মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৭

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৭
মির্জা সূচনা

রাত ৯টা।
সবাই বসার ঘরে একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ ফিরোজ মির্জা বললেন,
—আমি ভাবছি আবার মেহেরের বিয়ে দেবো।
এই নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়।
ফিরোজ মির্জা রাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তা রাজ, তুমি কি বলো?
রাজ মাথা নেড়ে বলল,
—আমি সম্মত, বাবা।
মেহেরের বড় ভাই আর দুলাভাই হিসেবে আমার মত হলো, মেহেরের আবার ধুমধাম করে বিয়ে হোক।
মালিহা মির্জা বললেন,

—তা না হয় হলো! কিন্তু রিদের ব্যাপারটা?
রাজ মুচকি হেসে বলল,
—মা, আপনি চিন্তা করবেন না। রিদের ব্যাপারটা আমি বুঝে নেবো।
মাহির বলে উঠল,
—সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাহলে ছোট প্যাকেট কেন বাড়িতে থাকবে? তাকেও বিদায় করো, বাবা!
এই কথা শুনে ফিরোজ মির্জা লাবিবের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন।
মালিহা মির্জা কড়া গলায় বললেন,
—চুপ কর, বেয়াদব!
এই সময় মেহবুবা সবার জন্য চা নিয়ে আসছিল। কথাগুলো শুনে সে লজ্জার সাথে সাথে রেগেও যায়।
চা রেখে মাহির চুল টেনে বলে,
—বেয়াদব! আমি কি তোর ভাগের খাবার খাই যে তুই আমায় বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছিস?
মেহরিন বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—তোরা ঝগড়া বন্ধ কর!
মেহবুবা চুপ করে গেলেও মাহির দিকে রেগে তাকায়।
মাহির চুল ঠিক করে মেহবুবাকে জিব দেখাই।
লাবিব সেটা দেখে হেসে ফেলে।
সে মেহবুবার পাশে গিয়ে বলে,
—শালাবাবু, আমার কষ্ট বোঝে, কিন্তু বউটা বোঝে না!
তার পর গুন গুন করে গায়,
বোঝেনা বোঝেনা বউ
আমার বোঝেনা বোঝেনা রে
বোঝেনা বোঝেনা বোঝেনা
বোঝেনা আমারে…
মেহবুবা মুখ ঝামটা দিয়ে লাবিবকে সরিয়ে দেয়।
এদিকে মেহের নেই, সে তার রুমে। আজ যা কাণ্ড ঘটেছে তাই লজ্জায় কারো সামনে আসছে না।
রাজ হেসে বলল,

—বাবা, বিয়েটা তাড়াতাড়ি হলে ভালো হয়। সামনে শুক্রবারটাই বরাদ্দ করি, কেমন?
ফিরোজ মির্জা হেসে বললেন,
—তুমি যা ভালো বোঝো।
মেহরিন হঠাৎ বলে উঠল,
—বাবা,তোমার কাছে একটা প্রস্তাব রাখতে চাই।
আমি তোমার মেয়ে হিসেবে নয়, লাবিবের ভাবি হিসেবে প্রস্তাবটা রাখতে চাই…
সবাই তাকিয় মেহরিনের দিকে।
রাজ হেসে ফেলে, কারণ সে বুঝে গেছে মেহরিন কি বলতে যাচ্ছে।
ফিরোজ মির্জা আয়েশ করে বসে বলেন,
—অবশ্যই বলুন, মেহরিন শিকদার।
মেহরিন হাসে বাবার ঠাট্টামাখা গাম্ভীর্য দেখে।
সে বাবার সামনে গিয়ে বসে, চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
—আমি আমার এক মাত্র দেবর লাবিব চৌধুরীর জন্য আপনার ছোট কন্যা মেহবুবা মির্জাকে চাই।
এই কথা শুনে মেহবুবা লজ্জায় পড়ে যায়, ছুটে নিজের রুমে চলে যায়।
সেটা দেখে সবাই হাসে।
এদিকে লাবিব বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। মন চাইছে “ভাবি”কে একটা কিস করে বলে,

—তুমি আমার ভাবি না, তুমি আমার মা!
কিন্তু নিজের খুশি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছে না।
ওর সামনে ওর নিজের বিয়ের কথা হচ্ছে— এখানে থাকা টা ভালো দেখাই না।
তাই সে ঘুরে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে যায়।
সেটা দেখে সবাই আরেক দফা হেসে ওঠে।
মেহরিন হাসিমুখে বলে,
—বলুন, ফিরোজ মির্জা! আপনি কি রাজি আমার প্রস্তাবে?
ফিরোজ মির্জা হেসে বলেন,
—ছেলে ভালো, আমার কোনো আপত্তি নেই।
মেহেরের বিয়ের পর এ বিষয় নিয়ে একটা বৈঠক হবে।
সবাই হাসে।
মাহির বলে,

—ফাইলানি! সব বড় প্যাকেট, মেজো প্যাকেট আর ছোট প্যাকেট বিদায় হবে!
রাজ মাহির কাঁধে হাত রেখে বলে,
—সময় হলে তোমার জন্যও কারো বাড়ির কোনো না কোনো প্যাকেট নিয়ে আসবো।
মাহির বলে,
—যা! এভাবে কেউ বললে আমার লজ্জা করে না বুঝি।
মাহির কথায় সবাই হাসে।
রাজ বলে,
—বাবা, আমি ডেকোরেশন আর খাবারের দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনি বিয়ের কার্ড আর আত্মীয়-স্বজনের ব্যবস্থা দেখবেন।
ফিরোজ মির্জা মাথা নেড়ে সম্মতি দেন।
এদিকে নিচে বিয়ের প্ল্যান চলছে, আর উপরতলায় মেহবুবা আর লাবিব—দুজনেই খুশিতে আত্মহারা, যদিও খোলাখুলি প্রকাশ করছে না।
লাবিব প্রকাশ করে ফেললেও, মেহবুবা কোনোদিনই প্রকাশ করেনি তার ভালোবাসা।
তবে সে প্রথম দিন থেকেই লাবিবকে দেখেই উল্টে পাল্টে প্রেমে পড়েছিল মেহবুবা।
আজ সেই মানুষটাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চলেছে।
এই আনন্দটা কেমন, যারা পায়, তারাই জানে।
এদিকে লাবিব দরজা লাগিয়ে বলে,

—ইস ভাবি! তোমাকে যে কী বলবো!
আই লাভ ইউ ভাবি।
তোমার মতো ভাবি যেনো ঘরে ঘরে হয়!
এটা বলে নাচা শুরু করে।
আর মেহবুবাও খুশিতে নাচতে শুরু করে।
হঠাৎ মেহরিন আসে মেহবুবার রুমে। দরজা খুলেই দেখে—মেহবুবা নাচছে!
ওদিকে রাজ যায় লাবিবের রুমে। গিয়েই দেখে, লাবিব ওখানে একা একা নাচছে।
রাজ ঢুকে বলে,
—কি রে? বিয়ের কথা উঠতেই এমন নাচানাচি শুরু?
লাবিব দাঁত বের করে বলে,

—আররে ভাই! তুমি বুঝতে পারছো না! ফাইনালি ল্যাদা বাচ্চা আমার বউ হবে!
এটা বলেই রাজকে টেনে আনে। আর দুই ভাই সেই নাচে সামিল হয়। রাজও ভাইয়ের খুশিতে সঙ্গ দেয়।
কিছুক্ষণ নাচানাচির পর রাজ হাসতে হাসতে বলে,
—ভাই, এত নাচিস না! তোর ভাবিকে তো দেখিস কেমন কেলানি দিয়ে ছিলো বিয়ের দিন আমাকে। আর আজ মেহেরকে দেখেছিস? রিদকে কী কেলানি কেলালো!
—ওদের দু’জনই বোন কিন্তু ও…
জাস্ট… ইমাজিন কর যদি সত্যি মেহবুনা এমন হয়?
তখন লাবিবের মুখের হাসি উবে যায়। সে সত্যি সত্যিই ইমাজিন করে—
একটা সুন্দর করে সাজানো রুম। ফুল দিয়ে সাজানো একটা খাট তার উপর গুমটা দিয়ে বসে আছে মেহবুবা।
লাবিব ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। গিয়ে গুমটা সরিয়ে দেখতেই…
“নাক বোরাবড় এক ঘুষি” মেরে মেহবুবা বলে,

—এই বঁদর! এত দেরি করলি কেন? জানিস, কতক্ষণ ধরে বসে আছি! গরম লাগছে! এখন আয় বাতাস কর।
লাবিব বলে,
—আমি তোমাকে বাতাস করবো?
এটা শুনেই মেহবুবা রেগে যায়।
—বাতাস করবি না তুই! করবি না বাতাস?
লাবিব দ্রুত উপর নিচ মাথা নাড়ে, মানে করবে।
টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে মেহবুবা ছুঁড়ে মারে লাবিবের দিকে!
লাবিব এক চিৎকারে—
—নাআআআআআআ!
রাজ বলে,

—কি হইছে? এমন চিল্লাসিস কেন?
লাবিব গম্ভীর মুখে বলে,
—ভাই, আমি বিয়ে করবো না!
রাজ হাসতে হাসতে বলে,
—কেন? ইমাজিন করেই বিয়ের শখ মিটে গেল?
লাবিব ঢোক গিলে বলে,
—ভাই, মেহবুবা যদি ভাবি বা মেহের আপুর মতো হয়… আমি একদম ইল্লা-নিল্লা!
রাজ পিঠচাপড়ে লাবিবকে বলে,
—না রে! মেহবুবা অমন না। ও শান্ত!
লাবিব ভ্রু কুঁচকে বলে,
—শান্ত?! আরে মানে… কুছ ভি?
রাজ হেসে বলে,

—শোন! ওসব বাদ দে। মেহেরের বিয়ের কাজ নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছি। এখন বাড়ির জামাই তো আমি একা না—তুইও হবি জামাই। তাই আমি আমার কাজগুলো তোকে দিয়ে দিলাম, যা কাজ কর!
লাবিব বলে,
—আরে বস্‌! নিজে শ্বশুরের সামনে ভালো সাজে কাজ নিলে, আর এখন আমার উপর এখন সেই ভার দিচ্ছো? তুমি গুরু সেই জিনিস!
রাজ হাসে,
—যা বললাম তা কর! না করলে আমার শালী তোকে দেবো না!
লাবিব মাথা চুলকে বলে,
—ল্যাদা বাচ্চারে… তোকে পাওয়ার জন্য কতো কি যে সইতে হবে, আর আল্লাহ মালুম!
ওদিকে মেহবুবা, মেহরিনকে দেখেই থেমে যায়। দাঁত বের করে বলে,
—না মানে… গানটা ভালো লাগে তো, তাই…
মেহরিন হেসে বলে,

—তো চল, আমিও একটু নাচি!
এটা বলেই মেহরিন একটা গান ধরে আর নাচে।
লো চালি মে…
আপনি দেবর কী বারাত লেকে…
লো চালি মে…
মেহরিনের নাচ শেষ হতেই, মেহবুবা মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—মেহু, জানিস… আমি অনেক খুশি!
মেহরিন বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—আমি জানি। তুই যে প্রথম থেকেই লাবিবকে পছন্দ করিস, তা আমি জানি!
মেহবুবা হেসে ফেলে।
মেহরিন বলে,
—লাবিব ছেলে ভালো। সুখী হবি!
মেহবুবা লজ্জায় মুখ লুকায়।
তা দেখে মেহরিন বলে,

—লজ্জা পাচ্ছিস না লজ্জা পেলে চলবে না বুঝলি! জামাইকে কীভাবে টাইট দিতি হয়, তা জানবি না?
মেহবুবা হেসে বলে,
—তা আর বলবতে! তুই আর মেহের আছিস ঠিক, শিখে নেব!
মেহরিন হেসে ওঠে।
হঠাৎ মেহবুবা উঠে দাঁড়িয়ে ফোনে একটা হিন্দি গান ছেড়ে, মেহরিনকে টেনে তোলে, আর নাচ শুরু করে।
মেহরিনও তালে তালে সঙ্গে নাচে।
ঠিক তখনই মেহের এসে ওদের এভাবে নাচতে দেখে,
আর ওও যোগ দেয়!
তিন বোন মিলে জম্পেশ একটা নাচ দেয়!
নাচ শেষে তিন বোন বিছানায় শুয়ে হাপাতে থাকে, আর একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে…
বিছানায় শুয়ে হাপাতে হাপাতে হাসছিল তিন বোন—মেহরিন, মেহর, আর মেহবুবা। একে অপরের দিকে তাকিয়ে তাদের মুখে শুধুই প্রশান্তির হাসি।

মেহরিন ধীরে বলল, আমি আজ অনেক খুশি… আমরা তিন বোনই পছন্দের মানুষটাকে পেয়ে গেছি। জীবনটা যেন রূপকথার মতো লাগছে এখন—যেখানে শুধুই সুখ আর সুখ… দুঃখের কোনো ঠিকানা নেই।
মেহর মাথা নেড়ে বলল, ঠিক বলেছিস। সব কিছু এত সহজে হয়ে যাবে—আমি কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। তবে ভাইয়া না থাকলে এসব এত সহজ হতো না।
মেহবুবা একপ্রকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তা যা বলেছিস! আমাদের দুলাভাই নাম্বার ওয়ান! উনি যেভাবে আমাদের বোনের মতো ভালবাসেন—তা কযন পারে।এখন তো মানুষ শালিদের দিকে কু দৃষ্টি দেয়,সেখানে আমাদের ভাইয়া আমাদের নিজের বোনের মতো দেখে ভালোবাসে।

মেহরিন, বরের প্রসংশা শুনে হেসে উঠে বসে বলল, আমি অনেক লাকি জানিস। এমন একজনকে পেয়েছি যে আমার সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করে, আমি কিছু বলার আগেই যেনো আমার মনের কথা জেনে সব হাজির করে দেয়! আমার সপ্ন গুলো নিজের করে নেয় আমার সপ্ন গুলোকে রঙিয়ে তুলে বাস্তবে।এই মানুষ টা আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার প্রতিটি সপ্ন বাস্তবে রুপ নিয়েছে।সপ্ন গুলো হয়ে উঠেছে মেহরিনের সপ্নরঙ।
মেহের আর মেহবুবা মিলে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ও মা গো! টুরু লাভ!
মেহরিন হেসে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দেন!
তিন বোন হেসে ওঠে। এমন সময় লামিয়া এসে দাঁড়ায় দরজায়। ওদের তিনজনকে একসাথে দেখে মজা করে বলে, আমি কি ভুল সময়ে চলে এলাম?

মনে হচ্ছে তিন বোনের স্পেশাল মুহূর্ত চলছে!
মেহরিন হেসে বলে, আরে না, এসো! এসো, লামিয়া!
লামিয়া এসে ওদের আড্ডায় যোগ দেয়। গল্প, হাসি, খুনসুটিতে জমে ওঠে রাত।
কখন যে রাত ১০টা ৪০ মিনিট পেরিয়ে গেছে—টেরই পাওয়া যায়নি।
সবাই খাবারের টেবিলে এসে বসে গেছে। সেখানে রিদও আছে। ফিরোজ মির্জা নিজে ফোন করে রিদকে ডেকেছিলেন, তাই আর না করতে পারেনি রিদ।
সবার মধ্যে কথার ফাঁকে চলছে ছোট ছোট গল্প, আর তিন জোড়া পাখির নিরব প্রেম বিনিময়।
রাজ নিজের পা দিয়ে একটানা মেহরিনকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে, মেহরিন কিছু বলতে পারছে না, আবার সহ্যও করতে পারছে না।

ওদিকে লাবিব মেহবুবার এক হাত চেপে ধরে আছে—কেউ না দেখলেও মাহির আর লামিয়া ঠিকই দেখে ফেলে, আর ওরা হাসে।
আরেকদিকে রিদ খাবারের ফাঁকে ফাঁকে চোখ তুলে চুপিচুপি দেখছে মেহেরকে, আর মেহেরও চোখ নামিয়ে রেখে চুপচাপ সেই নজর অনুভব করছে।
মালিহা মির্জা সবাইকে খাওয়া দাওয়ার খোঁজখবর নিচ্ছেন। ফিরোজ মির্জা মেয়ে জামাইদের সঙ্গে গল্প করছেন, খাওয়াও চলছে জমে।
মাহির, চারপাশে সবার হাসিমুখ আর হালকা রোমান্টিক আবহ দেখে বলে উঠল, Guys! আমার একটা প্রস্তাব আছে… শুধু বাচ্চাদের জন্য! ওখানে মি. মির্জা আর উনার ওয়াইফ এলাউ না!
মাহিলা মির্জা মাহিরের মাথায় এক ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলেন, চুপ! চুপ করে খা! কোনো বদমাইশি না!
রাজ মজার ছলে বলে, মা, ওকে বলতে দিন! বলো, সালাবাবু, কী প্রস্তাব?
মাহির বলল, আমরা আজ সবাই ছাদে আড্ডা দিবো! আর সেখানে অবশ্যই রিদ ভাই থাকবেন!
রিদ বলে, মাহির আমি….

রাজ হাত তুলে রিদ কে থামিয়ে বলে উঠল, একমাত্র সালা বাবু একটা আবদার করলো, তা না রাখলে হয়? বেটা!
তোর কাজকে গুলি মার! আর আজ রাতে তুই থাকবি আমাদের সঙ্গে!
মেহের কিছু না বলে মাথা নিচু করে হাসে।
মেহের, সেই হাসিমুখ দেখে চোখে চোখ রেখে রিদ নিচু গলায় বলে, আচ্ছা…
সেই কথা শুনে মেহের হাসে।
আরও একটা নিঃশব্দ মুহূর্ত জমা পড়ে তাদের জীবনের মিষ্টি গল্পে।

রাত প্রায় ১১টা ৩০। সবাই ছাদে বসে। ছাদে মাদুর বিছানো, আর তার মাঝখানে রাখা হয়েছে আটটা কফির মগ। সবাই গোল হয়ে বসেছে।
লাবিব তাকিয়ে আছে মেহবুবার দিকে। মেহবুবা চোখ রাগাচ্ছে। আর রাজ শুয়ে আছে মেহরিনের কোলে।
রিদ মেহেরের পাশে গিয়ে বসেছে। মেহের লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। আজ যা করল…!
লামিয়া আর মাহির একবার ওদের দিকে তাকায়, তো আবার একে অপরের দিকে।
দুজন রাগে ফেটে পড়ে।

একসাথে চিৎকার করে বলে ওঠে—
এই সমস্যা কী তোমাদের?
হঠাৎ এমন চিৎকারে সবাই চমকে ওঠে।
রিদ একটু দূরে গিয়ে বসে পড়ে।
লাবিব দ্রুত অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
আর রাজ এখনো শুয়ে—একটুও নাড়েনি।
রাজ বলে,

কি ব্যাপার? তোমাদের কী হয়েছে? এমন চিৎকার করছো কেন?
লামিয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে কোমরে হাত দিয়ে বলে,
তোমাদের লজ্জা করে না? আমরা এখানে আড্ডা দিতে এসেছি, আর তোমরা প্রেম নিয়ে ব্যস্ত!
রাজ ভুরু কুঁচকে বলে,
তো কি? এখন তোদের জন্য বিয়ে করে বউয়ের সাথে প্রেমও করতে পারব না? তোরা জ্বালালে কিন্ত আমি বউ নিয়ে এখনই শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করব।
মেহরিন রাজের চুল টেনে হেসে বলে,
চুপ করুন।
রাজ বলে,

কি চুপ করব! একদম ঠিক বলছি! কেউ আমার প্রেম সহ্য করতে পারে না!
বাইরে করলে আমার শত্রুদের জ্বলে, আর বাড়িতে করলে এই ছানাপুঁনা রা জ্বালায়!
এই বলে রিদের দিকে ফিরে বলে,
বুঝলি রিদ! এই জীবনে প্রেম করে শান্তি পেলাম না।
রিদ আগেই হাসছিল। রাজের কথা শুনে হেসে বলে,
তুই তো তাও একরকম সুবিধা পেয়েছিস ভাই!
আমার ভাগ্যে তো তাও জুটলো না!

বউ মেরে ধরে বিয়ে করলো, তাও আমাকে পাঞ্জাবি পরতেও দিল না!
হাফপ্যান্ট পরেই বিয়ে করে নিলো! সেখানে প্রেম তো বিলাসিতা!
মেহের অসহায় চোখে তাকায় রিদের দিকে।
রিদও তখনই তাকায়।
দুজনের চোখাচোখি হতেই রিদ হেসে ফেলে।
আর মেহের মাথা নিচু করে ফেলে।
সবাই হেসে ওঠে।
রাজ বলে,

তা যা বলেছিস! শালিকা যা খেলা দেখালো, I am to Obak..
সবাই হাসে।
মাহির বলে,
আমার বোন গুলা যে এমন গুন্ডি, আমি নিজেই জানতাম না রে ভাই!আমি নিজেই ওদের ইতিহাস জেনে হতাস।
এরা এমন জল্লাদ ভাবা যায়?
তা দুলাভাই গন আমি আপনাদের পছন্দের উপর তীব্র নিন্দা জানাই!
কি খাইয়া এই সব পাগল, ছাগল, গুন্ডি মার্কা মেয়েদের প্রেমে পড়লেন আপনারা?
Better deserve করেন আপনারা!
লাবিব, রাজ আর রিদ—তিনজনেই হেসে ওঠে।
এই কথা শুনে মেহরিন, মেহের আর মেহবুবা একসাথে বলে ওঠে,
মাহির!

সবাই আবার হেসে ওঠে।
ঠিক তখনই লাবিব দুঃখ দুঃখ গলায় বলে,
আর আমি এমন এক ল্যাদা বাচ্চাকে বিয়ে করতে চেয়েছি,
যে আমাকে দেখলেই ছেত করে ওঠে!
আর কিছু বললে তো কথাই নাই—
রীতিমতো তেড়ে আসে!
লিলিপুট হয়েও আমাকে থ্রেট দেয়!
প্রথমদিকে লাবিবের কথা শুনে সবাই হাসলেও
শেষের কথায় মেহবুবা রেগে যায়।
কোমরে হাত দিয়ে তেড়ে আসে লাবিবের দিকে।
আঙুল তুলে বলে,

এই! কি বললেন আপনি? আমি লিলিপুট?
লাবিব বলে,
নিজেই দেখে নাও!
মেহবুবা চোখ রাঙায়।
আসলে মেহবুবার থেকে লাবিব বেশ অনেকটাই লম্বা।
মেহবুবা বলে,
আমি চলে যাব! আর থাকব না!
এই বলে উঠে যেতে নেয়।
লাবিব তাড়াতাড়ি হাত ধরে, কান ধরে বলে,
সরি! আর বলব না!
মেহবুবা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
ডং
ওদের দেখে সবাই বললো,

—ওহ্হহহহহহহ! করে উঠে,
রাজ বললো,
—ভালো ভাই, ভালো! এখন থেকেই মাফ চাওয়া শিখে নে।
মেহরিনের দিকে ফিরে বললো,
—কারণ তুই দোষ না করলেও সরি তোকেই বলতে হবে।
মেহরিন রাগী চোখে রাজকে তাকিয়।
রাজ দাঁত বের করে বলে,
—না মানে..মানে বলছিলাম যে বউয়ের কাছে মাফ চাওয়া ভালো কাজ।
সবাই হেসে উঠলো।
রাজকে ভয় পেয়ে দেখে রিদ ও মেহরের দিকে তাকিয়ে বললো,

—কথা কি, সত্যি নাকি ভাই?
রাজ হেসে বললো,
—যদি হকি স্টিক দিয়ে আর মার খেতে না চাস, তাহলে নিজের দোষ না থাকলে সরি বলতে হবে।
সবাই আবার হেসে উঠলো।
মাহির লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—চলো বোন, আমরা জায়গা ছাড়ি। সময় তো ওদের, আমরা তো কেবল কাবাব মে হাড্ডি।
লামিয়া বললো,
—হে, চল ভাই, যাই গা!
তারপর তারা একসাথে চলে গেল।
ওদের চলে যেতে দেখে সবাই আবার হেসে ওঠে।
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—চলো বাচ্চারা, আমরা সবাই একটু রাতের শহর ঘুরে আসি।
মেহরিন বলে,
—এই রাত হলে আপনারা শুধু ঘুরতে মন করে।
রাজ মেহরিনের কান কাছে এসে বললো,

—কেন আরিওনা? তুমি কি অন্য কিছু চাও? আমার সঙ্গে ঘুরতে না… আার মানে খেলাধুলা করতে চাও? অবশ্য খেলাধুলা করা ভালো শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে?তুমি যদি চাও তাহলে ঘোড়ার প্ল্যান বাদ দেই। আর…..
মেহরিন রাজের বাহুতে একটা থাপ্পর মেরে বলে,
—অসভ্য!
রাজ হাসলো।
রিদ বললো,
—কোথায় যাবি?
রাজ বললো,
—চল দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
লাবিব বলে,
—তাহলে বাইকে যাই।
রাজ মাথা নাড়লো।

ততক্ষণে তিন জোড়া পাখি বের হয়ে এলো—ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে ঘুরতে।
রাজ, মেহরিন, লাবিব, মেহবুবা, রিদ আর মেহের।
মেহবুবা আজ প্রথম বার লাবিবের বাইকে উঠেছে।
মেহেরেরও তাই, ওদের দুই বোনের অনুভূতি একটু অন্যরকম।
রিদ বললো,
—মেডাম, ধরে বসো।
মেহের রিদের কাঁধে হাত রাখে।
রাজ বাইক ছেড়ে দেয় সবার আগে।
রিদ ও ছেড়ে দিলো।
লাবিব তখন থেকে বলছে,
মেহবুবাকে ধরো বসো।
মেহবুবা লজ্জায় পারছে না ধরতে।
কেমন যেনো লাগছে।
লাবিব একটু গম্ভীর হয়ে বললো,

—ধরে বস না, ল্যাদা বাচ্চা পড়ে গেলে তো মরে যাবি! তখন আমার কী হবে?
মেহবুবা মুখ কালো করে বললো,
—এমন করলে আমি যাব না!
লাবিব কপালে থাপ্পর মেরে বললো,
—আমার ভুল হয়েছে, আমার হবু বউ, দয়া করে আমাকে ধরো বসো।
মেহবুবা হাসলো আর ধরে বসে লাবিবকে।
লাবিব হেসে গতি বাড়ালো।
তিনটা বাইক একসাথে চলছে।
রাজ একটা গান ধরলো,
আমি হব রাত আর…
তুই হবি চাঁদ…
জোছনায় ঘর আমাদের….!
রিদ গায়,
তুই হলে রোদ আমি…
রংধনু হই….
ছিল সে শহর আমাদের….!
লাবিব গায়,
ভুলে যেতাম কুলাহল…
ভেবে নিতাম সবই বল….
ছিল রোজের চলাচল..
আমাদের….!
গান গাইতে গাইতে তারা ছুটে চলে—

ভালোবাসার মানুষ নিয়ে রাতের শহর ঘুরতে।তারা ছুটে চলে ভালোবাসার মানুষ নিয়ে স্বপ্ন পাড়ি দিতে।
রিদ তার নীলয়োনী কে নিয়ে শহরের ঘুমন্ত রাস্তায় নেমেছে আজ। তার মন অস্থির, যেনো আজকের রাতটা কিছু অন্যরকম ঘটানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই যে তার নীলয়োনী তার সাথে এটা কি কম পাওয়া।
ভালোবাসা কি শুধু শব্দ? রিদ ভেতরে ভেতরে ভাবছিলো। না, এটা অনুভব, বিশ্বাস আর বেঁচে থাকার এক আলাদা রং।

লাবিব তার ল্যাদা বাচ্চাকে নিয়ে শহরের নিস্তব্ধরাতে বেরোলো প্রথমবার তাও ভালোবাসার অঙ্গীকারে। তার সেই চাওনি, তার মিষ্টি হাসি—তার কথায় কথায় রেগে যাওয়া তেরে আসা এই সবকিছুই যেনো লাবিবের জন্য পৃথিবীর সবকিছু। সে ভাবছিলো, ভালোবাসা ছোট ছোট মুহূর্তে লুকিয়ে থাকে, আর আমি সেসব মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে চাই।
রাজ, তার আরিওনাকে নিয়ে রাতের শহরের ঝলমলে বাতাসে মিশে গেলো। রাজর মনটা ভরে উঠেছিলো—তার ভালোবাসা যেনো এই রাতের হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তার আরিওনাকে ছাড়া, এই শহরটা যেনো শুন্য।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৬

রাতের শহরের আলো গুলো যেনো গোপনে তাদের ভালোবাসার কাহিনী ফিসফিস করছিলো।
তারা সবাই আলাদা আলাদা পথে ভালোবাসার খোঁজে বের হয়েছে, কিন্তু মন একটাই ছিলো—একটা আশার আলোকস্তম্ভ যা কখনো নিভে যাবে না।
“ভালোবাসা,”… এটা খোঁজার নয়, এটা খুঁজে পাওয়ার। আর সবাই আজ রাতে সেই খুঁজে পাওয়া গল্পগুলো শুনছে রাতের শহরকে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪৮