মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৮

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৮
মুসতারিন মুসাররাত

ঘরজুড়ে থমথমে নিস্তব্ধতা। প্রত্যাশা স্তব্ধ, হতবুদ্ধি, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আশঙ্কায় মেয়েটার চোখের পাতাগুলো কাঁপছে অনবরত, ঠোঁটজোড়া কেঁপে কেঁপে থেমে যাচ্ছে। গলায় শব্দ আটকে আছে। সবটা ঠাওর করতে পারছে না। নিচু স্বর, অথচ ছু’রি দিয়ে কাঁচে আঁচড় দেওয়ার মতো ধারালো স্বরে প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল নীরব,
-” এই ছবিগুলো দেখার পর আমি কী ভাবব, বলো? তোমার প্রতি আমার ধারণা ঠিক কোন খাতে গড়াবে?”
প্রত্যাশার বুকের ভেতরটা ধকধক করছে, হতবিহ্বলতায় মেয়েটা বাকশুণ্য। মুখ খোলার আগেই নীরব প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বজ্র কণ্ঠে ফের বলল,

-” হুয়াই আর ইউ সাইলেন্ট? টেল মি… হোয়াট একজ্যাক্টলি অ্যাম আই সাপোজড টু বিলিভ অ্যাবাউট ইউ আফটার সিইইং দিস?”
প্রত্যাশা ধ’ম’কে কেঁপে ওঠে। মূহুর্তেই চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। ভেজা, কম্পিত স্বরে বলল,
-” বিশ্বাস করুন… আমি… আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না ছবিগুলো কোত্থেকে এলো, কখন তোলা হলো, কে তুলেছে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা আমি। আমি কী করে..….?”
টসটসে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল প্রত্যাশার গাল বেয়ে। প্রত্যাশা ব্যাকুল নয়নে একবুক আশা নিয়ে নীরবের দিকে তাকায়—-নীরব ঠিক ওকে বুঝবে এই আশায়। প্রত্যাশার সে আশায় বুঝি গুড়ে বালি।‌ নীরবের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।‌ চোখে অবজ্ঞার ঝিলিক নিয়ে বলল,
-” মানে বলতে চাইছো, ছবির এই মেয়েটা তুমি না? রাইট?”
বুকের ভেতর থেকে হাহাকার বেরুল প্রত্যাশার। কী বলবে, কীভাবে বুঝাবে? অস্থির চিত্তে ব্যাকুল স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি ছবির এই দৃশ্যগুলো কীভাবে ঘটেছে সেটাও মনে করতে পারছি না। আমি… আমি কিচ্ছু মনে করতে পারছি না। বুঝতেও পারছি না। বিলিভ মি।”
বলতে বলতে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল প্রত্যাশা। নীরব ত্যাড়া সুরে বলল,
-” বিকেলে তোমার ফোনে ওর কল এলো, সেটাও তুমি জানো না? এখন তো আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, তুমি কলেজ থেকে ট্যুরে গেলে, ওরাও সেইম জায়গাতেই ট্যুরে গেল, দেখাও হলো….এতটা কোইনসিডেন্স কী করে হয়? নাকি আমাকে আই ওয়াশ করা হয়েছে?”
প্রত্যাশা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চাহনিতে চেয়ে সহসাই বলল,
-” নীরব, আপনি এই ছবিগুলো দেখে এতদূর অবধি চলে গিয়েছেন। এত সহজেই ছবিগুলো দেখেই বিশ্বাস করে নিলেন। আমাকে একটুও বিশ্বাস করলেন না। আপনার মনেহয় আমি অমন?”
নীরব রাগে উচ্চ কণ্ঠে বলল,

-” তুমি কলেজ থেকে গিয়েছিলে, তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে তোমার থাকার কথা। সেখানে তুমি ওর সাথে কী করছিলে? তাও হোটেলের ফাঁকা রুমে! ছবিটাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটা হোটেলের একটা লাক্সারি রুম। ছবিগুলো দেখতেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। তারপরেও আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম এডিট করা কী না। কোনটা এডিট আর কোনটা রিয়েল, সেটা তফাৎ করার ক্ষমতা আমার আছে। ছবির তুমি সংজ্ঞাহীনও নয়। তাহলে বলো আমার কথাগুলো লজিকলেস, আমার মনে তৈরি হওয়া প্রশ্ন নিছকই?”
প্রত্যাশা ভেজা গলায় বলল,
-” নীরব, দয়াকরে আপনি আমার পুরো কথা আগে শুনুন। তারপর না হয় জাজ করবেন। প্লিজ শুনুন, একটু বোঝার চেষ্টা করুন।”
বাম ভ্রুটা কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে দারাজ স্বরে বলল নীরব,
-” ওকে বলো। এক্সপ্লেইন দাও।”

হাতের পিঠে গাল বেয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু মুছে নেয় প্রত্যাশা।‌ মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করে। বলে,
-” আগেই বলেছি আমার ওনাদের সাথে দেখা হয়। আমার পা কে’টে যায়। সার্থক উনি নিজে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়, মেডিসিন প্রেসক্রাইবও করে। তারপর আমার যতটুকু মনে আছে আমি ওনাদের সাথে সি-বিচের পাড়েই সময় কাটাতে থাকি। তারপর….. তারপরের কথা আমার ঠিকঠাক মনে পড়ে না। সার্থক আর ওনার ফ্রেন্ড, ওনার একটা মেয়ে ফ্রেন্ড ছিলো। ওনারা আমায় বলে ওষুধ নেওয়ার ফলে ঘুম পাচ্ছিল। আর…আর আমাদের ট্যুরের সবাই সেই মূহূর্তে ঘুরতে যাচ্ছিল। আমি অসুস্থ থাকায় ওনারা সাথে রাখে। আমার ফ্রেন্ডরাও একই কথা বলেছে। তারপর সন্ধ্যায় উনি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসে। ব্যস! এতটুকুই। কিন্তু কখন, কীভাবে? এই….”

নীরব থামিয়ে দিল। স্ক্রল করে একটা ছবি প্রত্যাশার সামনে ধরল। ছবিটাতে প্রত্যাশা নিজে সার্থকের হাত ধরে আছে। ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে, চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে। রাগে নীরবের মাথা ফেটে যাচ্ছে। গর্জে ওঠে বলল,
-” এখানে না তো অচেতন তুমি, আর না তো ঘুমের ছিটেফোঁটাও আছে।”
যে দৃশ্য দেখে নীরবের মাথা বিগড়ে গিয়েছে। সেই ছবিটা স্ক্রিনে এলো। দু’জনে খুব কাছাকাছি। প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে সার্থক টিশার্টের বোতাম থেকে চেইনটা ছড়াচ্ছে। ঘৃণা আর রাগে নীরব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফট করে হাতের ফোনটা ছুঁ’ড়ে মা’রল। ফ্লোরে পড়তেই ফোনের গ্লাস ফেটে যায়। ঝাঁঝিয়ে ওঠা শব্দে প্রত্যাশার বুক কেঁপে ওঠে। নীরবের এমন কঠোর আচরণে প্রত্যাশার শ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। নীরব কপাল স্লাইড করে রাগ দমানোর চেষ্টা করল। অধৈর্য হয়ে বলল,

-” এখন মনে হচ্ছে আমার মা ঠিকই বলে। এগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে। তাহলে আমিও বোধহয় জেনেশুনে নীবিড়ের মতো আরেকটা ভুলই করলাম। আসলেই র*ক্ত কথা বলে। জিনেটিক বিষয়টা সহজেই উতরানো যায় না। জেনেশুনে তোমাকে দয়া দেখানোই আমার ভুল ছিলো।”
ঘোর তমসার মধ্যে নিভুনিভু এক চিলতে আলোর রেখা নীরবের —‘যদি সত্যি হয়ে থাকে’ কথাটায় পায় প্রত্যাশা। উনি ‘যদি’ বলছে, তারমানে এক্ষুনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। তবে পরক্ষনেই প্রত্যাশার সেই আলো অজানা অন্ধকার গ্রাস করে নেয়। সাথে সবটা বুঝতেও ব্যর্থ হয়।‌ মস্তিষ্ক ক্যাচ করল— র*ক্ত, জেনেটিক, দয়া দেখানো! প্রত্যাশা কিছুটা উঁচু স্বরে বলল,
-” নীরব আপনি আমাকে বলছেন বলুন। আপনি ভালো করে জানেন আমার আব্বু-আম্মু কেমন।‌ জেনেটিক কথা তুলে ভুলেও তাদেরকে ছোট করে কিছু বলতে যাবেন না। আপনার রাইট নেই। আমি সহ্য করব না। আর দয়া, কীসের দয়া করেছেন আমাকে?”

রাগের বশে,মুখ ফস্কে কী বলতে বসেছিল তা ভাবতেই নীরব নিজেই নিজের উপর বিস্মিত হয়। হতাশায় চোখদুটো বুঁজে নিল। জোরালো শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলাল। গলার স্বর নামিয়ে বলল,
-” স্যরি। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। তুমি আমার জায়গায় একবার নিজেকে কল্পনা করে দ্যাখো, আমার কীরকম লাগছে! আমার অবস্থাটা রিলাইজ করার চেষ্টা করো। যেখানে আমি সার্থকের সাথে তোমার সামান্য কথা বলাই টলারেট করতে পারি না। সেখানে এই দৃশ্যগুলো দেখার পর কীভাবে সহ্য করব?”
চোখে নোনতা পানির বহর নিয়ে, অনুনয় করে ব্যাকুল স্বরে বলল প্রত্যাশা,
-” দয়াকরে, আমায় একবার বিশ্বাস করুন। আমি যেমনই হই না কেনো, তবে সজ্ঞানে কখনো কোনো অন্যায়, পা”প করতে পারি না। এতটুকু আত্মবিশ্বাস আমার আছে।‌”

-” আচ্ছা আমাকে সত্যি করে বলো, তুমি বুঝতে পারোনি আমি সার্থকের সাথে তোমার কথা বলা পছন্দ করতাম না। সেদিন হাসপাতালে ওর চেম্বারে আমার আচরণ, কথা শুনে কিছুই বোঝোনি? এছাড়াও বাড়িতেও আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারপরও তুমি ওর থেকে হেল্প নাও, ওর কাছে রেস্টের জন্য আশ্রয় নাও, আবার…..আবার আমারই সামনে থ্যাংকস জানাও।‌ আমার যে বিষয়টা এলার্জি লাগে, তুমি সেটা স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে করে যাও। এগুলোর ব্যাখা কী? বাদ দিলাম ছবির কথা।”
প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-” উ-উনি আপনার আত্মীয়, সেই সুত্রেই আমি কথা বলেছি। আপনি যে ওনাকে অপছন্দ করেন। আমি সেটা বুঝতে পারিনি।”

নীরব চোয়াল শক্ত করে আচমকা প্রত্যাশার দুই বাহু শক্ত করে ধরল। রাগান্বিত হয়ে দাঁত কিড়মিড়ে বলল,
-” তুমি বুঝবে কী করে? তুমি তো সবসময় নিজেকেই প্রায়োরিটি দাও। অন্যকে নিয়ে কখনো ভেবেছো? নাহ, ভাবোনি। অন্যের বিরক্তলাগা, অন্যের খারাপ লাগাকে তুমি এক পয়সার দাম দাও না। তোমার যখন যা মন চায় তাই করো।‌”
প্রত্যাশার গা থরথরিয়ে কাঁপছে। কান্নার শব্দ গলায় আঁটকে আছে। অঝোরে আষাঢ়িয়া বর্ষণ কপোল বেয়ে নামছে অবিরত। নীরব আ”গুন চোখ নিয়ে, রাগ-ক্ষোভ ঝাড়ল,

-” তুমি ছোটো, অগোছালো কিশোরী, তোমার কাছ থেকে বেশি কিছু এক্সপেক্টেশন রাখা বোকামি। তাই আমি তোমার কাছে নূন্যতম এক্সপেক্টও রাখিনি। তুমি যেমন আমি তেমন তুমিটাকেই মেনে নিয়েছি। মাঝখানে তোমার কিছু ভুলকেও চোখবুঁজে মেনে নিয়েছি।‌ তোমাকে কারো কাছে এতটুকু খাঁটো হতে দিইনি।”
প্রত্যাশার বুক ফেটে যাচ্ছে। ও অস্ফুটে কিছু বলতে চাইল,
-” নীরব.…এ___”
নীরব থামিয়ে দিল। প্রত্যাশার বাহু ছেড়ে দিল। ডান হাত উঁচু করে তুলে বলল,
-” লেট মি ফিনিশ।”

প্রত্যাশার নিজেকে খুব অসহায় ঠেকছে। নীরব হতাশা আর ক্ষোভ মিশিয়ে বলল রুঢ় স্বরে,
-” শুরু থেকেই তোমার পা’গলামি হাসিমুখে মেনে নিয়েছি, তোমার ছেলেমানুষী আচরণ ধৈর্য্য ধরে সহ্য করেছি। তোমাকে এতটুকু বুঝতে দেইনি। এবার তো তুমি লিমিট ক্রস করে ফেলেছো। এরকম দৃশ্য দেখার পরেও মেনে নেয়া যায়? তুমিই বলো যায়? পা’গলামি, অবুঝপনা মানা গেলেও চরিত্রের দোষ-ত্রুটি মানা সহজ নয়। আজকের পর থেকে তোমার আমার সম্পর্ক অনিশ্চিত। এই দৃশ্য দেখার পরেও তোমার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক কনটিউনু রাখা হবে বলে মনে হয় না।”

প্রত্যাশার পুরো পৃথিবী দুলে উঠল যেনো। বুকের ভেতরটা নিঃশব্দে র”ক্তাক্ত হলো। উল্টোদিক ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পা বাড়াল নীরব।‌ প্রত্যাশা আকস্মিক নীরবের হাতটা টেনে ধরল। আহত কণ্ঠে বলল,
-” নীরব, প্লিজ এতবড় একটা অপবাদ দিবেন না। মানা যাচ্ছে না। আমি পারছি না মানতে।”
নীরবের টানটান পিঠের দিকে কাতর হয়ে চেয়ে প্রত্যাশা। নীরব ঘাড় ঘুরিয়ে একহাতে প্রত্যাশার হাত নিজের হাত থেকে ছাড়াল। বলল শান্ত কণ্ঠে,
-” লেট মি এলোন।”

ভেতরের ছোট্ট হৃদয় দুমড়েমুচড়ে গেল।‌ তবুও নিজেকে সামলাতে, শক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করল প্রত্যাশা। ঝট করে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল বেয়ে পড়া জলের কণাগুলো মুছল। কান্না আটকিয়ে স্থির গলায় বলল,
-” আজ যা যা বললেন….যদি কখনো জানেন আমি সত্যিই নির্দোষ ছিলাম, তখন কী করবেন? ফিরিয়ে নিতে পারবেন কি আজকের এই কথাগুলো? পারবেন কি চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে, ‘ভুল করেছি’? জানেন তো, একটা কথা খুব শোনা যায়; বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি দুটোই একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত নেওয়া যায় না। আজ আপনার কথাগুলোও ঠিক সেরকমই আ’ঘা’ত করেছে আমাকে। আপনার কথায় আজ যে ক্ষত তৈরি হয়েছে আমার মনে, সেটা শুধু গভীর না। সেটা এমন একটা দাগ, যেটা হয়তো সারাজীবনেও শুকাবে না। আপনি তো আজ সন্দেহ করলেন, অবিশ্বাস করলেন। অথচ আমি শুধু চেয়েছিলাম বিশ্বাসটুকু। এটুকু কি খুব বেশি ছিল?”

প্রত্যাশার বলা প্রতিটি শব্দ শাণিত তীরের মতন নীরবের বুকে বিঁধল। নীরব থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।‌ প্রত্যুত্তর দিয়ে পারল না। নিজেকে এলোমেলো লাগছে ওর। হতাশ শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। প্রত্যাশা হাঁটু ভেঙ্গে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। দুই হাতে মুখ চেপে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে লাগল। চার দেয়ালের নিস্তব্ধতায় কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। কান্নার চোটে ফ্লোরে বসে থাকা ছোট্ট ভাঙা শরীরটা কাঁপছে অবিরাম।
রাতের অন্ধকারে নীরব ছাদে দাঁড়িয়ে। মাথার ভেতর তীব্র শব্দের মতো বাজছে প্রত্যাশার কথা। আবার না চাইতেও ওই ছবিগুলো চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে। তক্ষুনি রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে।‌
নিরিবিলি পরিবেশে নীরব ভাবতে লাগলো। নিজের উপরও তার কম রাগ হচ্ছে না। মনের এক কোণে নিজেকে নিয়েই প্রশ্নের উদয় হলো—উফ! খুব বেশিই রিঅ্যাক্ট করা হয়ে গেলো না তো? আরেকটু ধৈর্য্য ধরে সবটা যাচাই করা উচিত ছিলো নয় কী?
আসলে হঠাৎ করে এমন সেনসিটিভ ছবি দেখলে যে কারোরই স্বাভাবিক থাকার কথা নয়।‌ মানুষ তো, রোবট নয় তো। আকস্মিক রিঅ্যাক্ট করা অস্বাভাবিক নয়। তবুও কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের মধ্যে।

রাতে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে আসে।‌ এক বুক ভারী কষ্ট নিয়ে পাশের সোফায় মাথা এলিয়ে দেয় প্রত্যাশা। হাতটা মাথার নিচে গুঁজে, ভাবনার ভাঁজে হারিয়ে যায়। কখন যে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে, টেরই পায় না। ওভাবেই একসময় ঘুমে ঢলে পড়ে।
নতুন ভোরের সূচনা হয় বিষাদে। জানালার ফাঁক গলে আসা একফালি রোদের আলো চোখমুখে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে প্রত্যাশা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজে বেড়ায় কাঙ্ক্ষিত মুখটিকে। কোথাও নেই সে। এমন সময় ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ ভেসে আসলো। পর মূহুর্তেই খট করে দরজা খোলার আওয়াজ এলো। নীরব বেরিয়ে আসে। একঝলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় প্রত্যাশা। এদিকে সারাটা রাত যে নির্ঘুমে কেটেছে নীরবের। তা ওই লাল চোখদুটো প্রমাণ দিচ্ছে। নীরব টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল,

-” সাড়ে সাতটা বাজে অলরেডি। ইচ্ছেকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে, ওর স্কুল আছে। তুমিও রেডি থেকো, তোমাকেও নামিয়ে দিয়ে যাবো। বাড়তি ঝামেলা করার থেকে একসাথেই ড্রপ করে দিবো।”
প্রত্যাশা ভেতরে ভেতরে তীর্যক হেসে মনেমনে বলল—এতটাই ঘৃ”ণা করেন যে চোখের সামনে থেকে সরাতে, এত সকাল সকাল বিদেয় করার তোড়জোড় শুরু করেছেন।

খাবার টেবিলে এক লোকমা খাবার মুখে তুলে গলাধঃকরণ করতে খুব কষ্ট হচ্ছে প্রত্যাশার। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। ওদিকে নীরব তো আগেই মা’কে বলল— এত তাড়াতাড়ি সে ব্রেকফাস্ট করবে না। ইচ্ছেকে যেনো ফাস্ট রেডি করিয়ে দেয়। ওদেরকে দিয়ে অফিসে গিয়ে সে কিছু একটা খেয়ে নিবে। পানি দিয়ে মুখের খাবার কোনো রকমে গিলে প্রত্যাশা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ইচ্ছেকে চেয়ারে বসিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে মাছ বেছে বেছে গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিলেন নীহারিকা। প্রত্যাশাকে খাবার রেখে উঠতে দেখে সহসাই শুধালেন,
-” সে কি খাবার রেখে উঠছো যে। কিছুই তো খেলে না।”
প্রত্যাশা অজুহাত দিয়ে বলল,
-” আসলে এত সকাল সকাল নাস্তা করার অভ্যেস নেই তো, তাই খেতে পারছি না।”
-” অল্প করে কিছু খাও। এগুলো ভালো না লাগলে বলো, পরীকে বলি অন্যকিছু বানিয়ে দিতে।”
প্রত্যাশা মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” নাহ, মা। তার দরকার নেই। আমার এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-” আচ্ছা তাহলে ফ্রুটস জুসটা নাও।”
শাশুড়ির এত মমতায় প্রত্যাশার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল। আড়ালে কান্না লুকাল। বলল অপরাধীর মতো করে,

-” আসলে মা আমার শরীরটা একটু কেমন জেনো লাগছে। জোর করে কিছু খেতে গেলে বমি পাবে। আর আমাকে এত করে বলার কিছু নেই। আমার খেতে মন চাইলে আমি তো হাত দিয়েই নিয়ে খাই।”
নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে কথাগুলো বলে জোর করে ঠোঁটের কোণে হাসি টানে প্রত্যাশা। নীহারিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-” তোমার চোখের পাতা ভারী, তারপর চোখদুটোও লাল লাগছে। শরীর ঠিক আছে তোমার?”
অতিরিক্ত কান্নার ফলে এমন হয়েছে। প্রত্যাশা হেসে বলল,
-” ঠিক আছি। তেমন কিছুই না। ওই একটু মাথাটা ধরেছে তাই।”
শর্মিলা কিচেন থেকে বেরিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। বললেন,
-” মাথা ধরেছে তাহলে এত সকাল সকাল তোমার যাওয়ার কী তাড়া? ইচ্ছের নাহয় স্কুল আছে। মিস গেলে ওর মা আবার কথার তৈরি করবে। তুমি আজ থাকো। পরে পাছে যেও। নীরবকে বলি… তোমাকে যেনো কাল পরশু দিয়ে আসে।”

প্রত্যাশার বুক ভার হয়ে আসছে। তড়িঘড়ি করে বলল,
-” নাহ, ছোটো মা। বলবেন না, প্লিজ। আসলে আমার প্রাইভেট আছে, ক’দিন পরেই তো পরীক্ষা। প্রাইভেটে পরীক্ষা চলছে। আজ বিকেলেও আছে। মিস গেলে নিজেরই ক্ষতি।”
গড়গড় করে মিথ্যে বলার চেষ্টা করে প্রত্যাশা। যদিও অল্প ক’দিন পরেই পরীক্ষা। তবে পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার মেয়ে ও কোনোকালেই ছিলো না।
ইচ্ছেকে রেডি করে নীহারিকা বললেন,
-” প্রত্যাশা, নীরব দ্যাখো রুমে আছে। যাবেই যেহেতু তাহলে আর দেরি করার কী দরকার! ইচ্ছের স্কুলের টাইম হয়ে আসছে আবার। নীরবকে বলো, ইচ্ছে রেডি।”
প্রত্যাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইচ্ছের কাঁধে দুই হাত রেখে বলল,
-” ইচ্ছে, তোমার পাপাকে গিয়ে বলো আমরা রেডি।”
ইচ্ছে ঘাড় কাত করে জবাবে ‘আচ্ছা’ বলে।

নীরব ইচ্ছেকে মাঝখানে বসিয়ে দেয়। প্রত্যাশার সামনে ইচ্ছে তারপর নীরব। বাইক ছুটে চলেছে শোঁ শোঁ বাতাসের সাথে। প্রত্যাশার মনে হয়—-এই একদিনেই যেনো দু’জনের মাঝে চীনের মহাপ্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে। এই প্রাচীর ভাঙা কি আদৌ সম্ভব?
বাড়ির গেইটের সামনে বাইক থামায় নীরব। মুখে একটাও কথা নেই। প্রত্যাশা নেমে দাঁড়ায়। ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে মুখে ম্লান হাসি নিয়ে বলে,
-” বাই, ইচ্ছে।”
নীরব সৌজন্যমূলক কিছু বলল না। প্রত্যাশাও অদ্ভুত এক জড়তায় চুপ করে রইল। পা বাড়াতে গিয়েও হঠাৎ থেমে যায় প্রত্যাশা। নীরব আচমকা বলে উঠল,

-” সুস্থ তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, অমনই সুস্থ তোমাকে রেখেও গেলাম। যেটা আমার দায়িত্ব ছিলো।”
প্রত্যাশার পা জোড়া থেমে গেল। ফিরে তাকিয়ে নীরবের চোখে চোখ রাখল। ভেতরের চাপা কষ্ট নিয়ে মিহি কণ্ঠস্বরে বলল,
-” আমি জানি, আমি অনেকের কাছেই বিরক্তিকর। তবুও আজ একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। আমি কি খুব বেশি উচ্ছৃঙ্খল? আমি কি খুব বেশিই বেপরোয়া?”
নীরব নিশ্চুপ, নিরুত্তর। প্রত্যাশার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। ও উত্তরের অপেক্ষাও করল না। প্রশ্নগুলো রেখে ওর মতো চলে গেল। বড় কদম ফেলে লহমায় চোখের আড়ালে।

ইচ্ছেকে বাসায় দিয়ে অফিসে আসতে আসতে নীরবের নয়টা পার হয়ে যায়। নিজের অফিসকক্ষে চেয়ারে গা এলিয়ে চোখবুঁজে বসে নীরব। মনে মনে একের পর এক প্রশ্ন তৈরি করছে। একটা প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর নেই। ভাবছে রীতিমতো—- ছবিগুলো সেন্ড করল কে? ছবির দৃশ্য যা বলছে তা কী সব সত্যি? নাকি আমাকে বিভ্রান্ত করতে কেউ এসব করেছে? আর কে সে? তার উদ্দেশ্যই বা কী?
ঘুরেফিরে একটা নামই মস্তিষ্কে সিগন্যাল দেওয়ার মতো বারবার আসছে। এসবের পিছনে কী— সার্থক?
কারন ওই তো প্রত্যাশাকে পছন্দ করতো। আর ছবিগুলোও তো ওরই সাথে।

নীরব সোজা হয়ে বসল। টেবিলের উপর হাত দু’টো নামাল। টেবিলের উপর থাকা অফিশিয়াল ফাইল খুলতে গিয়েও আজ এক পাশে ঠেলে রাখল। ফোন ওপেন করল। ফাটা গ্লাস কাল রাতের রাগ-ক্ষোভকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলো। নীরব সেই নম্বরে কল করল। ওপাশ থেকে মেয়েলি মিষ্টি গলা এলো,
-” দুঃখিত, কাংখিত নম্বরে সংযোগ প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর ডায়াল করুন।”
নীরব অবাক হলো না। কারন কাল রাতেও কল দিয়ে বন্ধ পেয়েছে। নীরব ত্রস্ত কল লিস্ট থেকে একটা নম্বরে কল লাগাল। রিসিভ হতেই আদেশের সুরে বলল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৭

-” আমি এখনই আপনাকে একটা নম্বর মেসেজ করব। দয়া করে যাচাই করে দেখবেন নম্বরটা কোন আইডির নামে রেজিস্টার করা হয়েছে, কখন কোথায় সিমটা একটিভ হয়েছে। সবকিছু বিস্তারিতভাবে আমাকে জানাবেন। রিপোর্টটা আমার চাই। আই নিড দ্য ফুল রিপোর্ট অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। দিস ইজ আরজেন্ট। নো ডিলেস, প্লিজ।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২৯