মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৮

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৮
মির্জা সূচনা

একটা অন্ধকার ঘর।
যেখানে নেই কোনো বিদ্যুৎ এর আলো, নেই দিনের আলোর ছোঁয়াও।
শুধু একটি চেয়ার।
আর সেই চেয়ারেই বাধা অবস্থায় আছে এক ব্যথাতুর গর্ববতী নারী।
শরীরে অসংখ্য আগাতের চিহ্ন। ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা রক্তের বিন্দুগুলো আধ-শুকনো।
যেনো জিভে জিভে বলে দিচ্ছে—
এই নারী অনেক চেষ্টা করেছিল নিজেকে রক্ষা করার,
তবুও শেষরক্ষা হয়নি।

সে গর্ববতী। তাই হয়তো সে এই অবস্থায়।
আসলে কিছু কিছু পরিস্থিতি মানুষের জীবনে এমন সময় নিয়ে আসে,
যেখানে সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন,
দেহের জোর আর কাজ দেয় না।
এই নারীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
না হলে এই নারীকে আটকে রাখা বা ধরার ক্ষমতা কার ছিল?
সে দুর্বল নয়—সে নিরুপায়।
সে যদি একা থাকত,
তবে হয়তো তাকে ধরতে আসা সেই নিকৃষ্ট লোকগুলোর লাশ পাওয়া যেত,
না হলে তাদের হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে মাটিতে মিশে যেত।
সে দুর্বল নয়—পরিস্থিতির শিকার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কারণ এখন সে যে আর একা নেই।
তার ভিতরে আছে ছোট আরেকটি প্রাণ।
যাকে পৃথিবীতে আনতে এই নারীর আত্মসমর্পণ।
নিজের পরাজয় মেনে নেওয়া।
কিছু নিকৃষ্ট মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ—
যা সে কখনো, জিবন থাকলেও করত না।
কিন্তু এইবার সে মরতে পারে না।
কারণ তার গর্ভে যে প্রাণটা রয়েছে,
তার জন্য তাকে বাঁচতেই হবে।
ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে সে সন্তান আর যে বেশিদিন নেই সে ভূমিষ্ঠ হওয়ার।
আর তাই তাকে বাঁচাতে এই নারী নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছে।
এই প্রথম আত্মসমর্পণ…
শুধু তার ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানের জন্য।
একজন মা—

নিজের সন্তানের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বিসর্জন দিতেও দুইবার ভাবে না।
এই নারীও তাই করেছে।
নিজের জীবনের কথা,জেদ, রাগ বা বীরত্তের কথা না ভেবে,
ভেবেছে তার অনাগত সন্তানের কথা।
এই অনাগত সন্তানকে ঘিরে আছে অনেক মানুষের অনেক আশা, অনেক ভালোবাসা।
এই ভূমিষ্ঠ না হওয়া শিশু হবে অনেকের চোখের মণি বেচে থাকার কারন।
আর সেই শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে আজ এই নারী—
রাজপ্রাসাদ ছেড়ে,
এই বন্ধ অন্ধকার ঘরে বন্দী।
যেখানে একটুও আলো নেই,
কিন্তু এই নারী এক রাজরানির মতো
দুর্সাহসিক জীবন জাপন করা নারী। যার একটা ইশারাই তার স্বামী নামক মানুষটি তার পায়ের কাছে এনে সব রাখার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে,
নিয়তির খেলায় আজ সে বন্দী।
তবে প্রশ্ন একটা থেকেই যায়—
এই রাজরানিকে কি খুঁজছে তার মহারাজ?
হয়তো খুঁজছে…

না, শুধু খুঁজছে না—
পাগলের মতো খুঁজছে…
সময় এখন কত বাজে বলা যায় না। দিন না রাত—তা-ও বোঝার উপায় নেই।
চেয়ারে বাঁধা সেই নারী, জ্ঞান ফিরতেই টিপটিপ করে তাকায়।
মুখে অস্পষ্ট উচ্চারণ—
“কবি সাহেব…”
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় চেয়ারে বাধা মেহরিন।
অনুভব করে তার হাত-পা যেনো অসহ্য ব্যথায় জর্জরিত।
পুরো শরীরটা যেনো জমে এসেছে।
একটাই অনুভূতি—
যন্ত্রণা।

মেহরিন এবার পুরোপুরি চোখ মেলে, আস্তে আস্তে নিজেকে উপলব্ধি করে সে কোথায়।
গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা অশ্রুবিন্দু।
“কি হবার ছিল, আর কি হয়ে গেল…”
—এই ভাবনাতেই যেনো ডুবে যায়।
সে কাদে ধীরে ধীরে কান্নার তীব্রতা বাড়ে।
এবার আর চেপে রাখা যায় না।
আত্মচিৎকারে ফেটে পড়ে—
এই অসহায়ত্বে।
সে কাঁদে, কাঁদে অসহায়ভাবে।
এই যে শরীর জুড়ে এতগুলো আঘাত,
এই যে পেটে চাপ পড়ছে,
এই যে গর্ভের সন্তানের কিছু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা—
এসবই কি অসহায়ত্ব নয়?

মনে হচ্ছে, ভিতর থেকে সেই ছোট্ট প্রাণটা কাতর স্বরে বলছে—
আম্মু… আমার কিছু হবে না তো?
তুমি আমাকে বাঁচাবে না, আম্মু?
আম্মু… আমার খুব কষ্ট হচ্ছে…
সেই কষ্টে মেহরিনের ভিতরটা খানখান হয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে, কেউ যেনো তার হৃদয় কুচকে দিয়েছে।
কলিজায় শতবার ছুরি চালিয়েছে।
সে কাঁদতে কাঁদতেই বলে—
আমার সোনা, কিছু হবে না…
তোমার আম্মু আছে তো কিছু হতে দিবে তোমার… তোমার আম্মু আছে সোনা…আমি আছি… আমি আছি…
বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।
একদিকে নিজের বর্তমান অবস্থা,
অন্যদিকে রাজের কথা মনে পড়ে যায়।
কি করছে লোকটা?
পায়নি তাকে…

হয়তো পাগলের মতো খুঁজছে চারপাশে।
তবে আবার মনে হয়—
এত চিন্তা করলে গর্ভের সন্তানের ওপর প্রেশার পড়বে।এতে তার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে,আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিতে চাই।কিন্তু অনেকক্ষণ চিৎকার করে কান্নার ফলে তার কাশি দিয়ে উঠে যায়।
গলা শুকিয়ে যায়।
তৃষ্ণায় গলা জ্বলে যাচ্ছে…
মনে হচ্ছে, একফোঁটা পানি না পেলে এখনই মরে যাবে।
সে কষ্টে কষ্টে বলে—
“পানি… পানি…”
একজন লোক দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরেই।
মেহরিনের সমস্ত চিৎকারের সাক্ষী সে।
হয়তো বিবেকের তাড়নায় এগিয়ে আসে—
লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়।
একটু পানি এগিয়ে ধরে মেহরিনের মুখের কাছে।
আস্তে করে বলে—

কাঁদো না, বোন।
নিজের কথা না ভাবো, তোমার সন্তানের কথা ভাবো।
আমি শুনেছি, এই সময়ে চিৎকার করলে সন্তানের ক্ষতি হয়।
কোনো শব্দ কোরো না।
কেউ যদি জানে আমি তোমাকে পানি দিয়েছি—
তারা আমাকেই মেরে ফেলবে।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
মেহরিন বুদ্ধিমতী।সে পরিস্থিতি বুঝে
কোনো শব্দ না করে পানি খেয়ে ফেলে।
খাওয়া শেষে কৃতজ্ঞ চাহনিতে তাকায় লোকটার দিকে।
লোকটা মেহরিনের মাথায় হাত রেখে বলে—
চিন্তা করিস না, বোন।

তোর উপকার না করতে পারলেও ক্ষতি করব না।
তোর মতোনই আমারও একটা বোন ছিল।
ঠিক তোর মতো…
আমি তখন রাজমিস্ত্রির কাজ করতাম।
অভাব ছিল সংসারে,
কিন্তু শান্তির অভাব ছিল না।
আমার বোনকে কলেজে ভর্তি করিয়েছিলাম অনেক কষ্ট করে।
সে খুব পড়তে চাইতো।
অনেক দূর পর্যন্ত পড়াবো বলে নিজে বিয়ে করিনি।যদি আমার বউ এসে বোন কে সয্য না করতে পারে।
সে ছিল আমার পৃথিবী।
কিন্তু জানিস, আমরা ছিলাম গরিব সেই গরিবীটাই ছিল আমাদের একমাত্র অপরাধ।
কলেজে এক বড়লোক বাবার ছেলে আমার বোনকে ভালোবাসলো।
সে প্রেমের প্রস্তাব দিল, কিন্তু আমার বোন রাজি হল না।
তাই তাকে এসিড ছুঁড়ে পোড়ানো হলো।
তাও ছাড়ল না—জানিস,

পোড়া শরীর নিয়েই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে…
জানোয়ারটা আমার বোনের ইজ্জত আর জীবন দুইটাই কেড়ে নিল।
এই দুনিয়ায় আর কেউ রইল না আমার।
তারপর আমি চলে এলাম এই কালো জগতে…একথা বলেই সে দুর্লব হাসলো,তারপর আবার বললো,
সেই জানোয়ারের বাচ্চাটাকে পাঠিয়ে দিয়েছি জাহান্নামে।
কথা শেষে মেহরিনের দিকে তাকায়।
সেও তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে।
চোখে জল…
মেহরিন মনে মনে ভাবে,মানুষের জীবনে কতো না জানা কষ্ট, দুঃখ লুকিয়ে থাকে।
লোকটা বলল,

—বোন, তুই এখানে এলি কীভাবে?
মেহরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
—আগে আমার পেটের বাঁধনটা একটু খুলে দাও ভাইয়া…
লোকটা চমকে উঠে তাকায়।
তার চোখে যেনো হঠাৎ এক জলের ঢেউ নেমে আসে।
ভেতরে জমে থাকা অশ্রুরা গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় কাঁপছে।
সে আস্তে করে বলে,
—আরেকবার বলবি…? বোন… কতোদিন হলো শুনি না এই ডাকটা…
মেহরিনের চোখে পানির সঙ্গে মুখে একটুখানি হাসিও ফোটে।
চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এক ফোটাঁ জল।
সে বলে,

—ভাইয়া, তোমার বোন আর তার সন্তানের কষ্ট হচ্ছে…
একটু পেটের বাঁধন খুলে দাও… অথবা ঢিলা করে দাও…
মেহরিন এবার ভালো করে তাকাই লোকটার দিকে—
লোকটার চোখে দু গভির যেনো সমুদ্র , মুখে মায়া, কপালে কাটা লম্বা দাগ, গায়ে রুক্ষ কাপড়, মুখে চাপ দাড়ি…
লোকটা কাঁপা হাতে চোখ মোছে।
তারপর বলে,
—হ্যাঁ… হ্যাঁ, দিচ্ছি…
তুই শুধু এমনভাবে থাকবি, যেনো তোর বেশি কষ্ট হচ্ছে, ঠিক আছে?
মেহরিন মাথা নাড়ে।
লোকটা সাবধানে তার শরীরের সব বাঁধন খুলে দেয়।
এমনভাবে, যেন চাইলে মেহরিন নিজে খুলতে পারে।
তারপর মাটিতে বসে পড়ে।
মেহরিনের পায়ের কাছে বসে তার পা দুটো আস্তে আস্তে মালিশ করতে থাকে।
লোকটি বলে,

—পা ব্যথা করছে তোর?
মেহরিন আঁতকে উঠে বলে,
ভাইয়া… তুমি কী করছো? পায়ে ধরো না!
লোকটা হেসে ফেলে।
মৃদু সেই হাসিতে যেন এক অজানা কষ্টের চিহ্ন জ্বলজ্বল করে ওঠে।
লোকটি বলে,
—আমার বোনের মাঝেমাঝে পা ব্যথা করতো…
কারণ ও অনেক রাস্তা হেঁটেছে, টাকা বাঁচাতে…
আমি কতো বোঝাতাম, কিন্তু ও শুনতো না।
তখন আমি নিজেই ওর পা মালিশ করে দিতাম…”
মেহরিন কিছু বলে না।
শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
হয়তো সে লোকটার ভেতরের কষ্টের গভীরতা মেপে নিতে চায়…
লোকটা নিজের পরিচয় দেয়—

—“আমার নাম কাসেম।
তুই আমাকে কাসেম ভাই বললেই পারিস।”
মেহরিন হেসে ফেলে।
লোকটাও হাসে।
হাসির মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণা, এক অনুচ্চারিত শান্তি।
মেহরিন ভালো করে তাকায় লোকটার দিকে—
কৃষ্ণবর্ণের তামাটে মুখ, চোখে গভীরতা,
ঠোঁট সরু—টিয়া পাখির মতো।
কপালে লম্বা এক কাটা দাগ।
গায়ে ছেঁড়া সাদা শার্ট, কালো রঙের প্যান্ট।
মুখজুড়ে চাপ দাড়ি।
মেহরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
নিয়তি আজ এমন এক ভালো মানুষকে ঠেলে দিয়েছে এই অন্ধকার দুনিয়ায়…
যদি কাসেম ভাইয়ের বোনটা বেঁচে থাকতো…?
হয়তো আজ এই কষ্টটা তার জীবনে আসতো না…সে হতো না এই অন্ধকার জগতের পথের পথিক।
কাসেম নামের লোকটি মেহরিনের পা ধীরে ধীরে মালিশ করতে করতে বলে,
—এখানে এলি কিভাবে, বোন?
বললি না তো…

মেহরিনের চোখের কোণে দেখা যায় অশ্রুদের আনা-গোনা, তারা যেনো জোরে চিৎকার করতে চাইছে।
মেহরিন চোখে পানি নিয়েই হাসে।
তার চোখে ভেসে ওঠে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
মেহেরের বিয়ের পর কেটে গেছে দু বছর।
এই দু বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।
মেহেরের বিয়ের পরে আবার নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে মেহরিন।
আর এই পুরো পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড ছিল রাজ।
একদিন হঠাৎ রাজ বলে বলে—
—কি ব্যাপার, বউ, পড়াশোনাটা কি গোল্লায় গেছে?
তুমি কি পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাও?
এই দেখো, আমার সন্তানের মা মূর্খ থাকবে, তা আমি মানতেই পারি না।
যখন বাচ্চারা বলবে—‘আমার আম্মু ইউনিভার্সিটির গন্ডিও পার করেনি’, তখন কী জবাব দেবে আমি?
তাই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবার মেহরিনকে ইউনিভার্সিটিতে পাঠানো শুরু করে রাজ।
মেহরিন এখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

মাহির স্কুল পার করে কলেজে পা দিয়েছে।
মেহবুবা, লামিয়া, রাহি আর আরফা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।
মেহবুবা ও লাবিবের এনগেজমেন্টও হয়ে গেছে।
শান্ত আর চুমকির বিয়েও হয়ে গেছে।
রাহি আর রাকিব এখন রীতিমতো প্রেম করে ঘুরে বেড়ায়—খুব তাড়াতাড়ি তাদের ও এনগেজমেন্ট হবে।
রিদ স্টাডি শেষ করে ভালো একটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে।
এখন ওরা লাবিবের ফ্ল্যাটে নয়, নিজের বাসায় থাকে—যেটা রিদ নিজে টাকা দিয়ে বানিয়েছে।
তবে অদৃশ্যভাবে রাজ অনেক সাহায্য করেছে, যা রিদের অজানা।
সাথী আর মৌ বিয়ে করে সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

আরশ ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেছে এবং লামিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে শিকদার বাড়ি—সবাই রাজি।
মেহরিনের ডেলিভারির পর লাবিব আর লামিয়া—দুই ভাই-বোনের বিয়ে একসাথেই হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চারদিকে যেনো শুধু সুখ আর সুখ—সুখ উপচে পড়ছে।
মেহরিনের প্রেগনেন্সির এখন নয় মাস চলছে।
যেকোনো সময় নতুন সদস্য আসবে—তা নিয়েই সবাই ভীষণ এক্সসাইটেড।
সেদিন, যেদিন মেহরিন কনসিভ করেছিল, সেদিন রাজের কি পাগলামি!
মেহরিনকে কোলে নিয়ে বসে ছিল বেশ অনেকক্ষণ।
বাচ্চাদের মতো এদিক সেদিক লাফালাফি করেছিল,

আর একটু পরপর বলছিল—
—আমি… আমি বাবা হবো!
আমার সন্তান আসবে—
ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে খেলবে,
আদো আদো শব্দে আমাকে ‘বাবা’বলে ডাকবে আমায়!
উফ্ বউজান, আমার আরিওনা, তুমি জানো না আমাকে কী দিয়ে ফেলেছো।
তুমি আমাকে এত সুখ… এত সুখের অনুভূতি দিচ্ছো,
আমি বুঝতেই পারছি না কী করবো এখন!
তারপর হটাৎ করেই মেহরিনকে কোলে তুলে নেয়।মেহরিনকে কোলে নিয়ে চলে যায় ছাদে দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিল
— শোনো হে আকাশ, বাতাস, চাঁদ-তারা—
আমি বাবা হবো!শুনছো তোমরা আমি বাবা হবো।এ দুনিয়ায় আমি আর একা থাকবো না,শিকদার বংশের প্রতীভ নিবে যাবে না। শুনো আকাশ বাতাস নির্বংশ হবেনা শিকদার বংশ।তা এগিয়ে নেবে আমার সন্তানরা।আমি বাবা হবো।

তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—
— আল্লাহ্, তোমার দরবারে আমি শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবো না।
তুমি আমার জীবনটাকে সুখে সুখে ভরে দিয়েছো।
বাড়ির প্রতিটি মানুষকে গিয়ে গিয়ে বলেছিল—
— জানো, আমি বাবা হবো! আমি বাবা হবো!
সেদিন রাজ যেনো একেবারে একটা বাচ্চার মতোই হয়ে গিয়েছিল।
মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল—
বাবা হওয়ার আনন্দে।

কতো হাজার চুমু খেয়েছে মেহরিনের পেটে।
এরপর থেকেই শুরু হয় রাজের নিখুঁত স্বামীগিরি।
মেহরিনের প্রতিটি ব্যাপারে সে খেয়াল রাখতো
কখন কী খাবে, কী পরবে, তার মুড কেমন, সব।
মেহরিনের নানা মুড-সুইং রাজ হাসিমুখেই সহ্য করতো।
একবার যখন মেহরিনের পাঁচ মাস চলছে,
তখন একদিন গোসল করতে গিয়ে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে যায় মেহরিন।
ফলে পায়ে একটু আঘাত পায়।
ওইদিন রাজ গিয়েছিল অফিসে এক জরুরি মিটিংয়ে।
যদিও মেহরিন কনসিভ করার পর থেকে অফিসে যাওয়া একরকম কমিয়ে দিয়েছিল,
তবু ওই মিটিংটা জরুরি হওয়ায় তাকে যেতে হয়েছিল।
কুলসুম সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে রাজকে জানায়।
রাজ তখন মিটিং ফেলে একপ্রকার পাগলের মতো বাড়ি চলে আসে। লাবিব সব সামলে নেয়।এসেই প্রথম যা করে তা হলো,

বাথরুমে কার্পেট বিছিয়ে দেয়, যাতে আর এমন না হয়।
আর এদিকে কুলসুমকে মেহরিন খুব বকে,
কিন্তু তাতে কুলসুমের কিছু আসে যায় না। কারন তার মনে সে ঠিক কাজ’ই করেছে, এমন কাজ সে বার বার করবে মেহরিন বকলেও করবে,প্রয়জনে মার খাবে মেহরিনের হাতে করবে।
কারণ রাজ তাকে এই কাজেই রেখেছে আপাতত তার কাজ একমাত্র মেহরিনকে চোখে চোখে রাখা—
আর রাজেরদেওয়া কাজ কুলসুমের কাছে ওনেক বড় কাজ যা না করলেই গর্দান যাবে—
—এই খবর দিতে গিয়ে যদি কেউ তার গলা কেটে দেয়,
তাও সে দেবো।
ওইদিনের পর থেকেই রাজ মেহরিনকে একা গোসল করতেও দিত না।
সে নিজেই করিয়ে দিতো।
মেহরিন রাগে, দুঃখে কাঁদতো, মারতো—
সব রাজ সহ্য করতো।
তবু রাজ তাকে একা ছাড়তো না।

ওইদিনের পর থেকেই রাজ অফিস থেকেও রিটায়ার নিয়েছিল।
জরুরি কাজ থাকলে সে বাড়ি থেকেই করতো।
মিটিং থাকলে, মেহরিনকে এক বস্তা খাবার দিয়ে পাশে বসিয়ে রাখতো।
মেহরিন রাজকে গালাগাল করতে করতে তা খেতো,
আর রাজ শান্তভাবে তার মিটিং করতো…আর আর চোখে মেহরিনকে দেখতো।
আর মেহরিন, সে তো মুড সোইং-এর কারণে রাজকে মারতো, বকতো।
মাঝে মধ্যে অর্ধেক রাতে উঠে কাঁদতো।
রাজ তখন বুকে আগলে নিয়ে বলতো—
—এভাবে বসে বসে বকলে বা মারলেও ক্লান্ত হয়ে যাবে…
আসো, বুকে আসো… এখানে শুয়ে পড়ো।
তারপর আমার গুষ্টি উদ্ধার করো, মারো—বকা দাও যা ইচ্ছে করো…
মেহরিন আর কী করবে?
এমন করে বললে কী আর বকা যায়?

আর খাওয়ার ব্যাপারটা তা নিয়ে রাজ যা তা রকমের বারা বারি করতো,রাজ তার ঘরটাকে একদম খাবারের আখড়া বানিয়ে ফেলেছিল।
এমন কিছু নেই, যা সেখানে পাওয়া যাবে না।
রাজ মাঝে মাঝে মেহরিনকে নিয়ে ঘুরতে যেত। মেহরিনের অদ্ভুত রকমের মুডসোইং হতো মাঝে মধ্যে এই যেমন সে কোলে উঠবে, গান শোনাতে হবে,কামড়াতে ইচ্ছে হবে,বরফ খাবে রাজের চুল টেনে ধরবে আর রাজ সব মেনে নিতো।

মোট কথা, মেহরিন যা বলতো, তাই করতো রাজ।
রাজ সারা রাত বসে হাত-পা মালিশ করতো।
আর সুযোগ পেলেই পেটে কান দিয়ে সন্তানের সঙ্গে কথা বলতো।
তার অনাগত সন্তানের সঙ্গে রাজের এক নিজস্ব জগৎ ছিল।
রাজের ধারণা ছিল—সে তার বেবির সাথে কথা বলে। আর তার বেবিও বলে,
এই ব্যাপারটা মেহরিন খুব উপভোগ করতো।
একদিন বেবি কিক দেওয়াতে মেহরিন আঁৎকে উঠে
ব্যথায় চোখ-মুখ বিকৃত করে ফেলে।
তা দেখে রাজ কেঁদে ফেলেছিল।
মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল—

— আমি স্যরি, বউজান!
তোমার এত কষ্ট হবে জানলে আমি কখনোই বেবি নিতাম না।
এটা শুনে মেহরিন প্রথমে খুব রেগে গিয়েছিল,
কিন্তু যখন বুঝলো—মেহরিনের কষ্টের জন্যই রাজ এমন বলেছে,
তখন হেসে, রাজকে বুঝিয়ে বলেছিল—
— এই অল্প কষ্ট সহ্য করার ফলই তো খুব শান্তির। কবি সাহেব!
এত কষ্টের পর যখন সন্তানের মুখ দেখবো—
যে আপনার আর আমার অস্তিত্ব—
আমাদের সন্তানের মুখটা…
তখন এই কষ্টটাকেই তুচ্ছ মনে হবে। মনে হবে এই মা হওয়ার সুখ পাওয়ার জন্য এমন শত শত কষ্ট আমি সহ্য করতে রাজি আছি।

তখন রাজ মেহরিনের পেটে কান পেতে বলেছিল—
— আমার আব্বাজান বা আমার আম্মাজান!
প্লিজ, আমার বউজানকে এত কষ্ট দিও না।
তোমার বাবা তোমার থেকেও বেশি তোমার মাকে ভালোবাসে।
তুমি তো বাবার লক্ষ্মী সোনা!
আম্মুকে একদম কষ্ট দিও না, কেমন?
তোমার আম্মু ছাড়া যে এ দুনিয়ায় তোমার বাবার আর কেউ নেয়। তোমার আম্মুর কষ্ট হলে যে তোমার বাবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় সোনা। তোমার বাবা যে তোমার মা কে অনেক বেশি ভালোবাসে! বেশি কষ্ট দিও না সোনা। বাবার কথা শুনবে তো?তোমি তো বাবার লক্ষী সোনা! শুনবে তাই না বলো?
ঠিক তখনই বেবি কিক করে।

আর মেহরিন হেসে ফেলে, বলে—
— আপনার বাচ্চা আপনার কথাই শুনেছে,
আর তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে।
রাজ সেই কিকটা অনুভব করে
চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে বলে—

হুম! আমার দুষ্ট সোনা তার বাবার কতথা শুনে।এরপর মেহরিনের পেটের অংশের কাপড়টুকু তুলে একটা চুমু খায়।
আর মিষ্টি হেসে মেহরিনের পেটে হাত রেখে গায়,
লক্ষীসোনা,আদর করে দিচ্ছি তোকে,
লক্ষ চুমু, মায়া ভরা তোরই মুখে।
লক্ষীসোনা,আদর করে দিচ্ছি তোকে,
লক্ষ চুমু, মায়া ভরা তোরই মুখে।
কলিজা তুই আমার,তুই যে নয়নের আলো,
লাগেনা তুই ছাড়া,লাগেনা তো যে ভালো।
রূপকথা তুই তো আমারই,
জীবনের চেয়ে আরো দামী।
রূপকথা তুই তো আমারই,
জীবনের চেয়ে আরো দামী।
ও….ও….ও….ও
ও….ও….ও….ও
গান শেষে মিষ্টি হাসে মেহরিন।
তখন রাত গভীর।

চাঁদের আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে ঘরের ভিতর ঢুকছে নিঃশব্দে।
মেহরিন ঘুমাছে রাজের বুকে মাথা রেখে,
এক হাতে নিজের পেটটা আলতো করে জড়িয়ে রেখেছে।
রাজ চুপচাপ তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
তার মুখে হাসি, চোখে জল।
স্মৃতি আর ভবিষ্যতের মিশ্র আবেগে ওর বুকটা ভারী হয়ে আছে।
তখনই রাজ আস্তে করে মেহরিনের কপালে চুমু খেয়ে বলে—
ভালোবাসি বউজান…
আলো-ঝলমলে নয়, বরং
আমার এলো-মেলো জীবনে এসে আমার জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য ভালোবাসি।
আমার মতো চাল চুলোহীন ছেলেটাকে ভালোবাসার জন্য ভালোবাসি।
এই ছেড়ে যাওয়ার যুগে আমায় আগলে রাখার জন্য ভালোবাসি।
ভালোবাসি আমার বাচ্চার আম্মু হওয়ার জন্য…
ভালোবাসি খুব ভালোবাসি।

আমি আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসি আমার বউজানকে,
যে আমাকে মা–দের পরেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে।
আমার দুঃখে ভরা জীবনটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে নিজের ভালোবাসায়।
তাকে ভালোবাসি, যে আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।
ভালোবাসি, যে মানুষটা আমার আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে—
তাকে, আমার আরিওনাকে ভালোবাসি।
ভালোবাসি আমার Moonbem কে ভালোবাসি।
আমার সন্তানের মা’কে ভালোবাসি।
আমার বউজান মেহরিন শিকদারকে ভালোবাসি,ভালোবাসি খুব খুব খুব ভালোবাসি আমার রাগী গিন্নিকে।
রাজের ঠোঁট কেঁপে ওঠে কিন্ত মুখে হাসি।
এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মেহরিনের কপালে।
আর রাজ তখনো চেয়ে থাকে,

যেন এই দৃশ্য, এই ভালোবাসা, এই রাতটা চিরকাল ধরে রাখতে চায়।
তার পর আসে সেই ভয়ংকর দিনটা।
একটা গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসে রাজের কাছে—
গুদামে কেউ আগুন দিয়েছে! রাজের, অনেক লোক মারা গেছে,
রাজ জানে, এই মুহূর্তে না গেলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।
সে মেহরিনকে শেষবারের মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো বউজান। নিজের খেয়াল রাখবে ঠিক আছে।বারান্দায় আজ আর যাবে না।
তারপর রাজ নিজ হাতে দায়িত্ব দিয়ে যায়,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৭

মেহবুবা, মালিহা মির্জা, রূপা বেগম, লামিয়া আর কুলসুম, তোদের ওপর মেহরিনকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব।
আমি আর লাবিব এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি।
আর ঠিক রাজ আর লাবিব বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাত্র দশ মিনিট পরে
সেই বিভীষিকার শুরু—
চরম গুলির শব্দ, আতঙ্কে ভরা চিৎকার,
আর অজানা ভয়।
আর তখনই….

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৯