকার অধিকার নেই? তার মন যে ওই পুরুষটার প্রেমে ইতিমধ্যে ডুবে গেছে সে তো মিথ্যে নয়। শুধু প্রেম ভুল হবে না? এই যে মানুষ টাকে হারানোর ভয় তাকে গ্রাস করছে। এটা ভালোবাসা নয়?

নানান রকম ভাবনার মিশ্রণ মনিরা‌ কে যেন পাগল করে তুলছে। ভেতরের খারাপ সত্যটা যেন তাকে কঠোর হতে বাধ্য করছে। বাধ্য করছে জোর করে হলেও ভালোবাসা আদায় করতে! সে পারবে? না এবার‌ও জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে একাকীত্ব কে বরণ করে নিতে হবে?
~ এই মেয়ে ইচ্ছে হলে বাইরে আসতে পারো! আমি কাপুরুষ নয় তোমার একাকীত্বের সুযোগ নিবো!
চমকে উঠে মনিরা। অবচেতন মন যেন একাকীত্বের সুযোগ নেওয়ার তাড়নায় বয়ে যাচ্ছে। মনিরা কি তাহলে বিপথে যাচ্ছে? ভালোবাসা হারানোর ভয় তার মনুষ্যত্ব কে বলিদান দিয়ে দিলো? মাথা ঝেড়ে ভাবনা গুলো কে দূরে ফিকে মারে মনিরা। চোখ বুজে জোরে শ্বাস নেয়। আস্তে আস্তে পা ফেলে বাইরে আসে। আহিশের থেকে যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে বসতেই আহিশ বলে উঠে,

~ ভয় পাচ্ছো? পাচ্ছো না? তোমার অবশ্য‌ই ভয় পাওয়া উচিত। পুরুষ মানুষ দিয়ে বিশ্বাস নেই। কখন কোন সত্তা টা জেগে উঠে বলা যায় না। ধরো এত সুন্দর মেয়ে, নারী দেহ দেখে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। তখন কি করবে? গভীর অরণ্যে নিজের সতীত্ব বিসর্জন দিবে? যদিও আমি ধ* র্ষণ কে কখনোই সতীত্ব নষ্টের কারণ মনে করি না। নারী যদি নিজ থেকে এগোয় তবেই তার সতীত্ব বিসর্জন হবে! কিন্তু পুরুষ যদি জোর করে এগিয়ে আসে, আমার মতে নারীর সতীত্ব নষ্ট সে না ভাবা পর্যন্ত হবে না। পবিত্র সে সর্বদায়, যদি না নিজ থেকে অপবিত্রতার পথ বেছে না নেয়!

থেমে জোরে নিঃশ্বাস নিলো আহিশ। একটানা কথা বলে হাঁপিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবার বললো,
~ কোথায় যেন ছিলাম? ওহ, এইতো। আমি যদি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি তুমি নিশ্চয়ই তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে চাইবে। এর জন্য প্রয়োজন হাতিয়ার! কিন্তু তোমার কাছে নেই! প্রত্যেক নারীকে অবশ্যই নিজেকে প্রটেক্ট করার হাতিয়ার সাথে রাখা উচিত!
কথাগুলো বলেই আহিশ পকেট থেকে মাঝারি আকারের ছুরি বের করে মনিরা’র সামনে ধরলো। এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে মনিরা কথাগুলো শুনছিলো। ছুরিটা চটজলদি নিজের হাতে নিলো, কখন না ধমক দিয়ে বসে। হাতে হাত স্পর্শ হতেই মনিরা’র সারা শরীর কেমন কেঁপে উঠলো, আহিশের মধ্যে তেমন ভাবাবেগ দেখা গেল না। সে তার মতোই আগুনের আলোয় হাতে রাখা ইংরেজি নোবেল টা বিড়বিড় করে পড়ছে। এতেও যেন মনিরা অন্যরকম গাম্ভীর্য খুঁজে পেল। মুচকি হেসে আপন মনে গেয়ে উঠলো,
~ সখি ভালোবাসা কারে কয়!..

পাহাড়ের চড়াই-উতরাই, ঝিরিপথ, বুনোফুলের দল এসব পেরিয়ে ২ দিন ট্রাকিং করে নেপিউ পাড়া পৌঁছেছে আফীফ! এরপর বাংলাদেশের এই অংশে আর কোনো পাড়া নেই। আছে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড় পেরিয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত শুরু। বান্দরবানের পাড়াগুলোতে রাতে থাকার ব্যবস্থা থাকলেও আফীফ ইচ্ছে করেই তাবু নিয়েছে। এবংকি পাড়াতে ঢুকার সাথে সাথে গাইড কে তার প্রাপ্য সহ বখশিশ দিয়ে বিদায় করেছে। বিশ্রাম নিচ্ছিলো, ফোনের শব্দে বন্ধ চোখের পাতা উন্মুক্ত হয়। অচেনা নম্বর, ঝটপট রিসিভ করে। অপর পাশ থেকে মেয়েলী সুর ভেসে আসে,

~ আফীফ মুনতাসির বলছেন?
~ বলছি বলেই তো ফোন দিয়েছেন!
~ বড্ড বেশী কথা বলেন আপনি!
~ বড্ড বেশী রহস্যময়ী সাজেন আপনি!
~ যে জন্য ফোন করা।
~ কারণ শোনার অপেক্ষা।
চরম বিরক্ত হয় আফরা। নাকের পাটা ফুলে উঠে তার। আফীফ নিশব্দে হাসে। মেয়েটা কে ডিসটার্ভ করতে ভালো লাগছে। ভেবেছিল আফরা এবারো কিছু বলবে। তবে তার ভাবনা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আফরা বললো,
~ অপেক্ষা’র ফল মিষ্টি হয়!
কথাটা শেষ করেই ফোন টা কেটে দিলো‌ সে। আফীফ কপাল কুঁচকাতে গিয়েও হেসে ফেললো। বিশ্রামের ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে তাবু থেকে বেরিয়ে পড়লো। এদিকের জীবন গুলো কত জটিলতায় ঘেরা। না আছে উন্নত জীবন ব্যবস্থা। না আছে আধুনিকতার সহজর ছোঁয়া। তবুও তাদের জীবন ব্যবস্থা তাদের হিসেবে মানানসই!

গোধূলি বেলায় গোটা তান্দুই পাড়া ঘুরে দেখলো আহিশ’রা। পাহাড়ের উপর থেকে এই পাড়া দেখতে কেমন জানি বিভ্রম লেগেছিল। যেন গভীর অরণ্যের মাঝে দলবদ্ধ মানুষের বসতি। সন্ধ্যার দিকে ধীরে ধীরে পাড়ায় নামছে মেঘের দল। চোখের পলকেই জোছনা নেমেছে প্রকৃতিতে। ধবধবে সাদা আলোয় মেঘে ঘেরা এই জনপদ আরও রহস্যময় হয়ে ওঠার অনবদ্য দৃশ্য! কোনো গহ্বরে চুপটি করে লুকিয়ে থাকার মতো। যেন বের হলেই জোছনা তাদের গভীর অরণ্যের মাঝে দৃশ্যমান করে তুলবে, দানবীয় পাহাড় হায়েনার মতো এগিয়ে আসবে!

মিহির জন্য খানিক পিছিয়ে গেছে আহিশরা। মেয়েটা হাঁটতে এরহিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। হাঁটার গতি এত ধীর ছিল পিঁপড়াও যেন নিজের আয়তন অনুসারে প্রথম স্থান অধিকার করে নিবে। বিকেল হয়ে যাওয়ায় আজকের রাতটা পাড়ায় থাকতে হচ্ছে তাদের। দুর্গম পথ রাতে পাড়ি দেওয়া মৃত্যর মুখে যেচে যাওয়া সমান কথা! পথের ক্লান্তি ভুলতে ঝিরিতে প্রাকৃতিক স্পা শ্রেষ্ঠ মাধ্যম! নিজস্ব তাবু নিয়েছে এখানেও। যদিও থাকার ব্যবস্থা অন্যত্র ছিলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এলো বলে। পায়ে ট্র্যাকিং সু জড়িয়ে আহিশ মনিরা’র দিকে তাকালো। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। নরম সুরে বললো,

~ আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে রাত হতে পারে। তাবুর দরজা ভালো করে বেঁধে নিবে। ভয় নেই, কেউ আসবে না। আসলেও বের হবে না। নিঃশ্বাসের শব্দ‌ও যেন না হয়!
আড়ষ্ট হয়ে মনিরার মুখ ভুতা হয়ে এলো। এই অচেনা জায়গায় লোকটা তাদের রেখে কোথায় যাবে? যদি কোনো জীবজন্তু চলে আসে? আহিশ মনিরা’র মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করলেও আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলো না। তার কাছে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্মুখে দন্ডায়মান। তাবু থেকে বের হয়ে যেতেই মনিরা’র মনে হলো সে অথৈ সাগরে ডুবে যাচ্ছে। সত্যিই তাদের রেখে চলে গেল? বিষণ্ণ মুখশ্রীতে ভয় গুলো যেন কিলবিল করছে‌। আহিশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর‌ও ফিরে এলো। তাবুর খোলা অংশে উঁকি দিয়ে বলে উঠলো,

~ এই মেয়ে, তোমাকে খুঁটি হয়ে বসে থাকতে বলিনি, দরজা বাঁধতে বলেছি। আমি আশেপাশেই আছি, ভয় নেই!
সেকেন্ড সময় ব্যয় না করেই হাঁটা ধরলো আহিশ। ‘আশেপাশেই আছি’ শব্দ দুটোই কি ছিল মনিরা জানে না, তবে তার ভয় কেমন মন থেকে উড়ে যেতে লাগলো। মনে হলো অদৃশ্য এক ভরসাস্থল তাকে ঘিরে রেখেছে। তাবুর দরজা বন্ধ করে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লো সে। দুদিন ধরে একাকীত্ব তাকে ছুঁতে পারে না। ছুঁতে পারে না কোনো কালো রাতের বিভৎস কাহিনী। ছুঁতে পারে না মন খারাপেরা। শুধু ছুঁয়ে দেয় আহিশ নামক পুরুষ টি। কথা দ্বারা, কাজ দ্বারা নয়তোবা উপস্থিতি দ্বারা। এ কোন সুখে পড়লো সে? এই সুখ কপালে স‌ইবে তো?

জোছনার আলোয় হাঁটতে কোনো অসুবিধায় হচ্ছে না। যদিও হাতে কৃত্রিম আলোর উৎস রয়েছে‌। ঝোঁপঝাড়, গাছগাছালি, আগাছা পেরিয়ে হাঁটতে থাকে আহিশ। হাতে থাকা ঘড়িতে টাইম দেখে নিয়ে পায়ের গতি স্থির করে নেয়। অনেকটা সময় রয়েছে। একা একা মুটেও ভালো লাগছিলো না তার। ইদানিং একাকীত্ব কে বরণ করে নিতে কষ্ট হয়। হয়তো একাকীত্ব জীবন ছেড়ে তিন নারীর সঙ্গ পেয়েছিল বলেই আজ একাকীত্ব তাকে বাঁধতে পারছে না। ডান হাতে থাকা টর্চ লাইট বাম হাতে স্থানান্তর করে, ডান হাত গলিয়ে দেয় পকেটে। মানিব্যাগ টা হাতে তুলে নিয়ে মুচকি হাসে। সে তো ভুলেই গিয়েছিল তার সঙ্গিনী যে তার সাথে প্রতিটা সেকেন্ড রয়েছে। সে কেন একা মনে করবে নিজেকে? আহিশের এখন মনে হচ্ছে সত্যিই সে একা নয়। অদৃশ্য এক অবয়ব নিজের পাশে স্থাপন করে নেয় সে। যেন হাত ধরে হাঁটছে তার সাথে পা মিলিয়ে। মুচকি হেসে বলে উঠলো,

~ তোমাকে খোলা চুলে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে? সবটা সময় বেণী বেঁধে রাখো কেন?
~ আমার যে ভালো লাগে।
~ তোমাকে নিজের করে নিয়ে আসি, তারপর দেখবো কিভাবে বেণী করে রাখো। প্রতিটা ক্ষণ চুলের ভাজে মুখ লুকিয়ে ঘ্রাণ নিবো।
মেয়েটা বুঝি লজ্জা পেল? আহিশ অপলক তাকিয়ে র‌ইলো তার পাশে। ঘোরের মধ্যে বলে উঠলো,
~ লাজুকলতা প্রেমপিয়াসী আমার বুকে লুকিয়ে থাকো না! তোমার ওই লাজুক মুখশ্রী দেখে যে আমার হৃদয় কম্পমান হতে হতে থেমে যাবে। অতঃপর মৃত্য!
খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটি। হাসতে হাসতে চোখ দুটো কেমন ছোট ছোট হয়ে এলো, পানি জমতে শুরু করলো কার্ণিশে। হাসতে হাসতেই অদ্ভুত কন্ঠে বললো,

~ এই মৃত্য‌ই যে আমাদের আলাদা করে রেখেছে। নিয়তির নির্মম করাঘাতে আমি নামক মেয়েটি যে কলঙ্ক। ঝলসে দিল দেহ, জ্বলে যাচ্ছে আহিশ। শেষ করে দিচ্ছে আমাকে, আমার ভীষণ কষ্ট হয় আহিশ। আমি যাচ্ছি গো তোমাকে একা ফেলে, চলে যাচ্ছি!
এলোমেলো কন্ঠস্বর মিলিয়ে যায় পাহাড়ের বুকে‌। বারংবার বারি খায় আহিশের কর্ণকুহরে। মেয়েটিও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে। দিশেহারা হয়ে খুঁজে আহিশ। নেই! কোথাও নেই! আহিশের আর্তনাদ দানবীয় পাহাড় কেমন আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে।
~ ভাই! জলদি আহেন।

জঙ্গলের কোথাও থেকে চাপা চিৎকার। আহিশ নিজের কাল্পনিক ভাবনা থেকে বের হয়। মেয়েটা এখন তার কল্পনাতেই রাজত্ব করে। সামনাসামনি তো ধোঁয়াশা! চাপা আ‌ওয়াজ কে‌ অনুসরণ করতেই কয়েকটা যুবক কে চোখে পড়ে‌। তার দিকেই কেমন করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় আহিশ। মুখশ্রী শক্ত করে বললো,
~ খবর কি?
যুবক গুলো যেন আহিশের কথা কানেই নিলো না। একজন প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে উঠলো,
~ ভাবী কে এখনো খুঁজে পান নি? খুব মিস করেন না?
চোখ রাঙিয়ে তাকায় আহিশ। ছেলেগুলো মাথা নিচু করে নেয়। কঠোর কন্ঠে আহিশ বললো,
~ প্রশ্নের জবাব আমি দ্বিতীয় বার চাই না!

~ ভাই, কয়েকজন কে একটু আগেই বেরিয়ে যেতে দেখলাম। আমরা এখন পিছু নিতে পারবো।
আহিশ কিছু না বলে পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো‌। হাঁটতে হাঁটতেই গলা খানিক উঁচিয়ে বললো,
~ আজকের রাতের অল ডিটেলস ফযরের পর চাই! আগ থেকেই জানাছিল কি করতে হবে। এবার আদিল মাহমুদ ফাঁক দিয়ে বের হয়ে গেলে, একটাকেও জীবিত রাখবো। আমি দেখতে আদর্শ, তবে ভেতরে বড্ড হারামি!

ব্যস্ত হাতে ল্যাপটপে আঙুল চালাচ্ছিল আফীফ। পাশে ফোনে কথা বলছে জিয়াউল। মাঝে মাঝে অপর পাশের মানুষটার উপর চড়াও হচ্ছে। আফীফের সেদিকে খেয়াল নেই‌। সময় খুব কম, চটজলদি কাজ গুলো না শেষ করলে সমস্যাটা তার‌ই! কোনো দিক তাকাবার ফুসরত নেই যেন। এমন সময় মেয়েলি কন্ঠের অদ্ভুত ভাষা ভেসে আসে কর্ণকুহরে,
~ শিকুবায়া! ঙ্গাঁ কোবা ইনদো ওয়াংফো রাফ্ ল?

গতিতে থাকা আঙুল থেমে যায় আফীফের। ভ্রু কুঁচকে জিয়াউলের দিকে তাকায়। ছেলেটা এখনো ফোনে কথা বলছে। অগত্যা আফীফ উঠে দাঁড়ালো। দরজার বাঁধন খুলে বাইরে বেরোতেই চোখে পড়লো সালোয়ার কামিজ পড়া সুশ্রী এক মেয়েকে। আফীফ চিনতে পারলো না, তবে উপজাতির কেউ ধরতে পারলো‌। তাদের থেকে মুখের শ্রী আলাদা।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি খানিক ঝুঁকে বললো,
~ শিকুবায়া! ঙ্গাঁ নামে অনান! ঙ্গাঁ নেপিউ পাড়া গা লাচোয়া!
আফীফ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মেয়েটির ভাষা সে বুঝতে পেরেছে।এসব তার আয়ত্বে রয়েছে, তবে মেয়েটির আসার কারণ সে বুঝতে পারছে না। অনান এবার সহজ কন্ঠে বললো,
~ কোবাংনা চাগা তোঁখোঁয়াই হিঁয়ে?

আফীফ মাথা নেড়ে সায় জানায়। মেয়েটি কিছুক্ষণ আফীফের দিকে তাকিয়ে থাকে। চট করেই তার চোখ কেমন খুশিতে চকচক করে উঠে। চঞ্চল সুরে বলে উঠলো,
~ আসসালামু আলাইকুম! আমি কি আপনার বাসায় ঢুকতে পারি? আমার নাম অনান। এই পাড়াতেই থাকি। আপনার সাথে একটু কথা ছিল!
আফীফ বিরক্তের সাথে অবাক হয়‌। প্রথমত সে মেয়েটির ভাষা খুব বুঝেছে, তা বুঝতে পেরেও মেয়েটি তাকে বাংলায় বুঝিয়ে অক্ষমতা টাকে নির্বাক করার প্রয়াস চালালো। দ্বিতীয়ত মেয়েটি এত সুন্দর বাংলা বলছে। তবে সেসব বিষয়ে কোনো কথা না বলেই বললো,

~ আমি আপনার কথা সম্পূর্ণ‌ই বুঝতে পেরেছি ম্যাম। এখানে আসার‌ কারণ যদি বলতেন উপকার হতো।
কেমন একটা‌ বিদ্রুপ মিশে আছে যেন। অনান হাত দিয়ে নাক ঢলে বললো,
~ পর্বতের চূড়ায় উঠতে গাইড লাগবে বলেছিলেন। আমাকে আপনাদের সার্ভিস দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে।
ভ্রু উঁচিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো আফীফ। তারপর বললো,
~ আজ লাগবে না, কাল সকালে চলে আসবেন! এবার আসতে পারেন!
অনান মুচকি হাসলো। ভনিতা না করেই বললো,

~ জি আমি জানি আজ এখানে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এসেছি একটা খবর দিতে। আজ রাতে পাড়ায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। মূলত গান, বাজনা, নাচ, গান, লাঠি খেলা এসবের। পাড়ার হেড আপনাদের আমন্ত্রণ করেছেন, এও বলেছেন আপনারা থাকলে খুব‌ই ভালো লাগবে তাদের। আপনাদের কোনো অসুবিধায় হবে না। নিজ দায়িত্বে তাবুতে নিয়ে আসবে‌‌। চাইলে আপনারা পাড়াতেই থাকতে পারেন!
শেখানো বুলি গুলো আওড়িয়ে ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো অনান। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। তখন আফীফের মুখশ্রীতে বিষ্ময়। আজ অনুষ্ঠান হলে কেমন করে হবে? আফীফ দুম করেই প্রশ্ন করে বসলো,

~ আপনাদের ধর্মীয় উৎসব? নাকি হুট করেই আয়োজন করা হয়েছে?
~ না না ধর্মীয় নয়। অনেক দিন হলো গান বাজনার আয়োজন হয় না, হুট করেই কেন আজকের রাত ঠিক করলো আমি সঠিক জানিনা। হেড আমাকে এও বলেছে, আপনাদের চোখে চোখে রাখতে। দু দন্ড সময় ও চোখের আড়াল না করতে‌। তাই এখন থেকে আমি আপনাদের সাথেই আছি।
কথাগুলো বলেই অনান ভেতরে গেল। আফীফ তাজ্জব হয়ে অনানের যাওয়া দেখলো‌। খটকা টা ঠিক জায়গায় লেগে গেছে‌। আজ রাতের প্রটেকশনের জন্য‌ই এমন আয়োজন বুঝতে বাকি রাখে নি আফীফ। তবে মেয়েটি তাকে সরাসরি কেন বললো? আচরণে কেমন বাচ্চা বাচ্চা ভাব। সত্যিই কি বাচ্চা নাকি মেয়েটা ভান করছে ধরতে পারলো না আফীফ। মাথায় জট পেকে যাচ্ছে। কয়েক কদম এগিয়ে আফীফ ঘাসের উপর বসলো। হিসেব মিলেও যেন মিলছে না।
অনান ভেতরে গিয়ে বসে পড়ে। জিয়াউল পেছন ঘুরে তখনো ফোনে কথা বলছিলো। কারো উপস্থিতি তে ঘুরতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। অনান অস্বস্তি তে পড়ে নিজের মুখ ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে তবে নিয়তি আজ তার সাথ দেয় নি। কিছুটা চেঁচিয়েই উঠে জিয়াউল,
~ তুমি? তুমি এখানে কি করছো? দেখ তোমার পিক আমার ফোনে নেয়। আবার কি চাই?
ছবির কথা বলতেই জিভেতে কামড় বসায় অনান। চটজলদি মানানোর মতো করে বলে উঠে,
~ ওসব কথা তুলে লজ্জা দিবেন না প্লিজ‌। আমি আসলেই বান্ধবী দের পাল্লায় পড়ে ওরকম করে ফেলেছি। পরে আপনার ফোন ফেরত দিয়েছিলাম এক আপুকে দিয়ে।

জিয়াউলের রাগ তবুও কমে না। কমবে কি করে? এই মেয়েটার জন্য‌ শুধু শুধু তার বকা শুনতে হয়েছে। তেড়ে যেতে নিয়েও থেমে যায় সে। মেয়েদের সাথে ঝগড়া করতে পারে, তবে অসম্মান নয়। ঠোঁট কামড়ে রাগ নিবারণ করার চেষ্টা চালায় সে। তবে পারে না, বারবার মনে হয় এই মেয়েটার জন্য‌ই পুরো একটা রাত তার অসহ্য মাথা ব্যাথা ছিলো, সারা‌ শরীর ভর্তি টেনশন ছিলো। রেগে তাবু থেকে বেরিয়ে যায়। রাগ টা কমানো উচিত!

জোছনার রাত! প্রকৃতি যেন সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। চারপাশ কেমন আলোয় জ্বলজ্বল করছে। চুপচাপ বসে ছিল আফীফ। হিসেব মেলাতে মেলাতে কখন সে প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে হিসেব ভুলে গেছে টের পায় নি। টের পেল কারো নূপুরের রিমঝিম শব্দে। কর্ণকুহরের রহস্যময় ছিদ্র পথে শব্দ ঢুকে গিয়ে মস্তিষ্ক কে কেমন উত্তেজিত করে তুললো। সারা শরীরে অদ্ভুত হাওয়ার ছুটোছুটি। চোখ তুলে আশেপাশে তাকায়। শব্দের উৎস খুঁজে না পেয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। এদিক ওদিক হাঁটে চোখ ঘুরিয়ে। শব্দ টা ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে। দাঁড়িয়েই পড়ে সে। ওই যে অদূরে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে। সাদা এলোমেলো শাড়ি, আঁচল লেপ্টে আছে জমিনে।

হাঁটুর নিজ পর্যন্ত চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে, সাথে নূপুরের ঝমঝম শব্দ। আফীফের মনে হলো বুকটা ছলাৎ করে উঠলো‌। ক্রমশ ‌ই তার‌ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে পায়ের ঈষৎ কাঁপুনি। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে আফীফ ঘাস ধরে বসে পড়ে মাটিতে। চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন হয় না। একভাবেই পড়ে আছে এলোকেশী মেয়েটির উপর। আস্তে আস্তে ছায়া মিলিয়ে যেতে থাকে, এক সম্মোহনী ঘোরে এগিয়ে যেতে থাকে আফীফ। নাগাল‌ পায় না, থেমে যায়। ততক্ষণাৎ মস্তিষ্ক তার সচল‌ হয় না। অদ্ভুত অনুভূতি টের পায় নিজের মধ্যে। এটা কি চট করে প্রেমে পড়ার লক্ষণ? শুধু মাত্র এলোমেলো শাড়ি, চুলের গোছা দেখে প্রেমে পড়া যায়? প্রশ্নের উত্তর পেল না আফীফ। শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,

~ কোলাহল মুক্ত নির্জন পথ, পূর্ণিমার আলোয় প্রকৃতির জ্বলজ্বল ভাব বিস্তৃত!
অজানা এক এলোকেশী,
হৃদয় করে গেল ছিন্নভিন্ন!
…..
~ রাজনন্দিনী!
ফিসফিস শব্দে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে মিরা। কানে থাকা ফোনটা নামিয়ে নম্বর টা আবার দেখে নেয়‌। অচেনা নম্বর যে আদিল হতে পারে ভাবে নি হয়তো। মিরা কঠোর কন্ঠে বলে উঠে,
~ ডাকবেন না এই নামে! কি চাই?
হাসির শব্দ। নরম কন্ঠে আদিল বললো,
~ আমার একটাই রাজনন্দিনী! ডাকবো না?
আদিল মাহমুদ যে চিৎকারের বিনময়ে এমন নরম সুরে কথা বলবে মিরা হয়তো ভাবতে পারেনি। ভাবার কথাও না! প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আদিল আবার বললো,

~ আপনাকে নিজ স্বার্থেই চাইবো আমি! খুব জলদি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে! পরীক্ষা হয়ে যাক না! নিষ্ঠুর হৃদয়ের পুরুষ নিষ্ঠুর হৃদয়ের নারীর মনে জায়গা করতে পারে কিনা!
কথা বলার কিছু খুঁজে পায় না মিরা। বুকের ভেতর অসহনীয় পীড়া কাবু করে দিচ্ছে তাকে। মিরা ফোন কাটতেই শব্দ করে হেসে উঠলো আদিল। যেন কৌতুক পেয়েছে। রাজনন্দিনী নামে সেইভ করা নম্বরে একপলক চোখ রেখে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
~ কঠোর বাজখাঁই কন্ঠটাও সুধাময় লাগছে কেন রাজনন্দিনী? তবে কি আদিল মাহমুদ সত্যি সত্যি ডুবে গেল? নাকি সাঁতারে পারদর্শীতার প্রমাণ দিচ্ছে?
হাসির শব্দ! কানে বাজার মতো! কি ঘুরছে তার মনে? এ কেমন খেলা? ধ্বংস না সৃষ্টির ফুল ফুটবে? সর্বনাশা খেলায় মত্ত থেকে ভুল করছে না তো আদিল মাহমুদ?

পায়ে ট্র্যাকিং সু পড়ে ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মিরা। ফোনের ক্যামেরা অন করে বারবার মুখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। চুল গুলো খুব শক্ত করে খোঁপা করা। রঙিন এক কাঠি খোঁপা টাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। প্রসাধনী বিহীন মুখটা স্নিগ্ধ, গম্ভীর। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক মিশিয়ে পেছনে দাঁড়ানো আফরা’র দিকে তাকালো মিরা। এক‌ই পোশাকে আবৃত, পার্থক্য শুধু পিঠে এলোমেলো কেশের গোছা। মিরা’র চোখে মুগ্ধতা, হাত বাড়িয়ে দিলো চুলের ভাজে। আপ্লুত কন্ঠে বললো,

~ যত্ন বিহীন এত সুন্দর চুল?
~ কে বললো যত্ন নিই না?
আফরা’র পাল্টা প্রশ্ন। মিরা খানিক অবাক হলো। সে তো কখনো যত্ন নিতে দেখেনি। আফরা চুল গুলো খোঁপা করতে করতে বললো,
~ আব্বা বলতো আম্মার আর কিছু না পেলেও চুল টা পেয়েছি। আম্মা চুল সামলাতে হিমশিম খেতো, কখনোই একা শ্যাম্পু করতে পারতো না। ঠিক ভাবে পরিষ্কার হতো না, জট পেকে যেত। বিয়ের আগে নানু আর মামা সাহায্য করতো, আর বিয়ের পর আম্মা’র চুলের দায়িত্ব তো আব্বা’ই নিয়েছিল। কি যে পাগলামি করতো! আম্মা তো মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে চুল কেটে ফেলতে চাইতো। তখন আব্বা এক গাল হেসে বলতো আম্মাকে বিয়ের সাথে নাকি তার চুল কেউ বিয়ে করেছে। তাই আম্মার কোনো অধিকার নেই চুলের উপর নির্মম অত্যাচার করার।

বক্তা হিসেবে পারফেক্ট যেন, কথাগুলোয় আকাশ ছোঁয়া ভালোলাগা মিশে ছিল। গড়গড় করে অনুভূতিহীন বলে যাওয়া নয়, কথাগুলো ছিলো অনুভূতির দাপটে হেলে পড়ার মতো। না হলে এমন নিষ্ঠুর মেয়েটাও স্নিগ্ধ হাসি ফুটাবে মুখে? আফরা কথাগুলো বলে মিনিট খানেক সময় ঠোঁটের ভাজে হাসি ধরে রেখে জানালা ভেদ করে কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। দৃষ্টি সরিয়ে অত্যন্ত হেলায় বলে উঠলো,
~ আম্মার মতো তো সঙ্গী নেই, তাই বড় হলেই হাঁটুর নিজ পর্যন্ত চুল কেটে হাঁটুর উপর নিয়ে আসি। আম্মার আদর মিশে না থাকলে কবেই কাঁধ পর্যন্ত করতাম!
ভীষণ রকম চমকালো মিরা। সামনের মেয়েটা তার একটা কথার পরিপ্রেক্ষিতে এত কথা নিমিষেই আবেগ মিশিয়ে বলবে সে ভাবতেও পারেনি। নির্মল হাসিটা মিরা বুক কাঁপাতে যথেষ্ট ছিলো না? ছিলো! তবুও আফরা আজ যেন মিরা কে অবাক করে দিতেই সমস্ত পরিকল্পনা আগ থেকে সাজিয়েছে। মিরাকে অবাক মনোভাব পোষণ করতে দিলো না আফরা। হতাশ কন্ঠে আবার বললো,

~ ঝামেলা, ঘুরা ঘুরির জন্য খেয়াল ই ছিল না। এখন দেখ, হাঁটু ছাড়িয়ে পায়ের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। মহাজ্বালা!
কথাগুলো এমন ভঙ্গিমায় আওড়ালো মিরার মনে হলো সংসারের চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়া কোনো আটপৌরে বধু নিজের জ্বালা’র কথা শুনাচ্ছে। সাংসারিক কাজ করেই ফুসরত পায়না, সেখানে চুলের যত্ন‌ নিবে কেমন করে, ভাবটা এমন।

আচমকা মিরার খুব কান্না পেল। তাদের জীবন তো এমন না হলেও পারতো! সুন্দর একটা পরিবার থাকতে পারতো, হাসি খেলে কাটিয়ে দিতো। বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে কেউ তাদের জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতো, তাদের জন্য‌ও কেউ চিন্তা করতো। এক বেলা না খেলে বকে খাইয়ে দিতো, এলোমেলো চুল আঁচড়ে বেণী করে দিতো।
ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠলো। ভেজা চোখে মিরা ঝাপসা দেখলো কঠিন চোখের কার্ণিশে জলে’রা লুকোচুরি খেলছে। সে কি ভুল দেখছে? নিজের ভেজা চোখের প্রতিবিম্ব কি আফরা’র চোখে দেখছে? নাকি মেয়ে টা হাঁপিয়ে গেছে, শেষমেষ তার সামনে নিজেকে প্রকাশ করেই ফেললো! মিরা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। একপ্রকার কেড়ে নেওয়ার মতো করে আফরাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। কোনো ভাবাবেগ প্রকাশ করলো না আফরা। হাত পা ছেড়ে দিয়ে আগলে নিলো মিরা কে! কান্না ভেজা কন্ঠে মিরা বললো,

~ একটু কাঁদ না আফরা! বুকের জমানো দুঃখ গুলো বাষ্প হয়ে উড়িয়ে দে! এই যে আগলে নিয়েছি মৃত্য‌ও কখনো আমাদের পার্থক্যের জের টানতে পারবে না। কঙ্কালসার হয়েও আমি তোর নিঃশ্বাসের সাথে মিশে থাকবো। তোর চোখের জলে আমার বুক ভাসুক! আজকে অত্যন্ত বের হয়ে আয় শক্ত খোলসের আড়াল থেকে।
নিশ্চুপ! আশপাশ থেকে অজানা অচেনা নানান প্রজাতির কীট পতঙ্গের আওয়াজ ভেসে আসছে, বাতাসে ঝাপটায় গাছের ডাল গুলোর মধ্যে যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে। কখনো কখনো হয়তো এমন নিশ্চুপতায় সাপের পিলপিল করে হেঁটে যাওয়ার শব্দ‌ও ভেসে আসবে! মাঝারি সাইজের তাবুতে দুটো রমনী যে নিঃশব্দে জমানো দুঃখ গুলো তরল পদার্থের মাধ্যমে বহিরাগমনের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে, কেউ কি হুট করেই টের পাবে? হয়তো পাবে, আবার হয়তো পাবে না। সময় পেরিয়ে গেল অনেকটা। মিনিট মিনিট করে কখন ঘন্টার অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেল আফরা-মিরা‌ কেউ ই টের পেল না। দুজন রমনী একত্র হয়েছে, ঘনঘন পিঠ কেঁপে উঠছে। তবুও তারা এই কাঁপুনি নিরসন করছে না। শব্দ করে কান্না করে নিজেদের দুর্বল প্রমাণ ও করছে না। চোখের জল ফেলতেও যেন এক প্রকার গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। নিজেদের প্রয়োজনেই জল বিসর্জন দিচ্ছে, তবে মানতে নারাজ! এমন লড়াই কয়জনে পারে? শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে তো?

আরো মিনিট খানেক পর স্বাভাবিক হলো দুজন। তবে কোনো লজ্জা, অস্বস্তি, ইতস্তত ভাব নেই। নেই কোনো দোটনা। তাদের কাছে যেটা ঠিক মনে হয়েছে তাই‌ করেছে। চট করে দুজন পরিস্থিতিও কাটিয়ে তুলতে পেরেছে। দেখে কেউ বলবেই না একটু আগে এরা দুঃখের সুর তুলেছিল। মিরা মুচকি হেসে বললো,
~ যাওয়া যাক?
আফরা মাথা নাড়ালো। খানিক হেঁটে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
~ ক্যামেরা নিয়েছিস? আজকের কাজ এই যন্ত্র টিই করবে! তাছাড়া কোনো কাজ নেই!
কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে দেখে নিলো মিরা। ভুল করেনি। বরং একটু বেশীই নিয়ে ফেলেছে। হেসে বললো,
~ নিয়েছি। তবে আশপাশ ঠিক ঠাক তো? তুই দেখেছিস ভালো করে? আমার মনে হয় না, আদিল আমাদের সুযোগ দিবে!
প্রশ্নের গুরুত্ব আফরা দিলো না। ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,
~ আদিল?
থতমত হয়ে নিচের দিকে তাকালো মিরা। খানিকের মধ্যে হয়তো লজ্জা ভাব‌ও ফুটে উঠতো। যদি না মিরা সামলে‌ না নিতো। বললো,

~ মাহমুদ কয় জনে বলে? আড়ালে আবডালে গালি দিতেও ভুলে‌ না। সেখানে আমার মুখে শুধু আদিল শুনে চমকানোর মতো মেয়ে তুই না! আর তুই যা না, তা আমার সামনে প্রকাশ‌ করিস না প্লিজ!
ভ্রু উঁচিয়ে, ঠোঁট বেঁকানোর ভঙ্গিমা মিরার পছন্দ হলো না। চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আফরা হেসে বললো,
~ কাল তো বেরিয়ে ছিলাম শাড়ি পড়ে! ছবি দিলেও হয়তো চেনার উপায় তার লোকের ছিল না। আদিল মাহমুদ সুযোগ দেওয়ার লোক নয়, আশপাশে ছড়িয়ে আছে চামচা গুলা। আমরা অনুষ্ঠানে ঢুকে চেন্জ করে বেরিয়ে পড়বো!
মিরা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আফরা’র দিকে। ক্ষোভ মিশিয়ে বললো,
~ কখন বেরিয়েছিলি? তাও আবার শাড়ি পড়ে! আমি দেখি নি কেন?
~ একটু আগেই বেরিয়েছিলাম। তুই তখন নাদিয়ার সাথে ছিলি। তবে বেশী দূর দেখতে পাইনি। আফীফ মুনতাসির কে দেখেই কেটে পড়তে হয়েছিল!

~ আফীফ মুনতাসির?
~ হ্যাঁ! বেশী দূর নয় তার তাবু! এবার যাওয়া যাক!
মিরা’র বিষয়টা ভালো না লাগলেও কথা বাড়ালো না। তাবু থেকে বের হয়ে পাশের তাবুর সামনে চলে গেল। একটু অপেক্ষা করতেই বেরিয়ে এলো নাদিয়া, মিসেস কামিনী। মিসেস কামিনী মুচকি হাসলেন, বিনিময়ে আফরা হাসি ফেরত দিয়ে এগিয়ে গেল। টেনশন জেঁকে ধরেছে তাকে। অনুষ্ঠান থেকে লুকিয়ে বের হতে পারবে তো? না হলে প্রমাণ গুলো যোগাড় করবে কি করে?

অনেকক্ষণ হলো হেঁটে চলছে আফীফ। পাশে জিয়াউল। তার ঠিক কয়েক হাত দূরে অনান চলছে। মেয়েটা আর তাদের পিছু ছাড়েনি। আফীফ জোর দিয়েও কিছু বলতে পারেনি। যদি সন্দেহ গাঢ় হয়, তবে তার কাছে উপায় থাকবে না। হাঁটতে হাঁটতে জিয়াউল চাপা সুরে বললো,
~ স্যার এই মেয়ে টা তো পেছন ছাড়ছে না। আমরা বের হবো কি করে?
~ আমরা নয় বলো আপনি! তুমি কোথাও যাচ্ছো না ওকে?
আফীফের সরল কথা জিয়াউলের কাজে‌ ভীষণ জটিল মনে হলো। সেই সাথে মুখশ্রীতে নেমে এলো জৈষ্ঠ্যের দিনে আষাঢ়ে মেঘের প্রলেপ। অসহায় কন্ঠে বললো,

~ আমরা’ই হবে স্যার। আমি আপনাকে একা ছাড়ছি না।
চোখ রাঙিয়ে তাকালো আফীফ। হুট করেই তার কথার উপর কথা বলা পছন্দ হয় না। জিয়াউলের চোখে গাঢ় অসহায়ত্ব। আফীফ কে কিছু বলতে না দিয়ে আবার বললো,
~ আপনি আমাকে মারেন, কাটেন যাই করেন। আমি আপনাকে এক সেকেন্ড ও একা ছাড়বো না। এক নম্বর পেলেও কি, দুই নম্বর পেলেও কি! ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো! প্লিজ স্যার।
কথাটায় আফীফের বেশ হাসি পেল। তবে নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে এই মুহূর্তে হাসার মতো ভুল করলো না। ছেলে টা দায়িত্ব থেকে কোনো কথাতেই সরে যাবে না। জিয়াউলের জায়গায় আফীফ থাকলেও হয়তো এক‌ই কাজ করতো। কথার পৃষ্ঠে কোনো কথা না বলে নিরব সমর্থন দিয়ে এগিয়ে গেল আফীফ। জিয়াউল অনেকক্ষণ পর দাঁত বের করে হাসলো। বড় বড় পা ফেলে অনানের পাশে দাঁড়িয়ে আফীফ প্রশ্ন করলো,

~ আর কতক্ষণ?
~ পাঁচ মিনিট লাগবে জনাব।
আফীফ লক্ষ্য করলো মেয়েটার কথায় হালকা টান আছে। টেনে টেনে কথা বলে, তবে শুনতে খারাপ লাগে না। কাঁধ পর্যন্ত চুল, ফর্সা গাঁয়ের রং। দেখতেও খারাপ না। বরং সুন্দর বলতেই হয়। অনান বুঝতে পারলো আফীফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুচকি হাসলো সে। আফীফের মনে হলো মেয়ে টা তার চাহনীকে তাচ্ছিল্য করছে। যা মনে করে আফীফ নিজেই হাসলো। মেয়েটা কি তার চাহনীকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ ধরে‌ নিচ্ছে? কিন্তু সে তো কোনো আকর্ষণ খুঁজে পেল না। শুধু মাত্র উপজাতি আর মেয়েটার চালচলন দেখতেই খানিক তাকিয়ে ছিল। এর বাইরে ভাবা তার পক্ষে সম্ভব নয়! আফীফ সহজ গলায় বললো,

~ আমরা কিছুক্ষণ থেকে চলে আসবো। আপনি নিজের আস্তানায় চলে যাবেন!
~ ক্ষমা করবেন না জনাব। উপর থেকে নির্দেশ আছে আজ রাতে আপনাদের একা ছাড়া যাবে না।
মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হলো আফীফের। মেয়েটা তাকে বারবার বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। তাকে যে নজরে রেখেছে, আর এলোমেলো কিছু হলেই বন্দি হতে হবে মেয়েটা বার বার কথা দ্বারা বুঝিয়ে দিচ্ছে। তবে সে ধরতে পারছে না মেয়েটা তার জন্য কি? বিপদ না পথ! নিজেও ভনিতা না করে প্রশ্ন করলো,
~ তা আপনি কি চাচ্ছেন? বিপদ না পথ?

~ আমি? সবসময় সরল পথে হাঁটতে চেয়েছিলাম। তবে সে পথ কিভাবে আঁকাবাঁকা হয়ে যেত বুঝতেই পারি নি। এখন যখন আঁকাবাঁকা পথ ধরেছি, দেখি বাঁকে বাঁকে খাদে ফেলার লোকের অভাব নেই। আর যখন আমি খাদে ফেলার লোকটাকেই খাদে ফেলার ব্যবস্থা করলাম তখন যেন আরো জটিল হলো। একটা লোকের বদল এখন দল আসতে লাগলো বাঁধা হয়ে। আর এই দল কে উপড়ে ফেলার জন্য যখন পরিকল্পনা করলাম তখন আপনার খোঁজ পেলাম! চলে এলাম। এখন প্রশ্ন ছাড়া বলুন কি সাহায্য চান আপনি!
কথা বলার ভঙ্গিমা চমৎকার। আফীফ মেয়েটার কথায় টের পেল মেয়েটা তার মতোও না আবার তার শত্রুদের মতোও না। তবে কিছু কথা শুনে সন্দেহ থেকে বের করার লোক ও সে না। বললো,
~ সাহায্য নিজের জন্য নয়! গোটা জাতির জন্য দরকার। যাই হোক, অনুষ্ঠান থেকে লুকিয়ে বের করার দায়িত্ব আপনার, পারবেন?

~ অনুষ্ঠানে ঢুকার কি দরকার? আপনি আমার নজরে আছেন মানে তাদের নজরে আছেন। তারা ভাবে আর কি! তবে শর্ত আমাকে সাথে নিতে হবে!
আফীফ আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। জীবন কখন কি চমৎকার করে বুঝা বড়ই কঠিন। সরলের মরণ হালকা জটিলে হয়ে যায়। আবার জটিলের মরণ রাজনীতির কাছে হেরে। যুক্তি যে ঠোঁটের ভাজে লুকিয়ে থাকে। আর সেখানে যদি মানুষ নামক প্রাণীর মুখ নিঃসৃত বাণী হয়। সত্য মিথ্যা আলাদা করা বড্ড মুশকিল। স্বার্থে আঘাত লাগলে নিকৃষ্ট হতে সময় নেয় না। অথচ এক‌ই ঘটনা নিজের সাথে ঘটলে? ভিক্টিম নিজে হলে? তখন মুখশ্রীতে যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠে যেকেউ ই বলে দিবে লোকটা নিরাট ভদ্রলোক। রাতের আঁধারে তার নিংশ্র বাঘের মতো আক্রমণ দেখবে না। দেখবে না এক‌ই কাজের পাপী সেও। রাতের আঁধারে জানো* য়ার‌ও দিনের আলোয় ভদ্রলোক!

নিজেকে সম্পূর্ণ কালোতে মুড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদিল।‌ খুঁটিয়ে দেখছে নিজেকে। কয়েক দিন দাড়ি কামানো হয় নি। খোঁচা খোঁচা দাড়ির জায়গায় বেড়ে গিয়েছে। খারাপ লাগছে না, অন্যরকম লাগছে। চুল গুলোও বিন্যস্ত ভাব ছাড়িয়েছে। অবিন্যস্ত বড় চুল গুলোতে নিজেকে দেখে থমকালো আদিল। এভাবে নিজেকে কখনো খুঁটিয়ে দেখা হয় নি। স্কিন কেয়ার করেছে, ত্বক সফট রাখার জন্য ক্রিম ব্যবহার করেছে তবে এভাবে কখনোই দেখেনি। মনেই হয় নি এমন। আজ হঠাৎ কেন মনে হলো সেটাই আদিল ভেবে পেলো না, তাও আবার এমন একটা রাতে। এসবের কারণ কি মিরা? মন প্রেমে পড়ে খোলস ছাড়াচ্ছে? নাকি শুধু কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এসব ভাবনায় আর এগোলো না আদিল‌। চট করে অন্য ভাবনায় গিয়ে ঠিক করে নিলো এরপর থেকে কয়েকদিন এভাবেই থাকবে। দেখা যাক তার রাজনন্দিনী লক্ষ্য করে কিনা!

মিরার কথা ভাবতেই আদিলের ঠোঁটের ভাজে অন্যরকম চঞ্চলতার দেখা মিললো। ব্যাগ হাতড়ে কিছু কাগজ বের করে নজর বুলালো একবার করে। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো। বিড়বিড় করে বললো,
~ তোমাকে চিনতে এতটা দেরী হলো কেন কেন রাজনন্দিনী? আদিল মাহমুদ কি এই একটি কারণেই হেরে গেল, নিজের সাথে? অন্যায় করেছো তুমি? এর দাম অবশ্য‌ই তোমাকেই দিতে হবে, সে হোক জীবন দিয়ে!
কথাগুলো শেষ করে কাগজ গুলো নিজ জায়গা মতোই রেখে দিলো। আয়নার সামনে ফিরে এসে মুখে মাস্ক লাগাতেই নিস্তব্ধ তা কাটিয়ে ইলেকট্রনিক যন্ত্রটি বেজে উঠলো অপর পক্ষের বার্তা নিয়ে। ফোন তুললো আদিল, তবে চুপ করে র‌ইলো। অপর পাশ থেকে কিছু বলতেই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
~ নিজের সাধ্য মতো মাল হাতে নিতে বলবে। আজ অন্তত কারোর মৃত্য চাই না। এতে আমার লস। আমি বর্ডারে পৌঁছে যাবো! সাবধান! চারপাশের অবস্থা ভালো না। এমন ভাবে নিজেকে ঢেকে রাখবে যে জন্ম দিয়েছে সেও যেন চিনতে না পারে।

লোকটি ফোন কেটে দিলো। আদিল হুট করেই মাস্ক খুলে কালো কাপড় দ্বারা মুখ কপাল ঢেকে নিলো। দুটো চোখ ছাড়া দেখার কিছু নেই! চেনা যাচ্ছে না। মেশিন তিনটে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বের হয়ে এলো বাড়িটি থেকে।
অপরাধ করুক সমস্যা নেই তবে কেউ দেখে ফেললেই যেন সমস্যা। ভদ্রলোকের মুখোশ খুলে যাবে যে। সমাজের মানুষ ছি ছি করবে। অপরাধ ধরা পড়া যে ফাঁসির সমান, সে না হোক ফাঁসি। ব্যবসায় তো খারাপ না, সে হোক অসৎ উপায়ে!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩০+৩১

আদিলের মন বলছে কিছু একটা হবে আজ! তার জানা আবার অজানাও! চট করে শিউর ও দিতে পারছে না। শিউর দিতে গেলেও যেন মনের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। যেটা সে এই মুহূর্তে একদম চায়ছে না! হুট করেই সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঘোর বিপদ!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩৫+৩৬+৩৭