হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৪৭+৪৮+৪৯
Tahrim Muntahana
নিশ্চুপতা! চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়েছে নোমান। তীব্র রাগে ফোন ধরে রাখা হাত টি তার কাঁপছে। অপর পাশ থেকে উত্তর আসে নি। কিন্তু সে এখন স্পষ্ট টের পেয়েছে লোকটি আহিশ ছাড়া কেউ নয়। কিছুটা সময় চুপ থেকে দাঁতে দাঁত চেপে নোমান বললো,
~ ফোন দিয়েছো কেন? কোন সাহসে?
~ আহা! শালা বাবু রাগছো কেন? তোমার আর আমার সম্পর্ক টাই থাকবে হাসি মজার, দুষ্টুমির। কমপ্লিকেটেড করছো কেন?
আহিশের নিঃসংকোচ বুলি। নোমান জোরে শ্বাস নিয়ে নিজে কে স্বাভাবিক করে নিলো। শক্ত গলায় বললো,
~ ফোন দিয়েছো কেন? আমাকে চিনলে কি করে?
~ কিছুদিন আগেও চিনতাম না। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে মিরা কে দেখেই আমি মিহার প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়েছিলাম। খোঁজ নিলাম, সবটা ক্লিয়ার হলো। মিহা আমাকে কখনোই বলে নি তোমাদের কথা। বললে হয়তো চিত্র টা আলাদা হতো। আমাকে নিঃস্ব করে চলে যেতে হতো না।
প্রগাঢ় অভিমান, ব্যাথা। নোমান থতমত খেয়ে গেল। অভিনয় কি মানুষ এতটা সুন্দর পারে? আহিশ আবার বললো,
~ তোমাদের উচিত হয় নি নোমান, আমার সাথে দেখা করতে পারতে।
~ বোনের খুনীর সাথে দেখা করবো? খুন হতে? কি ভেবেছো তুমি? তোমার এই ভালোমানুষীর কারণ জানি না? কেউ রেহায় পাবে না তোমরা, কেউ না। আমি তোমাদের এমন ভাবে মারবো, তোমাদের লাশ দেখে কেউ চিনতে পারবে না!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ যেমন আরাফ এখনো মিসিং?
কথাটা বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো আহিশ। চমকে দাঁড়িয়ে গেল নোমান। তোতলানো কন্ঠে বললো,
~ কি.. কি বলতে চাইছো?
~ তুমি ঠিক বুঝতে পেরেছো নোমান। আরাফ কে এরেস্ট করা, পালাতে সাহায্য করা, আবার তাকে গোপনে আটকে রাখা, অত্যাচার করা, তারপর হত্যা! ঠিক বলছি না আমি? রিলেক্স, এত টা হাইপার হচ্ছো কেন? আমি তো দোষের কিছু দেখছি না, বাস্টার্ড দের ওমন পরিণতিই হওয়া উচিত!
নোমান চোখ বুজে চেয়ারে বসলো। আহিশ নিজেও নিশ্চুপ। নিজের ভাইয়ের উপর কেউ এমন শব্দ ব্যবহার করতে পারে? হয়তো পারে, হয়তো অনেকদিনের ক্ষোভ জমা ছিলো। আহিশ কিছুটা সময় দিলো নোমান কে স্বাভাবিক হতে। তারপর নরম সুরে বললো,
~ থানার বাইরে অপেক্ষা করছি, এসো!
ফোন কেটে গেল। নোমান নিজের পকেটে হাত দিলো। নাহ, অস্ত্র টা আছে। বেরিয়ে দেখলো তিনটে হাবিলদার চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছে। অন্য সময় হলে হয়তো ধমকে উঠতো, কিন্তু এখন সেই সময় বা ইচ্ছে কোনো টাই নেই। থানা থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হাঁটলো সে। আবছা আলো অন্ধকারে পুরুষালি অবয়ব চোখে পড়লো। আকাশে কি যেন খুঁজে চলছে।
কিছুটা দোটানা নিয়ে এগোতেই কন্ঠ ভেসে এলো,
~ এসো শালাবাবু!
দুরত্ব রেখে পাশে দাঁড়ালো নোমান। হাত দিয়ে ইশারা করে হাঁটতে শুরু করলো আহিশ। কিছুক্ষণ চুপ থেকেই দুজন মনের মধ্যে কথা সাজালো। আঙুল তুলে আকাশের দিক লক্ষ্য করে আহিশ বললো,
~ ওই যে দেখ, চাঁদ! তোমার বোন টাকে আমি মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত চাঁদ বলে ডাকতাম। ওর চোখে মুখে আলাদা দ্যুতি ঘুরে বেড়াতো, জানো? কিন্তু ব্যক্তিগত চাঁদ টা যে আকাশের চাঁদ হয়ে যাবে, তা কি জানতাম? আচ্ছা আমার কি এমন জীবন পাওনা ছিল?
নোমান ভ্রু কুঁচকে আহিশ কে দেখলো। তার জানা আহিশের সাথে এই আহিশের কোনো মিল নেই। সম্পূর্ণ বিপরীত। সেসবে নোমান গেল না। প্রশ্ন করলো,
~ আরাফের ব্যাপার টা শুধু ধারণা নাকি প্রমাণ পেয়েছো?
হাসলো আহিশ, শরীর দুলিয়ে। একপলক নোমানের দিকে তাকিয়ে সামনে তাকালো। বিজ্ঞ দের মতো বললো,
~ তোমার, মিরা’র পরিচয় জানার পর আর কোনো কনফিউশন থাকতে পারে?
~ পালাতে সাহায্য করেছিলাম আমিই। আবার সেই রাতে যখন আশরাফ উদ্দিনের সাথে দেখা করতে এলো, সুযোগ বুঝে আমি আর মিরা নিজের ডেরায় তুলে নিলাম। অবশ্য খুনের সময় মিরা ছিলো না, যা করার আমিই করেছি। এমন মৃত্যু দিয়েছি, প্রকাশ্যে এলে হয়তো বড় বড় কিলার রাও ভয় পেয়ে যাবে! কিন্তু আপনার বাবা কে আমরা মারিনি! তাকে টার্গেট করেছিলাম আরো দুদিন পর, কিন্তু সহজ মৃত্যু পেয়ে বেঁচে গেল।
কি ভয়ানক শুনালো কথাগুলো। বেঁচে গেল! আহিশ মুচকি হাসলো। নিম্ন স্বরে বললো,
~ সে জানা আছে! যার চামচা হয়ে এতদিন ছিল, তার হাতেই মরেছে!
~ অনল মাহমুদ?
~ ইয়েস, শালা বাবু?
~ তোমার কোনো অভিযোগ নেই? বাবার মৃত্যু টা মেনে নিলে?
~ অভিযোগ তো অবশ্যই আছে, মেনে নিতে পারছি না বলেই তো আসা!
বলেই এক গাল হাসলো আহিশ। নোমান বিচলিত চাহনি তে দেখলো। আহিশ আবার বললো,
~ নিজের হাতে মারতে পারি নি তো, অভিযোগ টা এখানে। ছেলের থেকে পাওয়া আঘাত কতটা নির্মম হয়, আশরাফ উদ্দিনের দেখা উচিত ছিলো।
~ আমি তোমাকে মেলাতে পারছি না আহিশ।
~ আমি তো পালিয়ে যাই নি, মেলাও!
~ মিহা’র খুনের সাথে জড়িত নও, তুমি কি এটা প্রমাণ করতে চাইছো?
~ প্রমাণ করছি না তো, আমি অবশ্যই জড়িত। সেদিন যদি কাজের চাপের রাগ টা মিহা কে না দেখাতাম, না সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেত। না এক্সিডেন্ট হতো, না ওই হসপিটালে ভর্তি হতো, না অপারেশন থিয়েটারের নির্মমতা কে দেখতে হতো। সবার আগে আমিই জড়িত নোমান। অস্বীকার করি নি তো!
~ তোমাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে আহিশ। ফোনে যখন মিহা তোমাদের সংসারের কথা বলতো, আমি শুধু প্রতিটা কথায় দোয়া করে যেতাম। তোমার মতো মানুষ কে আমার বোনের জীবনে পাঠানোর জন্য কত শুকরিয়া আদায় করেছি। কিন্তু হুট করেই আকস্মিক মৃত্যু। সচল বোনটার নির্জীবতা, তোমার দিকেই প্রথম আঙুল তুলতে বাধ্য করেছে। তার পর বাবার স্বীকারোক্তি ! প্রথম লড়াই শুরু হয়েছিল বাবার মৃত্যু তে। বোকা মিরা টা নিমিষেই বুলেট ছুড়ে দিলো, হাসতে হাসতে মৃত্যু কে মেনে নিলো বাবা।
শূণ্যে তাকালো নোমান। বিভিষিকাময় দিনটা চোখের পাতায় ভাসছে। মোহনলাল শিকদার যখন যেচে এসে নিজের দোষের কথা স্বীকার করলো। অনল মাহমুদের সাথে চোরাচালানের কাজে জড়িত হওয়ার গল্প, টাকা নিয়ে ঝামেলা হওয়ার গল্প, অনল মাহমুদ কে শাষানোর গল্প, সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ করে মিহা কে ধর্ষণ করার গল্প; সেদিন বোকা, সহজ, সরল আদুরে মিরা টা চুপ থাকতে পারেনি। নিজের বাবা কে তারই বন্দুক দিয়ে হত্যা করেছিল। সারা রাত লাশের পাশে বসে কেঁদেছিলো। কিন্তু কখনোই তাদের গিল্টি ফিল হয় নি। আজ পুরোনো কথাগুলো আবার উঠে আসছে। আহিশ নিজেও ডুবেছিল তার সংসার চিত্রে। নোমানের চাপা দীর্ঘশ্বাস হয়তো তার বুকেও লাগলো। নরম সুরে বললো,
~ আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না। আমাকে বিশ্বাস করো না। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ টিকে মেরে নিজের মৃত্যু ডেকে আনার মতো ভুল কেউ করে বুঝি? আমার জীবনে একমাত্র মা ছিলো নোমান। সেও আমার কাছে ছিল না। হোস্টেল থেকে পড়াশোনা, একাকিত্ব জীবনে না ছিল কোনো বন্ধু, না ছিল কাছের কেউ। দু দিন পর পর মায়ের সাথে পাঁচ মিনিটের কথা, ওইটুকুই ছিলো আমার জীবনের সুখ। জীবনের মানেটা তখনও জানিনা। হুট করেই তোমার বোন চলে এলো। সুখ কাকে বলে জানলাম, বাঁচতে শিখলাম। কেমন করে তার সাথে দুটো বছর চলে গেল টেরই পেলাম না। দুটো বছরের সুখ দিয়ে তোমার বোন আমার থেকে আড়াই বছরের সুখ কেড়ে নিলো নোমান। পাষাণী!
দুটো পুরুষ মন খুলে নিজেদের মনের কথা বলে যাচ্ছে। আজ রাত যেন তাদের জন্যই শহর টা কে ঘুমন্ত রেখেছে। কোনো মানুষ জন নেই, নেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ, চারদিক শুধু নিশ্চুপতা ও শূণ্যতা। আহিশ আবার বললো,
~ ছলনাময়ী নারীর ভালোবাসায় নিজেকে কখনো হারিয়ো না নোমান। ছিন্ন ভিন্ন করে তোমার জীবনের সুখ কেড়ে নিয়ে দূর থেকে হাসবে! সেই হাসির শব্দ জ্বলন ধরাবে, মৃত্যুর স্বাদ জাগাবে। আবার কোথাও যেন আটকে দিবে! দুর্বিষহ করে দিবে!
শরীরে কাঁপুনি টের পেল নোমান। হারাবে না? সে তো কবেই হারিয়ে ফেলেছে। প্রাণভোমরা’র ভালোবাসায় সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। এর থেকে পরিত্রাণ হয়তো সম্ভব নয়। সম্ভব নয় মুক্তির স্বাদ পাওয়া! হয় ভালোবাসা অর্জন করো, নাহয় দুঃখ কে বরণ করে নাও। চাপা শ্বাস টা আটকে রাখলো না নোমান। আহিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
~ পরবর্তী প্লেন কি?
~ নেই! শুধু দেখে যাবো। চলো!
কথা বলতে বলতে হসপিটালের সামনে এসে দাঁড়ালো আহিশ। নোমান কপাল কুঁচকে আহিশের দিকে তাকিয়ে রইলো। হসপিটাল কেন বুঝতে পারছে না। আহিশ কিছু বললো না, ইশারা করে হাঁটতে লাগলো ভেতরের দিক। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়াতেই আফরা কে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধক করে উঠলো নোমানের বুক। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখলো। নাহ, কোথাও তার ছোট বোন টা নেই। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আহিশের দিকে তাকাতেই মাথা নাড়ালো আহিশ। পড়ে যেতে নিয়েও নোমান সামলে নিলো নিজেকে। চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। আফরা’র এদিকে খেয়াল নেই। তার গাঢ় দৃষ্টি লাল বাতি টার দিকে। কখন নিভে যাবে, কখন ডক্টর বের হবে, আর কখন ভালো খবর টা সে পাবে।
জোর করে অনিচ্ছা পোষণ করেও , নিজের সাথে যুদ্ধ করেও হেরে গেল আফীফ। সেই তাকে বুকের ক্ষত নিয়ে নিচে নামতে হলো। ধীরে ধীরে পা ফেলে আফরা’র পাশে এসে দাঁড়ালো সে। আফরা কে দেখে মনে হচ্ছে না, দুনিয়ার কোনো কিছু তাকে স্পর্শ করছে। চাপা শ্বাস ফেলে আফরা হাত নিজের মুঠোয় পুরে নিলো আফীফ। চমকে গেল আফরা। ততক্ষণে আফীফ আফরা কে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা শরীর টা খানিক উষ্ণতা পেতেই আফরা দুম করে আফীফের সাথে চেপে বসলো। থতমত খেয়ে গেল আফীফ। পরক্ষণেই যখন বুঝতে পারলো মেয়েটার ঠান্ডা লাগছে। গলায় প্যাচানো উড়না মেলে দিলো শরীরে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি তে আফীফ কে দেখে চোখ বুজে নিলো আফরা। আহিশ, নোমান পুরো ঘটনা টাই লক্ষ্য করছিলো। আফীফ কে ঠিক চিনতে পারছে না। আহিশ কিছু বলবে তার আগেই নোমান নিজ আসন থেকে উঠে আফরা পাশে বসে। ধরা গলায় বলে উঠে,
~ কি হয়েছে মিরা’র !
~ গুলি লেগেছে!
কথাটা বলেই চোখ খুলে আফরা। নোমান কে দেখে কপাল কুঁচকে খানিক সরে বসে। এতক্ষণের আটকে রাখা জলের ধারা টা গড়িয়ে পড়ে গালে, নিজেকে শক্ত রাখতে পারে না নোমান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আহিশের দিকে তাকায় আফরা। চাপা গলায় আহিশ জবাব দেয়,
~ মিরা’র ভাই!
বড়সড় এক ধাক্কা খেল মনে হলো। দাঁড়িয়ে পড়েছে আফরা। অবিশ্বাস্য চোখে নোমানের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। সময় ব্যয় করলো না নোমান। দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো আফরা কে। ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বললো,
~ আমার মিরুর কিচ্ছু হবে না, বলো? মিহার মতো ওকেও হারাতে হবে না তো? আমি যে বেঁচেই আছি ওর জন্য। ও কি করে এতবড় রিস্ক নিলো? আমি কি নিয়ে বাঁচবো? কার জন্য এত লড়াই করছি? আমাকে নিঃস্ব করে সবাই চলে যাবে!
আমি একা পড়ে থাকবো এই স্বার্থপর দুনিয়ায়?
ভাইয়ের আহাজারি। এতক্ষণের ভেতরে জমা কান্না টা যেন রিলিফ পেল। বাঁধ ভাঙা পানি নোমানের ইউনিফর্ম ভিজিয়ে দিলো। বাম হাত তুলে নোমানের পিঠে রাখলো আফরা। জড়ানো কন্ঠে বললো,
~ কিচ্ছু হবে না মিরার। ও ঠিক হয়ে যাবে। শান্ত হোন আপনি।
এক মুহুর্তের ঘটনা গুলো শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে গেল আফীফের। জ্বলন ধরালো, ভেতর টা ছটফটিয়ে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো আফীফ। কিন্তু পারলো না। দু পা এগিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো আফরা’র হাত। বিস্ময় চাহনি তে আফীফের চোখে চোখ রাখলো আফরা। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাধ্য তার হলো না। সাহস হলো না আর পুরুষের বাহুতে জড়িয়ে থাকতে। নিজেকে কোনো রকম ছাড়িয়ে নিয়ে আফীফের মুঠো থেকে মুক্ত হলো। কপাল চেপে বসে রইলো চেয়ারে। পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে করিডরে। বিছানা আফীফ কে টানলেও এক চুল নড়ছে না সে। মনে হচ্ছে, সে চলে গেলেই ছেলেটা আবার আফরা’র মাঝে নিজের আশ্রয় খুঁজতে চাইবে। যা হতে দিতে তার মন বড়ই নারাজ। সময়ের স্রোতে ভেসে গেলেও মনের বাইরে সে কখনোই যায় না, যেতে পারে না। নিজেকে তখন মুখোশধারী মনে হয়। মনে হয় দু মুখো সাপের মতো ব্যবহার করছে সে। মন বলছে এক, সে করছে এক। নিজের আদর্শ ধরে রাখতেই হয়তো এমন দৃঢ়তা। সময় পেরিয়ে গেল দশমিনিট। ডক্টর এখনো বের হয়নি। এর মধ্যে নোমান শক্ত গলায় বলে উঠলো,
~ কি করে হলো?
~ ইট ছুঁড়লে পাটকেল খেতেই হবে। সে ছু*রির আঘাত করেছে বিনিময়ে বুলেটের আঘাত পেয়েছে। হিসেব বরাবর!
সরল কন্ঠস্বর। নোমান অবাক পানে চেয়ে রইলো। সে হয়তো আশা করেছিলো তীব্র আক্রোশ জন্ম নিবে আদিল মাহমুদের প্রতি, কোনোটাই সে পাচ্ছে না। নোমান আবার বললো,
~ বোনের ধ* র্ষক, খু* নী কে কিভাবে ট্রিট করবে?
হেসে উঠলো আফরা। আদিল মাহমুদের পরিবর্তে নিজে যেন তার স্বরূপ তুলে ধরছে এমন ভাবে বললো,
~ প্রতিপক্ষ কে কিভাবে ট্রিট করবে?
~ তুমি শত্রুর হয়ে কথা বলছো আফরা।
পেছন থেকে আহিশের গলা শোনা গেল। শত্রু? শত্রুই বটে। তবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী, শত্রু নয়! চেয়ারে মাথা এলিয়ে বললো,
~ ধ্রুব সত্যি কথা বলছি। আমি কখনোই আমার প্রতিপক্ষ কে আঘাত করে আলো বাতাসে ঘুরতে দিবো না। আদিল মাহমুদ ও দেয় নি। আঘাতের বিনিময়ে আঘাত করেছে। মিরা যেমন গাঁ বাঁচিয়ে আঘাত করেছে, আদিলও তেমন গাঁ বাঁচিয়ে আঘাত করেছে। আমি এতে ভুল কিছু দেখছি না মি. আহিশ!
~ একজন ধ*র্ষক, খু* নীর সাথে তুমি নিজেকে তুলনা করছো?
নোমানের তেজী গলা। আফরা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নোমান যদি মিরা’র ভাই না হতো, তাহলে হয়তো এখন দু চারটে থাপ্পড় পড়ে যেত। অযহত চিৎকার চেঁচামেচি মোটেও সহ্য হয় না তার। তবে এখন হজম করে নিলো। দৃঢ় গলায় বললো,
~ তুলনা? আমার সাথে কারো তুলনা হয় বুঝি? খু* নী? সে তো আমিও মেরেছি, পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে ওই রাতে যে গার্ড টিকে আঘাত করেছিলাম, শুনেছি ম* রে গেছে। পার্থক্য কই থাকলো? এখন আসি পরের কথায়, স্বয়ং আদিল মাহমুদ যদি নিজে এসে বলে সে ধ* র্ষক, আমি বিশ্বাস করবো না!
বো* মা ফাটার মতো পরিবেশ হলো। তিন জোড়া চোখ বিস্মিত। আফরা তবুও দৃঢ়তার সহিত বসে আছে। একজন প্রতিপক্ষের প্রতি এমন বিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছে তিনজন পুরুষ কে। আহিশ বসলো চুপচাপ। গম্ভীর কন্ঠে শুধালো,
~ তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছো?
~ আমি কিছুই বুঝাতে চাচ্ছি না মি. আহিশ! প্রতিপক্ষ আমরা আপনাকেও ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম মিহার খু* নের সাথে আপনিও জড়িত। কিন্তু সত্যি কি তাই? স্রেফ আপনি শুধু হারিয়েছেন, ক্ষত পেয়েছেন। তাহলে? যে আদিল মাহমুদ অনল মাহমুদ নামক মানুষ টাকে ছাড়া একটা শব্দ ব্যবহার করে না, সেই আদিল মাহমুদ বাবাকেই মুখের উপর রিজেক্ট করে দেয়। প্রতি রাতে সুন্দরী মেয়েদের মেলা বসতো হোটেলে, একটা রাতেও পা মাড়ায় নি আদিল। না পেরে বাংলোতে পাঠালো, দুটো লাশ পড়ে গেল! হি কলড দেম লাইক এ স্ট্রিট গার্ল! কি ঘৃণা মিশ্রিত শব্দ ভেবেছেন? তার পর এলো আপনার পাঠানো আসমানী! গভীর রাতে অচেতন এক সুন্দরী রমনী, কে ছিলো না করার? শুধু মাত্র নিজের স্বার্থে একটু ছুঁয়ে বাংলো তে নিয়ে এসেছিল। বোন কে খবর দিয়ে ওই রাতেই নিজ বাংলো থেকে ভাগিয়েছে!
আপনাদের ভাবনা’র সাথে আমার ভাবনা কখনোই পড়বে না। নিজেদের মস্ত বড় খেলোয়াড় ভেবে থাকলে বলবো, আপনারা ভুল! এখন পর্যন্ত খেলার দিক টাই আপনারা ধরতে পারেন নি!
কথাগুলো ঘুরে ফিরে তিন পুরুষের কানেই ধাক্কা খাচ্ছিলো। রহস্যময়ী মেয়েটির চিন্তা ধারা তিনটে পুরুষ কেই অবাক করে দিয়েছে। নোমান, আহিশ মাথা নিচু করে ভাবছে তাদের ভুল গুলো। আফরা দুজনের দিকে একপলক তাকালো। তারপর অপারেশন থিয়েটারের দরজার তাকিয়ে বললো,
~ চারটে বছর ধরে মাহমুদ পরিবার কে আমি ফলো করছি। মাটির নিচে থাকা তথ্যও খুঁজে বের করেছি হাতড়ে হাতড়ে। মিহার যখন এক্সিডেন্ট হয়, নাদিয়া হসপিটাল নিয়ে আসে। মিরা ছুটে আসে বোনের কাছে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা হয়, এসময় আদিল মাহমুদের প্রেমে পড়ে মিরা। বড়লোকের প্রেম নিয়ে সংশয় হলেও নিজেকে দমাতে পারে নি। নিয়মিত চিঠি পাঠাতো, বোকা মিরার বোকা বোকা কথায় আদিল মাহমুদ টলতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো মিরার মাঝে সে ক্ষমতা ছিলো। চলছিলো তাদের বেনামি চিঠির প্রেম। অনল মাহমুদের কাছে খবর পৌঁছে যায়। আদিলের পরিবর্তন তার বিপদ ডেকে আনতো ভেবে, ছুটে আসে হসপিটাল।
তখনি জানতে পারে তার সদ্য জন্ম হওয়া শত্রু মোহনলাল শিকদারের দুই মেয়ে তার হসপিটালে। প্রি প্লেন করে মিহার শরীরে ভুল ইনজেকশন পুশ করা হয়। অপারেশনের নাম করে অনল মাহমুদ, আশরাফ উদ্দিন, আতিকুর, এখানের দু ডক্টর; পাঁচ নরপশু মিলে গণ ধ* র্ষণ করে। অনল মাহমুদের ক্ষোভ ছিলো, মোহনলালের কষ্ট দেখতে চেয়েছিল। প্রাণে মারেনি। আদিল মাহমুদ জানতো, জানতো বাবার নির্মমতা’র কথা। ওসব তার কাছে নতুন হয়, কিন্তু প্রত্যক্ষ ভাবে সে কখনোই জড়িত ছিলো না। তার অন্যায় ছিলো একটাই নিরব সম্মতি দিয়ে প্রতিবাদ করেনি। সে যে পরিবেশে বড় হয়েছে, যেভাবে বড় হয়েছে আমি তার দিক থেকে ভুল দেখেনি। জন্মের পর থেকে সে ওসবই দেখে আসছে। হয়তো মিরা’র পরিচয় জানলে কিছুতেই হতে দিতো না। কঠোর, নষ্ট আদিল মাহমুদের ভালোবাসায় আঙুল তোলার সাহস আমার নেই।
থামলো আফরা। জোরে শ্বাস নিলো। আবার বললো,
~ এক্ষেত্রে আপনারও ভুল নেই মি. আহিশ। আমি যে ডক্টরের কাছে সব খবর জেনেছি, আপনিই তাকে হত্যা করেছিলেন না? কথা দিয়েছিলাম সব সত্য বললে প্রাণে মারবো না, আপনি মেরে ইচ্ছে টা পূর্ণ করে দিয়েছেন। লোকটা ভয়ে এমন ভাবে কথাগুলো এলোমেলো বলছিলো, আদিল মাহমুদ কে দোষী যে কেউ ভাববে। নাদিয়া কে নিজের দলে টানা, সব খবরাখবর রাখা, সবই আমার জানা ছিলো। কিন্তু আপনি জানতেন না নাদিয়া শুধু আপনাকে ভালোবাসে বলে এক কথায় বাবার বিরুদ্ধে রাজি হয়েছিলো। আপনি এও জানতেন না আপনাদের লুকিয়ে বিয়ের খবর আপনার বাবা ভাই জেনে গিয়েছিল। ছেলে আরো হাতছাড়া হয়ে গেল তারও আশ মিটিয়ে নিয়েছে। মোহনলালের উপর খবরাখবর রাখতে আশরাফ উদ্দিনের নজর পড়ে আসমানীর উপর। সৎ মা কিন্তু ওকে বাঁচাতেই বিয়েটা দিয়েছিল, হয়তো লোভ ও ছিলো। সেখান থেকে আপনি আসমানী কে ব্যবহার করলেন। ট্যুরের নাম করে নিজের কাছে নিলেন। পড়িয়ে শিখিয়ে নিলেন, তারপর আদিলের কাছে পাঠালেন। আজকে চূড়ান্ত বদলা নিতে গিয়েও আপনি অসফল!
হাঁপিয়ে যায় নি আফরা। আজ অনেক কিছু বলার আছে তার। দরজা থেকে চোখ সরায় নি সে। চাপা দম টা নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
~ আপনি তখন মিশনে ছিলেন নোমান। মেয়েটা চরম ভাবে ভেঙে পড়েছিল মিহার আত্মহত্যা’র পর। আমি হাত ধরেছিলাম। একটু একটু করে বোকা সহজ সরল মেয়েটা কঠোর, বুদ্ধিমতি করে তুলেছিলাম। জানিয়েছিলাম নির্মম সত্য। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়েছিলাম কিছু। আদিল হয়তো প্রত্যক্ষ দোষী নয় কিন্তু সে দোষী। কোনো মেয়েই চাইবে না বোনের ধর্ষকের ছেলে কে জীবনে গ্রহণ করতে। আমার আদিলের সাথে কোনো শত্রুতা নেই, আমার শুধু অনল মাহমুদ কে দরকার। আমি সীমাবদ্ধতায় ফেঁসেছিলাম। কঠোর বুদ্ধি, খানিক শক্তি, দুটো অস্ত্র ছাড়া আমার কিছুই নেই। যার ফলস্বরূপ আমি আপনাদের ব্যবহার করেছি। আদিল কেও ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে ভাবলাম ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওয়া কষ্ট হয়তো একটু বেশী। আদিল কে ছেড়ে দিলাম মিরা’র উপর। এখন আমি অপেক্ষা করছি শুধু মাত্র অনল মাহমুদের জন্য! তার মৃত্যুই হয়তো এতসব খেলা খেলোয়াড়ের সমাপ্তি ঘটাতো। কিন্তু আমার যে তাকে জীবিত চাই, একদম স্বাভাবিক ভাবে আমার কব্জায় চাই তাকে। নাহলে এত বছরের পরিশ্রম একটুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে! আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো!
নড়েচড়ে উঠলো আফীফ। মেয়েটা সুক্ষ্ম ভাবে তার নামটা এড়িয়েও তাকে এড়ায় নি। ইমপ্রেস হয়েছে বেশ। একটা মেয়ে কতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, আজকের দিনে না দাঁড়ালে জানতোই না সে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, নিঃশব্দে বসলো। আফরা একপলক তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এমন সময় নোমান গমগম কন্ঠে বললো,
~ তুমি কেন এতসব করছো?
~ জেনেও প্রশ্ন করছেন কেন? আপনার বা মি. আহিশের জানার বাইরে নেই অথৈ। মিরা যে লোক গুলো কে তার লোক বলে দাবী করতো তা যে আপনি বেশ বুঝতে পারছি। অথৈ কে প্রটেক্ট করার জন্য কৃতজ্ঞ আমি। তবে আপনি না থাকলেও কিছু হতো না, অথৈর বড় আপু বেঁচে আছে এখনো। এবার কথা, মি. আহিশের। আঁখি কে কব্জা করে বেশ তো ইনফরমেশন নিলেন, কিন্তু অনিক কে মাহমুদ বাড়ির বাইরে এনে কিছুই করতে পারেন নি। মাহমুদ দের জন্য যেমন সে মৃত আমার বা আমার বোনের জন্যও সে মৃত। আমার বোনের কাছ ঘেঁষানোর চেষ্টা করবেন না। আমি মেয়ে বড্ড খারাপ। কাউকে পরোয়া করবো না। সে হোক নির্দোষ আপনি, হোক অবলা আসমানী বা পাগল অনিক!
কড়া চোখে তাকালো আহিশের দিকে। আহিশ মুচকি হাসলো। সে হাসি আফরা’র গাঁয়ে জ্বলন ধরালো যেন। শক্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
~ প্রয়োজনে আমি প্রচন্ড খারাপ, প্রয়োজনে আমি রণচন্ডী আবার প্রয়োজনে আমি মমতাময়ী। প্রয়োজনের তাগিদে আমি সব হতে পারি। তাই আমাকে নিজের শত্রু বানিয়ে ভুল করবেন না, এখনো চিনতে পারেন নি!
আফরা আর বসে থাকতে পারলো না। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। ধুলো মেশানো সাদা ফ্রক, জড়ানো উড়না, মাথায় মস্ত বড় খোঁপা; রহস্যময়ী মেয়েটাকে অদ্ভুত আকর্ষণীয় লাগছে। যা আফীফ মুনতাসির কে উঠতে বাধ্য করলো। সমান পায়ে পিছু পিছু উপরে উঠে এলো সে। আকাশ দেখছে আফরা। চোখের কার্নিশে জলের ছিটে। নিঃশব্দে পাশে দাঁড়ালো আফীফ। যেন ভরসা হতে চাইছে। আফরা সরাসরি আফীফের চোখে চোখ রাখলো। বড় পাপড়ি বিশিষ্ট ছোট চোখ দুটোতে প্রশ্ন। আফরা যেন স্পষ্ট ওই চোখের ভাষা বুঝতে পারলো। ওই চোখ যেন তাকে শুধাচ্ছে, ভালোবাসেন আদিল মাহমুদ কে? ভালোবাসেন নোমান কে? বা ভালোবাসার মানুষ কি রয়েছে? সামনের পুরুষ টির চোখের ভাষা পড়তে পেরে কিঞ্চিৎ আনন্দ অনুভব করলো আফরা। মুচকি হাসলো চোখে চোখ রেখেই। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিমায় শক্ত কিছু বুলি আওড়ালো,
কংক্রিটের বুকে ভেসে থাকা ধুলো আমি। মনে হয় কংক্রিটের বুকে মিশে আছি। তবে একটু হাওয়া, কোথায় সেই মিশে থাকা?
জ্ঞান ফিরেছে মিরার। কিছুক্ষণ হলো। ক্ষতি বেশী হয় নি। ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত বিছানা থেকে নামতে পারবে না এই যা। কাত হয়ে শুয়ে আছে মিরা। সম্মুখে বসে আছে আফরা। গম্ভীর তার মুখশ্রী। নোমান হসপিটাল ছেড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। সন্দেহের মাঝে পড়তে চায় না বলেই বোন কে না দেখেই ছুটতে হয়েছে তাকে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সূর্য আগের দিনের মতোই উঁকি দিচ্ছে। অনেক টা সময় চুপ থাকার পর আফরা গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
~ বোকামি টা না করলে হতো না?
বন্ধ চোখের পাতা কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো। মুচকি হাসলো মিরা। চোখ বন্ধ করেই পাল্টা প্রশ্ন করলো,
~ কেমন আছে?
কাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটি করা হয়েছে আফরা বুঝেছে। তবে নিজের প্রশ্নের জবাব না পাওয়ায় পাল্টা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো না। মিরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। উত্তর না আসায় জেদী মেয়ের নিকট আত্মসমর্পণের ভঙ্গিমায় বলে উঠলো,
~ মাঝে মাঝে বোকামির ফল কিছুটা আনন্দদায়ক হয়, মনের স্বস্তি!
~ মি. আহিশের কথা শুনেই তো এমন বোকামি? এতটা অবিশ্বাস?
চোখ খুললো মিরা। ওই চোখের ভাষা আফরা বুঝলো না। মিরা সময় ব্যয় না করে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,
~ তোর কি মনে হয়? মি. আহিশ আমাকে প্রভাবিত করতে পেরেছে বা পারে?
আফরা জবাব দেওয়ার সুযোগ পেল না। মিরা নিজের মতো বললো,
~ সকাল টা সুন্দর ছিলো, ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলাম আজ ডাক্তার রাত পর্যন্ত হসপিটাল থাকবে। প্রত্যেক দিন আধ বেলা করে তিন হসপিটাল থাকতো। সারাটা দিন চোখের সামনে থাকবে, খুশিতে আটখানা ছিলাম। খুশিতে ভাটা পড়লো আপাইয়ের অসুস্থতায়। ডাক্তার রা সাত পাঁচ বুঝিয়ে তৎক্ষণাৎ অপারেশন রুমে নিয়ে গেল, বাবা কে খবর দেওয়ার সুযোগই পেলাম না। নার্স এসে খবর দিলো রক্ত লাগবে, যা এই হসপিটালে নেই। ছুটে গেলাম অন্য হসপিটালে। তিন ঘন্টা সময় লেগেছে। এই তিনটা ঘন্টা ওরা আমার বোনের উপর পাশবিক নির্যাতন করেছে। পাশের কেবিন টা ছিলো ডাক্তারের পার্সোনাল কেবিন। আমার বোনের আত্মচিৎকার, সম্মান বাঁচানোর ছটফটানি, শত অনুরোধ, নরপশুদের আনন্দ উল্লাস সবটাই ডাক্তারের কানে পৌঁছেছে।
নির্জনতায় বসে আদিল মাহমুদ শ্রবণ করেছে। চোখ দিয়ে না দেখলেও আদিল মাহমুদ সাক্ষী ছিল। একটা মেয়ের আহাজারি তাকে স্বাভাবিক রেখেছিল। একবারো মনে হয়নি ওই মেয়েটা তার বোন হতে পারতো, ওই মেয়েটা ওর ভালোবাসা রাজনন্দিনী হতে পারতো। একবারো মনে হয় নি কিন্তু। বুক কাঁপে নি তার। সেই হৃদপিন্ড মিরার নামে স্পন্দন নেয়, সেই বুকে মিরার নাম খুদায় করা। অথচ সেই বুকে ছু* রি চালানোর অধিকার মিরা’র নেই! কেন? অধিকার আদায় মিরা শিকদার করতে পারে! ধ*র্ষণ না করেও আমার কাছে আদিল মাহমুদ ধ*র্ষক! আমার বোনের খু*নী! আমার বাবা কিন্তু ধর্ষ*ক নয়, নয় মেয়ের খু*নী! সে শুধু মাধ্যম ছিল, তবুও তাকে মরতে হয়েছে। হাসতে হয়েছে মেয়ের বুলেটের আঘাত পেয়েও।আদিল মাহমুদ ব্যতিক্রম হবে কেন? আলাদা বুঝি? আবার দেখ, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বোনের খু* নী কেই ভালোবাসতে বাধ্য করে!
চোখ বুজে নিলো মিরা। অনুভূতি শূণ্য সে। এত এত চরম সত্যি, বুকের ক্ষত’র কথা অনায়েসেই বলে গেল মেয়েটি, চোখে কোনো ছাপ নেই! হয়তো আছে, আফরা ধরতে পারছে না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলো আফরা। তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললো,
~ তোর ভাই এসেছিল!
~ আমি তোকে আমার ভাইয়ের থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম। চাইনি, আমার ভাইয়ের একপাক্ষিক প্রেম তোকে বিব্রত করুক, তোর আর আমার সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করুক। চাইনি কাছে এসে আমার ভাই পুড়ুক। কিন্তু দেখ ভাগ্য আবারো আমাদের নৃত্য করিয়ে ছাড়লো। সেই দেখা হলো, জানা হলো, পুড়েছেও মনে হয়!
মেয়েটা আজ এত শক্ত কথা বলছে কেন? গমগম করে পুরো কথা বলে যাচ্ছে। আফরা ভেতরের দীর্ঘশ্বাস কে গোপনে রাখলো। মুচকি হেসে বললো,
~ বন্ধন ভাঙা এত সহজ?
~ সহজ তো! কোনো দিন ভেবেছিলাম তোর আমার দেখা হবে? হয়েছে তো? ভাবনার বাইরে অনেক কিছু হয়!
থামলো মিরা। হাঁপিয়ে গেছে কথা বলে। মিনিট খানেক চুপ থেকে আবার বলে উঠলো,
~ ভাঙা গড়ার মাঝেই দুনিয়া! চড়াই উৎরাই’র মাঝেই জীবন! আমরা তো শুধু নিছক আবেগ! অভিনয় করতে করতে শেষ চলে আসে, তবুও রঙ্গমঞ্চের রঙ হারায় না!
আফরা উঠে দাঁড়ালো। ডক্টর বলেছে বেশী কথা না বলতে। অনেক বলে ফেলেছে। দরজা পর্যন্ত এসে শান্ত গলায় বললো,
~ সে ভালো আছে!
আফরা দেখলো অসুস্থ মেয়েটার মুখের আঁধার কিছুটা কেটে গেল। আর দাঁড়ালো না সে। বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে এলো। ভালোবাসা বড়ই জটিল! জটিল তাদের প্রকাশ। এসব তার জন্য নয়!
নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে আদিল। শূণ্য দৃষ্টি তার ঘরের ছাদে। অনুভূতি হীন নির্মল চোখ, নিঃশ্বাসের ধাকে ক্ষত বুকটা উঠানামা করছে। জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ। শুয়ে থেকেও যেন সে শুয়ে ছিলো না। জ্ঞান ফেরার পরপরই যে খবর টি তার কানে পৌঁছেছে, এর পর আর চুপচাপ থাকতে পারে নি। ক্ষত বুকে আলাদা জ্বালা জুড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের ছাদ থেকে চোখ সরিয়ে দরজায় তাকালো আদিল। কেউ আসবে, এখনো আসছে না। বিরক্তির শ্বাস ফেললো আদিল। মানুষ টা উপরে শান্ত হলেও ভেতর বুঝবে না কেউ। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। তাকালো না সেদিকে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
~ এসো!
একটি শব্দ তিনটে মানুষ কে কেমন কাঁপিয়ে দিলো। ভেতরে ঢুকে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো তারা। লোকগুলো কে দেখেই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো আদিলের। উঠে বসার চেষ্টা করলো, তবে সে ব্যর্থ। বুকটা কেমন টনটন করে উঠলো। শুয়ে থেকেই প্রশ্ন করলো,
~ পরিকল্পনা কার?
উত্তর এলো না। মিনিট খানেক চুপ রইলো আদিল। আবার গমগম কন্ঠে বললো,
~ আদিল মাহমুদের খাচ্ছো, আদিল মাহমুদের টাকায় চলছো অথচ হুকুম পালন করছো অন্যকারো! ব্যাপার টা কেমন না? কে হুকুম করেছিলো আমার শিকারে হাত দেওয়ার! আন্সার মি!
শেষের বাক্য দুটো ততটা না কঠোর শুনালো, যতটা আদিলের চোখে ফুটে উঠেছে। রক্তিম চোখ ভয়ানক দৃষ্টি, লোক গুলোর মাথা নত না থাকলে হয়তো সাহস হতো না দাঁড়িয়ে থাকার। থরথর করে কেঁপে উঠলো তারা। বড়সড় ঢোক গিলে একজন বললো,
~ বস, প্রধান!
~ মবিন? কি বলেছিলো?
শান্ত স্বর। একটু আগে যে লোকটি ভয়ানক রেগে ছিলো এখন বুঝার উপায় নেই। আরেকজন উত্তর দিলো,
~ অপারেশন রুমে ঢুকে মেয়েটার মুখের ভেতর পি*স্তল ঢুকিয়ে খু* ন করতে বলেছিলো, বস!
একপলক তাকালো আদিল। ভয়মিশ্রিত কন্ঠ তার রাগ টাকে যেন দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। শান্ত, দৃঢ় কন্ঠে শুধালো,
~ ঠিক কোথায় কোথায় স্পর্শ করতে? গাল চেপে হা করাতে, তারপর মুখে ব* ন্দুক ঢুকাতে, এক্সট্রা পার্ট নিতে গেলে নিশ্চয়ই ঘাড় চেপে মাথা টা উপরে তুলতে? ভেরি গুড! তো কাকে বুলেট ঢুকানোর পারমিশন দিয়েছিল?
মোটাসোটা দেহের অধিকারী লোকটি এগিয়ে এলো কিছুটা। বাঁচার আশায় কাঁপা কন্ঠে বললো,
~ বস, আমরা প্রধান কে বলেছিলাম। কিন্তু সে বিশ্বাস করে নাই। আপনাকে আঘাত করছে দেখেই মারার কথা বলছিলো। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন বস। ভবিষ্যতে এমন ভুল হবে না!
~ তুমি নিশ্চয়ই আমার বর্ণনা মতো খু* নের পরিকল্পনা টা এভাবেই ভেবে রেখেছিলে?
ক্ষমা’র প্রসঙ্গে গেলই না আদিল। এবারের প্রশ্নে আরো ঘাবড়ে গেল লোকটি। ছলছল করছে চোখ, মৃত্যু যেন নিজের সম্মুখে টের পাচ্ছে। আদিলের প্রশ্নে মাথা নাড়াতেই আদিল দেরী করলো না এক মুহুর্ত! পকেট হাতড়ে রিভ* লবার হাতে তুলে বলে উঠলো,
~ চরম ভুল করেছো! আদিল মাহমুদের ব্যক্তিগত ফুলে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখানোর আগে তোমার আত্মহত্যা করা উচিত ছিলো। আমি হেল্পলেস!
তিনটে বাক্য মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ার পরপরই একটা বিকট শব্দ। ঘর যেন কেঁপে উঠলো। মোটাসোটা লোকটি বাম চেপে মাটিতে বসে কাতরাচ্ছে। সাদা ফ্লোর ইতিমধ্যে রক্তিম হয়ে উঠেছে। গোঙানিটা পছন্দ হলো না আদিলের। দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটো কে ইশারা করতেই লোক দুটো আহত লোকটাকে বের করে নিয়ে এলো কেবিন থেকে। পরক্ষণেই আরেকজন এসে রক্ত টা পরিষ্কার করে চলে গেল। নিস্তব্ধ রুম, চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নেয় আদিল। উত্তেজনায় বুকের ক্ষত তে টান লেগেছে। ডান হাত এগিয়ে এনে ক্ষত ছুঁয়ে দেয় আদিল। শিরশির করে পায়ে তলা, অদ্ভুত ব্যাথায় গলা শুকিয়ে আসে। ক্ষত তে হাত বুলাতে বুলাতে আনমনেই বলে উঠলো,
~ তোর নামের জায়গাটাতেই ছুরি বসালি, রাজনন্দিনী? নিষিদ্ধ তোর নামে, আমি জর্জরিত হলাম শত ব্যাথায়! নিষিদ্ধ তুই যে আমার আপন ক্ষত!
অনুভূতি হীন, কঠোর, নিষ্ঠুর আদিল মাহমুদ আজ জর্জরিত প্রিয়তমার আঘাতে! এমন পরিণতি তো হওয়ার ছিলো, তবুও কেন ক্ষীণ আশা মনে চেপে আছে। একটু হলেও মন ভাবতে বাধ্য করেছে। চাপা শ্বাস ফেলে রিভল* বার পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। তখনি দরজা খুলে কারোর ভেতরে আসার পায়ের শব্দ কানে এলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দিল দরজায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিভায় ভেতরে প্রবেশ করলো আফরা। টুল টেনে বসে মুচকি হাসলো। কৌতুক মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
~ দুটো বেড থাকলে ভালো হতো, আরেক টাকেও এখানে ফেলে রাখা যেত। দুই অচল মানুষ একসাথে থাকলে সময় ও ভালো কাটবে। কি বলুন মি. মাহমুদ? ভালো বলেছি না?
~ আপনি চাইলে আমরা তিনজনও হতে পারি! সময় তখন দ্বিগুণ ভালো কাটবে। কি বলুন মিস আফরা? ভালো বলেছি না?
ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট বাঁকালো আফরা। অসুস্থ তবুও তেজ হীন নয়। ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে থাকে জবাব। নিজেও বা কম কিসে। চাপা হেসে বললো,
~ তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকাতে চাচ্ছেন?
~ আদিল মাহমুদ কখনোই দু’জন ছিলো না! তৃতীয় ব্যক্তি আসবে কিভাবে?
মুচকি হাসলো আদিল। আফরা উঠে দাঁড়ালো। গমগম কন্ঠে বললো,
~ আপনার বাবা কে একটু সাবধান করে দিবেন। মিরার দিকে হাত বাড়ালে খপ করে সেই হাত ভেঙে দেওয়ার সাধ্যি আফরা ইবনাতের আছে!
বেরিয়ে এলো আফরা। আদিল কপাল কুঁচকে আফরা’র যাওয়া দেখলো। পরক্ষণেই ঠোঁট কামড়ে ভাবতে থাকলো কিছু। সে কি বিশ্বাস করে ঠকে যাচ্ছে?
নাকি খেলা চলছে অন্য রাউন্ডে?
আফীফের কেবিনে হূলস্থল কান্ড। ভোর থেকে দুটোই একে অপরের পেছনে লেগে আছে। কথায় কথায় ঝগড়া দুজনের স্বভাবে পরিনত হয়েছে। নিজ বেডে বসে রাগে ফুঁসছে জিয়াউল। পু্চকি একটা মেয়ে থাকে থাপ্প* ড়ের ভয় দেখায়! এটা যেন সে মানতেই পারছে না। বসের ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না সে। অন্যদিকে চুপচাপ বসে আছে অনান। একটু পর পর জিয়াউলের রাগ বাড়িয়ে দিয়ে গাঁ জ্বালানো হাসি দিচ্ছে। আফীফ সবই লক্ষ্য করেছে। তবে আজ দুজন কে থামানোর শক্তি পাচ্ছে না বা ইচ্ছে নেই। সকাল সাতটা হয়তো বাজে। একটু পরেই নার্স চলে আসবে খাবার, ঔষধ নিয়ে। কি একটা মনে করে উঠে দাঁড়ালো আফীফ। বালিশের নিচ থেকে ফোন টা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। দুজনে সুযোগ পেয়ে গেল যেন। জিয়াউল উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
~ এক থাপ্পড়ে মেয়ে শহর ঘুরিয়ে আনবো! তুমি জানো আমি তোমার কত বড়? তোমার সাহস হয় কি করে থাপ্পড় দেখানোর। অস* ভ্য আদিবাসী!
~ এই খবরদার আদিবাসী বলে ব্যঙ্গ করবেন না। তাদের মাঝে আপনাদের মতো ওত প্যাচ নেই। অস* ভ্য তো আপনি, বেয়া* দবের হাড্ডি।
তেড়ে এসে কথাটা বলতেই জিয়াউল হেসে উঠলো। অনান চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই হাসতে হাসতে বললো,
~ না প্যাচ থাকবে কেন? টাকার বিনিময়ে আদিল মাহমুদের চামচা হয়ে যায় আবার প্যাচ নেই। একদম চুপ থাকো আদিবাসী।
~ না জেনে কথা বলবেন না মি. খালেদা জিয়া। শুধু টাকার বিনিময়ে কেউ এতটা রিস্ক নেয় না। যে প্রতিবাদ করেছে তাকেই প্রাণ হারাতে হয়েছে। জীবন কি এতই ঠুমকো? কি করার ছিলো তাদের, দাসত্ব মানা ছাড়া? আপনি কিছু করতে পারছেন? হসপিটাল এসেই না আটকে আছেন। বাহাদুরি দেখাবেন না আমাকে। এই অনান কাউকে পরোয়া করে না।
একদমে কথা বলা শেষ করে বসলো অনান। মনটা অতিতের ডাক দিয়েছে। জিয়াউল নিশ্চুপ পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আঁধারে ঢাকা মুখটার দিকে। তারপর নিম্ন স্বরে বললো,
~ সরি আদিবাসী, আমি সেভাবে বলতে চাইনি!
চোখ রাঙিয়ে তাকালো অনান। জিয়াউল কিছুটা থতমত খেয়ে মুখ ছোট করে দৃষ্টি ঘুরালো। অনান নিঃশব্দে হেসে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ কোবাং ছোয়!
এই সময় টা প্রকৃতির মাঝে শরীর চর্চায় ব্যস্ত থাকেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। তবে মন টা আজ খুব আনমনা হয়ে আছে। অনেক দিন ছেলের সাথে কথা হয়নি, দু দিন ধরে জিয়াউল টাও তাকে ফোন করছে না। সাহস করে আগ বাড়িয়ে ফোন দিতেও পারছেন না তিনি। কোন অবস্থায় আছে কে জানে? ভেবেছিলেন আজ ফোন না এলে ছোট্ট একটি বার্তা পাঠাবেন। তবে তার অপেক্ষার অবসান সকালেই হলো। ছেলের ফোন পেয়ে কিঞ্চিৎ সময় ও অপচয় করলেন না। রিসিভ করেই বলে উঠলেন,
~ ঠিক আছো আব্বা?
~ সে আমি ঠিক আছি আব্বু? তবে তোমাকে ইমিডিয়েট বান্দরবান আসতে হবে। ঠিকানা সেন্ড করে দিবো, সরাসরি সেখানে চলে যাবে। একা!
বিচলিত হলেন নুরুল আলম সিদ্দিকী। বান্দরবান! নামটা শুনেই শরীর কেমন কেঁপে উঠলো। ছেলেকে বুঝতে না দিয়ে প্রশ্ন করলেন,
~ এনিথিং রং আফীফ?
~ এখানে ঠিক টা কোথায় আব্বু? নতুন করে বেঠিক খুঁজে কোনো ফায়দা নেই। আমি রাখছি, চলে এসো! সাবধানে আসবে, একা!
ফোন কেটে দিয়ে ফুস করে শ্বাস ছাড়লো আফীফ। পরিকল্পনা টা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ঠিক করলো কিনা তা আজ রাতে বুঝা যাবে। এই সময় টুকু কতটা উত্তেজনায় থাকতে হবে কে জানে! ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আফীফ কোনো দিক না তাকিয়েই বাইরে চলে যায়। হসপিটাল থেকে রিলিজ ফর্ম তুলতে হবে। রিসিপশন পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না আফীফের। আফরা’র মুখোমুখি হয়ে গেল। মেয়েটা এখনো সেই সাদা, ময়লা ড্রেসেই রয়েছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আফীফ এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
~ ফ্রেশ হোন নি নিশ্চয়ই?
করিডরে দাঁড়িয়ে বাইরের মানুষের আনাগোনা দেখছিল আফরা। কেউ কেউ প্রিয়জন দের দেখতে আসছে, কেউ বা প্রিয় জনদের হারিয়ে চলে যাচ্ছে, আবার কেউ কর্মক্ষেত্রে। সব তলার মানুষের আনাগোনা, কোনো ভেদাভেদ নেই। ভেদাভেদ নেই বলা হয়তো ঠিক হবে না। পোশাক আর হসপিটালের বেড দেখেই ভোদাভেদ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। নানান আনমনা ভাবনার মাঝে কারো কন্ঠস্বর অবাক করেছে তাকে। আফীফ কে দেখে নিম্ন স্বরে জবাব দেয়,
~ প্রয়োজন মনে হয়নি!
~ যে নিজের খেয়াল রাখতে পারে না, আমি তাকে শত্রুর খেয়াল রাখার উপযুক্ত মনে করি না, মিস আফরা!
ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো আফরা। আফীফ কেন আগ বাড়িয়ে এত কথা বলছে সে বুঝতে পারছে না। তবে ঠেস দেওয়া টা ঠিক ধরতে পেরেছে। কাট কাট গলায় বলে উঠলো,
~ আপনার মনে করায় বা না করায় আফরা ইবনাতের কিছু যায় আসে না মি. আফীফ মুনতাসির। শত্রুর খেয়াল ঠিক কিভাবে রাখতে হয় আমার জানা!
উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরে আফরা। নিজেকে খানিক বিধ্বস্ত লাগছে। এলোমেলো পায়ের ভাঁজ দেখে আফীফ মুচকি হাসে। কয়েক পা এগিয়ে হাত চেপে ধরে খানিক ঝুঁকে পড়ে আফরা’র দিকে। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও আফীফের আচরণে শক্ত হয়ে আসে আফরা’র দৃষ্টি। আফীফ তোয়াক্কা করে না। গমগম কন্ঠে বলে উঠে,
~ এই মেয়ে আফীফ মুনতাসির কে এখনো চিনিস নি! এখন থেকে চিনবি! মুখশ্রী টা বুক মাঝারে ধারণ করবি। এমন ভাবে গেঁথে রাখবি, আমার বুলেট তোর বুক ঝাঁঝরা করলেও আফীফ মুনতাসির নামক মানুষ টির কোনো রকম স্থানচ্যুত না হয়!
মি. মুখার্জি নিজ কেবিনে বসে আছেন। চোখে মুখে তীব্র চিন্তাবোধ। খানিক পর পর পাইচারি করছেন, আবার বসে কিছু ভাবছেন। ঠিক সুরাহা হচ্ছে না। এতটা অস্থির তার কখনোই লাগে নি। কর্ম জীবনে ৩২ টা বছর চলে গেল। সন্তান হীন সুখী দাম্পত্য জীবন! সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় অনেক ডক্টরের পেছনে সময় ব্যয় করেছেন তিনি। যখন জানতে পারলেন তাঁর স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম! ডক্টরের পেছনে ঘুরাটাও বাদ দিয়েছিলেন। অস্বস্থি জীবন থেকে বের হয়ে স্ত্রী কে নিয়ে বেশ আছেন। যদিও বা অনেক বার স্ত্রী তাকে বিয়ের অনুমতি দিয়েছিল, সন্তানের জন্য ভালোবাসা হারাতে চায় নি! মেয়েটা তার হাত ধরে পরিবার ছেড়েছিল, মন্দিরে বিয়ে করে তার হয়েছিল; শুধু সন্তানের জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া যায়? দিব্যি সুখে আছেন। সেই সুখ বুঝি সহ্য হলো না বিধাতার! শেষ বয়সে অশান্তি ডেকে আনলেন।
টেবিলে দুটো ফাইল! রিপোর্ট! বার বার চোখ বুলাচ্ছেন তিনি, কোথাও ভুল খোঁজার চেষ্টা করছেন; তিন তিন বার পরীক্ষা করিয়েছেন। ওই একই! টেবিলের উপর থাকা পানির গ্লাস টি হাতে তুলে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করলেন। শক্ত হাতে রিপোর্ট তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ফর্সা গালের নরম মাংস টা খানিক কেঁপে উঠলো। কেবিন থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলেন তিনি। বছর কয়েক আগের কিছু কথা মস্তিষ্কে ঘুরা ফেরা করছে। মনে হতেই তিনি টের পেলেন অস্বস্থি টা তার কেটে যাচ্ছে, কোথাও এক জেদ থেকে কিঞ্চিৎ আনন্দ অনুভব করছেন তিনি। খানিক উত্তেজিতও হলেন। মনে মনে সাজিয়ে নিলেন ঠিক কিভাবে কিভাবে বলবেন। গন্তব্যে পৌঁছে জোরে শ্বাস নিয়ে দরজায় টোকা দিলেন। অনুমতি এলো, ভেতরে ঢুকলেন তিনি।
আদিল আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো। হাতে ফোন, কিছু একটা করছিলো। মি. মুখার্জি কে দেখে কপাল কুঁচকে কিছু ভাবলো। পরক্ষণেই নাদিয়ার কথা মনে হতেই গম্ভীর স্বরে বললেন,
~ আপনার আরো আগে আসা উচিত ছিলো মি. মুখার্জি!
~ আমাকে সময়জ্ঞান না শিখিয়ে, আপনার উচিত ছিলো স্থান বুঝে কাজকর্ম করা। এটা হসপিটাল আপনাদের কষাইখানা নয় নিশ্চয়ই!
বসলেন না মি. মুখার্জি। গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বলেই রিপোর্ট খুললেন। আদিল মুচকি হাসলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
~ আপনার সাহস টা আমার বরাবরই ভালো লাগে মি. মুখার্জি!
~ না লাগলেও কিছু করার নেই মি. মাহমুদ! আমাকে ভয় দেখিয়ে আপনার কোনো লাভ নেই! না জীবনের চরম সত্য তে আমার কোনো ভয় আছে!
~ কাজের কথায় আসুন! বাক্যযুদ্ধের আগে আমার বোনের কন্ডিশন জানা আবশ্যক!
~ আপনাকে একটু উপরে যেতে হবে। পারবেন হাঁটতে নাকি হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করবো?
আদিল উঠে দাঁড়ালো। বুকের ক্ষতই কেমন টনটন করে উঠলো। একটু দাঁড়িয়ে ব্যাথা টা হজম করে বলে উঠলো,
~ যতক্ষণ নিঃশ্বাস চলবে, অন্যের উপর নির্ভরশীলতা কখনোই আদিল মাহমুদ কে ছুঁতে পারবে না!
বলেই হাঁটা ধরলো আদিল। মি. মুখার্জি গম্ভীর মুখে তাকে অনুসরণ করলেন। তাঁর কাছে আদিল মাহমুদ মানেই অধরা। অনেক সময় মনে হয় শক্তপোক্ত কঠোর মনের আড়ালে অধরা এক স্বচ্ছ মন রয়েছে, আবার কখনো মনে হয় পশুর থেকেও অধম! এতবছর দেখেও ঠিক চিনে উঠতে পারেননি নি। যদিও তার কাম্য নয়!
চোখ বুজে শুয়ে আছে নাদিয়া। শরীরে জ্বরের প্রভাব এখন নেই। তবে শরীর এতটা দুর্বল একা উঠতে পারছে না। তার উপর তেতো স্বাদ, মুখের লালা টাও বিশ্রি লাগছে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে নাদিয়া। ভাই কে দেখে মুচকি হাসার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। ঠোঁট নাড়াতেও যেন কষ্টকর। আদিল এসেই টুলে বসে পড়ে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হাঁপিয়ে গেছে সে। ডক্টর রিপোর্ট রেখে নাদিয়ার কাছে বসে। নরম সুরে বলে,
~ মিস. নাদিয়া, কথা বলতে পারবেন?
নাদিয়া মাথা নেড়ে সাথে সাথে জবাব দেয় ,
~ হ্যাঁ! কিন্তু আমার কি হয়েছে? কে এনেছে হাসপাতালে? এক্সিডেন্ট হয়েছিল আমার?
অবুঝপানা কথা শুনে আদিলের কপাল কুঁচকে আসে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় নাদিয়ার জ্ঞান ছিলো, আদিলের স্পষ্ট মনে আছে। তাহলে এমন কথা কেন বলছে? মি. মুখার্জি চাপা শ্বাস ফেলে বলে,
~ আপনার মনে নেই? আপনার ভাইয়া এনেছে, জ্বরে পড়েছিলেন। হঠাৎ জ্বর এলো নাকি এর আগেও জ্বর হতো বা অন্য কোন অসুখ?
~ আমার জ্বর? কই কোনো দিন তো আসে নি। না না, মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগতো। পেটে ব্যাথা হতো, গাঁ গুলিয়ে আসতো তার পরেই বমি পেতো খুব। কিন্তু মদ খেলে ভালো লাগতো।
মাথা নাড়ালেন ডক্টর। উঠে দাঁড়িয়ে আদিল কে ইশারা করলেন বাইরে যেতে। আদিল উঠে দাঁড়ালো। দু পা এগিয়ে এসে নাদিয়ার মাথা হাত রাখলো অতি সন্তর্পণে। সাথে সাথে হাত তুলে ইতস্তত ভঙ্গিমায় বাইরে চলে এলো। মি. মুখার্জি মিষ্টি হেসে বললেন,
~ আপনি ঘুমান, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন!
ইতস্তত ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ালো নাদিয়া। ডক্টরের হাব ভাব তার মোটেও ভালো ঠেকছে না। মি. মুখার্জি বাইরে এসে দেখলেন আদিল দাঁড়িয়ে আছে এক কেবিনের জানালার পাশে। উঁকি দিয়ে কিছু দেখছে। কৌতুহল বশত এগিয়ে যেতে নিয়েও থেমে গেলেন তিনি। ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। কেবিনে কে আছে তার জানা। বিব্রত করতে চাইলেন না আদিল কে। আবার সমস্যা টা গুরত্বর!
ঘুমন্ত মিরা’র মুখশ্রী কতটা স্নিগ্ধ লাগছে! নেই কোনো জটিলতা,কুটিলতা; শুধু এক সোনালি আভা। বেশীক্ষণ তাকালো না আদিল। নিষিদ্ধ জিনিসের জোঁক বড়, অথচ মন জানে নিষিদ্ধ তা নিষিদ্ধই। ঘাড় ঘুরিয়ে মি. মুখার্জি কে একপলক দেখে হনহন করে নিচে নেমে গেল। বুকের ক্ষত তে মলম যেন খুব তাড়াতাড়ি কার্যকর হলো! তা কি ওই স্নিগ্ধ মুখশ্রী? হয়তো! আদিল কে চলে যেতে দেখে মি. মুখার্জিও নেমে এলেন। এক পলক কেবিন টাই নজর বুলাতে ভুললেন না। মেয়েটা এখন কি সুন্দর হাসছে। হয়তো প্রিয় অপরাধীর উপস্থিতি টের পেয়েছে!
নিজের কেবিনে এসে বসলেন মি. মুখার্জি। আদিল চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। একটু আগের ঘটনার প্রভাব তার মধ্যে নেই। ভুমিকা হীন তিনি বললেন,
~ আপনার বোনের মুখ থেকেই শোনা, উনি অপরিমিত; নাহ অধিক মদ্য পান করতেন! দীর্ঘমেয়াদে অ্যালকোহল সেবনের ফলে মস্তিস্ক, যকৃত ও হার্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিরোসিস, অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস, ফাইব্রোসিস, উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, এরিথমিয়া, স্ট্রোক, প্যানক্রিয়েটাইটিসের মতো প্রাণঘাতি রোগ দেখা দিতে পারে। এবং কি মুখ, গলা, ব্রেস্ট এবং লিভারের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
থামলেন মি মুখার্জি। আদিল ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
~ বোনের কি হয়েছে সেটা বলুন!
~ আমাকে আমার মতো বলতে দিন। লিভার ক্যান্সারের সঙ্কেত ও লক্ষণ হলো চোখের সাদা অংশ এবং ত্বকে হলুদ বর্ণহীনতা, ওজন কমা, ক্ষুধামান্দ্য, বমি বমি ভাব, পেটে ফোলাভাব,পেটের উপর অংশে ব্যথা! প্রাথমিক ভাবে মিস নাদিয়া কে লিভার ক্যান্সারের দিকই ইঙ্গিত করে। কিন্তু আপনি বা রোগীর পরিবার কেউ ধরতে পারে নি। অথচ দু দুটো ডক্টর ঘরে বাস করে! আপনাদের স্বার্থকতা কোথায় মি. মাহমুদ?
গমগম কন্ঠস্বর। রাগ ও তাচ্ছিল্যের আভাস পেল আদিল। বিচলিত হলো না সে। জবাব দিল,
~ আপনি কারণ টাও ঠিক জানেন! ডাক্তারি আমি ২ বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছি। মূল কথায় আসুন!
চাপা শ্বাস ফেললেন তিনি। ছেলেটার জবাব ঠোঁটের কোণে থাকে। শান্ত কন্ঠে বললেন,
~ রক্ত পরীক্ষা , সিটি স্ক্যান , এমআরআই
লিভার বায়োপসি! কোনো টাই বাদ রাখে নি মি. মাহমুদ। শুধু মাত্র ইঙ্গিতের উপর সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি। এক বার নয় তিন বার পরীক্ষা করিয়েছি। একই ফল। আপনার বোন লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত!
~ আদিল শান্ত। মি মুখার্জি আশা করেছিলেন আদিলের ভঙ্গিমায় পরিবর্তন ঘটবে, ব্যাথা ফুটে উঠবে, বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করবে। অথচ ছেলেটা শান্ত দৃষ্টিতে তার পরের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। সে ভুলে গিয়েছিল আদিল মাহমুদ নিষ্ঠুর! আবার বললেন,
~ লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা এই রোগের মঞ্চের উপর নির্ভর করে। মঞ্চটি রোগের অবস্থান, আকার এবং বিস্তার বুঝতে সহায়তা করে। প্রথম পর্যায়ে লিভার ক্যান্সারের পরবর্তী পর্যায়েগুলির তুলনায় খুব আলাদা চিকিৎসা রয়েছে। আপনার বোন একদম লাস্ট স্টেজে মি. মাহমুদ! উনি অন্যদিক এতটা ব্যস্ত ছিলেন, পেট ব্যাথা, বমি ভাব, স্বাস্থ্যের অবনতি, চেহারার উজ্জলতা নষ্ট কোনো টারই তোয়াক্কা করেন নি। তার কাছে সবটাই স্বাভাবিক লেগেছে। আর যন্ত্রণা ভুলতে উনি মদের পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন। হয়তো উনার অন্য যন্ত্রণা টা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। মূল কথা, আপনারাই মেয়ে টার জীবন টা কে শেষ করে দিলেন। আর কত জীবন নিয়ে খেলবেন মি. মাহমুদ?
আদিল উঠে দাঁড়ালো, টের পেল তার পা কাঁপছে। ঈষৎ নয়, কাঁপুনির গতি এত বেশী ছিল দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আবার বসে পড়লো। বুকের ভেতর অসহনীয় এক উত্তাপ টের পাচ্ছে। কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসছে, প্রশ্ন করার সুযোগ সে পাচ্ছে না। মি. মুখার্জি হয়তো বুঝতে পারলেন। নিজে থেকেই বললেন,
~ এ্যালকোহল পান করলে মানুষের রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে যে রক্তনালী – সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যার ফলে স্মৃতি লোপ পেতে পারে। আমার মনে হচ্ছে উনি এই রোগেও আক্রান্ত! উনার শরীরে যে পরিবর্তন গুলো দেখা গিয়েছে উনি হয়তো কখনো ভাবতেন আবার ভুলে যেতেন। যত সময় গড়াবে উনার মস্তিষ্কের অবনতি ততটা হবে। আর উনি এ্যালকোহলে এতটা আসক্ত হয়ে গেছেন একমাত্র ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো ছাড়া বিরত রাখা সম্ভব নয়। পাগলামি করবেন, উনার নিজের মধ্যেই অস্বস্থি লাগবে, ডিপ্রেশনে গিয়ে আত্মহত্যাও করতে পারেন। যদিও তিনি মৃত্যুর মুখেই দাঁড়িয়ে আছে! ডাক্তারের কিছু করার নেই আদিল। বিজ্ঞান কোনো সাহায্য করতে পারবে না। বিয়ার, ওয়াইন, এলকোহল যেকোনো রূপে সেবন করলে বেশি প্রস্রাব করতে হয়। এলকোহল মুখকে শুষ্ক করে এবং ডিহাইড্রেশন করে থাকে। এ অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া মুখের দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে থাকে।
উনার মুখের দুর্গন্ধও সৃষ্টি হয়ে গেছে। নিজের প্রতি একটু খেয়াল রাখলে হয়তো উনি নিজেকে বাঁচাতে পারতেন! সাময়িক ভাবে আমরা ব্যাথানাশক ঔষধ দিতে সক্ষম হলেও চিরস্থায়ী নয়। এমতাবস্থায় সাজেস্ট করবো নিজের কাছে নিয়ে রাখুন বোনকে, শেষ সময়ে একটু সঙ্গ দিন। ভালো স্মৃতি নিয়ে যাক!
ঘামছে আদিল, কপাল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। মি মুখার্জি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে আদিল কাঁপা কাঁপা পা নিয়েই ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু আটকে গেল কারো প্রশ্নে,
~ আমার এই মুহূর্তে প্রশ্ন করাটা ঠিক হবে না। তবুও কৌতুহল, কেন সেদিন মেনে নিলেন আদিল? কেন, নিষেধ করলেন না? একটা মেয়ে বেঁচে যেত, একটা পরিবার বেঁচে যেত, এবং কি আপনি নিজেও? আপনি কঠোর আবার নরম! তাহলে কেন এই ভুল?
মি. মুখার্জি বুঝলেন ভুল সময়ে প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু আদিল রাগলো না। নিজেকে এখন অনুভূতি হীন জড় বস্তু মনে হচ্ছে। ঘুরে শান্ত কন্ঠে বললো,
~ আপনাকে উত্তর দেওয়ার বাধ্যতা আমার নেই। তবুও কেন জানি বলতে ইচ্ছে করছে। আদিল মাহমুদ যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, যে ঘটনা গুলো দেখে দেখে বড় হয়েছে, বুঝতে পারার পর থেকে যে ঘটনা গুলোর সাক্ষী হয়েছে; এমন ঘটনার সাক্ষী অন্য আদিল মাহমুদ হলে ওই দিন পাঁচ জনের জায়গায় নিজে উপস্থিত হয়ে ছয় জন হতো। অন্যান্য দের মতো নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়তো, উল্লাস করতো। এই আদিল মাহমুদ করেনি। পাশের ঘরে বসে কানে ইয়ারফোন গুঁজেও নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি এই আদিল মাহমুদ। নিগাঢ় অসহায়ত্ব বোধ নিয়ে সারা রুম পাইচারি করেছে, বারংবার কেঁপে উঠেছে চিৎকারে, ঘেমে একাকার হয়ে হাঁসফাঁস করেছে। সর্বশেষ জ্বালা সইতে না পেরে স্বপ্নের পেশা ডাক্তারি থেকে এই আদিল মাহমুদ সেদিনই ইস্তফা দিয়েছে! অন্য আদিল মাহমুদ হলে হয়তো এসব করতো না! বা আগের আদিল মাহমুদ হলেও হয়তো একটা মেয়ের আত্মচিৎকারে কেঁপে উঠতো না। বেনামি চিঠির মালকিন আদিল মাহমুদ কে এতটাই আসক্ত করেছিল, আদিল মাহমুদ করতে বাধ্য হয়েছে। তবে নিজের ফর্ম সে কখনোই ছাড়ে নি! হারামি কখনো ভালোর কাতারে পড়ে না!
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬
এলোমেলো পায়ে হাঁটা ধরে আদিল। মি. মুখার্জি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। এতবড় সত্যের মুখোমুখি হয়ে আজ সে বাক্যহারা। আদিল যখন ডাক্তারি থেকে ইস্তফা নিলো হাজার খুঁজেও তিনি কারণ বের করতে পারেন নি। যে ছেলেটা দিন রাত পরিশ্রম করে ডক্টর হলো, ছুটাছুটি করে প্র্যাক্টিস করতো সেই ছেলেটা হুট করে পেশা থেকে সরে যাওয়ার কারণ আজ তিনি জানতে পারলেন। এমন একটা দিনে জানতে পারলো, অথৈ সাগরে ভাসতে থাকার মতো ছটফটানি ছাড়া তার আর করণীয় নেই। এত যুদ্ধের শেষ আদৌ হবে তো?