হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩৫+৩৬+৩৭
Tahrim Muntahana
প্রকৃতি আজ নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে। অন্তরীক্ষে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। বাতাসের গতি তীব্র নয়, তীব্র নয় বৃষ্টির বেগ। ঝিরঝির বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি আজ পরীক্ষা নিচ্ছে নাকি? প্রতিকূল পরিবেশে হুটহাট ভিন্ন প্রতিকূলতা ছড়িয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে কি প্রমাণ করতে চায়ছে? প্রকৃতিও হিংস্র হতে পারে? মানুষের হিংস্রতা অপর পক্ষকে ধুলিসাৎ করে দেয়। তবে প্রকৃতির হিংস্রতা যে পুরো মানব সভ্যতা কে ধুলিসাৎ করে দিতে তৎপর! আফরা মিরার তো তাই মনে হচ্ছে। এই যে মাঝারি এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে তারা, পরিশ্রম হয়নি? প্রকৃতি আজ সহায় হলে খুব ক্ষতি হতো? ঠিক কাজ গুলো হয়ে যেত। হাতে ক্যামেরা নিয়ে অলস ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে মিরা। দৃষ্টি তার বর্ডারের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কালোতে আবৃত মানুষ গুলোর উপর। আলো-অন্ধকার একসাথে গ্রাস করে নিয়েছে। ক্যামেরা’র কাজ এমনিই ঠিকঠাক হতো না, এর মধ্যে বৃষ্টি যেন প্রতিপক্ষের জয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছে। হারটাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েও ঠিক হজম হচ্ছে না দুজনের। খানিক পর পর মুখের রঙ পাল্টে যাচ্ছে আফরার। মিরা একপলক আফরা’র দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললো,
~ নেমে যাবি? উপায় নেই!
~ দেখে ফেললে সকল পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবে, যা চাইছি না!
আফরা’র জবাবে বিরক্ত হলো মিরা। মেয়েটার মনে আছে একটা, সে বর্তমানে বলছে আরেকটা। ক্যামেরা টা গলায় ঝুলিয়ে বললো,
~ যেখানে ঝুঁকি বেশী, সেখানে লাভ ও বেশী। লেট’স গো!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মিরা’র কথা শেষ হওয়া মাত্রই একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়লো আফরা। বাঁশের ট্রেইল ধরে এমন ভাবে দৌড়াতে লাগলো, প্রফেশনাল বলেই মনে হলো। তবে হুট করে বাঁশ থেকে হাত ছুটে গেলে জীবনের মায়া’র সমাপ্তি বান্দরবানের মাটিতেই করতে হবে। পথটা সহজ নয়, চিন্তিত মুখশ্রীতে ভরপুর উৎকণ্ঠা। বাঁশ পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি ঝুম করে মেয়েলি শরীরে পড়ছে। ভিজে একাকার অবস্থা দুজনের। তীব্র জ্বরও আসতে পারে, সেদিকে সংকীর্ণ মনোভাবও পোষণ করলো না কেউ। কাজটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই নয় যেন! দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে চারপাশ নজর বুলালো দুজন। কোনো রকম অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে এসেছে, কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ! পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত দুজন। পাহাড়ের চূড়া থেকে দুরত্ব টা কম মনে হলেও, এখন মনে হচ্ছে সময়টাতে ঢাকা চলে যাওয়া সম্ভব। নেহাতই তাদের ভাবনা। ফিসফিসানি আওয়াজে আপনাআপনি থেমে যায় পা। সতর্কিত দৃষ্টি তে পরখ করে, যতদূর চোখ যায়। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দুজনই একসাথে পকেটে হাত গলিয়ে দিলো। ধারালো অস্ত্র, হাতের ভাজে রেখে এগিয়ে গেল অসীম সাহসে! পাহাড়ের বাঁক পেরোতেই দুটো লোককে নজরে পড়লো।
মোটাসোটা লম্বা শরীরের পাশে পাতলা গোছের আলস্য শরীর। পায়ের গতি দেখে মনে হচ্ছে নেহাতই চাপে পড়ে হাঁটছে, ঘুমাতে পারলে আরাম পেত। হাতে মাঝারি বক্স। বেশ ভারী মনে হচ্ছে। মিরা হেসে আফরা’র দিকে তাকালো। বিচলিত হলো আফরা, মেয়েটার হাসি মানেই এখন বিপদ। মাথা দিয়ে না করার সুযোগ টাও মিললো না, পূর্বেই মোটা লম্বা লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো মিরা। গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না তার, বের হতো যদি মিরা লোকটা কে মাটিতে ফেলে দিয়ে মুখ চেপে না ধরতো! হয়তো এতক্ষণে বন্দি থাকতে হতো, গোটা কয়েকশ লোকের মধ্যমনি থাকতো তারা, যারা বিশ্রী চোখের দৃষ্টি দ্বারা সেকেন্ডে সেকেন্ডে কামনা মেটাতো! মিরা সেরকম সুযোগ দিলো না, হাতে থাকা ছুরিটা চালিয়ে দিলো ঘাড়ের পাশে। মরবে না, অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবে! যদিও মরলে মিরা’র কিছু যায় আসে না। পাশের হ্যাংলা পাতলা লোকটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। অচেনা কাউকে এমন জায়গায় দেখে মানতে পারছে না। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে লোকটার যখন খেয়াল হলো বিপদ আগত! চিৎকার করার জন্য হা করতেই আফরা দৌড়ে গিয়ে ঘাড়ে পাঞ্চ মারলো। নেতিয়ে পড়লো পাতলা শরীর। ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। চোখ রাঙিয়ে মিরা’র দিকে তাকাতেই মিরা গাঁ বাঁচিয়ে হাসলো। পরক্ষণেই ভাবালেশ কন্ঠে বললো,
~ ঝুঁকি, লাভ প্রেমিক প্রেমিকা!
জবাবে কিছু বললো না আফরা। ক্যামেরা বের করে বক্সটার ছবি তুললো। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, তবে কোথাও কোনো নামের চিহ্ন পেল না। মাহমুদ রা যে নিজ উদ্যোগেই এমন ভাবে তৈরি করে বুঝতে অসুবিধা হলো না কারোর। বক্স খুললো মিরা। খোলা মাত্রই ভেতরের দৃশ্যমান বস্তু গুলো বিস্ফোরণ বয়ে নিলো দুজনের হৃদয়েই! আফরা’র থেকে মিরা’র চোখের করুণতা হয়তো প্রকট। কাঁপছে কেন মেয়েটা? অতীত থেকে বের হতে পারেনি? মনের প্রশ্ন গুলো মনের মাঝেই লুকিয়ে রাখলো আফরা। ভালো করে পরখ করলো সবগুলো ঠিক বস্তু নয়। মানুষের মধ্যে থাকা বাঁচার অঙ্গগুলো। যেগুলোর একটা বিকলাঙ্গ হলেই মৃত্য ধেয়ে আসতে চায়!
কিডনি, লিভার, হৃদপিণ্ড, বোন ম্যারো বা হাড়ের মজ্জা, ডিম্বাণু, চোখের মনি
রক্ত, পিত্তকোষ! একটা মানুষের মধ্যে অবশিষ্ট যা রয়েছে তাই লুকিয়ে আছে বক্স টাই! ফ্রিজিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
আফরা দ্বিতীয় বক্সটা খুলে একই রকম পেল না! বক্সটা বেশ বড়, মোটাসোটা লোকটাই এটা বহন করেছে। খানিক কেঁপে উঠলো আফরা। এ যেন জ্যন্ত মানুষ শুয়ে আছে! শুধু লোকটার চোখ বন্ধ। আচ্ছা চোখটা হুট করে খুলে গেলে কি হবে? তাকে বন্দি রাখার জন্য লোকটা তাদের দায়ি করবে? ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচার লড়াই করবে? নিজের অদ্ভুত ভাবনায় হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো আফরা। মৃত মানুষ বেঁচে উঠে?
প্লাস্টিনেশনের মাধ্যমে কেবল জৈবিক শরীরের অঙ্গ ও কোষ নয়, গোটা শরীরকেও সংরক্ষণ করা হয়৷ মানুষ মারা যাওয়ার পর থেকেই তার শরীর দ্রুত পচতে শুরু করে। প্রথমে শরীরে থাকা এনজাইম কোষগুলো অবমুক্ত হতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে গোটা শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং মাইক্রোঅর্গানিজম গুলো পচতে শুরু করে৷ শরীরে থাকা পানি এবং চর্বি সরিয়ে তার জায়গায় পলিমার ঢুকিয়ে প্লাস্টিনেশন এই পচে যাওয়াকে রোধ করে৷ প্লাস্টিনেশন শরীরের ব্যাকটেরিয়াগুলোকে টিকে থাকতে দেয় না, ফলে শরীরও আর পচতে পারে না৷
তবে শরীরের তরল পদার্থগুলো সরাসরি পলিমারের সংস্পর্শে কাজ করতে পারে না৷ তাই গ্যুন্টার ফন হাগেন্স একটি বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন৷ প্রথমে শরীরের মধ্যে অ্যাসেটোন নামে দ্রাবক ঢুকানো হয় এরপর তার জায়গায় পলিমার ব্যবহার করা হয়৷
কোনো এক ম্যাগাজিনে পড়েছিল আফরা। আজ তা সরাসরি দেখলো। কি অভিনব প্রক্রিয়ায় অঙ্গ গুলোকে জীবিত রেখেছে! ঠিক এই ব্যবসায়ই অনল মাহমুদ কে রাতারাতি এত দূর এনেছে? ঠিক এই মাধ্যমেই আজ অনল মাহমুদের আন্ডারে তিনটে হাসপাতাল? পুরো ক্ষমতা? নিজের অবাকতা লুকিয়ে অঙ্গ গুলো মেলে ধরে ক্যাপচার নিলো আফরা। সেই শুরু থেকেই থম মেরে বসে আছে মিরা। কি বলবে হাতড়ে হাতড়েও খুঁজে পাচ্ছে না। কোথাও একটা চিনচিনে ব্যাথার সুর পাচ্ছে! কিন্তু মানতে নারাজ। আনমনে প্রশ্ন করলো,
~ দাম কত হবে এগুলোর?
আফরা ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুঝলো। অঙ্গ গুলোর জন্য মনটা কেমন করে উঠলো। সবাই যে এখানে প্রাকৃতিক মৃত্য পেয়েছে তা নয়! কাউকে ধরে ধরে মৃত্যর কোলে ফেলে দেওয়া হয়েছে! বন্ধ চোখের পাতা কাঁপিয়ে আফরা বললো,
কালোবাজারে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দাম আকাশছোঁয়া। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় কিডনি। কালো বাজার ৭৫ শতাংশই কিডনির দখলে। একটি কিডনি বিক্রি হয় প্রায় এ কোটি বাহাত্তর লাখ টাকায়।
এদিকে লিভার রোগে অন্য আরো যে কোনো রোগের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়, কারণ এই রোগ ধরা পড়ে শেষ পর্যায়ে। সামর্থ্য থাকলে কালোবাজার থেকে কিনে নিয়ে রোগীরা নিজেদের চিকিৎসা করান। একটি লিভারের দাম পড়ে প্রায় এক কোটি আটত্রিশ লাখ টাকা।
আবার আইনী প্রক্রিয়ায় হৃদপিণ্ড দান করতে গেলে প্রচুর টাকা লাগে। ডাক্তারের বিশাল খরচ থেকে বাঁচতেই রোগীরা হৃদপিন্ড কিনে নিয়ে চিকিৎসা করান। একটি হৃদপিণ্ড বিক্রি হয় প্রায় এক কোটি তিন লাখ টাকায়।
একটি কর্নিয়া এবং একজোড়া চোখের মনির দাম প্রায় সমান। চোখের মনির দাম প্রায় এক লাখ একত্রিশ হাজার টাকা।
এছাড়া বোন ম্যারো বা হাড়ের মজ্জা, ডিম্বাণু, করোনারি আর্টারি, ক্ষুদ্রান্ত্র, গলব্লাডার বা পিত্তকোষ, রক্ত সবগুলো মিলিয়ে গবেষণা মতে একটি মানবদেহ থেকে নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিক্রি করলে এর আর্থিক মূল্য হতে পারে সাড়ে চার কোটি টাকারও বেশি।
টাকার অংক মিরাকে বিস্ফোরিত করেনি, করেছে আফরা’র জ্ঞানের পরিধি। মেয়েটা এতকিছু জানলো কি করে? সহজ গলায় বললো,
~ তার মানে একটি মানব শরীরের আর্থিক মূল্য কম করে হলেও সাড়ে চার কোটি টাকা! তুই এত কিছু জানলি কি করে?
হাসলো আফরা! কিছুক্ষণ চুপ করে ঘাসের উপর বসলো। বৃষ্টি নেই, প্রকৃতি নিশ্চুপতা কে বরণ করেছে। কালো মেঘ কেটে গিয়েছে। ভাবুক নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ সন্দেহ হয়েছিল! ডাক্তার মানুষ আর কি করতে পারে? ক্রাইম বিষয়ে একটু ঘেটে দেখলাম! এবার সন্দেহ টা সত্যিই হলো! এবার মনে হচ্ছে ডক্টর বা নার্স হলে ভালো হতো! পরের জার্নিটা সহজ হতো!
আফরা কথাটা শেষ করতেই পেছন থেকে ভরাট কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
~ তোমার জার্নিটা সহজ করার দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি!
চমকালো দুজনই। আফরা ঘুরে তাকাতেই লোকটা লাল লাল দাঁত বের করে হাসলো। যেন দুজন কে অবাক করে দিয়ে বেশ মজা পেয়েছে। মিরা তখনো নির্লিপ্ত! আফরা হাত বাড়িয়ে চিমটি কাটলো মিরা’র হাতে। তবুও শান্ত মেয়েটা! এবার কপালে ভাজ পড়লো আফরা’র। মেয়েটা কি বেশীই ভেঙে পড়েছে? এখন যে দুঃখ বিলাসের সময় নয়! লোকগুলোর মধ্যে সর্দার গোছের লোকটার পড়নে লুঙ্গি, কেমন এক ভঙ্গিমায় পড়েছে ঠাহর হলো না আফরা’র। আর সবাই মুখ ঢেকে রাখলেও লোকটা সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে! বিপদ সামনে দেখেও আফরা’র কি জন্য ভয় করছে না বুঝতে পারছে না নিজেই। নিজের সাহসের গন্ডি পেরিয়ে আরেকটু উঁচু তে গিয়ে আফরা ক্যামেরাটা সর্দার লোকটার দিক তাক করে ক্যাপচার নিয়েই হাসলো। ভড়কে গেল লোকগুলো। সাথে সাথে যেন গরম রক্ত টগবগিয়ে উঠলো। মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো,
~ সাহস ভালো। কিন্তু একটু বেশীই সাহস হলো না? আমার ছবি দিয়ে কি প্রমাণ করবি মাইয়া? আমাকে ধরতে পারবি? এখন যদি তোদের মেরে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিই কেউ টের পাবে না! আমার নাম মুজুলুম উদ্দিন, জুলুম করায় আমার কাজ!
কথাটা বলে লোকটা গর্বের সহিত হাসলো। আফরা’র নিজেরই খুব হাসি পেল নামের ছিরি শুনে। এটা আবার কেমন নাম? প্রশ্ন করতে গিয়েও চুপ রইলো সে। পাশ থেকে এক জন বলে উঠলো,
~ সর্দার খাড়াই আছেন ক্যান? তাত্তাড়ি করেন। বস অপেক্ষা করতাছে। ভাগ্যিস আমি দেখছিলাম মাইয়া গুলারে, না হইলে তো বসের হাতে আইজ আমরা শেষ। আরো লোক আছে ওদের। নিজেরাই ফাঁইসা যামু। আগে ক্যামেরা টা নেন।
মুজুলুম উদ্দিন মাথা নাড়ালেন। আফরা এবার বিচলিত হলো। ক্যামেরা টা নিজের সাথে রাখতে হবে। দুজনই একসাথে পিছিয়ে যেতে যেতে খাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। পাশেই আরেকটা পাহাড়, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে বেশ নিচুতে। ঝাঁপ দিলে কোথায় পড়বে ঠিক নেই। মুজুলুম উদ্দিন ক্যামেরাটার দিকে হাত বাড়াতেই গলা থেকে খুলে বাম হাতে রাখলো আফরা! লোকটা কিটকিটিয়ে হেসে আফরা কে স্পর্শ করতেই ছুড়ে মারলো নিচে! চমকে গেল লোকটি, রাগে চোখ রক্তিম হয়ে উঠলো। বলিষ্ঠ হাতে থাপ্পড় উঁচাতেই নত করে রাখা মুখ উঁচু করলো মিরা। হাতটার দিকে এমন করে তাকালো মুজুলুম উদ্দিন খানিক ভয় পেতে বাধ্য হলেন। এমন ধাঁরালো দৃষ্টি কারোর হয়? তবে তিনি থামলেন না, আফরা’র থেকে ঘুরে থাপ্পড় টা মিরা’র গালে বসালেন। ফর্সা গাল টা নিমিষেই লাল হয়ে এলো, হেসে উঠলো মিরা! আফরা’রা কে থাপ্পড়ের হাত থেকে বাঁচাতে পেরে যেন জয় তার হয়ে গেছে। কিন্তু মানতে পারলো না আফরা, পা উঁচিয়ে পেটে লাথি বসাতেই মুজুলুম উদ্দিন মুখ থুবড়ে পড়লেন। বাম হাত কাজে লাগিয়ে একই গালে পর পর দুবার থাপ্পড় বসিয়ে ক্ষান্ত হলো আফরা। মিরা’র হাসি চওড়া হলো। ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে।
মিরা’র আচরণে বিরক্ত আফরা। মেয়েটা এই পরিস্থিতিতে হাসছে! অথচ আফরা খেয়াল করলো না মিরা’র দৃষ্টি। হাসির আরেকটি কারণ।ওই যে মিরা দেখতে পাচ্ছে পাহাড়ের বাঁকে গাঁ লুকিয়ে মাথা বের করে আছে একজন। যার চোখের দৃষ্টিতে পুড়ে ছারখার হতে পারে পুরো বান্দরবান! যখনই দৃষ্টিটা তার উপর পড়ছে, কেমন শিথিল হয়ে যাচ্ছে ওই চোখ। যেন কত বছরের তৃষ্ণার্ত! সর্দার কে এভাবে লুটিয়ে পড়তে দেখে গর্জে এলো তিনটে লোক। সরু রাস্তায় একসাথে ফাইট করা সম্ভব নয় বলেই অন্যরা দাঁড়িয়ে আছে। লোকদুটো এসে আফরা, মিরা’র হাত চেপে ধরতেই আরেকজন কলার চেপে ধরলো! হাত গলিয়ে দিয়েছে গলায়! গ্রীবাদেশ থেকে যে এই হাত বুকে নামতে সময় নিবে না বেশ বুঝতে পারছে দুজনই। এই যে এদের চোখে এখন অন্য নেশা, বসের কথা ভুলে গেছে একদম! তবুও নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে রইলো মিরা! আফরা স্ট্যান্ড নিতে চাইলেও পারছে না। গাঁ গুলিয়ে আসছে! চোখে মুখে আকাশ ছোঁয়া ক্রোধ! লোক দুটোর হাত নিচের দিকে অগ্রসর হতে হতেই থেমে গেল! বিকট শব্দ! নিশাচরও বুঝি লুকিয়ে গেল পাহাড়ি বৃক্ষের আড়ালে! পেছন ঘুরে কাউকে রিভল* বার হাতে এগিয়ে আসতে দেখে ছেড়ে দিলো আফরা-মিরা কে। মাথা নত করে অভিযোগ করলো,
~ বস মাইয়া দুইডা আমাগর কাম পন্ড করতে আইছে! ধরছি, এই দুইডারে আমাগর হাতে ছাইডা দেন, বুইঝা লমু। আপনের চিন্তার কারণ নাই!
বস লোকটি শান্ত দৃষ্টি তে একবার আফরা’র দিকে তাকালো, আরেকবার মিরা’র দিকে তাকালো! দু কদম এগিয়ে মিরা’র সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা ঝুঁকে গেল! দৃষ্টি ঘুরাফেরা করছে লাল দাগে! মিরা’র ঠোঁটের ভাজে নির্লিপ্ততার হাসি। ভনিতা হীন চাপা স্বরে বলে উঠলো,
~ বস কে খবর দে! মাইয়া গুলারে নিয়া যা কুটিরে। ওইখানে দেখা যাবে!
লোকগুলো হয়তো ইঙ্গিত বুঝতে পারলো। এগিয়ে এসে ধরবে, মিরা শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসিটার স্থায়িত্ব কাল দীর্ঘ হলেও বসের আদেশ বিহীন কেউ এগোতে পারলো না। হাসি থামিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
~ আদিল!
শিথিল দৃষ্টি কেমন চকচক করে উঠলো। একটানে মুখের কাপড় খুলে ফেললো আদিল। মিরা’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গালের দিকে বাড়ানো হাত টা নামিয়ে ফেললো। আচমকাই গর্জে বলে উঠলো,
~ থাপ্পড় দিয়েছে কে?
লোকগুলো ভয় পেল না। বস কে এতদিন দেখে আসছে, একটু পরেই যে মেয়েদুটোর শরীর ভেদ করে বুলেট ঢুকে যাবে তারা জানে! একজন উল্লাস মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
~ বস সর্দার!
আদিল একপলক লোকটার দিকে তাকালো। উল্লাস টা একদম পছন্দ হলো না। হুট করেই আকস্মিক বুলেট ছুড়ে মারলো, উল্লাস মিশ্রিত কন্ঠনালী রক্তাক্ত হয়ে গেল। ধপ করে পড়ে গেল নিচে। ভয়ে কেঁপে উঠলো সবাই! আদিল এবার নিচে পড়া থাকা শরীর টার দিকে তাকালো। গুঙিয়ে যাচ্ছে একটু পর পর। উবু হয়ে বসে হাত টা মুচড়ে ধরলো, লোকটার প্রাণপাখি তখনই উড়ে গেল যেন! আকস্মিক ঘুরে কামনাযুক্ত চোখের মালিক দুটোর কপাল বরাবর বুলেট ছুড়ে সরল হাসলো আদিল। কয়েক মুহূর্তেই কি থেকে কি হয়ে গেল বোধগম্য হলো না কারোরই।
বসের হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেউই মেনে নিতে পারছে না! কিছু বলতেও পারছে না! আদিল উন্মাদের মতো মিরা’র গালের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে মুখে অসীম ব্যাথা’র ছাপ ফুটে উঠতেই মিরা’র নির্লিপ্ততা বিদায় নিলো। চোখ ভরে আসতে চাইলো। লোকটা আবার তাকে দুর্বল করতে আসছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো মিরা। আদিল হেসে ফিসফিস করে বললো,
~ রাজনন্দিনী! ভয় পাচ্ছো? অনেক দিন চিঠি দাও না! আমি অপেক্ষা করি জানো? প্রতিমুহূর্তে অপেক্ষা করি! অপরাধ করেছো তুমি। শাস্তি তো পেতেই হবে! আবার কখনো দেখা হোক রাজনন্দিনী!
কথাটা বলেই আদিল মুচকি হাসলো। দলের লোকের দিকে তাকিয়ে দু হাত বাড়িয়ে দুটো মেয়েলি শরীর কে ধাক্কা দিলো! নিমিষেই শরীর দুটো অন্ধকারে খাদের বুকে হারিয়ে গেল! পৈচাশিক হাসিতে মেতে উঠলো আদিল। শত্রু দুজন কে পথ থেকে সরিয়ে যেন জয়ের খাতা খুলে বসেছে! তার সাথে তুলনা কারোরই হয় না!
হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। টর্চের আলোয় যতটুকু দেখা যায় ঠিক ততটুকুতেই খুঁজে চলছে কিছু। খড়ের মাঝের সুঁই খোঁজার মতো। তবে বার বার নিরাশ হতে হচ্ছে। রাস্তার পাশের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আফরা মিরা! ফেলে দেওয়া ক্যামেরা টাই খুঁজে চলছে তারা। যদিও জানে অক্ষত পাওয়া যাবে না, তবে পিচ্ছিল নরম মাটিতে খুব একটা ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না, যদি না কোনো গাছে আটকে পড়ে। গাছের কথা মনে হতেই মিরা আফরা’র দিকে তাকালো। আলো থাকলেও ঘন গাছের নিচে উপরের কেউ তাদের হদিস পাবে না। তবুও রিস্ক নেওয়া যায় না। ক্লান্ত আফরা বসে পড়লো জমিনে। জোরে দম নিয়ে আনমনে বললো,
~ আদিল মাহমুদ রিয়েলি লাভ ইউ মিরা! তার চোখে যে স্বচ্ছতা আমি দেখেছি, ভালোবাসার উপর আঙুল আমি তুলতে পারছি না!
মিরা হাসলো। তাচ্ছিল্যই বটে। কিছু বললো না। মিরা’র হাসির শব্দে আফরা’র বুক থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আজ নিজেকে কেমন নিস্তেজ লাগছে। আবার বললো,
~ প্রেম নিয়ে অভিনয় করা যায়, ভালোবাসা নিয়েও অভিনয় করা যায়। মনে লুকিয়ে থাকা দৃশ্য যে চোখ বাহ্যিক দুনিয়ার সামনে তুলে ধরে। চোখ অভিনয় করতে পারে না, চোখ স্বচ্ছ আয়নার মতো। ন্যায় আর অন্যায়ের পার্থক্য এখানেই!
তাচ্ছিল্য হাসিটা ঠোঁটের কোণে ধরে রাখতে ব্যর্থ হলো মিরা। আফরা’র সামনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ হতে দিবে না বলেই মুখটা গম্ভীর করে নিলো। শক্ত কন্ঠে,
~ কাজ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছিস!
~ তুই তো এটাই চেয়েছিলি মিরু! শত্রুর বাড়িতে ঢুকে শত্রুকে আঘাত করবি। তবে এখন কেন পিছিয়ে যাচ্ছিস? কারণ টা আমি জানি! তুই ভয় পাচ্ছিস দুর্বল হয়ে পড়বি বলে। তুই ভয় পাচ্ছিস ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে অন্যায় কে প্রশ্রয় না করে ফেলিস। এই তো! তবে তোকে বুঝতে হবে আমরা যে খেলায় একবার পা রেখেছি এখন ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ফিরে গেলে মৃত্য নিশ্চিত। আবার ফিরে না গেলে মৃত্য নিশ্চিত-অনিশ্চিতের মাঝে ঝুলে থাকবে! লড়াই আমাদের করতেই হবে! তোর পিছিয়ে যাওয়ার হলে চলে যা এখান থেকে। যে সংগ্রাম টা আমি পাঁচ টা বছর ধরে শুরু করেছি, ফিরে যাওয়া মানে আত্মহত্যা করা!
ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো আফরা! মিরা কিছুক্ষণ ঝাপসা চোখে আফরার দিক তাকিয়ে রইলো। এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে আফরা’র পাশে বসলো। হেসে বললো,
~ যাওয়া যাক! শুরু হোক নতুন খেলা! নাহয় খেলাতেই নতুনত্ব আনলাম! জন্মদাতা পিতা কে মারতে যার হাত কাঁপে নি, আড়াই বছরের ভালোবাসা কে মারতে তার হাত কাঁপবে ভাবা বোকামি!
~ ক্ষমা করে দিলেও খারাপ হতো না! বাবা তো!
বলেই ফিচেল হাসলো আফরা! ঘা টা যেন মিরার বুকে লাগে এমন ভাবেই বললো। তবে মিরা’র মাঝে তেমন ভাবাবেগ দেখা গেল না। ভেজা মাটিতে শরীর এলিয়ে দিয়ে বললো,
~ বাবা! মাথার মুকুটের মতো! মৃত্যুর মুখেও সেদিন সে বলেছিলো, “পালিয়ে যা আম্মা। ওরা তোকেও বাঁচতে দিবে না। বাবা তোদের দুজন কে ভীষণ ভালোবাসে!” হ্যা এটাই আমার বাবা নামক নিকৃষ্ট মানুষ! যার হৃদয় কাঁপেনি আরেক বাবার হৃদয় খালি করতে। অথচ সে বাবাও তার জন্মকে অস্বীকার করতে পারেনি! দ্বিধাহীন বুক পেতেছিল বুলেটের সামনে! তাকে যদি সেদিন ক্ষমা করে দিতাম তাহলে আজ যে সম্মান টা তার প্রতি জীবিত আছে, বিলীন হয়ে যেত।
~ সেনানিবাসে চিঠি পাঠানোর সময় আপনার উচিত ছিল নামটা লিখে দেওয়া, বা নামের প্রথম অক্ষর! আমার চিনতে এত দেরী হতো না!
মুখশ্রী কঠোর হয়ে আসে। ধরা পড়ে ভেতরের হিংস্র ভাব টা যেন বেরিয়ে আসার যুদ্ধে নেমেছে। এই মুহূর্তে সামনের ছেলে টাকে একটুও পছন্দ হচ্ছে না আফরা’র। হাতে থাকা টর্চের দিকে একপলক তাকিয়ে আফীফের চোখে চোখ রাখে আফরা। আকস্মিক বুঝে উঠার আগেই আফীফের মাথায় টর্চের বারি বসিয়ে দেয়! তবে একজন আর্মিম্যান কে এত সহজে কাবু করা সম্ভব নয় হয়তো! ঝটপট নিচু হয়ে আফরা’র হাত আঁকড়ে ধরে আফীফ। জয়ের হাসি মুখশ্রী তে খেলা করে। টাল সামলাতে না পেরে আফীফের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় আফরা। রাগে ফুঁসতে থাকে। চোখের রক্তিম ভাব কমার বদলে বাড়ে। হুট করেই কি হয়ে গেল মিরা বুঝে উঠতে পারে না। ক্যামেরা হাতেই সে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে। এত ছোট বিষয়ে আফরা কে সে কোনো দিন এতটা রেগে যেতে দেখিনি। আজ দেখে কথা বলার শক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। আফীফের মুখশ্রী তে কোনো রাগ নেই, হাত বাড়িয়ে খোঁপা করা চুলের ভাজ থেকে কাঠি টা খুলে ফেলতেই এক গোছা চুল আফীফের মুখে এসে বারি খায়! এলোকেশী’র কেশের মায়ার আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে সে। একেবারে ডুবে যায় না। বাঁকা হেসে বলে উঠে,
~ রিলেক্স এলোকেশী কাটামুকুট! এত রাগার কিছু হয় নি। শান্ত হন, নিঃশ্বাস নিন!
নরম সুরের কথাগুলো খুব তাড়াতাড়ি কাজে দেয়। মেয়েটা আফীফের কথা মতো বার কয়েক জোরে শ্বাস ফেলে। চোখের রক্তিম ভাব কমে আসে। স্বাভাবিক হয় আফরা। হুট করে এত রাগার কারণ সেও খুঁজে পায় না। এক ঝটকায় আফীফের থেকে দূরে সরে আসে। চোখ ছোট ছোট করে বললো,
~ কি নাম বললেন?
~ চলি মিস আফরা! আপনার সাথে খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে। আর হ্যা, শাড়ি পড়ে লুকিয়ে বের হওয়ার আগে আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিতে হয়। মিসেস কামিনী বেগম কিন্তু এতটাও ভোলাভালা নয়!
বড় বড় পা ফেলে আড়াল হয়ে যায় আফীফ। আফরা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মিরার দিকে তাকায়। তাড়াহুড়ো করে দেখা হয় নি কামিনী বেগম কে। সেটাই ভুল হলো। তবে আফসোস নেই! মিরা মিটিমিটি হাসছে। আফরা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই মিরা বললো,
~ এলোকেশী কাটামুকুট! বাহ! চমৎকার সম্বোধন!
আফরা জবাব দেয় না। মিরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বললো,
~ আফীফ মুনতাসির, আফরা ইবনাত; খারাপ হবে না! বরং বেস্ট একটা কাপল হতে পারবে!
~ চোর পুলিশ একই সূত্রে গাঁথা থাকলেও তাদের বাসস্থান কখনোই এক হয় না। চোর থাকে কারাগারের ভেতর অন্ধকারে; পুলিশ থাকে কারাগারের বাইরে আলোতে!
পিনপতন নিরবতা! মিরা আর কিছু বলার খুঁজে পায় না। দুজন নারী হাঁটতে থাকে নিঃশব্দে! মনের মাঝে হাজারো অনুভূতির কিলবিল। জীবন আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে!
অন্ধকার বাড়িটিকে গ্রাস করে নিয়েছে। কোনো এক ঘরে টিমটিমে আলো জ্বলছে।ঠাওর করার মতো নয়। দারোয়ানের নাসিকারন্ধ একটু পর পর ফুস ফুস শব্দ ছড়াচ্ছে। হা করে নিঃশ্বাস নিয়ে ফুস করে ছেড়ে দিচ্ছে। গভীর ঘুমের লক্ষণ। চটি জুতার চপ চপ শব্দ আসছে। গভীর ঘুম ছুটে গিয়ে কখন হালকা হয়ে এলো আর দারোয়ান ঢুলুমুলু চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো; আসমানী ধরতে পারলো না। সে তো দারোয়ান কে চমকে দিতে চেয়েছিল, উল্টো দারোয়ানই তাকে চমকে দিলো। মিনিট খানেক পরেই দারোয়ান কপাল বরাবর ডান হাত তুলে স্যালুটের ভঙ্গিমা দেখাতেই আসমানী নিজের হাসি ধরে রাখতে পারলো না। খিলখিল হাসিতে গোটা মাহমুদ বাড়ি যেন জেগে উঠলো। চারপাশ শুধু হাসির শব্দ টায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।
চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো বৃদ্ধ দারোয়ান। নিভু নিভু ঘুম জড়ানো চোখ বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। সামনে দাঁড়ানো কন্যাটিকে দেখে তার সৎ বুদ্ধি ফিরে এলো। লজ্জায় আরক্তিম মুখ নত হয়ে এলো। বছর দুই দারোয়ানের চাকরি তে রয়েছে। মানুষ যে ঘুম কে মরা মানুষের সাথে তুলনা করে, তার কাছে ওটা ঘুমই নয়। বাগানের আম গাছ থেকে মৃদু শব্দে আম পড়লেও তার কানে এসে বারি খায়, সেখানে চটি জুতোর চপ চপ শব্দ কানে বাজবে না? প্রতিদিন কান খাড়া করে ঘুমিয়েই যে অনল মাহমুদ কে স্যালুট জানায়। মাতাল অনল মাহমুদ হয়তো ধরতে পারে না। তবে এই স্যালুটের মধ্যে যে কোনো রকম সম্মান থাকে না বৃদ্ধটি বেশ ভালো করেই জানে। আসমানী তখনো হাসছে। বৃদ্ধটি ইতস্তত ভঙ্গিমায় এগিয়ে গেল। আসমানী শব্দহীন ঠোঁট টিপে হেসে দাঁড়িয়ে রইল। হাসির ছলকে একপ্রকার কৌতুক মিশে রয়েছে, তাতে অপমান বোধ জন্মায় না বৃদ্ধের। মেয়েটির চোখ মুখ অত্যন্ত সরল। বড্ড মিষ্টি। দারোয়ান মাথা নত করে বললো,
~ এত রাতে কি জন্য এসেছো মা? কোনো দরকার?
বলার ভঙ্গিমা চমৎকার। আসমানী অবাক না হয়ে পারলো না। তার লোকটাকে বেশ শিক্ষিত মনে হচ্ছে। বয়স দিয়ে শরীর মানাচ্ছে না। সে তো ভেবেছিল বৃদ্ধ লোক, লাঠি ভর করে হাঁটে। ক্রমশই মনে হতে থাকলো এর থেকে কম বয়সে তার দাদা বিছানায় কঙ্কালসার হয়ে পড়ে থাকতো। অথচ ইনি? আরেকটু বাজিয়ে দেখার জন্য ইংরেজিতে বললো,
~ হোয়াটস ইউর নেই দাদু?
~ মাই নেম ইজ
এবার আর অবাক হলো না আসমানী। সে ভুলে গিয়েছিল দারোয়ান আহিশের লোক। দারোয়ান আবার বললো,
~ আহিশ দাদুভাই কিছু বলেছে?
ঘাড় কাত করে কিছুক্ষণ ভাবলো আসমানী। তারপর মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে চারপাশ নজর বুলালো চোরা চোখে। নাহ, কেউ নেই। ফিসফিস করে বললো,
~ অনিক কে বের করতে হবে। অনল মাহমুদ বা মিসেস নুরি কেউই উপস্থিত নেই। আমরা তিনজনই আজ এ বাড়ি ছাড়বো। আহিশ আংকেল সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। চারপাশে থাকা মাহমুদের লোকদেরও সরিয়ে নিয়েছে। চলুন তাড়াতাড়ি! কালকে রক্ষে থাকবে না।
আকস্মিক বৃদ্ধটির মুখশ্রী কঠোর হয়ে এলো। বাড়িটির দিকে তাকিয়ে কাট কাট কন্ঠে বললো,
~ অনিক কে বের করে নিয়ে এসো। তবে আমি যেতে পারবো না। জলদি করো, সময় নেই।
এমন পরিবর্তনের কারণ ধরতে পারলো না আসমানী। ফ্যালফ্যাল করে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃদ্ধ হাসলো। আসমানী দেখলো এই বয়সেও লোকটার একটা দাঁত ও পড়ে নি। না বাঁধানো মনে হচ্ছে। হাসিটাও কি স্বচ্ছ। বৃদ্ধ হেসেই বললো,
~ এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি বাড়ি ভাঙা হচ্ছে আমাদের। আব্বা গম্ভীর মুখে বসে আছেন তার প্রিয় চেয়ারে। আমি দেখছিলাম বাবার গম্ভীর মুখখানা কতটা অসহায় দেখাচ্ছিল। পুরুষ মানুষ বলেই হয়তো কাঁদতে পারে নি। পূর্বপুরুষের তৈরি বাড়িটা, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। কত মায়া মমতা মিশে ছিল। অনল মাহমুদের বাবা ছিলেন আজিমুদ্দিন মাহমুদ। দানবের মতো শরীর, টাকার জোর, ক্ষমতার গদি সব ছিল। সাথে ছিল নির্দয় মন। তার কথার পৃষ্ঠে কেউ কিছু বললেই তার জীবনের নরক যন্ত্রণা শুরু হতো। বাবা ছিল স্বাধীন চেতা মানুষ। রাজনীতি শুনলেই রক্ত গরম হয়ে উঠতো, ঠোঁটে হাসি ফুটতো। না সরকারের হুকুম মানতো না জনগণের। নিজের কাছে তা ঠিক মনে হতো তাই করতো। শত্রুও কম ছিল না। কোনো এক মিছিলে আজিমুদ্দিন মাহমুদের সাথে বাবার কথা কাটাকাটি হয়। বয়সে বড় বাবা! সেদিন বাবা জিততে পারলেও পরদিন সকালে বাড়ি ভাঙন তাকে ভেতর বাইরে সবটা জায়গায় হারিয়ে দিয়েছিল। উঠলাম ভাড়া বাসায়। যুবকদের সাথে পাল্লা দেওয়া বাবা তখন খুব শান্ত। ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরতো। হয়তো এই দেশ তার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে ইহলোক ত্যাগ করেন।
বেশ খানিকটা সময় জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো বুদ্ধ। বয়সের ভারেই হয়তো এমন অবনতি। বাড়িটির দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,
~ বাবা যেদিন মারা গেলেন তার আগের দিন এই আজিমুদ্দিন মাহমুদ এই মাহমুদ ভিলার কাজ শুরু করেন। পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া জমির উপর স্বৈরাচারী শাসকের বাড়ি বানানো মানতে পারেন নি বাবা। আজিমুদ্দিন মাহমুদ কে জিতিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বিয়ে করেছি তখন সবে। বড় ছেলে হওয়ায় তিন বোন, দুই ভাই সহ মায়ের দায়িত্ব তখন আমার কাঁধে। কোথাও তাকাবার ফুসরত নেই। পরিস্থিতি টা এমন ছিল মনের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগাতে পারিনি। যখনই মনে হয়েছে পাল্টা জবাব দিবো, তখনই মা, স্ত্রী, ভাই বোনদের মুখ ভেসে উঠতো। আমার কিছু হলে যে তারা না খেয়ে মরতো। এভাবে পঁয়ত্রিশ টা বছর কিভাবে চলে গেল টেরই পেলাম না। মাঝে মাঝে জন্মস্থান টা দেখে যেতাম। নামের স্বার্থকতা রাখতে পারিনি, যুদ্ধহীন ময়দান ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। এখন যখন মরনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন বাবার মুখটা খুব মনে পড়তে লাগলো। রক্ত গরম যুবকের মতো ভাবতে লাগলাম নিজেকে। এমন করেই আহিশ দাদু ভাইয়ের সাথে দেখা। দু বছর আগে। তখন থেকেই এখানে দারোয়ান হয়ে আছি, সকল খবরাখবর আহিশ দাদুভাই কে দিই। আর দিন গুনি মাহমুদ ভিলাটাকে আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া দেখার আশায়। বাঁচবোই আর কতদিন, কে জানে শেষমেষ প্রতিশোধ নিতে পারবো কিনা।
শেষের কথাটা কেমন করুণ শোনালো। আসমানী অবাক চোখে বৃদ্ধকে দেখছে। লোকটা পঁয়ত্রিশ বছর পর প্রতিশোধ নিতে এসেছে। কত জোর মনোবল, সাহস থাকলে এমন করা যায়? আসমানী শুকনো ঢুক গিলে বাড়িটার দিকে তাকালো। আভিজাত্যে ভরা বাড়িটি। আধুনিকতার ছোঁয়াতে কেমন জ্বলজ্বল করে। নিজের বলে দাবী করার লোকের অভাব নেই, অথচ যাদের মাটি কেড়ে নিয়ে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে তারা দারোয়ান হয়ে অপেক্ষা করছে। আসমানী’র মনে হলো বৃদ্ধের জন্য তার কিছু করা দরকার। কি করবে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বৃদ্ধের হাত ধরে বললো,
~ আহিশ আপনার নাতি হলে আমি আপনার মেয়েই হবো। আজকে আপনার মেয়ে আপনাকে শেষ বয়সে দীর্ঘ বছরের জমে থাকা ইচ্ছে টা পূর্ণ করার সুযোগ করে দিবে। অপেক্ষা করুণ আসছি!
বৃদ্ধকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না আসমানী। তার খুব তাড়া। দৌড়ে বাড়িতে প্রবেশ করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। টিমটিমে আলো জ্বলা ঘরটায় ঢুকে পড়লো নিঃসংকোচে। কিছুক্ষণ পরই এক যুবকের হাত ধরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। দুজনের হাঁটার গতিই স্বাভাবিক। অনিক কে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বাভাবিক মানুষ অত্যন্ত কায়দা করে হেঁটে আসছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আসমানী অনিক কে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে পড়লো। রান্না ঘরে একপাশে পর পর তিনটে পেট্রোলের বোতল সাজানো। বেশ ভারি, কোন রকম তুলে নিয়ে উপরের করিডরে চলে গেল। প্রত্যেকটা ঘরে পর পর কয়েক বার আপডাউন করে পেট্রোল গুলো ছড়িয়ে দিলো। মুখশ্রী এতটা গম্ভীর যে কেউ কথা বলার সাহস পাবে না। শেষ এক বোতল নিয়ে আসমানী বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। বৃদ্ধ একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো দিক না তাকিয়ে পুরো বাড়ির, বাগানের চারপাশে ঘিরে পেট্রোল ছড়িয়ে দিয়েই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আসমানী। এগুলো সে নিজের সেইফটি, শত্রুকে ইউনিক উপায়ে মাত দেওয়ার জন্য রেখেছিল। আজ সুযোগ হয়েছে। কোনো ছাড় নেই। লাইটার হাতে এগিয়ে এসে বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
~ শেষ নিঃশ্বাস কবে ফেলবো ঠিক নেই! মাহমুদদের পতন না হয় এই বাড়িটা বিসর্জন দিয়েই হোক। যদিও প্রাণ নেই এই বাড়ির, তবুও! আপনার হাতেই আপনার ইচ্ছে টা পূর্ণ করুন। জলদি, ভোর হতে চললো।
কথাটা শেষ করেই আসমানী গম্ভীর মুখে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃদ্ধের চোখে মুখে তখন তীব্র প্রতিশোধ! চোখ বুজে জোরে শ্বাস নিয়ে লাইটার অন করে দরজা দিয়ে ফিকে মারতেই আগুন টা তরতর করে বেড়ে গেল। আসমানী বৃদ্ধের হাত ধরে কিছুটা দৌড়ালো। গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার সময় নষ্ট করলো না, গেইট পেরিয়ে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ালো। তখনই শব্দ হলো ব্লাস্টের। রান্নাঘরই যে খুব তাড়াতাড়ি এই আগুন ছড়িয়ে দিবে আসমানী জানতো! দূর থেকে বৃদ্ধ চোখ বড় বড় করে দেখে নিল। শিতল স্রোত বয়ে গেল ভেতরে। পায়ের তলা কেমন শিরশির করে উঠলো।
অগ্নি শিখা ক্রমশ বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো সবগুলো এলার্ট এলার্ম বেজে উঠবে, আশপাশের মানুষ টের পেয়ে যাবে। আসমানী গাড়ি স্টার্ট করার পারমিশন দিলো। সাথে সাথে ভু ভু শব্দ করে গাড়ি চলতে শুরু করলো। পেছনে বসে দুজনই জানালা ভেদ করে মাথা বের করে তৃপ্তি নিয়ে দেখে গেল। যতদূর দেখা যায় চোখের তৃষ্ণা মেটালো। এভাবেই মাহমুদ দের পরাজয় নিশ্চিত!
কাঠের তৈরি বাড়িটি অদ্ভুত নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। বাড়িটি তৈরিই হয়েছে রহস্যের ছাপ ফেলে। এই যে চারকোনা বাড়িটি, সামনের দিকে দেখলে একরকম মনে হবে, পেছনের দিক থেকে দেখলে আরেক রকম মনে হবে। যেন এইটুকু জায়গাটিতে চারটে বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। দূর থেকে দেখলে অবশ্য কেউ চট করে পাশের কোনা ধরতে পারবে না। কি এক নিরাট রহস্যে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে! চারপাশ পাহাড়ি গাছপালায় ভরপুর। দু একটা পেয়ারার গাছ ও আছে। বিশেষ যত্নে পরিচর্যা করা হয়েছে বিদেয় বড় বড় পেয়ারা গুলো ঝুলে আছে ডালে ডালে। বা দিকটায় কয়েকটা ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছে। বেশ কিছুর মধ্যে ফুল শোভা পাচ্ছে।
অদ্ভুত এক আদুরে সুগন্ধি এসে নাকে বারি খাচ্ছে। মনে হচ্ছে বেশীক্ষণ সুগন্ধি টা নাসিকাপথ দিয়ে পেটে চালান হলে ঘুম এসে ভর করবে। পেছনের দিকটায় আপাতত খোলা বারান্দা ছাড়া কিছুই চোখে পড়বে না। মাঝে দু একটা ফুলের টপ অতি অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে। বারান্দা টা এতটাই উন্মুক্ত যে বৃষ্টি এসে সহজেই ভিজিয়ে যেতে পারবে, আবার রোদ এসে বৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিপরীতধর্মী কাজ করে খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়বে বারান্দায়, লেপ্টে থাকবে! আবার কখনো উড়ো ঝড় এলে এই বারান্দা টাকেই সব ভার বহন করতে হয়। বারান্দাটা ও যেন এত দিনে বুঝতে পেরেছে তাইতো একদম মাথা উঁচিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ডান দিকে অদ্ভুত কিছু লতাপাতা আগাছা। হয়তো হুট করে কারো কিছু হয়ে গেলে, চট করে বুদ্ধি করা যায় এসব লতাপাতা দিয়ে। এই জরাজীর্ণ প্রাণের শহরে তাছাড়া আর কি ব্যবস্থা।
মাঝারি সাইজের এক তক্তপোষে বাবু হয়ে আছে আদিল। মেহগনি গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে এক চিলতে রোদ ফর্সা শরীরটাই পড়ছে। নাকের ডগা ঘর্মাক্ত, রোদের আলোয় খানিক চিকচিক ই করছে। এলোমেলো উসকোখুসকো চুল, রক্তিম চোখ, গম্ভীর মুখশ্রী; ছেলেটাকে সবার থেকে আলাদা লাগছে। কিছুটা নয় একদম আলাদা। হাতে সিগারেট নামক বিষ; গেইট পেরিয়ে সরু রাস্তায় একটু পর পর নজর বুলাচ্ছে আর সিগারেট ফুকছে। হাতের নিচে ঠিক লাল লাল মাটির উপর ন’টা সিগারেটের পোড়া অংশ পড়ে আছে। যার বাকি অংশের শোষণ কাল যে কয়েক মিনিটের ব্যবধান স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তবুও ছেলেটা খুকখুক কাশ বিহীন বিষাক্ত ধোঁয়া গুলো হাওয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। হেলদোল নেই। ভোর ছ’টা নাগাদ যে বসেছে, একবার মনে হয় বসার ভঙ্গিমা পরিবর্তন করেছিলো। এখন সাতটা বেজে দশ মিনিট। চলে আসার কথা এখন; তবে আসছে না।
এদিকে যে আদিল মাহমুদের নির্দয় হৃদয়টা ক্রমশ ছটফট করে উঠছে! সে কথা যদি কেউ মহারানী কে বুঝাতো! বুঝিয়েই বা লাভ কি, মহারানী তো তাকে ভুল বুঝতে উস্তাদ! মুখটা খানিক বিকৃতি করে এক দলা থুতু দূরে ছুড়ে মারতেই মনে হলো লোহার গেইট পেরিয়ে কেউ এদিকেই আসছে। এক ছুটে চোখের দৃষ্টি তার সেদিকে চলে গেল। একরাশ স্নিগ্ধ তা এসে ভর করলো চোখ মুখে। কাঁধ পর্যন্ত চুল গুলো উড়িয়ে, মাথায় উড়নার সামান্য অংশ ফেলে মেয়েটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেল। মেয়েটা এক পা এক পা ফেলে যত তার দিকে এগিয়ে আসছে সে ততবার রোমাঞ্চিত হচ্ছে। হুট করে খেয়াল হলো চুল গুলো কালকেও এমন ছিলো না। পিঠ ছাড়ানো চুল গুলো তার আরেকটা ভালোবাসা ছিলো। আদিলের বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলো না।
শুধু মাত্র তার জন্যই, তাকে কষ্ট দিবে বলেই মেয়েটা এত শখের চুল কেটে ফেলেছে। এতক্ষণের স্নিগ্ধ তা এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। মুঠো ভর্তি রাগ এসে হানা দিলো শরীরে। সিগারেটের পুড়া অংশ টা মাটিতে ছুড়ে ফেলে, আরেকটা সিগারেট ধরালো। ততক্ষণে মিরা আফরা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে! কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে মিরা’র দিকে তাকিয়ে রইলো আদিল, তাকিয়ে থেকেই হাত দিয়ে ইশারা করলো। সাথের দুটো লোক মাথা ঝুঁকে চলে গেল নিজ কাজে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিরক্ত মিরা। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে, পা টা ব্যাথায় টনটন করছে। আফরা নিশ্চুপ নজর ঘুরিয়ে বাড়িটা দেখছে। আরো কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মিরা না পেরে আদিলের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে তক্তপোষের উপর বসে পড়লো। মুচকি হাসলো আদিল, যেন এই ক্ষণের জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। তবে দুরত্ব টুকু সহ্য হচ্ছে না, মিরা কে না ছুঁয়েই দুরত্ব টা গুঁচিয়ে দিলো আদিল। আফরা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
~ দুজন কে বেশ মানিয়েছে না?
~ হ্যাঁ, বানরের পাশে মুক্তোর মালা!
চট জলদি উত্তর দিয়ে নিজেও আদিলের পাশে বসলো। অচেনা কেউ দেখে সুসম্পর্কের প্রতীক হিসেবে বাহবাও দিবে হয়তো! ঘরের খবর কয়জনা জানে? আফরা’র বিদ্রুপ কন্ঠস্বর আদিল গাঁয়ে মাখলো না। মুচকি হেসে বললো,
~ বানরের গলায় যখন মুক্তোর মালা টা থাকবে তখন বানর নিজেকে অত্যন্ত উচ্ছাসিত মনে করবে। মালা টাকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরবে, ওই মালা যেন কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে। নিত্য যত্ন নিবে, পরম আদরে আগলে রাখবে! কোনো ভাবেই যেন রাজত্ব তার হাত থেকে না ছুটে যায়! এক্ষেত্রে নিজেকে বানরের জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে ক্ষতি নেই। আমার আবার মান অপমান বোধ খুবই কম। একটু নির্লজ্জও বটে। আমি কিন্তু মুক্তোর মালা টাকে খুব আগলে রাখবো। একদম বুকের খাঁচায় আটকে রাখবো। কষ্ট দিলে খুব যত্ন নিয়েই দিবো, আদর করলেও যত্ন নিয়েই করবো!
মুখে বিচিত্র হাসি। যোগ্য জবাব দিতে পেরে খানিক আনন্দিতও। মিনিট খানেক চুপ থেকে আবার বললো,
~ অসুন্দর কে গোছগাছ করে রাখলেও মানানসই হয়ে যায়! সেখানে আপনার বন্ধু আমাকে মানিয়ে নিতে পারবে না? আমিও না হয় মানানসই হয়েই রইলাম!
বিরক্ত দৃষ্টিতে চোখ মেলালো মিরা। কথাগুলো তার সহ্য হচ্ছে না, একদমই না। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
~ কি জন্য এত জরুরি তলব? ধাক্কায় মরি নি বলে মারতে এনেছেন? তো এত নাটকের কি আছে? একটা বুলেটই ই তো যথেষ্ট!
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৩২+৩৩+৩৪
আদিল জবাব দিলো না। তক্তপোষ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। মুখশ্রীতে রাগ খেলা করছে। আফরা, মিরা ভ্রু কুঁচকে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। আদিল বের হলো ডান হাতে চকচকে কিছু নিয়ে। দাঁড়িয়ে পড়লো আফরা! হাত আপনাআপনি কোমরে চলে গেল। প্রস্তুতি আজ সে নিয়েই এসেছে!