প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৮

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৮
আদ্রিতা নিশি

দেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচদিন। অরিত্রিকা এবং সারহানের আকদের এক সপ্তাহ পূর্ণ হলো। তাদের দুজনের সময় কাটছে পূর্বের মতো। অরিত্রিকা ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করছে আর সারহান রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত সময় পার করছে। দুজনের সারাদিনে দুবার দেখা হয়। সকালে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার সময় দেখা হয় ও রাতে খাওয়ার সময়। অরিত্রিকার অভ্যাস বদলেছে। রাতে বাড়ির সবার সাথে না খেয়ে সারহানের সাথে খায়।

সেই সময়টা অরিত্রিকা সারহানের সাথে মন প্রাণ খুলে সারাদিন তার সাথে ঘটে যাওয়া নানা কাহিনীর পসরা নিয়ে বসে। সারহান নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে। এ কয়েকদিনে মেয়েটার ছটফটানি বেড়েছে। শ্যামমানবকে না দেখলে মনটা খারাপ ও অশান্ত হয়। ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয় মানুষটাকে। কেমন যেন বর পাগলী মনে হয় নিজেকে। যখন মনটা মানে না তখন ভয় ডর ভুলে নির্দিধায় কল করে। কল রিসিভ করলে দুই চার কথা বলে কল কেটে দেয়— কাজে ব্যস্ত আছে ভেবে। কল কাটার পরেই সারহান পুনরায় কল ব্যাক করে। কাজ করা বন্ধ করে অর্ধাঙ্গিনীর মন খারাপের কাহিনী শোনে। এভাবেই একে ওপরের অভ্যাস – ভালো মন্দ আয়ত্বে নিয়ে দিনকাল চলছে নবদম্পতির।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইফা ও আফ্রিদি দুইদিন পূর্বে ঢাকা ফিরে গেছে। সাথী বেগম ওদের থাকতে বলেছিল কিন্তু দুজনে থাকেনি। মূলত আফ্রিদির থাকার কোনো ইচ্ছে ছিল না। অরিন এখন পড়াশোনাতে ব্যস্ত। অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা আর মাত্র দেড় মাস পর। যেহেতু এক মাস পর তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ডেট ফিক্সড হয়েছে সেহেতু সিলেবাসটা শেষ করে রাখা ভালো। আবিরের হাতের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। আপাততঃ সে অনেকটা সুস্থ। সেই অবস্থা নিয়ে পার্টি অফিসে কাজে দৌড়াদৌড়ি করছে। রাহা ও ইরফানের এর মাঝে দেখা হয়নি। দুজনে নিজেদের জীবনে ব্যস্ত সময় পার করছে। সাদাত ও ইশরা দু’জনে অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে। দুজনের দেখা হলে কেউ কারো সাথে কথা বলে না। এক ভালোবাসার স্বীকারোক্তি যেন দুটো জীবনে ঝড় তুলে দিয়েছে। ঝড়টা থামার কোনো সম্ভবনা নেই।

অরিত্রিকা ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আছে। তার পাশে রাহা বসে আছে। দুজন মিলে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর কফি খাচ্ছে। তাদের ক্লাস শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বে। ক্লাস শেষ হওয়ার পরেই তিশা বাসায় চলে গিয়েছে। কারণ ওর মা ভীষণ অসুস্থ। রুদ্র ও রুহানের গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। তারা দুজন গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করছে। ধীরে ধীরে সবার জীবন বদলে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আরও বদলে যাবে। সবাই কাজ এবং নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে এটাই বাস্তবতা।

“আমাদের বন্ধুমহলের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। রুদ্র, রুহান গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত। আন্টি অসুস্থ থাকায় তিশা বাড়ির কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আমারও জীবনে পরিবর্তন এসেছে। আকদ হয়ে গেছে। কিছু মাস পর হাসবেন্ড, সংসার ও পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাব। বাকী আছিস তুই — যে এখনো পাখির মতো উড়াউড়ি করছিস।”
অরিত্রিকা কফিটা শেষ করে নিরবতা ভেঙে কেমন যেন উদাসীন ভঙ্গিতে বলল। রাহা কফির কাপটা কাঠের টেবিলে রেখে এক মুহুর্ত দেরী না করে বিরস কন্ঠে বলল ;
“সময় অতিবাহিত হচ্ছে, আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসছে। বলা যায় না, কখন কি হয় বা আমি কতোদিন উড়োউড়ি করতে পারব। মনে হচ্ছে তোর মতো আমার উইকেটটা পড়তে চলেছে জানু।”
অরিত্রিকার কপাল কুঁচকে গেল। কৌতূহলী ভাব নিয়ে সহসা জিজ্ঞেস করল ;

“কেনো?”
রাহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মুখখানা ভার করে বলল;
“আমার কাজিনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ওদের মধ্যে আমিই শুধু বাকী আছি। আব্বু আম্মু আমার অগোচরে আমাকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে। কানাঘুষো খবরটা যখন আমার কানে এলো আমি তখন থ বনে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আমার বিয়ে কেন দিতে চাইছে সেই রহস্য খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে কাহিনী খুঁজেও পেয়েছিলাম। সেই ব্যাপারে আব্বুর সাথে কথা বলবো তা হলো না। আব্বু তার বন্ধুর ছেলে সাথে বিয়ে দিতে চান তা ঘোষণা করল।”
“হোয়াট কি বলছিস এসব? আংকেল তোর বিয়ে ঠিক করেছে? তিনি তো তোকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাননি। তবে এখন কেন এমন করছেন? কাহিনী কি সত্যি করে বল।”

“কাহিনী গুরুতর। আব্বুর বন্ধুর ছেলে আমাকে আর ইরফান ভাইয়াকে কথা বলতে দেখেছিল। সেটাই বাবার কানে পৌঁছে দিয়েছে কুটনি লোকটা। আব্বু সেদিন থেকে আমার ওপর নজর রাখছিল। আমি সেটা টের পাইনি। তোর আকদের দিনে পিক উঠিয়েছিলাম। সেগুলো পোস্ট করেছিলাম। সেই পিকগুলোর মধ্যে ইরফান ভাইয়ার সাথে আমার একটা পিক ছিল। সেই পিকটা অভদ্র লোকটা আব্বুকে দেখিয়েছে। শয়তান লোকের ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করাই ভুল হয়েছে।”

“ইরফান ভাইয়ার সাথে পিক কখন তুললি?”
“ওই…. উনি আমার পাশে বসেছিলেন তখন না জানিয়ে অগোচরে টুক করে কয়েকটা সেলফি নিয়েছিলাম। ভুলবশত সেই পিকগুলোর মধ্যে একটা পিক পোস্ট করে ফেলেছি।”
রাহা মুখখানা কাচুমাচু করে ক্ষীণ স্বরে বলল। অরিত্রিকা রাগত চাহনিতে তাকাল। মেয়েটা কি পাগল! একটা ভুলের জন্য বিয়ে নামক প্যারায় পড়ে যাচ্ছে। সে মেজাজ ঠান্ডা করল। সন্দিহান কন্ঠে বলল;
“শপিংমলে কবে দেখা হয়েছিল?”
রাহা মাথা নত করে বলল;
“তোর আকদের একদিন আগে।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় ছোট করে গম্ভীর কন্ঠে বলল;

“ইরফান ভাইয়ের সাথে এতো কিসের কথা? উনাকে তুই ঠিকাঠাক ভাবে চিনিস না। হয়তো তোদের ভালোভাবে কথাও হয়নি অথচ শপিংমলে দেখা হলো তুই আগে পিছে না ভেবে কথা বলতে গেলি!”
“উনার সাথে আমার তিন চারবার কথা হয়েছে। আসলে শপিংমলে উনার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। সৌজন্যতা রক্ষার্থে কথা বলেছিলাম। কে জানতো, ওই খাচ্চর ব্যাডা আমাদের কথা বলতে দেখে আব্বুকে গিয়ে বলবে।”
“আরও যাও উনার সাথে কথা বলতে! এবার ঠেলা সামলাও জানু।”
“আমি ওই খাটাশ লোককে বিয়ে করবো না। বেয়াদব লোক।”
“এ কথা আমাকে না বলে আংকেলকে গিয়ে বল।”
কথাটি বলে অরিত্রিকা রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাহার সাথে কথা না বাড়িয়ে হাটা দেয় মেইন গেটের দিকে। রাহাও ছুটে এসে অরিত্রিকার পাশাপাশি হাটতে থাকে। ভার কন্ঠে বলে;
“তুই আমার ওপর রেগে যাচ্ছিস কেন?”
অরিত্রিকা সোজা তাকিয়ে গমগমে কন্ঠে বলল;
“তুই কখনো আমার থেকে একটা কথাও লুকাসনি অথচ ইরফান ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছিল এটা আমায় বলিস নি।”

“যদি বলতাম তাহলে তুই উল্টাপাল্টা ভাবতিস।”
“আমি এখনো উল্টাপাল্টা ভাবছি। কেন যেন মনে হচ্ছে তুই কিছু লুকাচ্ছিস!”
“আমি কিছু লুকাচ্ছিনা।”
“তাই? ”
অরিত্রিকা সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল। রাহা থতমত খেয়ে গেল। কন্ঠ কোমল করে বলল;
“তুই যেমন ভাবছিস তেমন কিছুই না। আচ্ছা ওসব কথা বাদ দে। উনার নাম্বারটা দে তো।”
অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বলে উঠল ;
“কেন?”
“আকদের দিন উনার কিছু সিঙ্গেল পিক তুলেছিলাম। সেগুলো হোয়াটসঅ্যাপে দিতাম আরকি!”
“আমার হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দিস। আমি উনাকে দিয়ে দিবো।”
“ছবি নষ্ট হয়ে যাবে। নাম্বারটা দে প্লিজ।”
“০১৭******। ”

অরিত্রিকা বিরক্ত হয়ে নাম্বারটা বলল। রাহা মনে মনে খুশি হলো। এতো সহজে মানুষটার নাম্বার পেয়ে যাবে ভাবেনি। গদগদ কন্ঠে বলল;
“থ্যাংকস দোস্ত। চল আজ তোকে ফুচকা খাওয়াই। ”
অরিত্রিকা ভেংচি দিয়ে বলল;
“আমি ঘুষ খাই না।”
রাহার মুখটা চুপসে গেল৷ সে আর কথা না বাড়িয়ে অরিত্রিকার সাথে হাটতে লাগল। দুজনে নিরবচিত্তে হেটে মেইন গেট থেকে কিছুটা দূরত্বে অবস্থান করছে। সময় তখন দুইটা পেরিয়ে দশ মিনিট। দুপুরের তপ্ত গরমে জনমানসের বেহাল অবস্থা। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা গাছের নিচে ছায়ায় বসে জিরচ্ছে। কেউবা বই পড়ছে, গল্প করছে।
“অরিত্রিকা…. অরিত্রিকা দাঁড়ান।”

পেছন হতে ভেসে আসছে কারো কন্ঠস্বর। কর্ণকুহরে সেই ধ্বনি প্রবেশ করতেই দুই জোড়া পা থেমে গেল। পুরুষালি কন্ঠটি তার স্বল্প পরিচিত। সে বিরক্ত হলো। এতোদিন পর মানুষটা কোথায় থেকে টপকালো? তাকেই বা কেন ডাকছে? তারা ঘাড় বাঁকিয়ে পিছু ফিরে দাঁড়াল। ইলহাম ছুটে এসে দাঁড়াল সামনে। এতটুকু দৌড়ে আসতে হাঁপিয়ে গেছে। সে দম নিল। কিয়ৎ সময় দেরী করে অরিত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“আপনার সাথে কথা আছে।”
অরিত্রিকা চোখ মুখ শক্ত করে গমগমে কন্ঠে বলল;
“আপনার কথা শোনার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। গত কয়েকদিন ধরে আপনি আমাকে ফলো কেন করছেন তার কারণটা বলুন।”

ইলহাম দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তারমানে মেয়েটা তাকে লক্ষ্য করেছে। সে আশে পাশে তাকাল। অতঃপর দৃষ্টি সামনে দাঁড়ানো দুজনের দিকে স্থির করে শান্ত কন্ঠে বলল;
“সেটা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছি।”
অরিত্রিকা রুক্ষ কন্ঠে বলল ;
“দ্রুত বলুন।”
অরিত্রিকার অনাগ্রহী হয়ে বলেছে তা ইলহাম বুঝতে পারল। এই প্রথম কোনো মেয়ে তার সাথে রুঢ় আচরণ করছে — যা শরীরে জ্বলন্ত আগুন ঢেলে দিলো। ভেতরটা রাগে – ক্ষোভে ফুঁসে উঠল। ইচ্ছে করল তার লুকিয়ে রাখা পশুসম রুপটা দেখিয়ে দিতে। কিন্তু সে পাবলিক প্লেসে এমনটা করবে না। সেসবও পরোয়া করতো না যদি না সে অরিত্রিকাকে ভালো না বাসতো। পছন্দের রমণীর ঝাঁঝ যে সহ্য করতে পারে না সে কেমন প্রেমিক পুরুষ! সে হাসল। হাসি বজায় রেখে সরাসরি বলল;
“আমি আপনাকে ভালোবাসি মিস অরিত্রিকা।”

অরিত্রিকা চমকাল, থমকাল। স্তব্ধ হয়ে চকিত চাহনিতে তাকাল ইলহামের মুখপানে। বাকরুদ্ধ বোবার ন্যায় নড়চড়হীন দাঁড়িয়ে রইল সেথায়। রাগ যেন কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেল। রাহারও একই অবস্থা। এককালীন ক্রাশের মুখে বিস্ফোরক জাতীয় কথাবার্তা শুনে গলা খানা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। এ কি অবিশ্বাস্য কথা শুনছে সে? যদি এমপি সাহেব শোনে তার নববিবাহিতা বউকে আরেকজন প্রপোজ করেছে তখন কি হবে? ইলহাম অরিত্রিকাকে স্তম্ভিত নয়নে নির্বাক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভরাট কন্ঠে পুনরায় বলল;
“মিস অরিত্রিকা আমি…..।”
কথাটা সম্পূর্ণ করার পূর্বে পেছন থেকে কেউ একজন বজ্রকন্ঠে বলে উঠল;
“মিস নয় মিসেস হবে। মিসেস সারহান ইদায়াত চৌধুরী।”
ইলহাম চমকে উঠল। দ্বিধাদ্বন্দ্বিত ভঙ্গিমায় পিছু ফিরে তাকাল। অরিত্রিকা নিজেকে সামলে সামনে তাকাল। আচানক অনাকাঙ্ক্ষিত কারো দেখা পেয়ে স্বস্তি পেল। তবে সেই স্বস্তিভাব টিকল না বেশীক্ষণ। ভয় ও আতংকে মিইয়ে গেল। সারহান ভাই ভার্সিটিতে কখন আসলো? তিনি যে আসবেন বলেননি একাবারও। এবার কি হবে? সে ভীতিগ্রস্ত বদনে ভালোভাবে পরখ করল সারহানকে। মানুষটার ভাবমূর্তি স্বাভাবিক দেখে যেন ভয়ের মাত্রা বাড়ল। এ যেন ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ!

ইলহাম থমকিত কন্ঠে আওড়ালো ;
“মিসেস সারহান ইদায়াত চৌধুরী মানে অরিত্রিকার বিয়ে….. এটা হতে পারে না।”
সারহান এগিয়ে এসে ইলহামের সামনাসামনি দাঁড়াল। লহু স্বরে বলল;
“ফাইরুজের দিকে হাত বাড়ানোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল ইলহাম! ভাবীকে সম্মান দিতে শেখ। জানিস তো, ভাবী মায়ের সমান।”
ইলহাম জোরে জোরে শ্বাস নিলো। অতঃপর যান্ত্রিক কন্ঠে বলল;
“আমাকে মিথ্যা বলছিস তুই।”
“আকদের ফটোগ্রাফ দেখাবো? নাকি ভিডিও দেখাবো?”
“কোনোটাই দেখার ইচ্ছে নেই। আমি জানি তুই আমায় মিথ্যা কথা বলে মাইন্ড ড্রাইভাট করছিস। আমি বোকা নই যে তোর কথা অনায়াসে বিশ্বাস করব।”
“যেহেতু ভিডিও, ফটোগ্রাফ কোনোটাই দেখতে চাইছিস না তাহলে এক – দেড় বছর পর যখন আমার বাচ্চার মামা হবি তখন কষ্ট হলেও বিশ্বাস করে নিস।”

“সারহান!”
ইলহাম ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার করে উঠল। অরিত্রিকা ও ইশরা চমকে লাফিয়ে উঠল। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে একে ওপরের দিকে তাকাল। সারহান বিরক্ত হলো। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিয়ে কপাল কুঁচকে গম্ভীর কন্ঠ বলল;
“ডোন্ট শাউট ইলহাম।”
ইলহাম চোখ মুখ শক্ত করে রাগত স্বরে বলল;
“আমাদের মাঝে তুই কথা বলার কে?”
সারহান ইলহামের শার্টের কলার ঠিক করে দিয়ে হাত রাখল কাঁধে। ফিচেল হেসে বলল;
“আমি ওর হাসবেন্ড।”
“ইউ?”
“অযথা সিনক্রিয়েট করিস না। এটা পাবলিক প্লেস তোর বাড়ি নয়। তাই মেজাজ কন্ট্রোলে রেখে কথা বল।”
“আই ফা* পাবলিক প্লেস।”
“আমি স্বাভাবিক ভাবে তোর সাথে কথা বলছি দেখে ভেবে নিস না তোকে কিছু বলব না। আমি ভদ্র ভাবে কথা বলতেও জানি, দু-চার ঘা লাগিয়ে দিতেও জানি।”
সারহান হাসি থামিয়ে শক্ত গলায় বলল। ইলহাম কাঁধের ওপর রাখা সারহানের হাত নামিয়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলল;
“আমায় থ্রেট দিচ্ছিস?”

সারহান পূর্বের ন্যায় জবাব দিলো ;
“উহু। সাবধান করছি। তোকে তোর ভুল বোঝার জন্য সুযোগ দিচ্ছি।”
“আমি কোনো ভুল করিনি। কাউকে ভালোবাসা যদি ভুল হয় তবে আমি সেই ভুল করতে রাজি।”
“ভুল যখন গুরুতর হয় তখন কি করা হয় জানিস? ভুল করা মানুষটিকে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়।”
“সাহস থাকলে মে*রে দে আমায়।”
“সময় আসুক।”
সারহান গম্ভীরভাবে হেয়ালি করে বলল। ইলহাম আরও রেগে গেল। ফুঁসে উঠে বলল;
“আমি অরিত্রিকাকে …. ”
সম্পূর্ণ না করেই শয়তানী হাসি দিলো। সারহানের মুখাবয়ব কাঠিন্য কাঠিন্যে বর্ণ ধারণ করল। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো ক্রোধে। দুই চোখ রক্তাভ বর্ণ ধারণ করল।মন চাইল গলার রগ টে নে ছিঁড়ে দিতে।ইলহাম যেন সারহানের এমন রুপ দেখে আরও মজা পেলো। তার হাসির মাত্রা বাড়ল। পুনরায় বলে উঠল ;
“অরিত্রিকাকে কখনো তোর হতে দেবো না আমি। ও শুধু আমা… ”

ইলহাম আর কিছু বলতে পারলো না। বলার পূর্বেই শক্ত -পোক্ত ইস্পাত দৃঢ় পুরুষালী হাত এসে গলদেশ চেপে ধরল।ইলহামের কথা আঁটকে গেল। কন্ঠ রোধ হয়ে আসল। অসহনীয় যন্ত্র*ণায় কাতরে উঠল।সারহান জ্বলন্ত চাহনিতে তাকিয়ে ন হাতের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইলহামের গলদেশ চেপে ধরেছে। এতোক্ষণ চেপে রাখা সব রাগ – ক্ষোভ যেন মেটাচ্ছে। অরিত্রিকা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চাহনিতে থ বনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। কি করা উচিত এ মুহুর্তে তা যেন ভুলে বসল। রাহা ধরফরিয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল একটা বাগধারা — যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।

সারহান দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে রাগাশ্রয়ী ভঙ্গিমায় ইলহামকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল ;
“তোর সাহস আজ সীমানা ছাড়িয়েছে। আমার সামনে ফাইরুজকে নিয়ে যাতা বকে নিজেকে সাহসী প্রমানিত করতে চাইছিস? সাহসী প্রেমিক হতে চাইছিস? ওর থেকে দূরে থাক ইলহাম নয়তো তোর এমন অবস্থা করব কারো বউয়ের দিকে তাকানোর লায়েক থাকবি না। এমনকি যে গলা দিয়ে ভালোবাসার কথা বললি সেটা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতে আমার দুই মিনিট সময়ও লাগবে না। এখন শুধু ওয়ার্ন করছি। এরপর সেটা করে দেখাবো।”
একটু থেমে হিংস্রাত্মক ভঙ্গিমায় গর্জে উঠে বলল;
“আমার বিবিজানের দিকে যে তাকানোর চেষ্টা করবে — তার নামনিশানা দুনিয়া থেকে মুছে দিবো আমি। তাই যদি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাস ওর থেকে দূরে থাক।”

ইলহাম ছটফট করছে। চোখ উ*ল্টে যাচ্ছে। জি*হ্বা বেরিয়ে আসছে। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠছে৷ হাত পা আছড়াচ্ছে। অবস্থা খুবই শোচনীয়। যে কোনো মুহুর্তে রুহ বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরী হয়েছে। সারহান সেই দৃশ্য দেখছে ক্রোধান্বিত চাহনিতে। অরিত্রিকা ভয়ে কেঁপে উঠল নেতাসাহেবের বিধ্বংসী রুপে। অজানা শঙ্কায় বুক থিতিয়ে উঠল৷ কি করবে ভেবে দিশেহারা হয়ে গেল। মানুষটাকে ইলহামকে মে*রে ফেলবে? এ অনর্থ ঘটতে দেওয়া যাবে না। সে ছুটে এসে দাঁড়াল সারহানের সামনে। আকুতি করে বলে উঠল ;
“সারহান ভাই, উনাকে ছেড়ে দিন।”

বেশ কয়েকবার ডেকেও সাড়া পেল না। অরিত্রিকা দিশা না পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মানুষটাকে কিভাবে শান্ত করবে? কিভাবে রাগের মাত্রা কমাবে? সে অসহায় চাহনিতে আশে পাশে তাকায়। মানুষজন গোল করে আশপাশ ঘিরে হা করে তাকিয়ে দেখছে যেন কোনো কাহিনী চলছে। সে দবগে যায়। মানুষের নিবদ্ধ চাহনি সুচের মতো ফুটতে থাকে। কর্ণে এসে ধাক্কা খায় শোরগোলে চলমান বিষাক্ত কথা। অরিত্রিকা উপায়ন্তর না পেয়ে পুনরায় ভেজা কন্ঠে অনুনয় করে বলল ;
“সারহান ভাই, মানুষজন দেখছে। প্লিজ উনাকে ছেড়ে দিন।”
সারহান রুক্ষভাষীর ন্যায় জবান চালাল ;
“দেখুক।”

অরিত্রিকা অশ্রু গাল বেয়ে টপটপ করে পড়ছে। শঙ্কায় গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক প্রায় অচল। এমন পরিস্থিতিতে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে আচানক আশ্চর্যিত কান্ড করে বসে৷ আশেপাশে মানুষের দৃষ্টি উপেক্ষা করে সারহানকে পেছন থেকে জাপটে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেলে। কন্দনরত কন্ঠে বলে ;
“নেতাসাহেব উনাকে ছেড়ে দিন। আপনি শান্ত হোন। ”
সারহান আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় থমকে গেল। রাগ ধপ করে নিভে গেল। পাঞ্জাবি ভেদ করে অশ্রকণার শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে গেল পুরুষালি শরীর। তার মুখাবয়ব অতি শান্ত হয়ে উঠল। ইলহামের গলায় চেপে রাখা হাতটা শিথিল হয়ে গেল। ইলহাম ধপ করে বসে পড়ল সেথায়। ওষ্ঠকোণে র*ক্তের অস্তিত্ব! দুর্বল হয়ে গেছে শরীর। সেই অবস্থায় কাশতে কাশতে ঘোলা চোখে দেখে নিলো অরিত্রিকা এবং সারহানকে। মুহুর্তে মাথাটা ঘুরে গেল। দুচোখ বেয়ে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ল। তখনি ধুপধাপ পা ফেলে দৌড়ে মানুষের জটলা ভেদ করে ভেতরে আসলো দুজন দেহরক্ষী। ইলহানের করুণ অবস্থা দেখে বুঝতে দেরী হলো না কি ঘটেছে।
দেহরক্ষীদের একজন সারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“স্যার এখন কি করবো।”

সারহান চক্ষুদ্বয় বুজে শান্ত করল নিজেকে। অতঃপর ভরাট কন্ঠে নির্দেশনা দিলো;
“যারা এতোক্ষণ ভিডিও করছিল তাদের ফোন নিয়ে ভিডিও গুলো ডিলিট করে দাও আর ইলহামকে পানি দাও।”
দেহরক্ষী কথামতো কাজ করতে তৎপর হয়ে উঠল। রাহা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এককোণে। সারহান অরিত্রিকার হাত ধরে টেনে সামনে দাঁড় করালো। অরিত্রিকা তখনও নিঃশব্দে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। তার জন্য সবকিছু হয়েছে। কেন তখন ইলহামের ডাকে থেমেছিল? যদি না থামতো তাহলে এতো বড় ঘটনা ঘটতো না।
“নেতাসাহেবের বিবিজান দুর্বল হৃদয়ের হলে কিভাবে চলবে?”
সারহান অরিত্রিকার হাত মুঠোবন্দি করে নরম স্বরে বলল। অরিত্রিকা ভেজা নেত্রপল্লব ফেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। কন্দনরত কন্ঠে জবাব দিলো;
“কেমন হবো? আপনার মতো পাষাণ হৃদয়ের?”
সারহান মৃদু হেসে জবাব দিলো;
“আমি পাষাণ হৃদয়ের পুরুষ?”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৭

“হ্যা আপনি একজন পাষাণ হৃদয়ের পুরুষ। যদি ইলহাম তালুকদার ম*রে যেত তখন আপনার কি হতো ভেবে দেখেছেন?খু* নের দায়ে জেলে যেতেন। আমি কি করে থাকতাম আপনাকে ছাড়া? মাত্র আকদ হলো। এখনো দশ বারোটা বাচ্চা পয়দা করা বাকি আর আপনি সেসব ইচ্ছে না করে অপরাধ করতে যাচ্ছিলেন?”
“দশ – বারোটা বাচ্চা? এ শুকনো শরীর নিয়ে এতো ধকল সামলাতে পারতিস?”
কথাটা ফিসফিসিয়ে বলে সারহান ওষ্ঠ কামড়ে হাসল। অরিত্রিকার কান্না থেমে গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নাক ছিটকে বলল;
“অস*ভ্য পুরুষ।”
সারহান খানিকটা ঝুঁকে দুষ্টমি করে বলল;
“অস*ভ্য হওয়ার মতো কিছু না করতেই অ*সভ্য বানিয়ে দিলি।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৯