হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক শেষ পর্ব
Tahrim Muntahana
পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া সূর্যটা আজ লাজুক লতার ভূমিকায় উদ্ভাসিত করেছে প্রকৃতি। কমলা রঙের সূর্যটা রক্তিম হয়ে ডুবে যাচ্ছে দিগন্তের অতল গহ্বরে। জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা তিথির আগমন। পাখপাখালির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে, মৃদুমন্দ হাওয়ায় পত্রপল্লব নেচে উঠছে, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুরু হবে বলে। সন্ধ্যা তিথিতে এক যুবক সূর্যাস্ত উপভোগ করছে। শরীর এলানো মাটিতে, এক হাত মাথার নিচে রেখে আরেক হাত দ্বারা আবদ্ধ করে রেখেছে নিয়তির নির্মম পরিহাসের এক খন্ড আকাঙ্ক্ষা কে। আকাঙ্ক্ষা কে পুরোপুরি জব্দ করতে ব্যর্থ যুবক। এক হাত দিয়ে কি আর প্রসস্থ কবর টা কে জড়িয়ে নেওয়া যায়? তবুও খানিক পর পর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে।সূর্য যখন দিগন্তে একেবারে মিইয়ে গেল, আবছা অন্ধকার নেমে এলো ধরণীতে যুবক টি তখন মাথা থেকে হাত সরিয়ে, পুরোপুরি দখল করে নিল কবর টা। সরাসরি কথা বলার ন্যায় স্পষ্ট ভাষায় বললো,
~ প্রেমপিয়াসী মনে আছে? আমরা এভাবেই সপ্তাহের একদিন সূর্যাস্ত দেখতাম। আজও কিন্তু দেখেছি। কিন্তু সূর্যের তেজ নেই কেন? কেমন একটা বিষাদে ঘেরা!
কথার সমাপ্তি হতেই আহিশ দৃষ্টি রাখলো অন্ধকার আকাশে। মাথাটা কবরের উপর এমন ভাবে রাখলো যেন কারো বুকে মাথা রেখে উষ্ণতা খুঁজে চলছে। সাদা পাঞ্জাবি টা রঙ পরিবর্তন করেছ, কাঁচা মাটি লেপ্টে আছে, মুখশ্রীর একভাগে মাটির সামান্য আস্তরণ; হুট করে কেউ দেখলে পাগল বলে হয়তো হাসাহাসি করবে, নাহয় ভয়ে পালিয়ে যাবে। এতে আহিশের কোনো দৃষ্টি নেই, ইহজীবনের জাগতিক সকল কামনা-বাসনা তার ফুরিয়েছে অনেক পূর্বেই। গলায় আদুরে ভাব এনে আহিশ বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
~ আমি বেশী ভার হয়ে গেছি বউ? একটু মানিয়ে নাও প্লিজ। ওইভাবে মন ভরছিল না তো, কি করবো? এখন একটু সুখ লাগছে। কিন্তু শান্তি পাচ্ছি না। আচ্ছা কবর খুঁড়ে তোমাকে নিয়ে আসি? প্রতিটা ক্ষণ তোমাকে বুকের মাঝে আগলে রাখবো। প্রমিজ! এই বউ, কথা বলো! আর কত অভিমান করে থাকবে?
মেয়েটা সত্যিই অভিমান করেছে। কথা বলছে না, একটু শক্ত করে জড়িয়েও ধরছে না। আহিশের এবার খুব কান্না পায়। মেয়েটা তার সাথে শুধু শুধু এমন করে। ছেলেটা কি পাগল হলো নাকি? মৃতের মুখে বুলি থাকে? তবুও বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এইভাবে পারে না আহিশ, চোখ জল উপচে আসে। বুকে হাহাকার বৃদ্ধি পায়। হৃদপিন্ডে ছুরি বসানোর মতো ব্যাথা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আহিশ। রাতের অন্ধকারে কান্নার আওয়াজ কাঁপিয়ে তুললো আকাশ, বাতাস এই বান্দরবানের পাহাড় কে! জাগিয়ে তুললো পাহাড়ের ভাঁজের রহস্য কে। রাস্তার ধারের পেয়ারা গাছটার নিচে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ছলছল দৃষ্টি এসে পড়ছে আহাজারি করা যুবকটার উপর। হাতের ভাঁজে ছোট্ট আরেকটি হাত। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রহস্য ভেদ করে ছোট হাতের মালিক বলে উঠে,
~ আম্মু, আব্বু কাঁদছে কেন?
মনিরা মেয়ের দিকে তাকায় না, চোখের জল লুকাতে চায়। গলায় কথা আটকে আসে। শুকনো ঢোক গিলে জবাব দেয়,
~ তোমার আব্বুর হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন তো, রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। ক্ষত টা এত গভীর, এত তাজা; সইতে পারে না।
মনিরা আর দাঁড়াতে পারে না। বুকের উপর হাজার মণ বোঝা নিয়ে হাঁটতে থাকে। মিহি মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। গড়িয়ে পড়া জলগুলো দেখে তার চোখটাও ছলছল করে উঠে। থামিয়ে দেয় মনিরা কে। হাত টেনে মুখটা নিচু করে, ছোট ছোট হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয়। মনিরা’র চোখ এবার প্রাপ্তি তে ভিজে আসে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেশ। মিহি কাঁপা গলায় মা কে বলে,
~ তুমি কেঁদো না আম্মু, আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তো তোমার কাছেই আছি, তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবো!
মনিরা হেসে মেয়ের গালে চুমু এঁকে দেয়। মেয়ের হাত ধরে আবার হাঁটতে থাকে। মনের মাঝে কিলবিল করে নানান কথা। অস্পষ্ট স্বরে অতি ধীর কন্ঠে বিড়বিড় করে বলে,
~ আমার এই কষ্টের দূর তুমি করতে পারবে না। তা আমৃত্যু বহন করে যেতে হবে। রক্তাক্ত ক্ষতই সাঁতার কাটতে হবে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়বে। দেখবো, তবে এই রক্ত জমে যাওয়ার জন্য যে ভালোবাসা টা দরকার সে ভালোবাসার অন্য একজন ভালোবাসা রয়েছে! ভালোবাসা ভালোবাসা নিয়ে ভালো থাকুক!
অন্ধকারে মিশে যায় দুটি দেহ, হারিয়ে যায় ব্যাথার পাহাড়ে, গন্তব্যে ছুটে চলে অবিচল। তবে এখানে যে পরবর্তী গন্তব্য নেই, ছেলেটার শেষ গন্তব্যই এটা। আহিশ কবর থেকে মুখ উঠিয়ে একপলক পাশের কবর টাই তাকায়। বেইমান মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। মনে মনে বেইমান শব্দ টা ব্যবহার করলেও আহিশ কেন জানি মেয়েটা কে ঘৃণা করতে পারলো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো কবরটার দিকে। বললো,
~ ভালোবাসার কাঙাল তুমি ভালোবাসা না পেয়েই চলে গেলে। তোমার ভালোবাসায় স্বার্থ থাকলেও ভালোবাসা টা পবিত্র ছিল। কিন্তু আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবো না নাদিয়া!
আবার কবরে মুখ গুঁজে দেয় আহিশ। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে হাত দিয়ে কবর টা বুলিয়ে দেয়, যেন মিহা কে সে ছুঁয়ে দিতে পারছে। কয়েক মুহূর্ত নিরব থেকে উপভোগ করতে চায়, মিহাকে অনুভব করতে চায়। তবে কোথায় যেন একটা বাঁধা। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
~ পরপারে ভালো আছো প্রেমপিয়াসী? আমার জন্য অপেক্ষা করছো? অপেক্ষা করবে কিন্তু! আমি খুব শীঘ্রই তোমার নিকট চলে আসবো। ছোট্ট সংসার হবে। আমরা একসাথে থাকবো, তোমাকে ছুঁয়ে দিবো, হাতে হাত ধরে ঘুরবো। অনেক বেশী ভালোবাসবো। একটু অপেক্ষা করো।
একটু থেমে আবার বললো,
~ পরপারে আমাদের আবার দেখা হোক, সংসার হোক!
হাত প্রসারিত করে জড়িয়ে রইলো কবরটিকে। রাতের অন্ধকারে যুবকের হাহাকারের মিলিয়ে গেল। চোখ বুজে পড়ে রইলো সে। ঠিক তখনই মনে হলো কেউ যেন কর্ণকুহরের খুব নিকটে মুখ এনে বলছে,
~ অপেক্ষা করবো, আহি!
সন্ধ্যার পিছু পিছু একঝাঁক অন্ধকার নিয়ে রাত নেমে আসে ধরনীতে। অদ্ভুত নিশ্চুপতা বিরাজ করছে ঘরে। ঘর টা অনেক দিন ছন্দহারা। খাঁ খাঁ করে। বিছানার মাথার দিকের দেয়ালে মস্ত বড় এক ছবি। ইউনিফর্ম পড়া গর্বিত সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে। ঠোঁটের কোণে উল্লাসের হাসি, চোখে চিকচিক ভাব। সুদর্শন যুবকের ভঙ্গিমা সাবলীল, সুন্দর। ছবিটার নিম্নাংশে ছোট অক্ষরে লেখা ‘সৈনিক জিয়াউল’!
বিছানার এক কোণে বসে ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন জিয়াউলের বাবা-মা। সন্তান হারা সর্বশান্ত দু’জন। হাতের ভাঁজে সাদা এক টুকরো কাগজ, চোখে পানি। অনেকক্ষণ হলো নিয়ে বসে আছেন, বুকের উপর পাথা চাপা দিয়ে কাগজ টি খোলার সাহস হয়নি। তবে না পড়লে যে জানা হবে না, ছেলে শেষ সময়ে কি বলতে চেয়েছে। জিয়াউলের বাবা শক্ত করে স্ত্রীর হাত চেপে ধরেন, ভরসা হোন। চোখের পানি মুছে, খুলেন কাগজটি। স্ত্রী কে শোনানোর জন্য তিনি কাঁপা কন্ঠে শব্দ করে পড়েন,
“বাবা ও মা,
তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে না? সন্তান হারা বাবা-মায়ের বুকের যন্ত্রণা আমি বুঝবো না। কিন্তু বাবা-মা হারা বুকের যন্ত্রণা ঠিক বুঝতে পারছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা, তোমার বুকে একটু জায়গা দাও না! আমি লুকিয়ে পড়ি। ও বাবা! তোমার পেছনে আমাকে লুকিয়ে রাখো না, ঠিক ছোট বেলার মতো! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা! ও বাবা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তোমাদের তো গর্ব হওয়া উচিত। সৈনিক জিয়াউল দেশের স্বার্থে আত্মবলিদান দিয়েছে। পুরো পৃথিবী জানবে বাংলাদেশ সৈনিকের ত্যাগ! তোমরা নায়ক ছেলের জন্ম দিয়েছো! পুরো পৃথিবীর কাছে আমি নায়ক হয়ে রইলাম। তোমাদের কান্না মানায় না। ও মা ,তোমার আর আদিবাসী বউমা বানাতে হলো না। আর চিন্তা করতে হবে না তোমাদের। কি করছি, কি খাচ্ছি, কোথায় আছি, ঠিক আছি কিনা; এসব চিন্তা থেকে মুক্ত করে গেলাম। তোমাদের মতো বাবা-মা ঘরে ঘরে জন্মাক! আমার মতো ধন্য সন্তান জনে জনে হোক! কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কষ্ট তোমাকে দিয়ে গেলাম বাবা। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ বহন করার যন্ত্রণা টা আর কেউ না পাক! সন্তান তো ভুল করেই, বাবা-মা ক্ষমা করে দেয়। এবারও এই অধম, দায়িত্বজ্ঞানহীন সন্তান কে ক্ষমা করে দিও। আমি অপারে খুব ভালো থাকবো। আসছি মা! আসছি বাবা!
ইতি
তোমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে
জিয়া!”
বুকের ভেতর থেকে এক ছিটে আর্তনাদ ছিটকে বেরিয়ে আসে। বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লেন দুজন। হাত দিয়ে বুক চাপড়াতে লাগলেন জিয়াউলের মা। ছেলেটা কি তাহলে অভিমানেই দূরে চলে গেল? সে নাহয় একটু কঠোর হয়েছিলেন। তাই বলে ছেলে তাঁকে বুঝাতে পারতো না? কেটে যায় অনেকটা সময়। কান্নার শব্দ কমে আসে। নিশ্চুপতা ফিরে পায়। ঘরে বসেই জানালা ভেদ করে দুজন তাকিয়ে রইলেন কবরের দিকে। বুকের মানিক ঘুমিয়ে আছে যে! আরো কিছুটা সময় চলে যায়। জিয়াউলের মা দেখতে পান কেউ কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানা থেকে নেমে পড়েন তিনি। এগিয়ে যান জানালার দিকে। মেয়েটির মুখের গঠন দেখে বুঝতে সমস্যা হয়না। এটাই সেই আদিবাসী। তিনি ইচ্ছে করেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। দেখতে চান মেয়েটি কি করে। জিয়াউলের বাবা স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে নিজেও নজর বুলান কবরে..
এদিক ওদিক তাকিয়ে বাঁশের বেড়া টা খুলে ফেলে অনান। নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় শুয়ে পড়ে কবরের পাশে। আকাশের দিক আঙুল উঁচিয়ে বলে,
~ মি. খালেদা জিয়া ওই দেখ আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। কি সুন্দর জ্বলজ্বল করছে। ঠিক আমার চাঁদের মতো। আমার বুকেও তো তুমি জ্বলজ্বল করো।
চাঁদের থেকে দৃষ্টি ফেরায় অনান। কবরের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
~ তুমি খুব নিষ্ঠুর খালেদা জিয়া। আমি এতবার খালেদা জিয়া বলি, অথচ একবারও আদিবাসী বলো না। খুব পঁচা তুমি!
আবার কিছুটা ভেবে বলে,
~ তোমার চিঠি টা পড়িনি জানো? ভেবেছি তোমার সামনে পড়বো, যাতে তুমি লজ্জায় মুখ লুকাও। এখন পড়ি, কেমন?
অনান উড়নার ভাঁজ খুলে কাগজটি হাতে তুলে নেয়। ভাঁজ খুলে চোখ রাখে,
“এই আদীবাসি!
রাগ করে লাভ নেই, আমি তোমার বহুদূরে। ততদূরে; যতদূরে গেলে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না! যাওয়ার পূর্বে তোমাকে অনেক কিছু বলার স্বাদ জেগেছিল। কিন্তু ভাগ্য দেখ, শেষ দেখা টাও তখন হলো না। মি. খালেদা জিয়া তার আদিবাসী কে অনেক বেশী ভালোবাসে জানো? তুমি তো জানো না! জানিয়ে দিলাম! রাগ করো না! আচ্ছা কেমন আছো? আমি জানি তুমি ভালো নেই! তবুও বোকার মতো প্রশ্ন করলাম। তোমাকে আমি নিঃস্ব করে দিয়েছি আদিবাসী! আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটাবার যদি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম। কপালে দুটো চুমু খেতাম! স্বপ্ন গুলো স্বপ্নই রয়ে গেল। তোমার আর বাঁচার কারণ বেঁচে রইলো না আদিবাসী। কিন্তু তুমি বাঁচবে। অনেক বছর বাঁচবে। অনেক বছর আমাকে ভালোবেসে যাবে। সৈনিক জিয়াউল আজ সবার নিকট নায়ক, কিন্তু একজনের কাছেই খলনায়ক হয়ে বিদায় নিলো। আমি না বড্ড স্বার্থপর। তোমাকে অন্যের পাশে দেখতে পারবো না। তোমার জীবনে নায়ক, খলনায়ক দুটোতেই শুধু আমাকে রেখো! আর এগোতে পারছি না। হাত কাঁপছে, থেমে থেমে যাচ্ছে। একটু পরেই নিঃশ্বাস থেমে যাবে। চিঠির গন্ধ শুঁকে তোমাকে অনুভব করতে চাইলাম আদিবাসী। কিন্তু পেরে উঠলাম না। একটু বেশীই ভালোবাসি আদিবাসী! বিদায় ভালোবাসা!
ইতি
মি. খালেদা জিয়া”
মুখে হাত চেপে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। বুকের ভেতর দহন টা বড্ড জ্বালাচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজা টা চামড়া ভেদ করে বাইরে এসে পড়বে। কবর টাই একটু খানি ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। পরম আদরে ভঙ্গিমায় হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো অনান। আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মেয়েটি। জিয়াউলের বাবা-মা সেই অন্ধকারে ছায়া খোঁজার মতো ছটফট করতে লাগলো! মেয়েটি তাহলে অধরায় থাকবে?
…..
তিনটে মানুষ নিশ্চুপ বসে আছে চেয়ারে। কারো মুখে কোনো কথা নেই, শব্দ নেই। নিস্তব্ধ! টেবিলের উপর রাখা হাত ব্যাগ, পাশেই ধারালো রক্তাক্ত ছুরি! গম্ভীর আফীফের নিঃশ্বাস চলছে খুব দ্রুত। মনের ঝড় সে লুকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেকটা সময় তো চুপ ছিল, আর কত থাকবে? নিস্তব্ধতা কাটিয়ে নুরুল আলম সিদ্দিকী গলা ঝেড়ে নেন। একপ্রকার ফিসফিস করে বলেন,
~ কি করবে ভাবছো?
~ তুমি কি চাইছো? শেখ মেহরাব মুনতাসির কে না বিগ্রেডিয়ার আকা কে?
ভীষণ ভাবে চমকান নুরুল আলম সিদ্দিকী। পরপর কয়েকবার ঢোক গিলেন। কি জবাব দিবেন? শেখ মেহরাব মুনতাসির কে চাইলে যে তাকে হারাতে হবে আপন জন! আর বিগ্রেডিয়ার আকা? তাকে চাইলে হারাতে হবে আত্মসম্মান, আত্মগৌরব, আদর্শ, নিষ্ঠা! প্রথম টি হারালে অর্ধমৃত, দ্বিতীয় টি হারালে তিনি আত্মগ্লানিতে জীবন্ত লাশ হয়ে নিঃশ্বাস নিবেন। যে কাজ করার জন্য আজ বিকেল পর্যন্ত জেনারেল আকা কে ধিক্কার দিচ্ছিলেন, রাত এলেই তিনি একই কাজ কিভাবে করবেন? চাপা শ্বাস ফেলে নুরুল আলম সিদ্দিকী উঠে দাঁড়ালেন। নিম্ন কাঁপা কন্ঠে বললেন,
~ তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা রয়েছে। একজন সৈনিক কখনোই নিজের আদর্শ ভুলে অন্যায় কে প্রশ্রয় দিবে না।
তিনি দাঁড়ালেন না। ধীর গতিতে হেঁটে ঘরে চলে গেলেন। কামিনী বেগম কোটর ভর্তি পানি নিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি তো মা, এই মুহুর্তে ছেলের ভেতর কার অনুভূতি যেন তাঁকেও কাঁপিয়ে তুলছে। হাত বাড়িয়ে মাথায় রাখলেন। কপালে চুমু খেয়ে নিজেও স্বামীর ভরসা হতে নিজ ঘরে চলে গেলেন। আফীফ নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। যতটা ক্ষণ ভাবলো ততটা ক্ষণ সে ছটফট করতে লাগলো। পরক্ষণেই বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরে চলে গেল। টেবিলে পড়ে রইলো ব্যাগ ও রক্তাক্ত প্রমাণ! আফীফ ঘরে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো অনান। কিছুক্ষণ হলো এসেছে, সদর দরজা খোলা দেখে চমকালেও নিঃশব্দে ভেতরে আসে সে। এসেই পুরো ঘটনার অদৃশ্য সাক্ষী হয়ে রয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর পাগলামি করছিল মেয়েটি, এখন হয়তো অনিমেষ মাহমুদের কবরের সামনে বসে আছে। অনান নিশব্দেই নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে পড়লো।
বেশীক্ষণ দেরী করলো না। দরজায় দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কিনা। নেই, ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো অনান। বাজেয়াপ্ত করা ছুরিটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে ছোট্ট একটা কাগজ চাপা দিয়ে রাখলো গ্লাস দিয়ে। মস্ত বড় অপরাধ করছে সে। তবে সে তো এসবের পরোয়া করছে না। মস্ত বড় অপরাধে যদি চারটে মানুষ ভালো থাকে আর কি চায় সে? ছুরিটা হাতে নিয়েই গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো। এক পলক পেছনে তাকিয়ে আবার মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। জানে না কোথায় যাবে, তবে সে জাগতিক সকল কিছু ত্যাগ করে গৃহ ত্যাগ করছে। হয়তো আজ রাতেই মেয়েটি নিয়তির নির্মমতার শিকার হবে, নাহয় নিয়তির খেলায় জীবনের সমীকরণ নিয়ে চলতে থাকবে! তার বাঁচার মাধ্যম যে নেই! নিঃশ্বাস নিবে কি করে?
ইউনিফর্ম পড়ে বেরিয়ে এলো আফীফ। লাল চোখে আজ কৃত্রিম কঠোরতা। মুখশ্রীতে ফুটে উঠতে চায়ছে অসহায়ত্ব বোধ কিন্তু সে জোর করে ধরে রেখেছে নিষ্ঠুরতা। টুপিটা হাতে নিয়ে টেবিলের কাছে আসে আফীফ। মুহুর্তেই চমকে যায়, থমকে যায়। ব্যাগের পাশে বাজেয়াপ্ত করা ছুরিটা নেই! সে জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ছোট্ট কাগজ। আফীফ গ্লাস সরিয়ে কাগজ টি হাতে নেয়। সারমর্ম,
“ক্ষমা করে দিও, তোমার আদর্শে আঘাত করার কোনো ইনটেনশন আমার নেই। আমি শুধু হৃদয়ের কথা শুনেছি! ভালোবাসা হীন বেঁচে থাকা কষ্টকর। মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর! মেয়েটা সেই ৮ বছর থেকে কষ্ট, ভুল, নির্মমতার সাথে এ পর্যন্ত এসেছে। তোমরা দুজন নিজেদের দিক থেকে একদম ঠিক। একজন অপরাধী যেই হোক না কেন সে অপরাধীই। কিন্তু এবার তো একটু ভেতরের কথা শুনো! আমি জানি না তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার আগে মনে হলো মেয়েটাকে অন্তত অন্ধকার কারাগার থেকে বাঁচাতে পারবো। আমি ফিরবো না, হারিয়ে যাবো অন্ধকারে। খুঁজতে যেও না, কষ্ট বাড়বে!
~আদিবাসী মেয়েটি!”
যথাস্থানে কাগজটি রেখে দেয় আফীফ। পূর্বের ন্যায় অস্থিরতা তার দ্বিগুণ বেড়ে যায়। চেয়ারে বসে জগ থেকে পানি ঢেলে এক চুমুকে শেষ করে। তারপর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। গাড়িতে উঠেই স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করে সে। ঢোকের পর ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করতে চায়, নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আজ যেন আফীফ মুনতাসির নিজের মাঝে নেই। গাড়ি থেমে যেতেই নেমে পড়ে আফীফ। গেইটে দারোয়ান নেই, হাট করে খুলে রাখা। গাড়ি ভেতরে নিয়ে যায় না আফীফ। হেঁটেই আসে। সরাসরি বাড়ির বাম পাশে অনিমেষ মাহমুদের কবরের দিক চলে যায়। মেয়ে টা আজ সাদা শাড়িতে নিজেকে জড়িয়েছে, এলোমেলো শাড়ির আঁচল ছড়িয়ে আছে মাটিতে, পায়ে আলতা, খোঁপায় কাটামুকুট, হাতে এক গোছা চুরি! কি অপরূপ রূপের বাহার। আফীফ থেমে যায় সেখানেই, এগোনোর সাহস হয় না। বিড়বিড় করে বলে,
~ নারীর ভয়ংকর রূপ পুরুষের হৃদয় কে কব্জা করতে পারদর্শী।
পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
~ আপনি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন তো! তবে আফীফ মুনতাসির কে টলাতে পারবেন না!
এবার এগোয় আফীফ। স্বাভাবিক কঠোর ভঙ্গিমায় বলে উঠে,
~ পালক বাবার বুক ঝাঁঝরা করে অনুভূতি কেমন মিস মাহনূর মুনতাসির?
চমকিত ভঙ্গিমায় ঘাড় ঘুরায় আফরা। বাক্যটি পরিচিত। সেও ঠিক এভাবেই সামনের মানুষটার বুকে ঘা বসিয়েছিল। আজ ফেরত পেল। বেশীক্ষণ চমকানো ভাব রইলো না। স্বাভাবিক মুখশ্রী তে এগিয়ে এসে আফীফের সামনে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বললো,
~ কেমন লাগছে আমাকে?
~ অপরূপ সৌন্দর্যে সৃষ্টিকর্তা অধিক মায়ার নিপুণ কারুকাজ খচিত করে দিয়েছেন! কিন্তু সেই সৌন্দর্য ছুঁয়ে দেখার সাধ্যি নেই যে!
আফরা হাত বাড়িয়ে দেয়। ইঙ্গিত করে বলে,
~ সাধ্যি করে নিন না, ছুঁয়ে দিন!
আফীফ পিছিয়ে যায় দু পা! আফরা থমকায়। প্রশ্নাত্মক চাহনি তে তাকায়। আফীফ ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলে,
~ আপনাকে একদিন বলেছিলাম, অপরাধী আমার বাবা হলেও আফীফ মুনতাসিরের হাত কাঁপবে না বুক ঝাঁঝরা করতে। সেই আপনি কি করে ভাবলেন একজন খু’নী কে আমি আমার জীবনে জড়াবো! আইন আর খু’নী কখনোই একসাথে যায় না! অনেক অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে। আপনিও তাই ছাড়া পেলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির শেখ মেহরাব মুনতাসির ও নুরুল আলম সিদ্দিকী’র আদর্শে বেড়ে উঠেছে, তাদের একেকটা শিক্ষা বুকে যত্ন নিয়ে রেখেছে; সেই বুকে একজন খু’নীর মাথা কিভাবে থাকতে পারে মিস মাহনূর মুনতাসির? খুন হোক প্রতিশোধের!
আফীফ আরো দু পা পিছিয়ে যায়, আফরা হাত বাড়িয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। আফীফ আবার বলে,
~ কাটামুকুটের কাটা যুক্ত শরীরের কাটা উপড়ে ফেলতে আফীফ মুনতাসির ব্যর্থ হয়েছে! আপনি আমার অধরা হয়েই রয়ে গেলেন। ধরতে গেলেই অদৃশ্য!
এবার একটু এগিয়ে আসে আফীফ। মুচকি হেসে বলে,
~ আফীফ মুনতাসির দেশের জন্য কোনো নারীকে জীবনে জড়াতে চায় নি। কিন্তু আপনি জড়িয়ে গেলেন, এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলেন এখন ছাড়াতে চাইলে অতিরিক্ত পেঁচিয়ে যাচ্ছেন। তবে যে আফীফ মুনতাসির দূরত্ব করে নিল!
পিছু ঘুরো হাঁটতে থাকে আফীফ। আফরা আকুল হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। এই বুঝি মানুষ টা পিছু ফিরে হাসবে। এই বুঝি মানুষ টা সকল কথা কে মিথ্যে প্রমাণ করে এগিয়ে আসবে। সব আশা যে পূরণ হবার নয়। যেতে যেতেই আফীফ গলা উঁচিয়ে বলে,
~ নায়ক হতে চেয়েছিলাম, দেশ আমাকে আপনার নিকট খলনায়ক করে উপস্থাপন করলো। কিন্তু প্রাপ্তি, নায়িকা নায়ক কে নয় এই খলনায়ক কেই ভালোবেসেছে। আফসোস আমাদের বিস্ফোরণের সংসার তৈরি হলো না! তবে এলোকেশী কাটামুকুট শুনছেন, আফীফ মুনতাসির আপনাকে শর্তের বাহিরে ভালোবেসেছে। কিছু স্বপ্ন অধরা হয়ে বুকের ক্ষত বাড়ায়, এ ক্ষত আমৃত্যু থেকে যাক! আমি নিভু নিভু চোখেও আপনাকে ভালোবাসিবো!
বীর সৈনিক ক্যাপ্টেন আফীফ মুনতাসির ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। সাজে সজ্জিত নারী স্তব্দতা কাটিয়ে হাসে! বাড়ানো হাত গুটিয়ে নেয়। খোঁপায় বাঁধা কাটামুকুট হাতে তুলে নিয়ে দু চোখে ছুঁয়ে দেয়। বিড়বিড় করে বলে,
~ আপনার নির্বাসন আমি রক্তাক্ত বুকে গ্রহণ করলাম অপ্রিয় সত্তা! আপনি আবার বাধ্য করলেন শেখ মাহনূর মুনতাসির কে ব্যর্থতা নিয়ে হাসতে। ভেঙে চুরমার করতে সফল হলেন। এই জগতের ভালোবাসা অসহায়। আমরা নাহয় পরপারে এক হবো, তখনও কি আপনার দেশ আমাদের মধ্যে বৃহৎ দেয়াল তৈরি করবে? পরিশেষে আপনার এই কঠোর সত্তা নিষ্ঠুর আমি কে আবার বাধ্য করলো ভালোবাসতে, সম্মান করতে! কিন্তু শেখ মাহনূর মুনতাসির নায়িকা নয়, সে এক খলনায়িকার আড়ালে ভয়ংকর চরিত্র!
এরপর সব নিস্তব্ধ! মাটিতে বিছানো আঁচল, এলোমেলো শাড়ি নিয়ে আফরা হেঁটে যেতে থাকলো অন্ধকার পথ ধরে। রহস্যময় এই অন্ধকারে আরেক রহস্যময়ী মিলিয়ে গেল তীব্র অভিমানে! যাতনা গুলোও মাঝে মাঝে ভয়ংকর সুখ দেয়!
“Anol Mahmoud
He is a notorious terrorist But he is also a good husband and a best father.”
লেখাটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে আদিল। এই লেখাটার নিচেই তার আব্বু ঘুমিয়ে আছে। অনুভূতিহীন আদিল আজ বড়ই শান্ত। সেই কাল রাত থেকে একটানা বসেও কোনো ক্লান্তি ভাব নেই, বিরক্তি ভাব নেই। তবে এবার একটু উঠা দরকার। আদিল উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে কবর টা ছুঁয়ে দেয়। কেঁপে কেঁপে উঠে। বলে,
~ আমার জীবনের নায়ক আপনি আব্বু। যে আদিল মাহমুদ অনল মাহমুদ ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারতো না। আজ আপনাকে ছাড়ায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভালোবাসার উপর অভিমান কি একটু বেশীই হয়েছিল? ছেলের হাতে প্রাণ দিয়ে শাস্তি নিজেই গ্রহণ করলেন, তাহলে আমাকে কেন রেখে গেলেন আব্বু? এই স্বার্থপর পৃথিবীতে আমি একা, খুব একা আব্বু। আপনাকে ছাড়া শূণ্য শূণ্য লাগে। যাওয়ার পূর্বে আমার বুকটা ঝাঁঝরা করে যেতেন, আপনার হাতে মৃত্যুর স্বাদ যে বড়ই তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু এভাবে কেন রেখে গেলেন?
প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু উত্তর? উত্তর দেওয়ার মালিক যে নেই। কঠোর আদিলের রক্তাক্ত চোখে আজ অভিযোগের বাহার। কেন রেখে গেলেন তার আব্বু? অনেকটা বছর তো একসাথে ছিল, বাকি জীবন একসাথে থাকলে খুব একটা ক্ষতি তো হতো না! এত এত প্রশ্নের উত্তর না পেলেও, শেষ প্রশ্নের উত্তর টা কেও দিয়ে দিল। ভেসে এলো মেয়েলি কন্ঠস্বর,
~ আপনি আমার শিকার ডাক্তার, তাই আপনার আব্বু আপনাকে রেখে গেছেন!
চমকায় আদিল। ভড়কে যায় কিছুটা। মেয়ে টা শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করলো! ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু দেখে। স্তব্দ, চমকিত ভাবটা মেশালো হয়ে মুখের ভঙ্গিমাটা অদ্ভুত হয়ে উঠে। মিরা হাসে, নুপুরের ঝনঝন শব্দ তুলে এগিয়ে আসে। পরনের সাদা শাড়িতে গোলাপ ফুলের বাহারি কারুকাজ, কানে গোঁজা নন্দিনী ফুল; এতটুকুই! মেয়েটা কে ফুটন্ত এক গোলাপ মনে হচ্ছে। মেয়েটা আজ তাকে পুরোপুরি শেষ করতে এসেছে নাকি? নাহলে তার পছন্দের সাজে সেজেছে কেন? এই যে হৃদয়টা ধুকপুক করছে, মনের ভেতর জানা অনুভূতি গুলো কিলবিল করছে। উঠে দাঁড়ায় আদিল, ধুলো ঝেড়ে মিরার দিকে তাকায়। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ধরে রেখে দাঁড়িয়ে আছে মিরা।আদিল এগিয়ে আসতে চায়, পারে না। পূর্বেই শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা প্রাণনাশক অস্ত্র টি দৃশ্যমান হয়। বন্দুক নিজের হাতে তুলে নেয় মিরা। আদিলের দিকে তাক করে হাসে। আদিল বিচলিত হয় না। তোয়াক্কা না করে এগিয়ে আসে। বন্দুকে হাত দেয় না, মিরার কানে গুঁজে রাখা নন্দিনী ফুলটা ছুঁয়ে দিয়ে ভেজা কন্ঠে বলে,
~ আমার রাজনন্দিনী, আমার শাহজাদী, আমার নন্দিনী ফুল! আপনাকে পুষ্পের ন্যায় অলংকারমঞ্জিত, শোভাসিত লাগছে।
~ আপনি আমার কথা রাখেন নি ডাক্তার। আবার নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে আমার বাঁধা ভেঙেছেন।
মিরার কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। আদিল হাসে। বলে,
~ আদিল মাহমুদ বাঁধনে থাকতে পছন্দ করে না নন্দিনী ফুল! তাকে বাঁধা যায় না!
~ আপনি ঠিক বলেছিলেন ডাক্তার। আপনার ভালোবাসার জন্য হাহাকার করেও আমি আপনাকে মেনে নিতে পারবো না! আপনিও সমান দোষী ডাক্তার। আমার বাবা যেমন দোষী, আপনিও দোষী! আমি তো বাবা কে ছাড় দিই নি, আপনাকে কেন দিবো?
~ ছুঁড়ে দিন বুলেট, ঝাঁঝরা করুন বুক! আপনার প্রতিশোধ পূর্ণ করুন রাজনন্দিনী!
হেসে উঠে মিরা। হাসির ছলকে শরীর দুলতে থাকে। মৃদু বাতাসে চুলের ভাঁজ খুলে উড়তে থাকে। আদিল শুধু মুগ্ধ হয়েই দেখে যায়। এ দেখার যেন শেষ নেই। মিরা বলে,
~ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আপনাকে ভালোবাসা ডাক্তার, আবার সবচেয়ে বড় সুখ ও আপনাকে ভালোবাসা। আপাইয়ের ধর্ষণে সমান দোষী আমিও। কারণ আমার ভালোবাসা! আপনার বুক ঝাঁঝরা করলে যে শাস্তিটা আমি পাবো! আমৃত্যু বুকে দহন নিয়ে ছটফট করতে হবে। আমার আর কেউ রইলো না ডাক্তার, কেউ না! আপনি আমার থেকেও আমার না, আমার হয়েও আমার না। এ দুঃখ লুকানোর একটাই পথ ডাক্তার! মৃত্যু!
থেমে যায় মিরা। বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল চেপে আদিলের দিকে তাকায়। ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলে,
~ আপনার শাস্তি ডাক্তার! আমৃত্যু আপনি ছটফট করবেন, বুকে দহন নিয়ে দাপাদাপি করবেন। যে বুকে আপনি থেকেও আপনি রইবেন না সেই খালি বুক নিয়ে বাঁচতে পারবো না ডাক্তার! আপনাকে জড়িয়ে নেওয়ার সাধ্যি নেই যে! বিদায় ডাক্তার, এপারে ভালো থাকবেন!
বন্দুকের মাথা দিক ঘুরিয়েছে। ট্রিগার চেপে ধরা আঙুল টায় ভর দিতেই বিকট একটি শব্দ। কেঁপে উঠলো গাছপালা, রাতের নিশাচর রাও ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল যেন। রক্তাক্ত মিরা লুটিয়ে পড়লো জমিনে, ঠোঁটে হাসি, চোখে আকুলতা। দু চোখে চেয়ে ডাক্তার কে দেখে নিচ্ছে। স্তব্দ আদিল ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে। বড় বড় চোখ মেলে দৃশ্য টা বুঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে। হৃদপিন্ডের স্পন্দন থেমে গেছে, রক্তচলাচলের গতিও যেন বসে গেছে। মিরা বুকে হাত চেপে রক্তাক্ত হাতে ছুঁয়ে দেয় আদিলের গাল। নিমিষেই প্রেয়সীর রক্তে রাঙা হয় আদিলের গাল খানা। মুচকি হেসে কাঁপা কন্ঠে থেমে থেমে বলে,
~ আপনি আমার জীবনে নায়ক-খলনায়কের ভূমিকায় থেকে যেতে চেয়েছেন। আপনার জীবন কে ছারখার করে, আপনার নিঃশ্বাস কে বিষাক্ত করে, আপনার দৃষ্টিকে কুলষিত করে, আপনার হৃদয়কে দগ্ধ করে, আপনার ভবিষ্যৎ কে নরক করে আমি খলনায়িকা হয়ে বিদায় নিচ্ছি! নায়িকার ভূমিকায় আমাকে মানায় না। রাজনন্দিনী আপনাকে বড্ড ভালোবাসে ডাক্ত…!
ডাক্তার শব্দ টার উচ্চারণ সমাপ্তি পায় না। থেমে যায় কথা, রোধ হয় কন্ঠনালি, বন্ধ হয় নিশ্বাস, হৃদযন্ত্র নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়। গোলাপের ন্যায় অলংকারমঞ্জিত, শোভাসিত মেয়েটার সাদা শাড়ি লাল রঙা হয়ে বুকে ক্ষত করে দিয়ে যায়। কঠোর, নিষ্ঠুর, দয়াহীন, গম্ভীর আদিল রক্তাক্ত চোখ নিয়ে অনিমেষ তাকিয়ে রয় ফুলটার দিকে। রক্তাক্ত গাল ছুঁয়ে বুকে হাত চেপে ধরে। সারা পৃথিবী যেন সেখানেই থেমে থাকে। নিষ্ঠুর প্রেমিকার প্রতিশোধ পূর্ণ হয়। প্রেমিকের বুক একবার ঝাঁঝরা করার বদল হাজার বার ঝাঁঝরা করে দিয়ে যায়। জ্যোৎস্না এসে ঠিকরে পড়ে নিষ্ঠুর, সর্বগ্রাসী প্রেমিকার মুখশ্রীতে। দিক ভুলা ব্যর্থ প্রেমিক যন্ত্রণা নিয়ে সেভাবেই বসে থাকে।
বাতাসে যেন ভেসে আসে,
হয়তো নায়ক নয়তো খলনায়ক পর্ব ৬৫+৬৬
নিয়তির নির্মম খেলায় জীবনের সমীকরণ কোথায় গিয়ে পৌঁছায় কেউ জানে না। ভেসে যায় ভালোবাসা, ছুটে আছে প্রাণনাশক অস্ত্র! প্রতিশোধের তাড়নার উপখ্যান হয় নাটকের ইতি! অন্য কে দুঃখে ভাসাতে ঝাঁঝরা হয় বুক। কেউ বা নিয়তির শিকার, কেউ বা নিয়তির অধিক হিংস্রতার শিকার। শেষমেষ জয় নিয়তিরই হয়!