মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩১ (২)
মির্জা সূচনা
একটা বিকট শব্দ।
এক মুহূর্তে দু’জনেই চমকে ওঠে।
রিদ যেনো স্বভাবতই সজাগ হয়ে ওঠে, মাথা ঘুরিয়ে তাকায় শব্দের উৎসে।
মেহরিন চোখে ভয় মিশ্রিত বিস্ময় নিয়ে রিদের দিকে তাকিয়ে বলে—
এই শব্দটা… কিসের?
রিদ মুখ শক্ত করে ফেলে।
একটা অজানা আশঙ্কা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে চায় না।
ছাদের পাশ ঘেঁষে বড় একটা ফুলের টব পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।
টবের পাশেই মাটির গায়ে গুলির দাগ।
আর একটু এদিক-ওদিক হলেই জীবন কেড়ে নিত ওই নির্লিপ্ত গুলি।
রিদ আগেই এগিয়ে যায়।
চোখ ছানাবড়া। আশপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ নেই।
শুধু থমকে যাওয়া একটা সন্ধ্যা।
সে চোখ সরিয়ে মাটির দাগ দেখে।
এটা… এটা কে করলো? এমনটা কীভাবে হলো?কণ্ঠে ক্ষোভ নয়, ভয় আর বিস্ময়ের মিশেল।
মেহরিন ধীরে এগিয়ে এসে বলে—
চলুন রিদ ভাইয়া.. আমরা নিচে যাই। এখানে থাকা নিরাপদ না।
রিদ কিছুক্ষণ চুপ।
তারপর মুচকি হেসে বলে—
আমাদের বিয়েটা হতে চলেছে, আর তুমি এখনো আমায় ভাইয়া বলছো? ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার তো!
মেহরিন থমকে যায়। চোখে লজ্জা-মিশ্রিত মনে মনে বলে,
হ্যাঁ, ঠিকই তো…
আর মাত্র দু’দিন পর যাকে জীবনসঙ্গী বলবে, তাকে এখনো ভাই বলে ডেকে ফেলা—
একটা ছোট্ট হেসে নেয় সে।
তারপর বলে—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“চলুন নিচে।“
রিদ আর কিছু বলে না।
চুপচাপ ওর পাশে হাঁটতে থাকে।
নিচে নামতেই দেখে, বাড়িতে আবার বিয়ের আয়োজন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত— আর মাত্র পাঁচ দিন পর।
কিছুক্ষণ পর রিদ, শান্ত আর রাকিব আর বাড়ির সকলকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু রিদ কারো সাথে ছাদের ঘটনাটা ভাগ করে না।
সে জানে, বললে চারপাশটা চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে।
মেহরিন বারান্দায় বসে আছে একা নয়—
পাশে চুপচাপ মেহবুবা, চুমকি আর মাহির।
চুপচাপ একটা নীরবতা।
দুপুরের উৎসব যেনো একটু থেমে গেছে।
গুলিটা কে করলো?
মাহির চোখ তুলে তাকায় বারান্দার আলো-আঁধারিতে।
আর যদি একটু এদিক-ওদিক হতো… ভেবেছিস?
চুমকি আর মেহবুবাও মাথা নাড়ে।
কেউ কিছু স্পষ্ট বলতে পারে না, শুধু ভাবনায় ডুবে থাকে।
বাড়িতে সবাই আলাপ আলোচনা নিয়ে বেস্ত ছিলো আর মাহির বক্স বাজাছিলো তাই কেউ শুনেনি শব্দ টা কিন্তু মেহরিন ওদের জানিয়েছে শুধু।
মেহরিন চুপচাপ।
হঠাৎ বলে,
তোরা যা। ঘুমাবো আমি এই সব কথা এখন ভালো লাগছে না।
তিনজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
একটা বোবা ইশারায় মেহরিনকে আর বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
চুমকি হাসিমুখে বলে,
এই যে, সামনে তোর বিয়ে! এখন ঘুম না, এখন সেলিব্রেশনের সময়। আনন্দ কর, মজা কর।
মেহরিন কাঁধ ঝাঁকায়।
যা তো… তোদের যা খুশি কর।
তারপর মুখে একটুকরো কৃত্রিম হাসি।
চুমকি, মেহবুবা, মাহির চলে যায়।
ঠিক তখনই রিদের ফোন আসে।
মেহরিন ফোন হাতে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটা ধরে।
হ্যালো?
রিদের কণ্ঠ—
কি করছো?
কিছু না। আপনি কিছু বলবেন?
কাল আম্মু তোমাকে নিয়ে শপিং-এ যেতে বলছে। কখন ফ্রি হবে তুমি?
মেহরিন দ্বিধায় পড়ে যায়।
তারপর আস্তে বলে,
যখন আপনি বলবেন, আমি রেডি থাকবো।
“আচ্ছা,” রিদ ফোন কেটে দেয়।
মেহরিন ফোনটা রেখে দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে ফেলে।
মনে মনে বলে—
এই মানুষটাকে আমি কেন কষ্ট দেবো? উনি তো আমার কিছুই করেননি। আমি তো যাকে চেয়েছিলাম সে আমায় চায়নি, আর যাকে চাইনি, সে আমাকে চায়। এটাই কি নিয়ম পৃথিবীর?
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
হঠাৎ কী মনে করে ফোন তুলে একটা নাম্বারে কল দেয়—
“Madam” লেখা সেই নাম্বারে।
কবে আসবি তুই?
ওপাশ থেকে কিছু শোনা যায় না।
শুধু মেহরিন বলে,
আচ্ছা, ঠিক আছে।
তারপর ফোনটা কেটে রাখে।
চুমকি তখন আবার আসে।
মেহরিনের কাছে এসে ওর মুখটা দুই হাতে ধরে বলে—
তুই কষ্ট পাস না। এখন আর কিছু করার নেই। বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। হ্যাপি থাকার চেষ্টা কর।
মেহরিন চোখ বুজে চুমকিকে জড়িয়ে ধরে।
চুমকি মাথায় একটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে—
আল্লাহ যেটা করেন, ভালোর জন্যই করেন। তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী।
মেহরিন শুধু মাথা নাড়ে।
তারপর দুজনেই শুয়ে পড়ে।
পরদিন সকাল – শান্ত এক সূচনা
ফজরের নামাজ পড়ে মেহরিন বেরিয়ে যায় বাগানে।
শীতল ঘাসে জমা শিশিরের স্পর্শে মনটা এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরে যায়।
জুতা খুলে ঘাসে পা রাখে।
সেই ঠান্ডা ছোঁয়ায় মুখে একটা প্রশান্ত হাসি খেলে যায়।
চোখ বন্ধ করে ভাবে—
আমার রব যা করবেন, তাতেই আমার মঙ্গল আছে।
দুলনায় বসে দোল খেতে খেতে হেসে ওঠে।
ঠিক তখনই চুমকি এসে পাশে বসে।
দুজনে একসাথে দুল খায়, হাসে।
হঠাৎ চোখে পড়ে একটা নীল প্রজাপতি।
দুজনে তাকিয়ে দেখে সেটা উড়ে যাচ্ছে,
আর তারা দুজনে ছুটে চলে সেই প্রজাপতির পিছে।
হাসির ফোয়ারা, খুশির চিৎকার—
কেউ দেখছে না ওদের,
কিন্তু যে দেখছে, সে বুঝতে পারছে ওদের মুক্তির আনন্দ।
দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে দুজনেই।
ঘাসে শুয়ে পড়ে।
একটু হাপাচ্ছে, একটু হাসছে।
সেই মুহূর্তটা—
সত্যিই যেনো নতুন জীবনের সূচনা।
চুমকি, মেহু! তাড়াতাড়ি আসো, নাস্তা রেডি!
মালিহা মির্জার ডাক শুনে চুমকি আর মেহরিন ধীরে ধীরে উঠে পড়ে।
ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সবাই একসাথে নাস্তা করে নেয়।
বিকেল ৪টা।
মেহরিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো চুলটা ঠিক করে।
রিদ বলেছে ৪:২০-এ এসে নিয়ে যাবে।
মেহরিনের মুখে কোনো বাড়তি সাজ নেই, তবুও কেমন একটা লাগছে।
ঠিক ৪:২০ বাজতেই ফোন বাজে।
নিচে এসো।
রিদের গম্ভীর কণ্ঠ।
মেহরিন আস্তে বলে, “আচ্ছা, আসছি।”
নিচে এসে দেখে—
সাদা শার্ট, কালো প্যান্টে রিদ দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে।
চোখে সানগ্লাস, হাতে ঘড়ি, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
মেহরিনকে দেখেই সামনে বসার দরজাটা খুলে দেয়।
মেহরিন উঠে বসে।
রিদও ড্রাইভিং সিটে বসে বলল,
সিটবেল্ট লাগাও।
মেহরিন চুপচাপ বেল্ট লাগিয়ে নেয়।
গাড়ি ছুটে চলে শহরের রাস্তায়।
রিদ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সেটা বলে দিয়েছে আগেই।
তবুও মেহরিন শুধুই “হ্যাঁ” আর “না”-তে উত্তর দেয়।
রিদ আর কিছু বলে না। শুধু রাস্তার দিকে মনোযোগ রাখে।
শপিং মলের সামনে গাড়ি থামে।
দু’জনেই নামে।
রিদ কিছুটা এগিয়ে হাঁটে, মেহরিন পেছন পেছন।
মেহরিনের জন্য শাড়ি, জুয়েলারি, পছন্দের কসমেটিকস—সব কিছুতেই রিদ সাহায্য করে।
মেহরিন বেশি কিছু বলতে চায় না, তবুও কিছু কিছু জায়গায় রিদের মতামত নেয়।
রিদ শুধু চোখে চোখ রাখে, তারপর বলে—
তোমার পছন্দটাই আমার পছন্দ।
সবশেষে, রিদ বলে,
চলো, একটা রেস্টুরেন্টে যাই।
মেহরিন মুখ গম্ভীর করে বলল,
আমি যাবো না।
রিদ জোর করল না,
শুধু নরম গলায় বলল,
একটু বসলেই তো হয়। আজ সারাটা দিন তুমি হাঁটলে, একটু রেস্ট নাও।
শেষ পর্যন্ত রাজি হয় মেহরিন।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে দু’জনে এক কোণার টেবিলে বসে।
রিদ ওয়েটারকে বলে—
একটা চকলেট আইসক্রিম, আর একটা কোল্ড কফি।
মেহরিন চমকে তাকায়।
আপনি জানলেন কীভাবে আমি আইসক্রিম খেতে পছন্দ করি?
রিদ হেসে বলে,
তোমার মুখে আজ দুপুরে যখন আইসক্রিমের নাম শুনলাম, আর রাহি বলেছিলো।
মেহরিন চুপ হয়ে যায়।
কেউ তাকে এভাবে খেয়াল রাখে—এটা এতদিন বুঝেই উঠতে পারেনি মেহরিন।
রিদ কফিতে চুমুক দেয়,
মেহরিন আইসক্রিম খেতে খেতে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে।
পাশের রাস্তার ছায়া পড়ছে কাচে,
আর মনের ভিতরে যেনো এক অনুচ্চারিত প্রশ্ন বারবার ধাক্কা দেয়—
এই মানুষটাকে কী আমি ঠকাচ্ছি?একজনকে মনে রেখে আর একজনকে বিয়ে করতে চলেছি।
রেস্টুরেন্টের সেই নিরালায় দু’জনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ।
হঠাৎ রিদ বলে উঠল,
মেহু, একটা প্রশ্ন করব? সত্যি করে বলবে, প্লিজ।
হ্যাঁ, বলেন।— মেহরিন চমকে তাকায়।
এই বিয়েটা… সত্যিই কি নিজের ইচ্ছেতে করছো? কারো কথা ভেবে, নিজের মত করে?
রিদের গলা শান্ত, একেবারে নিঃশব্দের মতো।
মেহরিন চোখ নামিয়ে ফেলল কিছুক্ষণ।
তারপর ধীরে বলল,
হ্যাঁ, নিজেই করছি। জোর করে কিছু করছিনা।
রিদ কিছুক্ষণ চুপ থাকে,
তারপর নরম গলায় আরেকটা প্রশ্ন করে,
তুমি কি কাউকে পছন্দ করো? মানে, করতা?
মেহরিন চমকে তাকায় রিদের দিকে।
রিদ একরাশ হাসি নিয়ে বলে,
কি হলো? বলো না। আমরা তো ভালো বন্ধু, তাই না?
মেহরিন মাথা নাড়ে।
রিদ আবার বলে,
তাহলে বন্ধুকে বলতেও সমস্যা কিসে?
মেহরিন রিদের চোখে চোখ রাখে।
গলায় কোনো কাঁপন নেই, শুধু এক চিলতে শান্তি।
হ্যাঁ… করতাম। একজনকে খুব ভালোবাসতাম। বিশ্বাস করতাম। কিন্তু সে প্রতারক ছিল। আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।
রিদ মাথা নিচু করে হেসে ফেলে।
মেহরিন অবাক হয়ে তাকায়।
এই কথায় কেউ হেসে ফেলে?
রিদ আবার বলে,
তাহলে আমাকে বিয়ে করছো কেন?
মেহরিন নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
কারণ আমি জানি আপনি ভাঙা বিশ্বাসের মানুষ না। আপনি ভালো একজন মানুষ। আমি আপনাকে এখনই ভালোবাসি না, কিন্তু নিজেকে তৈরি করব, আপনাকে মেনে নিতে চেষ্টা করবো। সময় দিন আমাকে, আমি আমার সর্বোচ্চটা চেষ্টা করব।
রিদ মাথা নাড়ায়, আস্তে বলে,
আচ্ছা।
তারপর দাঁড়িয়ে যায়।
চলো, বাড়ি ফেরা যাক।
গাড়িতে ওঠার পর দু’জনেই চুপ।
কোনো কথা নেই, শুধু শহরের বাতিগুলো চলে যাচ্ছে জানালার বাইরে দিয়ে।
মেহরিনের বাড়ির সামনে গাড়ি থামে।
মেহরিন দরজা খুলে নেমে চলে যাচ্ছিলো, তখনই রিদ ডেকে বলে,
“মেহু!”
পেছনে ফিরে তাকায় মেহরিন।
রিদ জানালার ফাঁক দিয়ে বলে,
আমাদের বিয়ে হোক বা না হোক আমরা কিন্তু ভালো বন্ধু হয়ে থাকব, আজীবন। আমি তোমার অনুভবকে সম্মান করি। আর একটা কথা—তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে, আর ভালো মানুষদের আল্লাহ কখনও নিরাশ করেন না।
মেহরিন হেসে বলে,
আপনিও খুব ভালো।
রিদ হেসে “আল্লাহ হাফেজ” বলে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়।
মেহরিন ধীরে ধীরে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে।
ভেতরে সেই পুরনো চেনা ঘর, কিন্তু মনটা কেমন যেনো হালকা হালকা লাগছে আজ।
বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে মেহরিন।
আস্তে করে এক গভীর নিশ্বাস ফেলে।
অদ্ভুত হালকা একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে বুক জুড়ে।
হয়তো সেটা স্বস্তির, হয়তো মেনে নেওয়ার।
রিদকে মনের কথাগুলো বলতে পারায় কেমন যেনো একটা শান্তি শান্তি লাগছে মেহরিনের।
রিদের বলা কথাটা বারবার কানে বাজে—
আমাদের বিয়ে হোক বা না হোক, আমরা কিন্তু ভালো বন্ধু হয়েই থাকব আজীবন।
এটা কেনো বললো উনি?
তার পর বার ভাবে,
এমন নির্ভরতা, এমন শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক—সবাই কি পায়?
মেহরিন একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
এই মানুষটা যদি একটু আগে আসত, যদি সবকিছু একটু আগে জানত,
তবে কি জীবনটা অন্যরকম হত?
আকাশ-পাতাল ভেবে ভেবেই একসময় চোখে ঘুম নেমে আসে।
চোখ বন্ধ হতেই মনের এক কোণে নিঃশব্দে গেঁথে থাকে রিদের সেই মৃদু হাসি আর বন্ধুর মতো ভালোবাসার আশ্বাস।
দিনগুলো যেনো পানির মতো গলে গেলো। শপিং করা, বিয়ের বাজার করা, বাড়িঘর সাজানো, আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করা সবকিছু যেনো হুট করেই হয়ে গেল আর খুব তাড়াতাড়ি ।
আজ মেহরিনের গায়ে হলুদ।
বাড়িতে চারপাশে সাজসাজ রব।
রঙিন ঝালর, ফুলের তোড়া, আলোকসজ্জা—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নের পরিবেশ।
নিকট আত্মীয়রা চলে এসেছেন, ঘরের ভিতর বাইরে উৎসবের আমেজ।
চুমকি, আরফা, আর মেহবুবা ব্যস্ত গায়ে হলুদের আয়োজন নিয়ে।
মাহির আর আরশ ছেলেদের দলে ব্যস্ত বাইরে থেকে অতিথিদের দেখভালে ও স্টেজ সাজানো নিয়ে।
এক কোণে মেহরিন বসে আছে—হলুদের শাড়িতে, চুলে গাঁদা ফুল, হাতে মেহেদি।
পার্লারের মেয়ে তার সাজ শেষ করছে।
মেহরিনের মুখে এক অদ্ভুত নিঃশব্দ প্রশান্তি।
হঠাৎ সেadam” লেখা সেই নম্বরটিতে আবার কল দেয়।
কল রিসিভ হতেই সে বলে ওঠে,
“তোকেই খুব মিস করছি…”
ওপাশের কথা শোনা যায় না,
শুধু মেহরিন বলে ওঠে,
“এই বিয়ে, প্রস্তুতি—সবই চলছে, কিন্তু সবাই আছে শুধু তুই নেয় তোর এক্সাম তো পড়ার সময় পেল না …
বউভাতে আসবি তো?
তারপর সে নিজেই হেসে বলে,
আচ্ছা।
এই কথার মাঝেই রাহী আর নূপুর আসে মেহরিনের কাছে।
তাদের হাতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব।
মেহরিনের দিকে তাকিয়ে তারা একসাথে বলে ওঠে,
মাশাল্লাহ! আমাদের ভাবী তো একদম নায়িকা লাগছে!
মেহরিন হেসে ফেলে,
তাদের পাশে বসে গল্পে মেতে ওঠে।
একটু পর চুমকি, আরফা, আর মেহবুবাও এসে যোগ দেয় আড্ডায়।
মালিহা মির্জা এসে ট্রেতে করে নাস্তা এগিয়ে দেয় মেয়েদের সামনে।
ঘরের মাঝে খুশির ঢেউ, আর এক কোণে মেহরিনের চোখে এক চুপচাপ অপেক্ষার ছায়া।
রাতের আকাশ ভরা তারা, আর বাড়ির বাগানভর্তি আলো।
স্টেজের মাঝখানে বসে আছে মেহরিন—হলুদের শাড়ি, তাজা ফুলের গহনা, হাতে মেহেদির রঙ। মুখে এক চুপচাপ কোমল হাসি।
চারপাশে রঙিন আলোর ঝলকানি, ফ্লোরে ফুল বিছানো।
মেহরিনের সামনে স্টেজেই শুরু হয় গান বাজিয়ে নাচ।
চুমকি, মেহবুবা, মাহির, আরফা, আরশ, রাহী আর নূপুর—সবার মুখে উচ্ছ্বাস, পায়ে ছন্দ।
তারা সবাই মিলেই মেহরিনের জন্য এক চমৎকার পারফরম্যান্স উপহার দেয়।
চুমকির হাসিতে প্রাণ, মেহবুবা গানের তালে তালে ঘুরছে শাড়ি উড়িয়ে, মাহির আর আরশ মজার কোরিওগ্রাফিতে মেতে উঠেছে। রাহী আর নূপুরের নাচে আছে নাটকীয়তা, আর আরফা যেন ধীর অথচ গভীর ছন্দে মোহিত করে রাখে।
সবার চোখ মেহরিনের দিকে।
আর মেহরিন?
সে শুধু তাকিয়ে থাকে—এই মানুষগুলোর দিকে, যারা তার চারপাশে ভালোবাসার মতো জড়িয়ে আছে।
তার চোখে তখন একরাশ কৃতজ্ঞতা আর আবেগ।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয় হাসি, ভালোবাসা আর অসংখ্য ফটোশুটের মধ্য দিয়ে।
আজ মেহরিনের জীবনের বিশেষ দিন—আজ তার বিয়ে।
বাড়ি জুড়ে উৎসব, আলো, আনন্দের জোয়ার।
চারপাশের হাসি-গান, অতিথিদের কোলাহল—সব কিছুই যেন এক রঙিন চিত্রপট।
কিন্তু সেই কোলাহলের মাঝেও,
যাকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই মেহরিন চুপচাপ বসে।
পাশে মেহবুবা, চুমকি আর আরফা বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া শেষ তারা অপেক্ষা করছে পার্লারের লোকেদের।
মেহরিন মনে মনে নিজেকে শক্ত করতে চায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে—
এত কিছু পেরিয়ে আজ এই দিন।
কেন আজও মনে পড়ছে সেই প্রতারককে?
আজ আমি আরেকজনের স্ত্রী হতে চলেছি—
এটা কি ঠিক যে আজও সেই অতীতের ছায়া আমাকে স্পর্শ করছে?
ঠিক তখন চুমকি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির উঠোনে।
উঠানে তখন রঙ খেলার প্রস্তুতি।
মেহরিন দাঁড়িয়ে দেখে—সবাই ভেসে গেছে রঙে।
কে কাউকে চিনবে না, সবাই যেনো রঙে ভুত হয়ে গেছে।
শুধু রঙ নয়, যেনো প্রাণের উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে চারদিকে।
মেহরিন চুপচাপ হাসে।
সেও ধীরে ধীরে রঙে মেতে ওঠে, হাসে, দৌড়ায়, সবার গায়ে রঙ মাখায়।
একটুখানি সময়ের জন্য ভুলে যেতে চায় সবকিছু।
ঠিক সেই মুহূর্তে,
একটা হাত এসে ছুঁয়ে দেয় তার গাল—
নীল রঙে ঢেকে যায় তার মুখ।
মেহরিন চমকে ওঠে, পেছনে তাকায়।
ভিড়, রঙ, কোলাহল—সব মিলিয়ে কিছু বোঝে না।
কিন্তু একটুকরো গন্ধ, এক পরিচিত পারফিউমের ছোঁয়া—
মনে করিয়ে দেয় কারো উপস্থিতি।
কবি সাহেব!
তার মনের গহিনে একদম আলতো করে নাড়া দেয় এই চিন্তা।
কিন্তু কিছু নিশ্চিত হওয়ার আগেই,
চুমকি এসে মেহরিনকে আবার টেনে নিয়ে যায়—
এইবার গোসলের জন্য।
রঙ মুছে ফেলা হবে, কিন্তু মনে যে রঙ লাগল তার কী হবে?
সাজঘরের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে ওঠে মেহরিন।
সাদা-লালের সাজে, গহনার ঝলকে যেনো সে এক পরিপূর্ণ নববধূ।
চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল রঙ, কপালে টিকলি—সব কিছু নিখুঁত,
তবুও ভেতরটা?
একেবারে নিখুঁত নয়।
বরং ভিতরে ভিতরে কেমন যেনো কাঁপছে ওর মনটা।
বিছানার পাশে বসে আছে সে। সাজা শেষ, অপেক্ষা শুরু।
কিন্তু…
মনের ভেতরে ঝড় থামছে না কিছুতেই।
ওই এক ছোঁয়া।
ওই এক মুহূর্ত।
যে মুহূর্তটা ছুঁয়ে গেছে তার সমস্ত স্নায়ুকে।
রঙ খেলায় সেই অচেনা ছোঁয়া,
সেই চেনা গন্ধ—
আর তার সঙ্গে জড়ানো একটা নাম, একটাই নাম— কবি সাহেব।
কাউকে বলে উঠতে পারেনি কিছুই।
চুমকি, মেহবুবা, কেউ জানে না।
মেহরিন শুধু চুপ করে বসে আছে।
ভীষণ অস্থির সে।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩১
মন শান্ত করতে বারবার দোয়া পড়েছে,
আয়াতুল কুরসি, চার কুল, দোয়া ইউনুস।
তারপর,
সূরা আর-রহমান।
শব্দে শব্দে, আয়াতে আয়াতে সে ডুবে যায়।
চোখের কোণ ভিজে আসে,
কিন্তু ভেতরের ভার একটু হালকা হয়।
মনে হয়—এই এখন একটু শান্তি পেল।
একটু নিঃশ্বাস নিতে পারল।