চেকমেট পর্ব ৩৩

চেকমেট পর্ব ৩৩
সারিকা হোসাইন

কিছুক্ষন আগেই বর যাত্রী এসেছে।বরকে নিয়ে শুরু হয়েছে হই হুল্লোড় আনন্দ মাতামাতি।চারপাশের বিষয় নিয়ে কারোর যেনো কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।চার হাত এক করে দেবার জন্য সকলের মধ্যে তীব্র উৎকণ্ঠা।অভিরূপ বরের সাথে সারফরাজ কে পরিচিত করাতে চাইলো।কিন্তু ত্রি সীমানার মধ্যে সারফরাজ এর কোন দর্শন মিললো না।ঝটপট পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করলো সারফরাজ এর নম্বর।বার কয়েক রিং বাজলো কিন্তু ফোন তুললো না সারফরাজ।এবার অভির বাঁকা ভ্রু সরু হলো।সারফরাজ কখনোই তার ফোন এতো দেরিতে রিসিভ করবে না।তার মধ্যে রুদ্রকে দেখেছে সে এখানে।ছেলে পক্ষের গেস্ট হয়ে এসেছে রুদ্ররাজ।

ছেলের বন্ধু।রুদ্ররাজ এর পরিচিত মানুষ এর সাথে আপন মামাতো বোনের বিয়ে এটা অভিরূপ মানতে পারছে না।যদিও ছেলে সম্পর্কে তেমন খারাপ রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।কিন্তু রুদ্ররাজ এর ক্লোজড কেউ নিশ্চয় দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হবে না।বাজে টেন্সন রেখে পুনরায় সারফরাজ এর নম্বর ডায়াল করলো অভি।এবারো রিং হয়ে কেটে গেলো।অভিরূপ নিশ্চিত হলো ঘটনা তো অবশ্যই কিছু হয়েছে।অভিরূপ এর মুখের আকস্মিক পরিবর্তন দেখে ইয়ং ভরাট গম্ভীর গলায় শুধালো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আর ইউ ওকেই?হুয়াট হ্যাপেনড?
জবাব না দিয়ে অভিরূপ দ্রুত পা চালিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে বেরিয়ে এলো।এরপর হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো চারপাশে।
ইয়ং লুইস দুজনেই আঁচ করলো সারফরাজ এর কিছু হয়েছে।তারাও দীর্ঘ সময় ধরে তাকে দেখেনি।অভিরূপ দৌড়ে গিয়ে বরের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত গলায় শুধালো
“এরশাদ তোমার সাথে কিছুক্ষন আগেই ডক্টর রুদ্ররাজ কে দেখে ছিলাম বোধ হয়।কোথায় উনি?
অভির মুখে রুদ্রের নাম শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলো এরশাদ।এরপর ইতিউতি তাকিয়ে ইতস্তত করে জবাব দিলো
“আসলে ভাইয়া ওকে আমিও খুঁজছি অনেক খন ধরে।পাচ্ছি না।ফোন ও তুলছে না।
আর দাঁড়ালো না অভিরূপ।ঘটনা পুরোটাই পরিস্কার তার কাছে।নিশ্চিত দুজনে কোনো ঝামেলা পাকিয়েছে।অভিরূপ ইয়ং কে চোখের ইশারা দিতেই ইয়ং মাথা ঝাঁকালো।এরপর তিনজন ছুটলো তিন দিকে।

রূপকথার হাত চেপে ধরে রুদ্র বলে উঠলো
“আমার স্পর্শে এতো খারাপ লাগছে তোমার?কি আছে এই স্পর্শে?ডু ইউ নো?হাজারো মেয়ে এই স্পর্শের জন্য মুখিয়ে থাকে।কিন্তু রুদ্ররাজ তাদের তাকিয়েও দেখেনা।ইউ আর স্পেশাল এন্ড লাকি গার্ল।কজ মাই হার্ট হ্যাজ চুজেন ইউ।

রুদ্রের কথা শেষ হবার আগেই এক ঘুষি পরলো মুখ বরাবর।ঘুষির তোড়ে নিমিষেই রূপকথার হাত ছেড়ে দূরে ছিটকে পড়লো রুদ্র।এরপর তড়িৎ দুই হাতে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো।কেটে যাওয়া ঠোঁটের কোণায় আঙ্গুল বুলিয়ে জিভ দিয়ে গালের ভেতর টা ঠেলে ধরে অদ্ভুত হাসলো সে।এরপর সারফরাজ এর পানে তাকিয়ে বলে উঠলো
“wow… এখানেও মরতে এসেছিস?কেবলই প্রপোজ টা করতে নিয়েছি।সহ্য হলো না তোর?আমার সাথে জন্মের শত্রুতা বেঁধে উপর ওয়ালা দুনিয়ায় পাঠিয়েছে তোকে স্কাউন্ড্রয়েল?
হিংস্র চোখে তেড়ে এসে রুদ্রের কোটের কলার চেপে ধরে চিৎকার করে সারফরাজ শুধায়
“ডিড ইউ জাস্ট টাচ হার?
রুদ্র বাঁকা হেসে উত্তর করে

“ইয়েস,আই ডিড ইট।সো হুয়াট হুহ?আমি চাইলে যা খুশি তাই করতে পারি,এবং যা চাই তা নিজের করেই ছাড়ি।
রুদ্ররাজ এর জবাবে সারফরাজ তির্যক হাসলো।এরপর রুদ্রের হাতের কব্জি চেপে ধরে হিসহিস করে বলে উঠলো
“ওর গায়ে তোর নোংরা হাত রাখার সাহস কি করে হলো বাস্টার্ড?
তোর রক্ত দিয়েই ওই নোংরা সাফ করবো আমি।তুই ভুল মানুষকে ছুঁয়েছিস।তুই যাকে ছুঁয়েছিস সে আমার।এবং আমার জিনিসকে ছোবার দুঃসাহস স্বয়ং রূপকথার ছায়া পর্যন্ত করতে পারবে না।তুই তো অনেক দূরের কথা।।
বলেই পকেট থেকে ধারালো ফোল্ডিং চাকু বের করে আনলো সারফরাজ।সারফরাজ আঘাত হানার আগেই রুদ্র সারফরাজ এর বুকে এক পাঞ্চ বসিয়ে দিলো।আঘাতে সটকে গাছের সাথে বাড়ি খেলো সারফরাজ।এই দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে চিৎকার করে সারফরাজ এর নাম ধরে ডেকে উঠলো রূপকথা।সুফিয়ান চৌধুরী রুদ্রকে কড়া গলায় বলে উঠলো

“দেখে তো ভদ্র ঘরের সন্তান ই মনে হচ্ছে।তা ভেতরটা এতো কদাকার কেনো?বয়সে তোমার থেকে অনেক ছোট সে।ছোটদের সাথে এ কেমন আচরণ ?
সুফিয়ান এর কথাটা রুদ্রের কানে ঝংকার তুললো।সে ঠোঁট কাঁপিয়ে সুফিয়ান এর সামনে এসে এক ঘুষি উচাতেই সারফরাজ পেছন থেকে এসে ফোল্ডিং নাইফ দিয়ে রুদ্রের গাল কেটে দিলো।মুহূর্তেই রঞ্জন তরল গড়ালো ফর্সা গাল বেয়ে।জ্বল জ্বল চোখে সারফরাজ এর পানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো রুদ্ররাজ।এরপর বলে উঠলো
“নাইস শট!চল একটা গেইম খেলি তুই আর আমি।যে জিতবে রূপকথা তার।যে হারবে তার ডেড বডির সমাধি হবে এই মাটিতে।এগ্রি?
সারফরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠলো
“গেইম খেলার আগেই রূপকথা অলরেডি আমার হয়ে গেছে।তোর ফালতু গেইমের হার জিতে আমার কোনো কিছুই যায় আসে না।এন্ড আম নট ইন্টারেস্টেড।
“ভয় পাচ্চিস আমাকে?

“উহু মোটেই না।কারন তোর মতো ওভার কনফিডেন্স নিয়ে আমি খেলি না।আমার খেলার ধাঁচ আলাদা।তাতে আত্মবিশ্বাসী অহংকারের চাইতে চতুরতা থাকে বেশি।আর আমার আজকের এই সাফল্য তারই প্রতিদান।যতই চেষ্টা করিস,তোর স্থান আমার জুতার তলায়।
সারফরাজ এর কথায় রুদ্রের মাথায় আগুন ধরে উঠলো দপদপ করে।তবুও নিজেকে সামলে বলে উঠলো
“চাইলে কমিশনার কে রেফারি রাখতে পারিস।অথবা সহায়ক।
সারফরাজ গর্জন করা কন্ঠে বলে উঠলো
“জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো তোকে আমি রুদ্ররাজ আল্লাহর কসম।যদি হারিস তবে আজই পৃথিবীতে তোর শেষ দিন।
“তাহলে দেরি কেনো আয়?

অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সুফিয়ান চৌধুরী আটকানোর চেষ্টা করলেন।কিন্তু কেউ তার ধারই ধরলো না।ঘটনা বিপদজনক বুঝে মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে সরে যেতে চাইলেন।কিন্তু রূপকথা নিজ স্থানে অনড়।
মুহূর্তেই রুদ্ররাজ আর সারফরাজ এর মধ্যে তুমুল মারামারি শুরু হলো।কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।ব্যাক কিক,পাঞ্চ, এলবো এট্যাক কোনোটাই কেউ বাকি রাখছে না।এসব মারামারির ক্ষেত্রে দুজনেই যে প্রফেশনাল তা তাদের এট্যাক স্টাইল দেখে সহজেই অনুমেয়।একদিকে বিয়ের বাজনা বাজছে অপরদিকে মিউজিক এর তালে তালে মারপিট চলছে।সুফিয়ান চৌধুরী কপাল চাপড়ে মনে মনে বলে উঠলেন

“কোন অলুক্ষণে এই বিয়ে খেতে রাজি হলাম?এক মেয়ে নিয়ে দুজনের টানাটানি হায় মাবুদ।রক্ষা করো।
রুদ্ররাজ সারফরাজ দুজন দুজনকেই রক্তাক্ত করেছে।দুজনের ঠোঁট,কপাল গড়িয়ে রক্ত ঝড়ছে।আনন্দ রোশনাইয়ের বিয়ে বাড়ি কেমন হুট করে মল্ল যুধ্যের ময়দানে পতিত হলো।আপাতত বিয়ের শোরগোল গান বাজনা কানে লাগছে না এখন।শুধু মারপিট এর ধুপধাপ শব্দ আর হুংকার মিশ্রিত তর্জন গর্জন।
অভিরূপ ,লুইস আর ইয়ং সারফরাজ কে খুঁজতে খুঁজতে সুইমিং পুল এরিয়াতে এলো।হঠাতই শুনতে পেলো সারফরাজ এর ঠান্ডা গলা

“দ্যা বোর্ড ইজ এম্পটি এন্ড দ্যা কিং ইজ ডাউন।চেকমেট ডিয়ার রুদ্ররাজ চৌধুরী ।
সারফরাজ এর কন্ঠ অনুসরণ করে অভিরূপ লুইস আর ইয়ং কে নিয়ে সেখানে পৌঁছালে অভিরূপ দেখতে পায় মাটিতে হাটু মুড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বসে আছে রুদ্র আর সারফরাজ টলতে টলতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।মুহূর্তেই ইয়ং আর লুইস নিজেদের কোমরে গুঁজে রাখা গান বের করে রুদ্রের কপাল বরাবর তাক করে।রূপকথা দৌড়ে এসে সারফরাজ কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠে
“চলে যাবো এখান থেকে।ভালো লাগছে না এখানে।বাড়ি চলো প্লিজ
রূপকথাকে এক হাতে জড়িয়ে সারফরাজ ভাঙা ভাঙা হাঁপানো গলায় রুদ্রের উদ্দেশ্যে পুনরায় বলে উঠে
“তুই নিজেই বলে ছিলি যে হারবে তার সমাধি হবে এই মাটিতে।নাও ইউ হ্যাভ টু ডাই।

সারফরাজ এর মুখে এমন শীতল মৃত্যু বানী শুনে অভিরূপ এসে সারফরাজ এর হাত চেপে ধরে বলে উঠে
“পাগল হয়ে গেছিস?এটা বিয়ে বাড়ি।এমন কিছুই করা যাবেনা এখানে।বাড়ি ফিরে চল।
অভিরূপ এর হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে রূপকথার লাল হয়ে উঠা হাত অভির সামনে তুলে গর্জে সারফরাজ শুধায়
“তুই জানিস ও কি করেছে?ও রূপকথার হাত ধরেছে।ও আমার কোথায় হাত দিয়েছে তুই বুঝতে পারছিস?এন্ড ও নিজেই এই গেইম থ্রো করেছে।নিজেই বলেছে যে জিতবে তাকে মরতে হবে।
অভিরূপ ঘৃণা মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করলো রুদ্রের পানে।এরপর স্বাভাবিক গলায় শুধালো
“তুমি একটু বেশি বেশি ই করছো রুদ্র।তোমার সাথে আমাদের পার্সোনালি কোনো শত্রুতা নেই।অযথা তুমি সারফরাজ কে প্রতিমুহূর্তে হ্যানস্থা করে নিজের বিপদ ডেকে আনছো।সারফরাজ এর একটা চুল ও বাঁকাতে পারো নি এখনো।অহেতুক নিজের ক্ষতি এভাবে কেন করছো?
সারফরাজ এর আঘাতে কথা বলার অবস্থাতেই নেই রুদ্র।সুফিয়ান এসে শুধালো অভিরূপ কে

“একে আগে থেকেই চিনো?
অভিরূপ অবজ্ঞা জড়িত গলায় উত্তর করলো
“সুবহান গং এর নাতি।
আর বলতে হলো না সুফিয়ান কে।সুফিয়ান নিজেও রুদ্রের পানে তাচ্ছিল্য দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলো
“দাদার মতো না হয়ে ভালো ভাবে বাঁচো।তোমার দাদার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিলো সেটা নিশ্চয়ই অজানা নয় তোমার।যদি চাও সেভাবে তোমার ও মৃত্যু হোক তবে তুমি তোমার পাথে অটল থাকো।
বলেই রূপকথা সারফরাজ কে এখান থেকে চলে যাবার অনুরোধ করলেন তিনি।অভিরূপ নিজেও জোর করে টেনে হিচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেলো সারফরাজ কে।যাবার আগে রুদ্ররাজ এর প্রতি ঘৃণা ভরা দৃষ্টি ফেলে দাঁতে দাঁত পিষে সারফরাজ বলে উঠলো

“দুধ,চন্দন আর গোলাপ জলের ব্যবস্থা কর অভি।ওর ছোঁয়ায় রূপকথা অপবিত্র হয়েছে।রূপকথার শরীর থেকে ওই ছোয়া আমি চিরতরে মুছে দিতে চাই।নইলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।
অভিরূপ সারফরাজ এর চোখ দুটোতে খেয়াল করলো।কেমন রক্ত জমে গেছে সেগুলোতে।সারফরাজ এর চেহারার অবয়ব বলে দিচ্ছে ক্রোধের মাত্রা কতো টুকু।অভিরূপ বাড়তি কথা না বলে মাথা ঝাঁকালো।এরপর সারফরাজ কে টেনে হাঁটা ধরলো।
পিছে পিছে এলো ইয়ং আর লুইস।পরে রইলো শুধু রুদ্ররাজ একা।
সকলেই চলে যেতেই মাটিতে ভর দিয়ে কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো রুদ্ররাজ।এরপর হাতের উল্টোপিঠে মুখের রক্ত মুছতে মুছতে বলে উঠলো

“রূপকথা আমার হবে এটাই চিরন্তন সত্য।তুই নিজেও জানিস না আমার কাছে তোর কি গচ্ছিত আছে।তুই নিজেই রূপকথাকে আমার হাতে তুলে দিবি।কারন তুই বাধ্য।
কথাগুলো বলে গগন কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো রুদ্র।সেই হাসি ভয়ংকর শব্দ তুলে মিলিয়ে গেলো খোলা আকাশে।নিজের হাসি থামিয়ে এসিস্ট্যান্ট কেভিন কে কল করলো রুদ্র।ফোন তুলতেই স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো
“পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়ি বের করো।বাড়ি যাবো।

অসুস্থতার কারণে বেশ কয়েকদিন সোহানা হসপিটালে আসতে পারেনি।এই কয়েকদিন মায়ার দায়িত্ব অন্য এক ডক্টর কে দিয়েছিল সে।কিন্তু আজ যখন ডিউটিতে এলো তখন মায়ার করুন অবস্থা দেখে সুহানার বুক কেঁপে উঠলো।মায়ার চোখে মুখের কালসিটে জখম আঙ্গুল তুলে জানান দিচ্ছে কেউ তাকে খুব মেরেছে।হসপিটালে এমন কেউ নেই যে এই ধরনের ভয়ানক কান্ড ঘটাতে পারবে।কারন প্রত্যেকটা পেশেন্ট কে বাচ্চার মতো ট্রিট করা হয় এখানে।নিজের কৌতূহল নিয়ন্ত্রণ হারা হতেই মায়াকে আঘাত। কিভাবে পেয়েছে তা জিজ্ঞেস করেছিল সুহানা।কিন্তু মুখ খোলেনি মায়া।সহকারি নার্স,ডক্টর কেউ কিচ্ছুটি জানেনা।শেষ পর্যন্ত রাগে আগুন হয়ে হসপিটাল এডমিনিষ্ট্রেটর এর কাছে গেলেও মেলেনি উত্তর।

সুহানার বুঝতে বাকি রইল না কেউ ইচ্ছে করেই করেছে এই কাজ।কিন্তু সুহানা নিজেও হাল ছেড়ে দেবার মানুষ নয়।সে সত্যিটা উদঘাটন করেই ক্ষান্ত হবে।
যখন কোথাও কোনো ক্লু পেলো না তখন খালি হাতে আবার ফিরে এলো সুহানা।এসে সরাসরি মায়ার সেলে ঢুকলো।মায়া এখনো উল্টো পিঠে জানালা মুখ করে বসে আছে।কীয়ত ক্ষণ অপেক্ষা করে তপ্ত শ্বাস ফেললো সুহানা।এরপর মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় শুধালো
“আচ্ছা মায়া সত্যি করে একটা কথা বলবে?
মায়া কোনো প্রত্যুত্তর করলো না এমনকি সুহানা কে তাকিয়ে পর্যন্ত ও দেখলো না।
সুহানা জানে কিভাবে মায়ার মুখ থেকে কথা বের করতে হবে।তাই যে সরাসরি শুধালো
“সারফরাজ এর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো।ও তোমাকে নিতে আসবে।যেই ছেলেটা প্রতিদিন এখানে আসে ও সারফরাজ নয় তাই না?

এবার চট করে উঠে দাঁড়ালো মায়া।এরপর ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বলে উঠলো
“হুশ আর বলোনা।ও শুনে ফেলবে।কারন ও একটা মনস্টার।
সুহানা আরেকটু এগিয়ে ধীর গলায় শুধালো
“সারফরাজ এর বর্ননা দাও তো, দেখি আমি যাকে সারফরাজ হিসেবে চিনি সেই কিনা।
সোহানা জানে সে মিথ্যে বলছে কিন্তু ছদ্দবেশী সারফরাজ তার ছেলে নয় এই ব্যপারে সোহানা নিশ্চিত।এবং যে আসে সে কোনো ভালো উদ্দেশ্যে আসে না এটাও ধরতে পেরেছে সোহানা।কি চক্রান্ত হচ্ছে ভেতরে ভেতরে সোহানাকে তা জানতেই হবে।আর কোনো পেশেন্ট নিয়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না।তবে মায়াকে নিয়ে কেন এতো ঝামেলা?তাছাড়া ট্রিটমেন্ট এ অনেক পেশেন্ট নরমাল হয়ে উঠছে দিনকে দিন।কিন্তু মায়া যেনো আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।আদতেই মায়ার ব্রেন ফাংশনে সমস্যা নাকি তাকে ইচ্ছে করে অসুস্থ রাখা হচ্ছে এটা জানতে হবে সোহানাকে।
মায়া সোহানার কথায় ফিসফিস করে বলে উঠলো

“সারফরাজ দেখতে একদম রাজ পুত্রের মতো বুঝলে?সাদা গোলাপের মতো গায়ের বর্ণ।আভিজাত্য ভরা চেহারা।একদম বাপের মতো হয়েছে।এই টুকুন ছোট।চোখ দুটো স্বচ্ছ নীল আকাশ।তাতে শুধু মায়া।কপালের কাছটায় ছোট একটা দাগ ।ছোট বেলায় পড়ে গিয়ে ফেটে গেছিলো।
আরো কিছু মনে করতে চাইলো মায়া কিন্তু পারলো না।এরপর মাথা চেপে ধরে চারপাশে কিছু খুজলো।সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে বিছানার ম্যাট্রেস এর নিচ থেকে একটা লকেট ওয়ালা চেইন বের করে এনে মায়ার হাতে দিয়ে বলে উঠলো
“কর্নেল সাহেবের দেয়া শেষ উপহার এটা।এটা সারফরাজ কে দিও।আর বলো মা খুব শীঘ্রই দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি।
বলেই ছোট বাচ্চার ন্যয় কেঁদে উঠলো মায়া।মায়াকে বুকে জড়িয়ে সোহানা বলে উঠলো

“কোথায় যাবে তুমি ?
“ওই হিংস্র লোকটা আমায় নিয়ে যেতে চায় ডক্টর।সারফরাজ কে কষ্ট দিতে ও আমাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।আমি শুনেছি।
সোহানা আর বসতে পারলো না।সব কিছু গোলক ধাঁধা মনে হচ্ছে তার কাছে।হসপিটালের কে সাহায্য করছে ওই ছেলেকে আর সারফরাজ ই বা কোথায়?

সকাল সকাল রূপকথা এলো সারফরাজ এর বাড়িতে।সারফরাজ এর শারীরিক অবস্থা নিজ চোখে দেখতে চায় সে।আজ সুফিয়ান চৌধুরী তাকে কোনো বাধা দেয়নি।বরং গাড়ি করে এনে সারফরাজ এর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে।রূপকথা যখন সারফরাজ দের বাড়ির গেট পাড় হলো তখন নজরুল কে দেখা গেলো গেছে পানি দিতে।রূপকথাকে দেখে এক গাল হেসে নজরুল এগিয়ে এসে শুধালো
“আপা মনি যে,সারফরাজ তো এখনো উঠেনি।ডাক দেবো?
“না ,প্রয়োজন নেই।আমি যাচ্ছি ওর ঘরে।ঘুমাক।
নজরুল ঘাড় কাত করে নিজের কাজে মন দিলো।
রূপকথা দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।এরপর সিঁড়ি ধরে সোজা সারফরাজ এর কক্ষে।
বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুজে ঘুমাচ্ছে সারফরাজ।উদোম শক্ত প্রশ্যস্ত পিঠ কাঁথার ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এসেছে।এলোমেলো চুল গুলো আকর্ষণীয় লাগছে।কাঁথার ফাঁক ফোকর দিয়ে লোমশ সফেদ পা চোখে কেমন কাতুকুতু দিলো।

সারফরাজ কে দেখে রূপকথার সমস্ত বিষাদ নিমিষেই কেটে গেলো।ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি ফুটিয়ে সারফরাজ এর বিছানার নিকট এসে দাড়ালো রূপকথা।এরপর হাত বাড়িয়ে চুলে আদুরে স্পর্শ করতে চাইলো।
ঘুমের ঘোরে নিজের কাছাকাছি কারো উপস্থিতি টের পেলো সারফরাজ এর চতুর মস্তিস্ক।রূপকথা সারফরাজ এর চুল স্পর্শ করার আগেই খপ করে রূপকথার কব্জি চেপে ধরে টেনে বিছানায় ফেলে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে রূপকথার উপরে উঠে গেলো সারফরাজ।সারফরাজ এর এহেন আক্রমনে চোখ মুখ শুকিয়ে চুপসে গেলো রূপকথার।অধিক তন্দ্রায় রূপকথার ভীতু মুখশ্রী ঝাপসা নজরে এলো সারফরাজ এর।বার কয়েক পলক ঝাপটিয়ে রূপকথা পরিস্কার মুখশ্রী নজরে আটকাতেই শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে রূপকথার উপর শুয়ে গেলো সারফরাজ।দৈত্যের মতো ভারী মানুষটার নীচে পরে রূপকথার মনে হলো সে আরেকটু হলেই চাদরের সাথে মিশে যাবে।

হাত দিয়ে সারফরাজ কে ঠেলতেই রূপকথাকে বুকে জড়িয়ে কাত হয়ে শুয়ে গেলো সারফরাজ।
এরপর চোখ বুজে ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো
“রাতে এলে ঘুমটা আরো ভালো হতো।নিঃসঙ্গ রাত কাটতে চায় না।
কিন্তু এই কথাটা তুমি আর তোমার খারুস বাপ দুজনের কেউই বুঝতেই চাও না।ধ্যাত !
বলেই রূপকথার চুলে মুখ ডুবালো সারফরাজ।
সারফরাজ কে চাপড় মেরে রূপকথা রাগী চাপা গলায় বললো
“কেউ দেখে ফেলবে ছাড়ো নির্লজ্জ কোথাকার।
“দেখলে তাতে আমার কি?
“কি মানে ?কি ভাববে তোমাকে তারা?
“কিছুই ভাববে না।শুধু ভালোই তো বাসছি, অন্যায় কিছু করেছি?
রূপকথা কপাল কুঁচকে বলে উঠলো

“এ কেমন ভালোবাসা?
রূপকথাকে আরেকটু শক্ত করে ধরে সারফরাজ আবেশীত গলায় বলে উঠলো
“আমার ভালোবাসার ধরন ই এমন।সবার চাইতে আলাদা।ওসব সাদা মাটা প্রেম আমার পোষায় না।আর এখন তো সফটলি ভালোবাসছি।বিয়ের পরের টা হবে রাফ।সইতে পারবে না।তাই আগে ভাগেই একটু একটু করে ট্রেনিং দিচ্ছি।যাতে পরে কান্নাকাটি কম হয়।নয়তো পরে দোষ দিবে আমি মানুষ ভালো না।বিয়ের নাম করে তোমায় টর্চার করছি।মেয়ে মানুষের অপবাদ দেবার কোনো শেষ আছে?
রূপকথা সারফরাজ এর ঠোঁট শক্ত মুঠে চেপে ধরে শাসানো গলায় বললো
“তোমাকে বেশী লায় দিয়ে ভুল করছি আমি।দিনকে দিন মাথায় উঠে যাচ্ছ।
সারফরাজ দুস্টু হেসে বলে উঠলো

“মাথায় উঠছি এটা তোমার জন্য ভালো।ভাগ্যিস তোমার উপরে উঠছি না।
“তোমার সাথে থেকে থেকে পেকে যাচ্ছি আমি।দূরত্ব বাড়াতে হবে।কাল থেকে সারা রাত ফোনে কথা বলা আর প্রতিদিন দেখা করা সব বন্ধ।

চেকমেট পর্ব ৩২

রূপকথার এহেন ভয়ানক কথায় চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে বড় বড় চোখে সারফরাজ ধমকে উঠলো
“কমিশনার মাথার মধ্যে কু বুদ্ধি ঢালতে শুরু করেছে অলরেডি তাই না?সেগুলোর ই আছরে এমন পঁচা পঁচা কথা তোমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে?আমাকে চেনো তুমি?এক আছাড়ে সমস্ত কুবুদ্ধি বার করে দেবো।বজ্জাত মেয়ে কোথাকার।

চেকমেট পর্ব ৩৪