প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ২+৩

প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ২+৩
শার্লিন হাসান

বাসায় এসে নিজের রুমে চলে যায় জাইমা। লম্বা শাওয়ার নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। ড্রয়ার থেকে মলম বের করে পায়ের আঙুলে মালিশ করে। জাইমা রুমে থাকতে,থাকতে তার দাদী উপস্থিত হয় তখন। জাইমা দাদীকে দেখে বলে, “রাহেলাবানু কী খবর”
দাদী জাইমার কাছো এগিয়ে আসেন। পাশে বোসে বলেন, “শোন, এবার মনে হচ্ছে তোমার বিয়ের সময় ঘনিয়ে আসছে।”
জাইমা পা তুলে খাটের উপর বসে। রাহেলা খানের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “ওটা রিজেক্ট করে দিয়েছি। নতুন পাত্র থাকলে বলো?”

“না। আমার নাতি লাখে একজন। পুরোটা শুনে যাও?”
“ওই মর্ম কর্ম নামের কোন ছেলেকে আমি বিয়ে করতে পারব না।”
“আচ্ছা নামটা ছাড়ো, ও জাপান থেকে পড়াশোনা করে এসেছে।”
“তো?”
“তো কী? তোমার সাথে ওর বিয়ে দেব।”
“দাদীন, বাবা আমাকে তোমার নাতির সাথে কখনোই বিয়ে দিবেনা। দেখোনা, ভাই-ভাই কথা বলেনা। বড়ফুপ্পু আর ছোট ফুপ্পু ওই বাসায় যায়, এখানে তেমন আসেনা।”
“তোমার বাবা পুরোনো ঐতিহ্য কখনো ভুলেনি আরনা পুরোনো কথা কখনো ফেলতে পারবে।”
“হ্যাঁ, বুঝলাম কিন্তু তোমার ছেলেরবউ সে তো আমায় নিজের পুত্র বঁধু হিসাবে নাও মানতে পারে? যেখানে আমার আম্মুর সাথেও তার যোগাযোগ নেই। আচ্ছা,তোমার নাতিকে আমি কখনো দেখিনি, তারকথা খুব একটা শুনিওনি। এই বাসায় ওদের কথা উঠানো নিষেধ। আর না কখনো ওই বাড়িতে গিয়েছি। এরকম ভাঙা সম্পর্ক তুমি কী করে জোড়া লাগাবে বলো? হয়ত তোমার নাতির গার্লফ্রেন্ড আছে নাহলে বিবাহিত।”
“আমার নাতি বিয়ে করবে, আর আমি জানব না?”
“তুমি এটা নিয়ে পরিকল্পনা করো। আমি তোমার জন্য নতুন নাতিন জামাইয়ের ব্যবস্থা করছি।”
কথাটা বলে লাফঝাপ দিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে জাইমা। রাহেলা খান জাইমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইশরাক বাসায় আসতে না আসতে দুইবছরের একটা ছোট্ট মেয়ে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে। গালে চুমু দিয়ে মেয়েটা বলে, “পাপা এসে পুরেছে।”
ইশরাক ইরাকে কোলে তুলে হাটা ধরে। সামনের সোফায় গিয়ে ইরাকে নিয়ে বসে। তখন সেখানে উপস্থিত হয় ইরার দাদী রাজিয়া আহমেদ। ইশরাক তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “ইরার আম্মুকে ডাকো মেয়ে নিতে। আমি ফ্রেশ হতে যাব।”
রাজিয়া আহমেদ হাত বাড়িয়ে দিলে ইরা যায়না তার কাছে। উল্টো ইশরাকের গলা পুনরায় জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি পাপার সাতে তাকবু।কুতাও যাবুনা।”
ইশরাক ইরার দুগালে আলতো করে হাত চেপে ধরে। গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে, “ইরা মামনী ভালো। তোমার মাম্মিকে ডেকে এনে তার কাছে যাও। পাপা রুমে যাব।”
ইরা ইশরাকের কোল থেকে নেমে যায়। ছোট ছোট পাশে হেঁটে দাদীর কাছে যায়। ইশরাক উঠে দাঁড়ায়।সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিজের কক্ষে যায়। রুমে এসেই দরজাটা লক করে ব্যালকনির সামনে রাখা সোফায় বোসে সে। কাচের দরজা খোলা। পর্দাগুলো বাতাসে উথালপাতাল ভাবে উড়ছে। রুমের এসি অফ থাকায় দরজা,জানালা খুলা। ইশরাক লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

ব্যালকনিতে বসে জাইমা কল দিয়েছে তার পুরোনো বান্ধুবী আলিশাকে। কল রিসিভ হতে টুকটাক খোঁজ খবর নিয়ে জাইমা শুধায়, “শোন আলু, প্রেম করে বিয়ে করব। এখন কীভাবে সহজে ছেলেমানুষ ইমপ্রেস করা যায়?”
“ইউটিউব দেখ। ভালো,ভালো টিকস পাবি।”
“সব ঘাটা শেষ। কিন্তু আমি ভাবছি এরকম প্রেম করব যে দুদিনে সে দিওয়ানা হয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য চলে আসে। মানে খুব তাড়াতাড়ি পড়াশোনার বোঝা ঘাড় থেকে নামবে। তুই বল, ছোট্ট একটা জীবন এই য ভার্সিটির প্যারা,এসাইনমেন্ট, আবার প্রেজেন্টেশন! আমি ইংলিশ পারিনা সেখানে প্রেজেন্টেশন কীভাবে দেব?”

“বড় ঝামেলা তো! তুই একটা কাজ কর।”
“কী কাজ?”
“যেদিন প্রেজেন্টেশন থাকবে সেদিন অজ্ঞান হওয়ায়র নাটক করবি।”
“পরে তো দিতে হবে।”
“পরেরটা পরে।”
“এই সপ্তাহ গেলেই শুনব আমার প্রেজেন্টেশন আছে। কী ঝামেলা!”
“আরেহ তোর যেই বুদ্ধি ডানেবামে কাটিয়ে দিবি।”
“আর এসাইনমেন্ট অল্প সময়ে কে করে দিবে?”
“রিলেক্স! তুই ব্রিলিয়ান্ট কাউকে ইমপ্রেস কর। তাকে দিয়ে এসাইনমেন্ট লিখিয়ে নিবি।”
“ইমপ্রেস করার জন্যও তো ছেলে চাই সাথে চাই সময়। একদিনে তো আর কেউ ইমপ্রেস হয়ে যাবেনা।”
“তাহলে ছেলে খোঁজ।”
“তুই একটা ছেলে দে।”
“সর শালী! আমি কী ছেলের ব্যবসা করি নাকী?”
“কোন কাজের না তোরা।”

জাইমা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আলিশার সাথে টুকটাক কথা বলে কল কেটে দেয়। ব্যালকনি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দোয়া করে, “হে মাবুদ, ভার্সিটির এসাইনমেন্ট আর প্রেজেন্টেশন থেকে মুক্তি দাও। মুক্তি হিসাবে বরের মুখ দেখাও।”
চিন্তিত জাইমা কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। রুম জুড়ে পায়চারি করতে,করতে দু’টো আইডিয়া বের করে। একটা এসাইনমেন্টের জন্য আরেকটা প্রেজেন্টেশন ফাঁকি দেওয়ার জন্য। কিন্তু এসব করে পয়দা কী? সে তো নাম্বার কেটে দিবে! তার সিজিপি খারাপ আসবে। তখন তার আম্মু তাকে বকা দিবে। বাবাও বকা দিবে। জাইমা বিরক্ত হয় পড়াশোনা নিয়ে। কেন যে এই উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করতে গেলাম। পড়াশোনা ছাড়া কথা নেই।

এর মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। জাইমা ভার্সিটি গেলেও পড়াশোনায় তার সিরিয়াসনেস আসেনি। একটা না একটা দুষ্টমিতে মেতে থাকে সে। বাকী ক্লাসগুলোতে ভদ্র থাকলেও ইশরাকের ক্লাসে সে চাইলেও নিজের ভদ্রতা বজায় রাখতে পারেনা। একটা না একটা অঘটন ঘটায়। সেদিন সামনে বসা মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি করতে গিয়ে একপ্রকার মারামারি লেগে গেছে সে। সেই মারামারির ইশরাক এসে থামিয়েছে। জাইমা অল্পতে বিরক্ত হয়ে গেছে ভার্সিটির প্রতি। মেয়েদের সাথে ভাব ভালো জমালেও সে তার আগের ফ্রেন্ড সার্কের মিস করছে। হারে,হারে টের পাচ্ছে একবছর ড্রপ দেওয়ার বেদনা। ফ্রেন্ড সার্কেল হারিয়েছে, পড়াশোনায় সিরিয়াস হতে পারছেনা। তারউপর ইশরাকের সাথে দেখা! দুইদিন পরপর তাকে দাঁড় করিয়ে একটা না একটা কুয়েশ্চন করে। যার উত্তরে জাইমা হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে পারেনা।
সব চিন্তা ভাবনা মাথা জ্যাম হয়ে থাকলেও সবসময় নিজেকে চিল মুড রাখতে চায় জাইমা।
এই তো ক্লাসে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। ইশরাক ক্লাসে প্রবেশ করতে
জাইমা ফোন ছেড়ে সিরিয়াস হয়ে বসে।

ইশরাক, জাইমার সামনে এসে দাঁড়ায়। দু-হাত প্যান্টের পকেটে গোঁজা। জাইমা ইশরাককে দাঁড়াতে দেখে, আলিফ-বা-তা-ছা যা আছে, এই মূহুর্তে মনে পড়ছে সব পড়ছে। না জানি, দাঁড় করিয়ে কী অপমান করে। ইংলিশে একটা প্রশ্ন করলেই তো সে হা করে থাকবে। যেই ইংলিশের ভয়ে সে প্রেজেন্টেশনের দিন কীভাবে পালিয়ে থাকা যাবে সে চিন্তা করছে। ইশরাক নিরব চাহনিতে জাইমাকে পরখ করে। কন্ঠস্বরে গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলে, “মিস মৈশানী খানম, স্ট্যান্ড আপ।”
জাইমা দাঁড়ায়। ইশরাক স্বাভাবিক কন্ঠে আওড়ায়, “আপনি বলুন, একজন মানুষের মৌলিক চাহিদা কয়টি?”
এতো সহজ প্রশ্ন শোনে জাইমা খুশি হয়ে যায়। এতোদিন একটা প্রশ্নের ও জবাব দিতে পারেনি। আজকে এই সহজ প্রশ্নের জবাব দিয়ে ইশরাককে বুঝাবে, সে ছোট বেলায় পড়াশোনায় ভালো ছিলো। এখন ন। জাইমা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে জবাব দেয়,

“একজন মানুষের মৌলিক চাহিদা ছয়টি।”
জাইমার উত্তর শোনে ইশরাক ভ্রুদয় সংকুচিত করে ফেলে। বাকীরাও হা হয়ে তাকিয়ে আছে। জাইমা সবার দিকে তাকিয়ে, ভাব নেয়। অসাধারণ প্রতিভার একটি উত্তর দিয়েছে সে। ইশরাক হতাশ হয়ে বলে, “তাহলে বলুন ছয়টি মৌলিক অধিকার কী কী?”
জাইমা হেঁসে বলে, “খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অংক,ইংরেজী জানা একজন শিক্ষিত স্বামী।”
“আপনি এসব মৌলিক চাহিদা কোথা থেকে শিখেছেন?”
“ফেসবুক থেকে। ফেসবুকের পোস্টে দেখেছি মানুষের মৌলিক চাহিদা ছয়টি।”
ইশরাক এবার কী বলবে খুঁজে পেলো না। জাইমা উত্তর দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে হাসে। কেউ,কেউ মুখ টিপে হাসছে। ইশরাক জাইমার আনন্দ মিশ্রিত মুখটা পরখ করে বলে, “ছোট বেলায় আপনার কোন ড্রিম ছিলো?”
ইশরাকের প্রশ্ন শোনে জাইমা চটজলদি বলে, “অবশ্যই ছিলো। অনেক বড় স্বপ্ন ছিলো, এই স্বপ্ন এখনো দেখি আমি।”

“কী সেটা? আমরা জানতে পারি?”
“ইয়েস স্যার। কেন নয়?”
“বেশ! তাহলে বলুন আপনার ড্রিম?”
“বিয়ে করা। ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, বিয়ে করব। বউ সাজব। সবাইকে বলব, দেখ আমার সুন্দর বর।তোদের আছে?”
জাইমার কথায় বেশিরভাগ স্টুডেন্ট হাসলেও ইশরাক মুখশ্রী রঙ পরিবর্তন করেনা। সে জাইমার কনফিডেন্স লেভেল দেখছে। জাইমা ইশরাকের দিকে তাকাতে, ইশরাক বলে, “আপনি বসতে পারেন।”
জাইমা বসে। ইশরাক নিজের আসনের দিকে আসে। সবার দিকে একনজর তাকিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেয়।

“বেশ! তাহলে বলুন আপনার ড্রিম?”
“বিয়ে করা। ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, বিয়ে করব। বউ সাজব। সবাইকে বলব, দেখ আমার সুন্দর বর।তোদের আছে?”
জাইমার কথায় বেশিরভাগ স্টুডেন্ট হাসলেও ইশরাক মুখশ্রী রঙ পরিবর্তন করেনা। সে জাইমার কনফিডেন্স লেভেল দেখছে। জাইমা ইশরাকের দিকে তাকাতে, ইশরাক বলে, “আপনি বসতে পারেন।”
জাইমা বসে। ইশরাক নিজের আসনের দিকে আসে। সবার দিকে একনজর তাকিয়ে পড়ায় মনোযোগ দেয়। একটা টপিকের উপর এসাইনমেন্ট করার জন্য নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে দেয় ইশরাক। এই তারিখের মধ্যে সবার এসাইনমেন্ট জমা হওয়ায় চাই। একমিমিটও নড়চড় যাতে না হয়। নাহলে সে নাম্বার দিবেনা।
এসাইনমেন্টের কথা শোনো জাইমার জ্বর চলে এসেছে। বসে,বসে কে লিখবে এসব এসাইনমেন্ট? মাত্র দুদিন সময়। এই দুদিন তো জাইমা চোখ বন্ধ করে,চোখ মেলতে,মেলতে চলে যাবে।
ইশরাক যেতে জাইমা তার পাশে বসে থাকা মেয়ে, তার নাম মেহের। মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এই এখানে কেউ এসাইনমেন্ট লিখে দেয়?”

জাইমার কথায় মেহের জবাব দেয়, “হ্যাঁ দেয়তো। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডকে আর বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডকে।”
“ধুরু! আমার এসব বড়লোকি সম্পর্ক নেই। এসব ছাড়াও কেউ লিখে দেয়না?”
“জানা নেই। নিজের গুলো নিজে লেখা ভালো।”
“আবার প্রেজেন্টেশন কবে দিতে হবে?”
“চলে আসবেশ শীঘ্রই। এখনি প্রিপারেশন নেও। আবার মিড টার্মও আসবে কয়দিন পর।”
জাইমা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। এরপর বলে,
” ‘পরীক্ষা’ হলো মানবসৃষ্ট একটা দুর্যোগ। আমি এই দুর্যোগে অংশগ্রহণ করতে চাইনা। আমি আমার শামীর বুকে থাকতে চাই।”

“বাসা গিয়ে বলো?”
জাইমা নড়েচড়ে বসে। হাত নাড়িয়ে বলে, “পাক্কা তিনশ পয়ষট্টি দিন বলেছি। শুনেনি কেউ সেজন্য আবার ভার্সিটি আসতে হলো।”
“আহারে! এতো ধৈর্য তোমার?”
“বিয়ে বলে কথা। শোনো, কিছু পেতে হলে তো ধৈর্য ধরতে হয়। আমিও ধরেছি, কিন্তু মনে হচ্ছে আরো ধৈর্য ধরতে হবে। সবকথার শেষ কথা আমি বিয়ে করব। তুমিই বলো, বিয়ে করলে এতো প্যারা থাকত? ফিউচার প্ল্যানিং,পড়াশোনা,এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, এক্সাম,ঝামেলা সবই তো একবিয়েতে মিটমাট হয়ে যেতো।”
জাইমার লম্বা কথায় মেহের মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শোনে। জাইমা প্রচুর বকবক করা মেয়েমানুষ সেটা মেহের খুব ভালো করে বুঝেছে। জাইমা মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে। এই এসাইনমেন্ট সে কবে কভার করবে? এসবের জন্য চাই দুইমাস। কিন্তু ইশরাক দিয়েছে মাত্র দুদিন সময়। কী ঝামেলা,কী ঝামেলা!
সেদিন ক্লাস শেষে তাসকিন এবং মেহেরের সাথে বেরোয় জাইমা। দু’জনের কাছেই ইশরাক নিয়ে একগাদা নালিশ করেছে। ইশরাকের মতো ‘গোলামেরপুত’ সে তার জীবনে একটাও দেখেনি। এখন তো বুলি হয়ে গেছে। ইশরাক,মর্ম,কর্ম কেউ না। সোজা গোলামেরপুত।

দুটো দিন কেটে নবদিনের সূচনায় জাইমা নামাজ পড়ে দাদীর রুমে যায়। রাহেলা খান জায়নামাজে বোসো তখনো তসবিহ পড়ছিল। জাইমাকে দেখে হাতের ইশারা করেন। জাইমা গিয়ে রাহেলা খানের সামনে বসে। দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে, “রাহেলাবানু আমার জন্য দোয়া দাও। তাড়াতাড়ি যাতে বরের সেবা করতে পারি।”
রাহেলা খান দোয়া পড়ে জাইমাকে ফুঁ দেন। খারাপ নজর,বালামুসিবত থেকে যাতে রক্ষা পায় সেজন্য দোয়া করেন। জাইমা দাদীর সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প গুঁজব করে। দাদী তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। জাইমার আম্মু একজন টিচার, বাবা বিজনেস করে। ভাই এবার মাধ্যমিক দিবে সেজন্য হোস্টেলে আছে। বাড়িতে জাইমা,রাহেলা খান এবং জাইমার বাবা-মা থাকেন। যদিও বাবা-মা সারাদিন বাইরে,বাইরে থাকে। সন্ধ্যায় শুধু সবাই বাসায় থাকে। কাজের বুয়া এসে রান্নাবান্না করে। বিল্ডিং গুছিয়ে রাখে। সে এখানেই থাকে জাইমাদের সাথে।

বিশাল বড় বাড়িটা সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। জাইমা তার বাবা-মাকে তেমন পায়না। তার যত দুষ্টুমি দাদীকে ঘিরে।
দাদীর গলা জড়িয়ে ধরে লিভিং রুমে আসে জাইমা। চেয়ার টেনে বসতে গরম ধোঁয়া উঠা কফি রাখে হেল্পিংহ্যান্ড রুপা। জাইমা রুপার দিকে তাকিয়ে বলে, “রুপা আন্টি, সন্ধ্যায় বেরুবে আমার সাথে?”
“স্যার জানলে বকবে মা। রাত বিরাতে বেরুতে নেই।”
জাইমা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রুপার পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখে। সামনে তাকিয়ে বলে, “বাবা কী বলবে? আমি রাজী করাব। তুমি প্লিজ আমাকে সঙ্গ দিও।”
তখন উপস্থিত হোন সাজ্জাদ খান। সাথে আসেন তার স্ত্রী জামিলা। জাইমা বাবাকে দেখে ভদ্র হয়ে যায়। চেয়ার টেনে বাবার সামনের চেয়ারে বসে। জামিলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ভার্সিটি কেমন কাটছে?”
জাইমা বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে নেয়। মেকি হাসি টেনে বলে, “হুম যাচ্ছে।”

“পড়াশোনায় সিরিয়াস হও। একটা বছর তো ড্রপ দিলে। এখন এসব চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
“পড়ালেখা যে কঠিন। তারচেয়ে কঠিন হলো পরীক্ষা। পরীক্ষার মতো মানব সৃষ্ট দুর্যোগ আর দ্বিতীয়টি নেই।”
জাইমার কথায় তার বাবা সাজ্জাদ খান জামিলার দিকে তাকান। তিনি মেয়ের কথায় কাঠকাঠ গলায় জবাব দেন, “একবছর অনেক ফাঁকি বাজি করেছ। এখন পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। মনে রেখো, তোমার বাবা ভার্সিটি গিয়ে তোমার এক্টিভিটিস সম্পর্কে খোঁজ খবর নিবে।”

“চলছে, তো। ওই টিচার খুব খারাপ। মানুষের জীবন খুব ছোট। স্বল্প সময়। সেজন্য জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত কাজে লাগানো উচিত। হাসিখুশি থাকা উচিত। কিন্তু এই এসাইনমেন্ট, ভার্সিটির ক্লাস করে জীবন বরবাদ করার কোন মানে হয়? একদমই না! কিন্তু কী করার! কপালে তো সুখ নেই যে জীবন উপভোগ করব। তারচেয়ে ঝামেলা আর প্যারা উপভোগ করি।”
জাইমার একনাগাড়ে বলা কথা শেষ হতে সে পানি পান করে। পুনরায় কথা বলতে যাবে জামিলা তাকে থামিয়ে দেয়। চোখ রাঙিয়ে বলে, “অনেক বলেছ এখন নাশতা করে ভার্সিটি যাও।”
জাইমা চুপ। নাশতা খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। জামিলা মেয়ের দিকে একনজর তাকায়। বুঝতে পারছেনা তার মেয়ে কার মতো এতো বাচাল আর চঞ্চল হলো। ভদ্রতার ‘ভ’ তার মাঝে উপস্থিত নেই। একটা মানুষ পড়াশোনা নিয়ে এতো বেশি বিদ্বেষ প্রকাশ করতে পারে? এদিকে তার বাবা-মাকে দেখো। দু’জন নিজেদের কাজ এবং জব নিয়ে ব্যস্ত। একজন মানুষের যতটুকু স্বপ্ন পূরণ প্রয়োজন বা যতটুকু চাহিদা নিজেদের সবটাই পূরণ করেছে।

জাইমা উঠে রুমে আসে। তার এসাইনমেন্ট এখনো বাকী আছে। দুইদিনে কমপ্লিট করতে পারেনি সে। এখন এসব নিয়েই ভার্সিটিতে যেতে হবে। ইশরাকের থেকে দু’টো দিন ভিক্ষা করে নেওয়ার মতো আইডিয়া অবশ্য তার কাছে আছে। এখন কথা হলো ইশরাল যদি রেগে যায়? তাহলে সব মাটি।
সব মনে করে কী হতে দৌড়ে সাজ্জাদ খানের কাছে যায় জাইমা। সাজ্জাদ খান সবে রেডি হয়ে বেরিয়েছেন। মেয়েকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কিছু লাগবে?”
জাইমা ইনিয়েবিনিয়ে বলে, “তোমার কারটা দাও। রিকশায় বসে গরমে মরে যাই।”
সাজ্জাদ খান চিন্তায় পড়ে যান। একবার জাইমা তার কার নিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। এক্সিডেন্ট বলতে কী! বাইরের টঙের দোকান উড়িয়ে দিয়েছে প্রায়। এরপর জরিমানাও দিতে হয়েছে। জামিলার নিষেধাজ্ঞা আছে, জাইমাকে যাতে কার দেওয়ানা হয়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। সাজ্জাদ খানকে ভাবনায় তলানো দেখে জাইমা চট করে বলে, “বিশ্বাস করো, আমি সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাব। দেও না —প্লিজ।”
জাইমার কথায় সাজ্জাদ খান হেঁসে বলেন, “বেশ! তোমার মা যাতে না জানে।”
জাইমা খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে বলে, “জানবেনা।”

সাজ্জাদ খান কারের চাবি জাইমাকে দিয়ে বেরিয়ে যান। জাইমা চাবি পেয়ে খুশিতে রুমে চলে আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রঙঢঙ করে রেডি হয়ে নেয়। যাওয়ার সময় দাদীকে ডেকে বলে, “দরজা লাগিয়ে দিতে।” জাইমা কার নিয়ে বেরোয়। চোখে কালো চশমা। পরণে টুপিস। চুলগুলো হালকা কার্ল করে ছেড়ে রাখা। কাঁধের কিছুটা নিচ অব্দি বড় তার চুল। তাতেও ব্রাউন কালার। বা হাতে ঘড়ি। একবারে সাদাসিধা ভাবে সেজেগুজে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে। খুব মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভিং করছে জাইমা। কারণ এর আগের বার তো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।
তার সব সতর্কতায় পানিতে ডুবে যায় যখন গেটের সামনে এসে কারোর কারের সাথে নিজের কার সংঘর্ষ হয়। জাইমা স্টিয়ারিং ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে, “গোলামেরপুত, বাপের গাড়ির কিছু হলে জরিমানা তুই দিবি;আমি না।”

ইশরাকের গাড়ির মিরর ভে’ঙে গেছে। সাথে পাশটায়ও লেগেছে। সেজন্য সে গাড়ি পেছনে নেয়। মূহুর্তে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। সাথের গাড়ির ড্রাইভার তো একনাম্বারের অন্ধ! নাহলে এভাবে কেউ ঝড়ের গতিতে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে? ইশরাক নিজের শখের গাড়ির কথা ভেবে গাড়িতে থাকা স্টিক হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। তার হাঁটার মধ্যে তাড়াহুড়ো এবং রাগের একটা ভাব ছিলো। এমনিতে রেগে চোখমুখের অবস্থা লাল করে নিয়েছে। এসে ভেতরের কাউকে দেখেনি। সোজা গাড়ের সামনের কাঁচে কয়টা বারি দিতে তাতে ফাটল ধরে যায়। জাইমা হা করে তাকিয়ে থেকে চশমা মাথায় তুলে রাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে। ইশরাককে দেখে রাগ লুকিয়ে নেয়। গাড়ির দিকে তাকিয়ে ইশরাকের দিকে তাকায়। ইশরাক জাইমাকে দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। অতিরিক্ত রুক্ষ কন্ঠে বলে, “এগুলো কেমন ধরনের ড্রাইভিং? আমার গাড়ির কী অবস্থা করেছেন দেখুন। ড্রাইভিং না শিখে গাড়ি নিয়ে বেরুতে কে বলেছে? নাকী দেখাচ্ছেন আপনার গাড়ি আছে। কোনটা?”

“এক্সিডেন্টলি হয়েছে। তাই বলে আপনি আমার গাড়ির কাঁচ ভেঙে দিবেন?”
“ভেঙেছি তো?”
“এখন জরিমানা দিবেন। নাহলে থানায় মামলা করব।”
জাইমার কথায় ইশরাক রাগবে না হাসবে ভেবে পায়নি। তবে কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়, “করুন মামলা। কোন জরিমানা দেওয়া হবেনা।”
“এতো টাকাপয়সা থেকেও জরিমানা দিতে চাচ্ছেন না। টু মাচ ছোটলোক।”
ইশরাক রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। জাইমা গাড়িতে গিয়ে বসে। মাথার উপর তুলে রাখা চশমা চোখে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ইশরাক জাইমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও গাড়ি নিয়ে ভেতরে যায়।

জাইমা গাড়ি পার্ক করে হেঁটে এগোয়। হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই আপাতত। গাড়ি তো শ্যাষ করে দিয়েছে! এখন এই অবস্থায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এতোবড় গ্লাস লাগাতে কমপক্ষে দশ হাজার টাকা তো চাই। ভালোটা লাগাতে গেলে ত্রিশ হাজার প্লাস। এতো টাকার বাড়ি কই? এখন কী নিজের গহনা বিক্রি করে গাড়ির গ্লাস লাগাতে হবে? এছাড়া আরকী? মনে,মনে ইশরাককে হাজারটা অভিশাপ দিয়ে এগুতে মনে পড়ে সে ব্যাগ গাড়িতে রেখে চলে এসেছে। আবারো ছুটে যায় সেখানে। পার্কিং এড়িয়ায় আসতে দেখে ইশরাককেও বেরুচ্ছে। জাইমা নিজের গাড়ির সামনে আসে। দরজার লক খুলে ভেতর থেকে ব্যাগ বের করে। পাশেই ইশরাকের গাড়ি। দেখেই জাইমা কয়টা লাথি মারে গাড়িটায়।আশেপাশে তাকিয়ে,কেউ দেখার আগে কেটে পড়ে সেখান থেকে।

ইশরাকের মন মেজাজ ভালো না। রুক্ষ মেজাজ নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ শান্তশিষ্ট ব্যবহারে নিজের রাগ দমিয়ে রাখলেও জাইমার হাসিমাখা মুখ দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়। তার শখের গাড়ির বারোটা বাজিয়ে বেয়াদব মেয়ে কী সুন্দর ভাবে আনন্দ করছে। এসাইনমেন্ট না জমা দিকে মার্ক কাট! সে খবর কী আছে জাইমার? ভেবে ইশরাক ভেতরে,ভেতরে হাসে। কিছুক্ষণ পর সবাইকে বলে এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য। তারা নতুন টপিক নিয়ে আলোচনায় যাবে। এরপর প্রেজেন্টেশন সিডিউল দেওয়া হবে।

সবাই এসাইনমেন্ট জমা দেয়। জাইমা সবাইকে জমা দিতে দেখে বিরক্ত হয়। সে তো ভেবেছিল তার মতো কয়েজন থাকবে যারা এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করেনি। কিন্তু এরকম কাউকে সে পেলো না। জাইমাকে জমা দিতে না দেখে ইশরাক খুশি হয়। সবাই যখন নিজ স্থানে বসে ইশরাক জাইমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। চোখ দিয়ে ইশারা করে জাইমাকে দাঁড়ানোর জন্য। জাইমা আলাভোলার মতো দাঁড়ায়। ইশরাক জিজ্ঞেস করে, “আপনার এসাইনমেন্ট কোথায়?”
জাইমা মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে। ইশরাকের দিকে তাকিয়ে বলে, “না হওয়া শামীর কথা স্মরণ করে বলছি, আমার দাদী মা-রা গেছে স্যার। সেজন্য এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে পারিনি।”

প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১

জাইমার কথায় ইশরাক কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। চাইলেও এই মূহুর্তে কঠোর হতে পারছেনা সে। জাইমার ইনোসেন্ট ফেস দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়েটা সত্যি বলছে। ইশরাক পুনরায় বলে, “কবে মারা গেছে?”
জাইমা চটজলদি বলে, “গতকাল রাতে।”

প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৪