এলিজা পর্ব ৭৭+৭৮

এলিজা পর্ব ৭৭+৭৮
Dayna

অপূর্ব বিরবির করছে।কিছু বলছে তবে বাক্য গুলো স্পষ্ট নয়। অপূর্ব অনুভব করলো তার কপালে ঠান্ডা পানির মত কিছু একটা আছে। অপূর্বর চোখে ঘুম আসছে না। কিন্তু ক্লান্তির জন্য সে নিস্তেজ।প্রিয় মানুষটির কঠিন রুপ তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। অপূর্ব চোখ মেলে দেখছে।সব ঝাঁপসা।তবে বুঝতে পারছে ,তার সামনে থাকা মানুষটা তার প্রিয়তমা স্ত্রী। অপূর্বর মাথায় জ্বলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। অপূর্বর হাতে পায়ে তেল ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। অপূর্ব অনুভব করছে।
রাত বেড়ে চলেছে।রাত ২টো নাগাদ।
পিজি হাসপাতাল-

পাখির হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়।এপাশ ওপাশ করছে। পাখির কোন কিছু ভালো লাগছে না। হঠাৎ এরকম অনুভুতি পাখিকে ভাবাচ্ছে।পাখি খেয়াল করলো, শ্রাবন টুলে বসে পাখির হাতের উপর হাত রেখে মাথা গুঁজে সুয়ে আছে। পাখি শ্রাবন কে দেখছে। মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।পাখি-হীন শ্রাবন যে নিঃস্ব। পাখি ভাবছে,আমি মরে যাবো,সেই ভেবে আমার একটু ও কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু এই মানুষটির কি হবে,সেই ভেবে আমি মৃত্যুর আগেও মৃত্যুর স্বাদ পাচ্ছি।
ভোর হয়ে যায়। ফজরের আজান শুনে অপূর্ব সজাগ হয়ে যায়। অপূর্ব ভাবলো,কাল রাতে সব স্বপ্ন ছিল।নয় এলিজা আসবে কি করে।সে তো পাষান।এসব ভাবতে ভাবতে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অপূর্ব ঘুম থেকে উঠবে ঠিক তখনি বুঝলো,তার বুকের উপর কিছু একটা।ঘর অন্ধকার। অপূর্ব হাত দিলো,দেখলো চুল। অপূর্ব ভালো ভাবে পরোখ করতেই দেখে এলিজা। অপূর্ব হকচকিয়ে উঠে। অপূর্ব শান্তি অনুভব করলো। অপূর্বর বুক পাজরে মাথা রেখে এলিজা ঘুমোচ্ছে। অপূর্ব এলিজা কে ডাকলো না। অপূর্ব এলিজার মাথায় হাত বুলাতে যাবে,ঠিক তখনই, অপূর্ব চোখের সামনে সেসব চিত্র ভেসে উঠে।যা দেখার জন্য অপূর্ব কোনদিন প্রস্তুত ছিল না। অপূর্ব হাত টা এলিজার মাথায় দিতে যেও না,হাত মুঠি করে সরিয়ে নেয়। এলিজার নিঃশ্বাস অপূর্বর বুকে লাগছে। অপূর্ব কোন এক অজানা কারণে এলিজার নিঃশ্বাস ভারী মনে হচ্ছে। এলিজা অনুভব করলো অপূর্ব জেগে গেছে।এলিজা ধিরে উঠে যায়। ভোরের কিছুটা আলো পরেছে। অপূর্ব সোয়া থেকে উঠে,খাটে পা ঝুলিয়ে বসে।কাট গলায় বললো, এসেছো কেন? বারন করেছি না, আমার চোখের সামনে আসতে!।সহ্য হয়না তোমাকে‌।

অপূর্বর ঘৃনিত আচরণ এলিজাকে ভেতর থেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। এলিজা কাপা কন্ঠে বললো, আপনার বুক পাঁজর ছাড়া,যে আমার ঘুম হয়না। অপূর্ব আওয়াজ করে হাসলো‌।যেই হাসিতে লুকিয়ে আছে ঘৃনা,। এলিজা অপূর্বর দিকে দৃষ্টি স্থাপন করলো। এলিজা অপূর্বর কাছে এগোবে, তখন ই অপূর্ব দ্রুত পায়ে মনোভাব নিয়ে বেড়িয়ে যায়। এলিজা অপূর্বর পেছন পেছন গিয়ে পথ আটকিয়ে দেয়। অপূর্ব থমকে দাঁড়ায়। এলিজা হাত জোড় করে বললো,একটা বার আমার কথা শুনোন, এরকম আচরণ করবেন না, আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই, অপূর্ব শক্ত করে এলিজার স্বিনা ধরে বললো, তোমার যা বলার, এবং যা করার,তা করে নিয়েছো। এখন কি নতুন কোন ফন্দি আটছো,নাকি ভয় পেয়ে গেছো,যখন বলেছি আইনের আওতায় এনে দিবো।ভয় পেয়ে গেছো তাই না। অপূর্ব এলিজা কে চটকে ছেড়ে দেয়।শক্ত গলায় বললো, ভয় নেই। তোমাকে পুলিশে দেবো না। আমার সামনে এসো না। বলেই অপূর্ব সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।

অপূর্বর কথা বলার বাক্যে ছিলে,ঘৃনা,ছিলো তেজ, কিন্তু তার মধ্যে ও লুকিয়ে ছিল ভালোবাসা। এলিজা বুঝতে পারলেও, অপূর্বর এরকম আচরণ এলিজাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে।
বেলা বারছে।এলিজা রান্নাঘরে।পাখির জন্য খাবার নিয়ে যাবে‌। অনেকদিন পাখির থেকে দূরে।পাখির জন্য মন পূড়ছে। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয়,নূরনেসা বেগম এবং চাঁদনী।জয়া মারা যাওয়ার পর,নূরনেসার মন ভালো যাচ্ছে না। নূরনেসা জয়ার ছোট বোন।

অপূর্ব,অর্পা ওদের জন্য মন খারাপ হওয়াতে চলে আসে দেখতে। মমতাজ, এলিজা, তাদের দেখে খুশি পোষন করে আলিঙ্গন করে। মমতাজ,অর্পা , চাঁদনী সবাই একসাথে বৈঠকখানায় বসে গল্প করছে। এলিজা সবার জন্য খাবার তৈরি করছে। বারবার দরজার দিকে পরোক্ষ করছে।এই বুঝি অপূর্ব আসলো।সকালে না খেয়ে বেড়িয়ে গেছে।এখনো ফিরছে না। মনোরা এলিজার দিকে পরোখ করে বললো, বউমনি দাদাবাবুর সাথে মনে হম মনোমালিন্য হয়েছে?তাই না? দাদাবাবু কাল থেকে কিছু খায়নি। এবং ঘরের দরজাও খোলেনি।
মনোরার মুখ থেকে কথা গুলো শোনা মাত্রই এলিজা-হকচকিয়ে ওঠে।মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে। এলিজা হাসপাতাল যাবে না, অপূর্বর জন্য অপেক্ষা করবে বুঝতে পারলো না। এলিজা মনস্থির করলো , হাসপাতালে যাবে না। মমতাজ কে বললে সে খাবার নিয়ে যায়। এলিজা অপেক্ষা করছে কখন আসবে। সবাইকে খাইয়ে এলিজা নিজের ঘরে চলে আসে।ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে,কখন আসবে।
অপেক্ষা করতে করতে রাত হয়ে যায়।

এলিজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। শীতল হাওয়া তে চাদরটা উরছে‌। তৎক্ষণাৎ চোখ পরে বাড়ির গেটের দিকে। অপূর্ব আসছে তবে একা নয়,সাথে দুজন লোক।কারা তা বোঝা যাচ্ছে না। এলিজা চোখ বড় করে পরোখ করে। অপূর্ব বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর ঘরের দিকে ফিরে। সাথে থাকা লোক দুটো উল্টো দিকে চলে যায়।এলিজার খটকা লাগলো।কি বললো,আর তারা কে। এলিজা ভাবনা উপেক্ষা করে। অপূর্ব ঘরে আসে। হাতে দুটো বই।এলিজা খাটের এক কোণে বসে আছে। এলিজা-কে উপেক্ষা করলো।তার আশেপাশে কোন ব্যাক্তি আছে,তা অপূর্বর মনেই হচ্ছে না। অপূর্ব পরনের কাপড় পাল্টে নিচ্ছে। পরনে ছিল সাদা প্যান্ট, এবং শার্ট। উল্টো দিকে ঘুরে শার্ট খুললো। এলিজা আর চোখে পরোখ করলো‌। অপূর্ব শুধু সু-দর্শন নয়,তার সিক্স প্যাক পেট এবং মাসেল।এলিজা আজ তা প্রথম দেখলো। অপূর্ব গুনগুন করে গান গাইছে, আলমারি থেকে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা বের করলো। অপূর্বর হাবভাব স্বাভাবিক মনে হলো না।এলিজা উপেক্ষা করে বললো, আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসবো?

অপূর্ব বাথরুমে ভেতর যেতেই, এলিজা প্রশ্ন টা করে। অপূর্ব থম মেরে দাঁড়িয়ে বললো,বাহির থেকে খেয়ে এসেছি। তাছাড়া আমি ,কারো জন্য না খেয়ে থাকবো ,এটা ভাবা ভুল।
এলিজা ভ্রু কুঁচকে বললো,তবে গতকাল সারাদিন,রাত না খেয়ে ছিলেন কেন? অপূর্ব কিছু বললো না।
কিছুক্ষণ পর অপূর্ব বাথরুম থেকে বের হয়। এলিজা খাটের উপর বসে আছে। অপূর্ব আসার সময় দুটো বই কিনে নিয়ে আসে।একটি বই হাতে নিয়ে পায়চারি করতে করতে পরতে থাকলো। হঠাৎ করেই অপূর্বর এরকম,নরম হয়ে যাওয়া এলিজাকে ভাবায়।রাত বেড়ে চলেছে। এলিজা বেহায়ার মত শান্ত স্বরে বললো,আমি খাইনি। আপনি খাননি ভেবে আমিও খায়নি। অপূর্ব দাড়িয়ে যায়।আর চোখে এলিজা-কে দেখে বললো, খেয়ে নিলেই তো‌ হয়। আমার জন্য অপেক্ষা করা, খারাপ লাগা,এসব অভিনয় বন্ধ করো।

এলিজা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।এই কথার জবাব যে দিতে চেয়েও দিতে পারছে না।
অপূর্ব বইটা রেখে সুতে আসে।সুয়ে চাদরটা গায়ে দেয়। এলিজা কে উদ্দেশ্যে করে অহং’কারী স্বরে বললো,অন্য ঘরে গিয়ে সোয়। তুমি পাশে থাকলে আমার ভয় হয়।যদি মেরে ফেলো। এলিজা হাতের উল্টো দিক চোখ মুছে কাপা কন্ঠে বললো, আপনার বুক পাঁজর ছাড়া যে ঘুম হবে না। অপূর্ব বললো, না হলে জেগে থাকো।
এলিজা অপূর্বর দিকে কয়েকবার দৃষ্টি স্থাপন করে। অপূর্বর কথা মত খাট থেকে নেমে ফ্লোরে সোয়।অন্য ঘরে যে,যেতে পারলো না।

কোন বালিস,চাদর ছাড়াই এলিজা-ফ্লোরে , সোয়। শীত অনেক।বাহিরে শীতল হাওয়া বইছে। এলিজা শীতের জন্য চার হাত পা এক করে গুটিসুটি দিয়ে সুয়ে আছে।রাত ধিরে ধিরে বারছে। অপূর্ব পেছনে ঘুরে তাকায়।দেখলো এলিজা-ফ্লোরে সুয়ে আছে।শীতে কাঁপছে।এটা দেখে অপূর্বর বুকের ভেতর চাপ সৃষ্টি হয়। জ্বলজ্বল চোখে এলিজার মায়াবী মুখ দেখছে‌। অপূর্ব বিরবির করে বলছে, কত নত-যত হয়ে নিস্পাপ,রুপ নিয়ে ঘুমিয়ে আছো’ ।পারতে না,আমাকে ভালবেসে সারাজীবন সাধারন এলিজা হয়ে থাকতে। কেন, দ্বিতীয় বার মালাইকা হতে গেলে। অপূর্ব দৃষ্টি সরিয়ে বললো, সব মিথ্যা অভিনয় ছিলো। অপুর্ব বিছানা থেকে উঠে এলিজার কাছে আসে।ভাবছে এলিজা ঘুমিয়ে গেছে‌। অপূর্ব এলিজাকে ফ্লোর থেকে পাজা কোলে করে খাটে সুইয়ে দেয়।এলিজার দিকে পরোখ করে,ভাঙা গলায় বললো, আমার ভালোবাসা তোমার মত মিথ্যা ছিল না ‘ তুমি কি করে ভাবলে,তোমাকে রেখে আমি বাহির থেকে খেয়ে আসবো। আমি পানাহার। অপূর্ব অন্যপাশে শুয়ে পরে। এলিজা চোখ মেলে তাকায়। এলিজা সজাগ ঘুমোয়নি। অপূর্বর সমস্ত কথাই শুনে নেয়।ভাবছে,হাজারো ঘৃনার মাঝে লুকিয়ে আছে ভালোবাসা।তবুও কেন আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেয়।এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরে দুজনেই।

সকাল ৮ টা।এলিজা ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরে যেতেই চোখে পরে, অপূর্বর গতকাল নিয়ে আসা বই দুটোর দিকে।এলিজা আগ্রহ নিয়ে দেখলো‌।বইটি ইংলিশ ভাষার। এলিজা আহত চোখে দেখলো বইটির নাম, The Murd,er ।
এলিজা অবাক হয় এই বই দিয়ে সে কি করছে‌। এলিজা উপেক্ষা করে রান্না ঘরে চলে যায়।
চাঁদনী এইঘর ও ঘর ঘুরছে। হঠাৎ চোখ পরে পেছনের ঝোপঝাড় এর দিকে ‌।দেখছে অপূর্ব ঝোপঝাড়ে বসে কিছু করছে।এত সকাল সকাল অপূর্ব ওখানে কেন। চাঁদনী আগ্রহ নিয়ে দেখতে যায়। চাঁদনী পেছন থেকে দেখলো, একটা মাঝারি আকারের রাম,দা ধার দিচ্ছে‌‌।
চাঁদনী নরম কন্ঠে বললো,এটা দিয়ে কি হবে?
অপূর্ব উল্টো দিকে ঘুরেই জবাব দিলো, জঙ্গল পরিষ্কার করবো

এলিজা রান্না করছে। কিন্তু তার মনে গহীন চিন্তা আবরন করেছে। অপূর্ব হঠাৎ করে তার আচরণ বদলে নেয়াতে এলিজা চাপসে যাচ্ছে। অপূর্বর চোখের ঘৃনিত চাহনি।কর্কট মেজাজ , এলিজা-কে পুরিয়ে দিচ্ছে। এলিজা ভাবছে,সে কি আর আমার সাথে কথা বলবে না,আর কি আমাকে ম্যাডাম ডাকবে না, আমার না বলা কথা গুলো কখন ও কি তাকে বলতে পারবো!।এসব ভাবতে ভাবতে মনোরা এলিজার ভাবনা ভাঙিয়ে দেয়। মৃদু হেসে বললো, তোমার করাই এখন ই জ্বলে উঠতো। এলিজা কিছু বললো না। সকলের জন্য খাবার তৈরি করলো,।
চাঁদনী অপূর্ব কে পেছন থেকে পরোখ করছে। অপূর্বর পরনে সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা,কালো জুতো।বা হাতে ঘরি।ভারী দেহখানি নিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে আছে। চাঁদনী দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলো,কি করবি এটা দিয়ে? অপূর্ব রা,মদা তে ধার দেয়া বন্ধ করে বললো,এই জঙ্গল পরিষ্কার করবো।লতাপাতায় ভরে আছে। চাঁদনী বললো, পরিষ্কার করার জন্য বাড়িতে অন্য লোক আছে‌।

অপূর্ব নরম গলায় বলল,নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়।
এলিজা অপূর্বর খোঁজে ঘরে আসে।ঘরে নেই। এলিজা এদিক সেদিক পরোক্ষ করতে উপস্থিত হয় অপূর্ব। এলিজা কিছু বললো না।, অপূর্ব দেখেও না দেখার ভান ধরলো। এলিজা কাপা কন্ঠে বললো,খাবেন না?
খিদে নেই।
আমার উপর রাগ,ঘৃনা চেপে রেখে নিজেকে কষ্ট দিবেন না।
অপূর্ব ঠোঁট কুঁচকে হেসে বললো, আমার সামনে এসো না।
এলিজা অপূর্বর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললো, কি করবেন আসলে! অপূর্ব দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।
এলিজা ভেজা গলায় বললো, এরকম করবেন না। আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিবেন না। কষ্ট হয় যে।
অপূর্ব কর্কট স্বরে বললো, তোমার মনে অন্য কারো জন্য মায়া থাকতেই পারে না।আমি জানি না,তুমি আবার ফিরে কেন এসেছো।

অপূর্ব উল্টো দিকে ঘুরে ভেজা কন্ঠে বললো,যদি তুমি আমাকে ভালোবাসতে তবে তোমার অতীত ,সমস্ত কিছু আমাকে বলতে। জানি আমার বাবা সবকিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু তুমি চাইলে,আমরা দুজন মিলে অপরাধিদের শাস্তি দিতাম।ন্যায় বিচার হত।
তবে এই মৃত্যু খেলা আর হতো না।
এলিজা জ্বল জ্বল চোখে বললো, আমি আপনাকে হারানোর ভয়ে বলিনি।
অপূর্ব এলিজার দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো, এখন কি নতুন করে, আমার আবেগ বাড়িয়ে তবেই আমাকে শেষ করবে!এই ভেবেছো?
এলিজার এই কথার জবাব দেয়ার মত শব্দ নেই। অপূর্ব এলিজাকে উপেক্ষা করে যেতেই,খাটের সাথে পা লেগে হোঁচট খেয়ে পরে যেতেই, এলিজা অপূর্ব কে ধরে ফেলে। অপূর্ব এলিজার দৃষ্টি স্থাপন করলো। এলিজা কাট গলায় বললো,আমি আপনাকে শেষ করতে নয়, আপনার বিপদে ঢাল হয়ে থাকতে চাই। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আপনাকে রক্ষা করবো। অপূর্ব এলিজার হাত সরিয়ে চলে যায়।

অপূর্বর ঘৃনিত আচরণ এলিজা কে দুমরে মুচড়ে দিচ্ছে।কোন ভাবেই বোঝাতে পারছে না,যে অপূর্ব কে সত্যিই ভালোবাসে।এলিজা অপূর্বর যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।
মমতাজ পাখি এবং শ্রাবনের জন্য রান্না করছে। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয় এলিজা।নরম গলায় বললো,কাকি আমি আজকে হাসপাতাল যাবো।পাখিকে অনেক দিন দেখা হয়নি।জানি না ও কেমন আছে। মমতাজ যেতে বললো।
এলিজা খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।এলিজা একা যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ মমতাজ বললো, একা যাবে?এলিজা বললো,এখন থেকে একাই পথ চলতে শিখতে হবে।ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই,কথাটি অপূর্ব শুনে নেয়।
এলিজা বাহিরে বের হয়। এলিজা অপূর্বর জন্য অপেক্ষা করছে, ভাবছে আমি একা যাচ্ছি জেনেও উনি আসলো না।এলিজা পেছনের দিকে তাকিয়ে অপূর্বর পথ চেয়ে থাকে। অপূর্ব আসলো না।

এলিজা গাড়িতে বসে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করবে,ঠিক তখনি অপূর্ব আসে।এলিজা অপূর্ব কে দেখে মৃদু হাসে। অপূর্ব ড্রাইভার কে কাট গলায় বললো,তুমি বাড়িতে থাকো।ড্রাইভার বললো,দাদাবাবু আপনি গাড়ি চালাবেন! আপনি বউমনির সাথে পেছনে বসেন। অপূর্ব গাড়ির দরজা খুলে বললো, নামো।ড্রাইভার নেমে যায়। অপূর্ব গাড়ি ড্রাইভ করে।এলিজা পেছনে বসে পরোখ করছে।এলিজার ঠোঁটের কোনে অজান্তেই হাঁসি চলে আসে। কিন্তু অপূর্বর চোখের ঘৃনার দর্পন দেখা মাত্রই বুকের ভেতর দুমরে মুচড়ে ওঠে। অপূর্ব গাড়ির মধ্যখান লুকিং গ্লাস দিয়ে পেছনে এলিজার দিকে পরোখ করে বললো, ভেবো না আমি তোমার জন্য যাচ্ছি। শ্রাবন এর সাথে কথা আছে তাই যাচ্ছি। এলিজা কিছু বললো না।
পৌছে যায় হাসপাতালে।এলিজা কে দেখা মাত্রই পাখি হকচকিয়ে উঠে। এলিজা কে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কান্না শুরু করে।এলিজা পাখিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।এলিজা কাপা কন্ঠে বললো, আমার পাখির কিছু হবে না।পাখি ভাঙা গলায় বললো, এতদিন কোথায় ছিলে তুমি।আমায় দেখতে আসলে না।এলিজা বললো, মামির শরীর টা ভালো না তাই সেখানে ছিলাম। অপূর্ব পেছনে দাঁড়িয়ে,মনে মনে বললো, এত নিখুঁত অভিনয় কিভাবে করে। ছলনাময়ী।সবার সাথে ছলনা করে।

এলিজা পাখির জন্য আনা খাবার খাইয়ে দেয়। অপূর্ব শ্রাবন কে নিয়ে বাহিরে বের হয়।
এলিজা কে পেয়ে পাখি সস্থি অনুভব করলো।দুই বোন মিলে ছোট বেলার এটা ওটা ব্লা ব্লা অনেক কথা বলছে। আর হাসছে।পাখির মুখের হাঁসি দেখে এলিজা শান্তি অনুভব করলো। অপলকে পাখিকে দেখলো। জ্বলজ্বল চোখে ভাবলো,সেদিন যদি আমাদের পরিবার টা এভাবে ধ্বংস না হয়ে যেত তবে, আজ পাখির এমন অবস্থা দেখতে হতো না।পাখির এরকম অবস্থা দেখতে ভালো লাগছে না।তার মাঝে আমার প্রানময় স্বামির ঘৃনিত চাহনি যে,-বি,ষের চেয়েও বিষাক্ত।বাবা মায়ের আদর স্নেহ থেকে অতি কম বয়সে বঞ্চিত হলাম। বঞ্চিত হলাম সুখময় জিবন থেকে।আর নিয়তির নির্মম খেলায় আজ নিজের স্বামির চোখে ভালোবাসার বদলে ঘৃনা দেখতে হচ্ছে।এলিজার চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরে। পাখি পরোখ করে বললো, কাঁদছো কেন?এলিজা চোখের পানি মুছে বললো ،তোর মুখে হাঁসি দেখে।
অপূর্ব শ্রাবন কে নিয়ে গ্লাসকোব ফরেন্সিক ল্যাবে যায়।সেখান থেকে কিছু কেমিক্যা,ল এবং ইনজেকশন নেয়। শ্রাবন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,এসব নিয়ে কি হবে?

অপূর্ব মৃদু হেসে বললো আমাদের ফ্যাক্টরিতে দরকার।দুজন একসাথে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অপূর্ব থম মেরে দাঁড়িয়ে বললো, তুই অপেক্ষা কর আমি আসছি। অপূর্ব ফরেন্সিক ল্যাবে যায়। ফরেন্সিক ডাঃ নুহার সাথে কিছু কথা বলে।
কথা বলা শেষে দুইভাই মিলে রওনা হয় হাসপাতাল এর উদ্দেশ্যে। অপূর্ব শ্রাবন কে বাহির থেকে জোর করে কিছু খাওয়ায়। শ্রাবন পানাহার থাকায়,চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। অপূর্ব তা পরোখ করলো।
হাসপাতালে ফিরে পাখির সাথে কিছু কথা বলে, অপূর্ব ।শরীরের কি অবস্থা হান তান।পাখি মৃদু হেসে উত্তর দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখি শ্রাবন, এলিজা অপূর্ব একসাথে আড্ডা দেয়।পাখি সকলকে দেখে কিছুটা শান্তি অনুভব করে।সবার কথার মাঝে পাখি খেয়াল করলো, এলিজা আর অপূর্বর মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।যেটার অপূর্ব আর এলিজার মুখের ভাষাই বলে দিচ্ছে।

পাখি এলিজাকে এই নিয়ে কোন প্রশ্ন করলো না। অপূর্ব এলিজা হাসপাতাল থেকে বের হয়।গাড়ি রাস্তার ওপার রাখা।রাস্তায় অনেক জ্যাম।এলিজা অপূর্বর পাশে।এলিজা মনে মনে ভাবলো,এত জ্যামের ভিতর কিভাবে রাস্তা পার হবো।একটা বার আমার দিকে ঘুরেও দেখছে না।এতটা দূরে ঠেলে দিলেন।এলিজা এসব ভাবতে না ভাবতেই, অপূর্ব এলিজার ডান হাত টা শক্ত করে ধরে।এলিজা হকচকিয়ে উঠে। অপূর্ব এলিজাকে নিজের বা দিকে রেখে রাস্তা পার হয়।এলিজা অপূর্বর দিকে পরোখ করলো। গাড়িতে অপূর্ব এলিজাকে বসিয়ে দেয়।সহর থেকে গাড়ি নিয়ে বের হতে থাকে। অপূর্ব লুকিং গ্লাস দিয়ে পরোখ করলো,এলিজা আগ্রহ নিয়ে বা দিকের রাস্তার পাশে তাকিয়ে আছে। অপূর্ব আগ্রহ নিয়ে,তাকায়। অপূর্ব দেখতে পায় এক-লোক বেলিফুলের মালা বিক্রি করছে।সেদিকেই এলিজা দেখছে। অপূর্ব উপেক্ষা করে চলে যায়।
রাত ১০ টা নাগাদ —

বৈঠকখানায় সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে।নূরনেসা বেগম, তাদের অতিতের কথায় মশগুল।জয়ার সাথে শৈশব কাল কেমন ছিলো ব্লা ব্লা। জাহাঙ্গীর এক কোনে ঘাপটি মেরে বসে আছে।পাপের অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে।তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। এলিজা সবাইকে চা দিচ্ছে। অপূর্ব চায়ের কাপ টা হাতে নেয়। কিন্তু চা-টা খেলো না।এলিজা পরোখ করলো। রাত বেড়ে চলেছে।

পাখি আগের থেকে বেশ কিছু টা সুস্থ। শ্রাবন পাখিকে নিয়ে রাস্তায় হাটতে বের হয়। চাঁদনী রাতে ভরা জ্যামের পাশে শান্ত গলিতে দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। শ্রাবন পাখির দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে, মৃদু হেসে বললো, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত, পাশাপাশি ,তোমার সাথে এভাবেই হাঁটতে চাই।পাখি শ্রাবনের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে।পাখি কিছু বললো না। শুধু চেয়ে চেয়ে শ্রাবন কে দেখছে। উষ্কখুস্ক কোকরা চুল,ক্লান্তি মুখ,দাড়ি কিছু টা বড় হয়েছে,তার সাথে ফর্সা মুখ। শ্রাবন পরোখ করে বললো,এভাবে কি দেখছো! একদম এলোমেলো হয়ে গেছি!সুন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে! আমার তো এখন ভয় হচ্ছে! আশেপাশে কত স্মার্ট ছেলেরা। না জানি আমার বউয়ের দৃষ্টি তাদের দিকে চলে যায়।পাখি কাট গলায় বললো, আপনি ছাড়া অন্য কোন পর পূরুষের দিকে দৃষ্টি পরলে,সেই চোখ আমি নিজেই উপরে ফেলবো।
শ্রাবন নরম গলায় বলল, আমি দুনিয়ার সেই হতভাগা যে তার প্রিয় মানুষ টিকে কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলছি। প্রতিদিন তাকে হারানোর ভয়ে হয়। আমার মত আর কি কেউ আছে,যে তার প্রিয় মানুষ টিকে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত হারানোর ভয় করে।পাখি পরোখ করলো, শ্রাবণ কাঁদছে।

রাতে সবাই খেয়ে সুয়ে পরে। এলিজা অপেক্ষা করছে কখন অপূর্ব ফিরবে।রাতের খাবার না খেয়েই বেড়িয়ে যায়। হঠাৎ কোথায় যায়,কি করছে কিছু বুঝতে পারছে না। অপূর্বর এরকম আচরণ এলিজা কে ভাবাচ্ছে। এলিজা এসব ভাবনা থেকে বেড়িয়ে,নূরনেসার ঘরে যায়।নূরনেসা ,রাত অনেক পর্যন্ত জেগে থাকে এটা তার অভ্যাস। এলিজা একাকিত্ব অনুভব করাতে, গল্প করতে আসে।কোন ভাবেই এলিজার মনে শান্তি আসছে না।মনটার ভেতর কুহ ডাকছে। শুধু মনে হচ্ছে কিছু একটা ধেয়ে আসছে।নূরনেসা ,সাদা রঙের শাড়ি পরা,চুল গুলো কোকরা। সবসময় মাথায় কাপড় রাখে‌। নুর নেসা,এলিজাকে দেখে মৃদু হাসে। নুরনেসা এটা,ওটা বলছে। কিন্তু এলিজা তা খেয়াল ই করছে না।এলিজার মনটা ছটফট করছে।

এলিজা নূরনেসার সাথে কথা শেষ করে তার ঘর থেকে বেরোয়।নক খুঁটতে খুঁটতে হাঁটছে। এলিজার তৎক্ষণাৎ চোখ পরলো তিনতলায় আলো জ্বলছে। কিন্তু যে ঘরে আলো,জ্বলছে,ঐ ঘরে তো,কেউ কখনো যায় না। এলিজা আগ্রহ নিয়ে উপরে যায়। চারদিক নিশ্চুপ।কালো ধোঁয়া ধেয়ে আসছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ। এলিজা যেতে যেতে দেখলো, তিনতলার বন্ধ স্টোর রুমটা খোলা। এলিজার খটকা লাগলো। এলিজা এদিক সেদিক পরোক্ষ করে ঘরটার দিকে এগোয়।এলিজা যা দেখলো,তাতে সম্পুর্ন ভাবে হতভম্ব হয়ে যায়। অপূর্ব বন্ধ স্টোর ঘরটার ভেতর কিছু করছে।

এলিজা জানালা দিয়ে দেখছে।কি অদ্ভুত অপূর্বর আচরণ। তার হাবভাব স্বাভাবিক নয়। এভাবে কিছুক্ষণ এলিজা দেখলো। অপূর্ব কাজ শেষ করে বের হতেই এলিজা লুকিয়ে পরে। অপূর্ব হাতের উল্টো দিক দিয়ে ঘাম মুছে চলে যায়। এলিজা মনস্থির করলো কি আছে এই ঘরে তা দেখতে হবে।এলিজা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। চারদিকে পূরানো জিনিস এলোমেলো করে রাখা।সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। এলিজা একটু দূরে খেয়াল করলে,দেখতে পায় একটা ওয়ারড্রপ। এলিজা আগ্রহ নিয়ে ভেতরে কি আছে দেখে। ভেতরে যা ছিলো তা,দেখে এলিজা বিষন্নত হয়ে যায়। ড্রয়ারে রাখা, ফ্লোরিক্সা ডাইন-যেটা এক ধরনের কেমিক্যাল।এই কেমিক্যাল শরীরে পুশ করলে,তার বুক থেকে হা,র্ট বের করে নেয়ার পরেও সে ১৫ মিনিট বেঁচে থাকে, শুধু এই কেমি’ক্যাল এর সাহায্যে।

এলিজা ভালো করে চিন্তে পেরেছে।কারন,এই কেমিক্যাল তারা ২৭ বছরের ছেলেদের হা,র্ট পাচার করাতে ব্যাবহার করতো। এলিজা ভ্রু কুঁচকে বিরবির করে বললো, এগুলো দিয়ে উনি কি করছেন। এগুলো তার কাছে কিভাবে আসলো।এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কেন করছে।এসব ভাবতে ভাবতে এলিজা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।একা একা বির বির করছে আর হাঁটছে।এলিজা ঘরে গিয়ে দেখলো অপূর্ব সেখানে নেই।এইতো ফিরলো আবার কোথায় যাবে। এলিজা ঘরের এদিক সেদিক পরোক্ষ করতেই দেখে,খাটের উপর বেলিফুল রাখা।এলিজা অবাক হয়। এলিজা ফুল গুলো হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকে।বুকের মধ্যে জড়িয়ে,বললো আপনি সামনের দিকে ঘুরেও,ব্যাস্ত শহরের মাঝেও আমার চাহনি কে খেয়াল করেছেন’পথের বাঁকে থাকা বেলিফুল আমার নজরে এলো’সেই নজর যে ,নিশানা করেছে আপনাকে। আপনার মত স্বামী পেয়ে আমি গর্বিত। কিন্তু তবুও কোথায় একটা শূন্যতা পরে আছে।

এলিজা পর্ব ৭৫+৭৬

এলিজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনের অজান্তেই কাদছে।চোখ থেকে অঝরে পানি পরছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
এক অজানা বেথা গ্রা,স করেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে, আকাশের দূরদূরে তারাদের আগমন। চারদিক নিশ্চুপ। চাঁদনির আলোয় চারদিক আলোকিত।হঠাৎ এলিজার চোখ পরলো ঝোপঝাড় এর দিকে। ঝোপঝাড় এ কেউ একটা আছে। এলিজা চোখ বড় বড় করে দেখার চেষ্টা করলে দেখে অপূর্ব—

এলিজা পর্ব ৭৯+৮০