চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫ (২)

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন

ভোরে বাড়ি ফিরে ফারাজ। ফজরের সময়। বাড়ি তখনও অন্ধকার। ভোরের আলো সবে মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। অন্দরমহলে প্রবেশ করতেই হঠাৎ খেয়াল করে কেউ একজন সিঁড়ির নিকটে বসে তসবিহ পাঠ করছেন। ফারাজ ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে আসতেই বসে থাকা ব্যক্তি উঠে এগিয়ে আসে। কাছে আসতেই ফারাজ মার্জিয়াকে আবিষ্কার করল। মার্জিয়া মলিন মুখ নিয়ে আশাভরা গলায় ফারাজকে জিজ্ঞেস করল,”আমার পোলা আর বউয়ের কোনো খবর পাইছো আব্বা?”

ফারাজের আজ একটুও মজা করতে মন চাইল না। সে গভীর একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “জ্বী না আম্মা।”
আম্মা ডাক শুনে মার্জিয়ার হৃদয় ব্যথাতুর হলো। মাহাদীর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। তার চেয়েও বড় বিষয় ফারাজ তাকে আম্মা বলে ডেকেছে। কেমন যেন একটা শান্তি লাগছে।
“আপনি রুমে গিয়ে বিশ্রাম করুন। এখানে বসে আছেন কেনো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমার ওইদিকে দুনিয়া ধ্বংস হইয়া গেছে আর বিশ্রাম? নামাজ পইড়া তোমার জন্য অপেক্ষা করতাছিলাম। চিত্রার থেকে শুনলাম তুমি রাতে বাহিরে গেছো। ফিরলে ভোরেই ফিরবা। তাই বইসা ছিলাম। যদি আমার পোলা-বউয়ের খবর আনো সেই আশায়। আব্বা কিছু করো। আমার পোলার বউটা পোয়াতি। ওর শরীরটা ভালা ছিল না। ” বলেই অশ্রু ঝরায় মার্জিয়া। ফারাজ আরেকটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। আঁতিপাঁতি করছে ভেতরটা। বুকের ভেতর কিছু একটা আঁটকে আছে। উগড়ে ফেলতে পারলে হয়তো হালকা লাগত। ফারাজ মার্জিয়াকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজেই রুমে দিয়ে আসে। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রুমের বাইরেই। সে জানে চিত্রা ঘুমায়নি। আজকাল চিত্রার সঙ্গে ভালোই দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এই দূরত্ব তাকে অস্ত্র ছাড়াই জখম করছে। তবুও…..

ফারাজ রুমে গিয়ে দেখতে পেলো চিত্রা ঘুমিয়ে আছে। হয়তো শেষ রাতে হুট করে তার চোখ বুঁজে এসেছিল অপেক্ষা করতে করতে। ফারাজ ক্লান্ত শরীর নিয়ে গায়ের শার্ট খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। প্রিয়শীর গায়ের গন্ধে নিজেকে না জড়ালে আজকাল ঘুমই আসে না চোখের পাতায়। চিত্রার দুইপাশে দু’টো কোলবালিশ। পায়ের নিচে একটা আর মাথার নিচে দু’টো বালিশ রেখে ফ্যান ছেড়ে কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে সে। এসি ছাড়লে কি ক্ষতি হতো? ফারাজের আবার এসির বাতাস খেতে খেতে ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগে না। চিত্রার নরম শরীর জড়িয়ে ফারাজ দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে, ” আমি অতীত ভুলে যাবো, বর্তমান মুছে দেব। তবে তোমার দায়িত্ব কেবল একটাই–চিরকাল আমার হয়ে থাকা। কারণ তুমি ছলনা করলে ফারাজ তোমার প্রতিও বিন্দুমাত্র মায়া দেখাবে না৷ ভালোবাসার জন্য মরতেও পারি সব ছাড়তেও পারি আর মারতেও।”

সকালে ঘুম থেকে প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে চিত্রা জেগে ওঠে। রুমে খাবার ওষুধ সব কিছুই গুছিয়ে সাজিয়ে রাখা। সাজানোর ধরন দেখেই বোঝা যায় কার কাজ। ফারাজ নিচে। ফোনে কথা বলছে। অ্যাপোলো শত্রুতা শুরু করেছে। চুক্তি বাতিল আর উপহার প্রত্যাখ্যান করার পর থেকে। কালো জগতের এটাই নীতি। এই জগৎ তোমাকে ভালো হতে দেবে না। পাপ করলেও ভুগতে হবে আর ছাড়তে গেলে তো মৃত্যু ছাড়া মুক্তি নেই। তবে ফারাজের কি এত জলদি মরলে হবে? সংসার গুছাতে হবে না? শেষ পর্যন্ত চিত্রার ভরসা হয়ে পাশে থাকতে হবে না?আর এখনো তো ফারাজ থেকে পিতা হওয়ার জার্নি বাকি। পদোন্নতি না হতেই রিটায়ার হওয়া কি সম্ভব চাকরি থেকে? তাহলে জীবন কি করে চলবে?

ফারাজ ফোন রাখতেই পেছনে চিত্রাকে দেখতে পায়। এমন হুট করে চিত্রার আগমন সে আশা করেনি। ফারাজ একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “আগুন সুন্দরী নাস্তা শেষ?”
“খেয়েছি।”

চিত্রার মন খারাপ। ফারাজ জানে এই মন ভালো করার ওষধ কী? সে ফোন হাতে নিয়ে একটা কল করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে রোজ নিচে নেমে আসে। বাড়ির সবাই তখন নিচে। মোহনার সুন্দর চোখের নিচে এক রাতের ব্যবধানেই কালি পড়ে গিয়েছে ফুলির চিন্তায়। ওদিকে ফুলির আত্মীয়দেরই একই অবস্থা। তবে তার চেয়েও বড় বিষয় তারা রোশান কিংবা এলাহীদের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস কুড়াতে পারেনি। ফুলির চাচা এই বাড়িতে যখন কাজ করতে প্রথম এসেছিল তখন সেও যুবক ছিল। কত মানুষ চোখের সামনে খুন হয়েছে,কত নারী চোখের সামনে ধর্ষণ হয়েছে,খুন হয়েছে সেইসবের সাক্ষী ফুলির চাচা। কিন্তু মুখ খুললে সেও ওই মৃতদের মধ্যকার একজনই হতো। বুদ্ধি খাটিয়ে এই পর্যন্ত টিকে থাকা তার। তবে কখনও ভাবে নি তার আজ এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। ফুলি মারা গেলে ভাইয়ের কাছে কি জবাব দেবে? বাড়িতে পুরুষ বলতে ফারাজ,অভ্র আর বজ্র ছাড়া আপাতত কেউ নেই। জুনায়েদ এলাহী ছিলেন তবে খানিক আগে চলে গিয়েছেন। আজকাল সে আবার অনেক ব্যস্ত থাকেন। ফারাজ সকলকে অন্দরমহলে উপস্থিত হতে বলে। একরাশ কৌতূহল নিয়ে সকলে অন্দরমহলে উপস্থিত হতেই রোজ সেখানে উপস্থিত হয়। ফারাজ তখন চিত্রার হাত শক্ত করে ধরে তাকে বলে,

“এত কাঁদো কেন বিবিজান? দুঃখকে মেনে নিয়ে তার থেকে দুঃখিত শব্দটা শুনতে তোমার এত ভালোলাগে বুঝি? দুঃখ পেলেই দুঃখ। নিজের সব পরিস্থিতিতে তোমার শক্ত হওয়াটা প্রয়োজন।”
ফারাজ রোজের দিকে ইশারা করতেই ফুলিকে নজরে আসে চিত্রার। সবাই ফুলিকে সুস্থ ভাবে দেখে অবাক। এটা কী করে সম্ভব? রোশান বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া মেয়েটি এখনও বেঁচে আছে? মোহনা ফুলিকে দেখা মাত্র দৌড়ে জড়িয়ে ধরে। এলোপাতাড়ি চুমু খায় গালে, মুখে, কপালে। খুশিতে সে কান্না করে দেয়। চিত্রা চোখেও জল। তবে এই জল খুশির,আনন্দের। নদীও খুশী। ফারিয়াটার কোনো অনুভূতি নেই। এই জগতের বাহিরে সে। ওদিকে রুমানা নাক ছিটকে সেখান থেকে চলে যায়। চিত্রাকে এখন তার সহ্য হয় না। এই মেয়ে বংশ বাড়াতে আসে নি বরং ভাইয়ে ভাইয়ে ক্যাচাল লাগিয়ে বংশেরবাতি গুলো নিভাতে এসেছে। একে জলদি কোনো না কোনো উপায়ে সরাতেই হবে। বিনাশিনীদের এই বাড়িতে কোনো জায়গা নেই।

মোহনা দৌড়ে এসে ফারাজের পায়ে পড়ে যায়। ফারাজ চটজলদি পা সরিয়ে নিয়ে বলে, “আহা কী করছেন?”
“ফারাজ তোমার এই ঋণ সোধ হওয়ার নয়। তুমি আমার ফুলকে সুস্থভাবে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছো।”
ফারাজ হাসল। চিত্রা গিয়ে মোহনাকে উঠাতেই ফারাজ বলল,”যদি ঋণ পরিশোধ করতে এতোই মন চায় তাহলে এখনও ভেবে দেখুন আপনার কোন ভুলের কারনে এই দিন দেখতে হয়েছে। এখনও সময় আছে ভুল শুধরে ফেলুন। আর অন্যায়ের প্রতিবাদ নিজ থেকে করতে শিখুন।”
ফারাজ চিত্রার দিকে তাকায়। সরু চোখ করে বলে, “রাতে আমার ঠিক করে ঘুম হয় নি। মাথাটা একটু মালিশ করে দিবে? খুব ঘুম পাচ্ছে।”
চিত্রা মুচকি একটা হাসি দেয়। অর্থাৎ সে সম্মতি প্রকাশ করছে।

এতদিন পর ফারিয়ার মুখে হাসি ফুটেছে। তার নিহান যে বাড়ি ফিরল বলে। দুপুরে বাড়ি ফিরে নিহান। ফিরেই হুট করে প্রথম দফায় সাক্ষাৎ হয়ে যায় চিত্রার সঙ্গে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে বলে ওঠে, ” মাথায় আপনার আসলেই অনেক বুদ্ধি আছে। দেখা যাক বুদ্ধি কবে বোকামিতে বদলায়।” চিত্রাও কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল নিহানের দিকে। বুঝতে চাইল সেই কথার মানে। তবে মাথায় ধরল না।
নিচে সুলেমান এলাহীর মাথা ঠিক নেই। ঠিক থাকবে কেমন করে? এতদিন পর এই প্রথম সমুদ্রে তাঁদের চালান ধরা পড়েছে। কীভাবে ধরা পড়ল মাথায় ঢুকছে না। প্রশাসনকে এত এত টাকা খাইয়ে লাভ কী যদি অন্য কারো চালান ধরতে গিয়ে উল্টো তাদেরটাই ধরে একগাল ক্ষমা চায়? এদের পাছা কেটে সেলাই করে দেওয়া উচিত। তখন অন্তত বিশেষ কাজ সারতে যখন বসতে হবে তখন বুঝবে পারবে যন্ত্রণা কাকে বলে। সেই যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারবে যা আজ এলাহীর বাড়ির পুরুষদের হচ্ছে।

দুপুরে সকলে একসঙ্গে খেতে বসে। চিত্রা নলা তুলে ফারাজকে খাইয়ে দিচ্ছে। ওইসব চামচ, ছুরি খেলে কি পেট ভরে? সুন্দর করে দুপুর বেলায় পেট ভরে খাবে। তা নয়! তাকে দেও সবসময় পাতালতা,ঘাস খেতে। এই পর্যন্ত নিজের রান্না সে কাউকেই করতে দেয় নি। জিজ্ঞেস করলেই বলে,”আমি যার-তার হাতের রান্না খেতে পারি না। বুঝোই তো? হাইজেন বলেই তো একটা কথা আছে?”
চিত্রার আর হাইজেন নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল না। কারণ জিজ্ঞেস করলেই বলবে, “হাইজেনের স্পেলিং বলো তো।”
চিত্রা ফারাজের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে যাবে তার আগেই অভ্র এসে ফারাজের সামনে দাঁড়ায়। অভ্র এসেই ফারাজকে বলে,

“ভাই একটা কথা ছিল। অনেক দরকারি।”
ফারাজ একপ্রকার ভাবলেশহীন ভাবেই বলে, “হ্যাঁ, যা বলার বল।” তার কথার ধরন দেখে ঝোঝা যাচ্ছে সে আগে থেকেই সব কিছু জানে। অভ্র একবার সকলের দিকে তাকালো বলল, “নদীর ঘাটে একজন পুরুষ আর নারীর লাশ পাওয়া গিয়েছে।”
সকলে ঘাবড়ে উঠলেও ফারাজ পানি খায়। মনে মনে বলে উঠে,” নিরুর দেখা ভারতীয় সিরিয়ালের কাছেও বাঙালির রোজকার নাটক ফেল। ওরে নিরু রে তোকে খুব মনে পড়ছে না রে।”

নদীর ঘাটে সন্তানহারা এক মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তনাদ আকাশ ছুঁয়ে গেছে। সেই আর্তি নদীর জলে গলে গলে মিশে যাচ্ছে। মাহাদী এবং তার বউয়ের মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মার্জিয়া। নিস্তব্ধ আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মানুষজন নির্বাক। তারা কিছু বলতে পারে না, শুধুই চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ে নীরবে। এই মৃত্যু শুধু তিনটি প্রাণ কেড়ে নেয়নি, তা গোটা পরিবারের অস্তিত্ব নিঃশেষ করে দিয়েছে। এমন নিষ্ঠুরতম মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না। স্বামীকে হারানো প্রথমে,তারপর ছোট ছেলের নবপরীনিতা বউয়ের তো কোনো খোঁজই পেলেন না। আর এখন সেই শোক কাটিয়ে উঠার আগেই হারালেন গর্ভবতী ছেলের বউ আর ছেলেকে। সোহাগ অবশ হয়ে বসে আছে লাশের ধারে। সে কাকে শান্তনা দেবে? সেই মাকে, যিনি নিজের কোলের সমস্ত শূন্যতা গলে যেতে দেখে ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন? না নিজেকে, যে আজও বুঝে উঠতে পারছে না কোন ক্ষতটা বেশি গাঢ়?

মনে হচ্ছে সে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে কেবল দুঃখ পাওয়ার ক্ষমতা আয়ত্ত করেছে। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ফারাজ দীর্ঘক্ষণ চেয়ে ছিল। অতীত মনে পড়ছে তার। এমন ভাবে অতীতে, ঠিক এমন ভাবেই কেউ একজন চিৎকার করে কেঁদেছিল। সেই চিৎকারেও কারো বুক কাঁপেনি। ফারাজের সোহানের কথা মনে পড়ে যায়। রাতে রোশানের সঙ্গে যখন আলাপ করছিল তখন তার থেকেই মাহাদী আর মারিয়ার কথা জানতে পারে ফারাজ। তার ওপর সোহানদের লোকেদের মধ্যে ফারাজের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ একজন ছিল। যদিও ওইরকম ভাবে খবর দিতে পারে না তবুও ফারাজ জানতে পেরেছে মাহাদী নাকি সোহানদের হয়ে কাজ করত। মানে ওই শালা ফাউল কত্তবড় মফিজ! পরক্ষণেই ফারাজ ভাবল তার যে এত টাকা পয়সা সেইসবও তো এমনি এমনি আসে না। সব যে এমনি এমনি আসে না তাও বললে ভুল হবে। বিদেশে তার এতগুলো মাছের ফ্যাক্টরি আছে।

অনেক দেশে মাছ সাপ্লাই হয়। আর কি হয়? ফারাজ কপাল চুলকে বাঁকা হাসল। তারপর পুনরায় সোহানের কথা ভাবল। ভোরে এক ঘন্টার মতো শুয়ে ছিল। ছটফট করছিল। ঘুম চোখের পাতায় এসেও বার বার চলে যাচ্ছিল। সকালে সোহানের আস্তানা গিয়েছিল ফারাজ। ফারাজ আগেই জানে সোহান মাহাদীর কথা স্বীকার করবে না। কিন্তু না করার কারণ কী? সেও খারাপ, ফারাজও খারাপ। খারাপ মানুষেরা হয় এক দলের। এদের মধ্যে গোপন কিছু থাকতে হয় নাকি? তবে ওই কাইল্লা পাপী নামকও কলঙ্ক। এমনি এমনি কী নিজের ভবিষ্যতের থেকেও থোমা কালো? ফারাজ জানে মাহাদীকে এতক্ষণে সোহান পটল তুলতে পটল ক্ষেতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

এই যে ভালো করে কতবার জিজ্ঞেস করল তাও স্বীকার করল না। আসলেই দেশে ভালো মানুষের মূল্য নেই রে। তার ওপর ফারাজ আবার নরম মনের মানুষ। শরীরটা তুলার মতো নরম। তাই মারপিটে যায়নি। কারণ গেলে তারই তো লস। ফারাজ কী মারপিট পারে নাকি? মনটার মতো নরম শরীর। সে তো গলা উঁচু করে কাউকে একটা ধমকও দিতে পারে না। উল্টো দেখা যেত সোহান তাকে মেরে মাছের খাবার বানিয়ে ফেলেছে। তবে অস্বীকার করেছে মানা গেলো কিন্তু বোকার মতো লাশ আবার এই নদীর ঘাটে ফেলার মানে কী? মাথা ভর্তি অজৈব লিকুইড নিয়ে কী প্ল্যান করছে ওই বাংলাদেশী নিগ্রো? আল্লাহ ভালো জানেন। ওই ধান্দাবাজ সোহান কাইল্লার খালি লিকুইড মার্কা ভন্ডামি।

রাতে মোহনা আর রোশান হাঁটতে বের হয়েছে। এই মোহনার জীবনটা ভুলে ভরপুর হয়ে গেল। সেদিন ফারাজের বলা কথাগুলো নিয়ে তিন রাত-চার দিন ভেবেছে। এখন মনে হচ্ছে যেই জিনিস খোদা কপালে রাখেনি, তার জন্য এত মায়া করা ছিল তারই বোকামি। আর এই বোকামিই আশপাশের সবকয়টা জীবন একত্রে নষ্ট করেছে। ফারাজ তখন ঢাবিতে চান্স পায়। তবে মোহনার যতটুকু মনে আছে, এক বছরই ফারাজ বাংলাদেশে ছিল। তারপর হুট করে গায়েব হয়ে গেল। তবে পরবর্তীতে ফারাজের অনেক খোঁজ করেও কিছু পাওয়া যায়নি। একসময় শুধু জানতে পেরেছিল, ফারাজ বিদেশের একটা বড় ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। তবুও ভালোবাসার মানুষটির খোঁজ এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে নি সে।

ওইদিন রাতের কথা। রাতে ফারাজের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল, যার কাছ থেকে ফারাজ ওই অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে, তার কাছ থেকে ফারাজের খোঁজ নেওয়ার জন্য। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি মোহনার। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। এক পর্যায়ে ঠিক ফারাজের দরজার সামনেই জ্ঞান হারায় মোহনা। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করে ফারাজের বিছানায়। তবে চোখের সামনে ফারাজ ছিল না। ছিল অন্য একটা মুখ। সেই মুখ ছিল একান্ত রোশানের। এখানে একটা কাজে এসেছিল রোশান। রাতে থাকার জন্য ফারাজের ফাঁকা ফ্ল্যাটে আসে। রোশানের মন-মানসিকতা অনেক ভালো ছিল। তা না হলে কী আর রাত করে মোহনাকে কাছে পেয়েও ফায়দা লুটত না? সেই রোশান প্রথম দেখায় ভালোবাসল মোহনাকে। মোহনা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সব ভুলে, হয়ে উঠল এলাহী বাড়ির বউ। তবে মাঝখান থেকে নষ্ট করল নিজের এবং রোশানের জীবন। সেদিন সব ভুলে রোশানকে ভালোবাসলে কতই না সুখী হতো।
শেষ মুহূর্তে এসে এখন মোহনা সেইসব হারে হারে উপলব্ধি করছে। মোহনা এখনও জানে এই রোশান ছিল বলেই এলাহী বাড়িতে সে আজও টিকে আছে। তা না হলে কবেই অন্য দেশে রপ্তানি হয়ে যেত।

মোহনা ফারাজকে ভালোবাসে, সেই খবর প্রথমবার রোশান জানার পরও মোহনাকে কিচ্ছু বলেনি। ভুলই তো! শুধরে নিলেই হয়। তবে দিনকে দিন সব বেড়েই চলছিল। তারপর এমন একটা পর্যায় এলো, যখন রোশান নেশা-পানি খাওয়া শুরু করল। তারপর ধীরে ধীরে ধাবিত হলো কালো দুনিয়ায়। মোহনাকে ভালোবেসে রোশান ধ্বংস হয়ে গেল। যেই স্ত্রী সে থাকাকালীন তার ছোট ভাইকে ভালোবাসি বলল তার সামনে, সেই স্ত্রীর থেকে তীব্র যন্ত্রণা পেয়েও শরীরের চাহিদা মেটায়নি সে অন্য নারীর মাধ্যমে। ফারাজ আর রোশানের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। তাও এসবের জন্য নষ্ট হলো। মোহনা নিজেই রোশানকে হিংস্র বানিয়েছে।

তাই তো খোদা তার বাচ্চাগুলোকে দুনিয়ায় আসতে দিল না। পরপর তিনটা বাচ্চা তাদের বাবার দ্বারাই নষ্ট হলো। সেদিন পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল মোহনা। লক্ষণগুলো দেখে মনে হয়েছিল, আবার মা হবে। তবে না, তার কন্ডিশন বরং খারাপ হলো। ডাক্তার বললেন, সে মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। জরায়ুটা কেটে ফেলতে হবে। না হলে ইনফেকশন বাড়বে। এসব কথা রোশান এখনও জানে না। কী করে, কোন মুখে জানাবে?অধিকার রেখেছে কী মোহনা? এই যে এত পেটের ব্যথা, এত যন্ত্রণা নিয়ে এখনও মোহনা দাঁড়িয়ে আছে, তবুও রোশানকে যেই কষ্ট সে দিয়েছে, তার কাছে এসব দুধ-ভাত। প্রতিটি অপরাধের কথা ভাবলে মায়ের দুধ মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।

“মোহনা।”
“হুম।”
“আমি তোমারে অনেক কষ্ট দিছি তাই না? একদিন দেখবা তোমারে দেওয়া সব কষ্ট ফিরত নিয়া আমি হারাইয়া যামু।”
“তোমার আর একা হারাবার পথ কোথায় রোশান এলাহী? পাপিষ্ঠা মোহনাকে ছাড়া রোশান কোথাও যেতে পারবে না।”
“রোশান তো মারা গেছে বহু আগেই। ফালাইয়া রাইখা গেছে একটা অধম পাপীরে। আমার সঙ্গে তোমার যায় না। দোষ তো আমারই। সব জানারও পরও তোমাকে মুক্তি কইরা দেয় নাই।”
“হয়তো মুক্তি হওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না।”

” ছিল না? তবুও কেন আমার মুখের ওপর বললা আমার ভাইকে ভালোবাসো?কেবলই তাকেই ভালোবাসো।” রোশান কষ্ট লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করল।
” আমি এত অন্যায় করার পরেও কেনো ভালোবাসে তুমি?”
“তোমারে না মোহনা। আমি নিজেরে ভালোবাসছি। কারণ আমি আমার বলতে তোমারে বুঝতাম। ডিভোর্স চাইছিলা না অনেক আগে? কালকে ডিভোর্স লেটার হাতে পাবা। আমি তোমারে চিরমুক্তি দিলাম। আর কোনোদিন চোখের সামনে আসমু না।”

মোহনার ভেতর ফেটে কান্না আসছে। এই জীবন তাকে কোথায় নিয়ে এলো? রোশানের থেকে বহুবার ডিভোর্স চেয়েছিল। আজ সে মুখ দিয়ে যখন ডিভোর্সের কথা বলল তখন এত কষ্ট কেনো লাগছে? কেনো শ্বাস নিতে গেলো মুখ দিয়ে অদৃশ্য রক্ত ছিটকে বেরুচ্ছে? মোহনা হঠাৎ থমকে গেলো। জীবনের এই পর্যায়ে এসে ভালো খারাপ সবটা চোখ নিজ থেকেই দেখিয়ে দিল। আজ যখন নিজের মন দিয়ে রোশানের মন পড়ার চেষ্টা করল তখন উপলব্ধি হলো মনকে কয়েকহাজার টুকরো করা নারীকে রোশান এখনও সেই মন জোরা লাগিয়ে ভালোবাসে।
“তুমি সত্যি চাও আমি চলে যাই রোশান?”
“সেটা তোমারই ইচ্ছা ছিল। বিশ্বাস করো মোহনা একটা মানুষ নিজেকে নিজে জবাই করলে যেমন যন্ত্রণা হয়, ঠিক তেমন যন্ত্রণা আমার হইতাছে। আমার সারাজীবনের একটা আফসোস রইয়া গেল— মোহনা আমায় ভালোবাসল না। আমার হয়েও আমার হইল না।”

মোহনা কান্না করে উঠল। আশপাশে মানুষ নেই। কেবল তার কান্নায় ব্যথিত হচ্ছে রোশান। রোশানের চোখেও জল। সে নিজের জলের পরোয়া কর না। আঙুল দিয়ে মোহনার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
“খোদার কাছে আমার শুকরিয়ার শেষ হবে না গো মোহনা। কেন জানো? সল্প সময়ের জন্য হলেও তো তিনি আমার জীবনে একটা নূর পাঠাইছেন। আমি কালো পাথর ছিলাম। আমার সাথে নূর যায়? নূরের যাওয়ার কথা ছিল অন্য অমূল্য রত্নের সঙ্গে। গায়ের ময়লা হইয়াও যে তোমার শরীরে মিইসা থাকতে পারছি সেটাই অনেক। মনের সঙ্গে মিশার তো আমার কপালে ছিল না। তবুও যা ছিল তার রেশ আমার মরণের আগ মুহুর্তেও কাঁটবে না গো মোহনা।”

মোহনা অশ্রুসিক্ত নয়নে অনুতাপের সাগরে সাঁতার না জানা অসহায় ব্যক্তিটির মতো ডুবে যায়। চোখের পলকে খামচে ধরে রোশানের নীল রঙের শার্টটা। জলে ভাসা পদ্মের ন্যায় নোনা জলে ভিজিয়ে দেয় রোশানের চোখ। ছোট্ট বাচ্চাটাটির মতো নিজেকে দোষারোপ করে হাহাকার করে, “আমায় তুমি মেরো ফেলো রোশান। তবুও এমন কঠিন কথা বলো না। আমি ছাড়াতে পারব না। আমার মুক্তি চাই না রোশান। আমি শেষ পর্যন্ত তোমার হৃদয়ে ঠাঁই পেতে চাই। আমায় ক্ষমা করো রোশান। আমি ইহকালের সবচেয়ে বড় পাপ করেছি তোমায় ভালো না বেসে। তোমায় কষ্ট দিয়ে। আমি অন্ধ ছিলাম। মনের পর্দায় সাদা স্তর পরে গিয়েছিল। ভালো মন্দের তফাৎ বুঝতে পারি নি। আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবুও চলো সবটা শেষ থেকে শুরু করি।”

রোশানের চোখে জল। তার চোখের জল বাঁধ মানছে না। সে মোহনাকে বুকে জড়িয়ে অন্য দুনিয়ায় হারায়। ক্ষমা আর মোহর দুনিয়ায়। রোশান দু-হাত মোহনার গালে দেখে তার দিকে মুখটা উঁচু করে বলে, “দেখি, তাকাও। কিসের ক্ষমা চাও তুমি? আমার চোখে তুমি সদ্য ফোটা ফুলের মতো নিষ্পাপ। যাকে ভ্রমর স্পর্শ করে নি। তুমি মোহনা ঝরে পড়া ফুল নও, তুমি আমার হৃদয়ের সদ্য ফোটা তাজা লাল গোলাপ। যার সুবাসে এই রোশান এক লহমায় ধ্বংস হতে পারবে হাজারবার। ”
রোশান এলোপাতাড়ি মোহনার গালে,নাকে,কপালে,চোখে চুমু খায়। যেন হাজার বছর সে তার হারানো প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। সে তো এই দিনেরই অপেক্ষায় ছিল। খোদার অপ্রিয়তে তবে সে এখনও পুরোপুরি স্থান দখল কে উঠে নি। “মোহনা একবার কও আমারে ভালোবাসো।”

“শতবার শতরূপে কেবলই তোমাকেই ভালোবাসতে চাই রোশান। তোমায় ভালোবাসি। সেই ভালোবাসতে চাই যা পৃথিবীর শেষ দিনে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে বাসবে। কিংবা তার চেয়েও বেশি। সঠিক মানুষটিকে বুঝতে,ভালোবাসা কী তা বুঝতে হয়তো দেরি করে ফেলেছি। তবে সব তো শেষ হয়নি, সবেমাত্র শুরু। আমাদের ছোট্ট সংসার হবে দেখবে রোশান। আমরাও এত বিচ্ছেদের গল্পে সুখের অধ্যায় লিখব।”
“হুম মোহনা। চলো শেষ থেকে শুরু করি।”
বাহিরে তখন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মোহনা আর রোশানের সকল ভুল,দুঃখ আর অতীতের গল্প। রচিত হবে পবিত্র একটা সম্পর্ক। যেখানে রোশান পাপের ধার ধারবে না। বিয়ের আগে যেই স্বপ্ন বুকে লালন করেছিল তা এবার পূরণ করার পালা। কে বলতে পারে আজ বেঁচে কাল যদি মরণ হয়?নিশ্বাসের নেই বিশ্বাস। যেই মোহনার জন্য পাপে ধাবিত হয়েছে তার জন্য রোশান মরতেও রাজি আর সেখানে সামান্য পাপ ছাড়া কোনো বিষয় হলো?

আজ সারাদিন মরা বাড়িতে থাকতে হয়েছে। চিত্রা আপার সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটানো হয়েছে। অভ্র রুমে এখন ঘোড়া বেঁচে ঘুমাচ্ছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আয়েশা নিচে চলে আসে। জমিদার মহলের কর্মীদের থাকার জন্য যেই বাড়ি দেওয়া হয়েছে জমেলা এখনও একা সেখানে থাকে। এই রাতের বেলাতেই সেখানে যেতে হবে। কিছু কাগজ আর পুরোনো সিমটা বের করে একটা জরুরী কল করা দরকার। আয়েশা চারপাশে ভালো করে দেখল। এই বাড়িতে সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে রাতের বেলায় বাড়ির পুরুষরা বাড়িতে থাকে না। এমনকি যেইসকল বিশেষ কর্মী অর্থাৎ এলাহীদের ডান হাত বাম হাত আছে ওরাও রাতে থাকে না। আয়েশা বাড়ির দরজা খুলে জলদি বেড়িয়ে পড়ে বাগানের দিকে। তবে সেদিকে পা বাড়ানোর আগেই একটা হাত তার বাহু স্পর্শ করে তাকে থামিয়ে দেয়। আয়েশা ঘুরে দেখে সুলেমান এলাহী দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখে কেমন যেন কামুকতা ছড়িয়ে। গা থেকে মদের বাজে গন্ধ বের হচ্ছে। আয়েশা একটুও ঘাবড়ায় না। একদম স্বাভাবিক থেকে বলে, “আপনি আমার হাত ধরেছেন কেনো?”
“চাইলে অন্য কিছুও করতে পারি।” বলেই সুলেমান হাসে। দাঁত গুলো বিকষিত করে বিশ্রী হাসি ছুঁড়ে দিলো। গা ঘিনঘিন করে উঠে আয়েশার।

“হাত ছাড়ুন। আমার কাজ আছে।”
“এত রাতে কাজ? অভ্রর আড়ালে গিয়া অন্য কাউরে রাতবিরেতে খুশী করো নাকি? তোমার স্বামী জানে?”
“দেখুন আপনি এমন জঘন্য মানুষ আশা করিনি। হাত ছাড়বেন নাকি মানুষ ডাকতে বাধ্য হবো?”
সেই মুহুর্তে হুট করে একটা শব্দ আসে। সুলেমান সেদিকে তাকাতেই আয়েশা এবার এক মুহুর্তের জন্য ঘাবড়ে যায়। তারপর হুট করে ঝোপের থেকে বিড়ালটিকে বের হতে দেখে বলে, “ওহ বিড়াল ছিল!।”
সুলেমান বিড়ালটির দিকে একবার তাকায়। তারপর সরু চোখে আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলে,”কী লুকাইতাছো?”
আয়েশা নিচের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। তারপর মাথা তুলে একটা নিবেদন করা হাসি নিক্ষেপ করে। কেবলই একটা হাসি।

সকালে জমিদার বাড়িতে হইহট্টগোল বেঁধে যায়। লাশ পাওয়া গিয়েছে। আবারও লাশ। পুকুরেই পাওয়া গিয়েছে সেই লাশ। বাড়ির সবাই দৌড়ে আসে। কান্নার রোল পড়ে গিয়েছে। চিত্রা গোসল করে মাত্রই বের হয়েছিল। আজকে সে কুচকুচে কালো রঙের শাড়ি পড়েছে। ভেজা চুল দিয়ে ঘুমন্ত ফারাজের সামনে বসতে যাবে তার আগেই শুনে এমন চেচামেচি। তারপর আর কী? নিচে আসা। সুলেমান এলাহী মারা গিয়েছে। উঁহু হত্যা করা হয়েছে তাকে। অভ্রর হাত ধরে গুটিসুটি মেরে আয়েশা লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লাশ পানি থেকে তুলে জমিনে রাখা হয়েছে। রুমানা স্বামী হারিয়ে পাগল প্রায়। চিৎকার করে হা-হুতাশ করছেন। বাড়ির মানুষ, ছেলে বউরাও থমকে গিয়েছে। কারো মাথা কাজ করছে না। তবে ফারাজ একেবারে শান্ত। তার ঘাড়-মাথা সব ব্যথা করছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এমন তো কখনও হয়নি। তাছাড়া নেশা তো সে রাতে ভুলেও করেনি। তাহলে?

ফারাজ নিশ্বাস ছেড়ে অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তায় পড়ল। অভ্রকে ডাকতেই আয়েশাও সঙ্গে ফারাজের কাছে এসে দাঁড়ালো। অভ্রর কাঁধে হাত রেখে ফারাজ বলল, “আমার অনেক কান্না পাচ্ছে রে অভ্র। কিন্তু কাঁদলে আবার অনেকগুলো টিস্যু অপচয় যাবে। তাই কাঁদছি না। তার ওপর চিন্তায় আছি।”
“কিসের চিন্তা?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫ 

“ভাবছি বাবা যে চলে গেলো এখন এত সহায়সম্পদ আমি একা কেমন করে সাবলাবো? আমার ওপর যে এত চাপ দিয়ে চলে গেলো বিষয়টি কী ভালো হলো?” অভ্রর কাশি চলে আসার উপক্রম। এই লোকের বাবা মরে গিয়েছে উনি আছেন এত সম্পত্তি একা কী করে সামলাবেন তা নিয়ে। রোশান, রাজন সহ বাকিরা আঁড়চোখে ফারাজকে দেখছে। ফারাজ রাতে কোথায় ছিল?আর সে এত স্বাভাবিকই বা কেমন করে? ফারাজই কী তবে সুলেমান এলাহীকে মেরেছে?নাকি অন্য কেউ? তবে এর আগেও তিনটা খুন করেছে যে এই খুনটাও সেই ব্যক্তিই করেছে। কত্ত বড় সাহস খুনীদের বাড়িতে এসে খুনী খুন করে চলে যাচ্ছে আর চেয়ে তামাশা দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই? আয়েশা চিত্রার পাশে দাঁড়াতেই তাকে বলে উঠল, “তুমি এমন কাউয়ার মতো কালা একরঙা শাড়ি কেন পড়ছো আপা?”
চিত্রা লাশের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে জবাব দিল, “শোকের রঙ কালো হয় যে।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৫ (৩)