প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৬
শার্লিন হাসান
সুপ্রভাতে ঘুম ভে’ঙেছে জাইমার। নামাজ আদায় করে দাদীর রুমে ছুটেছে সে। রাহেলা খান নামাজের জায়নামাজে থাকা কালীন জাইমার আগমন হয়েছে। জাইমা চুপিসারে দাদীর কোলে মাথা রাখে। নাতনির চুপচাপ হয়ে যাওয়াটা রাহেলা খান মেনে নিতে পারেননি। সেজন্য জিজ্ঞেস করেন, “কী হয়েছে আমার বনুর? আজকে চুপচাপ কেন?”
জাইমা মাথা নাড়ায়। কিছু বলেনা। রাহেলা খান জাইমার কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “নতুন বন্ধু পেয়েছ? আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখার ইচ্ছে নেই?”
জাইমা উঠে বসে। রাহেলা খানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “দাদীন, আমি কৌতূহল থেকে তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করলাম। সেজন্য কী তুমি আমাকো শাস্তি দিবে?”
“না। একদম না! কী হয়েছে?”
“জানো গতকাল স্যারকে জিজ্ঞেস করেছি, মেহেরের প্রেজেন্টেশন কবে? সে বলছে, আমি নাকী তার ক্লাসে ডিস্টার্ব করেছি। সেজন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আবার বলেছে, টানা দুইদিন আমি প্রেজেন্টেশন না দিকে আমার মার্ক কাট করে দিবে। ওই গোলামেরপুত যাতে বিয়ে করার জন্য মেয়ে না পায়। শালার! চেহারা সুন্দর সেজন্য এতো এট্টিটিউড? আমারও তো চেহারা ফর্সা,কই আমি তো ভাব নেইনা। সুন্দর করে কথা বলি। ওই স্যারকে জন্মের পর মধু খাওয়ানো হয়নি অ্যাম শিওর। নাহলে ওনার মা ওনাকে কথা বলানো,ব্যবহার কোনটাই ঠিকঠাক শেখায়নি।”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে জাইমা। রাহেলা খান নাতনির অভিযোগ শোনে মুচকি হাসে। জবাবে বলে, “স্যার খুব বাজে কাজ করেছে। আমার জাই এতো ভালো মেয়ে আর তাকে কিনা দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিলো? ভেরি ব্যাড!”
“এই তো দুহাত তোলো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথাটা বলে রাহেলা খানের দু’হাত তুলে মুনাজাত ধরায় জাইমা। পরক্ষণে বলে, “দোয়া করো, ওই প্রফেসরের বউ যাতে একটা উড়নচণ্ডী হয়। আমার থেকেও বেশি। তার জীবন যাতে তেজপাত বানিয়ে দেয়।”
তখন দাদী বলে, “ওই প্রফেসর যাতে আমার জাইমা রানীর মতো সুন্দর মনের মেয়েমানুষ জীবন সঙ্গী হিসাবে পায়।”
“নো! রাহেলা বানু, ওই প্রফেসরের বউ হবে উমমম….আমার মতোন না। তবে আমার থেকেও বেশি দুষ্ট। আমার মতো হলে তো বেটা জিতে যাবে। কত কিউট একটা মেয়ে মৈশানী খানম। এমন বউ চাই, যাতে সে ঠকে।”
“হ্যাঁ ঠিক আছে।”
জাইমা প্রতিত্যুর করে,
“ওই প্রফেসরকে একা পেলে আমি তার মাথা ফাটাব। তুমি মনে রেখো। পারলে ডাইরিতে লিখে রাখো।”
কথাটা বলে দাদীর কপালে ফটাফট কয়টা চুমু খেয়ে জাইমা নাচতে,নাচতে বেরিয়ে যায়। রাহেলা খান জাইমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসে।
রুমে এসে জাইমা লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। যেহেতু আজকে ভার্সিটি যাবেনা সেহেতু অনেক বেলা অব্দি ঘুমানোর পরিকল্পনা জাইমার।
নয়টা নাগাদ জামিলা রেডি হয়ে জাইমার রুমে আসে। লাইট অন করতে দেখে জাইমা গভীর ঘুমে তলানো। জামিলা হাত ঘড়ি দেখে জাইমার কাছে যায়। ডাক দেয়, “জাইমা উঠো। ভার্সিটি যাবেনা?”
জাইমা রেসপন্স করেনা। এভাবে বার কয়েক ডেকে জামিলা জাইমার হাত টেনে ধরে উঠে বসায়। অগোছালো চুল কপালের উপর এলোমেলো হয়ে আছে। জাইমা ঘুমঘুম চোখে মায়ের দিকে তাকায়। জবাব দেয়, “প্রিন্সিপালের দাদী মারা গেছে সেজন্য ভার্সিটি অফ।”
“ফাজলামো ছাড়ো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ভার্সিটি যাও।”
ধমকে বলে জামিলা। ধমক খেয়ে জাইমা মুখটা কুঁচকে নেয়। জবাব দেয়, “যাব না আমি। আমি পড়ালেখা করব না। বিয়ে দিয়ে দাও—প্লিজ।”
জাইমার কথাটা শেষ হতে চোখেমুখে পানি ছুঁড়ে মারে জামিলা। জাইমা ভীতু দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে। জামিলা চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। জাইমা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। ডান হাতের তর্জনী কামড়ে বলে, “তুমি ডেকেছ আমায়? ভেবেছিলাম, স্বপ্ন দেখছি। বিয়ে করব,এরকম কিছু আমি তোমাকে বলিনি। স্বপ্নে বলেছিলাম।”
জাইমা ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। জামিলা চিৎকার করে বলে, “আধঘণ্টার ভেতর রেডি হয়ে, নাশতা খাওয়া কমপ্লিট করবে। আমি নিজে তোমাকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে আসব।”
জামিলা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। জাইমা ড্রেস চেঞ্জ করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নুড কালারের একটা সেলোয়ার-কামিজ পরিধান করেছে। সোজা চুলগুলো মৃদু কার্ল করে দুকাধের উপর রাখা। গলার ডায়মন্ডের লকেট খুলে গোল্ডের একটা চেইন পড়ে নেয়। চেইনের মাথায় ছোট্ট করে M লেখা। টুকটাক তৈরি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে জাইমা। জামিলা সোফায় বসে ফোন স্ক্রোল করছিল। মূলত জাইমার অপেক্ষায় ছিলো সে। জাইমা বিরক্তিমাখা মন নিয়ে নাশতা খেতে বসে। জামিলার তাড়া খেয়ে তার পেট ভরে গেছে। নাশতা তেমন খেতে পারেনি। মায়ের সাথে একই গাড়িতে পাশাপাশি বসে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হয় জাইমা। আগে জামিলার স্কুল এরপর জাইমার ভার্সিটি পড়ে। জামিলার ড্রাইভার জাইমাকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে আসবে।
স্কুল গেটের সামনে গাড়ি থামতে জামিলা নেমে যায়। জাইমা মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে জামিলাকে বিদায় দেয়। এক গাদা বিরক্তি আর অলসতা নিয়ে ভার্সিটিতে আসে।
আজকে জাইমার মন ভালো নেই। এছাড়া ইশরাকের দেওয়া অপমান আর বাঁশ খেয়ে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর যাই হোক ইশরাককে কখনো কোন প্রশ্ন করবে না। আর না,ইশরাকের ক্লাসে উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করবে।
আজকে মেহেরের সাথেও তেমন ভাব জমায়নি জাইমা। চুপচাপ সবগুলো ক্লাস মুড অফ করে শেষ করে।
ক্লাস শেষ হতে একা একা বেরোয়। লিফটের কাছে ভীড় পাবে সেজন্য সবার শেষেই ধীরে,ধীরে হেঁটে সামনে এগোয়। জাইমার একাকিত্বে অবসান ঘটিয়ে আগমন হয় একটা ছেলের। সে ছেলেটাকে জাইমা সেদিন দেখেছিলো। যেদিন ইশরাক তার গাড়ির গ্লাস ভেঙেছে। ছেলেটা এসেই জাইমার পাশে দাঁড়ায়। জাইমা ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে ছেলেটা হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, “আরশান শিকদার।”
জাইমা মাথা নাড়িয়ে বলে, “মৈশানী খানম জাইমা।”
“নামটা ভীষণ সুন্দর এবং ইউনিক।”
“জ্বী ধন্যবাদ।”
“কোন ইয়ার?”
“ফার্স্ট।”
“থার্ড ইয়ার।”
“সিনিয়র। বাট আপনি এভাবে আমার সাথে কথা বলছেন?”
“ওমাহ্ কথা বলা যাবেনা?”
“না! সিনিয়রদের ভাবটাই তো আলাদা থাকে। সেখানে আপনি আগ বাড়িয়ে পরিচিত হচ্ছেন?”
“আমার বাবা হয়ত তোমার বাবার ভালো বন্ধু। তোমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার রিজন অবশ্যই আছে।”
“কী?”
“তোমাকে আমি আগে দেখেছিলাম। মানে আগে থেকে চিনতাম তবে নাম জানতাম না। হুট করে একদিন দেখলাম গাড়ি নিয়ে এসেছ। প্রথম দেখায় চিনতে ভুল হয়নি।”
“ওয়াও! কী সুন্দর ব্যপার। আপনি আমায় আগে থেকে চিনতেন অথচ আমি চিনতাম না।”
“হ্যাঁ। তুমি ভীষণ মিশুক এবং মিষ্টি একটা মেয়ে মিস..
” জাইমা।”
আরশানকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে কথাটা বলে জাইমা। জাইমার কথায় আরশান তাল মিলিয়ে বলে, “হ্যাঁ, মিস জাইমা।”
জাইমা মাথা নাড়িয়ে বিদায় নেয়। লিফটের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে আরেকটা মেয়েও দাঁড়ানো। জাইমা তাকে দেখে হাত নাড়িয়ে বলে, “হাই।”
জাইমাকে দেখে ইশরাত জবাব দেয়, “হ্যালো।”
জাইমা নিজেই আগ বাড়িয়ে বলে, “কোন ইয়ার?”
“থার্ড। তুমি?”
“ফার্স্ট। মৈশানী খানম।”
“ইশরাত খানম।”
“ওয়াও! দু’জনেই খানম।”
“হ্যাঁ।”
ইশরাতের কথায় জাইমা হাসে। পরক্ষণে বলে, “এ্যাই তুমি প্রফেসর ইশরাক খানকে চেনো?”
“হ্যাঁ আমার…
” আস্ত শয়তান একটা। উনি এরকম ব্যবহার নিয়ে কী করে প্রফেসর হয়েছে সেটাই ভাবছি। মানুষ এরকমও হয়? গোমড়ামুখে একটা। একে দেখলেই আমার রাগ হয়। মাঝেমধ্যে তো ইচ্ছে করে মাথাটাই ফাটিয়ে দেই। আচ্ছা, তুমি বলো মানুষের কৌতূহল থেকে একটা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে, তাই বলে তুমি তাকে শাস্তি দিবে? কখনোই না। কিন্তু ওই গোমড়ামুখো বুড়োটা কী করলো? আমায় আধঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখলো? এই শোনো, আমার সাথে তুমিও দোয়া করো, ওই গোমড়ামুখে প্রফেসর ইশরাককে এক ফেলে আমি যাতে তার মাথা ফাটাতে পারি। প্লিজ,প্লিজ। এটা এখন আমার ড্রিম হয়ে গেছে।”
জাইমা এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামতে দেখে তাঁদের লিফট খালি। ইশরাতের সাথে লিফটে প্রবেশ করে দাঁড়াতে দেখে ইশরাকও লিফটে প্রবেশ করছে। জাইমার হাসিমাথা মুখখান নিষ্প্রভ হয়ে যায়। জাইমা আলগোছে লিফটের সাথে হেলান দিয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকায়। ইশরাত মুখটা গম্ভীর করে নিয়েছে। এই মেয়ে বড্ড বাচাল! এক মিনিটে তার মাথা উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে। তাও তার ভাইয়ের নামে নালিশ করে। মেয়েটা যদি জানত, সে প্রফেসরের বোনের কাছে নালিশ করছে তাও প্রফেসরের উপস্থিতিতে। কিন্তু মেয়েটার তো দিনদুনিয়ার খবর নেই। ইশরাক ইশরাতকে বলে, “এতো তাড়াহুড়োয় আসতে কে বলেছে?”
কন্ঠস্বরে রাগ স্পষ্ট। ইশরাত বুঝে জাইমার বকবকানি তার পছন্দ হয়নি। জাইমা হতাশ হয়ে সামনে তাকায়। ইশরাকের রাগী কন্ঠ তার কানে বারি খেয়েছে। ইশরাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। তার চোখমুখ শক্ত। ইশরাত তড়িঘড়ি জবাব দেয়, “বুঝতে পারিনি।”
“পাবলিক প্লেসে সবার সাথে কথা বলে পরিচিত হতে নেই। সবসময় ভালো মানুষের পরিচয় জুটে না। মাঝেমধ্যে পাগলের পরিচয়ও জুটে। সো —বি কেয়ারফুল।”
ইশরাকের কথায় জাইমা হা হয়ে যায়। ইশরাক তাকে ইনডিরেক্টলি পাগল উপাধি দিলো? আয়হায়! তার মান সন্মান আর কিছু অবশিষ্ট আছে? জাইমা চোখমুখ খিঁচে ডান হাতের আঙুলে চুল পেঁচাতে থাকে। তারা তিনজন লিফট থেকে বের হয়। প্রথমে ইশরাক এরপর ইশরাত শেষে জাইমা। জাইমা বেরুতে শোনে ইশরাত, ইশরাককে ডেকে বলছে, “ভাইয়া শোনো?”
জাইমা ভীতু চোখে তাকায়। জিভে কামড় বসায়। এতোক্ষণ বোনের কাছে ভাইয়ের বদনাম করলো? ছিঃ! ছিঃ!
জাইমা এখন তো পাবলিক প্লেসেও সবার সাথে কথা বলা যাবেনা।
জাইমা কপাল চাপড়াতে,চাপড়াতে ভার্সিটির প্রাঙ্গণ ছাড়ে। তখন মনে পড়ে, আগামী কালকে তার প্রেজেন্টেশন আছে। কিন্তু সে তো ইংলিশ ভালো পারেনা। কী করা যায়? এখন তো একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। এছাড়া উপায় নাই।
ইশরাক গাড়িতে বসে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। ইশরাত এসে পাশের সীটে বসে। কল দেয় পোহাকে। তারা দু’জন একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। ইশরাক জয়েন করেছে ছয়মাস হলো। ইশরাক গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সামনে তাকায়। ইশরাত কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা। তখন ইশরাক চোয়াল শক্ত করে বলে, “ওই মেয়েটার সমস্যা কোথায় গড নোজ! যখন যাকে পাচ্ছে,যার কাছে পাচ্ছে আমায় নিয়ে উল্টাপাল্টা বলেই যাচ্ছে। ইট’স অকে বাকীদের কাছে বলো। তাই বলে আমার বোনের কাছেও? স্ট্রেঞ্জ!”
প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৫
“আরেহ ভাইয়া বাদ দাও। মেয়েটাকে দেখেই বুঝা যায়, অল্পবয়সী বুদ্ধি জ্ঞান তেমন হয়নি। পুরো ইমম্যাচিউর। তবে বেশ মিশুক আছে। যাই বলো, এরকম মানুষের মন ভালো হয়।”
“এক্সকিউজ মি! তুমি ওই ড্রামা ফ্যাক্টরীর করা ড্রামাকে প্রশংসার কাতারে ফেলছ?”
“না। ও মনে হয় উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করে বেশি।”
ইশরাক জবাব দেয়না। বোনের কথা কানেও তোললেও ভাবেনা। পোহা আসতে তারা রওনা হয় খান বাড়ির উদ্দেশ্যে।