প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৮
শার্লিন হাসান
জাইমা কিছুক্ষণ বকবক করে রুমে চলে আসে। যেহেতু আগামী কালকে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে কিছু তো করতে হবে। অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে প্রেজেন্টেশন রেডি করে। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখে টা মনে রাখা অসম্ভব। তারউপর সে তেমন ভালো ইংরেজি পারেনা। ভুলভাল বললে ইশরাক ভুল ধরবে। তারপর সবার সামনে লজ্জা দিবে।
জাইমা অনেকক্ষণ ভেবে চিন্তে ইশরাকের ফোন নাম্বার রেডি করে। রুপাকে দিয়ে একটা ব্যবস্থা করাবে ভেবে সে উঠলে দেখে তার রুমে প্রবেশ করেছে রাহেলা খান। জাইমা দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে, “কীগো? নতুন খবর আছে নাকী?”
“আগামী কালকে তুমি আমার সাথে তোমার জ্যাঠুর বাসায় যাবে।”
“কেন?”
“মর্মর সাথে দেখা করাব তোমায়। তুমি বলছিলে না আমার নাতির থেকেও ভালো ছেলে পেয়েছ। অসম্ভব! আমার নাতি লাখে একজন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“অবশ্যই ভালো ছেলে পেয়েছি। তোমার নাতির থেকে।”
“আমার নাতি বউকে ভীষণ আদর করবে। তার সব কথা শোনবে।”
দাদীর কথায় জাইমা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। কল্পনা করছে, তার বর মর্ম তাকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে, “মৈশানী তোমার পড়াশোনা করতে হবেনা। তিনবেলা আমার আদর নিবা। পড়াশোনা কী ভালো মানুষ করে? যাদের কোন কাজ নাই তারাই করে। তোমার তো অনেক অকাজ আছে। কীভাবে কাকে জ্বালানো যায়।”
দাদী জাইমার মুখপানে চেয়ে থাকেন। জাইমা লাফ দিয়ে উঠে দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি রাজী দাদী।”
“এই তো। আগামী কালকে ছেলে দেখবে এরপর তোমার বিয়ে।”
“বাবা রাজী না হলে আমি বিয়ে করব না।”
“তোমার বাবা বাধ্য।”
“আচ্ছা আমি আসছি।”
কথাটা বলে ফোন হাতে রুপার রুমে ছুটে জাইমা। রুপাকে বসে থাকতে দেখে সে খাটের উপর বসে। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে আবারো লাফ দিয়ে খাটের উপর বসে রুপার দু কাধে হাত রেখে বলে, “রুপা বেইব, আমি মনে হয় বেশিদিন বাঁচব না।”
কথাটা বলে সে ভঙ্গিমা করো। রুপা ভ্রু কুঁচকে বলেন, “আবার কী হলো?”
“আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করবে?”
“তুমি পাগল? শেষ ইচ্ছে আবার কী?”
“প্লিজ,প্লিজ তুমি আমার আম্মুর ক্যারেক্টার প্লে করে একজনের সাথে কথা বলবে।”
“কীহ?”
“হ্যাঁ। ওই যে বললাম করলার জুশ গোলামেরপুত, ওই প্রফেসরকে কল দিয়ে বলবে, মৈশানী অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি। আগামী কালকে সে ভার্সিটি যেতে পারবেনা। তার প্রেজেন্টেশন বাতিল করে দিবেন তবে মার্ক —কাট করবেন না।”
“কীহ্? তুমি এসব কী বলছ?”
“আমার শেষ ইচ্ছে—প্লিইইজ।”
কথাটা বলে জাইমা ইশরাকের ফোনে কল দেয়। দুবার কল দিলে ব্যস্ত দেখায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার কল দিকে ইশরাক রিসিভ করে। রুপার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে জাইমা দুই হাঁটুর উপর থুঁতনি রেখে বসে। রুপা নিজেকে স্বাভাবিক করে ভারী কন্ঠে বলে, “আসসালামু আলাইকুম।”
ইশরাক জবাব দেয়, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। জ্বী—কে বলছেন?”
“আমি মৈশানী খানমের মা বলছি।”
ইশরাক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “জ্বীবলুন?”
জাইমা বিছানায় গড়াগড়ি খেতে,খেতে ইশারা করছে রুপাকে। রুপা জাইমার দিকে তাকিয়ে বলে, “মৈশানী অসুস্থ হয়েছে হসপিটালে এডমিট। সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি হসপিটালে নেওয়া হলে ডক্টর ইমার্জেন্সিতে রাখে তাকে। আগামী কালকে নাকী ওর প্রেজেন্টেশন? আপনি যদি ওর দিকটা বিবেচনা করে মার্কস দিয়ে দিতেন।”
ইশরাক রাশভারি গলায় বলে, “ঠিক আছে—মিস মৈশানী খানৃ সুস্থ হলেই প্রেজেন্টেশন দিবেন। ভার্সিটির নির্দিষ্ট রুলস আছে। আমি সেটা ব্রেক করতে পারব না।”
“ঠিক আছে স্যার।”
ইশরাক কল কেটে দেয়। জাইমা উঠে রুপার কাছে যায়। রুপার হাত দু’টো নিজের গলায় নিয়ে বলে, “প্লিজ আমাকে মেরে ফেলো। ওই প্রফেসর আমাকে দিয়ে প্রেজেন্টেশন নিয়ে ছাড়বে। আমি ইংলিশ পারিনা।”
রুপা হাত সরিয়ে বলে, “তুমি শিখে নেও তাহলেই তো হয়।”
“পারব না।”
কথাটা বলে জাইমা দৌড়ে দাদীর রুমে যায়। গিয়েই ফ্লোরে ধপ করে বসে বলে, “দাদী আনি আগামী কালকেই বিয়ে করব। প্লিজ তুমি সব ব্যবস্থা করো।”
“আরেহ না। এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে? এখনো তো কথাবার্তা কিছুই ফাইনাল হয়নি।”
“ওই প্রফেসর আমায় বাঁচতে দিবে না। দাদী আমি মারা যাব। মরার আগে প্রফেসরের মুখটাও আমি দেখব না।”
“কী হয়েছে?”
“আমি বলেছিলাম না? একটা ছেলে আছে মানে আমার পছন্দের সেটা প্রফেসর। কিন্তু এখন থু! ওই প্রফেসরকে আমি দেখতে পারিনা। মানে ওর কথা মনে পড়লে এখন মাথায় আগুন জ্বলে। ওর পেছনে আমি লাইন লাগাইনি,লাগাবোও না। ওর মতো কাঠখোট্টাকে বিয়ে করবে কে? আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছে নাহলে ওই প্রফেসর আমাকে পড়ালেখা করিয়ে মেরে ফেলতো। দাদী তোমার নাতিকে বলো তাড়াতাড়ি আসতে। আমি বিয়ে করব।”
জাইমা কথাগুলো বলে হাঁফাতে থাকে। রাহেলা খান জাইমার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলেন, “এই না আমার নাতিকে তোমার পছন্দ না। তোমার প্রফেসর আছে।”
“না,না তোমার নাতি আমার সব। প্রফেসরকে আমি দেখতে পারিনা। অসহ্য! আল্লাহ বাঁচিয়েছে আমায়।”
জাইমার কথায় রাহেলা খান কিছু বলেননা। সবাই যখন ডিনার করতে বসে রাহেলা খান সাজ্জাদ খানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আগামী কালকে আমি আর জাইমা মর্মদের বাসায় যাব। সব ঠিকঠাক থাকলে, ওদের বিয়ের দিন-তারিখ ফেলব। তোমার কোন আপত্তি আছে?”
সাজ্জাদ খান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “ছেলে হিসাবে মর্ম ভালো তবে আমি চাচ্ছিনা এই সম্পর্ক ঠিক করতে। আমার মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দেব।”
“সাজ্জাদ! তোমার বাবা ওদের বিয়ে ঠিক করে গেছে। ভুলে গেছ?”
“এসব তো অতীত! যেই অতীতে আমরা দু’ভাই ছিলাম। এখন আমার কোন ভাই নেই।”
“তুমি সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে না পারলেও আমি পারি। আমার দুই ছেলে এবার সব অভিমান ভেঙে এক হবে। আমার মর্ম এবং জাইমার বিয়ের মাধ্যমে।”
সাজ্জাদ খান জবাব দেননা। জাইমা লজ্জা পাওয়ার ভাণ ধরে। ভেতরে,ভেতরে সে ভীষণ খুশি। জামিলা জাইমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলেন, “তোমার আগামী কালকে ভার্সিটি আছে?”
জাইমা না বোধকে মাথা নাড়ায়। দাদীর দিকে ইশারা করে। পরক্ষনে বলে, “মর্ম ভাইয়াকে দেখতে যাব।”
সাজ্জাদ খান মেয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। জাইমা থতমত খেয়ে বলে, “দাদীর ছেলের বাসায় যাব।”
সকাল দশটা থেকে জাইমা রেডি হচ্ছে। একটা পাকিস্তানি নরমাল থ্রিপিস গায়ে জড়িয়েছে সে। কানে সাদা পার্লের ঝুমকা। গলায় ডায়মন্ডের লকেট। হাতে তার পছন্দের ব্র্যান্ডের ঘড়ি। চুলগুলো আজকে সোজাই রেখেছে। একদম সিম্পল ভাবে তৈরি হয় জাইমা। ফোন হাতে দাদীর রুমে যেতে দেখে দাদী রেডি। জাইমাকে দেখে রাহেলা খান বলেন, “আমার নাতি তোমাকে দেখবে, প্রথম দেখায় তার মনে ফুল ফুটাতে হবেনা? কী মেন্দা কালারের লিপস্টিক দিয়েছ? দিবা লাল টকটকে লিপস্টিক। মেকআপ ও তো করোনি। এতো সাদাসিধা জামা পড়েছ কেন?”
“সরো! আমি কী কম সুন্দর নাকী? তোমার থেকেও বেশি। যা হয়েছে তাই সুন্দর। লাল লিপিস্টিক আমি দেইনা। বুঝেছ বুড়ি?”
জাইমার কথায় দাদী হেসে দেয়। দু’জন একসাথে গাড়িতে বসে। ড্রাইভার তাদেরকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।
ঘড়ির কাটা এগারোটা ছুঁয়েছে। জাইমা একটা রাজকীয় বাড়ির গেটের সামনে পা রেখেছে। দেওয়ালটা শ্বেত রঙের। ডিজাইনে একদম রাজকীয় ভাব। নাম প্লটে লেখা, “খান মহল” রাহেলা খানের ব্যাগ ড্রাইভার ভেতরে নিয়ে যায়। জাইমা দেওয়ালের দিকে তাকাতে, তাকাতে রাহেলা খান ভেতরে চলেও গেছে। জাইমা আস্তে ধীরে বিশাল গার্ডেনে আসে। দু’পাশে ওয়াটার ফাউন্টেন। জাইমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসতে সেই ওয়াটার ফাউন্টেনের সামনে উঁকি ঝুঁকি মেরে পানি হাত নেয়। কিছুক্ষণ পানিতে থাপ্পড় দেয়। পানি হাতে নিয়ে চারপাশে ছিঁটাতে একটা পার্সিয়ান ডগ ঘেউ ঘেউ করে উঠে। মূলত, তার শরীরে পানি ফেলেছো জাইমা। জাইমা কুকুর দেখে এক চিৎকার দিয়ে বলে, “ওই কুত্তার বাচ্চা সর এখান থেকে।”
কিছুক্ষণ তাড়ানোর চেষ্টা করলেও কুকুরটা যায়না। উল্টো জাইমা সামনে হাঁটলে কুকুরটা পিছু নেয়। এক পর্যায়ে সে দৌড় দিলে দেখে কুকুরও তার পেছনে দৌড়াচ্ছে। জাইমা এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে যায়। এতো জোরে দৌড় দিয়েছে যে থামতে, থামতে আরেকজনের সাথে ধাক্কা লেগে তার হাতে থাকা গরম কফি সামনের ব্যক্তির গায়ে পড়ে যায়।
রাজিয়া আহমেদ ইশরাককে কফি দিচ্ছিল, এমন সময় জাইমা এসে তাকে ধাক্কা দিতে কফি গিয়ে ইশরাকের গায়ে পড়ে। এতো জোরে ধাক্কা লেগেছে যে রাজিয়া আহমেদের পিঠ বোধহয় আর নেই। ইশরাকের গায়ে গরম কফি পড়ায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠে। হাত দিয়ে গরম কফি টিশার্ট থেকে ঝাড়ে। তখন পোহা টিস্যু হাতে এগিয়ে আসে। নিজে ইশরাকের টিশার্ট মুছে দেয়। এদিকে রাগে চোয়াল শক্ত করে নেয় ইশরাক।
রাজিয়া আহমেদ হাতে থাকা ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে কোমড়ে হাত রাখেন। জাইমা অপরিচিত এতোগুলা মুখ দেখে নার্ভাস হয়ে যায়। রাহেলা খান জাইমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি দৌড় দিলে কেন?”
জাইমা ডান হাতের তর্জনী ঠোঁটের সামনে ধরে বলে, “কুত্তার বাচ্চা তাড়া করেছে।”
তখন ইশরাত জবাব দেয়, “ওটা তো ভাইয়ার বাচ্চা।”
জাইমা ইশরাতকে দেখে অবাক হয়ে বলে, “কীহ্? কুকুর কী করে মানুষের বাচ্চা হয়?”
“ভাইয়া আদর করে ওকে নিজের বাচ্চা বলে।”
“তাহলে ঠিকই বলেছি।”
তখন ইশরাক মৃদু চিৎকার করে বলে, “মিস মৈশানী খানম আপনি আমার বাসায়?”
জাইমাও ঢঙ দেখিয়ে বলে, “ওমাহ্? আমি আপনার বাসায়? কী করে?”
সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। জাইমার এতোক্ষণে টনক নড়েছে। ইশরাতের ভাইটা আসলে কে? ইশরাক আজকে ভার্সিটি যায়নি। তবে জাইমাকে দেখে সে কথা বলতে ভুলে গেছে। জাইমা সবার দিকে একনজর তাকিয়ে ইশরাকের দিকে তাকাতে দেখে বেটা হা হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে জাইমার পাণে। জাইমার মনে পড়েছে, সে রাজিয়া আহমেদকে ধাক্কা দিয়েছে। সেজন্য এগিয়ে এসে রাজিয়া আহমেদকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মিস আমি দেখতে পাইনি। রিয়েলি স্যরি।”
জাইমার কথায় রাজিয়া আহমেদ গলে যায়। তখন রাহেলা খান বলেন, “উনি তোমার জ্যেঠাইমা।”
“শাশুড়ী মা।”
কথাটা বলে রাজিয়া আহমেদের গালে টুপ করে চুমু দেয় জাইমা। পরক্ষনেই মুখটা গম্ভীর করে নেয়। ওয়েট! ওই প্রফেসরের আম্মুকে সে শাশুড়ী ডেকেছে। না! তাকে তো জাইমা বিয়ে করবেনা।
জাইমা সবাইকে একনজর দেখে রাহেলা খানকে থমথমে কন্ঠে বলে, “বাসায় যাব।”
প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ৭
সবাই অবাক হয়ে তাকায়। জাইমা ইশরাকের দিকে তাকাতে দেখে সে থমথমে মুখ করে বসে আছে। তার পেছনে সোফার সাথে দাঁড়িয়ে আছে পোহা। জাইমা দেখেছি, ইশরাকের গায়ে যখন কফি পড়েছে তখন মেয়েটা কেমন উত্তেজিত হয়ে টিস্যু এগিয়ে দিয়েছে। নাহ্! নিজেই টি-শার্টে থাকা গরম কফি মুছে দিয়েছে।