এলিজা পর্ব ৬০+৬১

এলিজা পর্ব ৬০+৬১
Dayna

বেলা বাড়ছে।আজ কুয়াশা নেই। হঠাৎ করেই ভিষন গরম পরছে।আজকে হঠাৎ সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।এত বেলা অব্দি কেউ ঘুমোয়না। কিন্তু আজ হঠাৎ সবাই বেলা অব্দি ঘুমোচ্ছে। এলিজা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য খাবার তৈরি করছে। আজকে মনজুরাও আসছে। এলিজা বার বার সিড়ির দিকে দেখছে। অপূর্ব নিচে এলো বলে। গতকাল রাত করে, জাহাঙ্গীর অপূর্ব একসাথে ই বাড়ি ফিরে। এলিজা গতকাল রাতের ঘটনা কাউকে বলেনি। তৎক্ষণাৎ কমড়ে হাত দিয়ে নিচে নামলো জয়া।
জয়া বললো,গতকাল কড়া ঘুম হয়েছে। এরকম হঠাৎ করে ঘুম হলো।আজ খুব রোদের তেজ। হঠাৎ খুব ঠান্ডা,গরমে অসুস্থতা বাড়ে।

বৈঠকখানায় বসে মনোরাকে ডাকে।বললো আদা দিয়ে চা করে নিয়ে আয়। এলিজা তৎক্ষণাৎ সবার জন্য টেলিবে খাবার দিচ্ছে। মমতাজ, অর্পা নিচে আসে। মমতাজ জয়ার পাশে বসে।বললো, গতকাল ঘুমটা অন্যরকম ছিল।এত গভীর ঘুম।খুব ভালো লেগেছে।জয়া মৃদু হাসে। মমতাজ রান্না ঘরের দিকে পরোখ করে বললো, রান্না ঘরে দেখছি এলিজা কাজ করছে। সারাদিন মেয়েটা কত কাজ করে।আর আমার বউ টাকে দেখো, সারাদিন মহারানির মত পায়ে পা তুলে থাকে।জয়া মৃদু হেসে বললো,তুই তোর ছেলের বউকে মহারানি করে রাখ দেখবি সেও তোকে রাজরানির মত সম্মান করবে।ছেলের বউকে বউমা নয়, নিজের মেয়ের মত দেখতে হয়। এলিজা জয়ার কথায় খুশি হয়। এলিজা বায়েজিদ এর জন্য কিছু খাবার আলাদা করে রাখে।এক এক করে সবাই খাবার টেবিলে আসে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শ্রাবন পাখি দুজন একসাথে পাশাপাশি বসে।পাখি ইতস্তত বোধ করে।তার বোন কাজ করছে অথচ সে কিছু করছে না। এলিজা তাকে কাজ করতে দিবে না যে। অপূর্ব খাবার খেতে খেতে বার বার এলিজার দিকে পরোখ করছে। মৃদু হেসে বললো, আমার বউ যেমনই দেখতে তেমনি তার রান্না। এলিজা মৃদু হাসে। শ্রাবন পাশ থেকে বলে উঠলো, পিচ্চি তোমার হাতে একদিন রান্না খেতে হবে।পাখি খাবার রেখে ভ্রু কুঁচকে বললো, ভাইয়া, আপনি আমাকে পিচ্চি ডাকবেন না। তৎক্ষণাৎ শ্রাবনের বিষন লাগে। মমতাজ দ্রুত পানি দেয়। অপূর্ব মৃদু হাসে। অর্পা,ডালিয়া চাঁদনী,এলিজা আওয়াজ করে হেসে উঠে। শ্রাবন পানি খেয়ে নেয়। শ্রাবন পাখির দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো,ভাইয়া আমি?
পাখি হ্যা সুচক মাথা নাড়ে।

শ্রাবন পাখির কাছে এগিয়ে বললো,আমি তোমার স্বামী! ভাইয়া কেন বলছো।ভাইয়া টা লেগেছে।তাও সবার সামনে।
মমতাজ টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে বললো, এই মেয়েটা ঠিক মত আমার ছেলেকে খেতেও দেবে না।বাবা ওর কথায় কান দিসনা।তুই তারাতারি খেয়ে নে। জাহাঙ্গীর এখনো নিচে আসেনি।এলিজা বায়েজিদ এর জন্য খাবার নিয়ে যায়। বায়েজিদ চৌকিতে বসে আছে।এলিজা কে দেখে মৃদু হাসে।এলিজা খাবার টা দিতে দিতে বললো, মুখো,শধারী লোকটির লা,শটি কোথায় পুতে রেখেছিস?
বায়েজিদ ঠোট কুঁচকে হেসে ফিসফিস করে বলল,তা আমি রেখেছি।সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

এলিজা চলে যায়‌। অপূর্ব সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে।থানার উদ্দেশ্যে বের হবে বলে। তৎক্ষণাৎ জয়া অপূর্ব কে দাড় করিয়ে নরম গলায় বললো,খোকা আমার জন্য পান নিয়ে আসবি। আমার পান যে শেষ হয়ে গেছে। অপূর্ব মৃদু হেসে বললো, এভাবে বলার কি আছে। তুমি বললে পানের দোকান টাই কিনে নিয়ে আসবো।বলেই,শ্রাবন অপূর্ব থানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।পাখি রান্না ঘরে যায়। বাহানা ধরেছে আজ সে রান্না করবেই। এলিজা রান্না ঘরে পাখিকে দেখে মৃদু হাসে।বললো, এখানে কেন এসেছিস! কোন কিছু করতে হবে না।হাত পুড়ে যাবে।পাখি বললো,আপু একদিনে কিছু হবে না।
আচ্ছা কর তাহলে। কিন্তু সাবধানে। এলিজা রান্না ঘর থেকে যেতেই থমকে দাঁড়ায়,পেছন ঘুরে সন্দেহ গলায় মৃদু হেসেই পাখিকে প্রশ্ন করলো, গতকাল ঘুম কেমন হয়েছিল?

পাখি এলিজার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো, বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।ঘুম টা ভালো হয়েছিল। এলিজা মনোরাকে উদ্দেশ্য করে বললো, পাখির যা দরকার গুছিয়ে দাও।ওর যাতে কোন আঁচ না লাগে। আমি আম্মার ঘরে যাচ্ছি।এলিজা জয়ার ঘরে চলে যায়। এলিজা গিয়ে দেখে জয়া মেঝেতে সুয়ে কমড় ধরে কাঁদছে। এলিজা অস্থির হয়ে যায়। এলিজা চোখ গুলো বড় বড় করে বললো,কি হয়েছে আম্মা। এরকম কমড় ধরে কাঁদছেন কেন?
জয়া কাপা কন্ঠে বললো,মারে ভিষন কষ্ট হচ্ছে।কমড়ে বেথা টা বেড়েছে।তারসাথে বুকের ভেতর চিনচিন বেথা করছে। এলিজা কি করবে বুঝতে না পেরে জাহাঙ্গীর কে ডাকে। জাহাঙ্গীর স্টোর রুম থেকে চলে আসে। জাহাঙ্গীর জয়াকে ধরে বসে।কাপা কন্ঠে বললো,কি হয়েছে খোকার মা? এরকম করছো কেন? জয়া নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর এলিজা কে বললো, তুমি বসো জয়ার কাছে আমি এ্যাম্বুলেন্স কে ফোন দেই।

রাত ৮ টা নাগাদ —
অপূর্ব কিছু ফাইল চেক করছে।পাশে বসে শ্রাবন চা খাচ্ছে। হঠাৎ অপূর্বর বুকের ভেতর চাপ চাপ বেথা হচ্ছে। অপূর্বর বুকে হঠাৎ করেই জ্বালাপোড়া শুরু করে। অপূর্ব কাজে মন দিতে পারছে না। শ্রাবন অপূর্বর হাব ভাব দেখে বললো,কি হয়েছে? কিছু ভাবছিস?

অপুর্ব কাপা কন্ঠে বললো, মনটার ভেতর কুহ ডাকছে। হঠাৎ কেমন জানি মনে হচ্ছে চারদিক টা অন্ধকার ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবন বললো চল বাড়ি ফিরে যাই। আমার ও কিছু ভালো লাগছে না। তৎক্ষণাৎ একজন কনস্টেবল অপূর্ব কে বললো, স্যার আপনার বাড়ি থেকে একজন মেয়ে ফোন করেছে ,বললো এখনি বাড়ি ফিরতে। অপূর্বর চোখ গুলো ছানাবরা হয়ে যায়। হঠাৎ কেমন জানি অদ্ভুত রকম অনুভুতি হচ্ছে। অপূর্ব দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যায়। শ্রাবন গাড়ি ড্রাইফ করছে। অপূর্ব অঝরে ঘামছে। চারদিক কেমন জানি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অপূর্বর ভেতরে জ্বালাপো,ড়া টা কমছেই না। শ্রাবন কে বললো, তারাতাড়ি গাড়ি চালা। রাস্তা যেন শেষ ই হচ্ছে না। আকাশের তারা গুলো ঢেকে গেছে কালো মেঘে। অপূর্ব বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে, রাস্তা শেষ হলো কিনা। কিছুক্ষণ এর মধ্যে পৌছায় বাড়িতে।

অপূর্ব সম্পুর্ন ভাবে থমকে যায়।বুকের ভেতর ধুকবুকানি টা হঠাৎ বেড়ে গেছে।কপাল থেকে অঝরে ঘাম বেয়ে পরছে।বাড়ির সামনে অনেক মানুষ জন।এত মানুষের ভির কেন।কি হয়েছে। অপূর্ব ভেতরে যায়। চারদিকে সবাই কাঁদছে।কান্নার আওয়াজ এ যেন বাড়ি, হইহুপ্পুর হয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব কে দেখেই,অর্পা দৌড়ে আসে। অপূর্ব কে জড়িয়ে ধরে। অপূর্ব থমকে যায়। এলিজা সিড়ির কোনে বসে কাঁদছে।পাশে পাখি কাঁদছে। মমতাজ নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। জাহাঙ্গীর নিস্তব্দ হয়ে বসে আছে। অপূর্ব অর্পার দুই স্বিনাতে হাত দিয়ে কাঁপা গলায় বললো,এই অর্পা কি হয়েছে? কি হয়েছে বল।অর্পা কথা বলার মত অবস্থায় নেই। অপূর্ব দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলে ,অর্পা হাতের ইশারায় উঠানের বা দিকে দেখিয়ে দেয়।

অপূর্বর চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। হৃদয়ের স্পন্দন টা বন্ধ হয়ে যায়। একটা খাটিয়া ।উপরে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। অপূর্ব ধিরে ধিরে এগোয়। অপূর্বর হাটার শক্তি যেন নিমিষেই ফুরিয়ে গেছে। অপূর্ব কাপা হাতে ধিরে ধিরে ,সাদা কাপড় টা তুলতেই দেখে জয়া সুয়ে আছে। তার নাকের মধ্যে তুলা দেয়া।রুহহীন হয়ে শুয়ে আছে। অপূর্ব মা বলে এক চিৎকার। অপূর্বর চিৎকারে চারদিকে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অপূর্ব কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো,মা ও মা মা, কি হয়েছে তোমার।তোমায় ওরা এভাবে বাহিরে সুইয়ে রাখছে কেন।ও মা মা, কথা বলো,চোখ খুলো,মা মা বলেই অপূর্ব বুক ফাটা কান্না শুরু করে।এই আমার মায়ের কি হয়েছে। আমার মা কেন খাটিয়ায় সুয়ে আছে।আমার মা আমায় সকালেও খোকা বলে ডেকেছে। এখন কেন আমার মা চুপ হয়ে আছে।ও মা,মা চোখ খুলো। আশেপাশের সবাই অপূর্বর কান্না দেখে কান্না করছে। প্রতিবেশী মহিলারা মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদছে।কেউ কেউ দোয়া করছে। অপূর্ব কে ধৈর্য্য ধারন করার ক্ষমতা দাও। অপূর্ব জয়ার লা,শের কাছে বসে অঝরে কাঁদছে।

মা ওমা চোখ খুলো , তোমার খোকা তোমায় ডাকছে। কথা বলোনা মা,এটা তুমি কি করলে।এটা তুমি কি করলে আমাকে একা রেখে ফেলে গেলে।আমাকে কে খোকা বলে ডাকবে কে,কে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করবে! মা উঠোনা মা! শ্রাবন অপূর্বর পেছনে দাঁড়িয়ে ফোপাচ্ছে, অপূর্ব কে শান্ত না দেয়ার মত কোন শব্দ যে নেই। শ্রাবনের হাতে জয়ার জন্য আনা পান। অপূর্ব পান টা থাবা মেরে নিজের হাতে নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, ওমা তুমি না পান আনতে বলেছিলে।এইযে তোমার জন্য অনেক পান নিয়ে এসেছি।মারে একটা বার চোখ খুলো মা।মা একটা বার ওঠোনা মা।আমি আর পুলিশের চাকরি করবো না,মা।তুমি না বলতে এই কাজ তোমার পছন্দ নয়। তোমার সারাদিন আমায় নিয়ে চিন্তা হয়।আমি চাকরি টা ছেড়ে দেবো।আর তোমায় চিন্তা করতে হবে না। সারাদিন তোমার সাথে সময় কাটাবো।

হঠাৎ চারদিক নিস্তব্ধ। গাছের পাতা গুলো ও যেন মা হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে যাচ্ছে। অপূর্বর বুক ফাটা কান্নায় , ভেঙে যাচ্ছে সবকিছু। অপূর্ব মাটিতে লুটিয়ে বসে পরে।মা মা বলে চিৎকার করে।ওমা সাড়া দাও।মারে একটা বার ওঠো না।
পাশে বসা ইমাম সাহেব, অপূর্বর কাদে হাত রেখে বলল, আর যে তোর মা সাড়া দিবে না।মা,যে চলে গেছে পরপারে।যার মা চলে গেছে,তার যে দুয়িয়ার সব থেকে দামি জিনিস টাই চলে যায়।ভেঙে পরিস না।
অপূর্ব খাটিয়ার সাথে কপাল লাগিয়ে কাদদে থাকে।মা মা বলে ডাকতে থাকে।মা উঠো না,ওমা,কে আমায় খোকা বলে ডাকবে।কে আমার পথচেয়ে বসে থাকবে।ইমাম সাহেব অপূর্ব কে সরাতে চায় বলে চোখের পানি পড়রে,মৃত মানুষের ক্ষতি হয়।

অপূর্ব কে খাটিয়া থেকে সরাতে পারছে না। অপূর্বর হাতে ,জয়ার জন্য আনা পানটা অপূর্ব শক্ত করে ধরে রেখেছে। অপূর্ব ধিরে ধিরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
মমতাজ এলিজাকে শান্তনা দিচ্ছে, এলিজা অঝরে কাঁদছে,কাপা কন্ঠে বলছে, কাকি আমার আম্মার কি হলো, আমার আম্মা না বলেই চলে গেলো‌।আমি আম্মা বলে কাকে ডাকবো,কার শরীর থেকে আমার মায়ের গন্ধ শুকবো,এলিজার বুকের ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে।…..

বেলা বাড়ছে।আজ কুয়াশা নেই। হঠাৎ করেই ভিষন গরম পরছে।আজকে হঠাৎ সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।এত বেলা অব্দি কেউ ঘুমোয়না। কিন্তু আজ হঠাৎ সবাই বেলা অব্দি ঘুমোচ্ছে। এলিজা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য খাবার তৈরি করছে। আজকে মনজুরাও আসছে। এলিজা বার বার সিড়ির দিকে দেখছে। অপূর্ব নিচে এলো বলে। গতকাল রাত করে, জাহাঙ্গীর অপূর্ব একসাথে ই বাড়ি ফিরে। এলিজা গতকাল রাতের ঘটনা কাউকে বলেনি। তৎক্ষণাৎ কমড়ে হাত দিয়ে নিচে নামলো জয়া।
জয়া বললো,গতকাল কড়া ঘুম হয়েছে। এরকম হঠাৎ করে ঘুম হলো।আজ খুব রোদের তেজ। হঠাৎ খুব ঠান্ডা,গরমে অসুস্থতা বাড়ে।

বৈঠকখানায় বসে মনোরাকে ডাকে।বললো আদা দিয়ে চা করে নিয়ে আয়। এলিজা তৎক্ষণাৎ সবার জন্য টেলিবে খাবার দিচ্ছে। মমতাজ, অর্পা নিচে আসে। মমতাজ জয়ার পাশে বসে।বললো, গতকাল ঘুমটা অন্যরকম ছিল।এত গভীর ঘুম।খুব ভালো লেগেছে।জয়া মৃদু হাসে। মমতাজ রান্না ঘরের দিকে পরোখ করে বললো, রান্না ঘরে দেখছি এলিজা কাজ করছে। সারাদিন মেয়েটা কত কাজ করে।আর আমার বউ টাকে দেখো, সারাদিন মহারানির মত পায়ে পা তুলে থাকে।জয়া মৃদু হেসে বললো,তুই তোর ছেলের বউকে মহারানি করে রাখ দেখবি সেও তোকে রাজরানির মত সম্মান করবে।ছেলের বউকে বউমা নয়, নিজের মেয়ের মত দেখতে হয়। এলিজা জয়ার কথায় খুশি হয়। এলিজা বায়েজিদ এর জন্য কিছু খাবার আলাদা করে রাখে।এক এক করে সবাই খাবার টেবিলে আসে।

শ্রাবন পাখি দুজন একসাথে পাশাপাশি বসে।পাখি ইতস্তত বোধ করে।তার বোন কাজ করছে অথচ সে কিছু করছে না। এলিজা তাকে কাজ করতে দিবে না যে। অপূর্ব খাবার খেতে খেতে বার বার এলিজার দিকে পরোখ করছে। মৃদু হেসে বললো, আমার বউ যেমনই দেখতে তেমনি তার রান্না। এলিজা মৃদু হাসে। শ্রাবন পাশ থেকে বলে উঠলো, পিচ্চি তোমার হাতে একদিন রান্না খেতে হবে।পাখি খাবার রেখে ভ্রু কুঁচকে বললো, ভাইয়া, আপনি আমাকে পিচ্চি ডাকবেন না। তৎক্ষণাৎ শ্রাবনের বিষন লাগে। মমতাজ দ্রুত পানি দেয়। অপূর্ব মৃদু হাসে। অর্পা,ডালিয়া চাঁদনী,এলিজা আওয়াজ করে হেসে উঠে। শ্রাবন পানি খেয়ে নেয়। শ্রাবন পাখির দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো,ভাইয়া আমি?
পাখি হ্যা সুচক মাথা নাড়ে।

শ্রাবন পাখির কাছে এগিয়ে বললো,আমি তোমার স্বামী! ভাইয়া কেন বলছো।ভাইয়া টা লেগেছে।তাও সবার সামনে।
মমতাজ টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে বললো, এই মেয়েটা ঠিক মত আমার ছেলেকে খেতেও দেবে না।বাবা ওর কথায় কান দিসনা।তুই তারাতারি খেয়ে নে। জাহাঙ্গীর এখনো নিচে আসেনি।এলিজা বায়েজিদ এর জন্য খাবার নিয়ে যায়। বায়েজিদ চৌকিতে বসে আছে।এলিজা কে দেখে মৃদু হাসে।এলিজা খাবার টা দিতে দিতে বললো, মুখো,শধারী লোকটির লা,শটি কোথায় পুতে রেখেছিস?
বায়েজিদ ঠোট কুঁচকে হেসে ফিসফিস করে বলল,তা আমি রেখেছি।সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

এলিজা চলে যায়‌। অপূর্ব সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে।থানার উদ্দেশ্যে বের হবে বলে। তৎক্ষণাৎ জয়া অপূর্ব কে দাড় করিয়ে নরম গলায় বললো,খোকা আমার জন্য পান নিয়ে আসবি। আমার পান যে শেষ হয়ে গেছে। অপূর্ব মৃদু হেসে বললো, এভাবে বলার কি আছে। তুমি বললে পানের দোকান টাই কিনে নিয়ে আসবো।বলেই,শ্রাবন অপূর্ব থানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।পাখি রান্না ঘরে যায়। বাহানা ধরেছে আজ সে রান্না করবেই। এলিজা রান্না ঘরে পাখিকে দেখে মৃদু হাসে।বললো, এখানে কেন এসেছিস! কোন কিছু করতে হবে না।হাত পুড়ে যাবে।পাখি বললো,আপু একদিনে কিছু হবে না।
আচ্ছা কর তাহলে। কিন্তু সাবধানে। এলিজা রান্না ঘর থেকে যেতেই থমকে দাঁড়ায়,পেছন ঘুরে সন্দেহ গলায় মৃদু হেসেই পাখিকে প্রশ্ন করলো, গতকাল ঘুম কেমন হয়েছিল?

পাখি এলিজার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো, বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।ঘুম টা ভালো হয়েছিল। এলিজা মনোরাকে উদ্দেশ্য করে বললো, পাখির যা দরকার গুছিয়ে দাও।ওর যাতে কোন আঁচ না লাগে। আমি আম্মার ঘরে যাচ্ছি।এলিজা জয়ার ঘরে চলে যায়। এলিজা গিয়ে দেখে জয়া মেঝেতে সুয়ে কমড় ধরে কাঁদছে। এলিজা অস্থির হয়ে যায়। এলিজা চোখ গুলো বড় বড় করে বললো,কি হয়েছে আম্মা। এরকম কমড় ধরে কাঁদছেন কেন?
জয়া কাপা কন্ঠে বললো,মারে ভিষন কষ্ট হচ্ছে।কমড়ে বেথা টা বেড়েছে।তারসাথে বুকের ভেতর চিনচিন বেথা করছে। এলিজা কি করবে বুঝতে না পেরে জাহাঙ্গীর কে ডাকে। জাহাঙ্গীর স্টোর রুম থেকে চলে আসে। জাহাঙ্গীর জয়াকে ধরে বসে।কাপা কন্ঠে বললো,কি হয়েছে খোকার মা? এরকম করছো কেন? জয়া নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর এলিজা কে বললো, তুমি বসো জয়ার কাছে আমি এ্যাম্বুলেন্স কে ফোন দেই।

রাত ৮ টা নাগাদ —
অপূর্ব কিছু ফাইল চেক করছে।পাশে বসে শ্রাবন চা খাচ্ছে। হঠাৎ অপূর্বর বুকের ভেতর চাপ চাপ বেথা হচ্ছে। অপূর্বর বুকে হঠাৎ করেই জ্বালাপোড়া শুরু করে। অপূর্ব কাজে মন দিতে পারছে না। শ্রাবন অপূর্বর হাব ভাব দেখে বললো,কি হয়েছে? কিছু ভাবছিস?

অপুর্ব কাপা কন্ঠে বললো, মনটার ভেতর কুহ ডাকছে। হঠাৎ কেমন জানি মনে হচ্ছে চারদিক টা অন্ধকার ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবন বললো চল বাড়ি ফিরে যাই। আমার ও কিছু ভালো লাগছে না। তৎক্ষণাৎ একজন কনস্টেবল অপূর্ব কে বললো, স্যার আপনার বাড়ি থেকে একজন মেয়ে ফোন করেছে ,বললো এখনি বাড়ি ফিরতে। অপূর্বর চোখ গুলো ছানাবরা হয়ে যায়। হঠাৎ কেমন জানি অদ্ভুত রকম অনুভুতি হচ্ছে। অপূর্ব দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যায়। শ্রাবন গাড়ি ড্রাইফ করছে। অপূর্ব অঝরে ঘামছে। চারদিক কেমন জানি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অপূর্বর ভেতরে জ্বালাপো,ড়া টা কমছেই না। শ্রাবন কে বললো, তারাতাড়ি গাড়ি চালা। রাস্তা যেন শেষ ই হচ্ছে না। আকাশের তারা গুলো ঢেকে গেছে কালো মেঘে।

অপূর্ব বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে, রাস্তা শেষ হলো কিনা। কিছুক্ষণ এর মধ্যে পৌছায় বাড়িতে। অপূর্ব সম্পুর্ন ভাবে থমকে যায়।বুকের ভেতর ধুকবুকানি টা হঠাৎ বেড়ে গেছে।কপাল থেকে অঝরে ঘাম বেয়ে পরছে।বাড়ির সামনে অনেক মানুষ জন।এত মানুষের ভির কেন।কি হয়েছে। অপূর্ব ভেতরে যায়। চারদিকে সবাই কাঁদছে।কান্নার আওয়াজ এ যেন বাড়ি, হইহুপ্পুর হয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব কে দেখেই,অর্পা দৌড়ে আসে। অপূর্ব কে জড়িয়ে ধরে। অপূর্ব থমকে যায়। এলিজা সিড়ির কোনে বসে কাঁদছে।পাশে পাখি কাঁদছে। মমতাজ নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। জাহাঙ্গীর নিস্তব্দ হয়ে বসে আছে। অপূর্ব অর্পার দুই স্বিনাতে হাত দিয়ে কাঁপা গলায় বললো,এই অর্পা কি হয়েছে? কি হয়েছে বল।অর্পা কথা বলার মত অবস্থায় নেই। অপূর্ব দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলে ,অর্পা হাতের ইশারায় উঠানের বা দিকে দেখিয়ে দেয়।

অপূর্বর চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। হৃদয়ের স্পন্দন টা বন্ধ হয়ে যায়। একটা খাটিয়া ।উপরে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। অপূর্ব ধিরে ধিরে এগোয়। অপূর্বর হাটার শক্তি যেন নিমিষেই ফুরিয়ে গেছে। অপূর্ব কাপা হাতে ধিরে ধিরে ,সাদা কাপড় টা তুলতেই দেখে জয়া সুয়ে আছে। তার নাকের মধ্যে তুলা দেয়া।রুহহীন হয়ে শুয়ে আছে। অপূর্ব মা বলে এক চিৎকার। অপূর্বর চিৎকারে চারদিকে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অপূর্ব কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো,মা ও মা মা, কি হয়েছে তোমার।তোমায় ওরা এভাবে বাহিরে সুইয়ে রাখছে কেন।ও মা মা, কথা বলো,চোখ খুলো,মা মা বলেই অপূর্ব বুক ফাটা কান্না শুরু করে।এই আমার মায়ের কি হয়েছে। আমার মা কেন খাটিয়ায় সুয়ে আছে।আমার মা আমায় সকালেও খোকা বলে ডেকেছে। এখন কেন আমার মা চুপ হয়ে আছে।ও মা,মা চোখ খুলো। আশেপাশের সবাই অপূর্বর কান্না দেখে কান্না করছে। প্রতিবেশী মহিলারা মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদছে।কেউ কেউ দোয়া করছে। অপূর্ব কে ধৈর্য্য ধারন করার ক্ষমতা দাও। অপূর্ব জয়ার লা,শের কাছে বসে অঝরে কাঁদছে।

মা ওমা চোখ খুলো , তোমার খোকা তোমায় ডাকছে। কথা বলোনা মা,এটা তুমি কি করলে।এটা তুমি কি করলে আমাকে একা রেখে ফেলে গেলে।আমাকে কে খোকা বলে ডাকবে কে,কে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করবে! মা উঠোনা মা! শ্রাবন অপূর্বর পেছনে দাঁড়িয়ে ফোপাচ্ছে, অপূর্ব কে শান্ত না দেয়ার মত কোন শব্দ যে নেই। শ্রাবনের হাতে জয়ার জন্য আনা পান। অপূর্ব পান টা থাবা মেরে নিজের হাতে নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, ওমা তুমি না পান আনতে বলেছিলে।এইযে তোমার জন্য অনেক পান নিয়ে এসেছি।মারে একটা বার চোখ খুলো মা।মা একটা বার ওঠোনা মা।আমি আর পুলিশের চাকরি করবো না,মা।তুমি না বলতে এই কাজ তোমার পছন্দ নয়। তোমার সারাদিন আমায় নিয়ে চিন্তা হয়।আমি চাকরি টা ছেড়ে দেবো।আর তোমায় চিন্তা করতে হবে না। সারাদিন তোমার সাথে সময় কাটাবো।

হঠাৎ চারদিক নিস্তব্ধ। গাছের পাতা গুলো ও যেন মা হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে যাচ্ছে। অপূর্বর বুক ফাটা কান্নায় , ভেঙে যাচ্ছে সবকিছু। অপূর্ব মাটিতে লুটিয়ে বসে পরে।মা মা বলে চিৎকার করে।ওমা সাড়া দাও।মারে একটা বার ওঠো না।
পাশে বসা ইমাম সাহেব, অপূর্বর কাদে হাত রেখে বলল, আর যে তোর মা সাড়া দিবে না।মা,যে চলে গেছে পরপারে।যার মা চলে গেছে,তার যে দুয়িয়ার সব থেকে দামি জিনিস টাই চলে যায়।ভেঙে পরিস না।
অপূর্ব খাটিয়ার সাথে কপাল লাগিয়ে কাদদে থাকে।মা মা বলে ডাকতে থাকে।মা উঠো না,ওমা,কে আমায় খোকা বলে ডাকবে।কে আমার পথচেয়ে বসে থাকবে।ইমাম সাহেব অপূর্ব কে সরাতে চায় বলে চোখের পানি পড়রে,মৃত মানুষের ক্ষতি হয়।

এলিজা পর্ব ৫৮+৫৯

অপূর্ব কে খাটিয়া থেকে সরাতে পারছে না। অপূর্বর হাতে ,জয়ার জন্য আনা পানটা অপূর্ব শক্ত করে ধরে রেখেছে। অপূর্ব ধিরে ধিরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
মমতাজ এলিজাকে শান্তনা দিচ্ছে, এলিজা অঝরে কাঁদছে,কাপা কন্ঠে বলছে, কাকি আমার আম্মার কি হলো, আমার আম্মা না বলেই চলে গেলো‌।আমি আম্মা বলে কাকে ডাকবো,কার শরীর থেকে আমার মায়ের গন্ধ শুকবো,এলিজার বুকের ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে।…..

এলিজা পর্ব ৬২+৬৩