কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৪

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৪
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

তুশির মাথাটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। সদ্য পৃথিবী চিনতে থাকা শিশুর মতো মেয়েটা নিস্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল শুধু। তুরন্ত, ক্ষিপ্ত বাঘিনীর ন্যায় ওপাশ হতে ছুটে এলো আইরিন। সবার সামনে দিয়ে এক উন্মাদ পশুর মতো হামলা করল ওর ওপর। গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে সজোরে এক চড় মারতেই, অপ্রস্তুতিতে ছিটকে গিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল তুশি। হকচকাল প্রত্যেকে। ইউশা আর্তনাদ করে ওঠে,

“ তুশি!”
পরপর, ঝোড়ো বাতাসের মতোন দৌড়ে গেল সে। তুশি স্তব্ধ,বিমুঢ়। বিস্ময়াহতের ন্যায় চাইল ফিরে। আইরিন হিঁসহিঁস করছে। চোখেমুখে জ্বলন্ত গরিমা। ফের এগোতে নিলেই,হাতটা চেপে ধরল অয়ন। ধমকে বলল,
“ তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? মারলি কেন ওকে?”
আইরিন পালটা চ্যাঁচিয়ে উঠল,
“ বেশ করেছি মেরে। কেন মারব না? তখন সবার সামনে ও কি বলল শোনোনি? গয়না না পাওয়া গেলে ও আমাকে মারবে। আর এখন গয়না পাওয়া গেছে, তাই হিসেব মিলিয়ে নিতে এবার আমি ওকে মারলাম।”
তনিমা বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আইরিন,আমরা বড়োরা কেউ এখনও মরে যাইনি যে তোমাকে হিসেব মেলাতে হবে। তুশি যাই করুক, ও ইয়াসিরের বউ। কিছু করার আগে এটুকু অন্তত মাথায় রাখবে।”
রেহনূমা এগিয়ে এসে বললেন,
“ আপা, তুমি এখনো এসব বলছো? এই যে দেখো মায়ের হার। দেখতে পাচ্ছো,ঝুলছে আমার হাতে! এটা তুশির বিছানার নিচ থেকে পেয়েছি। অথচ একটু আগে এই মেয়ে কত বড়ো বড়ো কথা বলল সবার সামনে। আইরিন তো ভুল কিছু করেনি। আমাদের বাড়ির মেয়েকে মারবে বললে,আমরা কি কাউকে ছেড়ে দেবো নাকি!”
তনিমার কথা হারিয়ে গেল। কার হয়েই বা বলবেন? তুশি তো সেই পথ খোলা রাখেনি। তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না,সত্যিই এরকম কিছু ঘটেছে। আর্ত নজরে তুশির দিকে ফিরলেন তনিমা। দুই ঠোঁট ফাঁকা করে মেয়েটা হাঁ করে চেয়ে। যে অপরাধ ও করল,তারপরেও এই বিস্ময় কীসের?
ইউশা উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,

“ তুশি, ব্যথা লেগেছে তোমার? ওঠো,আমার হাতটা ধরে ওঠো।”
অমনি খ্যাক করে উঠলেন রেহনূমা,
“ খবরদার ইউশা, তুই ওই চোর মেয়েকে ছুঁবি না। সরে আয় ওর থেকে,সরে আয়।”
“ মা আমি…”
মেয়েটাকে পুরো কথা বলতে দেয়া হলো না। পূর্বেই হনহন করে এসে টেনে নিলেন রমনী। তুশি তখনও বিমূর্ত বনে রইল।
কী থেকে কী ঘটেছে ও কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। শওকত বসে পড়লেন চেয়ারে। জয়নব দুপাশে মাথা নেড়ে বললেন,
“ ছি, ছি ছি! ছিহ!”
তুশির শরীরে কথাটুকু কাঁটা হয়ে বিঁধল। মনে হলো, ছি-টা ওকেই বললেন বৃদ্ধা। হ্যাঁ ওকেই। ফের কানে এলো জয়নবের আওয়াজ। নিরাশ কণ্ঠে বলছেন,
“ শেষমেশ বাড়ির বউই বাড়ির গয়না চুরি করল!”

নৈসর্গিক দিনের ফকফকে আলো,আকাশের বুকে ছুটে বেড়ানো পাখি, কিংবা, তরুর ডগায় বসে থাকা রোদের ধারে ভীষণ চপলতা আজ। সব কিছু স্বাভাবিক, সুন্দর। তবে সৈয়দ নিবাস! তার কোল জুড়ে বসেছে এক আশ্চর্য নীরবতা। বসবার ঘরে মানুষের কমতি নেই। সাইফুল,ইয়াসির বাদে প্রত্যেকেই উপস্থিত। অথচ কারো মুখে কথা নেই। বিস্ময়, হতাশায় নিস্তেজ দৃষ্টিগুলো শুধু লেগে গেছে মেঝেতে। সকলের নিঃশ্বাসের এক থমথমে ভার ছড়িয়েছে হাওয়ায়। যেন এই ঘর, এই মানুষগুলো,এই মূহুর্তটা জমে গেছে অদৃশ্য এক শূন্যতার জালে। টেলিফোনে কথা বলছেন রেহনূমা। সংযোগ গিয়ে ঠেকেছে সুদূর ইয়াসিরের থানায় থাকা ল্যান্ডফোনের লাইনে। ছেলেটাকে এক্ষুনি বাড়িতে আসার তলব পাঠিয়েছেন তিনি। এতবার জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে, উত্তরই দিলেন না।

শওকত মাথা নুইয়ে বসে আছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে অয়ন। আশাহত,নির্বাক তারা। তনিমার চেহারায় মেঘের অন্ধকার কেবল ছুটে ছুটে ঘুরছে। বারবার চোখ মুছছে ইউশা। এমন পিনপতন নীরবতার মাঝে তার মৃদূ ফ্যাচফ্যাচে কান্নাটা শোনা যাচ্ছে অল্প। অথচ তুশি! ওর চোখে জল নেই। তবে ধুধু মরুতে কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে? ঠিক সেই ভাবে অদূরের কোথাও একটা দেখছে সে।
মিন্তু চুপ করে বসে আছে। বড়োদের মাঝে তার বলার কিছু নেই। রেহনূমা যে কোনো সময়েই ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। জয়নবও একরকম নিশ্চুপ। রেহনূমা কথা শেষ করে আইরিনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ঘোষণা করলেন সবার উদ্দেশ্যে,

“ সার্থ আসছে। এই মেয়ের ব্যবস্থা ওই এসে করুক। এমন চোর মেয়েকে বাড়িতে আর একটা দিনও রাখা ঠিক হবে না আপা। আমি অন্তত আর চাইছি না সেটা।”
তনিমা নিরুত্তর। একটু এক্সায,আ,ও,,হুঁ-হাও করলেন না। আইরিন আড়চোখে তুশির দিকে চাইল। মেঝেতে দু পা ভাঁজ করে বসে আছে মেয়েটা। সেই থেকে এই একইরকম বসে। ফরসা,সুন্দর মুখখানা কী করুণ,কী ফ্যাকাশে! এত নিঃসহায়,এতটা দূরাবস্থা তো বস্তির তুশির কোনোদিন ছিল না। আইরিন ঠোঁট টিপে ক্রুর হাসি হাসল। পরপর সেই হাসি মিলিয়ে নিলো রুক্ষতায়। গলা ঝেড়ে বলল,

“ আমি তো আগেই বলেছিলাম,এই মেয়ে সুবিধের নয়। একটু আগ পর্যন্তও কেউ আমাকে বিশ্বাস করছিলে না। এখন মিলল তো? হোলো তো প্রমাণ? কী ইউশা,কিছু বলবে না এখন!” ইউশা চিবুক নামিয়ে রাখল বুকে। ওর কাছে উত্তর নেই। চোখ সহ,মনটাও টলমল করছে বিষাদে। যে মেয়েটাকে শুরু থেকে ও বোনের মতো ভালোবাসল,বন্ধুর মতো আগলে রাখল,সেই তুশি পারল এমন করতে? পারল ওর বিশ্বাস নিয়ে খেলতে? কতবার বারণ করেছিল,বাড়ির জিনিসে হাত না দিতে। কতবার সাবধান করেছিলে। অথচ তুশি ওর এই সামান্য কথাটুকুর এক ফোঁটা দামও দিলো না!
তনিমা বললেন,

“ তুশি! আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করতাম,হয়ত তুমি নিজেও তা জানতে। সার্থ না চাইলেও,ওর বউ হিসেবে তোমাকে আমি মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম,একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আফসোস,সব তো দূর,তুমি নিজেই ঠিক হোলে না। বরং প্রমাণ করে দিলে,চোরের মন গহীন জঙ্গলের মতো হয়। সেই জঙ্গল চাইলেও কেটেকুটে সাফ করা যায় না।”
তুশি মাথা তুলে চাইল। বিষবাক্যের এক ঝটকা আঘাতে নীল হলো সারামুখ। আর্দ্র,ব্যাকুল স্বরে বলল,
“ বিশ্বাস করুন,আমি চুরি করিনি। আমি সত্যিই চুরি করিনি।”
রেহনূমা খ্যাকিয়ে উঠলেন,
“ চুরি করোনি তাহলে হারটা তোমার বিছানার নিচে গেল কী করে? উড়ে উড়ে?”
তুশির নিস্পন্দ জবাব,
“ আমি জানি না।”
আইরিন টেনে টেনে বলল,

“ বাহ,কী সুন্দর কথা! উনি জানেন না। সব চোরের মুখেই একই কথা থাকে, মামি। কেউই নিজেদের অন্যায় স্বীকার করতে রাজি নয়। আগেও যেমন ছিল,এখনোও তাই। কয়লা ধুলে কি আর ময়লা যায়!”
ইউশা আর নিতে পারল না। প্রতিবাদ করল রিনরিনে স্বরে,
“ আপু তুমি চুপ করো। মা তো বললেন,ভাইয়া আসছেন। ভাইয়া এসে যা করার করবে। তুমি ওকে এত কথা শোনাচ্ছো কেন? ও তো আর তোমার গয়না নেয়নি।”
রেহনূমা ফুঁসে উঠলেন সহসা,

“ তুই চুপ কর। তোকে এখানে কথা বলতে কে বলেছে? আইরিন তো ভুল কিছু বলেনি। আমি আপাকে প্রথম দিন থেকে বলছিলাম,মেয়েটাকে এত লাই দিও না। সে তো আমার কথা শোনেইনি,সাথে ভাইজানও এই বস্তির মেয়েকে নিজের মেয়ে বানিয়ে ফেলেছিলেন। আরে বাবা, মানুষের একটা বংশ,কর্মেরও ব্যাপার আছে। এমন নচ্ছার মেয়ে মানুষ ঘরের বউ মানে,নিজেদের মাথায় কালো কাপড় বাঁধা। যার মধ্যে আচার-ব্যবহারের বালাই নেই। না আছে ভদ্রতা-সভ্যতা। এসব চোর কি কখনো ঘরের লক্ষ্মী হয়?”
তুশি চোখ খিচে নিলো। ঢোক গিলল সাথে। গলার ভেতর কিছু একটা দলা পাঁকিয়ে ঘুরছে। ফুটন্ত লাভার মতো তপ্ত তার আঁচ। কেমন অসহ্যকর অনুভূতি এটা! আচ্ছা,ও তো ছোটোবেলা থেকেই মানুষের কটু কথা শুনে বড়ো হয়েছে। কত মানুষের মারধরও খেয়েছে! কখনো তো এমন কষ্ট হয়নি। ভেতরটা ছিঁড়ে নেয়ার মতো এই বিশ্রী অনুভব একদমই নতুন। এমন ছটফট লাগছে কেন হঠাৎ? সদ্য জবাই করা পশু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যেমন করে,তেমন লাগছে নিজেকে।

অয়নের দুচোখে মায়ার শ্রাবণ। নীরস চোখে তুশির মুখপানে চেয়ে রইল সে। বোকা মেয়েটা এত বড়ো একটা ভুল কি না করলেই পারতো না? এখন ওকে কী করে বাঁচাবে সে! এত এত খারাপ কথার তির থেকে কীভাবে উদ্ধার করবে? ধীরেসুস্থে মুখ খুলল সে। বলল,
“ আচ্ছা দিদুন, তুমি তো বলেছিলে এই হার বংশের প্রথম নাতির বউয়ের জন্যে রাখা। সেই হিসেব করলে ভাইয়াই এখন বড়ো ছেলে। আর তুশি এখনো ভাইয়ার বর্তমান স্ত্রী। তাহলে হার তো ওরই পাওয়ার কথা। ওর হার ও নিয়েছে,ব্যাস। সেটাকে চুরি না বলে, সাধারণ ভাবে দেখতে পারছো না কেন তোমরা?”
“ কী বলছো তুমি দাদুভাই! একটা হার সম্মানের সাথে অর্জন করে নেয়া,আর চুরি করে বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখা কি এক হলো? হ্যাঁ হিসেব করলে হার ওর প্রাপ্য হতো। কিন্তু সেটা তখনই,যখন ওদের সম্পর্ক আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো সহজ হবে। এভাবে আমার ঘরে লুকিয়ে ঢুকে,বাক্স হাতিয়ে গয়না নিয়ে আসাকে তুমি সাপোর্ট করছো দাদুভাই? তোমার থেকে আমি এসব আশা করিনি।”

অয়ন ফোস করে শ্বাস ফেলল। সে নিজেই নিজের থেকে এসব আশা করে না। এমন অযৌক্তিক,বোকা বোকা কথা! কিন্তু কী করবে? এই মূহুর্তে ওর নিজেকে কেমন উপায়হীন লাগছে কাউকে বোঝাতে পারবে কখনো? তুশির হাস্যোজ্জ্বল মুখখানার এই নিভন্ত প্রদীপের ন্যায় দশা সহ্য হচ্ছে না অয়নের। জিভে ঠোঁট চুবিয়ে কথা খুঁজল অয়ন। বলল ফের,
“ দিদুন,তুশির বয়স কম। ও এখনো জগতের ভালোমন্দ ঠিক করে বোঝে না। এত বছর ধরে ও একটা পেশায় ছিল,হোক সেটা চুরি বা অন্যকিছু। মাত্র এক-দুমাস আমাদের বাড়িতে থেকেই তো আর সেই অভ্যাসের বদল হয়ে যাবে না। হয়ত ভুল করে লোভের বশে গয়না সরিয়ে ফেলে…”
অমনি প্রতিবাদ করে উঠল তুশি,
“ নাআয়া,আমি গয়না নিইনি। আপনারা কেন বিশ্বাস করছেন না বলুন তো! আমি সত্যিই কিছু জানি না।”
অয়নের কণ্ঠ কোমল,

“ তুশি রিল্যাক্স। আমি কথা বলছি তো। দ্যাখো,আমার বাড়ির লোক কেউ খারাপ নয়। তারা অত্যন্ত ভালো মানুষ। তুমি ভুলটা স্বীকার করে,ক্ষমা চাও। সবাই ঠিক ক্ষমা করে দেবে।”
ইউশা সবেগে মাথা ঝাঁকাল। তারও একই কথা।
অথচ তুশি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“ কীসের ভুল? স্বীকার করার প্রশ্নই বা আসছে কেন? যে কাজ আমি করিইনি, তার জন্যে কেন ক্ষমা চাইব?”
রেহনূমা তাজ্জব কণ্ঠে বললেন,
“ দেখেছিস, চোরের মায়ের কত বড়ো গলা দেখেছিস ,অয়ন? এবার দ্যাখ ভালো করে। আমি নিজে ওর বিছানা থেকে এটা বের করলাম,আর ও নাকি চুরি করেনি। অনেক হয়েছে,আমি বুঝে গেছি এই মেয়ে স্বীকার করবে না। আচ্ছা ভাইজান,আপনি চুপ করে আছেন কেন? আপনি অন্তত এই মেয়েকে কিছু বলুন। নাকি এখনো আপনার এর থেকে দরদ কমেনি!”

শওকত যেমন বসেছিলেন,তেমনই বসে রইলেন। তুশি এবার নড়েচড়ে উঠল। জীবনে প্রথম একটা মানুষকে ও বাবা ডেকেছে। তার মুখ থেকে মায়ের মতো আদুরে সম্বোধন শুনেছে। সেই মানুষ ওর জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা স্বয়ং স্রষ্টা জানেন। মূহুর্তে উঠেই ভদ্রলোকের কাছে ছুটে গেল তুশি। হুড়মুড়িয়ে বসল পায়ের কাছে। কণ্ঠে ব্যাকুলতা,
“ বাবা,বিশ্বাস করুন, আপনি অন্তত বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি আমি সত্যিই কিছু করিনি।”
শওকত মাথা তুললেন না। তুশির হাতটা ওনার উরুর ওপর ছিল। নিঃশব্দে সেটা হটিয়ে দিয়ে,মুখ ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। মেয়েটা স্তব্ধ হলো আরেকবার। ভদ্রলোক বোজা স্বরে বললেন,

“ আমি বরাবর আমার ভালোবাসা ভুল পাত্রে দান করে এসেছি। তুই সেটা আরেকবার প্রমাণ করলি, তুশি। তোকে আমি মেয়ের জায়গা দিয়েছিলাম। স্নেহ করেছিলাম। মা ডেকেছিলাম,কিন্তু তুই! একটা গয়নার জন্যে আমাদের সবার আবেগ,ভালোবাসাকে এত নিচে নামিয়ে ফেললি?”
তুশি স্তম্ভিতের ন্যায় আওড়াল,

“ বাবা!”
“ ডাকিস না, ডাকিস না। এসব নামে আর ডাকিস না আমাকে। আমার মেয়ে আর যাই হোক,চোর হবে না।”
তুশির ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে গেল। পাঁজর খাবলে নেয়ার মতো টান পড়ল বুকে। শুকনো চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মেয়েটা। চোর তুশি,পকেটমার তুশি এসব ডাক তো ওর কাছে ডালভাতের মতো। তাহলে, তাহলে আজ এত কষ্ট হচ্ছে কেন? কেন ও এসব কথা মেনে নিতে পারছে না? তুশির বিধ্বস্ত চেহারা দেখে খারাপ লাগল ইউশার! মায়ের ভয় দূরে ঠেলে,এসে কাঁধে হাত রাখল ওর। অবসন্ন চোখ তুলে চাইল তুশি। ইউশাকে দেখেই,ধড়ফড়িয়ে দাঁড়াল আবার। গড়গড়িয়ে বলল,

“ ইউশা,তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করো। কেউ কেন আমার কথা শুনছে না বলো তো। আমি সত্যিই হারটা নিইনি। আমি..” ইউশা বাম হাত তুলে গাল ছুঁলো ওর। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ অপরাধ করলে, সেটা স্বীকার করতে হয় তুশি। তাতে কেউ ছোটো হয়ে যায় না। তুমি স্বীকার করে নাও, দেখবে সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে।”
তুশি মর্মাহত! নিভন্ত স্বরে বলল,
“ তুমিও!”

তারপর ইউশার মুঠো থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো সে। সবার মুখের দিকে ঘুরে ঘুরে দেখল এক পল। প্রত্যেকের চোখে অবিশ্বাস। কারো চোখে ঘৃণা। এমনকি মিন্তুর মতো একটা বাচ্চা ছেলেও কেমন অদ্ভুত নয়নে দেখছে। চোখাচোখি হতেই, মাথা নুইয়ে নিলো সেও। অথচ কিছুদিন আগেই কেমন কাছে ছুটে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কত অমায়িক হেসে বলেছিল,
“ আপু এসো,তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।” তুশি আরেকদফা আহত হলো। বক্ষপট বেদনায় নিঃশেষ।
রেহনূমা অধৈর্য চিত্তে বললেন,

“ আপা, ভাইজান আজকে আমি একটা কথা বলে দিচ্ছি, সার্থ এসে কী করবে আমি জানি না, তবে এই চোর মেয়ে এ বাড়িতে থাকলে আমি কিন্তু আর এক মূহুর্তও থাকব না বলে দিলাম।এসব অপয়া-অলক্ষ্মী মেয়েমানুষ সংসার থেকে যত দ্রুত বিদেয় করা যায় তত ভালো। এই মেয়ে আমাদের কপালে কালো ছায়া হয়ে এসেছে। তোমাদের এত ভালোবাসা,আহ্লাদের পরেও যে চুরি করতে পারে,সে সব পারবে। আজ গয়না সরিয়েছে,কাল টাকাপয়সা সরাবে। আস্তে আস্তে রাস্তার ফকির বানিয়ে ছাড়বে আমাদের।”
আইরিন সুর মিলিয়ে বলল,

“ ঠিক তাই। ভাইয়া আসুক, একেবারে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে বলবে।”
তুশির অন্তঃপট দ্বিখণ্ডিত। মানুষের কথায়ও এত বিষ,এত যন্ত্রণা থাকে? এর ঘা তো শখানেক ছুড়ির কোপের চেয়েও ধারালো। মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে পেছনে সরে যায়। দূর্বলের ন্যায় পিঠটা হেলে পড়ে দেওয়ালে। দৃষ্টি শক্ত, শূন্য। অথচ তার কানায় কানায় শোক,দুঃখ আর দূর্বলতা। এতটা নিরূপায় নিজেকে ওর কোনোদিন লাগেনি। এখন কীভাবে প্রমাণ করবে এসব? কীভাবে বোঝাবে সবাইকে! চুরি করতে গিয়ে পুলিশর ধাওয়া তুশি বহুবার খেয়েছে। কত মানুষের গালি শুনেছে অকথ্য ভাষার। কখনো এমন করে বুক ছিন্নভিন্ন হয়নি। কখনো গলার ভেতর সুনামি আসতে চায়নি। তাহলে আজ,আজ এমন কেন হচ্ছে আল্লাহ? এই যন্ত্রণা আসলে কীসের? মেয়েটা দেওয়াল ঘেঁষে ধপ করে বসে পড়ল মেঝেয়ে। অয়ন এগোতে নিয়েও থামল। ব্যর্থ শ্বাস ঝাড়ল ঠোঁট ফুলিয়ে।
তুশি বিড়বিড় করে বলল,

“ আমি চুরি করিনি। কিছু করিনি আমি। কিছু না।”
ইউশা ওড়না তুলে ভেজা চোখ মুছল। আইরিন ভেংচি কেটে বলল,
“ নাটক!”
জয়নব অতীষ্ঠ গলায় বললেন,
“ আমার আর এসব ভালো লাগছে না। বড়ো বউ মা,আমাকে ঘরে দিয়ে এসো। আমি আর নিতে পারব না এসব। তোমরা যা করার করো,আমি এখানে আর একদণ্ডও থাকতে চাই না।”
আইরিন বলল,

“ কেন নানু,ঘরে কেন যাবে? ভাইয়া এসে এই চোরের কী করে দেখবে না? তোমার হার,তুমি না থাকলে চলে! অন্যায়টা তো তোমার সাথেই হয়েছে। আজ আসুক ভাইয়া একবার। এমন শাস্তি দেবে, চোরটা হাড়েহাড়ে বুঝবে পুলিশের বাড়িতে হাত সাফাইয়ের মজা কী!”
তুশি উদাস চোখে মেঝের দিকে চেয়ে রইল। একইরকম বিড়বিড় করল,
“ আমি চুরি করিনি। কিছু করিনি আমি। আমি কিছু জানি না।”

ঠিক সেই সময় তার বা পাশে এক জোড়া বুট পরা পা এসে দাঁড়াল। বক্ষপটে নিদারুণ উত্তালতায়,তুশির বোধগম্য হলো তার প্রিয় কেউ এসেছে। হাওয়ায় ছুটে আসা পুরুষালি সুঘ্রাণ পেতেই, নিষ্প্রভ চোখ তুলে চাইল সে। ইউনিফর্ম গায়ে জড়ানো ইয়াসিরকে দেখে নিরুত্তাপ তরুণী, নিস্তেজ হলো আরো। এবার কী ঘটবে তুশি জানে। বাকি সবার মতো ইয়াসিরও ভুল বুঝবে ওক। অবশ্য বুঝবে নাই বা কেন? উঠতে-বসতে, প্রতি কথায় কথায় যে ওকে কখনো চোর ছাড়া সম্বোধন করেনি, তার কাছে এসব ভরসা,আস্থা কিছু আশা করা যায়? যে ইউশা সারাক্ষণ ছাঁয়ার মতো ওর পাশে রইল,যে তনিমা এমন মায়ের মতো আদর করল ওকে,তারা সবাইতো মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। সেখানে ইয়াসির ওকে বুঝবে এমন প্রত্যাশা করাও বোকামি! নিষ্ঠুর সত্যি হলো, এত বড়ো পৃথিবীতে তুশিকে বিশ্বাস করার কেউ নেই। গরিবদের কেউ কখনো বিশ্বাস করে? মেয়েটাকে এমন এলোমেলো বসে থাকতে দেখে ভ্রু গোছাল ইয়াসির। বাকিদের থমথমে, বিরস মুখগুলোও দেখল একবার। রেহনূমা ফোন করে বলেছিলেন, “তাড়াতাড়ি বাসায় আয়৷ খুব জরুরি!” কেন,কী সেসব কিছু বলেননি। অস্থির চিত্তে সারাপথ পাড়ি শেষে মাত্রই পৌঁছাল সে। ইয়াসির আবার মাথানত তুশির দিকে চাইল। এভাবে বসে আছে কেন মেয়েটা? তারপর নজরে পড়ল ইউশার টলমলে চোখ। কৌতূহল গাঢ় হলো এবার। প্রশ্ন ছুড়ল তৎক্ষনাৎ,

“ কী হচ্ছে এখানে?”
তনিমা ফোস করে শ্বাস ফেললেন। চেহারার আমাবস্যা ঠেলে টা-টু করলেন না তবে। শওকতও চুপ। কিন্তু আইরিন মুখ খুলল সবেগে,
“ এই মেয়েটা নানুর সীতাহার চুরি করেছে, ভাইয়া। ওর ঘর থেকে সেই হার ছোটো মামি বের করেছে। কী ছোটো মামি,বলো!”
রেহনূমা সজোরে মাথা নাড়লেন। উত্তর, হ্যাঁ। ইয়াসির হতবাক,বিস্মিত। আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার মতো করে চাইল তুশির পানে। মেয়েটার খোলা চুল এলোমেলো। পিঠসহ মুখখানাও ঢেকে গেছে তাতে। প্রচণ্ড রাগে ইয়াসিরের রক্ত টগবগিয়ে উঠল। এত কিছুর পরেও মেয়েটা শুধরালো না?
জয়নব বললেন,
“ দাদুভাই! ওকে এই বাড়িতে তুমি এনেছিলে। আশায় ছিলাম, একদিন তোমাদের মিলমিশ হবে। সেই মোতাবেক আমি, বড়ো বউ মা,দুজনেই যথেষ্ট স্নেহ করেছি ওকে। কিন্তু তুমিই বলো,ও আজ যে কাজটা করল এটা কি ঠিক হয়েছে? শত হলেও তোমাদের বিয়েটা মিথ্যে নয়। বাড়ির বউ হয়েই,বাড়ির গয়না চুরি করল? এত কিছুর পরে কি আমি কখনো মেয়েটাকে আমার নাতবউ হিসেবে মেনে নিতে পারব!”
রেহনূমা বললেন,

“ সার্থ,তোকে আমি আগেই বলেছিলাম মেয়ে ভালো নয়। তাও ওকে এনে শিক্ষা দেয়ার নাম করে বাড়িতে রেখে দিলি। কিন্তু কী হলো? স্কুলে ভর্তি করালি,পড়াশোনাও করাচ্ছিস। এসব কেমন শিক্ষা? আর কী লাভ হলো এতে? এসব মেয়েরা কি ভালো কিছু শেখার যোগ্য নাকি? জন্ম থেকে তৈরি হওয়া চোর-ছ্যাচড় কি কখনো ভালো মানুষ হতে পারে? দ্যাখ বাবা,তোর সম্মানে আমরা এখনো ওকে কিছু করিনি। দয়া করে এবার একে বিদেয় কর। অনেক শিক্ষা দিয়েছিস, আর না। এই অশান্তি থেকে এবার মুক্তি দে আমাদের।” বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে, বিজয়ি হাসল আইরিন। তার ভেতরটা উত্তেজনায় চৌচির। তুশি বিদেয় হোক, শুধু একবার বিদেয় হোক। অথচ ইউশা ফুঁপিয়ে উঠল। চোখের থইথই জলটা বেড়ে এলো, তুশিকে বের করে দেওয়ার কথা শুনে। কিন্তু কী করবে ও! ওর কথা তো কেউ শুনবেও না। তক্ষুনি বিরোধাভাস করে উঠল অয়ন,

“ ছোটো মা,এভাবে কেন বলছো? ও নাহয় একটা ভুল করেই ফেলেছে, তাই বলে বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে?”
রেহনূমা অবাক চোখে বললেন,
“ তুই এখনো ওর হয়ে কথা বলছিস, অয়ন?”
“ হ্যাঁ বলছি। কারণ ভুল মানুষ মাত্রই হয়। তুশিও একটা ভুল করে ফেলেছে। ও যে পরিবেশে মানুষ হয়েছে, সেখান থেকে এসে এসব দামি দামি জিনিস দেখলে এরকম একটু-আধটু এলোমেলো যে কেউ হয়ে যাবে। তাই বলে বাড়ি থেকে বের করার তো কোনো কারণ দেখছি না। এই একটা অপরাধের জন্যে,ওর ভালোটা কেন ভুলে যাচ্ছো সবাই? বাবা যে আজ এখানে সুস্থ ভাবে বসে আছেন,এর জন্যে তুশির অবদান কিন্তু কিছু কম নেই। এসবের জন্যে হলেও ওকে একটা সুযোগ অন্তত দিতে পারি আমরা। ”

আইরিন বলল,
“ সুযোগ দিয়ে কী হবে ভাইয়া? ও শুধরে যাবে? কুকুরের লেজ কখনো সোজা হতে শুনেছ? ও চোর ছিল,চোরই থাকবে। এসব থার্ডক্লাশদের ওপর এত আবেগ-টাবেগ দেখিও না। ছোটো মামি যা বলছেন তাই করা উচিত। তাই না ভাইয়া?”
শেষটুকু ইয়াসিরের দিক চেয়ে বলল সে। বুঝতে চাইল ওর অভিব্যক্তি৷ সে মানুষ থম মেরে দাঁড়িয়ে। দূর্বোধ্য চেহারায়, ললাটের নীল শিরা ফুঁসছে। বক্ষপটে জোরালো শ্বাস। রাগ-ক্ষোভের পুরোটা তুশির ওপর ঠিকড়ে দিতে,মেয়েটার কনুই টান মেরে দাঁড় করাল ইয়াসির। আতঙ্কে থরথর করে উঠল তুশি। ইয়াসির ক্রুদ্ধ। ক্ষুব্ধতায় কিছু বলতে যাবে,নজর পড়ল তুশির দুটো কাতর চোখে। অপমান আর কষ্টের ছুরিকাখাতে প্রহৃত তা।
সিক্ত স্বরে সেই একই কথা মৃদূ শব্দে আওড়াল,

“ আমি চুরি করিনি।”
ইয়াসির থমকায়। নিভে যায় তার তপ্ত চোখ। ফেঁপে থাকা কপালে দুটো ভাঁজ বসে অচিরে। তুশি ফের ভেজা গলায় বলল,
“ আমি জানি না গয়না আমার ঘরে কী করে এলো! আমি সত্যিই চুরি করিনি, সার!”
ওপাশ থেকে তেতে উঠলেন রেহনূমা,
“ নাটক বন্ধ করো,মেয়ে। নাহলে তোমাকে যে আমি কী করব নিজেই জানি না। তোমার বিছানার নিচ থেকে গয়না আমি নিজে বের করলাম, আর তুমি বলছো চুরি করোনি? তুমি চুরি না করলে কী আমরা গিয়ে তোমার ঘরে গয়না রেখে দিয়ে এসেছি?”
আইরিন কটমটিয়ে বলল,

“ মনে হয় আমার একটা থাপ্পড়ে ওর শিক্ষা হয়নি। আরেকটা খেতে চাইছে।”
ইয়াসির ফিরে চাইল তড়িৎ। চোখ ছোট করে বলল,
“ তুমি ওর গায়ে হাত তুলেছ?”
আইরিনের কথায় তেজ,
“ তো কী করব? আপনি জানেন ও আমাকে কী বলেছে,বলেছে যদি ওর ঘরে গয়না না পাওয়া যায়,তাহলে নাকি মেরে আমার মুখ থেতলে দেবে। ওর কত্ত বড়ো সাহস ভাবতে পারছেন! বস্তির একটা কীট! ওকি না আমাকে মারার কথা বলে? আমাকে!”

ইয়াসির ঠান্ডা চোখে চেয়ে রইল দু সেকেন্ড। তারপর ফিরল তুশির দিকে। করুণ চেহারায় মাথা নুইয়ে নিলো মেয়েটা। আচমকা
শক্ত করে ধরা পেলব কনুইটা ছেড়ে দিলো ইয়াসির। থুতনিতে হাত ঘষল বিক্ষিপ্ত ভাবে। আইরিনের ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে। ইয়াসির চুপ কেন? উতলা হয়ে বলল,
“ ভাইয়া, আপনি আর কী শোনার অপেক্ষা করছেন? সব তো আপনার সামনে পরিষ্কার হয়েই গেল। তাহলে এখন এই মেয়েকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিন না!”
হিমশীতল নয়ন ঘুরিয়ে চাইল ইয়াসির। চোখের তীক্ষ্ণ ভাষায়,পোক্ত চিবুক। উত্তর ছুড়ল সুস্থির,

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৩

“ তুশি চুরি করেনি।”
তুরন্ত মাথা তুলল তুশি। অবিশ্বাস তার দৃষ্টিতে। মুখায়বে বিস্ময়। ঠোঁট জোড়া আপনা-আপনি দুই প্রান্তে গিয়ে বসল৷ মূঢ়তায় কেমন ঝাঁঝিয়ে এলো কান। ঠিক শুনল ও? ইয়াসির ওকে বিশ্বাস করেছে,সত্যিই করেছে?

কাছে আসার মৌসুম পর্ব ২৫