প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৭
শার্লিন হাসান
আজকে জাইমার প্রেজেন্টেশনের দিন। টানা দুইদিন সে প্রেজেন্টেশন দিবে। গতকাল রাত কোনকিছুই রেডি করেনি সে। উল্টো সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে নিয়েছে। রুপার ডাকা ডাকিতে তার ঘুম ভেঙেছে। জাইমা উঠতেই দেখে ঘড়ির কাটা দশটার ঘর ছুঁতে বেশিক্ষণ বাকি নেই। কোনরকম রেডি হয়েছে। চুলগুলোও ঠিকঠাক আচড়ায়নি সে। জামা চেঞ্জ করে ব্যাগ নিয়ে চিরুনি হাতে দৌড় দিয়ে গ্যারেজে ছুটেছে। ড্রাইভারকে বলে, গাড়ি নিয়ে বেরোয়।
গাড়িতে বসেই চুলগুলো কোনরকম ঠিক করে নেয়। চিন্তায় ডান হাতের তর্জনী আঙুল কামড়াচ্ছে সে। ভাগ্য ভালো থাকায় বেশি জ্যাম পড়েনি। জাইমা ঝড়ের গতিতে ভার্সিটিতে আসে।
জাইমা ভার্সিটি আসার বিশ মিনিট আগে ক্লাসে প্রবেশ করেছে। এসেই জাইমার অস্তিত্ব পায়নি ইশরাক। সেজন্য শিডিউল ছাড়াই একজনকে দিয়ে প্রেজেন্টেশন করিয়েছে। যখন তার ক্লাসে প্রায় শেষের দিকে, বেরুনোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে দরজার সামনে আসে। দুকদম এগিয়ে যেতে ইশরাক থমকে যায়। জাইমা সে যে দৌড় লাগিয়েছে, এখন মনে হয়না থামতে পারবে। যার দরুন এসেই ইশরাকের বুকের সাথে ধাক্কা লাগে। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে ইশরাক ধরেনা। বরং দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে রয়। জাইমা নিচে পড়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। চোখ মেলে তাকাতে ইশরাকের রাগী চেহারাটা দৃশ্যমান হয়। জাইমা কোনরকম উঠে দাঁড়ায়। গা ঝাড়া দিয়ে বলে, “স্যরি স্যার।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইশরাক আশেপাশে তাকিয়ে নিজের রাগ দমায়। জাইমা উঠে দাঁড়ালে ইশরাক জিজ্ঞেস করে, “আজকে আপনার প্রেজেন্টেশন ছিলো।”
“জ্বী স্যার। কিন্তু আমার বাবা গতকাল রাতে অসুস্থ হয়ে হসপিটালে এডমিট হয়। আপনাকে আগে বলেছিলাম না? আমরা গরিব তো বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করতে করতে দেরি হয়ে গেছে। এখন এসেছি, হসপিটাল থেকেই। সেজন্য আজকে প্রেজেন্টেশন দিতে পারিনি।”
কথাটা বলো জাইমা কাঁদো কাঁদো মুখ করে নেয়। ইশরাক জাইমার কান্না মিশ্রিত চেহারা দেখে কী বলবে ভেবে পায়নি। জাইমা এমন একটা ভাব করছে, জেনো সত্যি বলছে। ইশরাক সেই সত্যি বিশ্বাস করতে বাধ্য। তখন ইশরাক জাইমার দিকে তাকায়। নজরে আসে গলার লকেট চেঞ্জ হয়েছে। ডায়মন্ডের জায়গায় গোল্ডের লকেট। ইশরাকের চাহনি দেখে জাইমা নড়েচড়ে উঠে। চুল ঠিক করার বাহানায় লকেট লুকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু ইশরাক জাইমার হাতের ঘড়িটার দিকে আবারো নজর দেয়। সেই একই ঘড়ি এখনো। তবে তার ধারণা এতোটাও নড়বড়ে নয়। ঘড়িটা ভীষণ এক্সপেন্সিভ। আর এটা দেশের না। বাহিরের দেশের। যেটা নিয়ে সে গুগলে সার্চ অব্দি করেছে। এমাউন্টও বিশাল। কিন্তু জাইমা তো বলেছে ফুটপাত থেকে নিয়েছে। হলেও হতে পারে। এদেশে ডুপ্লিকেট অনেক প্রোডাক্টই কম দামে পাওয়া যায়। জাইমা ইশরাকের খুঁচিত দৃষ্টিতে নড়েচড়ে দাড়াতে ইশরাক জাইমার মুখপানে চেয়ে বলে,
“কিন্তু এসব কোন এক্সকিউজ হতে পারে? আপনি ভার্সিটির রুলস ভুলে গেছেন।”
“কিন্তু আপনাকে তো আমি একজন দয়ালু, নরম মনের মানুষ হিসাবে জানি। এতোটুকুও কন্সিডার করবেন না?”
“মিস…
” জাইমা।”
ইশরাককে থামিয়ে দিয়ে বলে জাইমা। ইশরাক থেমে পুনরায় বলে,
” মৈশানী খানম আপনি কিন্তু পড়াশোনা সিরিয়াস নিচ্ছেন না।”
“এরপর থেকে সিরিয়াস নেব। বিশ্বাস করুন।”
“ঠিক আছে। তাহলে আগামী কালকে প্রেজেন্টেশন দিবেন।”
জাইমা খুশি হয়ে বলে “জ্বী স্যার অবশ্যই।”
“আপনার বাবা কোন হসপিটালে এডমিট আছে?”
জাইমা বিপাকে পড়ে যায়। তেমন হসপিটালের নাম সে জানেনা। সেজন্য আন্দাজি ঢিল মেরে বলে, “আ দিয়ে নাম। খেয়াল করিনি।”
ইশরাক ভ্রুদয় প্রসারিত করে নেয়। জাইমা মাথা নাড়িয়ে বলে, “থ্যাঙ্কিউ স্যার।”
ইশরাক জবাব দেয়না। জাইমা নিজের ক্লাসে ঢুকে মেহেরের পাশের সীটে বসে। জিজ্ঞেস করে, “আজকে কে প্রেজেন্টেশন দিয়েছে?”
“একটা ছেলে।”
“যাক বাবা।”
“তুমি আসোনি কেন? স্যার তো মার্ক কেটে দিবে।”
“নো বেইব। স্যারকে পটিয়ে নিয়েছি….
থেমে
ওই আজকের প্রেজেন্টেশন নিয়ে। স্যার বলেছে, আগামী কালকে দেওয়ার জন্য।”
“কীভাবে কী হলো?”
“ওই বাবা হসপিটালে ভর্তি, আমরা তো গরিব সেজন্য বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে,করতে দেরি হয়ে গেছে।”
“কিন্তু প্রফেসররা তো এতো কিছু জানতে চায়না।”
“উনি ভালো। সেজন্য…
কথাটা বলতে গিয়ে থামে জাইমা। মেহের ভ্রু কুঁচকে বলে, ” কী?”
“ওয়েট, ওনার মতো গোলামেরপুতকে আমি ভালো বলছি?”
“সখি, ইশরাক খান মর্ম! নামটাতে আলাদা একটা ব্যপার আছে। উনি দেখতেও ভীষণ হ্যান্ডসাম। ক্রাশ খাওয়ার মতো। সেখানে তোর সাথে ঝামেলা যাই হোক দিনশেষে তোর মিথ্যে বিশ্বাস করে তোকে ছাড় দিচ্ছে। মানে তোর জন্য একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে। এখন এটাকে কাজে লাগিয়ে নে।”
“মানে?”
আলাভোলার মতো জবাব দেয় জাইমা। মেহের পুনরায় বলে, “ওনাকে ইমপ্রেস কর।”
“আসতাগফিরুল্লাহ। জীবনেও না। এরকম গোমড়ামুখো মানুষ আমার সহ্য হয়না।”
“বিয়ের পর তুই নাহয় তাকে ঠিক করে নিবি। এমনিতেও ছেলে খুঁজছিস।”
“কিন্তু তার চেয়ে বেটার আমার কাজিনকেই বিয়ে করে নিই।”
“ধুর মহিলা।”
“আচ্ছা ওকে। আজকে থেকে আমি প্রফেসর ইশরাক খানকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করব।”
“হ্যাঁ।”
জাইমা মাথা নাড়ায়। বুদ্ধিটা খারাপ না। তবে সেটা স্বল্প সময়ের জন্য। যেকোন সময় মন মর্জি চেঞ্জ হলে সে ইমপ্রেস নাও করতে পারে। কিন্তু ইশরাককে চোখের দেখায় সবারই ভালো লাগবে। একে তো বেটা ফর্সা। তারউপর গম্ভীর! সবসময় ইন করে আসে।
জাইমা এসব ভেবেই তওবা পড়ে। ছি!ছি! আরেক জনের শোয়ামির দিকে বাজে নজর দিচ্ছে সে।
ক্লাস শেষের দিকে জাইমাকে ডেকে পাঠানো হয়। জাইমা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর ক্লাস করবে না সে। বাইরে আসতে দেখে তার বাবা এসেছে। জাইমা বাবাকে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। তার বাবা তো হসপিটালে থাকবে। কিন্তু তার ভার্সিটিতে কেন? জাইমা বলে, “তুমি আজকে আসতে গেলে কেন?”
“কেন কোন সমস্যা?”
“সমস্যা মানে? তুমি কেন এসেছ?”
“আমার পরিচিত একজন প্রফেসরের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিতে।”
“তার নাম?”
“ইশরাক…
সাজ্জাদ খানকে থামিয়ে দিয়ে জাইমা বলে, ” না,না। ওনাকে আমি চিনি। উনিও আমাকে চিনে।”
কথাটা বলে জাইমা চোখমুখ বন্ধ করে নেয়। পেটে হাত দেয়। আবার মাথায় হাত দেয়। একটু পর আবার পিঠে হাত দেয়। সাজ্জাদ খান মেয়ের অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে যান। জিজ্ঞেস করেন, “কী হয়েছে মা?”
“বাবা, আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি গাড়িতে গিয়ে বসলাম। তুমি কথা শেষ করে এসো।”
“তুমি সহ আসো?”
“না না বাবা। আমার শ্বাস প্রশ্বাস ঠিক করার জন্য এখন প্রকৃতির নির্মল অক্সিজেন চাই। বিল্ডিংয়ের গরম অক্সিজেন না।”
“মৈশানী, দেখা করেই চলে আসবে। চলো?”
জাইমা এক পা এগিয়ে আবার কোমড়ে হাত রাখে। বলে, “বাবা পায়েও ব্যাথা করছে।”
“তুমি ফাঁকি বাজি করছ?”
“না বাবা। আমি গেলাম। এই মূহুর্তে প্রকৃত অক্সিজেন না পেলে তোমার মৈশানী পটল তুলতে চলে যাবে।”
কথাটা বলে দৌড় লাগায় সে। সোজা লিফটে প্রবেশ করে। সাজ্জাদ খান মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলেননা। ইশরাকের রুমের দিকে রওনা হোন।
সাজ্জাদ খানকে দেখে ইশরাক এগিয়ে আসে। কুশলাদি বিনিময় করে বলে, “চাচ্চু, হুট করে আসলে? সারপ্রাইজিং ব্যপারস্যপার।”
হেঁসে বলে ইশরাক। এই হাসিটা খুব একটা দেখা যায়না। সাজ্জাদ খান ইশরাককে দেখে বলে, “খুব ভালো লাগছে দেখা হয়ে। আমার মেয়ে এই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে।”
“ওয়াও! দারুণ খবর তো। ইশরাতও এখানেই পড়াশোনা করছে।”
“ইশরাতের সাথে দেখা হলোনা তো।”
“আপনার মেয়ে কোথায়?”
ইশরাকের কথায় সাজ্জাদ খান কিছুক্ষণ আগে জাইমার করা এক্টিংয়ের কথা ভাবেন। এতো পরিমান ফাঁকি বাজ মেয়েটা। সাজ্জাদ খানকে চুপ দেখে ইশরাকের হাসি থেমে যায়। পুনরায় বলে, “কিছু হয়েছে?”
“ও অসুস্থ।”
“ওহ্! ঠিক আছে, ওকে নিয়ে বাড়িতে আসবেন। দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।”
“তুমি বেরুবে?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
ইশরাক সাজ্জাদ খানের সাথে কথা বলতে,বলতে বেরোয়। দু’জন পার্কিং লডে এসে থামে। সাজ্জাদ খান গাড়ির কাছে আসতে দেখে জাইমা সীট বেল্ট পড়ে ঘুমাচ্ছে। মুখের উপর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ইশরাককে আর ডাক দেননি তিনি। হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে যায় গাড়ি নিয়ে।
রাস্তার মাঝামাঝিতে আসতে জাইমা চোখ মেলে তাকায়। সাজ্জাদ খানকে বলে, “তোমার পরিচিত প্রফেসরের সাথে দেখা করেছ?”
“হ্যাঁ।”
জাইমা জবাব দেয়না। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয়। একটুর জন্য কট খায়নি সে। নাহলে কত বড় বাঁশ খেতো ধারণার বাইরে ছিলো।
বাসায় আসার পর থেকে জাইমার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হলো ইশরাককে ইমপ্রেস করার ব্যপার। কিন্তু এসব তো অনেক ঝামেলার। যদি ইশরাক তার পরিচয় জেনে তাকে রিজেক্ট করে দেয়? নাহ্! যদি ইশরাকের গার্লফ্রেন্ড বা বউ থাকে? তাহলেও তো জাইমা রিজেক্ট হবে। এতোদিন যেহেতু প্রেম করেনি, এখনও করবেনা। বরং অন্য কেউ তার পেছনে ঘুরলে সে ভেবে দেখবে। যদি ভালো ছেলে হয় এক্সেপ্ট করে নিবে।
নেচে-গেয়ে দাদীর রুমে যায় জাইমা। এসেই দাদীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “দাদী শোন?”
“কী হয়েছে?”
“আমি না একটা ছেলে পেয়েছি বিয়ে করার জন্য।”
“ওমাহ কী বলো? কিন্তু তোমার বিয়ে তো মর্মর সাথে দেব।”
“উফফ রাখো তোমার মর্ম। আমি যাকে পেয়েছি সে তোমার মর্ম কর্মকেও ছাড়িয়ে। একবারে উপরের ধাপে! কী বলব দাদী। তুমি কী সুন্দর নাতিন জামাই পেতে চলেছে।”
জাইমার কথায় রাহেলা খান বলেন,
“তুমি তাহলে প্রেম করছ?”
“আমি প্রেম করিনা তবে একজন আছে।”
“কী করে সে?”
“আপাতত আমায় ইগনোর করে।”
“কীহ?”
“আরে হ্যাঁ! বেটা আমাকে খুব একটা দেখতে পারেনা তবে কোথাও গিয়ে আমার কথা মানছে। বিশ্বাস করছে। কিন্তু ইগনোরের মতো ব্যপারস্যপারও আছে।
প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৬
“তুমি তাহলে প্রেম করছ?”
“আমি প্রেম করিনা তবে একজন আছে।”
“কী করে সে?”
“আপাতত আমায় ইগনোর করে।”
“কীহ?”
“আরে হ্যাঁ! বেটা আমাকে খুব একটা দেখতে পারেনা তবে কোথাও গিয়ে আমার কথা মানছে। বিশ্বাস করছে। কিন্তু ইগনোরের মতো ব্যপারস্যপারও আছে।”
জাইমার কথায় মনোযোগ দেননা রাহেলা খান। সকালে একরকম বিকেলে আরেক রকম। একটু পর আবার শোনবে, কেউ নাই। প্রেম ভালোবাসা সে করবেনা।