মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩১ (৩)
মির্জা সূচনা
বধূর সাজে মেহরিন চুপচাপ স্টেজে বসে।
তার পাশে চুমকি, মুখে একটুও হাসি নেই।
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মেহরিনের—কিন্তু বাইরের কেউ টের পাচ্ছে না,
জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন—তবু কোথাও এক ফাঁকা,
একটা শূন্যতা।
বরযাত্রী এসে গেছে,
সবাই খেয়ে নিয়েছে, গল্প করেছে, অপেক্ষা করছে শুধু—
বরের।
কিন্তু বর?
কোথায় বর?
ঘড়ির কাঁটা বারবার দেখে কেউ গুমরে ওঠে, কেউ ফিসফিস করে বলে—
“এখনো এল না কেন?”
রেদওয়ান তালুকদার, মেহরিনের বাবা, গম্ভীর মুখে ওঠে দাঁড়ায়।
সবার সামনে গলা কাঁপতে কাঁপতে বলে,
ফোন বন্ধ বলছে, কোথায় যে গেল বুঝতে পারছি না…
চোখে একরাশ চিন্তা, ঠোঁটে চাপা হতাশা।
সবার ভেতরে ভেতরে শুরু হয় কানা-ঘুষা, গুঞ্জন—
বর কি আসবে না?
কারো সাথে কিছু হয়েছিল বুঝি?
কি এমন হলো?
শান্ত আর রাকিব কম করে হলেও শতবার করে ফোন করে ফেলেছে—
ফোন বন্ধ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদিকে মেহরিন স্টেজে এক জায়গায় নিশ্চুপ বসে আছে,
জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনে, যেনো এক জরাজীর্ণ পুতুল।
এই যখন সবার দৃষ্টি বরের খোঁজে বিভ্রান্ত,
শান্ত ইশারায় চুমকিকে কিছু বলে।
চুমকি হেসে মাথা নাড়ে।
তারপর গানের বক্সে বাজে এক রোমান্টিক ট্র্যাক,
স্টেজের আলো বদলায়, সবাই চমকে ওঠে।
রাহি, রাকিব, শান্ত আর চুমকি—চারজন স্টেজে উঠে
একটি কাপল ডান্স শুরু করে।
সবার মন কিছুটা অন্যদিকে যায়।
সবাই এখন নাচ গানে বেস্ত।
হটাৎ শান্তর ফোনে একটা এসএমএস আসে।
প্রেরক—Rid।
শান্ত ফোনটা দেখে, তারপর ধীরে ধীরে পড়ে—
> আমি সিঙ্গাপুর যাচ্ছি।
কেন যাচ্ছি, তা এখন বলতে পারবো না।
আমি মেহরিনের যোগ্য নই। ও কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য,
আর সে আমাকে ভালোবাসেও না।
তাই আমি যাচ্ছি।
আমার জীবনের একজন প্রিয় মানুষ জীবনে খুব কষ্ট করেছে,তার দরকার এখন।
কাউকে কিছু এসব বলবি না,
শুধু বলে দে আমি এই বিয়ে করছি না।
আমি চলে গেছি।
বায় দেখা হবে খুব তাড়াতাড়ি…”
শান্ত স্থির হয়ে যায়।
কথা হারিয়ে ফেলে কয়েক মুহূর্তের জন্য।
তারপর মাথা নিচু করে বলে ফেলে—
“রিদ চলে গেছে… বিয়ে হবে না।”
সবার মুখে নীরবতা,
আলো ঝিমিয়ে আসে,
একটা মুহূর্তে যেনো চারদিক বোবা হয়ে যায়।
বিয়ের দিন, যেখানে আনন্দ আর আশার আশা ছিল, সেখানে আরেকটি অন্ধকার সত্য বের হয়ে আসে।
বরের কোনো খবর নেই।
রিদ বিয়ে করতে আসেনি।
রেদওয়ান তালুকদার চিন্তিত হয়ে পড়ে—শরীরের শক্তি হারিয়ে, অবিশ্বাসের চোখে একটানা ফোনে তাকিয়ে থাকে।
তার ছেলে আজ, তার অমূল্য রত্ন—তার গর্ব—এভাবে তার মাথা হেট করে চলে গেছে, এটা যেনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
“বিয়েটা হবে না,” এমন একটা অশনি সংকেত যেনো পুরো বাড়িতে ভেসে আসছে।
শান্তর কথা শুনে সবার ভিতরে এক শোকের জোয়ার।
রাহি আর নুপুর অবিশ্বাসে একে অপরের দিকে তাকায়। তারা বিশ্বাসই করতে পারে না—রিদ যার চোখে ওরা মেহরিনের জন্য ভালোবাসা দেখেছে সে মেহরিন কে বিয়ে করবে না বলে চলে গেছে!
মেহরিনের বাবা রেদওয়ান তালুকদারকে বললো, কেন রিদ এই কাজটা করল?
এখন আমার মেয়েটার কী হবে?
আকরাম চৌধুরী ধীরে ধীরে এসে উপস্থিত হন,
ঘৃণা মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে তিনি মৃদু গলায় বলেন,
এমন নাটকের মানে কী?আপনার ছেলে যেহেতো আমাদের মেয়েকে বিয়ে করবে না সেটা আগে কেন জানালো না। এভাবে বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়ার মানে কি ? আমরা তো আমাদের মেয়ের জন্য আপনার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায়নি। আপনি এসেছিলেন সে প্রস্তাব নিয়ে তাহলে আজ এসবের মানে কি এর উত্তর আছে আপনার কাছে?
মেহরিনের মা মন ভারাক্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,
ফাইজা চৌধুরী পাশে, চোখে তারও অশ্রু।
কানাঘুষো শুরু হয়েছে আশে পাশের মানুষ।
কারো মুখে বিস্ময়, কারো চোখে অপমান, কেউ আবার ঘোলাজলে মাছ ধরতে উঠে পড়ে লেগেছে।
কিছু মহিলা এক কোণে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলছে—
“নিশ্চয়ই মেয়ের চরিত্রে সমস্যা ছিল।”
“না হলে বর এমন দিনে পালায়?”
“আজকালকার মেয়েদের বিশ্বাসই নেই—কে জানে কার সাথে কী করত?”
মেহরিন চুপচাপ স্টেজে বসে সব শুনছে।
তার চোখে জল আসতে চাইছে, কিন্তু সে কাউকে দেখাতে চায় না।
সে কাঁদছে না। সে লড়ছে।
কিন্তু যখন সেই বাজে কথাগুলো একদম কানে এসে লাগে—
“কার সাথে কী করত কে জানে!”
ঠিক তখন সে আর থাকতে পারে না।
ধীরে ধীরে স্টেজ থেকে উঠে দাঁড়ায়।
শত শত মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গর্জে বলে ওঠে—
আপনাদের এত বড় সাহস কে দিলো? আমার নাম নিয়ে এমন কথা বলার? আজ আমার বিয়ে ভেঙেছে মানে এই না যে আমি দোষী। মেয়েদের বিয়ে ভাঙ্গা মানে এই নয় যে মেয়েটার চরিত্র কোন সমস্যা আছে,সব সময় কারণে অকারণে মেয়েদের দোষারোপ করা বন্ধ করুন।
প্রমাণ দিন—কার সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক আছে! যদি প্রমাণ না দিতে পারেন, তাহলে শুনে রাখুন— আমি মেহরিন মির্জা ওর জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব! আমার নামে আর একটা বাজে শব্দ উচ্চারণ করলে আমার চরিত্রে আঙুল তুললে সে আঙুল আমি ভেঙে দিতে দুইবার ভাববো না।
চারপাশ হিম হয়ে যায়।
এক মহিলা ফিসফিস করে বলে ওঠে,
এই মেয়ের ব্যবহারই তো প্রমাণ করে—ওই ছেলেটা ঠিক করেছে।এমন বেয়াদব মেয়ে কে কে বিয়ে করতে চাইবে।
মেহরিন সেই মহিলার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়।
ঠিক তখনই ফাইজা চৌধুরী, মেহরিনের ফুপ্পি, ভিড় ঠেলে এসে ওই মহিলার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পর মারে।
আর যদি আমার ভাইয়ের মেয়ের নামে একটা বাজে কথা বলিস,
আমি তোকে নিজের হাতে শেষ করে ফেলব।
নিজের মেয়ের চরিত্র জানিস? আগে আয়নায় মুখ দেখে আয়।
এরপর কথা বলিস! তোর সাহস কী করে হয় আমার বাড়ির মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বাজে কথা বলার । আর একটা বাজে শব্দ গলা দিয়ে বের হলে সেই গলায় পাড়া দিয়ে ধরবো বেয়াদব মহিলা।
মঞ্চে ঝড় বয়ে যায়।
লোকেরা নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে—যেনো সময় থেমে গেছে।
এইদিকে আরোশ মাকে ধরে শান্ত করে,
আর ফাইজা চৌধুরী তীব্র রাগে কাপছেন।
আর সেই মুহূর্তে, সবাইকে চমকে দিয়ে
রেদওয়ান তালুকদার হাতজোড় করে সামনে এসে দাঁড়ায়।
চোখে পানি, কণ্ঠ ভেঙে গেছে।
আমাদের ভুল হয়েছে।
আমি দায় নিচ্ছি।
আমার ছেলের এই কাজের জন্য আমি মেহরিন আর তার পরিবারকে লজ্জিত করে ফেলেছি।
আমি ক্ষমা চাই।
আমি জানি, ক্ষমা চাইলে সব ঠিক হয় না…
কিন্তু আজ যদি একটা ভালো মানুষ ভেঙে যায়, সেটা আমি সইতে পারব না।
দয়া করে আমাদের মাফ করে দিন।
আপনারা দয়া করে মেহরির মা কে কোন বাজে কথা বলবেন না ওর কোন দোষ নেই।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফিরোজ মির্জা, মেহরিনের বাবা, চোখে এক বিন্দু জল মুছে বলেন—
ক্ষমা চাইলেই কি সব ঠিক হবে মিস্টার তালুকদার।
তবে মেহরিন আমার মেয়ে—সে ভাঙবে না।
সে আজ ভাঙলেও, কাল সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
আর আপনার ছেলে?
সে পালিয়ে বাঁচলেও, নিজের চোখে তাকাতে পারবে না।
কারণ সে শুধু আমার মেয়েকে নয়—
আমাদের বিশ্বাস, সম্মান, ভালোবাসার সাথেও প্রতারণা করেছে।
এমন টানটান উত্তেজনা পূর্ণ মুহূর্তে…
হঠাৎ করেই বক্সে সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে উঠল চেনা এক সুর। সবাই একসঙ্গে তাকিয়ে গেলো গেটের দিকে। দরজার ফাঁক গলে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলো একজন ছেলে ঘোড়ায় চড়ে—গায়ে বরের পোশাক, একপাশে একটা ছেলে, আর অন্য পাশে এক মেয়ে।
তাদের সাথে ব্যান্ড পার্টি। তাদের এক ঝলকে দেখে অনেকেই চিনে ফেললো।
মেহবুবা আর চুমকি একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলো, “রাজ ভাইয়া!”
সবাই অবাক, বিস্ময়ে হতবাক! যারা চেনে না তারা বলছে কে এই ছেলে? এমন বর সেজে কেন এসেছে? কি হচ্ছে এসব ?
লাবিব গাইছিল গান, গানের কথাগুলো যেনো কারও মনের ভেতর ঘূর্ণি তোলে—
ছোটে ছোটে ভাই ও কি বারে ভাইয়া ….
আজ বানায়েঙ্গে কিসি কি সাইয়া…..
তার গানের তালে তালে সেই মেয়েটিও একটি সুরেলা গলা মিলিয়ে দিলো আর গানের তালে নাচতে থাকে।
লো চালি মে….
আপনি ভাই কী বারাত লেকে….
লো চালি মে….
রাজ… ধীরে ধীরে গানের সুরে এক দারুণ কোরিওগ্রাফিতে নাচতে নাচতে এগিয়ে এল মেহরিনের ঠিক সামনে।
ও……..
তেরে ঘর আয়া মে আয়া তুজকো লেনে…
দিল কে বাদলে মে দিল কা নজরানা দে নে….
লাবিব আর ওই মেয়ে টাও রাজের সাথে নাচছে।
মেহরিন নিথর, স্তব্ধ। এই আবির্ভাব সে কিছুতেই কল্পনা করতে পারেনি। তার চোখে জল এসে গেছে, কিন্তু তবু সে তাকিয়ে আছে—একি স্বপ্ন, না বাস্তব?
রাজ থেমে যায় মেহরিনের একদম কাছে এসে। তার চোখে চোখ রাখে।
চোখ দুটো যেন বলে উঠলো:
তোমার পাশে থাকতে চেয়েছি আজীবন, আজ যদি সুযোগ… দিও।
আকরাম চৌধুরী হেসে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন রাজকে। রাজও তাঁকে জড়িয়ে ধরল এক আবেগে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে রাজ উচ্চস্বরে বললেন, এই বিয়ে হবেই।
মঞ্চের নীরবতা বিদীর্ণ করে মেহরিন সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখে ক্রোধ, বুকে ঘৃণা।
সে ফুঁসে উঠল, আপনি এই কথাটা বলার কে? আর আপনি ভাবলেন কী করে—আপনার মতো একজন মানুষকে আমি, আমি মেহরিন মির্জা, বিয়ে করব?
রাজ হেসে বলল, তুমি করবে না,তোমার চৌদ্দ গুষ্টি করবে।
মেহরিন হতচকিত। রাজের এমন দম্ভ! সে তাকিয়ে থাকে রাজের দিকে, তখন রাজ হাত ইশারায় তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটিকে ডাকল। মেয়েটি সামনে এসে হাসিমুখে দাঁড়াল মেহরিনের কাছে।
মেহরিন তার দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকাল। মনে মনে ভাবল, এই মেয়েটা…?
রাজ তখন বলল, ও আমাদের বোন, লাবিবের বোন—লামিয়া।
মেহরিন অবাক হয়ে তাকাল। মেয়েটি এগিয়ে এসে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরল। মেহরিন স্তব্ধ, নির্বাক।
তবুও, তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—যদি ও কবি সাহেবর বোন হয়, তবে সেইদিন ওসবের মানে কী…?
রাজ চোখে চোখ রেখে বলল, আমরা তোমাকে দেখেই গিয়েছিলাম ওখানে। তোমার প্রতিক্রিয়া জানতেই।
এই কথাটা শুনে মেহরিনের ভেতরের সমস্ত কষ্ট, অপমান, ভালোবাসার ভুল বোঝাবুঝি একসঙ্গে বিস্ফোরিত হলো এত দিন গুমরে গুমরে মরার স্মৃতিচারণ হল কত টা কষ্টে ছিলো আর এই বেয়াদপ কী না বলছে ওটা অভিনয়। রাগে- দু:খে, কষ্টে ঘৃণায়-আঘাতে উত্তাল হয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজের গালে সজোরে এক চড় কষাল।
আমি তোকে কখনও বিয়ে করবো না! শোনেছিস? কোনোদিন না!”—চিৎকার করে বলে উঠল মেহরিন।
সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চারপাশে স্তব্ধতা।
রাজ গাল চেপে ধরে কঁকিয়ে বলে উঠল, উফ্! এতো জোরে কেউ মারে? কী জোর, মাইরি…
তাকে দেখে কিছুমাত্র লজ্জা বা অনুতাপ নেই—তবুও হাস্যরস যেনো ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে।
ফিরোজ মির্জা এগিয়ে এসে বললেন, রাজি হয়ে যা মা। ও তোর ভালো চায়।
কিন্তু মেহরিন দৃঢ় গলায় বলে উঠল, “না, বাবা। কখনোই না। প্রয়োজনে আমি আজীবন অবিবাহিতা থাকব। তবু ওকে বিয়ে করবো না।
রাজ মেহরিনের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
বলো, বিয়ে করবে কিনা?
মেহরিন এক মুহূর্ত দেরি না করে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিল,
জীবনেও না।
চুমকি, মেহবুবা, আরফা—সবাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু মেহরিন ছিল অটল।
ঠিক তখনই রাজ পকেট থেকে একটি পিস্তল বের করে মাটিতে গুলি ছোঁড়ে। এক রকম ডেভিল হাসি দিয়ে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বন্দুকটা তাক করে মেহরিনের বাবার মাথায়। চারদিকে শিউরে ওঠার মতো নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
ফিরোজ মির্জা ফিসফিস করে বলেন,
আমার মেয়ের হাতে আবার মার খাবে তুমি বাবা?
রাজ ফিসফিসিয়ে উত্তর দেয়,
আপনি কেমন মেয়ে ডাউনলোড করেছেন, শ্বশুর আব্বা?দেখলেন কমনে মারলো বিশ্বাস করুন আমার চাপার দাঁত মনে হয় নরে গেছে শেষের কথা টা দুঃখ নিয়ে বললো রাজ।
ফিরোজ মির্জা বলে, আাহারে.. থাক বাবা অমন মাইর খাওয়ার অভ্যাস করে নাও। জানোই তো আমার মেয়ের মুখের থেকে হাত চলে বেশি।
রাজ অসহায় মুখ করে বলল, শিশুর আব্বা।
ফিরোজ মির্জার হাসি পেলে ও তা চেপে গেলো হাসলেই মেহরিন বুঝতে পেরে যাবে এটা প্লেন। ফিরোজ মির্জা আতঙ্কিত খাওয়ার ভান করে বলে,
“মেহু… রাজি হয়ে যা মা…”
মেহরিন হতভম্ব। নিজের বাবার মাথায় বন্দুক তাক করে আছে যে,এটা যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না সে কিছুতেই।
তবু সে ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে বলে,
আমার বাবা’কে ছেড়ে দাও, আমি রাজি।
রাজ তখন বন্দুক নামিয়ে, দুষ্টু হাসি হেসে এগিয়ে আসে মেহরিনের দিকে। কিন্তু মেহরিন তখনই নিজের বুদ্ধির খেলা দেখায়। আচমকা এক ঘুষি মেরে বন্দুকটা রাজের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়, আর তারপর রাজের কপালে বন্দুকটা ঠেকিয়ে দাঁড়ায়।
চোখে আগুন, গলায় বজ্র স্বর—
তোর এত বড় সাহস! আমার বাবার কপালে বন্দুক ধরিস? আর ভাবিস আমি তোকে বিয়ে করব?
রাজ পুরোপুরি স্তম্ভিত। বলল,
“ববব… বউ… তুমি তো খুব ডেঞ্জারাস!আমি তোমার ভবিষ্যৎ সুয়ামি। প্লিজ সোনা বউ আমার এমন করো না। এসব করলে পাপ হয় পাপ।বন্দুকটা নামাও আমি ভয় পাচ্ছি তো বউউউ একটু টেনে বলে রাজ।
মেহরিন চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“চুপ!”
ঠিক তখনই রাজ লাবিবের দিকে ইশারা করে। লাবিবও তার লোকদের সিগন্যাল দেয়। মুহূর্তেই কিছু লোক ছুটে এসে চুমকি, মেহবুবা, মাহির, মেহরিনের মা, ফুপি, এমনকি মেহরিনের বাবার মাথায় বন্দুক তাক করে দাঁড়ায়।
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যায়। যেনো যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে।
রেদওয়ান তালুকদার বলে,এই ছেলে কি করছো তুমি ছেড়ে দাও সবাই এমন করছ কেন। রাহি আর নুপুর ভয়ে কাঁপছে। ওদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে রাকিব। শান্ত অস্থির হয়ে উঠেছে চুমকির মাথায় বন্দুক দেখে ।
মেহরিন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, চোখে এক ঝাঁক ঝড়। সবার চোখের সামনে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়েছিল আজ সে। নিজের কাঁপা হাতে বন্দুকটা নামিয়ে নিলো—রাজ আর অন্যদের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
ওদের ছেড়ে দিন। আমি… আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি।
চারদিকের সবাই হতবাগ। কেউ অবাক, কেউ অবিশ্বাসী। কিন্তু রাজ চোখ সরাল না তার দিক থেকে। ঠোঁটে একটুকরো তিক্ত হাসি, কণ্ঠে অবিশ্বাসের তীব্রতা,
না… বিশ্বাস করি না। তুমি যদি আবার ছলনা করো তখন Moonbeam ?
তারপর চারপাশে তাকিয়ে সে সবাইকে গান পয়েন্টে রেখে বলল,
আজ এই মঞ্চেই বিয়ে হবে। সবাই শুনে রাখুন, কাজী সাহেব—শুরু করুন।
সবার চক্ষু চড়কগাছ, এ কেমন বর পরিবারকে জিম্মি করে বিয়ে করছে কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। কাজীকে ডাকা হয়। কাগজ কলমে শুরু হয় নাম লেখার পর্ব।
কাজী সাহেব মেহেরিন কে নিজের সম্পর্কে সব জিজ্ঞেস করে মেহেরিন অনিচ্ছা শর্ত বলে দেয়।
তারপর কাজী সাহেব তার চশমাটা একটু উপরে ঠেলের আজকে বলে,
বাবা… তোমার বাবার বলো।
এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। এমন সময় এক মহিলার গলা ভেসে আসে,
ওর বাবার নাম রুদ্র শিকদার। আর মা… ফারজানা শিকদার। তাদের একমাত্র ছেলে—রাজ শিকদার।
এক ঝড় বয়ে যায় লোকজনের ভেতর। সব চোখ ঘুরে যায় সেই মহিলার দিকে। রূপা বেগম দাপটের সঙ্গে প্রবেশ করে বিয়ের মঞ্চে।তার চোখে মুখে আনন্দের ঝলক। মুখে আত্মবিশ্বাসী হাসি, তার আজ এখানে আশা যেনো অনেক দিনের পুরনো ইতিহাস প্রকাশ করার এক অদ্ভুত রকমের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব নিয়ে এসেছে।
আকস্মিক চুপচাপ বসে থাকা আকরাম চৌধুরী আর ফাইজা চৌধুরীর চোখে তখন আশ্চর্য এক দৃষ্টিতে জল চিকচিক করছে।
আর ঠিক তখনই এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা রেদওয়ান তালুকদার ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন।রূপা বেগমের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
“অসম্ভব…” কেঁপে উঠল তাঁর কণ্ঠ।
বলেই দু’পা পিছিয়ে যান তিনি ।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩১ (২)
সবাই নিস্তব্ধ, সবার দৃষ্টি রূপা বেগমের দিকে।
রাজ, লাবিব, লামিয়া ও রূপা বেগম একসঙ্গে হেসে উঠলো রেদওয়ান তালুকদারের অবস্থা দেখে। উচ্চস্বরে, অট্টহাসিতে। যেনো তারা জানতো ঠিক এই মুহূর্তটা আসবেই।