মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৭

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৭
মুসতারিন মুসাররাত

ফোনটা আবার কেঁপে উঠতেই প্রত্যাশা ত্রস্ত রিসিভ করল। নীরব নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে সামনের ছোট্ট টেবিলের উপর থেকে ম্যাগাজিনের বইটা হাতে তুলল। প্রত্যাশা ফোনটা কানে নিয়ে হালকা গলায় বলল,
-” আসসালামু আলাইকুম।”
ওপাশ থেকে সার্থকের শান্ত,গম্ভীর গলা ভেসে এল,
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
একরাশ কৃতজ্ঞতা মেশানো সুরে বলল প্রত্যাশা,

-” সেদিন আপনি কতটা হেল্প করলেন, একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি‌। তাই দুপুরে ভাবলাম একটা ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু…”
কথার মাঝখানেই সার্থক থামিয়ে দিয়ে বলল,
-” ইট’স ওকে।”
পরপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-” তোমার পায়ের অবস্থা কেমন? ব্যথা আছে কি? কোনো প্রবলেম নেই তো?”
প্রত্যাশা হালকা মাথা নাড়ল। ঝটপট বলল,
-” না না, ব্যথা একদম নেই। এখন ভালো আছি।”
-” গুড।”
-” ওষুধ প্রেসক্রাইবের চার্জটা কিন্তু পান আপনি। আত্মীয় বলে আবার সৌজন্য করবেন না কিন্তু।”
প্রত্যাশার বোকাসোকা, সরল কথাটি শুনে সার্থক হেসে ফেলল। বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” এতটা ব্যবসায়ী হতে পারব না। আত্মীয়দের সঙ্গে হিসেবনিকেশ চলে না। আর আত্মীয়-স্বজনেরও তো অধিকার আছে। ওটা তোমার অধিকার ছিলো। সো এখানে চার্জের প্রশ্নই আসছে না।”
কথা বলতে বলতে আকস্মিক চোখের তারায় দীঘির জলের মতো ভাসাভাসা দু’টো চোখ, মায়াবী একখানা মুখ ভেসে উঠল। বেহায়া মন না জানি উস্কে দেয়, এই ভ’য়ে তটস্থ হলো সার্থক। আর হলো বলেই হঠাৎ কথার রেশ ছিঁড়ে প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলে উঠল,
-” আচ্ছা, প্রত্যাশা আমি একটু বিজি আছি। এখন রাখছি। ভালো থেকো, বাই।”
ওদিকে নীরবের মুখ থমথমে। ভেতরে জমে থাকা রাগ ফুসফুস করে ফাটিয়ে উঠতে চাইছে। রাগে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। হাতের ম্যাগাজিনটা শব্দ করে টেবিলের উপর ফেলল। শব্দে প্রত্যাশা চমকে ফিরে তাকাল। ওদিকে তাকিয়েই মিহি স্বরে বলল,

-” ওকে।”
রাগটা কমাতে নীরব জানালার দিকে পিঠ করে দাঁড়াল। মেরুদণ্ড সোজা, হাত দুটো মুঠো করা, চোয়াল শক্ত। ভেতরের দাবানল প্রকাশ না করলেও শরীরের ভাষায় বোঝা যাচ্ছে কিছুটা রুক্ষ মেজাজে আছে। নীরবের অভিব্যক্তি প্রত্যাশা খেয়াল না করেই ও মনে পড়ার মতো করে সরল মনে বলে উঠল,
-” ওহহো যেটা বলছিলাম, কুয়াকাটায় প্রীতি আপুদের সাথে দেখা হয়েছিল। ওনাদের সাথে দেখা হওয়ার পরেই আমি আপনাকে কল দিই। কিন্তু তখন আপনি কল রিসিভ করেননি। তারপর বিকেলে যখন ঘুরতে গিয়েছিলাম, সমুদ্রের পানিতে খালি পায়ে হাঁটছিলাম তখনই পা কে”টে যায়।”
একটু থেমে শ্বাস নিয়ে আবার শুরু করল,
-” প্রীতি আপুকে যেমনটা আগে ভেবেছিলাম, সেদিন তো উনি আমার পুরো ধারনাই চেঞ্জ করে দিলো। উনাকে যতটা রুক্ষ মনে হয়েছিল, সেদিন কথা বলে তেমন মনে হলো না। আমার তো ওনাকে যথেষ্ট আন্তরিকই মনে হলো। প্রীতি আপু নিজে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এলেন। আর উনার ভাই ওষুধ প্রেসক্রাইব করে দিলেন। তারপর ব্যান্ডেজও উ___”

কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ নীরব ঘুরে দাঁড়াল। রুক্ষ, ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
-” তুমি কীভাবে চলো? ঘুরতে গিয়েও একটা না একটা ঘটনার জন্ম দিতেই হবে! এতজনের কারো কিছু হয় না, আর তুমি গিয়ে পা কে’টে নাও? আর সেই সুযোগে অন্যদের সাথে গল্প জমাও।”
প্রত্যাশা বিস্ময় আর বিরক্তির মিশ্র সুরে বলল,
-” আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো সবটা বলার আগেই আপনি ঝাড়তে শুরু করলেন। আর কে’টে গেলে আমারই বা কী দোষ? আমি কি ইচ্ছে করে করেছিলাম? আজব তো!”

প্রত্যাশা ঠোঁট ফোলাল। গাল দুটো অভিমানে ভারী হলো। প্রত্যাশার অভিমানি মুখের দিকে তাকাতেই নীরবের মুখের আদল মিইয়ে আসলো। গলার স্বর আগের তুলনায় নরম করল। তবুও সাবধানবাণী নামল প্রতিটি বাক্যে,
-” ওকে ওকে, এখন গাল ফুলিয়ে নাটক করো না। এখন আমাদের বেরোতে হবে। তবে শোনো, আগেও বলেছি, আবার বলছি; কিছু কিছু মানুষের সংস্পর্শে না যেয়ে দূরে থাকাই বেটার। আর সব মানুষের বাহ্যিক ব্যবহার দেখে পুরো বিশ্বাস করে ফেলো না। কারো সাময়িক আন্তরিকতায় নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দিও না। জীবনে চলতে গেলে বুদ্ধি খাটাতে হয়, চোখ খোলা রাখতে হয়। সবাই সবসময় যেরকম মনে হয়, আসলে কিন্তু সেরকমই হয় না।”
প্রত্যাশা কতটা গুরুত্ব দিলো বোঝা গেল না। ও বোঝার চেষ্টাই করল না। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। এরমধ্যে নীরবের ফোনটা বেজে উঠল। আন্নাউন নম্বর দেখে নীরব কপালে ভাঁজ ফেলে রিসিভ করল।

-” হ্যালো….?”
বলতেই ওপাশ থেকে পুরুষ গলা এল,
-” অফিসার নীরব বলছেন?”
নীরব ভ্রু গুটিয়ে জবাব দিল,
-” জ্বী। নীরব মাহবুব স্পিকিং।”
-” আমি ডিআইজি অফিস থেকে বলছি, সৎ, সাহসিকতা আর দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার জন্য আপনাকে মেডেল দেওয়া হবে। অতি সত্বর হেড অফিসে চলে আসুন।‌ এখানে….”
কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে নীরব রুক্ষ স্বরে বলল,

-” ফা’জলামো রাখ। নম্বর চেঞ্জ করলেই কি গলার স্বরও চেঞ্জ হয়?”
-” আরে ওইটাই তো চ্যালেঞ্জ ছিল। দেখলাম ধরতে পারিস কিনা। আচ্ছা দোস্ত কই তুই? সবাই তো পৌঁছে গেছে। তুই কোথায় শা’লা? বিয়ে করলি, জানালি না। দাওয়াতও দিলি না। এখন তো সবাই বউ নিয়ে এসেছে, তোর বউ আনবি না? না কি সবাই বউ দেখে ফেলবে বলে আসছিসই না?”
নীরব ঠোঁট শক্ত করে ছোট করে বলল,
-” ফাজলামো কথাবার্তা বলতে অন্য কাউকে খুঁজে নে,
ফাজলামি সাথে টাইম ন”ষ্ট করার মতো মুডে নেই আমি। আসছি।”

ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি পালন কম একে বন্ধুদের গেট-টুগেদারই বলা যায়। ফয়সালের ল্যাভ ম্যারেজে বন্ধুদের অবদান অনস্বীকার্য। ক্লাসমেটের সাথে প্রেমের সূচনালগ্ন থেকে বিয়ে অবধি যেসব বন্ধু পাশে থেকেছে, যাদের সঙ্গে হৃদ্যতা আর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তাদেরই কয়েকজনকে সে আমন্ত্রণ জানিয়েছে নিজের নিরিবিলি ফ্ল্যাটে। সম্পর্কের পথচলার এই স্মরণীয় দিনে আপন মানুষগুলোকে সঙ্গে রাখতেই এমন ঘরোয়া আয়োজন।
ড্রয়িংরুমে বন্ধুদের হাসাহাসি আর গল্পের আসর জমেছে। এমন সময় একজোড়া দম্পতির আগমণ ঘটে। সবার চোখ তাদের দিকে। প্রত্যাশা নীরবের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে এলো। সোফায় বসা এক রমণীর ফরসা মুখের আদল বিবর্ণ, ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এতক্ষণের হাসি মুখটা নিমিষেই মিইয়ে আসলো। প্রত্যাশার গায়ে মেরুন রঙের শাড়ি। আঁচলটা ডান হাতের ফাঁক গলে সামনে এনে রাখা। একহাতে আলতো করে ধরে রাখা। নীরবের পরনে কফি কালারের শার্ট, অফ হোয়াইট ডেনিম প্যান্টের উপর ইন করে পড়া। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে হালকা ব্যাক ব্রাশ করা। একজন উচ্চস্বরে বলল,

-” বন্ধু অবশেষে আসলা? বউ সবাই দেখে ফেলবে বলে গোপনে বিয়ে করছো।”
আরেকজন বলল,
-” আরে এএসপি তো কিপটামিও করছে, আমরা সব কবজি ডুবে খাব বলে, বিয়েতে অনুষ্ঠানই করেনি।”
নীরব বলল,
-” হুট করে হয়েছে সবাই জানিস, অহেতুক আজবাজে বলা বন্ধ রাখ।”
একজন লম্বা করে সালাম দিল,
-” আসসালামুয়ালাইকুম ভাবি।”
প্রত্যাশার লজ্জা লাগছে, ও এভাবে অভ্যস্ত না থাকায় আনইজি ফিল করছে। দৃষ্টিজোড়া ওর নত। ও মাথাটা তুলে মিহি স্বরে উত্তর দিতেই চোখ পরে প্রীতির দিকে। প্রীতি এদিকেই চেয়ে। প্রথমে বিস্মিত হলেও পরক্ষণে খেয়াল হয় প্রীতি নীরবের ফ্রেন্ড হলে এদেরও। মোবাইলে ডুবে ছিলো ইচ্ছে। মুখ তুলে তাকাতেই চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। একবার নীরবের দিকে তাকাল তো আবার প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,

-” মাম্মা, পাপা! পাপা এসেছে!”
ইচ্ছে ঝট করে ওঠে এগিয়ে নীরবের সামনে দাঁড়ায়। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে প্রাণোচ্ছ্বল কণ্ঠে বলল,
-” পাপা!”
সবার মাঝে এভাবে বলায় প্রত্যাশার না চাইতেও কেমন জানি লাগলো। ইচ্ছের গাল ধরে নীরব বলল,
-” সুইট মামণি, কখন এসেছো?”
উপস্থিত কেউকেউ একটু অবাকই হলো। একজন হাসতে হাসতে মশকরা করে বলল,
-” আরে দ্যাখো দেখি কান্ড! ইচ্ছে বেবি কী নীরবকেই নীবিড় ভাবছে? আর টুইনস হলে ইচ্ছেরই বা কী দোষ। ও ছোট মানুষ। অত বুঝে নাকি।”
আরেকজন ঝট করে বলে ফেলল,

-” যেখানে স্বয়ং ইচ্ছের মা, আমাদের বলিউড সুন্দরী প্রীতি জিনটাই মিস্টেক করেছিলো।‌ নীবিড়কে প্রপোজ করতে গিয়ে ভুলে তো প্রথমে নীরবকে প্রপোজ করে ফেলেছিল। সে নিয়ে কী এক কান্ড!”
পুরোনো ঘা টা দগদগ করে উঠল প্রীতির। সবাই যেটাকে মিস্টেক জানে, আদৌও কী মিস্টেক ছিলো? নাকি অপমানের বদলা, সাথে পুরনো প্রতিশোধের স্পৃহা থেকেই ঘটনার মোড় উল্টে দেওয়া হয়। মিথ্যে নাটক সাজানো হয়। প্রীতি প্রসঙ্গ পাল্টাতে, সবার মনোযোগ ঘুরাতে বলল,
-” আরে তোমরা সব পুরোনো কথা বাদ-ছাদ দাও তো। এতক্ষণ তো সবাই নীরবের বউ দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলে, তাকেই বরং দ্যাখো।”
পরপর প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে আছো কেনো, এসো বসো।”
প্রত্যাশা প্রীতির দিকে তাকিয়ে ফের নীরবের দিকে তাকাল। চোখের ভাষায় নীরবের সম্মতি পেতেই আলগোছে গিয়ে বসল। মেয়েরা একপাশের সোফায়। ছেলেরা অপর পাশে। সামনের টি-টেবিলে নাস্তায় ভরপুর। খেতে খেতে আড্ডা আবার জমে উঠল। ইচ্ছে নীরবের কোলের উপর বসে ফোনে গেম খেলছে। গল্পের এক পর্যায়ে একজন বলল,
-” এখানে উপস্থিত নীরব বাদে বাকিদের লাভ ম্যারেজ। তা নীরব আমাদের ছোঁয়া কেনো তোর গায়ে লাগলো না, বলতো? প্রেম-পিরিতে তোর এলার্জির কারনটা কী ছিলো?”
নীরব একটু কেশে বলল,

-” প্রেমের পরিণতি যদি বিয়ে না হয়, তবে তা আবেগই থাকে, অধিকার নয়। একটা কাগজে নাম মোহর হওয়া মানেই; দেয় হক, দেয় নিরাপত্তা, দেয় তাকে ছুঁয়ে রাখার অধিকার। সবার সামনে গর্ব করে বলা যায় সে আমার হালাল জীবনসঙ্গী।”
এক সেকেন্ড থেমে বলল,
-” প্রকাশ্যে, সম্মানে, দায়িত্ব নিয়ে আমার জন্য নির্ধারিত জনকে আমার পাশে রাখতে চেয়েছি। তাই প্রেম নয়, আমি হালাল সম্পর্ককে বেছে নিয়েছি। এটা আমার থট। তবে আমি এটাও মনে করি, সব কিছুই উপরওয়ালার লিখে দেওয়া, তাই এমনটাই হয়েছে। এছাড়া নাথিং।”
কিছুপল পর। সবাই কথা বললেও প্রত্যাশা চুপচাপ। একেতে অচেনা লোকজন, তারউপর সবাই অনেক সিনিয়র। ওর কিইবা বলার আছে। ইচ্ছের হাত ধরে প্রত্যাশা একটু দূরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। কয়েক মূহুর্ত পরেই পুরুষালি পরিচিত স্বর কানে এলো,

-” আনইজি লাগছে? বেশি খারাপ লাগছে তোমার?”
নীরবের দিকে ঘুরে তাকাল প্রত্যাশা। মাথা নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
-” হুম। বেশি না একটু….একটু কেমন কেমন লাগছে।”
প্রত্যাশার বলার ধরণ দেখে নীরব হেসে ফেলল। আশ্বস্ত করতে বলল,
-” আর একটু ওয়েট করো, আমরা চলে যাবো।”
ইচ্ছে মুখ তুলে নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” পাপা আমিও যাবো।”
এরমধ্যে প্রীতি ডাক দিলো,

-” ইচ্ছে, তোমার হেয়ার ব্যান্ড ওখানে খুলে পড়েছিল দেখছি। এসো লাগিয়ে দিই।”
ইচ্ছে কপা এগিয়ে প্রীতির শুভ্ররঙা থ্রি পিসের ওড়না টেনে ধরল। আহ্লাদি গলায় বলল,
-” মাম্মা আমি পাপার সাথে যাবো। পাপা ওকে নিয়ে যাবে।”
প্রত্যাশাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে। প্রীতি বিরক্তি নিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে জ্বালাবে না। একটু পর আমরা বাসায় ফিরবো। এখন চুপচাপ বাকিটা সময় থাকবে। কোনো কথা বলবে না।”
ইচ্ছে গাল ফুলাল। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে। নীরব এগিয়ে ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে অন্যদিন নিবো তোমাকে?”
ইচ্ছে জেদি স্বরে বলল,

-” নাহ…ইক্ষুন।”
প্রীতি চোখ রাঙিয়ে চাইল। ধ’ম’ক দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নীরব বলল,
-” আচ্ছা, ঠিক আছে তোমাকে নিয়ে যাবো।”
পরপর প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে যেহেতু যেতে চাইছে ওকে নিয়ে যাই। কাল আমি দিয়ে আসবো। আশাকরি তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। আর অসুবিধা হওয়ার কিছু নেইও, কাজের লোকের কাছে থাকার চেয়ে আমাদের ওখানে যে একটু হলেও বেশি ভালো থাকবে ইচ্ছে, এটা আমি চোখবুঁজে বলে দিতে পারি।”
কথাগুলো পিঞ্চ মে”রে বলে নীরব তা প্রীতি ঢের বুঝল। তবে প্রত্যুত্তর দিলো না।
ডিনার না করেই সবাইকে বুঝিয়ে কিছু একটা অজুহাত দিয়ে নীরব চলে আসে। পার্কিংলটে পার্ক করা বাইকের কাছে আসতেই প্রত্যাশা শুধাল,

-” আগে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারপর ইচ্ছেকে নিয়ে যাবেন না?”
নীরব বাইকে বসতে বসতে বলল,
-” না।”
-” না মানে।”
-” না মানে তো না-ই হয়।”
-” হেঁয়ালি না করে ঝেড়ে কাঁশুন তো। সরাসরি বলুন।”
-” তুমিও আমাদের সাথে যাচ্ছো।”
-” আজ?”
-” হুম। আজ, এখন।”
নীরব আদেশের সুরে বলল,
-” বাড়তি কথা না বলে ঝটপট কাজ করো। ইচ্ছেকে তুলে দাও।”
ইচ্ছেকে মাঝে তুলে বসাতে গেলে নীরব চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,

-” সামনে দাও।”
-” চালাতে সমস্যা হবে তো?”
-” হবে না, যা বলছি তাই করো।”
অগত্যা ইচ্ছেকে সামনে বসিয়ে নিজে নীরবের পাশে বসল। বাইকের ইঞ্জিন চালু করতে করতে নীরব বলল,
-” শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে বসো।”
প্রত্যাশা শাড়ির আঁচল কোলের উপর তুলে একহাত কোলের উপর রাখল। অপর হাতে নীরবের পেট জড়িয়ে ধরল। ইচ্ছে ঘাড় বাঁকিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে বলল,
-” তুমি সবসময় আমার পাপার সাথে থাকো কিনো?”
প্রত্যাশা দুষ্টু হেসে বলল,
-” তোমার এই পাপা আমার বর, তাই।”

ইচ্ছেকে দেখে নীহারিকার ভেতরে ভেতরে ভালো লাগলেও প্রকাশ করলেন না। ওদিকে বাড়িসুদ্ধ লোক তো বলতো ইচ্ছেকে আনতে। সবাই প্রত্যাশা আর ইচ্ছেকে দেখে খুশিই হলো। নীহারিকা কোলের কাছে ইচ্ছেকে বসিয়ে, মাথায় মমতায় ভরা হাত বুলিয়ে গেলেন। প্রত্যাশা সবার সাথে সাক্ষাৎ শেষে শাশুড়ির পাশে বসল। নীহারিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালেন,
-” চুল কেটেছো?”
প্রত্যাশা ভড়কে গেল। এইরে শাশুড়ি মায়ের জহুরির চোখ। ঠিক খেয়াল করেছে। আম্মুর মতো উনিও বকা না দেয়, এই ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল ও। নিচের ঠোঁট জিভের ডগায় ভিজিয়ে আমতা আমতা করল,

-” হ-হ-হু।”
-” বড়বড় চুলই বেশি ভালো লাগে। বড় চুলে তোমাকে বেশি সুন্দর লাগতো।”
বেশি কিছু না বলায় প্রত্যাশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরমধ্যে নিভান এসে ইচ্ছের সাথে কথা বলতে লাগল। ইচ্ছের পাশে বসে আদুরে গলায় বলল,
-” সোনা মামণি তুমি চিনো আমায়?”
ইচ্ছে বড়বড় চোখে চেয়ে দু’পাশে মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝায়। নিভান কিছু বলার আগেই প্রত্যাশা ঝটপট বলে উঠল,
-” ইচ্ছে উনি তোমার বড় পাপা।”
ইচ্ছে ভেঙে ভেঙে বলল,
-” বড়ো পাপা?”
নিভান একগাল হেসে স্নেহমাখা হাত ইচ্ছের মাথায় রেখে বলল,
-” হ্যাঁ সোনা।”
ফ্রেশ হয়ে ক্যাজুয়াল পোশাকে নীরব রুম থেকে বেরিয়ে এদিকে আসছিলো। প্রত্যাশার নজর পড়তেই ইচ্ছেকে দেখিয়ে তর্জনী তুলে বলল,
-” ইচ্ছে, আর ওনাকে আজ থেকে পাপা নয়, ছোটো পাপা বলবে, ক্যামন? উনি তোমার ছোটো পাপা হোন।”
ইচ্ছে নাক ফুলিয়ে বিরোধীতা করে উঠল,

-” পাপা।”
নীহারিকা আদর করে নরম স্বরে বলল,
-” ইচ্ছে, আপু আমার প্রত্যাশা ঠিকই বলেছে, তুমি ছোটো পাপা বলবে সোনা।”
ইচ্ছে ঘাড় ফুলিয়ে বলল,
-” পাপা ছোট না, পাপা অনেক বড়।”
উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো। নিভান আশকারা দিয়ে বলল,
-” আহ মা বাদ দাও না। ছোটো বাচ্চা মেয়ে, ব্যাপার না। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
কিছুক্ষণ পর,

আনিশা ইচ্ছের সাথে বেশ গল্প জুড়ে দেয়। সবাইকে চেনাতে বড় অ্যালবামটা নিয়ে আসে। ইচ্ছেকে দেখাতে থাকে, এটা ওর বাবা। বাবা এখনো অফিসে। আত্মীয়দেরও দেখিয়ে বকবক করতে থাকে। তবে ইচ্ছের কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। ও নীরবের ফোন নিয়ে কার্টুন দেখতে লাগলো। পরীকে এককাপ ব্লাক কফি আনতে বলল নীরব। তবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যাশা ছবি দেখতে আরম্ভ করল। অ্যালবামটা প্রত্যাশার কোলের উপর। এক পাশে আনিশা, আরেক পাশে ইচ্ছে নীরবের গা ঘেঁষে। প্রত্যাশা আর আনিশার দৃষ্টি অ্যালবামের পাতায়। ছবির পাতা উল্টে উল্টে হঠাৎ একটা পাতায় এলেই, আনিশা খিলখিল করে হেসে বলে উঠল,

-” ছোট ভাবীমণি, এই দ্যাখো ভাইয়া লুঙ্গি পরে দাঁড়ায়ে আছে। ওরে বাবারে! ভাইয়ারে কে এভাবে তুলছে?”
প্রত্যাশা চোখ বড় করে তাকায় ছবিটার দিকে। আবিরের ছবি, গাল দুটো ফুলে আছে, আর পরনে ছাপের লুঙ্গি, আর সাদা গেঞ্জি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সুন্নাতে খাতনার ছবি। প্রত্যাশা ভ্রু তুলে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-” আরে আরে এই ছবি তো দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেয়াই প্লাস দেবরের ম্যানলি জার্নির শুরুর দিক।”
আবিরের দৃষ্টি টিভির পর্দায় থাকলেও এহেন কথায় বেশ লজ্জায় পড়ল। আরেক পাতা উল্টাতে না উল্টাতেই একদম ছোট বেলার ছবি আসলো। দুষ্টু পাকনি আনিশা বিজ্ঞের মতন গোলগোল চোখ করে চেয়ে বলল,

-” এইটা ভাইয়া। আমি জানি বড় দাদান বুলেছিল। এমা নেনটু ভাইয়া।”
একদম ছোটবেলার ছবি। ছবিটিতে আবিরকে বেশ নাদুসনুদুস লাগছে। গায়ে পোশাক না থাকলেও কপালের উপর কালো ইয়া বড় নজর টিকা। ফর্সা মুখে চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে। আনিশার কথা শুনে আবির ধ’ম’ক দিয়ে উঠল। পরপর শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদো কাঁদো মুখ করে অসহায় কণ্ঠে বলল,
-” আম্মু এসব ছবিও রাখা লাগে নাকি? কী একটা অবস্থা। মানসম্মানের ফালুদা বানানোর জন্য কী সব ছবি জাদুঘরে সংরক্ষিত রাখার মতো, সংরক্ষণ করে রেখেছো। দিলে তো বারোটা বাজিয়ে।”
শর্মিলা হেসে রুমের দিকে যেতে যেতে জোরেশোরে বললেন,

-” ছেলেবেলার ছবি এগুলো, স্মৃতি হিসেবে রেখেছি। ছেলেবেলার ছবিতে মানসম্মান আবার কী বাবা?”
আবির অপ্রস্তুত ভঙিতে চোখমুখ কুঁচকে বসে রইল। প্রত্যাশা দ্রুত পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল,
-” দেখি দেখি সামনে এগোই। দেখি আর কারো ঐতিহাসিক ছবি-টবি পাওয়া যায় কী না।”
আচমকা আবির প্রশ্ন করে উঠল,
-” ছোট ভাবিমণি আর কারো বলতে তুমি কী ছোট দাদানকে বোঝাচ্ছো?”
প্রত্যাশা কথাটা কতটা বুঝল বোঝা গেল না। ও তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়ে বলল,

-” হুঁ।”
সবে কফির মগে চুমুক দিয়েছিল নীরব। ওদের এমন কথোপকথনে গলায় বেষম লাগে তার। নীরবের খুকখুক কাশিতে প্রত্যাশার টনক নড়ে। ও ঝড়ো বেগে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” এই না না..আমি তা বলিনি।”
আবির হাসতেই নীরব চোখ পাকিয়ে তাকাল। নীরবের এক দৃষ্টিতেই বেচার হাসি ফিউজ হয়ে গেল। প্রত্যাশা লজ্জা পেয়ে অ্যালবাম রেখে ত্রস্ত উঠে গেল।

ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর ছুঁইছুঁই। ইচ্ছে নীহারিকার কাছে শুয়েছে। নীরব সোফায় বসে ল্যাপটপে মেইল চেক করে ফোনটা ওপেন করতেই হটস অ্যাপের নোটিফিকেশন নজরে এল। অ্যাপে ঢুকে মেসেজে ফটো এর নোটিফিকেশন দেখে কৌতূহল নিয়ে চেক করতেই মেঘ বিনা বাজের মতো স্তব্ধ হলো নীরব। ভাষা হারিয়ে গেল, বিমূঢ়, বিমূর্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে রইল। বেশ কয়েকটা ছবি। প্রত্যাশা সার্থকের বুকের উপর, সার্থক চেইন ছড়াচ্ছে সেই দৃশ্যর ছবি, নীরবের মাথায় র’ক্ত চড়ে গেল। চোখদুটো বুঁজে নিল।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৬

প্রত্যাশা সবার সাথে গল্প-গুজব করে রুমে এসে নীরবকে অমন অসাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এগোল। ঠোঁট ফাঁক করে কিছু বলবে তার আগেই নীরব মুখে কিছুই না বলে সোজা ফোনটা প্রত্যাশার দিকে ধরল। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই গোটা আসমান যেনো প্রত্যাশার মাথার উপর পড়ল। বুকটা ছ্যাত করে উঠল। মূর্ছা যাওয়ার মতন হলো।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৮