হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫০+৫১

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫০+৫১
Tahrim Muntahana

সরু গলির মাথায় গাড়ি টা দাঁড় করানো। দরজা খুলে বসে আছে অনল মাহমুদ। বাম পা টা মাটিতে, বাম হাতের দুটো আঙ্গুলের মধ্যখানে জলন্ত সিগারেট। নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে অপেক্ষা করছেন তিনি। মিনিট খানেক যেতেই পিলপিল করে কয়েকটা যুবক এলো, গুমোট তাদের মুখশ্রী। চোখে মুখে ভয় কিনা বুঝা যাচ্ছে না, কিঞ্চিৎ রাগী‌ও মনে হচ্ছে। অনল মাহমুদ তাকালেন না, ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট ফেলে ধোঁয়া গুলো উড়িয়ে দিলেন যুবক দের মধ্যে‌‌। ছ’টা যুবকের মধ্যে চারটে যুবক‌ই স‌ইতে না পেরে কাশতে লাগলো। নাকে মুখে ধোঁয়া গিয়ে যেন বুকে জ্বলন ধরাচ্ছে। কিটকিটিয়ে হেসে উঠলেন অনল মাহমুদ। বেশ মজা পেয়েছেন, সাধারণ ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না; আবার সিগারেট! অথচ রাতের আঁধারে এরাই ছুরি হাতে উঁত পেতে থাকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। গমগম কন্ঠে বললেন,

~ যা প্রশ্ন করবো উত্তর দিবি! কাল আগের রাতে কি হয়েছিল?
যুবক গুলো এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে‌‌। কিছুটা ভয়, কিছুটা ইতস্ততবোধ। প্রশ্নের জবাব না পেয়ে অনল মাহমুদ তাকালেন ওদের দিকে। দৃষ্টি কি ভয়ানক! একজন আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
~ একটা মেয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসছিল, গাড়ি দামী ছিলো আমরা ভাবছিলাম মালদার পার্টি হবে। আটক করছিলাম। মেয়ের গলায় চেইন ছিলো শুধু, শহরে কার বাড়িতে নাকি কাজ করবে‌। সেটা নিতে যেতেই দুটো লোক চলে আসে। ধস্তাধস্তি হয় আমাদের সাথে, পেশীবহুল ভারী শরীরের সাথে আমরা পারছিলাম না। রাগ উঠে গিয়েছিল দুটো ছেলের গায়ে ছু* রি চালিয়ে দিয়েছি। মারা গিয়েছে নাকি কেউ?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শুদ্ধ ভাষা, সাবলীল ভাবে কথাগুলো বলে দম নিলো ছেলেটি। বুক টিপটিপ করছে‌। অনায়েসেই কিভাবে মুখস্থ মিথ্যা গুলো বললো। যদিও তারা দিনে সত্তর ভাগ‌ই মিথ্যা বলে কিন্তু অনল মাহমুদের সামনে মিথ্যা বলে পার পাবে নাকি সেটাই ভাবছে তারা। এগ্রেসিভ অনল মাহমুদ তাদের দোষ দেখলে জানে মেরে দিবে। অনল মাহমুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকালেন ছেলেটির দিকে। না চাইতেও ছেলেটি ঈষৎ কেঁপে উঠলো। যতটা দৃঢ়তা মুখশ্রী তে আনা যায় সবটাই চেষ্টা করলো সে। তবে অনল মাহমুদের পরবর্তী কথায় দুঃসাহসী মনোভাব তার নিভে গেল,
~ সিগারেট ধরা, তিন টানে শেষ করবি!

গাঁ দুলিয়ে হাসলেন কথা টি বলে। ছেলেটা সিগারেটের দিকে একপলক তাকালো‌।‌ এই জিনিস টা সে শতবার হাত দিয়ে ধরেছে, বাবা কে এনে দিয়েছে, পাড়ার বড় ভাইদের এনে দিয়েছে কিন্তু শখ করেও কখনো ঠোঁটের ভাঁজে ফেলা হয় নি। মেয়েদের মতো তার কাছেও সিগারেট গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। অথচ তাকেই লোকটি সিগারেট অফার করছে। ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললো,
~ আমি সিগারেট খাই না।
~ খাস নি, এখন খাবি। আমার সামনে! আমি বলেছি সো তোকে খেতে হবে। পুরুষ মানুষ মেয়েছেলেদের মতো ব্যবহার করবি কেন? শরীরে রস নাই? নাকি মেয়েছেলে দেখে দেখে রস ছাড়িয়ে ফেলছিস?
বিশ্রী কথাগুলো বলে বিশ্রী ভঙ্গিমায় হেসে উঠলেন। ছেলে টি নাক মুখ কুঁচকে র‌ইলো, কপালের রগ ও কেমন ফুলে উঠেছে। ঘৃণ্য চোখে তাকিয়ে বললো,
~ আপনার কথা শেষ হলে আমি যাবো। কলেজ থেকে ডেকে নিয়ে আসছে‌ন। কাজের কথা না বলে অকাজের কথায় সময় পার করছেন। আপনার অনেক সময় থাকতে পারে, আমার নেই। ভাবছি কোনো ডিল নিয়ে কথা বলবে, অযহত!

মুখ বেঁকিয়ে কথা গুলো বলেই ছেলেটি চোরা চোখে অনল মাহমুদ কে দেখলো। একটু বেশীই বলে ফেলেছে মনে হয়।‌এতক্ষণের ঠান্ডা মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না অনল মাহমুদ। ধপ করে মাথাটা যেন জ্বলে উঠলো‌। রক্ত লাল চোখ ছেলেটিকে দেখে পকেটে হাত গুঁজে রিভল*বার বের করে বলে উঠলেন,
~ ক’দিনের ছোকরা অনল মাহমুদ কে সময় জ্ঞান শেখায়? বাচ্চা ছেলে প্রাণ নিবো না, কিন্তু অনল মাহমুদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার দায়ে হাঁটার ক্ষমতা কেড়ে নিলাম! নামটা মনে রাখবি, অনল মাহমুদ!
কথা বলা শেষ করতেই ছেলেটির হাঁটুর দিকে রিভল*বার তাক করে। লাফিয়ে উঠে ছেলেটি, হাঁটুতে হাত চেপে ধরে গোঙাতে থাকে। অপেক্ষা করে না অনল মাহমুদ, এক ছুটে বেরিয়ে যায় পাড়া থেকে। সঙ্গীরা হ‌ইহ‌ই করে ছুটে যায়। ব্লিডিং হচ্ছে প্রচুর। দেরী করে না, ধরাধরি করে তাদের ডেরায় নিয়ে যায়। দুজন ছুটে যায় তাদের চুক্তি করা ডক্টরের কাছে। দেখা যায় অনেক সময় তারা ইনজুরিড হয়, হসপিটাল গেলে পুলিশের কাছে ধরা পড়ার চান্স থাকে। তাই ছোট খাটো এক ডক্টরের সাথে চুক্তি করে নিয়েছে। টাকা দ্বিগুণ দিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। কথা কাটাকাটিও হয়ে যায়, অনল মাহমুদের বংশ তুলেও কথা বলতে লাগাম টানে না! এক‌ই সঙ্গে কাজ করে, এক‌ই পাড়ায় বাড়ি থাকার সুবাধে বন্ডিং টাও বিশাল। এমন অবস্থায় বিদ্রোহ করা ছাড়া মাথায় কিছু আসবে কি করে?

ক্ষত বুকের বিক্ষিপ্ততা নিয়ে হসপিটাল ছেড়েছে আদিল। মি. মুখার্জি শত অনুরোধ করেও আটকে রাখতে পারেন নি। দু তলা এক বাংলোর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে আদিল। ড্রয়িং রুমে বসে ছিলেন মিসেস নুরি। আদিল কে দেখে তিনি চমকে যান। কখনো আশা করেন নি। আদিল তাকে আরেকটু চমকে দিয়ে গাঁ ঘেঁষে বসে। বিস্মিত চাহনি তে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন মিসেস নুরি। আদিল ভুমিকা হীন জিজ্ঞেস করে,
~ আপনি কি নিজেকে মা ভাবেন? আপনার সেই অধিকার আছে? মাতৃত্ববোধের কোনো আকাঙ্ক্ষা জাগে?
~ আমি? আমি না মেয়ে হিসেবে যোগ্য, না বোন হিসেবে যোগ্য, না স্ত্রী হিসেবে যোগ্য, না মা হিসেবে যোগ্য! আমি মানুষ হিসেবেও যোগ্য নয়। কীট চিনো? সেই কীট আমি, যাকে তোমার বাবা নরপশু তে পরিণত করেছে। আবেগ হীন, বিবেকহীন, অনুভূতি হীন! আর কিছু বলবে?

মিসেস নুরির গলা ধরে আসে। এই যে ইনি বললেন অনুভূতি হীন, আবেগ হীন। অথচ কথাটা বলতেই সে আবেগে ভেসে অনুভূতি প্রকাশ করে ফেললেন‌। আদিল শান্ত চোখে মা কে দেখলো। শুধালো,
~ আমাদের জীবনে কি সত্যিই এরকম লিখা ছিলো, মিসেস নুরি?
~ মা বলতে ইচ্ছে হয় না?
~ ওই যে বললেন যোগ্য না!
আদিলের নির্লিপ্ত উত্তর। মিসেস নুরি করুণ চোখে তাকালেন। পরক্ষণেই হেসে বললেন,
~ আজ হঠাৎ আমার কাছে? আব্বু তো বাড়ি নেই?
~ কেন? আপনার কাছে আসা যাবে না?
~ সে আশা তো আমি করি না। আব্বু ছাড়া তুমি বড্ড অবুঝ! একটু বুঝমান হ‌ও।‌
~ বারে! আপনি আবার স্বামী ছাড়া বুঝমান নাকি?
সুক্ষ্ম খোঁচা টা ধরতে পারলেন মিসেস নুরি, মলিন হাসলেন। আদিল ফ্লোরে তাকিয়ে বললো,
~ আমাদের জীবন কি অন্যরকম হতে পারতো না?

~ হয়তো পারতো! তবে নিয়তি খন্ডাবে কে? নিয়তির বেড়াজালে আমরা সবাই বন্দি! তুমি, আমি , তোমার আব্বু! যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল পাবে! এই আমি, কিশোরী বয়সের এক ভুলের মাশুল এত বছর ধরে দিচ্ছি। আর তুমিও সেই ভুলের অনুসারি! মা-বাবার কর্মফল কোথাও কোথাও সন্তান কেউ ভোগ করতে হয়! এ দিক থেকে আমি মস্ত বড় অপরাধী! মা হয়ে ছেলের জীবন টা ভালোবাসা হীন করে দিয়েছি! ক্ষমা চাইবো না, পাবো না জানি। শাস্তি স্বরূপ মৃতদেহের খাটিয়া কাঁধে তুলো না, দু মুঠো মাটি সন্তান হিসেবে দিও না! এর থেকে চরম শাস্তি কোথাও আছে?
উঠে দাঁড়ালো আদিল। কোন দিক না তাকিয়েই হাঁটা ধরলো। দরজার কাছে একটু থেমে বললো,
~ আমি আপনাকে ক্ষমা করবো না মিসেস নুরি! কখনো নয়! নাদিয়া হসপিটালে, বড়জোর এক দু’মাস বাঁচবে! চাইলে দেখে যেতে পারেন‌। যদি সময় হয়!

বেরিয়ে গেল আদিল। মিসেস নুরি শূন্য দৃষ্টিতে আদিলের যাওয়া দেখলেন। নাদিয়ার করুণ দশা তাকে ছুঁতে পেরেছে কিনা বুঝা গেল না। এলোমেলো পা ফেলে ঘরের দিকে চলে গেলেন। সময় আজ সত্যিই কথা বলছে!
মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চুপ করে বসে আছে আদিল। স্টেয়ারিংয়ে মাথা রেখে চোখ বুজে আছে। শরীর দুর্বলতায় মিইয়ে যাচ্ছে। ক্ষত তে চিনচিনে ব্যাথা করছে। আর কিছুক্ষণ হলে হয়তো ব্লিডিং হতে পারে। উবু হয়ে চোখ বুজে রেখে বেশ স্বস্তি পাচ্ছে সে। স্বস্তিটা বেশীক্ষণ থাকলো না। মিনিট না পেরোতেই পকেট কাঁপিয়ে ফোন বেজে উঠলো। দুর্বল হাতে নম্বর না দেখেই রিসিভ করে হেলো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠলো,

~ কোথায় তুমি? কি শুরু করেছো? আমি তোমাকে মেলাতে পারছি না আদি। অধঃপতন হচ্ছে তোমার!
আদিল অস্পষ্ট স্বরে বললো,
~ আব্বু!
অপর পাশে থাকা অনল মাহমুদ সাড়া দিলেন না। ঘন নিশ্বাসের শব্দ আসছে। আদিল চোখ বুজেই মুচকি হাসলো। প্রসঙ্গ পাল্টে কাটকাট গলায় বলে উঠলো,
~ আমার শিকারে হাত দেওয়ার পরিণতি মবিন কে বলে দিয়েন আব্বু! সাবধান করছি! আমার গতিতে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। ওর গাঁয়ে সামান্য টোকা পড়লে আমাকে আর নিজের সাথে পাবেন না আব্বু! আমি আপনার‌ই ছেলে। আমার থেকে আপনি আপনাকে বেশী জানেন! রাখছি!

অপরাহ্নের মাঝামাঝি সময়। রাগী চোখে নার্সের দিকে তাকিয়ে আছে মিরা। সুপ নিয়ে এসেছিল, মিরার ভাষ্যমতে গরম পানি। যা তার গলা দিয়ে নামবে না। ভাত খেতে নিষেধ নেই, শুধু মাত্র এলার্জি জাতীয় খাবার খাওয়া নিষেধ। ক্ষত তে ইফেক্ট পড়তে পারে। হসপিটালে ভাত দেওয়া হয় না। বাড়ি থেকেই রোগীর আপন জন নিয়ে আসে। ঔষধ খাওয়ার সময় আধা ঘন্টা আগে ছিলো। কিন্তু মিরা’র খাবার না‌ খাওয়ায় নার্স তার কাজ সম্পন্ন করতে পারছে না। বেজায় রেগে আছেন তিনিও। আফরা হসপিটালেই ছিলো, ঘন্টা দুয়েক আগে বাড়ি গিয়েছে। রান্না করে নিয়ে আসার কথা, এখনো আসেনি। মিরা নার্স কে যেতে বলেছিল সে খেয়ে নিবে। কিন্তু নার্স কড়া কন্ঠে বলে দিয়েছে,

~ হুকুম অমান্য করতে পারবো না। আপনাকে ঔষধ না খাইয়ে নড়া নিষেধ।
মিরার বুঝতে সময় লাগেনি হুকুমদাতা কে। ঠোঁট এলিয়ে হেসেছে সে। তবে জেদ ধরে খায়নি। এমন সময় দরজায় টোকা পড়তেই নার্স দরজা খুলে দিলো। মাস্ক পরিহিত এক যুবক কে দেখে মিরা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
~ আপনার পরিচিত ম্যাম?
মিরা মাথা নাড়ালো। যুবকের হাতে মাঝারি সাইজের একটি টিফিন বক্স। নার্স আর কিছু না বলে চলে গেলেন। নার্সের প্রস্থান হতেই মিরা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
~ এখানে কি করছো তুমি? তোমার উচিত হয় নি এখানে আসা। ভুল করেছো ভাইয়া।
নোমান মিরার কথা কানে তুললো না। টুলে বসে, টিফিন বক্স পাশে রেখে কিছুক্ষণ বোন কে দেখলো। হুট করেই ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে বক্স খুলে ভাত মাখানো শুরু করলো। মিরা আর কিছু বললো না। নোমান খুব যত্ন নিয়ে বোন কে খাওয়ালো। টুলে আরাম করে বসতেই মিরা প্রশ্ন করলো,

~ তুমি খেয়েছো?
মাথা নাড়ালো নোমান। হাত এখনো পরিষ্কার করা হয় নি। গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ মেহেরবানী করে ভেতরে আসলে দু মুঠো খেতে পারি মিস আফরা!
চমকালো আফরা‌। মিনিট দুয়েক আগেই এসেছে সে। ভাই বোনের ভালোবাসা টা আড়াল থেকেই দেখছিলো। হাতে বড় সাইজের একটি টিফিন বক্স। খায় নি সে, ভেবেছিল মিরার সাথে খাবে। নোমান দেখে ফেলায় বিব্রত বোধ করা উচিত ছিল। আপাতত নোমান তো তাই ভেবেছিল‌। তবে আফরার মাঝে তেমন কিছু দেখা গেল না। সে সরাসরি ভেতরে এসে টুল টেনে বসতেই মিরা বললো,
~ আমি তো খেয়ে ফেলেছি, অনেক দিন ভাইয়ার হাতে খাইনি। তুই খাস নি আমি জানি, ভাইয়ার সাথে খেয়ে নি।
আফরা কথা না বাড়িয়ে টিফিন বক্স খুলতেই নোমান নিজ হাতেই খাবার বেড়ে নিলো। প্রথম লোকমা টা মিরা’র মুখে তুলে ধরে বললো,

~ তোমার জন্য রান্না করেছে, তুমি না খেলে হজম হবে না আবার‌। দু লোকমা খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও।
মিরা খেয়ে নিলো। দু চোখ ভরে ভাইয়ের তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া টা দেখলো। চোখে মুখে অন্যরকম খুশি। হঠাৎ করেই মুখটা মলিন হয়ে এলো তার। তার ভাই যে অন্ধকারের পেছনে ছুটছে সে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আফরা খাওয়া শেষ করে এঁটো বাসন গুলো ধুয়ে যেই একটু আরাম করে বসেছে ফোনের শব্দে বিরক্তি ফুটে উঠে মুখশ্রীতে। কিন্তু ফোনের উপরে জ্বলজ্বল করা ‘নায়ক’ নামটা দেখে কপালে বড়সড় ভাঁজ পড়ে তার। এই নামে কোনো নম্বর সেইভ করেছে বলে মনে হয় না। কৌতুহল বশত ঝটপট রিসিভ করে কানে তুলেই বলে উঠে,

~ হ্যালো, কে বলছেন?
~ দিস ইজ নট ফেয়ার মিস আফরা! চিনতে পারেন নি?
কঠোর হলো আফরা’র মুখশ্রী। সেই সাথে মনে পড়লো সকালের কথা। আফীফ এক প্রকার জোর করেই নিজের নম্বর সেইভ করে দিয়েছে। সে ভেবেছিল নাম দিয়েই সেইভ করবে। অথচ এমন একটা শব্দ দিয়ে সেইভ করেছে সে বুঝতেই পারে নি। শক্ত কন্ঠে বললো,
~ কি চাই?
~ আপনাকে!
গম্ভীর স্বর। আফরা কিছুটা চমকালো। কিছু বলার আগেই আফীফ আবার বললো,

~ দু ঘন্টা সময় হবে? ইট’স আর্জেন্ট।
আফীফের কন্ঠটা এতটা ব্যস্ত দেখালো আফরার মনে হলো না আফীফ মজা করছে‌। আর সে জানে এমন মজা করার মানুষ আফীফ মুনতাসির নয়। নরম কন্ঠে বললো,
~ কোথায় আসতে হবে?
~ যেখানে আছেন সেখান থেকে নীচে নামুন! বাইরের লোক কে রান্না করে খাওয়ানোর চুক্তি করেন নি। অপেক্ষা করছি, জলদি!
ঈর্ষান্বিত কন্ঠস্বর। আফরার কেন যেন হাসি পেল। তবে হাসলো না। ফোন রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো‌। মিরা কে উদ্দেশ্য করে বললো,

~ আমি আজ আর আসবো না! আর্জেন্ট কাজ পড়ে গিয়েছে। মি. নোমান আজ থাকুক! আমি আসছি!
মিরা কে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে যায় আফরা। নোমান অসহায় চোখে আফরা’র যাওয়া দেখে। আজ যদি অধিকার থাকতো ঠিক হাত ধরে‌ আটকে দিতো।‌ বসিয়ে রাখতো সম্মুখে, নয়নভরে দেখতো। ভাইয়ের দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে মিরা মুচকি হাসে। শীতল কন্ঠে বলে,
~ বলেছিলাম আমি! পুড়বে তুমি, জ্বলবে তুমি! শুনো নি! এগিয়েছো! এখন বুঝতে পারছো তো? মেয়েটা তোমার অধরা হয়েই থেকে যাবে!
বোনের কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসে নোমান। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,
~™আগুনে জ্বলে পুড়ে শতবার মৃত্য হোক! শুধু চোখের তৃষ্ণা মিটুক! মনের প্রবাহমান প্রেমের উষ্ণতা মিইয়ে যাক, আমি তবু ভালোবেসে যাবো আমৃত্য!

আফরা নীচে নেমে দেখলো গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে গেইটের বিপরীত পাশে। বিকেল শুরু হবে খানিক পরে। সূর্য টা পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাতাস ব‌ইছে অনেক উঁচু তে। রোদের তাপ টাও শরীরে ঠেকছে বেশ। দূর থেকেই আফরা লক্ষ্য করলো জিয়াউল সামনে থেকে গিয়ে পেছনে বসছে। আফরা ঠোঁট টিপে হাসলো, ব্যাপার টা বেশ লাগছে তার কাছে‌‌। এগিয়ে গিয়ে প্রশ্নবিহীন সামনে বসে পড়লো। আফীফ একপলক আফরা কে দেখে নিয়ে গাড়ি ছুটালো। জিয়াউল কিছুক্ষণ হলো উসখুস করছে, কিছু বলবে। আফরা লক্ষ্য করে বললো,
~ মিনিট খানেক পর আপনি নিঃশ্বাস নাও নিতে পারেন। তাই মনে যা আসে মুখ ফুটে বলে দিতে হয়, মি. জিয়াউল!
~ কোবাং ছোয় অর্থ আপনি জানেন?
অনুমতি পেয়ে এক মুহূর্ত‌ও দেরী করলো না জিয়াউল। প্রশ্ন টা করেই যেন স্বস্তি পেল। আফরা কিছুটা থতমত খেয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। বলে উঠলো,
~ ছাগল..!

~ হোয়াট! আপনি আমাকে ছাগল বললেন? সবাই সবকিছু জানবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে? নেই তো। আমি এমন কিছু জানি যা আপনি জানেন না। তাই বলে আমি আপনাকে সেসব বলে বলে অপমান করবো? না জানার কারণে ছাগল উপাধি দিবো? দিবো না তো। তাহলে আপনি কেন ছাগল বললেন? আমাকে ছাগলের মতো দেখতে? কাল কে স্যার ও বললো ছাগল, আজ আপনি বলছেন। হচ্ছে টা কি আমার সাথে, আমি কি মানুষ না নাকি? আমার কি মান অপমান বোধ নেই? আমার ইমোশন নেই? আপনি এভাবে বলতে পারলেন? আমি যাবো না আপনাদের সাথে, নামিয়ে দিন আমাকে। এত ইনসাল্ট সহ্য করতে পারবো না।

বলা শেষ হ‌ওয়া মাত্র‌ই হাঁপাতে লাগলো জিয়াউল। আফীফ বিরক্ত হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আফরা, অনান বিস্ফোরিত চোখে জিয়াউল কে দেখছে। এই মুহূর্তে জিয়াউল কে তাদের ভিন গ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে। একটা শব্দের বিনিময়ে এত গুলো কথা! আফরা কিছু বলবে তার পূর্বেই অনান রেগে মেগে আগুন হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ মাই ছোয়, নুয়া, ম্রাং, ক্রা, বে, ছাং!
মাথার উপর দিয়ে গেল জিয়াউলের‌। আফরা’র দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই আফরা হাসি চেপে বললো,
~ একজন সরকারি অফিসারের ধৈর্য এত কম হলে চলে? কোবাং ছোয় অর্থ আপনি ছাগল! মাই ছোয় অর্থ তুই একটা ছাগল, নুয়া মানে গরু, ম্রাং মানে ঘোড়া, ক্রা মানে মুরগি, বে মানে হাঁস, ছাং মানে হাতি! মোরাল অফ দ্যা স্টরি আপনি গৃহপালিত প্রাণীদের একত্রীকরণ রূপ!

শেষের কথাটা অনানের এতটা মজা লেগেছে শব্দ করে হেসে উঠলো। আফরা একটু চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এমন খিলখিল হাসি সে সেই শৈশবে হেসেছিল। জিয়াউল রাগতে গিয়েও রাগতে পারলো না। মেয়েটার হাসি দেখতে ভালো লাগছে। মানুষের হাসি সুন্দর যদি সে মন খুলে হাসতে পারে।
গাড়ি থামলো বস্তির পাশে। নেমে পড়লো আফীফ। স্যার কে নামতে দেখে জিয়াউল ও নেমে পড়লো। আফরা বুঝলো না বস্তিতে কি কাজ থাকতে পারে। পকেট থেকে একটি মাস্ক বের করে আফীফ আফরা কে উদ্দেশ্য করে বললো,

~ পড়ে নিন, আমরা ভেতরে যাবো।
তীব্র কৌতুহলে আফরা দেরী করলো না। মাস্ক পড়েই আফীফ কে অনুসরণ করতে লাগলো। বস্তি পেরিয়ে খোলামেলা এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো তারা। কিছু দূরেই একটি বড় সাইজের ছাউনি। জিয়াউল কে ইশারা করে আফীফ ছাউনি তে ঢুকে পড়লো। পড়ন্ত বিকেলের শুরু। চারদিক খানিক শিতলতা বিরাজ করছে। আফীফ কে দেখেই কয়েক টা ছেলে অবাক হয়ে এগিয়ে এলো। বাইরের লোক এই ডেরা সম্পর্কে জানে না। আটকানোর সুযোগ ও পেল না। তক্তপোষের উপর কেউ শুয়ে আছে দেখে এগিয়ে গেল আফীফ। ব্যান্ডেজ পা দেখে প্রশ্ন করলো,

~ কিভাবে হলো?
ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো। আফীফ কে এক লহমায় চিনে ফেললো। গড়গড় করে বলে উঠলো,
~ আপনি সেদিন যা যা শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমি সেসব‌ই বলেছি, কোনো ভুল করিনি। প্লিজ ধরে নিয়ে যাবেন না আমাদের।
মুচকি হাসলো আফীফ। সে ঠিক‌ই ধরেছিল। ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে ঠিক লোক আসবে। তক্তপোষের একপাশে বসে বললো,
~ রিলেক্স, আমি তোমাদের সাথে এমনিই কথা বলতে এসেছি। আহত হলে কি করে?
ফুঁসে উঠলো ছেলেটি,
~ ওই শালা অনল মাহমুদ। প্রশ্নের উত্তর দিলাম, বে* জন্মা টা বলে সিগারেট খেতে। আমি কি সিগারেট খাই? না করলাম, আমাকে হুকুম করে। যখনি প্রতিবাদ করলাম গুলি করে দিলো। আমি কি ওর বাপের সম্পত্তি নাকি? শালা একদিন একা পাই একদম জানে মেরে দিবো।
ছেলেটি ঠিক জানে এমন কিছু পারবে না। তবুও মনের রাগ মেটাতে নানান কথা বলে যাচ্ছে। আফীফ জিয়াউলের দিকে চোরা চোখে তাকালো। মনে মনে সে বেশ খুশি হয়েছে। এবার একটু তাতিয়ে দেওয়া যাক,

~ তুমি তার কিছুই করতে পারবে না। অধীনস্থ হয়ে মালিকের দিকে হাত বাড়ানোর দুঃসাহস করছো?
~ কিসের অধীনস্থ? আমি ওর খাই না পড়ি? কাজ খুঁজছিলাম, তখন তো কেউ দিলো না। এখন মানুষের টাকা মেরে খাই, আর কলেজে পড়ি। বড় হলে চাকরী করে ভিক্ষুকদের দিয়ে শোধ করে দিবো।
ছেলেমানুষী কথা। আফীফ না হেসে পারলো না। হেসেই বললো,
~ তোমার নাম কি?

~ বাপে রাখছিল সৈয়দ, এখানে এসে হয়েছি গুরু। কেউ আর নাম ধরে ডাকে না, এখানে সব গুরু নাম‌ই চলে! আপনি জেনে এতসব কি করবেন? আপনারা বড়লোক আমাদের দেখে নাক ছিটকাবেন।
~ আচ্ছা? ক‌ই আমি না তোমার সাথেই বসে আছি! বাঁচাল দের মতো কথা বলো না। মূল কথায় আসি?
ছেলেগুলো সহ আফরা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো আফীফের দিকে। কি এমন কথা থাকতে পারে বুঝতে পারছে না। আফীফ কিছুটা সময় নিলো‌। জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো,
~ আমার তোমাদের দরকার! ওই যে একটু আগে বললে না একা পেলে জানে মেরে দিবে? জানে মেরে দেওয়ার আগে তো তাকে একা পেতে হবে! কিন্তু অনল মাহমুদ তো একা থাকে না, চারপাশ সিকিউরিটি। তাই আগে আমাদের তাকে একা করতে হবে। এর জন্য‌ই তোমাদের দরকার!
আফীফের কথা শেষ হতেই একজন গমগম বলে উঠলো,

~ মানে? আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন? আমি এসবের মধ্যে নেই। আপনি সরকারি অফিসার আসামি আপনি ধরবেন। কিন্তু আমাদের ব্যবহার করতে চাইছেন কেন? ভাতের অভাবে মরে গেলে আপনার সরকার আমাদের খাওন দিবে? ফিরেও চাইবে না, সরকার তো জানেই না তার দেশের এত মানুষ অনাহারে আছে, কাজের অভাবে অপরাধ জগতে ঢুকে পড়ছে‌। সরকার সুনাম নিবে, পাবলিকের কাছে বাহাদুরি দেখাবে। আমরা কিছুই পাবো না, আরো অনল মাহমুদ জানতে পারলে পরিবার সহ মাটির সাথে মিশিয়ে দিবে। সাধারণ পাবলিক তার ব্যাপারে না জানলেও আমরা ছিনতাইকারী রা ঠিক‌ই জানি শালা কত বড় হারামী। আমাদের খেয়ে কাজ নাই, আমরা এসবের মাঝে নাই। আপনারা তাকে ধরতে পারলেই কি না পারলেই কি আমাদের ছিনতাইকারী হয়েই থাকতে হবে।

স্পষ্ট ভাষায় যথাযথ কথাগুলো তুলে ধরেছে। সরকার সত্যিই জানে না এত এত অনাহারে থাকা মানুষের কষ্ট। উন্নত দেশ গড়ছে, অথচ খাবারের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে গরিবদের উপর জুলুম ছাড়া কিছুই হচ্ছে না। আসামি ধরে বাহাদুরি সরকার‌ই করবে। কিন্তু এসব কত দিন? জনগণ ছাড়া সরকার গঠন হয়? জনগণ ‌যদি দেশের জন্য এগিয়ে না আসে দেশ সুস্থ থাকবে? থাকবে না। আফীফ এসব কথার সম্মুখীন হবে জানতো, আগ থেকে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে সে। সবার দিকে একপলক নজর বুলালো সে। নিস্তব্ধ পরিবেশে, সবাই তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করলো,
~ নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?

ছাউনিতে গমগমে একটা ভাব, উত্তেজনায় ভেতর গমগম করলেও নিশ্চুপ সবাই! পিনপতন নিরবতার মাঝে নিঃশ্বাসের শব্দ টাও কেমন ভয়ানক লাগছে। প্রশ্ন টার উত্তর আসেনি। আফীফ অপেক্ষা করেছে কয়েক মিনিট। যখন উত্তর এলো না, বা পাল্টা প্রশ্ন শোনা গেল না তখন খানিক শব্দে হেসে উঠলো সে। ততক্ষণে আফরা, জিয়াউল আফীফের পাশে দাঁড়িয়েছে। জিয়াউল কে ইশারা করে আফীফ কিছুটা উঁচু গলায় বললো,
~ এটি আমার প্রশ্ন নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন? রবী ঠাকুর চিনো না? যে রবী ঠাকুর কে একটু চিনেছে সেই ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছে!

শেষের কথাটায় অদ্ভুত এক আবেগ মিশে ছিলো। রবী ঠাকুর নামটি আসলেই মনে পড়ে কুঠিবাড়ির কথা! কলকাতা শহর টাকে তখন এতটা আপন মনে হয়, অন্য কোন দেশ ছুঁতে পারে না। শিলাইদহের পথে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া, কুঠিবাড়িকে ঘিরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা। আহা! মন চায় মাটির গন্ধে বুক ভাসিয়ে অনুভব করি রবীঠাকুর কে। মামুন নামের ছেলেটি এবার মাঝখান থেকে এগিয়ে এলো। এখানে সবার বড় সে, বয়স আনুমানিক উনিশ – বিশ হবে! এখানে মনে হচ্ছে না একুশের ঊর্ধ্বে কোনো ছেলে আছে। মামুন আফীফের সম্মুখ দাঁড়িয়ে সরাসরি বললো,

~ আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন বলুন, আমাদের সাহিত্য গিলে খেলে চলবে না। আমাদের মাথা সবসময় ভাবে মালদার পার্টি ধরবো কিভাবে!
আফীফ মুচকি হাসলো। বললো,
~ নগরে আগুন জ্বলছে সেই স্ফুলিঙ্গের নিষ্ঠুরতা থেকে দেবালয় রক্ষা পাবে না। এক‌ই ভাবে জ্বলবে, পুড়বে, ছাই হবে! কিন্তু দেখ দেবালয়ে হলো ধর্মকর্ম পালন করা হয়! অনেকের ভাষ্যমতে বিধাতা থাকেন, তাহলে কি বিধাতা রক্ষা করতে পারতেন না? কিন্তু বিধাতা যে অসম মনোভাব পোষণ করেন না। কর্মের সামঞ্জস্যতায় তুমি ফল পাবে। এখন তুমি যদি মনে করো সরকারের কাজ শুধু সরকারের, লাভ হলেও সরকারের হবে, ক্ষতি হলেও সরকারের হবে তাহলে তোমাদের ভবিষ্যত কি? লাভ হলে সরকারের হবে কিন্তু ক্ষতি থেকে তুমি বাঁচবে কি করে? ইয়ং জেনারেশন তোমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাচ্ছো? নাকি নিজে ছিনতাইকারী বলে নিজের প্রজন্মের জন্য‌ও এক‌ই পেশা রেখে যাবে। মুখ দেখাতে পারবে? গর্ব করে বলতে পারবে তোর বাবা ছিনতাইকারী ছিল, খু* নী ছিলো যে মানুষের হক কেড়ে নিয়ে বেঁচেছে? বলতে পারবে?

ঠিক জায়গায় ঘা টা লেগে গেল মনে হয়। ছেলে গুলো কেমন মিইয়ে গেল। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে র‌ইলো লজ্জায়। আফীফ সবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরখ করলো। কাজ হবে বলেই তো মনে হচ্ছে। আবার দৃঢ় কন্ঠে বললো,
~ উম হাম! মাথা নত করবে না। এমন কাজ করবে না অন্যের দুটো কথা শুনেই তোমার দৃষ্টি মাটিতে ঠেকে। বাঁচতে হলে মাথা উঁচু করে বাঁচো, না হলে মরে যাও। বেঁচে থেকেও কাপুরুষের মতো জীবনযাপন করে নিজেকে অন্যের নিকট তামাশার পাত্র করো না।
মাথা উঠালো ছেলেগুলো। মামুন নিম্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

~ আমি বুঝতে পারছি না আমাদের আপনি কিসের জন্য এসব কথা বলছেন। তবে আপনাকে আগেই বলে দিতে চাই আমরা ছিনতাইকারী। এইযে বস্তি টা দেখছেন। কম করে হলেও চারশো মানুষ বাস করে। তার মধ্যে আমাদের বয়সী ছেলের সংখ্যা হলো সত্তর প্লাস হবে। তার মধ্যে আমরা চল্লিশ জনের মতো স্কুল কলেজে পড়ি। আব্বা চাইছিলো মাহমুদ দের কাছে কাজে পাঠাতে, কিন্তু যাই নি। আমরা পড়তে চেয়েছি, ওখানে কাজ করলে ছয়মাসেও মনে হয়না বাইরে বেরোতে পারবো। রাগ করে আব্বা খরচ চালায় না, অনেক কাজ খুঁজেছি কিন্তু বস্তির ছেলেদের কুলি, মেকানিক ছাড়া কিছু জুটে না। দিনে ওসব করি, রাতে ছিনতাই করি। আম্মায় অসুখে পড়ে আছে, চিকিৎসার জন্য মাসে দশ বারো হাজার খরচ হয়। মা তো, ফেলে দিতে পারি না।
থামলো মামুন। সবার‌ই এক‌ই সমস্যা। শিক্ষিত ছিনতাইকারী যাকে বলে। প্রতীক নামের ছেলেটি এগিয়ে এসে বললো,

~ এই বস্তিতে কলের সংখ্যা মাত্র পাঁচ টা। চারশো মানুষের পাঁচটা কল, আপনারা স্বপ্নে ভাবতে পারবেন? এমন কোনো দিন নেই সকাল বিকাল হাতাহাতি, মারামারি, গালাগালি না হয়। বয়স্ক রা মাতলামি করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে, সকালে উঠে দেখা যায় বাচ্চারাও মজা করে ওসব বলাবলি করছে। অসুস্থ পরিবেশ। রিপোর্ট দিলেও মনে হয় না কখনো দেখে, সেই তিন বছর আগে উপরতলা থেকে লোক এসেছিল‌ যা লোক দেখানোই, কাজ আর কিচ্ছু হয় নি। এই পরিবেশ থেকে মুক্তি আমরা কখনোই হবো না। তাই নতুন করে ঝামেলা বাড়িয়ে মাথার ওই ফুটো টিনের ছাদ টাও হারিয়ে ফেলতে চাই না। অনল মাহমুদ জানতে পারলে দেখা যাবে সকাল না হতেই ভেকু মেশিন নিয়ে হাজির হবে বস্তি ভাঙতে। চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
আফীরের মুখটা করুণ দেখালো। বস্তি একটা শব্দ অথচ এই শব্দের মাঝে কত কি লুকিয়ে থাকে। আজ ওদের কথা না শুনলে হয়তো সে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারতো না এই শহরে জীবন যাপন করা কত কঠিন। কি বলবে ভেবে পেল না আফীফ। আরেকটি ছেলে বললো,

~ যুবতী মাইয়াগর কথা শুনবেন না? মাইয়া টার নাম ছিলো রূপসী। দেখতেও একদম হিরার মতো চকচক করতো। আমারে দেইখা মিষ্টি ক‌ইরা হাসতো। তিনমাসের প্রেম ছিলো। কথা ছিলো কয়দিন পর একটা বড় কাম যোগাড় ক‌ইরা ওরে বিয়া করমু‌। কিন্তু এই শহরে সুন্দরী হ‌ইয়া জন্ম নেওয়া পাপ। শালা হারামী মবিন আছে না? অন‌ইল্লার চামচা, উঠাইয়া নিয়া গেছেগা‌। কত্ত দিন ঘুরছি, আর পাই নাই। স্বাদ মিটাইয়া বারের ডান্সার বানাই রাখছে!
ছেলেটার ভেতর থেকে এক চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো। চোখে তুমুল বর্ষণ। যতটুকু সাহস আফীফ করেছিল, সবটুকু যেন মিইয়ে গেল। সে কি আবেগের কাছে হেরে যাচ্ছে? এমন হ‌ওয়ার তো কথা ছিলো না। তৎক্ষণাৎ মেয়েলি ভৎসর্না ভেসে এলো শান্ত কন্ঠে,

~ ও আচ্ছা, মেয়েটা ধর্ষিত, নষ্ট বলে এখন আর ভালোবাসা নেই? সব ভালোবাসা ফুস?
এই প্রথম কথা বললো আফরা। আফীফ অবাক হয়ে তাকায়, পরক্ষণে অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। আফরা’র কথায় ছেলেটি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো একদম,
~ খবরদার, আমার ভালোবাসা নিয়া কথা বলবেন না‌। গেছিলাম আনতে, মাইয়া শুধু কান্দে কিন্তু আমার সঙ্গে আসবার চায় না।

~ কিভাবে চাইবে? অনল মাহমুদের খাঁচায় ঢোকা সহজ, বের হ‌ওয়া জটিল‌। তাকে তো এমনি এমনি রাখেনি। আপনার উচিত তাকে বের করে আনা, যদি ভালোবাসা থাকে‌। আমাদের সাথে আসুন, আই প্রমিজ কালকে আপনি মেয়েটাকে নিজের সামনে দেখতে পাবেন!
কথাটি বলা মাত্রই অবিশ্বাস্য এক কান্ড ঘটে গেল। প্রেমিক যুবক টি বসে পড়লো আফরা’র পায়ের কাছে‌। দু পা পিছিয়ে যেতেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো আফরা। ছেলেটি কেঁদে ফেললো অঝোরে। বললো,
~ আমি রাজি, শুধু ওরে আইনা দেন। ওর বাপ টাই গলায় দড়ি দিছে, ওর মাই অসুস্থ, আমার ঘরেই থাকে। দিন রাইত নাম ধ‌ইরা ডাকে‌। আপনি মরতে ক‌ইলে আমি তাই করমু শুধু তারে আইনা দেন।
আফরার হঠাৎ কি হলো, ডান হাত এগিয়ে ছেলেটির মাথায় রাখলো। নরম সুরে বললো,
তোমার নাম কি ভাই? পড়াশোনা করো না?

~ রনিত! না বাপ ম‌ইরা গেছে জ্বরে প‌ইড়া, মাই মাইনষের বাড়ি কাম করতো‌। বুইড়া রা ভালা ছিল না। আর কাম করতে দেই নাই। পড়াশোনা ছাইড়া কামে ঢুকছি সেই সিক্সে থাকতেই।
~ আচ্ছা উঠে দাঁড়াও। আমরা কথা বলি।
রনিত উঠে দাঁড়ালো। আফরা আফীফের দিকে তাকাতেই আফীফ কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
~ এই যে আমি তোমাদের সাথে কথা বলছি, আমার কিন্তু কোনো স্বার্থ নেই! না আমার কোনো লাভ আছে। শুধু মাত্র দেশের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছি। সবার আগে তোমাদের মন থেকে কনফিউশন গুলো দূর করি। তোমাদের প্রথম অভিযোগ সরকার তোমাদের দেখে না। হ্যাঁ তা দেখে না! সরকারের কি এতটা সময় আছে ঘরে ঘরে গিয়ে দেখে আসবে? না সময় নেই! সরকার কে দেখাতে হবে‌। কিন্তু ভুল টা কি জানো? কয়েকজন স্বার্থবাদী লোক ক্ষমতার বসে সরকার কে যেমন চুষে খায়, জনগণ কেও চুষে খায়। এই যেমন ধরো কোনো কাজের বাজেট আসলো পঞ্চাশ হাজার। তোমার কাছে সর্বোচ্চ দশ হাজার আসবে। আর চল্লিশ হাজার‌ই চলে যাবে উপরতলা দের কাছে। এসব কি সরকারের জানার কথা? না, জানার কথা না! সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তারা ক্ষমতায় থেকে ভোগ করছে বিলাসীতা।

এখন তোমাদের প্রশ্ন থাকতে পারে সরকার কি ধোঁয়া তুলসী পাতা? নাহ তাও না! ক্ষমতার লোভ যার মস্তিষ্কে ঢুকে যায়, সে অনেক কিছু করে ক্ষমতা ধরে রাখতে। কিন্তু আমাদের তো কাজ সরকার নিয়ে নয়, বা বামপন্থী দল নিয়ে। আমরা লড়াই করবো আমাদের অধিকার নিয়ে। না ফলো করবো সরকার কে, না ফলো করবো বামপন্থী কোনো দল কে। আমরা আমাদের মতো লড়াই করে যাবো নিজের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে! এতে সরকারের কি লাভ হলো বা না হলো আমাদের দেখার কথা না, আমরা শুধু নিজেদের টা বুঝবো। পৃথিবীতে অসৎ মানুষের পাশাপাশি সৎ মানুষ ও বেঁচে আছে। নাহলে দেশ কবেই রসাতলে চলে যেত, ততটুকু রয়েছে সব‌ই তাদের চেষ্টা। আশা রাখছি ক্লিয়ার হয়েছো?
ছেলেগুলো কেমন সতেজ হয়ে উঠলো। আফীফ সবার পরিবর্তন লক্ষ্য করছে‌। ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য তারা এবার লড়াই তে নামবে। আফীফ থামলো না, আবার বললো,

~ সাধারণ জনগণ না জানলেও তোমরা ঠিক‌ই জানো এই শহরে কেমন অরাজকতা চলছে। নারী প্রা* চার, নারী ব্যব* সা, স্মাগ* লিং, ধ* র্ষণ, খু* ন‌ কি নেই এই শহরে। তার মূল হচ্ছে মাহমুদ পরিবার। এই মাহমুদ দের ক্ষমতা ধরেই পাড়ায় পাড়ায় বখাটেরা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ইভ* টিজিং বাড়ছে, ধ* র্ষণ বাড়ছে, খু* ন বাড়ছে। যদি কোনো পরিবার আইনের দারস্ত হয় দেখা যায় প্রশাসন কেস না নিয়ে খবর পাঠিয়ে দেয়। অনল মাহমুদ পরিবার কে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। এরকম দাসত্ব আর কত? এখন তোমাদের সময়, তোমরা হলে দেশের ভবিষ্যৎ। তোমরা যেভাবে দেশ কে গড়বে, পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থ দেশে বাস করতে পারবে। সবাই যদি পিছিয়ে যায় দেশ, সমাজ অসুস্থ থেকেই যাবে। এখন সবটা তোমাদের হাতে‌‌। আছো আমার পাশে?
পিনপতন নিরবতা‌। ছেলে গুলো এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। দোটনায় পড়ে হাঁসফাঁস করছে। এমন সময় আফরা বললো,

~ Samuel Taylor Coleridge বলেছেন,
He prayeth best, who loveth best.
এটি দ্বারা কি বুঝায় জানো?
জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর! সিদ্ধান্ত এখন খুব তাড়াতাড়ি নিতে পারবে। ভাবো, বেশী করে ভাবো! মনে রেখো, লড়াই কিন্তু নিজেদের জন্য!
ভাবতে হলো না ছেলেদের‌। ছড়ানো ছিটানো ছেলেগুলো আফীফদের কাছে ঘেঁষতে লাগলো। মাদুর বিছিয়ে রাখা ছিলো, সবাই একে একে বসলো। বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। মামুন সবার প্রতিনিধি হয়ে বললো,
~ আমরা লড়াই করবো, বাঁচার মতো বাঁচবো!
আফীফের পেছন থেকে জিয়াউল এগিয়ে এলো। চুপ থাকতে তার মুটেও ইচ্ছে করছে না। চোরা চোখে অনানের দিকে তাকিয়ে বললো,

~ সুকান্ত ভট্টাচার্য কে চিনো? নবজাগরণের কবি। তাঁর কবিতা পড়লে রক্ত টগবগ করে উঠে। আমাদের এই ভাঙাচোরা সমাজ, বুজোয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কবিতা লিখেছেন তিনি। যুদ্ধ শুধু যে অস্ত্র দিয়ে, হাতাহাতি করে তা নয়! মস্তিষ্ক দিয়েও যুদ্ধ ঘোষণা করা যায়, বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করা যায়। এই যেমন সুকান্ত স্যারের একটি কবিতা। শুনবে?
“এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে
সোনালী নয়কো রক্তে রঙিন ধান
দেখবে সকলে সেখানে জ্বলবে
দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ!”
প্রতিবাদ দেখেছো? দাউ দাউ করে কিন্তু আগুন জ্বলছে, এই বান্দরবান শহর পুড়ে পুড়ে আজ ছাই হতে চললো‌। তোমাদের হাতেই আগুন নেভানোর অস্ত্র। প্রস্তুত তো?
সমস্বরের আওয়াজ ভেসে উঠলো। আফীফ কেমন কেঁপে উঠলো। তার তৈরি করা পরিকল্পনা যে এত সহজে খেটে যাবে, সে ভাবতেও পারেনি। জিয়াউলের দিকে তাকালো আফীফ। ছেলেটা কাজের বেলায় একদম অন্যরকম হয়ে যায়। তাই তো এই ছেলেটা তার এতটা প্রিয়। ছেলেগুলোর সামনে বসে পড়লো সে। যত মিশবে তার কার্য হাসিল ততটা হবে। শান্ত, দৃঢ় কন্ঠে বললো,

~ মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণ পরিচালনা কারী নীতি ও মানদণ্ড। যার মাধ্যমে মানুষ নিজের ভুল ও শুদ্ধ, ভালো ও মন্দ, দোষ ও গুণের পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারে। তুমি ভালো মন্দের পার্থক্য তখন‌ই বুঝবে যখন তুমি ভালো টা গ্রহণ করতে উৎসাহিত হবে। এখন তোমরা ভালোর জন্য লড়াই করছো, কারণ ভালো টা তোমাদের জন্য জরুরি। ভালোর পেছনে ছুটছো কত জন?

মূল্যবোধ! প্রতিটি মানুষের মূল্যবোধ থাকাটা জরুরি। অকৃত্রিম ও অর্জিত আপোষহীন নিতী বা দৈনন্দিন কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এটি জীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। একটি শিশুর মূল্যবোধ শিক্ষার প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হলো পরিবার এবং প্রাতিষ্ঠানিক উৎস শিক্ষালয়। এই দুই থেকেই শিশুরা শিখতে পারে জানতে পারে। পরিবারের মানুষ যদি শিশুকে ভুল শিক্ষায় বড় করে, শিক্ষালয়ের কিছুই করার থাকবে না। আবার শিক্ষালয় যদি নিতী ধরে রাখতে না পারে শুধু মাত্র পরিবারের চেষ্টায় শিশুর সঠিক বিকাশ হবে না। দুই কেই নিতী ধরে প্রজন্ম কে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বস্তি তে মূল্যবোধ কথাটি চলে না! এখানে প্রকাশ্যে অনৈতিক কাজ গুলো ঘটতে থাকে। পরিবর্তন হলে ক্ষতি কি? বসবাসের যোগ্য হবে‌। জবাব দিলো মামুন,
~ আমি চল্লিশ জনের গ্যারান্টি দিতে পারবো স্যার‌। আমরা এই চল্লিশ জন একত্রে আছি‌‌। কিন্তু সৈয়দ পারবে না, গুলি খেয়েছে তো।

~ সৈয়দ ও পারবে শুধু পরিচালনা করতে হবে। কথা হচ্ছে বেইমানি করবে না তো? আফীফ মুনতাসির লোকটা কিন্তু সত্যিই ভালো না। তুমি যদি আমাকে বিপদে ফেলো, আমি তোমাকে মৃত্যুর মুখে ফেলতে কন্ঠাবোধ করবো না। তুমি আমাকে একটু ভালো সঙ্গ দাও, আমি তোমাকে জীবন দিয়ে রক্ষা করবো!
তক্তপোষের উপর শুয়ে থেকে সৈয়দ হেসে উঠলো। কেউ তার হাসির কারণ বুঝতে পারলো না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে র‌ইলো তার দিক। সৈয়দ নিজের হাসি থামিয়ে বললো,
~ সরি সরি, হাসতে চাইনি। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো। বাংলা ছবি তে যেমন বলে না? “চৌধুরী সাহেব আমি গরিব হতে পারি কিন্তু ছোটলোক না।” সেভাবে আমার‌ও বলতে ইচ্ছে করছে, “মুনতাসির সাহেব আমরা ছিনতাইকারী হতে পারি কিন্তু বেইমান না।”

কথা টা বলা শেষ হতেই চারদিক হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল। আফীফ হাসতে না চেয়েও হেসে ফেললো। পরিবেশ একটু স্বাভাবিক হয়েছে। আড় চোখে আফরা কে দেখলো আফীফ। মেয়ে টা শুরু থেকেই কাটকাট মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত জন হাসলো তবুও হাসলো না। চাপা শ্বাস ফেলে ছেলে গুলোর হাসি দেখতে লাগলো আফীফ। বর্তমানে জিয়াউলের হাসির শব্দ টাই বেশী শোনা যাচ্ছে। হাসির মাঝেই প্রতীক বলে উঠলো,
~ কিন্তু স্যার, আমরা কিভাবে পারবো? ওদের কাছে যে অস্ত্র, লোক আছে আমরা পাঁচশো জন হলেও পারবো না।
আফীফ মুচকি হেসে কিছুক্ষণ ভাবলো। দাঁড়িয়ে পড়লো শটান হয়ে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,

~ তোমাদের একটি গল্প শোনায়। ঠিক গল্প না, ইতিহাস। পর্তুগিজ বণিক দলের অধিনায়ক ‘ভাস্কো দ্য গামা’! মসলার যুদ্ধের কথা কখনো শুনেছো? নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কালিকটের রুখে দাঁড়ানোর কথা শুনেছো?
পর্তুগিজদের অগ্নি উদগিরণ কামান গুলোর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল কালিকটের অস্ত্র ঝঞ্চণা জাহাজ। ঢাল, তলোয়ার, দিয়ে কামানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো বড় বোকামি হয়তো নেই। কিন্তু কালিকট রাজার উদ্যোগে বণিক রা সাহস করেছিল‌। খোজা আস্বরের ভারী ভারী জাহাজ গুলো যখন কামানের গোলার ঘায়ে জখম হয়ে পড়তে লাগলো তখন নৌ সেনাপতি কাশিম তার ছোট ছোট জাহাজ গুলোকে কামানের সম্মুখে দাঁড় করালেন‌। এমন কৌশলে জাহাজ গুলো পরিচালনা করলেন কামানের একটা গোলাও জাহাজের বুকে আঁচড় কাটতে পারলো না। ক্ষিপ্রগতি জাহাজ গুলো নিয়ে নৌ সেনাপতি পর্তুগিজদের জাহাজ গুলো কে বোলতার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ঘিরে ফেললো। ভাস্কো দা গামা কিন্তু তখন টিকতে পারে নি। যে সুবিশাল, শক্ত, জটিল পরিকল্পনা সাজিয়েছিল তা এক নিমিষেই তাদের ভয়ের কারণ হলো। কোনোমতে অব্যাহতি পেয়ে যুদ্ধে ইস্তফা দিয়ে ঘরে ফিরলেন।
ইতিহাসের এই যুদ্ধের কথা সে বাবার কাছে শুনেছিলো। পরবর্তী তে আরো জেনেছে এই ব্যাপারে। এই মুহূর্তে মনে হলো এর থেকে বড় উদাহরণ তার কাছে নেই। একটু থেমে আবার বললো,

~ খোজা আস্বরের বড় বড় জাহাজ গুলো যেখানে হার মেনে নিয়েছিল, কাশিমের ছোট ছোট জাহাজ গুলো কিন্তু জয়ের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। তুমি ছোট, তোমার কিছুই নেই ভেবে যদি অচল হয়ে পড়ো অপর পক্ষ তোমাকে শুধু আঘাত করেই যাবে। নিজেকে এমন কৌশলে পরিচালনা করো, এমন ভাবে গড়ে তুলো, মস্তিষ্ক কে এমন ভাবে খাটাও; তোমার প্রতিপক্ষ ভাস্কো দ্য গামা’র মতোই যেন পিছিয়ে যায়। কালিকট রাজা জামোরিন যদি নিজের শক্তি কম বলে পর্তুগিজ দের দাসত্ব মেনে নিতেন তাহলে সারাজীবন তাদের গোলাম হয়েই থাকতে হতো। হারাতে হতো মুকুট, আধিপত্য, দেশের সমৃদ্ধি। তৈরি করো নিজেকে। রুখে দাঁড়াও অস্ত্রের বিরুদ্ধে। তুমি নিজেই কৌশল পেয়ে যাবে কিভাবে রুখতে হবে। শুধু দরকার আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় সংকল্প, ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম! আমাদের জয় নিশ্চিত!

বুকে সাহস জমলো। কথাগুলোই এতটা আত্মবিশ্বাস মিশে ছিলো সবার মনেই একখন্ড জোর এসে জড়ো হলো‌। উথাল হাওয়ার মতো এক ছুটে বুকে স্বপ্ন ছুড়ে দিলো। আফীফ সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর সরাসরি অনান কে সামনে আসতে বললো,
~ সামনে এসো, সবার একটা করে ছবি উঠিয়ে নাও।
এই কথাটির জন্য‌ই হয়তো মেয়েটা অপেক্ষা করছিলো। শোনা মাত্র‌ই ছুটে এলো সামনে। ছবি উঠিয়ে, একটি কাগজে নাম লিখে নিজের কাজ সম্পন্ন করলো। আফীফ সবার উদ্দেশ্যে শিতল কন্ঠে বললো,

~ আজ আমরা যাবো। খুব শীঘ্রই আমাদের দল গঠন হয়ে যাবে‌। পরিকল্পনা মতো কাজ গুলো শেষ করতে পারলে আমাদের জয় নিশ্চিত! এরপর দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হবে। অসৎ লোক‌ও থাকবে তবে তাদের মনে ভয় থাকবে স্বয়ং আদিল মাহমুদ জিততে পারেনি! তোমাদের কাজে খুশি হয়ে সরকার বড় একটি সুযোগ দিতে পারে। আবার নাও পারে, তোমাদের ভালো তোমাদের‌ই বুঝে নিতে হবে। আমি মাসে এক লাখ রোজগার করি বা দুই লাখ এত গুলো পরিবার কে আমি একা বহন করতে পারবো না। কিন্তু প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন আমার সাথে এলে সেটি সম্ভব। মনে রাখবে দশের লাঠি একের বোঝা।

বেরিয়ে পড়লো আফীফ। আফরা কিছু বললো না। খুব‌ই শান্ত সে। মনে ক্ষুদ্র ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এমন পরিকল্পনা সে করতে পারে নি। সে ভাবেও নি এভাবে। ভিন্ন মস্তিষ্ক, ভিন্ন পরিকল্পনা। খেলা টা এবার পাবলিকলি ওপেন হয়ে গেল।‌ আনমনা হয়ে আফীফ কে অনুসরণ করলো আফরা‌। জিয়াউল গেল না। তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। সবাই কে উদ্দেশ্য করে বললো,

~ বুক কেঁপে উঠে না? এই ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী রূপকথার মতো। এত এত মানুষ, বাঁচার তাগিদে লড়ে যাচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধ দু মুঠো ভাতের জন্য লড়ে যাচ্ছে। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও ঠিক স্বাধীনতার অর্থ বুঝি না। বড়লোকের কাছে স্বাধীনতা হলো, বারে গিয়ে মদ খেতে নিষেধ করলে তাদের স্বাধীনতা ভঙ্গ হয়। আর নিম্নশ্রেণীর মানুষ রা তো জানেই না স্বাধীনতার মর্মার্থ। তাদের কাছে নিছক একটা শব্দ মাত্র। মানুষ জটলা করে ঠিক কিন্তু যখন দেখে জটলা তাদের দিকেই আসছে তখন কেটে পড়ে‌। এটা কে তো স্বাধীনতা বলে না! যে শহরে মত প্রকাশ করলে মৃত্যু হজম করতে হয়, সে শহরে বাঁচা যায় মুখ বুজে। তোমরা যুবসমাজ, তোমাদের মুখ বুজে পড়ে থাকা মানায় না। লড়ে যাও, বাঁচো! বাঁচার মতো বাঁচো, নাহয় মরে যাও!

বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে এলো জিয়াউল। কথাগুলো বলতে পেরে স্বস্তি পেয়েছে সে। নুরুল আলম সিদ্দিকী যে কাজ টি তাকে দিয়েছেন সে কাজ টি যথাযথ করতে পারলেই যেন সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে গাড়িতে গিয়ে বসলো জিয়াউল। আফীফ রা তার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিলো। গাড়ি ছুটতেই আফরা হঠাৎ প্রশ্ন করে,
~ শেষমেষ ভাস্কো দা গামা কিন্তু ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলো। পুরো কয়েক যুগ রাজত্ব করেছে। সে কথা বললেন না কেন?

~ ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল বলে আমি কালিকটের রুখে দাঁড়ানো কে সম্মান করবো না? যতক্ষণ লড়াই করে যাওয়া যায় ততক্ষণ করেছিল। যুদ্ধের উন্নত অস্ত্র প্রতিপক্ষের তুলনায় কম ছিলো বলে হেরে গিয়েছেন। আমরা তো শুধু অস্ত্রের লড়াই করবো না, খেলবো বুদ্ধি দিয়ে। ইতিহাসের অর্ধেক যদি কোনো ভাঙাচোরা হৃদয় কে শক্ত হতে শেখায়, লড়াই করতে শেখায়; পরের অংশ বলার প্রয়োজন পড়বে কেন?
মুচকি হেসে গাড়ি চালানোয় মন দিলো আফীফ। আফরা কিছুক্ষণ সেই হাসি হাসি মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বাইরে নজর দিলো। এদিকে জিয়াউল নিশ্চুপ। আজকের কথাগুলো বিরাট প্রভাব ফেলেছে তার উপর। এভাবে সে কখনোই ভাবে নি। বড় স্যারের প্রত্যেক টা কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও দেশ নিয়ে এভাবে ভাবার সুযোগ সে নেয় নি। হয়তো সে এক ফ্যান্টাসি তে বসবাস করতো, বোকামি করতো, ছেলেমানুষী করতো; আজ এই সভাটা তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে, অনেক কিছু শিখিয়ে। ঘোর থেকে সে যেন বের হতেই পারছে না।আনমনেই বিড়বিড় করলো,

~ “কবিতা তোমায় আজ দিলাম ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি!”
চমকে গাড়ি দাঁড় করালো আফীফ। পেছনে তাকালো‌। ঝাকুনিতে জিয়াউলের ঘোর কেটেছে। বিব্রত হলো সে। আফীফ অপলক তাকিয়ে র‌ইলো জিয়াউলের দিকে। আফীফের দৃষ্টি উপেক্ষা করতে না পেরে বিগলিত হাসলো জিয়াউল। আফীফের চোখে মুখে প্রাপ্তির ছোঁয়া। ঠোঁট এলিয়ে হেসে সামনে তাকালো। কি মনে করে আবার পেছনে ঘুরে কপালে ডান হাত ঠেকিয়ে স্যালুটের ভঙ্গিমা করলো, জিয়াউল হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। এই পেশা টা তাদের কাছে কি বাইরের কেউ কিছুতেই বুঝবে না। ইমোশনের প্রথম সারিতে অবস্থান করছে তাদের পেশা! একটু প্রাপ্তি চোখে জ্বলন ধরায়!

মৃতের ন্যায় শরীর টা বিছানায় এলানো‌। উজ্জলতায় ভাটা পড়ে কালসিটে দেখাচ্ছে গাঁয়ের রঙ। চোখ যেন কোটরে ডেবে যাবে, শুষ্ক ঠোঁট! হাসপাতালে থেকে একদিনেই মেয়েটা আরো রোগা হয়ে গেল। আদিল ভেবেছে আজ সন্ধ্যার পর বাড়ি নিয়ে যাবে। যত দিন আছে বাড়িতেই চিকিৎসা হবে। ডক্টরের সাথে কথা বলে বোনের কেবিনেই এসেছে আদিল। এমন মিইয়ে যাওয়া তার কোথাও মানতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে আছে। ভাই কে দেখে নাদিয়া হাসার চেষ্টা করে তবে পারে না। শুষ্ক ঠোঁট ফেটে মনে হচ্ছে রক্ত বের হবে। আদিল এগিয়ে যায়, পকেট থেকে লিপবাম বের করে নিজেই আলতো করে লাগিয়ে দেয়। কালসিটে পড়া চোখে মুখে বিস্ময়। নাদিয়ার মনে হচ্ছে সে ভুল দেখছে, স্বপ্ন দেখছে‌। চোখ বন্ধ করলেই আদিল মিলিয়ে যাবে, যত্ন গুলোও হাওয়ায় উড়ে যাবে‌। কাঁপা কাঁপা হাত তুলে আদিল কে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টায়। হাতটাও আজ ত্যাড়ামো করছে, অবশ হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আদিল হয়তো বুঝলো, টুলে বসে খানিক ঝুঁকে পড়লো‌। নরম হাতে নাদিয়ার হাত ধরে নিজের গালে রাখতেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো তপ্ত নোনা জল। কন্দনরত চোখ নিয়ে নাদিয়া ভাই কে দেখতে লাগলো। এটা স্বপ্ন‌ নয়! অস্পষ্ট স্বরে নাদিয়া বললো,

~ আমি জানি আদিল মাহমুদের এই কঠোর হৃদয়ে নাদিয়ার জন্য এক টুকরো ভালোবাসা আছে। আমার একটি আফসোস ছাড়া আর কোনো আফসোস র‌ইলো না!
আদিল নিজেকে নরম করতে গিয়েও পারলো না। পারলো না এতদিনের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে‌। কোথাও একটা বাঁধা আসে, ভেতর থেকেই। শিতল কন্ঠে শুধালো,
~ আফসোস? একটি? ভাইয়া কে বলো, ভাইয়া ইচ্ছে পূরণ করবে!
এবার মিষ্টি হাসলো নাদিয়া। সেই সাথে গড়িয়ে পড়লো জল। দুর্বল কন্ঠে বললো,
~ ওই আফসোস আমার জীবন দিয়েও পূরণ হবে না। ওই আফসোস আমাকে সুখ দেয়, শান্তি দেয়, দুঃখ দেয় আবার যন্ত্রণা দেয়। ওই আফসোস বহুরূপী ভাইয়া।

দুর্বোধ্য হাসলো‌। আজ ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সরছেই না। তা কি কেবল ভাইয়ার ভালোবাসা পেয়ে? আদিল বুঝে ফেললো নাদিয়ার মনের কথা। ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। এই আফসোস সত্যিই পূরণ হবার নয়! চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপ র‌ইলো। নাদিয়া আবার বললো,
~ আচ্ছা ভাইয়া, মরে গেলে ভালোবাসা পাওয়া যায়? শুনেছি মরে গেলে নাকি সবাই মনে করে কান্না করে। আমার জন্য কাঁদবে তোমরা?

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৪৭+৪৮+৪৯

আদিল চোখ খুললো। অতি সন্তর্পণে হাতটি বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালো। মিনিট খানেক নিশ্চুপ থেকে উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো। হাঁটার তালে গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ মরে গেলে যদি ভালোবাসা পাওয়া যেত আদিল মাহমুদ সহস্র বার মৃত্যু কে বরণ করে নিতো!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫২+৫৩+৫৪