হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৫+৫৬

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৫+৫৬
Tahrim Muntahana

ছাউনি টা আজ মানুষে ভরপুর। চল্লিশ জন ছেলে উন্মুখ হয়ে আছে আলোচনা শোনার জন্য। পাইচারি করছে আফীফ। আহিশ, মিরা এসে উপস্থিত হলেও এখনো আফরা , নোমান আসেনি। তাদের দেরীর জন্য‌ই তারা আলোচনা শুরু করতে পারছে না। আফীফ একটু পর পর উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে, কেমন অস্থির লাগছে। জিয়াউল, অনান পাশাপাশি বসে আছে, মিটিমিটি হাসছে আর একটু পর পর জিয়াউলের দিকে তাকাচ্ছে অনান। জিয়াউলের সেদিকে পাত্তা নেই, সে আছে বসের অস্থিরতা নিয়ে। এত অস্থির কেন সেটাই সে বুঝতে পারছে না। এগোচ্ছে তো ভালো করেই। আস্তে করে উঠে আফীফের পেছনে দাঁড়ায় জিয়াউল। ধীর কন্ঠে শুধায়,

~ স্যার, এত অস্থির হচ্ছেন কেন?
~ জিয়া তুমি বুঝতে পারছো না। আজকের পরিকল্পনায় যদি একজন মানুষ ও দ্বিমত করে আমার সকল পরিশ্রম শেষ। কাজ গুলো যে একটু বেশীই রিস্কি। আমার এখানে কিছুই করার নেই, আব্বুও কিছু বলছে না।
পাইচারি করতে করতে জবাব দিলো আফীফ। জিয়াউল নিজেও ভাবনায় পড়ে গেল।‌ সত্যিই তো! সে তো এসব ভাবেনি। মূলত ভাবার সময় ই পায় নি সে। এত কাজ ছিলো, এত এত ভাবনা ছিলো এই ভাবনা টা জায়গা করে নিতে পারেনি। ছেলেগুলো উসখুস করছে এখন। ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না মনে হয়, চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।‌ আফীফ চিন্তিত হয়ে পড়লো, বিপদ হয় নি তো? বুকটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুকের কাঁপন কে ইস্তফা দিতে উপস্থিত হলো আফরা। একা, অনান ছুটে এলো। আফরার এক হাত জড়িয়ে ধরে বললো,
~ রূপসী ক‌ই? আনো নি?
আফরা কিছু বললো না। মুচকি হেসে অনানের হাত ছাড়িয়ে পেছনে ঘুরলো। চাপা স্বরে বললো,
~ নিয়ে আসুন।‌

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উপস্থিত হলো নোমান। সাথে রূপসী। মেয়েটির চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। আফরা খানিক চমকে দিতে চেয়েছে। রূপসী কে সামনে এনে দাঁড় করাতেই বিস্ফোরণ বয়ে গেল যেন। আশাহীন প্রাপ্তি টা আচমকা দেখে কথা বলতে ভুলে গেল সবাই। আফরা মুচকি হেসে রূপসীর চোখের উপর থেকে কালো কাপড় সরাতেই রূপসী কপাল কুঁচকে নিলো।‌পিটপিট করে চোখ খুলে সম্মুখে পরিচিত মুখ গুলো দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। দু পা পিছিয়ে আফরার উপর শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আফরার চোখে চোখ রাখলো, জিজ্ঞাসা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আফরা কিছু না বলে রূপসী কে ঠিক করে দাঁড় করিয়ে পিছিয়ে গেল সে। মিরা’র পাশে দাঁড়িয়ে রনিতের কাছে আসার দৃশ্য টি দেখতে লাগলো। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে রনিত, চোখে জলের ফোয়ারা, আকস্মিক চমক তাকে নাজেহাল করে দিয়েছে। সবার ভাবনা মতো কিছুই করলো না রনিত, রূপসী কে একটুখানি ছুঁয়ে ছাউনি থেকে বের হয়ে গেল। হাসলো রূপসী, কারো থেকে অনুমতি নিলো না। রনিতের পিছু যেতে যেতে মেতে উঠলো নানান কথায়। সুযোগ যেহেতু এসেছে ছাড়ার প্রশ্ন‌ই আসে না।

আফীফ এবার নিজের কাজে মন দিলো‌। একটি কাগজ হাতে তুলে নিয়ে বললো,
~ আমি আজ পুরো পরিকল্পনা টা উপস্থাপন করবো। ভালো দিক, খারাপ দিক তুলে ধরার জন্য তোমরা, আপনারা আছেন! প্রথমে আমাদের একটি ছোট রাস্তা বের করতে হবে, যে রাস্তা ধরে আমরা বড় রাস্তাটা খুঁজে পাবো। সেই ছোট রাস্তাটা আমার মতে একটাই। বিরূপ মনোভাব হতে পারে, তবে আমি এ ছাড়া কোনো রাস্তা খুঁজে পেলাম না। রাস্তা টা মিহা!
পরের কথা শোনার জন্য সবাই উৎসুক হয়ে র‌ইলেও মিরা, নোমান ও আহিশ চমকালো। ভীষণ ভাবে চমকালো তারা। একটা নাম তিনজনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যার রেশ ধরেই তো তিনটে জীবন লড়াই করে যাচ্ছে। আফীফ একপলক তিনজন কে দেখে নিয়ে বললো,

~ হসপিটাল ভর্তি হয়ে যে কোনো লাভ‌ই হয় নি সে কথা বলবো না। সিসি টিভি চেইক করে আমি দু বছর আগের সেই মুহূর্তের কিছু ফুটেজ পেয়েছি। তারা হয়তো ভাবতে পারেনি তাদের রাজ্যে ঢুকে কেউ এমন কিছু করবে, তাই ফুটেজ মুছে ফেলেনি। স্ট্রং এভিডেন্স নয়, তবে এর সূত্র ধরেই আমরা এগোতে পারবো। কিন্তু তোমরা যদি সবার থেকে সত্য টা লুকিয়ে রাখতে চাও আই মিন মিহার সাথে যা ঘটেছে তা প্রকাশ করতে না চাও তাহলে এটি এখানেই শেষ। সিদ্ধান্ত তোমাদের!
আহিশ প্রতিবাদ করে উঠলো,

~ অসম্ভব, আমি এমন চাইনা। যে সত্যটা এতদিন লুকিয়ে ছিলো সে সত্যটা প্রকাশ হোক আমি চাইনা। আমার স্ত্রী কে কেউ ধর্ষিতা বলুক আমি শুনতে পারবো না!
~ আমি চাই! এমন টাই হবে। মি. আহিশ ভুলে যাবেন না আপনার স্ত্রী বলে সমাজে সে স্বীকৃতি পায় নি। আপাই মরে গিয়ে বেঁচে গেছে, এখন কার সম্মানের কথা ভাববো? আমি যে উদ্দেশ্যে দুটো বছর এত কিছু করে যাচ্ছি শেষ সময়ে পিছিয়ে যেতে পারবো না। আপনি বলুন মি. আফীফ।
মিরা’র পাল্টা জবাবে আহিশ চুপসে গেল। সত্যি কথায় বলেছে, সমাজে সে মাথা উঁচু করে বলতে পারবে না মিহা তার স্ত্রী। এর থেকে পীড়াদায়ক আর কি আছে? মিরার থেকে আফীফ এমন‌ই কিছু আশা করেছিল। মুচকি হেসে বললো,

~ মিস মিরা আপনাকে এই ফুটেজ আর মিহার পোষ্টমর্টাম রিপোর্ট নিয়ে থানায় কেস করতে হবে। মি. নোমান কেস পাওয়া মাত্র‌ই টিম নিয়ে হাজির হবে মাহমুদ বাড়িতে। আমি সাংবাদিক দের আগ থেকেই জানিয়ে রাখবো, নতুন খবর প্রচারে উন্মুখ হয়ে থাকবে তারা। সাংবাদিক দের সামনে অনল মাহমুদ বা তার লোক কিছুই করতে পারবে না। আমি উপরতলা কে বলে রাখবো এরেস্ট ওয়ারেন্টে সাইন করে দিবে। যদিও বুঝতে পারছি না কতদিন থানায় আটকে রাখা যাবে। পরের দিন‌ই আমরা সৈয়দের কেস তুলবো, ওর বন্ধুরা সাক্ষী দিবে। দুটো কেস যখন রমারমা হবে, তখন চল্লিশ জন পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে কাজে নেমে পড়বে। চব্বিশ জন তিনটে হসপিটাল দখল করবে, আর আটজন মাহমুদের গুদাম ঘরে যাবে, বাকি আটজন মাহমুদের বাড়ি, গুদাম, হসপিটালের আশেপাশে থাকবে। তোমাদের প্রত্যেকের শার্টের বোতামে হিডেন ক্যামেরা থাকবে, যা আমাদের পিসি তে কানেক্ট থাকবে আমরা গুরুত্বপূর্ণ গুলো তখন‌ই পাবলিসড করবো। এভাবে একের পর এক তথ্য ফাঁস হলে মাহমুদ দের কেউ বাঁচাতে পারবে না। পাবলিসড হলেই আমি আমার ষাট জন মেম্বারের টিম নিয়ে হসপিটাল, গুদাম ঘর, অনল মাহমুদের বাড়ি ঘেরাও করবো। এনকাউন্টারের হুকুম নিয়েই ঘেরাও করবো!
সবাই বুঝলো। এভাবে ছাড়া আর কোনো পথ নেই‌। অনান এগিয়ে এসে বললো,

~ আমার কাছে কিছু প্রমাণ রয়েছে, যদিও নড়বড়ে তবে কাজে লাগতে পারে।
আফীফ মাথা নাড়ালো। অনান নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে কিছু কাগজ, ছবি বের করে দিলো। আফীফ দেখলো কিছুটা হলেও কাজে দিবে‌। মিরা বলে উঠলো,
~ আমাদের কিছু ছলের আশ্রয় নিতে হবে। বাবার মৃত্যুর কথাটি জুড়ে দিলে আরো ভালো হয়। আমার কাছে কিছু প্রমাণ রয়েছে, যা বাবার হ*ত্যার কারণ হিসেবে অনল মাহমুদ কে ফাঁসানো যাবে।
~ গ্রেট! আর কি চাই? এবার যে আরো সহজ হলো। মিস আফরা আপনার কিছু বলার নেই?
আফীফের প্রশ্নে আফরা কিছুটা হকচকিয়ে গেল। পরক্ষণেই এগিয়ে এসে বললো,

~ আছে তো! আপনার পরিকল্পনা একটু উল্টে দিবো। আমার মনে হয় ছেলেদের আজ থেকেই কাজে লাগালে ভালো হবে। অনল মাহমুদ কে যখন মি. নোমান ধর্ষ*ণের কেসে এরেস্ট করবে তখন আদিল মাহমুদ চট করেই বুঝে ফেলবে এর পেছনে মিরা, মি. আহিশ বা আমি রয়েছি‌। সে আমাদের কিছুই করবে না কিন্তু সতর্ক হবে। নতুন করে কোনো গার্ড, কাজের লোক নিবে না। ছেলে গুলো হসপিটাল, গুদামে ঢুকবে কি করে?
মেনে নিলো আফীফ। ভুল বলে নি মেয়েটি। মাঝখান থেকে জিয়াউল বললো,
~ কিন্তু আমার মনে হয় না নতুন করে কোনো লোক ওরা নিবে, অনেক লোক ওদের।
অনান চট করে বলে উঠলো,

~ নেওয়াতে হবে, আমরা সেই ব্যবস্থা করবো!
অনান কোন দিকে ইঙ্গিত দিয়েছে বুঝার বাকি র‌ইলো না কারোর। আফরা অনানের কাঁধ চাপড়ে বলে উঠলো,
~ ইয়েস! ব্যবস্থা আমরা করবো! কয়েকটার নিঃশ্বাস বন্ধ করলেই হয়ে যাবে!
সম্মতি দিলো না আফীফ। একজন আইনের লোক হয়ে বেআইনি কাজে সে কি করে হ্যাঁ বলবে। আফরা’র সিদ্ধান্ত কে নাকচ করে বললো,
~ আইন নিজের হাতে নিতে পারেন না মিস আফরা।
মুখ বেঁকালো আফরা। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
~ আপনার আইন মোতাবেক এখানের চারজন মানুষ ই অপরাধী। এই আমি তিনটে কে মে*রেছি, মিরা তো নিজের বাবাকেই ওপেন সু*ট করে দিয়েছে, মি. আহিশ ছয়টা গার্ড একজন ধ*র্ষক কে করে গ*লা কে*টে মেরেছে, মি. নোমান আইনের লোক তবুও আরাফের শরীর কে টুকরো টুকরো করে কে* টেছে। এখন এরেস্ট করবেন? করেন করেন!

হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল আফরা। আফীফ শান্ত কন্ঠে আফরা কে দেখছে। ছেলে গুলো কেমন ভয়ার্ত চোখে দেখছে ওদের। আফরা আবার বললো,
~ কিন্তু আপনার কাছে কোনো প্রমাণ নেই! আমি নিতান্তই সহজ, সরল, কর্মঠ, এতিম এক মেয়ে। আমার কি শত্রুতা থাকতে পারে ওদের সাথে? বড়জোর আমি আপনাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারি। দিবো?
কৌতুক হাসলো আফরা। আফীফ অবাক হয়ে মুচকি হাসলো। দু’পা এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললো,
~ আমাকে ফাঁসিয়ে দিবেন? এত সহজ? আফীফ মুনতাসির খুব ভালো জানেন, কিন্তু হঠাৎ করেই কি হয় কে জানে? আদিল মাহমুদের তিনটে গার্ড কে ওপেন সু*ট করে দিয়েছি! আমি কিন্তু ছুটিতে আছি, সরকারি বন্দুক টাও জমা দিয়ে এসেছি! এত সহজ নয় মিস আফরা!

আফরা পিছিয়ে এলো, এবার আফীফ কৌতুক হেসে ঘাড় নাচালো দু’বার। নোমান বলে উঠলো,
~ নিজেদের মধ্যে কলহ করে লাভ নেই। আমাদের উচিত কাজে লেগে পড়া!
কাঁধে হাত চেপে মিরা এগিয়ে এসে বললো,
~ গার্ড খালি করার কাজটি আমার আর ভাইয়ার উপর ছেড়ে দিন। পুলিশ তো, ধরে নিয়ে বন্দি করে রাখবে‌। আমার উপর আদিল মাহমুদ কে ছেড়ে দিন, ভালোবাসা তো তাকে সেইফ রাখা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মি. আহিশের উপর ছেলেগুলো কে ছেড়ে দিন। আপনারা তিনজন পিসি নিয়ে বসে পড়ুন! আর আফরা সে নিয়মের বাইরে!
পরিকল্পনা একদম গোছানো। আরো কিছুক্ষণ আলোচনা চলতে থাকে। ঠিক হয় কালকের দিনটা দেখে পরদিন শুরু হবে সরাসরি যুদ্ধ। আলাপের এক পর্যায়ে আফরা’র ফোন বেজে উঠে। সবাই চুপ হয়ে যায়। পরিচিত এই নম্বর থেকে অনেকদিন পর ফোন এলো। আফরা চট জলদি রিসিভ করেই বলে উঠলো,

~ পাপা, তুমি খুব নিষ্ঠুর!
অপর পাশ থেকে কোনো উল্লাস বা আদুরে স্বর শোনা গেল না। বরং কিছুটা অস্থির কন্ঠে অনিমেষ মির্জা বলে উঠলেন,
~ ঢাকায় ফিরো মামুনি। জলদি, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে।
পাপার অস্থির কন্ঠ আফরা কে নাড়িয়ে দেয়। ঝটপট বলে উঠলে,
~ আই উইল ব্যাক পাপা, এস সোন এস পসিবল!
দাঁড়ায় না আফরা। দৌড়ে ছাউনি থেকে বের হয়। কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। একে একে যে যার কাজে লেগে পড়ে। সামনে কি অপেক্ষা করছে কে জানে?

মাহমুদ বাড়ির সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে পড়ে মিরা। গার্ডে বাড়ি ভর্তি, কিঞ্চিৎ চিন্তিত সে। যদি না ঢুকতে দেয়? এগিয়ে গিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়াতেই দুটো গার্ড দৌড়ে আসে। তৎক্ষণাৎ বুদ্ধি করে ব্যস্ততা দেখিয়ে মিরা বলে উঠে,
~ সরি সরি, আমার কি খুব দেরী হয়ে গেল? স্যার কি চলে গেছেন? আমাকে যে আসতে বললো! আমি মনে হয় দেরী করে ফেলেছি, কি করবো ভাই যে জ্যাম!
গার্ড দুজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, একজন বললো,
~ বস বাড়িতেই আছেন। আপনি যান।
মুখ টিপে হাসতে গিয়েও নিজেকে দুঃখী দেখালো মিরা। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
~ যাক বাবা বাঁচলাম। আমার তো অনেক ভয় করছিলো। সে যাই হোক ভাই, আদিল স্যার কে ফোন দিয়ে বলে দেন অনল স্যার মিরা কে আসতে বলেছিলো এবং সে এসেছে। এখন‌ই বলবেন, নাহলে চাকরি থেকে বাদ পড়বেন। চেনেন‌ই তো বস কে।

কথাটা শেষ করেই মিরা বাগানে ঢুকে পড়লো। গার্ড টি তৎক্ষণাৎ ফোন বের করলেন। মিরা পিছু ফিরে একটু দেখে হাসলো। এই অভিনয়ের শেষ কোথায়?
ড্রয়িং রুমে বসে চা পান করছিলেন অনল মাহমুদ। দৃষ্টি টিভির দিকে। মনোযোগ সহকারে আইটেম গানের তালে তালে নাচ দেখছিলেন। কলিং বেল বেজে উঠায় মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে, বিরক্তি হোন। কেউ নেই, মিসেস নুরি ঘুমাচ্ছেন।‌ অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজা খুলতে হাঁটা ধরেন। মিরা কে দেখা কপালে বড়সড় ভাঁজ পড়ে তার। অনল মাহমুদের সরে দাঁড়ানোর অপেক্ষা মিরা করে না, ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ে। টিভির দিকে ভুল করেও নজর রাখে না। অনল মাহমুদ রেগে যান, হুংকার দিয়ে বলে উঠেন,

~ এখানে কি করছিস তুই? বাঘের খাঁচায় আসতে ভয় করলো না? তোকে কে বাঁচাবে আজকে?
মিরা শব্দ করে হাসলো। এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে মিসেস নুরি কে খুঁজলো। না পেয়ে খুশিই হলো। ন্যাকামো করে বলে উঠলো,
~ এভাবে বলছেন কেন শশুড়? আমি আপনার একমাত্র ছেলের হবু ব‌উ, আরেকটা তো মরেই গেছে। একটু খাতির যত্ন করুন, যান চা করে নিয়ে আসুন!‌
অনল মাহমুদ মিরা কে দেখলো। অস্বস্তি হলো মিরার। তবে সে চাহনিতে খারাপ কিছুর ইঙ্গিত মিরা পেল না। অনল মাহমুদ নিম্ন কন্ঠে শুধালো,

~ কি জন্য এসেছো? ছেলের জন্য তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি বলে ভেবো না বারবার তোমাকে ছেড়ে দিবো!
~ আপনি আমার কিছুই করতে পারবেন না, সেই মুরোদ আপনার নেই। আদিলের শক্তি তে চলে বড় বড় কথা আপনার ওই পাপী মুখে মানায় না। একজন ধর্ষ*কের মুখে তো নয় ই। তুই কি ভেবেছিস আজ আমি এমনি এমনি এসেছি? আজ তোকে না মে*রে এখান থেকে যাচ্ছি না।
কথা টা বলেই মিরা কাপড়ের ভাঁজ থেকে ছু*রি বের করে। অনল মাহমুদের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না। এগিয়ে গিয়ে মিরার গলা চেপে ধরতেই মিরা নেতিয়ে পড়ে সোফায়। ক্ষত স্থানে আঘাত পেয়ে চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ঠিক তখনি গাড়ির হর্ন খুব কাছে শুনতে পায় মিরা। কষ্টের মাঝেও একটু স্বস্তি মেলে। হাতের ছুরি দিয়ে নিজের বাম হাতে খানিক আঘাত করে অনল মাহমুদের দিকে তাক করে। অনল মাহমুদ এক লহমায় ছু*রিটা কেড়ে নেয়। মিরা হেসে উঠে, হাসির কারণ না বুঝতে পেয়ে অনল মাহমুদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থেমে যায়। ঠিক তখনি পেছন থেকে ভেসে আসে পুরুষালি গর্জন,

~ আব্বু…..!
আকস্মিক ছেলের কন্ঠ শুনে অনল মাহমুদের হাত থেকে ছুরি পড়ে যায়, গলা চেপে ধরা হাতটি আলগা হয়ে আসে। মিরা জোরে নিঃশ্বাস নেয়, একটু হলেই প্রাণপাখি ছুটে যেত। বাম হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উঠে বসে মিরা। এক সেকেন্ডে সময় ব্যয় না করেই দৌড়ের ঝাঁপিয়ে পড়ে আদিলের বুকে। চমকায় আদিল, বুকের ভেতর অসম্ভব কম্পন টের পায়, প্রেয়সীর ছোঁয়ায় শরীর অসাড় হয়ে আসে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে কিছু মুহূর্ত যেতেই আগলে নেয় নিজেও। মিরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
~ ও আমাকে খারাপ ইঙ্গিত দিয়েছে ডাক্তার! আমার শরীরে বাজে স্পর্শ করেছে!
মিরা কে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বুজে নেয় আদিল। কথাগুলো তার নিকট কতটা শক্তিশালী সেটা কি মেয়ে টা বুঝতে পারছে? কতটা ক্ষত সৃষ্টি করছে মেয়েটা জানে? জানলে হয়তো এরকম কথা বলতো না। রক্তিম চোখে অনল মাহমুদের দিকে তাকায় আদিল। অনল মাহমুদ সে দৃষ্টি নিতে পারে না। দু পা পিছলে পড়ে। কিছু বলতে চায় পারে না। মিরা কে কোলে তুলে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

~ আমার বিশ্বাসে এভাবে ফাটল সৃষ্টি না করলেও পারতেন আব্বু! আপনার জন্য আদিল মাহমুদ আজ থেকে মৃত! আপনি জানতেন আব্বু, এই মেয়েটা আদিল মাহমুদের কি! জানতেন! সব মেনে নিয়েছিলাম, সব! মুখ বুজে সব দেখেছি, কিছু বলিনি! কিন্তু আজ!
ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো আদিল। কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে। মনে হচ্ছে মরে যাবে। অনল মাহমুদ এগিয়ে আসে। আদিল দুরত্ব সৃষ্টি করে আবার। স্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠে,
~ এই মেয়েটা আমার নিকট কতটা পবিত্র আপনি জানতেন আব্বু! তার পরেও অপবিত্রতা ছড়িয়ে দিতে উদ্ধত্ব হলেন? মেয়ে টাকে ছুঁতে আমি ভয় পাই আব্বু, আমার ছোঁয়ায় ফুল টা নেতিয়ে পড়বে না তো? আজ আমাকে আপনি যে দুঃখ দিলেন আদিল মাহমুদ কোনো দিন ভুলবে না!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আদিল। মিরাকে গাড়িতে সাবধানে বসিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে বসে গাড়িতে। অনল মাহমুদ ফ্লোরে অত্যন্ত দুর্বল চিত্তে পড়ে যায়। বুকের ভেতর অসহনীয় এক পীড়া টের পায়। সব বুঝি শেষ হয়ে গেল?

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন অনিমেষ মির্জা। কিছুক্ষণ হলো আফরা নিজ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। অনেকটা দিন পর বাবা-মেয়ে এক হয়েছে‌। তবে উল্লাসের ছিটে ফোটাও নেই। অনিমেষ মির্জা আজ অদ্ভুত গাম্ভীর্য নিয়ে বসে আছে। আফরা দু বার প্রশ্ন করেছে তবে উত্তর আসে নি। মেয়েকে ছাড়লেন অনিমেষ মির্জা। মুখ খুলে বললেন,
~ আজ‌ই ফিরে যাবে! এই ফাইল টা নাও, মাহমুদদের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ রয়েছে। আশা করি দুদিনের মধ্যে মাহমুদদের পতন হবে।
আফরা চমকিত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
~ তোমার কাছে প্রমাণ রয়েছে আগে বলো নি পাপা।
~ আজ‌ই এলো আমার কাছে। তুমি এটা নিয়ে ফিরে যাও, মাহমুদ বংশের আমি একটা প্রাণী কেও কারাগারের বাইরে দেখতে চাইনা। বিশেষ করে আদিল মাহমুদ!
ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন অনিমেষ মির্জা। বাবার এত রাগের কারণ খুঁজে পেল না আফরা‌। বললো,
~ আদিল মাহমুদ আমার শত্রু নয় পাপা!

চোখ রাঙালেন অনিমেষ মির্জা। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,
~ অনল মাহমুদ জেলে গেলে বা মরে গেলে পাপের সাম্রাজ্যের একমাত্র অধিকার পাপে আদিল মাহমুদ। আবার এসব কাজ শুরু করবে। মাহমুদদের রক্ত হলো বেইমানের রক্ত, হেসে হেসে তোমাকে ঠকিয়ে যাবে, টের পাবে না। যা বলছি তাই করো।
গজগজ করে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন অনিমেষ মির্জা। আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। পিছু ফিরে বললেন,
~ তোমার ক্ষতি যেন না হয়, খেয়াল রেখো।
চলে গেলেন। আফরা কিছুক্ষণ বসেই র‌ইলো। ফাইল টা হাতে নিয়ে দেখলো। সবকিছুর প্রমাণ রয়েছে, এত এত পরিশ্রমের কোনো দরকার নেই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে সে। হয়তো কিছুটা দেরী করে ফেলেছে।

সৈয়দ রনিত সহ কিছু ছেলেপেলে নিয়ে গুদামঘরে গিয়েছিল নোমান। সতের জন গার্ড ছিলো। কৌশলে স্প্রে’র সাহায্য অজ্ঞান করে নিয়েছে। মাঝারি সাইজের এক জিপে সবগুলোকে চাপা দিয়েছিল এন্টিক ফুলে। কাজ গুলো এতটা স্মোথ,দ্রুত হয়েছে কোনো রকম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। যদিও এতে মাহমুদের হেঁয়ালি, মিথ্যে অহংকার সাহায্য করেছে। তারা নিজেদের রাজা ভেবে এতটাই উল্লাসে ছিলো, ভাবার সময় হয় নি কেউ তাদের ডেরায় গিয়ে এমন কান্ড ঘটাবে‌। নিজ বাড়িতেই ঠাঁই দিয়েছে লোক গুলোর।

কিছুই করবে না এদের। কিছুটা দিন শুধু অজ্ঞান করে ফেলে রাখবে, কাজ হয়ে গেলে ছেড়ে দিবে।‌ গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গাড়ি চালাচ্ছে নোমান। থানায় যাবে না আজ। কাজ গুলো সম্পন্ন না হ‌ওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না। কিছুটা ভয় তাকে গ্রাস করছে। নিজের জন্য ভাবে বলে তার মনে হয় না, সকল ভাবনা জুড়ে দুটো মেয়েই। একজন তার অতি আদরে বড় করা বোন, আরেকজন অতি যত্ন পুষে রাখা প্রাণভোমরা। একজনের কিছু হলে সে হারিয়ে যাবে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। চাপা শ্বাস ফেলে ফোন বের করলো নোমান। মি. জিয়াউল নামে সেইভ করা নম্বরে ডায়াল করে ফোন স্পিকারে দিয়ে দিল। রিসিভ হতেই বললো,

~ অল ডান?
~ ইয়াহ! মি. নোমান আপনিই মেইন কাজ টি করে দিয়েছেন। আমি তো শুধু ওদের জায়গা মতো সেট করে দিয়েছি। তবে কথা হচ্ছে ধরা পড়ার চান্স নব্ব‌ই পার্সেন্ট। কোথায় পেশীবহুল গার্ড, আর কোথায় উনিশ বিশ বছরের হ্যাংলা পাতলা ছোকরা!
গড়গড় করে কথা গুলো বলে চুপ করলো জিয়াউল। নোমান মুচকি হেসে বললো,
~ সেসব কে খেয়াল করবে জিয়াউল? মাহমুদ দের এখন যে সময় চলছে বা চলবে এদিকে নজর দেওয়া হয়ে উঠবে না। তাই আমি প্ল্যান খানিক চেন্জ করে আদিল কে না জানিয়েই গার্ড প্রতিস্থাপন করেছি। আজকের দিনটাই তো! প্যারা নিবেন না, বাকিটা আমি দেখে নিবো!

আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলো নোমান। পরের গন্তব্যে ছুটতে শুরু করলো। অন্যদিকে জিয়াউল চিল মুডে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে নিজ ভাবনায় বলে উঠলো,
~ এবার একটু বিশ্রাম নিবো। বাবাহ কত পরিশ্রম গেল!
চোখ বুজলো জিয়াউল। নিদ্রা নিজ উদ্যোগে ভর করছিল দু চোখে, কারো ব্যাঙ্গাত্মক ডাকে তা এক ছুটে পালিয়ে গেল,
~ এই মি. খালেদা জিয়া! শুনছো? খালেদা জিয়া?
মুখ টিপে হাসছে অনান। ছেলেটাকে জ্বালাতে তার বেশ ভালো লাগে। জিয়াউল শুয়ে থেকেই চোখ রাঙালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

~ আদিবাসী তোমাকে বলেছি এই নামে ডাকবে না। আমার সুন্দর একটি নাম রয়েছে।
নামের বিকৃতি সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না অথচ পছন্দের মেয়েটি বারংবার এক‌ই কাজ করে। জিয়াউলের গমগম কন্ঠে অনান যেন আরো মজা পেল। আবার বললো,
~ মি. খালেদা জিয়া!
উঠে বসলো জিয়াউল। অনানের হাত ধরতে যেতেই অনান দূরে সরে গেল। হাসতে শুরু করলো মেয়েটি। দরজার দিকে দৌড় দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
~ মি. খালেদা জিয়া তোমার একটা মিসেস খালেদা জিয়ার প্রয়োজন। সে তোমার মাথার নাট বল্টু টাইট করে দিবে।
হাসির শব্দ যতক্ষণ শোনা গেল মুগ্ধ হয়ে শুনলো জিয়াউল‌। মেয়েটা কখন তার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে সে টের পায়নি। আদৌও জায়গা টা শক্তপোক্ত কিনা সে জানে না। তবে মেয়েটাকে দেখার স্বাদ তার মিটে না, এত এত কথা শুনতেও বিরক্ত হয় না। তবে কি সে ভালোবাসে? নাকি সবটাই মোহ। উপজাতি বলে খানিক কৌতুহল। হবে হয়তো, ভালোবাসা কি এত সহজ? জিয়াউল আবার শুয়ে পড়লো, এসব ভাবতে ইচ্ছে করে না। যা হ‌ওয়ার নয় তা নিয়ে ভাবলে বুকের রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। চোখ বুজে জিয়াউল নিজের মায়ের কথাগুলো স্মরণ করলো,

~ তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছি জিয়া। তোমার পেশা আমার কখনোই পছন্দের নয়, ছেলেকে দূরে রেখে কোনো মা’ই ভালো থাকতে পারে না। শুধু মাত্র তোমার মুখের হাসির জন্য রাজী হয়েছি। কিন্তু তুমি যদি এখন একটি উপজাতি মেয়ে ধরে এনে বলো বিয়ে করবে। তাহলে মা কে ভুলে যাও। উপজাতি বিয়ে করার খেসারত তোমাকে দিতে হবে না, তুমি থাকবে ডিউটিতে। কোথায় রেখে যাবে ওই মেয়েকে? তার জাতি তাকে যেকোনো উপায়ে খুঁজে বের করবে, ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের দেশ এতটা উন্নত নয় জিয়া। ভুলে গেছে মারমা মেয়ের কাহিনী? ভালোবেসে ধর্ম পরিবর্তন করেছিলো বলে গণধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। আমি মানছি মেয়েটি আমাদের ধর্মের কিন্তু সে উপজাতি‌। তাদের নিয়ম নেই গোত্রের বাইরে বিয়ে করার। বিপদে আমরা পড়বো! আগে থেকে সাবধান হয়ে যাও।
জিয়াউল তখন মা কে বুঝাতে পারেনি এই মেয়ে গোত্র ছেড়েছে আরো কয়েকবছর আগে। সে স্পষ্ট টের পেয়েছিল তার মা শুধু মাত্র একটি যুক্তি ধরে নিজের অপছন্দের কথা উল্লেখ করলো। কথা বাড়ায় নি জিয়াউল। ইচ্ছে হয়নি। নিজের ফোকাস থেকে সরে যাচ্ছিলো। তবে আজ মেয়েটার এমন বাচ্চামো খানিক ক্ষতটা তাজা করে গেল। বন্ধ চোখের পল্লব কিছুটা কেঁপে উঠলো‌। আনমনেই গলা উঁচিয়ে গেয়ে উঠলো,

“ভাগ্য আমার ছুবল মারে রক্তে বিষের জ্বালা.. তুমি আমার আঁধার রাতের একশো তারার মালা!
তোমার আমার এই কাহিনী হাজার বছর ধরে….ভালোবাসার গান শুনাবে প্রাচীন কোনো সুরে!
বেহুলা আমি মরলে আমায় নিয়ে ভাসাইয়ো ভেলা!”
মুচকি হাসলো জিয়াউল। উঠে বসলো। ঘুম ছুটে গেছে, আসবে না। ফোন টা হাতে নিলো কাজ কতদূর খোঁজ নিবে। উপস্থিত হলো আফীফ। ঠিকঠাক হয়ে বসলো জিয়াউল। ঘরে ঢুকেই আফীফ তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
~ পিসি নিয়ে বসো ফাস্ট!
আবার খানিক ভেবে বললো,
~ না না, আমি বসছি। তুমি এককাজ করো। মিস মিরা কে নিয়ে থানায় যাও‌। এক সেকেন্ডে সময়‌ও খুব জরুরি।
আফীফ কথা বলেই বেরিয়ে গেল। চোখে মুখে তার চিন্তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বস্থি পাচ্ছে না। জিয়াউল রেডিই ছিল, বাইরে এসে একপলক আফীফের ঘরে নজর বুলিয়ে হাঁটা ধরলো। পেছন থেকে আফীফ খানিক গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো,

~ সাবধানে। নিজের খেয়াল রেখো!
হাসলো জিয়াউল। ছোট্ট কথাটা তাকে কত আনন্দ দেয় বলার বাহিরে। অনান দাঁড়িয়ে ছিল দরজায়, জিয়াউল তাকালো না। মন খারাপ হয়ে গেল অনানের। দরজা বন্ধ করে দিলো। জিয়াউল যে তাকে সুক্ষ্ম ভাবে ইগনোর করে গেল বুঝলো সে। মানলো না। অযহত মন কে না মানাতে পেরে চুপচাপ র‌ইলো!

পিটপিট করে চোখ খুলে মিরা। বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে নির্জীব থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝেনি। চারপাশ নজর বুলিয়ে বুঝতে পারে কোথায় আছে। আশেপাশে মানুষ টাকে খুঁজে, পায় না। উঠে দাঁড়ায়। গলা টা কেমন টনটন করে উঠে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গলা লক্ষ্য করে। আঙুলের দাগ স্পষ্ট। হাসে মিরা! দাগ গুলো তাকে নিজের জয়ের কথা মনে করিয়ে দিলো। ফোন তার নিকটেই ছিল। ভাইয়ার নম্বরে ফোন করে, রিসিভ হয়। অপর পাশ থেকে চাপা স্বর ভেসে আসে,
~কোথায় তুমি? সব ঠিকঠাক?
~আমার এদিকে সব ঠিকঠাক। তবে ততক্ষণ থাকবে যতক্ষণ আমার আদিল ঠিক থাকবে!
মিরা’র কথায় চমকালো নোমান। অস্পষ্ট শুধালো,

~তোমার আদিল?
~নতুন শুনছো তুমি? আদিল খু*নী, ধর্ষ*ণের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, স্মাগ*লার, সর্বোচ্চ নিকৃষ্ট জীব! তবুও এই মিরা শিকদার আদিল মাহমুদ কে ভালোবাসে। হ্যাঁ ভালোবাসে! স্বীকার করতো কোনো অসুবিধা নেই!
~সবকিছু প্রকাশ হলে আইন আদিল কে ছাড়বে না মিরু।
~কেন ছাড়বে না? তুমিও তো খু*নী! আমিও তো খু*নী! দিব্যি তো ঘুরে বেড়াচ্ছি! তাহলে? আদিশের ভান্ডারে কোনো সৎ কাজ নেই, বাবার সব পাপের ভাগীদার সেও! তুমি যদি বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে একজন টুকরো টুকরো করে কাঁ*টতে পারো, আদিল কেন বাবা কে ভালোবেসে এসব পারবে না? যার শৈশব কেটেছে স্মাগ*লার দের সাথে, যার কৈশর কেটেছে খু*নীদের সাথে, যুবক বয়সে ধর্ষ*কের সাথে থেকেও যে একজন ধর্ষ*ক হয়নি! তাকে তোমার আইন কেন শাস্তি দিবে? আইন কি করে বুঝবে ভালোবাসা একটি মানুষ কে অন্ধ করে দেয়। এই যে যেমন আমাকে করেছে। আমি আমার শপথ ভুলে গেছি, যার কষ্ট দেখবো বলে এতকিছু তার কষ্ট‌ই আমাকে মৃত্যুর স্বাদ পাইয়ে দিচ্ছে! তাহলে?
জবাবে কোনো কিছু পেল না নোমান। বোনের সব কথা সত্য। তাদের অপরাধী কখনোই আদিল ছিল না। আদিল কে শুধু মাত্র তারা একটি সিড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। চাপা শ্বাস ফেলে বললো,

~আফরা ছাড়বে না!
~আদিলের সাথে তার কোনো শত্রুতা নেই!
~আফীফ মুনতাসির এলাউ করবে না মিরু। সে একটি আইনের লোক, দেশের স্বার্থে এত কিছু করছে‌।
~ আমি কিছু না জানিনা ভাইয়া! আমি শুধু চাই ডাক্তার ঠিক থাকুক। তা করতে যদি আফীফ মুনতাসির কে টপকে দিতে হয় তাই হোক! সবাই নিজ স্বার্থে বাঁচে, আমিও!
ধমকে উঠলো নোমান,

~ পাগল হয়ে গেছ মিরা। কিসব বলছো! দোষী কোনো অংশেই আদিল কম নয়। মানছি তার বেড়ে উঠা অপরাধ জগতের সাথে, তার কি বোধ শক্তি ছিল না? তার সামনে তার বাবা একজন মেয়েকে ধ*র্ষণ করলো; সেই বাবার প্রতি এত ভালোবাসা আসে কি করে মিরা? আমার তো ঘৃণা হয়! নিজ হাতে বাবা কে মেরেছিলে মিরা। ভুলে গেছ? সে কিন্তু ধর্ষ*ক ছিল না। শুধু মাত্র বোনের খু*নীদের সাথে তার গলায় গলায় ভাব ছিল। তবুও মেরেছো। তাহলে আদিল কেন মনুষ্যত্ব হীন? সে কেন বাবার বিরুদ্ধে যাচ্ছে না? কেন বাবা কে আইনের হাতে সোপর্দ করছে না?
ফোন কেটে দিল মিরা। রাগে ফোন ধরে রাখা হাত কাঁপছে তার। সে জানে ভাইয়ের একটা কথাও ভুল নয়, সে নিজ হাতে বাবাকে মেরেছে কিন্তু আদিল পারবে না। সে বাধ্য! কিন্তু তাকেই কিছু একটা করতে হবে। আদিল কে বুঝালে হিতে বিপরীত হবে। ভাবনায় বসে গেল মিরা‌। তাকে অন্য উপায় খুঁজতে হবে! খুব শিঘ্রই!
ভাবনায় ব্যস্ত মিরার ঘোর কাটলো ফের ফোনের শব্দে। অচেনা নম্বর! কপাল কুঁচকালে সে।‌ রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে বললো,

~ মিস মিরা বলছেন? আমি জিয়াউল বলছিলাম। থানায় যেতে হবে। কোথায় আপনি?
মিরা উঠে দাঁড়ালো। ভুলে গিয়েছিল। চটপট বলে উঠলো,
~ এখন নয়, সন্ধ্যায়। রাতের মধ্যে জানাজানি হবে, সকাল হতেই পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করবে। সুযোগ দেওয়া চলবে না, পালানোর!
জিয়াউল কিছুটা বিরক্ত হলো। প্রকাশ না করে ফোন কেটে কুঁচকানো ভ্রু নিয়েই বাড়ির পথ ধরলো। আগে বললে খুব ক্ষতি হতো? অযহত সে সময় নষ্ট করলো।

সময় টা এখন বিকেলের শুরু হবে হয়তো। অনেকদিন পর সালেহা বেগম নিচে নেমেছেন। মনিরা সুযোগ টা মিস করতে চায় নি, শাশুড়ির সাথে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। পুরোনো ক্ষত ভুলে , অন্তরে জ্বালা নিয়েও মেয়েটি দিব্যি হাসছে। কিন্তু হঠাৎ করে সালেহা বেগমের অতিত জানতে চেয়ে পরিবেশ গুমোট করে দিয়েছে সে। সালেহা বেগম গম্ভীর মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনিরা কিছুটা ভয় পেল। মিনমিন কন্ঠে বললো,
~ আম্মা আপনি কষ্ট পাবেন না। আমি আর প্রশ্ন করবো না।
সালেহা বেগম মুখ তুললেন। মনিরা ভীত মুখশ্রী দেখে মৃদু হেসে বললেন,

~ বাবার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করছিলাম। একদিন এসে হুট করে শুনি আমার বিয়ে। পাত্র ভালো, একটি ছেলে রেখে ব‌উ চলে গিয়েছে। আমাকে ছেলে সহ নাকি মেনে নিবে। কান্না কাটি শুরু করলাম, রাজী হলাম না। আব্বা এসে বুঝালেন। তারা চলে গেলে আমার যাওয়ার জায়গা ছিল না। ভবিষ্যত অনিশ্চিত। মেনে নিলাম, বিয়ে হলো। আতিকুর তখন তিন বছরের। আমার ছেলেটা নয় মাসের। শুরুতে আতিকুর আমাকে সমীহ করলেও বড় হতে হতে প্রতিবেশীদের নানান কথায় আমাদের সম্পর্কে তিক্ততা এলো। মানুষ করতে পারলাম না। আমার ছেলে আমার খুব বাধ্য। বিয়ের দুবছর হতেই আমার দেওয়া শর্ত আশরাফ ভুলে যায়। জোর করে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। আমার রমিজদার ভালোবাসাটা আমার শরীর থেকে মিলিয়ে দেয়। সন্তান আসে!

তাকেও ঠিক মানুষ করতে পারিনি! ভয়ে ছিলাম। আমার আহিশ টা না জানি এদের সাথে মিশে খারাপ হয়ে যায়‌। হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলাম। বাবার ছেলে বলে না? আমার রমিজদার অংশ নষ্ট হয় নি। আমার আহিশ আর দুটোর মতো হয়নি। কিন্তু আমার ব্যর্থতা কি জানো? আমার ছেলেটাকে আমি বলতে পারি না তার জন্মদাতা বাবার কথা, আমার রমিজদা তার থেকে বিলীন। আমাদের জীবন এমন হয় কেন? একটু এদিক সেদিক হলে ক্ষতি হতো? আমার রমিজদা বেঁচে থাকতো, সুখের সংসার হতো আমাদের। আমি, রমিজদা, আহিশ তিনজন মিলে ছুটে চলতাম স্বপ্নের পিছে! হয় না কেন এমন?
মনিরা দেখলো মহিলার গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কখন তার‌ও চোখ ভিজে এসেছে বুঝেই নি। শাশুড়ির হাত আঁকড়ে ধরলো মনিরা, একটু ভরসা হ‌ওয়ার চেষ্টা করলো। তবে সব ক্ষেত্রে কি ভরসা হ‌ওয়া যায়? সালেহা বেগম দরজা ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে আছেন। এক জোড়া পা দেখেছেন তিনি। বিচলিত হলেন না। তিনি জানেন ওই পা জোড়ার মালিক তার রমিজদার অংশ!

আদিল দেখছে সাদা শার্ট পড়া বৃদ্ধ লোকটি নিথর হয়ে পড়ে থাকা দেহটার হাত ধরলেন। পালস চেইক করছেন। পরমুহূর্তেই চিন্তিত মুখ কেমন মলিনতায় ছেঁয়ে গেল।‌ ধক করে উঠলো তার বুক। ডক্টর উঠে দাঁড়িয়ে দুটো শব্দ খরচ করে শরীরে থাকা রঙিন কাঁথা দিয়ে মুখটা ঢেকে দিলেন, আদিল ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে। অবশ হয়ে আসছে তার শরীর। বুকের ভেতর অসহনীয় ব্যাথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। মস্তিষ্ক কিছুক্ষণের জন্য যেন অচল হয়ে গেছে। কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে ওই রঙিন কাঁথায় মোড়ানো মুখশ্রী টা দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাঁথা টা তার মালিক কে ঢেঁকে রাখার জন্য প্রাণপণে লড়াই করে যাচ্ছে। আদিল উঠতে চেষ্টা করলো, তবে কিছুতেই পারলো না। না পেরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। অবশ কাঁপা হাত তুলে কাঁথা তে রাখতেই শরীরে অদ্ভুত এক জ্বালা টের পেল আদিল। বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলে কাঁথা টা শক্ত করে ধরে সরাতেই ভেসে উঠলে কঙ্কালসার একটি শরীর। সৌন্দর্য হীন, শ্রীহীন একটি মুখ, স্পষ্ট ব্যাথার ছাপ। কত‌ই না কষ্ট হয়েছে সে সময়। শক্তপোক্ত কঠোর আদিল আজ ছোট্ট শিশুর মতো আচরণ করছে‌। কেমন এক ঝটকা খেল, হাত সরিয়ে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো ছেলেটি। এই আত্মচিৎকারে হয়তো লাশ টাও আঁতকে উঠছে। পাগলের মতো বিড় বিড় করে ডক্টরের বলা দুটো শব্দ উচ্চারণ করতে থাকলো,

~ নো মোর, নো মোর, নো মোর!
দরজায় দাঁড়ানো মিরা নিজের তাল রাখতে পারলো না। দরজার হাতল চেপে কোনো রকম দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষ টার আর্তনাদ দেখতে লাগলো বিরস বিমুঢ় দৃষ্টিতে। এই আদিল কে সে চিনে না, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক আদিল তার সম্মুখে বসে‌। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। আষাঢ়ে আকাশের মতো পুরো পৃথিবী তার অন্ধকার হয়ে এলো। ছোট ছোট পা ফেলে বিছানার কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এক পলক বন্ধ চোখের নির্জীব মেয়েটির দিকে তাকালো, মুহূর্তেই চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষে মৃদু কাঁপতে লাগলো মিরা। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা তপ্ত জল। খানিক সময় পর তা বাঁধ মানলো, অবিরাম গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫২+৫৩+৫৪

মননস্পটে ভেসে উঠলো কিছু স্মৃতি। কিছু তিক্ত মুহূর্ত। ভেসে উঠলো মদ খেয়েও নিজেকে ঠিক রাখা শরীর টা, সেই হাসি, সেই আত্মচিৎকার। সহ্য করতে পারলো না মিরা। দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, মনে হলো মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েই মৃদু হাসছে, তাকে উপহাস করছে। বসার রুমের সোফায় বসে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। কান্নার সময়সীমা কতক্ষণ হলো মিরা টের পেল না। একপলক খোলা দরজা ভেদ করে নিস্তব্ধ ঘরটায় নজর রেখে ফোন‌ দিলো কাউকে। রিসিভ হলো তাড়াতাড়িই। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
~ নাদিয়া ইজ নো মোর!

হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৫৭+৫৮