চেকমেট পর্ব ৩৪
সারিকা হোসাইন
ঘড়ির কাটা টিকটিক করতে করতে পাঁচের ঘরে গিয়ে ঠেকলো।কিছুক্ষন বাদেই সুফিয়ান চৌধুরীর ডিউটি আওয়ার শেষ হবে।বিকেলের প্রারম্ভে তেমন কাজ না থাকায় কমিশনার কার্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার একটা চেয়ারে আয়েশ করে বসলেন সুফিয়ান।শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে।একটু চিনি কম দিয়ে ধোয়া উঠা গরম কফি খেতে পারলে ভালো লাগবে।যেই ভাবনা সেই কাজ।ক্যাফেটেরিয়ায় এসে এক কাপ অল্প সুগার দিয়ে কফি চাইলেন সুফিয়ান।এরপর কফির অপেক্ষায় বসে বসে সেল ফোন স্ক্রল করতে আরম্ভ কবলেন।
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ওয়াইটার ছেলেটা কফি দিয়ে চলে গেলো।বৃষ্টি মেঘলা বিকরলে ধোয়া উঠা কফিতে পরম আবেশে চুমুক দিয়ে চোখ বুঝলেন সুফিয়ান।এমন সময় পেছন থেকে কেউ রাশভারী গলায় বলে উ
আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছেন স্যার?বহু দিন বাদে দেখা।
পরিচিত কন্ঠস্বর পেয়ে কফি কাপ ফেলে পেছনে ফিরে তাকালেন সুফিয়ান।পেছনে স্করপিও হাসিতে বুকে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন এসপি নিয়াজ মোর্শেদ।দীর্ঘদিন পর এই কপট লোকের দর্শন সুবিধার ঠেকলো না সুফিয়ান চৌধুরীর কাছে।সে কপাল কুচকে সালাম এর প্রত্যুত্তর না করে সামনে মুখ করে ফিরে বলে উঠলো
“তা কি মনে করে নিয়াজ সাহেব?সালামের সুর হাসি কোনোটাই তো সুবিধার ঠেকছে না।হঠাৎ দর্শন দিলেন যে!
সুফিয়ান এর প্রশ্নে হা হা করে হাসলেন নিয়াজ।এরপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে সুফিয়ান চৌধুরীর সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে উঠলো
“বহু দিন বাদে দেখা পেলাম আপনার।শেষ পর্যন্ত ঢাকা বদলি হলেন।তা ঢাকায় কি মনে করে?শুধুই কি মেয়ের পড়ালেখা নাকি অন্য কিছু?
বলেই দুই হাতের তালু ঘসলেন নিয়াজ।ঠোঁটে এখনো সেই ধূর্ত হাসি।
নিয়াজের ঠেস দেয়া প্রশ্নে তরতর করে রাগ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গেলো সুফিয়ান চৌধুরীর।তিনি কফি মগ ঘুরাতে ঘুরতে উত্তর করলেন
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কেনো ঢাকায় আশা নিষেধ আমার?কে জারি করেছে এই নিষেধাজ্ঞা?
সুফিয়ান এর রাগী প্রশ্নে জিভ কেটে মাথা নাড়লেন নিয়াজ।এরপর টেবিলে ঝুকে ধীর গলায় শুধালেন
“শুনলাম মেয়ে নাকি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে?তা মেয়ে কি জানে আপনি যে তার আসল বাপ নন?
নিয়াজের মনের সকল শয়তানি পরিস্কার বুঝতে পারলেন সুফিয়ান।তাই চোখে মুখে বিরক্তি ঢেলে বলে উঠলেন
“নাহ মেয়ে কিচ্ছুটি জানে না।আপনার জন্য রেখে দিয়েছি।খবর টা তার কানে দিয়ে আমায় উদ্ধার করুন।কি হলো এখনো বসে রয়েছেন যে?
নিয়াজ খেঁক খেঁক করে হেসে বলল উঠলেন
“আগের মতোই রসিক রয়ে গেছেন।তবে যাক সেসব কথা।যেটা বলতে এলাম।
“কি বলতে এত দিন পর নিজের বদ সুরত দেখাতে আমার সামনে এলেন নিয়াজ সাহেব?তাড়াতাড়ি বলুন মন মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
চেহারার বর্ণনায় একটু থতমত খেলেন নিয়াজ মোর্শেদ।এরপর দুই হাতের তালুতে নিজের গাল ঘষতে ঘষতে বলে উঠলেন
“শুনলাম মেয়ের নাকি কঠিন ভালোবাসা চলছে সেই খুনী ছেলেটার সাথে?ঘটনা কতো দূর সত্যি?
নিয়াজের কথায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না সুফিয়ান।কফি মগ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে ধমকে উঠলেন তিনি
“চুপ করুন।কি সব আবোল তাবোল বকতে চলে এসেছেন?কে খুনি?তাছাড়া আমার মেয়ের ব্যপারে আপনার তো দেখছি ভারী উৎসাহ।
নিয়াজ এবার প্রশস্ত হাসলো।এরপর বললো
“সত্যি করে একটা কথা বলুন তো!সেদিন গুলি সারফরাজ স্বেচ্ছায় করেছিলো নাকি আপনি খেতে চেয়েছিলেন?
বলেই চকচকে চোখে তাকিয়ে রইলেন নিয়াজ।সুফিয়ান এর ব্লাড প্রেসার কেমন তরতর করে বাড়তে লাগলো নিয়াজের চেহারার অবয়ব দেখে।রাগ জেদ লাগাম হীন হতে চাইছে।ইচ্ছে হচ্ছে নিয়াজ এর চামড়া তুলে লবন মরিচ ভরতে।তবুও নিজের মধ্যে সংযম টানলেন সুফিয়ান।নিয়াজের কথার উত্তর না দিয়ে কফিতে চুমুক বসালেন।সুফিয়ান চৌধুরীর নির্ভার নীরবতা সহ্য হলো না নিয়াজের।তিনি রয়ে সয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে শুধালেন
“যেই ছেলেকে নিয়ে দেশে এতো এতো শোরগোল হলো,মিডিয়া প্রশাসন সরব রইলো,হুট করেই সেই ছেলে হাওয়া।তা এতো বছর বাদে আপনাদের পরিবারের সাথে তার এতো দহরম মহরম কি করে?ঘটনা আসলে কি কমিশনার সাহেব?তবে সেদিন কি সব নাটক ছিলো?
সুফিয়ান ঠান্ডা গলায় নিয়াজের লোভী চোখে তাকিয়ে শুধালেন
“কি চাইছেন আপনি নিয়াজ সাহেব?
নিয়াজ বত্রিশ টা দাঁত বের করে খিকখিক করে হেসে বলে উঠলো
“আমি কি চাই আপনি খুব ভালো করেই জানেন।খামোখা পেরেশানি হবার কোনো দরকার নেই।আমার মুখটা বন্ধ করুন তাইলেই হবে।নয়তো কোন তথ্য কোথায় চলে যায় তার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।
নিজের ফোন পকেটে ভরতে ভরতে উঠে দাঁড়ালেন সুফিয়ান।এরপর কিছুই হয়নি এমন গলায় বলে উঠলেন
“যেখানে যেই তথ্য পাঠানোর পাঠিয়ে দিন ।আপনার মুখ আমার বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নেই।আর নেক্সট টাইম থেকে এই চেহারা আমাকে দেখাতে আসবেন না।নয়তো আমি ভুলে যাবো আপনি পুলিশের সাবেক একজন সদস্য।
“তা কি করে হয় স্যার?এভাবে হেলাফেলা করছেন কেনো?বিষয়টা কি হেলাফেলার?
বাঁকা হেসে সুফিয়ান প্রত্যুত্তর করলেন
“এসব কুমতলবের জন্য এতো বড় চাকরি হারিয়েও শিক্ষা হলো না আপনার?ডিপার্টমেন্ট কি জানেনা কতো বড় ধাপ্পাবাজ আর খতরনাক লোক আপনি?কে বিশ্বাস করবে আপনার কথা?আর কি প্রমাণ ই বা আছে আপনার কাছে?
এবার থতমত খেলেন নিয়াজ।কোনো উত্তর করবার আগেই হনহন করে চলে গেলেন সুফিয়ান।সুফিয়ানের পায়ের চলনে খেয়াল করে ক্রুর হাসলেন নিয়াজ।এরপর বলে উঠলেন
“খুব পস্তাবেন কমিশনার।ল্যাঙট খুলে দৌড় করাবো।সবার সামনে আপনার ভালো মানুষির মুখোশ যদি না ছিঁড়েছি তবে আমার নাম ও নিয়াজ মোর্শেদ নয়।শুধু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করুন।
ক্লাসের নতুন অধ্যায় নতুন প্রফেসর সব মিলিয়ে বোর টাইম পার করলো নেলি আর রূপকথা।লেকচারার এর লেকচার এর আগা মাথা কিছুই তাদের মাথায় ঢুকলো না।ক্লাসের টাইম শেষ হবার সাথে সাথে দুজনেই যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।প্রয়োজনীয় নোটস প্যাডে লিখে ঘড়িতে সময় বুলালো রূপকথা।দুই পিরিয়ড অফ।এরপর ফিজিওলজির ক্লাস।
ক্লাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রূপকথা আর নেলি।হঠাৎ রূপকথার ফোন বেজে উঠলো।ব্যাগ থেকে ফোন বের করে চোখের সামনে আনতেই মুখে হাসি ফুটলো।স্ক্রিনে সারফরাজ এর নম্বর।ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে ধরে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সারফরাজ কিছু একটা বললো।শুনেই মুখের রঙ পরিবর্তন হলো রূপকথার।ফোন কেটে দ্রুত পা চালাতেই নেলি শুধালো
“কি হয়েছে?কে ফোন করেছে?
“হসপিটালে চল নেলি।অভিরূপ বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।
অভিরুপ এর এক্সিডেন্ট এর খবর টা নেলির ভেতর কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করলো।নেলির হাসিখুশি মুখটা কেমন সহসাই চুপসে গেলো।বুকে ধুপধুপ আওয়াজে হৃদ গতি চলছে।আকস্মিক নিজের এহেন অনুভূতির কোনো হেতু খুঁজে পেলো না নেলি।রূপকথা আর নেলি দৌড়ে ইমারজেন্সি তে এলো।
ইমারজেন্সির কাঠের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে অভিরূপ।পা কেটে গলগল করে রক্ত ঝড়ছে।বেচারার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বহু কষ্টে কান্না আটকে রেখেছে।পাশেই কিছুই হয়নি এমন চেহারায় বসে আছে সারফরাজ।রূপকথা চঞ্চল গলায় ডাকলো
“সারফরাজ!
রূপকথাকে দেখতে পেয়ে সারফরাজ উঠে দাঁড়ালো এরপর রূপকথার হাত জড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো
“আসলে কোন ছুতোয় তোমাকে দেখবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না।এজন্য অভিরূপের কথা বলে নিয়ে এলাম।বুকটা পিপাসায় ধুকছিলো।এবার তৃষ্ণা মিটলো।এবার আমার মরন হোক।
সারফরাজ এর এহেন কথায় রূপকথা সারফরাজ এর পেটে কুনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বললো
“একজন আহত মানুষ নিয়ে এসব কি ধরনের মজা?কোথাও তুমি নিজে থেকেই ওকে এমন আহত করোনি তো?
সারফরাজ সিরিয়াস ভঙ্গিতে উত্তর করলো
“আমি করলে ও এতো ক্ষণ জমের দুয়ারে পৌঁছে যেতো।শালা কুকুরের সাথে এক্সিডেন্ট করে এই অবস্থা করেছে।কুকুর নাকি কাবাডি খেলতে চাইছিলো মাঝ রাস্তায় ওর সাথে।
সারফরাজ এর নিষ্ঠুর হেঁয়ালি কথায় কাঁদো কাঁদো গলায় অভি বলে উঠলো
“শালা নির্দয় পাষন্ড,দেখ কতো গুলো ব্যাথা লেগেছে।আর তুই আমাকে নিয়ে সেই কখন থেকে হাসি তামাশা করে যাচ্চিস।শালা অভিশাপ দিলাম ।তুই ও একদিন কাঁদবি।সেদিন আমিও হাসবো।
অভির কথায় ঠোঁট টিপে হাসলো সারফরাজ।এরপর বললো
“আমার শরীর থেকে যেই রক্ত ঝরেছে সেই পরিমাণ রক্ত তোর গায়েও নেই।
এদিকে ডক্টর আর নার্স দৌড়ে এলেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে।সুই সুতো ,ইনজেকশন আর সাদা গজ দেখেই ভীত হলো অভিরূপ।সে আর্তনাদ করে চাপা গলায় বলল
“ইনজেকশন এ আমার ফোবিয়া আছে।প্লিজ আমায় দিবেন না ওটা।আমি ভয়ে মরে যাবো গড সয়ার।
এতো বড় দামড়া ছেলের মুখে ইঞ্জেকশন এর ভয় শুনে ডক্টর কপাল কুঁচকে ভারিক্কি গলায় বললেন
“তাহলে এতবড় ক্ষত কিভাবে সেলাই করবো?এতো বড় মানুষের মুখে এসব মানায়?চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন কিচ্ছু হবে না।এসব মনের ভয়।
অভিরূপ মানলো না।সে কাকুতি মিনতি অব্যাহত রাখলো।
নেলি এতোক্ষন সবটা অবলোকন করলো।অভিরূপ এর করুন চেহারা তাকে বেশ পীড়া দিচ্ছে।এই অনুভূতির সাথে আজই পরিচিত হয়েছে নেলি।সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগছে তার কাছে।
নার্স ইনজেকশন নিয়ে এগুতেই অভিরূপ সারফরাজ এর উদ্দেশ্যে অনুরোধ করলো
“আমাকে জড়িয়ে ধর সারফরাজ।আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো নয়তো।
সারফরাজ তোয়াক্কা করলো না অভিরূপ এর কথা।সারফরাজ এর এহেন নিষ্ঠুরতায় রূপকথার মেজাজ তিরিক্ষী হলো।সে দাঁত চেপে বলে উঠলো
“কি হলো যাচ্ছ না কেনো?
“ওকে শক্ত হতে হবে রূপকথা।ছেলে মানুষের এতোটা নরম হলে মানায় না।যেখানে ওর নিজের কাউকে ভরসা দেবার কথা সেখানে ও নিজেই অন্যের ভরসা চাচ্ছে।আজীবন ওকে প্রটেক্ট করার জন্য আমি বসে থাকবো না।তাছাড়া এমন ভীতু মানুষ আমার পছন্দ নয়।আমি দেখতে চাই সামান্য একটা ইনজেকশন এর সুচের ফুটোয় ও কিভাবে মরে।
অভিরূপ এর কাকুতি মিনতিতে টিকতে পারলো না নেলি।সে সব কিছু ভুলে বশীভূত মানুষের ন্যয় অভিরূপ এর মাথা আলতো হাতে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো।এরপর নার্স কে ধীর গলায় বলে উঠলো
“নিন পুশ করুন।
নেলির স্পর্শে কাটা ছেড়া ব্যথা,ইনজেকশন সব ভুলে গেলো অভিরূপ।সে নেলির বড়বড় চোখ দুটোতে দৃষ্টি মেলালো।মুহূর্তেই যেনো কোনো ঘোরের মধ্যে চলে গেলো সে।
নেলির অভিরূপ কে আগলে নেয়া দেখে সারফরাজ আর রূপকথার চোখ কপালে উঠলো।সারফরাজ বিস্ফারিত চোখে বিড়বিড় করে বলে উঠলো
“ঘটনা কি ঘটলো?এক তার ছেড়া মেন্টাল আরেক মেন্টাল এর কাছে?ওহ নো।ভবিষৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে।
রূপকথা ফিসফিস করে সারফরাজ কে শুধালো
“আমি যা দেখছি তুমিও কি তা দেখছো?
.”হু।
“কি করে সম্ভব?
“তোমার ফুল মেন্টাল বোন কে জিজ্ঞেস করো।
নেলির চোখের দিকে তাকিয়ে কখন সময় পেরিয়ে গেলো অভিরূপ তার খেয়াল রাখলো না।অভিরূপ এর ধ্যান ভাঙলো সারফরাজ এর ডাকে।
“হুশে আয়।বাড়ি ফিরতে হবে।মধু পরে আবার খাস।এক দিনেই সব খেয়ে ফেললে পরে পস্তাবি।শালা মৌমাছি।
সারফরাজ এর গলায় সম্বিত ফিরে পেলো অভিরূপ।সে দ্রুত নজর সরিয়ে চারপাশে নজর বুলালো।ডক্টর নার্স কেউ নেই।পায়ে শুধু সাদা ব্যান্ডেজ।অভিরূপ যেনো আকাশ থেকে পরলো।নেলিকে চমৎকার জাদুকরী মনে হলো তার।
রূপকথার চোখে চোখ পড়তেই অভিরূপ কে ছেড়ে লাজুক ভঙ্গিতে সরে আসতে চাইলো নেলি।কিন্তু নেলির হাত চেপে ধরলো অভি।এরপর আদুরে গলায় শুধালো
“তুমি কি আমার পেইন কিলার হবে নেলি?
নিয়াজ মোর্শেদ এর অত্যাচারে সুফিয়ান চৌধুরির মাথা পাগল প্রায়।আজ সপ্তাহ খানেক ধরে ফোন কল,সরাসরি সাক্ষাৎ,লোক মারফত হুমকি ধামকি তে সুফিয়ান এর মাথা নষ্ট করে ফেলেছে সে।এদিকে চাপা স্বভাবের সুফিয়ান কারো কাছেই শেয়ার করলেন না এই বিষয়ে।প্রথমে নিয়াজ মোর্শেদ কে তেমন আমলে না নিলেও ধীরে ধীরে তার হুমকিতে ভীত হতে শুরু করেছেন সুফিয়ান।নিয়াজ নিজে থেকে এসব করছেন না তা বেশ টের পেয়েছেন সুফিয়ান।কেউ তো অবশ্যই কলকাঠি নাড়ছে নিয়াজ মোর্শেদ এর পেছনে।কিন্তু মানুষটা কে?
ড্রয়িং রুমে এক মনে বসে বসে নানাবিধ ভেবে চলেছেন সুফিয়ান।এমন সময় রূপকথা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো।দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাচ্ছে।মেয়ের সাজগোজ দেখে সুফিয়ান ক্লান্ত চিন্তিত গলায় শুধালেন
“কোথায় যাচ্ছ?
রূপকথা ইতস্তত করে উত্তর করলো
“ক্লাস ফ্রেন্ড অহনার বার্থডে বাবা।নেলিও যাচ্ছে।খুব করে অনুরোধ করেছে।যেতেই হবে।তাছাড়া আমাদের বাসার কাছেই পার্টির ভেন্যু।তাই যাচ্ছি আর কি।
“সারফরাজ যাবে?
“না।ওকে ডাকিনি।
আর কথা বাড়ালেন না সুফিয়ান।নিঃশব্দে সিঁড়ি ধরে নিজের ঘরে চলে গেলেন।ঘড়িতে আরো একবার সময় বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রূপকথা।
হোয়াইট প্যালেস রেস্টুরেন্ট টির রুফটপ এরিয়া সেজেছে বাহারি সাজে।রঙিন বাতি,খোলা আকাশ আর এলোমেলো বাতাস।সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি।রুফটপ এর এক সাইডে একটা স্টেজ বানানো হয়েছে।তাতে বড় করে লিখা “হ্যাপি বার্থডে অহনা।হরেক রঙের বেলুন আর ফুলে সাজানো হয়েছে স্টেজ।স্টেজে চারটে বড় বড় কেক রাখা।সাদা বার্বি গাউনে নিজেকে হুর পরী সাজিয়েছে অহনা।চারপাশে বন্ধুদের হাসি ঠাট্টা আর আনন্দ।
ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো আনন্দ।কেক কাটা হলো।আয়োজন করা হলো স্পেশাল খানা পিনার।নেলি হুট করে বললো
সে ওয়াশরুমে যাবে।রূপকথা ভিড় এড়িয়ে নেলিকে নিয়ে নেমে এলো থার্ড ফ্লোরের রেস্টুরেন্টে।এরপর নেলিকে ওয়াশ রুমে ঢুকিয়ে নিজের গায়ের ক্রিম কালার এর জামদানি আর মেকআপ একটু ঠিক করে নিলো।মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে এলো নেলি।লিফট এ উঠতে গিয়ে দুজনেই দেখতে পেলো লিফট লোড।তাই সিঁড়ি ধরে চলতে লাগলো দুজনে।সিক্সথ ফ্লোরে এসে হঠাৎ রূপকথার পা স্থির হলো।হনহন করে ছয় নম্বর ফ্লোরে হেটে যাচ্ছে সারফরাজ।হাটার গতি কেমন ভয়ংকর ছন্দ হীন।সারফরাজ এর জুতার খটখট ধ্বনি বুকের ছাতিতে কেমন ভয়ানক কাপন তুললো।রূপকথা নেলিকে বলে উঠলো
“তুই যা আমি আসছি।
নেলি অবাক গলায় বলে উঠলো
“এখানে কোথায় জাবি?পুরোটা জায়গা অন্ধকার।আর কেমন গা ছমছমে।দ্রুত উপরে চল।
রূপকথা শুনলো না।সে বলে উঠলো
“সারফরাজ আছে এখানে।
সারফরাজ এর নাম শুনে নেলি আর ঘাটালো না।ভাবলো রূপকথা হয়তো তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।তাই রূপকথাকে ফেলে বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি ডিঙিয়ে চলে গেলো নেলি।
অন্ধকার কক্ষের ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে নিয়াজ মোর্শেদ।ফ্লোর টা নতুন।কাজ শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো।অফিসের জন্য ভাড়া হবে।নিজের কুমতলব হাসিলের জন্য এই ফ্লোর এর একটা রুম ভাড়া নিয়েছে নিয়াজ।মানুষকে হুমকি ধামকি দিয়ে বেশ ভালোই টাকা পয়সা পকেটে ঢুকছে।এভাবেই যদি আয়েশী জীবন কভার হয়ে যায় তবে ক্ষতি কি?পুলিশের লোক বলেও খাতির ধান্দা হচ্ছে বড় বড় মানুষের সাথে।জীবন পূর্বের তুলনায় এখনই যেনো ঝাঁ চকচকে।কোনো বাধা নিষেধ শৃঙ্খলা নেই।নেই কোনো জবাবদিহিতা।
সামনের টেবিলের উপর থেকে মুঠো ফোন হাতে তুলে নিলো নিয়াজ।এরপর খোঁজে খোঁজে বের করলো সুফিয়ান চৌধুরীর নম্বর।সুফিয়ান চৌধুরীর নম্বরের পানে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হাসলেন নিয়াজ।সহসাই সেই হাসি ক্রোধে পরিণত হলো।নিয়াজ নাকের পাতা ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
“তোর জন্য সারফরাজ এখনো বেঁচে আছে কমিশনার।নয়তো ওই কুলাঙ্গার কে আমি….
বলেই ফসফস করতে লাগলেন নিয়াজ।
“তোর জন্যই আমি আজ চাকরি ছাড়া বেশ্যার ছেলে।খুব সততা গিরি তাই না?ল্যাঙটা করে ছেড়ে দেবো বলে দিলাম।
নিজে নিজেই রাগ ক্রোধের খায়েশ মিটিয়ে সুফিয়ান চৌধুরীর নম্বর ডায়াল করলেন নিয়াজ।নতুন সিম থেকে এবার কল করলেন তিনি।আগের নম্বরটা সুফিয়ান ব্লক লিস্টে ফেলেছে বোধ হয়।
রিং বাজতেই ফোন কানে তুললেন নিয়াজ।রিং কেটে যাবার মুহূর্তে ফোন রিসিভ হলো।সেই সাথে ভেসে এলো নরম কন্ঠস্বর
“হ্যালো।
সুফিয়ান এর কন্ঠ পেয়ে শব্দ করে হাসলেন নিয়াজ।এরপর নাটকীয় ভঙ্গিমায় বললেন
“আসসালামু আলাইকুম স্যার।নিয়াজ মোর্শেদ বলছি।
“ওয়ালাই কুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু
কানের কাছে গম্ভীর ভরাট ঠান্ডা কন্ঠে সালাম শুনে ফোন কান থেকে নামিয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরালেন নিয়াজ।ডিম লাইটের নীল আলোয় এক জোড়া নীল চোখ জ্বলে উঠলো।মানুষটির মুখে লিও স্মাইল।নিয়াজ চট করে সুইচ টিপে কক্ষ আলোকিত করলেন।লাইনে এখনো সুফিয়ান চৌধুরী।
সারফরাজ নিজের বন্দুক দিয়ে নিয়াজ মোর্শেদ এর গাল স্লাইড করে ভারী গলায় বলে উঠলো
“বলে ছিলাম না নেক্সট টাইম সামনে পেলে জাস্ট খেয়ে ফেলবো?
সারফরাজ এর গলার স্বরে ভীত হলেন নিয়াজ।ড্রয়ার থেকে নিজের লাইসেন্স বিহীন বন্দুক বের করে সারফরাজ কে গুলি করতে চাইলেন।কিন্তু তার আগেই নির্দয়ের মতো নিয়াজের বুকে গুলি বসিয়ে দিলো সারফরাজ।যেনো চিন্তা ভাবনার জন্য এক সেকেন্ড সময় পর্যন্ত নিলো না।চিৎকার টুকু করার সময় পেলেন না নিয়াজ।
মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া বুঝি এতোই সহজ এই নিষ্ঠুর মানবের কাছে?
গুলি খেয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন নিয়াজ।সারফরাজ হো হো করে হাসলো নিয়াজের পতনে।এক হাতে টেবিল ঝটকা দিয়ে সরিয়ে নিয়াজের বুকে পা ঠেকিয়ে সারফরাজ হিসিসিয়ে বলে উঠলো
“কিভাবে জেলে আমাকে মেরে ছিলি মনে আছে?ছোট বাচ্চাটাকে ছুড়ে ফেলে কপাল ফাটিয়ে দিয়ে ছিলি।সেই দাগ এখনো রয়েছে।বাচ্চা মেয়েটা আমার কলিজা।তুই আমার কলিজায় আঘাত করেছিলি।কলিজায় আঘাত পেলে কেমন ব্যথা অনুভূত হয় বল তো?সহ্য করা যায় সেই তীক্ষ্ণ নিদারুণ ব্যথা?
বলেই আরেকটা শুট করলো সারফরাজ।নিয়াজ কথা বলতে চাইলো।কিন্তু পারলো না।ফ্যালফ্যাল চোখে সারফরাজ এর নিষ্ঠুরতা দর্শন করতে লাগলো শুধু।
নিয়াজ মোর্শেদ এর গলা চেপে ধরে সারফরাজ হুংকার ছাড়লো
“দে থ্রেট দে ।আমিও দেখি তোর বুকে কতো দম।সমস্ত দম নিংড়ে বের করবো আমি তোর।রুদ্ররাজ তোকে নাচাচ্ছে তাই না?এবার নাচ।ইচ্ছে মতো নাচ।
নিয়াজ মোর্শেদ বহু কষ্টে ভেঙে ভেঙে বলে উঠলো
“ধ্বংস হয়ে যাবি।
সারফরাজ নিয়াজের কপালে বন্দুক তাক করে হেসে উত্তর করলো
“ধ্বংস !আমি ধ্বংস হই না নিয়াজ মোর্শেদ।আমি ধ্বংস ডেকে আনি।এবার তোর ধ্বংস অনিবার্য।গুড বাই এসপি নিয়াজ।সী ইউ ইন হেল।
কথাটি বলেই নিয়াজ মোর্শেদ এর কপালে শুট করে দিলো সারফরাজ।কপাল ছিদ্র হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে ভিজিয়ে দিলো সারফরাজ এর মুখ আর গায়ের পোশাক।ফু দিয়ে বন্দুকের নলের ধোয়া থামিয়ে বড় বড় ভীত চোখে তাকিয়ে থাকা শ্বাস হীন নিয়াজের পানে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো সারফরাজ।
“আরো একটি গুটির পতন।চেকমেট।
চেকমেট পর্ব ৩৩
কথাটি বলেই পকেট থেকে লাইটার বের করে একটা সিগারেট ধরালো সারফরাজ।এরপর শূন্যে ধোয়া উড়িয়ে সমস্ত নীরবতা ছিন্ন করে খটখট শব্দ তুলে বেরিয়ে এলো ।আকস্মিক সামনে দাঁড়ানো মানবীকে দেখে পা থেমে গেলো তার সেই সাথে ঠোঁট থেকে খসে পড়লো জ্বলন্ত সিগারেট।ঝটপট হাতের বন্দুক কোমরের পিছনে গুঁজে ভয়ার্ত গলায় ডাকলো
“রূপকথা!