মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩২
মির্জা সূচনা
রুপা বেগম ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন।
তাঁর মুখে কুটিল হাসি, চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে।
তিনি সামনে দাঁড়ানো রেদওয়ান তালুকদারের চোখে চোখ রেখে বললেন,
— আরে রেদু… কেমন আছিস তুই?
রেদওয়ান তালুকদার হতভম্ব। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই নারী কি সত্যিই রুপা? কণ্ঠটা শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল,কিন্তু ওর বেঁচে থাকাটা অসম্ভব।
— তুই… তুই বেঁচে আছিস রুপা?— অবিশ্বাসের স্বরে বলল রেদওয়ান।
রুপা বেগম হেসে উঠলেন। সেই হাসিতে ছিল ব্যথা, ছিল বিজয়ের স্পষ্ট ছাপ।
— হ্যাঁ রে… দেখ, বেঁচে আছি। তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
একটুখানি থেমে তিনি বললেন,
—জানিস রেদু, হায়নার দল আমাদের শেষ করে দিতে চেয়েছিল। আল্লাহর রহমত, আমি এখনো বেঁচে আছি।
কিন্তু জানিস… ওরা মেরে ফেলেছে রুদ্রুকে… মেরে ফেলেছে ফারজানাকে।
আমার বড় ছেলে হাবিবকেও তারা মেরে ফেলেছে… আসলামকেও মেরে ফেলেছে।
আর আর জানিস ফারজানা আর রুদ্রুর ছোট্ট মেয়েটাকে… তাকেও ছাড়েনি ওরা। ওরা নিয়ে গেছে সেই ছোট্ট দুধের শিশুটাকেও।
তার কণ্ঠ ক্রমশ কাঁপছিল, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো জল।
— ওরা আমাকেও মারতে চেয়েছিল। জানিস কেন? কারণ আমি ওদের চেহারা দেখে ফেলেছিলাম।
নিজ চোখে দেখেছি, ওরা কিভাবে একে একে সবাইকে মেরে ফেলছে… কী ভয়ানক মৃত্যু ছিল ওগুলো।
তিনি হাত তুলে দেখালেন সামনের দিকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— ওই যে দেখছিস, ওটাই রাজ শিকদার — রুদ্র আর ফারজানার ছেলে। ওকেও মারতে চেয়েছিল ওরা।
আর ওই যে দেখিস, লাবিবকে দেখেয়ে বললো…ওকে ও মারতে চেয়েছিলো।
তার চোখ থেমে রইলো একটুখানি, এবার গলা নেমে গেল শূন্যতায়—
— আর ওই যে লামিয়াকে দেখিয়ে বললো… ও তো ছিল আমার পেটে।
ওকেও ছাড়েনি… মারতে চেয়েছিল আমারই গর্ভে থাকা বাচ্চাটাকে।আমার ভূমিষ্ঠ না হওয়া বাচ্চাটাকে মেরে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু না ওরা পারেনি হায়াত মৃত্যুর মালিক তো আল্লাহ। আল্লাহ হয়তো চেয়েছিল ওদের মত জানোয়ারদের শাস্তি হোক তায় হয়তো বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের।
লাবিব রাজ ওরা এখন বড় হয়েছে, ওরাই নিবে ওদের মা-বাবা ভাই-বোনের মৃত্যুর বদলা। আর লুকোচুরি নায় এবার শত্রুদের সম্মুখে দাঁড়ানোর পালা।
এই কথা বলতেই রেদওয়ান তালুকদারের মুখে কোনো কথা থাকল না।
সে নিঃশব্দে দারিয়ে রইলো ঘেমে নেয়া কাকার অবস্থা হয়ে গেছে।
হঠাৎ তার দৃষ্টি গেল রাজের দিকে, একবার রাজকে দেখলো তারপর রাহি কে।
আর এদিকে রাহি আর নুপুরের চোখে পানি এত গুলো মানুষ মারা গেছে শুনে।
মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে সে রাহির হাত চেপে ধরল রেদওয়ান তালুকদার ।
কিছু না বলে টেনে নিতে লাগল তাকে নিজের সঙ্গে।
রুপা বেগম চিৎকার করে বললেন,
— পালাতে চাস? দাঁড়া! আমার কথা শেষ হয়নি!
কিন্তু রেদওয়ান থামল না।
সে জানে, এই গল্পের শেষ এখানেই না।
এ গল্পের শেষ হবে, যখন রক্তের ঋণ শোধ হবে।
সবার মুখে স্তব্ধতা। রুপা বেগমের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা একেকটা বাক্য যেনে বিদ্যুৎচমকের মতো পরিবেশে আঘাত করছিল।
সবার চোখ অবাক, আর মেহরিন দাঁড়িয়ে ভাবছে—এই নারীটা বলছে রাজের মা-বাবাকে খুন করে দিয়েছে কেউ। তার বোনকেও।
এত নিকৃষ্ট, এত ভয়ঙ্কর —মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?
চোখ ভিজে আসছে মেহরিনের। পাশে থাকা আকরাম চৌধুরীর চোখেও জল।
একটা মুহূর্ত, পুরো জায়গাটা নীরব। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও যেনো থেমে গেছে।
এরমধ্যেই সামনে এগিয়ে এলেন রুপা বেগম।
তিনি চুপচাপ কাছাকাছি থাকা কাজী সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
— বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।
কাজী সাহেব একটু অবাক হলেও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
কাগজ-কলম বের করে বললেন,
— তা… দেনমোহর কতো লিখব?
রুপা বেগম হঠাৎ মেহরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
মাথায় হাত রেখে বললেন,
— এটা তোমার প্রাপ্য। তাই তুমিই বলো—দেনমোহর কতো লিখব?
মেহরিন কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো। তার চোখে জল মুখে কোন কথা নেয়।
আর ঠিক তখনই রুপা বেগম নিজেই বললেন,
— দেনমোহর যেহেতু আজই শোধ করতে হবে, তাই লিখুন ৫০ লাখ।
যদিও আমি জানি, আমার রাজ কোনোদিন তার বউকে ছেড়ে দেবে না।
তবুও, নিয়ম তো নিয়ম—লিখুন ৫০ লাখ।
হঠাৎ মেহরিন বলে উঠলো,
—সাথে আরও লিখুন। ওর ২১২টি হাড়—সব আমার।
ওর হৃদয়—আমার।
তার সাথে ওর দুই চোখ, আর তার হাত—সবও আমার।
সবাই চমকে উঠল।
কাজী সাহেব কাগজ নামিয়ে বিস্ময়ে তাকালেন,
— মা, এসব কী বলছো! এগুলো তো দেনমোহরে লেখা যায় না!
মেহরিন এবার কণ্ঠে অনড় দৃঢ়তা এনে বললো,
— আপনি লিখুন। যেনো কখনো ওর হাড় ভাঙলে কেউ না বলতে পারে ‘ওগুলো তার ছিল।’
যদি ওর হৃদয় আমার ছাড়া আর কারো জন্য নাচা নাচি করে—তাহলে সেই হৃদয় এক কোপ এ দু’ভাগ করে দিলে কেউ যেনো না বলে ওটা তার ছিলো, যেনো কেউ না বলতে পারে ‘ওটা আমার ছিল।’
যদি আমার ছাড়া আর কোনো নারীর দিকে সে কু-দৃষ্টি দেয়—তাহলে সেই চোখ তুলে ফেললে, যেনো কেউ দাবি না করতে পারে ‘ও চোখ তার ছিল।’
আর যদি সে অন্য কোনো নারীকে স্পর্শ করে—তাহলে সেই হাত ভেঙে গুড়িয়ে দিলে, যাতে কেউ বলতে না পারে ওগুলো তার ছিলো।
কারণ, দেনমোহর তো আমার, তাই না?
কাজী সাহেব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন মেহরিনের দিকে।
তার ঠোঁটে শুধু একটাই বাক্য বের হলো—
— আল্লাহ… কী মেয়ে রে বাবা!
সবার মুখে বিস্ময়!
কেউ যেনো এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না—মেহরিন এসব কী বলল!
মাথা নিচু করে অনেকে মুখ চেপে হাসছে, কেউ বা তাকিয়ে আছে রাজ আর মেহরিনের দিকে অপলক।
রাজ মনে মনে বললো এই না হলে মিসেস.শিকদার। যার কথা শুনলেি মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যাবে। সাব্বাস বউ তোমার জন্য গর্বে আমার বুক ফুলে যাচ্ছে।কিন্তু
মুখে একটু কান্না মেশানো ভঙ্গি।
নরম গলায় বলে উঠলো—
— বউ, তুমি বিয়ের আগেই আমাকে ওপরে পাঠানোর প্ল্যান করে ফেলছো বুঝি?
তারপরেই হেসে উঠে বলে,
— কোনো সমস্যা নাই, লিখে দিন কাজী সাহেব! আমি আমার আপন নারী ছাড়া কারো দিকে তাকাবো না, স্পর্শ তো দূরের কথা! আমার হৃদয়ও আর কারো জন্য নাচবে না! লিখে দিন কাজী সাহেব সবার কপালে তো আর পতিবক্ত বউ জোটে না। আমার বউ পতিবক্ত না হোক আমিই বউ বক্ত হয়ে যাবো কোন সমস্যা নাই।
রাজের কথা শুনে চারপাশে হাসির একটা নরম ঢেউ বয়ে গেল।
চুমকি কানে কানে বললো,
—কবি সাহেন নাকি বউ বক্ত জামাই হবে রে!
মেহরিন মুচকি হাসে। মনে মনে বলে,বিয়ের সাদ সারাজীবনের জন্য মিটিয়ে দিবো চান্দু।
লাবিব মনের ভেতরেই হেসে উঠলো মনে মনে বললো—
“এইবার বুঝবে, ভাই কতো চাল এ কতো ধান! ঠুক্কো কতো ধানে এ কতো চাল!
আর কাজী সাহেব মনে মনে বলে—
দুইজনই যে একেকটা পাগল! এ জীবনে কতো কিছু যে দেখতে হবে, আল্লাহই জানেন!
তবুও মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন,
—আচ্ছা বাবা, লিখে দিচ্ছি… এখন আল্লাহর নামে বিয়ের কাজ শুরু করি।
পবিত্র বন্ধনের সূচনা হয়।
দুই পাশে দুজন—একপাশে রাজ, অন্যপাশে মেহরিন।
মাঝখানে পাতাবাহার ফুলে সাজানো সাদা কাপড়।
কাজী সাহেব রাজের দিকে ফিরে বলে, বাবা!
এদিকে রাজ কাজীর কথা পুরুটা না শুনেই বলে,
_হে আমি রাজি আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
সবার কপালে হাত।
কাজী সাহেব হতবাক হয়ে বলেন—
— বাবা, আগে তো আমাকে বলতে দাও!
রাজ মুখটা কিঞ্চিত ভ্যাঙচায়—
— আপনি এত স্লো কেন?আপনার বউয়ের জন্য তো আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। কি দেখে যা আপনাকে বিয়ে করেছিল।
কাজী সাহেব একটু বিরক্ত হলেন,
_তিনি বললেন আমার বউয়ের জন্য তোমার দুঃখ করতে হবে না। নিজের চিন্তা করো তোমার যে বউ!
চুমকি চোখে জল নিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠলো—
— তোর কবি সাহেব তো বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে রে?আহারে বেচারা মুখটা দেখ?
এই কথায় মেহবুবা আর আফরাও হেসে উঠলো।
মেহরিন কিছু বলে না, শুধু ঠোঁটে নরম এক হাসি।
ওদিকে রাজের কানে ফিসফিস করে বলে লাবিব—
— ব্রো, একটু ধৈর্য ধরো! এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? কাজী সাহেব তো এখনো বলতে শুরু করেননি!
রাজ মুখ বাঁকিয়ে বলে—
— তুই বুঝবি না লাবিব! আমার মতো বউ পেলে তুইও বুঝতি! কখন কী মুড বদলায় আর ‘বিয়ে করবো না’ বলে বসে—তখন আমি যাবো কোথায়?
লাবিব হেসে গড়িয়ে পড়ে—
— হেহে, তাই তো!
ঘরজুড়ে তখন নিঃশব্দ উত্তেজনা।
বিয়ের মূল পর্বের শুরুটা করছেন কাজী সাহেব।
তিনি গম্ভীর গলায় বলেন,
—বাবা, আপনি কি এই বিবাহে সম্মতি প্রদান করছেন? রাজি থাকলে বলুন—‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
রাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে, ভুরু কুঁচকে বলে উঠলো,
— রাজি না থাকলে এখানে নাচতে আসছি নাকি? বউয়ের এমন মারার প্ল্যান শোনার পরও যখন পালিয়ে যাইনি, তখন বুঝে নিতে হবে রাজি তো আমি! শুধু আমি কেন, আমার পুরো ১৪ গুষ্টি রাজি!”
সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। হাসির স্রোতে কেউ মুখ চেপে ধরেছে, কেউ চোখ মুছছে।
কাজী সাহেব মুখটা বিরক্ত করে বললেন,
— আচ্ছা আচ্ছা, এবার বলুন—‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
রাজ ঠোঁট ফাঁক করে ৩২টা দাঁত বের করে, হাসিমুখে বলে উঠলো—
— “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল!”
সবাই হাসিতে মেতে উঠলো।
চারদিক যেনো হালকা হয়ে গেলো।
এরপর কাজী সাহেব মেহরিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
— মা, আপনি কি এই বিবাহে সম্মতি দিচ্ছেন? রাজি থাকলে বলুন—‘আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।’
হঠাৎ নিস্তব্ধতা।
মেহরিন চুপ।
ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু শব্দ নেই।
চোখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা।
মনে হচ্ছে বুক চিরে কিছু বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু গলায় আটকে আছে।
চুমকি আসে, মেহরিনের হাত ধরে বলে—
—বলে দে রে! বল!
ফাইজা চৌধুরী মেহরিনের মাথায় হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে বলেন—
— বল মা, তুই পারবি।
আর সেই মুহূর্তে রাজ আর থাকতে পারে না।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে চিৎকার করে বলে ওঠে—
— বউ ও বউ! প্লিজ, বলে দাও না! একটা কবুল… এই তো একটা শব্দ!
দেখো, তোমার মুখে ‘কবুল’ না শুনে আমার তো টেনশনে কিডনি লক হয়ে যাচ্ছে রে! বউ প্লিজ… বলে দাও!
এই কথা শুনেই সবাই হেসে গড়াগড়ি খায় আবার।
ফাইজা চোখ মুছতে মুছতে হেসে ওঠেন,
চুমকি তো হাসতে হাসতে বলে,
— রাজ ভাইয়ের তো পুরো শরীর লকডাউন হয়ে যাবে মনে হচ্ছে!
শেষমেশ মেহরিন নিজেও আর ধরে রাখতে পারে না।
চোখে জল, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে ধীরে ধীরে বলে—
— “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”
এই শব্দ শোনা মাত্রই পুরো ঘরে গর্জে ওঠে—
“আলহামদুলিল্লাহ!”
কারও চোখে জল, কারও ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি।
একটি সম্পর্ক, দুটি হৃদয় আর অজস্র ভালোবাসার মানুষ এই বন্ধনের সাক্ষী হয়ে থাকলো।
এই একটি শব্দ যেনো হাজার বছরের অপেক্ষার জবাব হয়ে রইলো।
এবার সাদা কাপড় টা সরানো হলো।
আর সাদা কাপড়টা সরানো মাত্রই ঘটে গেলো এক অনভিপ্রেত অথচ মজাদার ঘটনা।
রাজ যেনো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।
সে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেহরিনের উপর—
হঠাৎ এমন অনিয়ন্ত্রিত ভালোবাসায় মেহরিন নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো।
একেবারে মাটিতে পরে গেল রাজ আর মেহরিন
সবার সামনে, নতুন বর-বউ গড়াগড়ি খাচ্ছে!
— “Thanks bou,” রাজ বলে।
মেহরিন মুখ কুঁচকে বলে,
— আল্লাহ গো, আমার কোমর! ইসস্! কোমরটা আমার বোধহয় ভেঙেই গেলো রে…
আপনি মানুষ না হাতি? উঠুন উঠুন বলছি!
রাজ বলে,
—তুমি আমায় হাতি বললা, বউ?
মেহরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— হাতি না বললে আর কী বলব? এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেন? একটু লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেয় তাই না?
সবার চোখ তখন এদিকেই, কিন্তু কাউরো হাসি থামছে না। বড়রা এদিক ওদিক তাকিয়ে কেটে পরলো ওখান থেকে।
পাশে দাঁড়ানোদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেছে।
চুমকি, মেহবুবা আর আরফা তো একে অপরের ওপর পড়ে যাচ্ছে হাসতে হাসতে।
লামিয়া পেট ধরে বসে পড়েছে মাটিতে।
আরশ আর মাহির চোখে জল এসে গেছে হাসতে হাসতে।
এদিকে, রাজ উঠে দাঁড়িয়ে মেহরিনকে টেনে তুললো।
মেহরিন গা ঝেড়ে এক চোখ গরম করে তাকাল রাজের দিকে—
রাজ আবার দাঁত বের করে হেসে ফেললো।
ঠিক তখনই লাবিব পাশে এসে ফিসফিস করে বলে,
— ব্রো, একটু কন্ট্রোল করো না নিজেকে প্লিজ! নতুন বউকে নিয়ে যদি স্টেজেই গড়াগড়ি খাও, হানিমুনে তো একেবারে ভূমিকম্প হবে মনে হয়!
এই কথা শুনেই আবার হাসির রোল—
চুমকি হাসতে হাসতে বলে,
— তোর বিয়ে স্মরণীয় হয়েই থাকলো রে মেহরিন! কী বিয়ের শুরু রে ভাই, কেউ বিশ্বাস করবে না।
মেহরিন লজ্জায় চোখ নিচু করে হাসে—
কিন্তু তার চোখের কোণায় যে আনন্দের টলমলে জল, সেটা কেবল কাছের মানুষগুলোই বুঝতে পারে। যতই বিয়ে করতে না চাক এই মানুষ টাকেই তো ভালোবেসে ছিলো তার সাথেই আজীবন থাকতে চেয়ে ছিলো।
রাজ তখন সবাইকে বলে,
— চুপ! এত দাঁত বের করছিস কেন? আমি কি ক্লাউন নাকি? আর আমি আমার বউকে নিয়ে পড়েছি পাশের বাড়ির ভাবীকে নিয়ে তো আর পরিনি!
আর এই কথা শুনে আবার চারপাশে হাসির ঝড় বইতে লাগলো…
আতঙ্ক, ভয়, রহস্য, হাসি, মজা, আনন্দের সাথে বিয়ের মুহূর্ত পেরিয়ে এলো সেই সময় — বিদায়।
একটা মেয়ে তার শৈশব, কৈশোর, ঘর, মানুষ, স্মৃতি — সব কিছু পেছনে ফেলে নতুন জীবনের পথে পা বাড়ায়।
এটা এমন এক সময়, যা বাইরে থেকে যতই সুশোভিত মনে হোক, ভিতরে তা এক ভয়ঙ্কর বেদনার আগুন।
তেমনি এক আগুনের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে মেহরিন।
চারপাশে কান্না — মায়ের, ফুপির, বোনের, ভাইয়ের।
সবাই কাঁদছে। শুধু মেহরিন কাঁদছে না।
তার চোখ শুকনো, কিন্তু বুকটা যেনো ভিতর থেকে ফেটে যাচ্ছে।
কারণ সে জানে, তার কান্না দেখলেই বাকিরা আরও ভেঙে পড়বে।
তাই নিজের কান্না আটকে রেখে সবার শক্তি হতে চায় সে।
মা জড়িয়ে ধরে বললেন,
— সবার সাথে মানিয়ে নিস মা… কাউকে কিছু বলার আগে ভাবিস… সবসময় ওদের মন বুঝে চলার চেষ্টা করবি।”
মেহরিন শুধু মাথা নাড়ে। কিছু বলতে পারে না।
চুমকি আর মেহবুবা একসাথে এসে জড়িয়ে ধরে—
চুমকি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— ভালো থাকিস রে… তোকে মিস করবো।
মেহবুবা বলে,
— তুই না থাকলে এই বাসাটা কত ফাঁকা লাগবে ভাবতেই কষ্ট হয়…
মেহরিন হাসিমুখে বলে,
— নিজেদের ও বাবা-মায়ের খেয়াল রাখিস। আমার জন্য দোয়া করিস।
আরফা এসে চোখভেজা চোখে বলে,
— খুব মিস করবো তোমাকে আপু…”
মেহরিন ওকে জড়িয়ে ধরে হাসে—
কিন্তু হাসির আড়ালে একটা কষ্ট চাপা পড়ে যায়।
তখন আসে আকরাম চৌধুরী আর ফাইজা চৌধুরী—
দুজনেই মেহরিনকে মাথায় হাত রেখে বলে,
— “সুখী হ মা…”
আরশ এসে মাথায় হাত রাখে—
— ভালো থাকিস… সবসময়।
দূরে দাঁড়িয়ে ছিল মাহির।
মেহরিন এগিয়ে যায় তার ছোট ভাইয়ের দিকে।
মাহির এক ঝলকে বোনকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।
মেহরিন মাথায় হাত রেখে হেসে বলে,
— আরে, দেখ! আজকে আমি তোর ‘আপদ বিয়াদ’ হয়ে গেলাম! খুশি হওয়া উচিত তো তোর,
— তোকে আর কেউ বকবে না, রাজা হয়ে গেলি বাড়ির, বুঝলি?
মাহির কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ে।
শেষে আসে বাবা — ফিরোজ মির্জা।
তিনি মেহরিনের হাত ধরে বলেন,
— “চলো মা…”
তারপর রাজের হাতে মেয়ের হাত তুলে দিয়ে বলেন,
— আমার মেয়ের খেয়াল রেখো।
রাজ মাথা নাড়ে, সম্মান দেখায়।
কিন্তু মেহরিন যখন বাবার বুকে জড়িয়ে পড়ে, তখন ফিরোজ মির্জা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না।
বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে কষ্ট।
— আমার মেয়েটাকে কখোনো যেনো কষ্ট না আসে, রাজ… ভুল করলে রাগ দেখিও না, বোঝাও। না হলে হার গোর আর ঠিক থাকবে না।ও তো আর অবলা নারী নয়। আমার মেয়ের জন্য নয় চিন্তা হচ্ছে তোমার জন্য সাবধানে থেকো বাবা!
রাজ মুখে দুঃখী হাসি এনে বলে,
— শ্বশুর আব্বা… ভয় দেখাবেন না, সাহস দিন।
ফিরোজ মির্জা কাঁধে হাত রেখে বলেন,
— তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। কিন্ত তুমি ‘মাইর খাবে’।
রাজ এবার জোরে বলে,
শশুড় আব্বাাা…..
সবাই আরাক দফা হেসে উঠে।
তারপর রাজ ওঠে সাজানো ঘোড়াটিতে, হাত বাড়ায়— মেহরিনের দিকে,
মেহরিন-ও হাত ধরে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে।
চারপাশের মানুষ কান্নাভেজা চোখে বলে—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩১ (৩)
— “আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন…”নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা ।
টগবগ শব্দ তুলে ঘোড়াটি বাড়ি ছাড়ে—
আর পেছনে পড়ে থাকে কিছু স্মৃতি, কিছু চোখের জল, আর একখণ্ড শূন্যতা।