মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬২

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬২
মির্জা সূচনা

ঠিক তখনই,
মেহরিন চোখ বন্ধ রেখেই, চুরি ধরা হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলে।
আক্রমণকারী হকচকিয়ে যায়।
মেহরিন মুচকি হেসে চোখ খোলে, বলে,
—তুই জানিস? আমার মন বলছিল তুই আসবি। আর দেখ, তুই এলিও! আমি তো জানি, আমার মন কখনও মিথ্যে বলে না।
আক্রমণকারী হেসে হেসে বলে,

— উহ্ফ, মেহরিন! তুই সত্যিই চালাক। কিন্তু আফসোস, এত চালাকি করেও লাভ নেই। কারণ তুই আর তোর সন্তানরা—তিনজনেই আজ আমার হাতে মরবি।
সে চুরিটা মেহরিনের গায়ে চালাতে চায়।
কিন্তু মেহরিন হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে।
— উহ্ জেসি বেবি…..! জ্বালিয়ে দিলে মেজাজটাই! আমি পর্যন্ত ঠিক ছিল, তাই বলে আমার সন্তানের দিকে হাত বাড়াবি? মানে কী! মুড টাই নষ্ট করে দিলি ছেহ…
মেহরিন এবার থামে। তারপর মুখ শক্ত করে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— আমি যখন শুধু ‘মেহরিন’ ছিলাম, তখন’ই তো কিছু করতে পারলি না। আর এখন আমি একজন ‘মা’।
তুই জানিস না বোধহয়—একজন নারীর চেয়েও একজন মায়ের শক্তি বেশি।
একজন মা তার সন্তানকে বাঁচাতে দশ-বারোজনের জীবন অনায়াসে নিতে পারে।
এই কথা বলেই, মেহরিন তার বাম হাত দিয়ে একটা কষিয়ে থাপ্পড় দেয় আক্রমণকারীর গালে।
জেসি ছিটকে পরে।
ঠিক তখনই শিশ বাজাতে বাজাতে রাজ ঢুকে কেবিনে।
জেসিকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে দরজা বন্ধ করে দেয়।
তারপর মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
—বউ! আমার একটা গান গাইতে ইচ্ছা করছে। গাই….!
মেহরিন হেসে বলে,

— অবশ্যই।
রাজ গেয়ে ওঠে,
Jab koi larki dekho, mera dil deewana bole—ole ole ole!!!
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, রাজ জিভ কামড়ে নেয়।
মেহরিন হেসে বলে,
— ভুল গান!
রাজ মাথা চুলকে বলে,
— তুমিই আসলটা গাও!
মেহরিন গায়,
— Jab koi shotro dekho, mera dil deewana bole—mardo mardo mardo!!!
জেসি অবাক হয়ে বলে,
— এটা আবার কোন গান?
রাজের যেনো সহ্য হয় না। সে খেঁকিয়ে উঠে বলে,
—তুই বেশি জানিস! ওটাই ঠিক। আমার বউয়ের ভুল ধরিস! আমার বউ কখনো ভুল বলতেই পারে না। ওটাই ঠিক ঠিক ঠিক বুজেছিস।
জেসি বলে,

— “রাজজজজ”
মেহরিন রেগে বলে,
— এই আমার বরকে নাম ধরে ডাকছিস কেন? আর একবার আমার বরের নাম ধরে ডাকলে মেরে মুখ ভেঙ্গে দেব মুখপুরি..!
জেসি রেগে তাকায়, রাজ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
মেহরিন রাজের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— এখনও ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছিস কেন আহাম্মক? জানিস না, তোকে দেখলেই এই মেয়ের ছোক-ছোকানি বেড়ে যায়!
রাজ কপাল কুঁচকে তাকায়।
হঠাৎ করেই জেসি উঠে রাজকে জড়িয়ে ধরে।
রাজ ও মেহরিন—দুজনেই অবাক!
মেহরিন রেগে তাকায় রাজের দিকে,
রাজ ধাক্কা দিয়ে জেসিকে ফেলে দিয়ে বলে,
— ছিঃ ছিঃ ছিঃ! লজ্জা করে না? পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরতে? আমি আমার বডির সব পার্ট আমার বউয়ের, একদম আমার সাথে ঘেষা-ঘেষি করবিনা বেয়াদব মহিলা!
জেসি বলে,

— Raj, I am not mohila! I’m still a girl, you know? Baby I love you… please, try to understand. I love you lot!”
রাজ মেহরিনের দিকে তাকায়,
মেহরিন উঠে এসে জেসিকে উঠিয় দেয় এক থাপ্পড়। তারপর আরেকটা।
৫-৬টা থাপ্পড়ের পর জেসি উঠে দাঁড়ায়। মেহরিনের চুল ধরে।
মেহরিনও চুল টেনে ধরে জেসির।
রাজ বলে,
— এই ডাইনী, ছাড় ছাড় বলছি আমার বউকে ছাড় ডাইনী!
সে গিয়ে মেহরিনের চুল থেকে জেসির হাত সরিয়ে দেয়।
মেহরিন এবার চুল ছাড়া পেয়ে আরও জোরে টেনে ধরে জেসির চুল।
রাজ চোখের ইশারায় বলে, আরও মারও!
মেহরিন সুযোগ ছাড়ে না।
চুল টেনে একদম কাকের বাসার মতো করে ফেলে জেসির মাথা।
চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে যখন ক্লান্ত, তখন হঠাৎ দেখে রাজ জেসির হাত ধরে আছে।
মেহরিন চিৎকার করে বলে,

—তুই ওর হাত ধরলি কেন?
রাজ চট করে হাত ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে বলে,
— আরে বউ! আমি তো ওভাবে ধরিনি। মানে… না মানে… আসলে কী হয়েছে বলো তো আমি তোমার!
মেহরিন হাত তোলে বলে,
— থাক বুজে গেছি।
রাজ গিয়ে, টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে রাজ বলে,
— এই নাও, একটু পানি খাও। চুল ছিড়া ছিড়ি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছো। আজ একদমই মারতেই পারলে না।
মেহরিন মাথা নাড়ে,
— হ্যাঁ, শরীরটা একটু দুর্বল তো তাই,মারতেই পারলাম না।
আর ওদিকে মেজেতে পরে থাকা জেসি রাজ-মেহরিনের কথা শুনে মনে মনে ভাবে,
এরা কি পাগল!
আমি তো ভেবেছিলাম রাজ শুধু ভালোবাসে তার বউকে। কিন্তু সে তো পুরোই বউয়ের দাস!

কিন্তু মেহরিনের প্রতি রাজের এত যত্ন, এত ভালোবাসা দেখে তার আর সহ্য হয় না।
জ্বলে ওঠে ভেতরটা।
তাই একরকম দানবীয় ক্ষোভে উঠে গিয়ে মেহরিনের গলা চেপে ধরে!
মেহরিন কিছু বলে না, বাধাও দেয় না।
রাজ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর গর্জে ওঠে,
— ওকে ছাড়! বলছি ছাড়!!
জেসি ভয় পায়—কিন্তু তা প্রকাশ করে না।
রাজ মুহূর্তেই তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয়।
দেয়ালে ঠেসে ধরে গলা চেপে ধরে।
জেসির মুখ মুহূর্তেই লাল হয়ে যায়, চোখে পানি জমে ওঠে, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে…

— তোকে আমি ছাড়ব না! তুই আমার বউ আর সন্তানদের মারতে চেয়েছিলি! তা যখন পারলি না এখন আবার এসেছিস।
তার চিৎকারে বাচ্চারা ঘুম ভেঙে কেঁদে ওঠে।
মেহরিন তাড়াতাড়ি ছুটে যায় ওদের থামাতে।
ওদিকে রাজের তাণ্ডবে কেবিনে ঢুকে পড়ে শান্ত, রিদ, কাসেম আর লাবিব।
জেসিকে দেখে তারা অবাক হয় না—কারণ সবাই জানত, জেসি আসবেই।
তবে রাজকে এখন থামানো দরকার।
লাবিব আর রিদ দুজনে মিলে রাজকে বোঝায়,
— ভাই, ছাড়ো! ও মরে যাবে! প্লিজ!
রাজ চোখ রাঙিয়ে বলে,

—মরে যাক! ও মরবেই—কিন্তু এত সহজে নয়।
ও আমার বউ আর সন্তানদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল—তাই ও মরার যোগ্য!
এই বলে এক ধাক্কায় হাত সরিয়ে নেয় রাজ।
জেসি ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়।
পরে গিয়ে কাশতে থাকে, গলা চেপে ধরে শ্বাস নিতে থাকে।
লাবিব এগিয়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি দেয়।
রিদ ও শান্ত রাজকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
আর মেহরিন তখনও ছেলেদের শান্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত।
পানি খাওয়া শেষ হতে না হতেই রাজ ঠান্ডা গলায় বলে,
— পানি খাওয়া বেশি করে। পারলে কোলেও উঠে বসে থাক।
কিন্তু ভুলে যাস না—এই তুই- যাকে এত আদর সোহাগ করে পানি খাওয়াচ্ছিস সেই তোর মা, বোন আর বউকে মরণের পথে প্রায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

এই কথায় মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ।
লাবিবের চোখে এক ঝলক দৃশ্য ভেসে ওঠে—
রূপা বেগমের রক্তাক্ত দেহ, লামিয়ার নিথর মুখ,
মেহবুবার ক্ষতবিক্ষত শরীর…
হঠাৎই লাবিব এক ঝাঁকুনি দিয়ে জেসির গলা চেপে ধরে।
রিদ কপালে হাত চেপে দাঁড়িয়ে পড়ে, আবার দৌড়ে গিয়ে লাবিবকে থামায়।
—ভাই, ছাড় ওকে! ছাড়!
লাবিবের ঘেন্নাভরা চোখে আগুন,
শেষ পর্যন্ত শারীরিক শক্তি দিয়ে এক লাথি মারে জেসির পেটে!
জেসি মাটিতে পড়ে যায়, মুখে হাত চেপে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
রিদ দাঁড়িয়ে বলে,

— তুমি যা করেছো, এটা তোমার প্রাপ্য।
এখন চুপ করে চলে যাও, জেসি। বাঁচতে চাইলে এখান থেকে বিদায় হও।
জেসি চোখে রক্তজবা রাগ, চোখে পানি, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— আমি মরবো তাও ! আমি যাব না এখান থেকে!
রাজকে পাওয়ার জন্য আমি কী করিনি? সব দিয়েছি আমি!
রাজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে,
— কী আছে ওই মেয়েটার মধ্যে যা আমার মধ্যে নেই?
আমি কি কম সুন্দর? ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, শিক্ষা, টাকা-পয়সা—সবকিছুতেই তো আমি ওর থেকে ভালো!
তবু তুমি কেন শুধু ওকে ভালোবাসলে?
আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য তোমার পায়ের নিচে পড়েছি!
তুমি শুধু একবার চাইলে সব দিয়ে দিতাম তোমাকে!
কিন্তু তুমি তবুও আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে!
আমার অপরাধটা কী ছিল? শুধু তোমাকে ভালোবাসা?
জেসির উন্মত্ততা দেখে রিদ কিছু বলতে পারে না।
কিন্তু লাবিব থামে না।
সে বাচঁখায় গলায় বলে,

— তোর ভালোবাসার মায়রে বাপ!
ভালোবাসা মানে বোঝিস তুই।
ভালোবাসলে মানুষ তার ভালো থাকা দেখে খুশি হয়।
ভালোবাসলে মানুষ কাউকে কষ্ট দেয় না।
ভালোবাসলে তার সুখ কেড়ে নিতে চায় না।
তুই রাজকে ভালোবাসিস বলিস?
তুই রাজকে ভালোবাসলে ওর সুখ দেখে খুশি হতে পারতি!
ওর বউ, ওর সন্তান, ওর পরিবার—তাদের মারতে চাইতিস না!
ভালোবাসলে তুই নিজের জীবন দিতিস, জীবন নিতিস না!
এটা তোর ভালোবাসা না, তোর জেদ!

তুই যা চাইছিস তা-ই চাইছিস জোর করে হলেও পেয়েছিস সব!
তাই তো, রাজ যখন তোকে ফিরিয়ে দিলো তুই হিংসায় জ্বলে পুড়ে গেলি!
এই জেদ থেকেই তুই একের পর এক নানা ছক কশে গেছিস দিনের পর দিন।
এমন কী জীবন কেড়ে নিতেও চেয়েছিস!
আমার মা, বোন, বউ—সব এখন হাসপাতালে বেডে শুয়ে আছে শুধু তোর জন্য!
ভালোবাসা না, এটা জেদ! শুধু আর শুধু তোর জেদ!!
লাবিব থেমে যায়।
ঘর নিস্তব্ধ।

জেসি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে লাবিবের দিকে।
তারপর কোনও কথা না বলে একরকম উঠে দাঁড়ায়।
নীরবে চলে যেতে থাকে… একা।
সবার মুখে তখন একটিই দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
মেহরিন বাচ্চাদের আবার ঘুম পাড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বলে,
— শান্ত হন, আপনারা।
লাবিব, তুমি যাও… একটু বিশ্রাম নাও।
রিদ ভাইয়া, আপনারাও যান।
সবাই একে একে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
তারপর মেহরিন আস্তে আস্তে রাজের কাছে এসে দাঁড়ায়।
রাজ মেহরিনকে নিজের কোলে বসিয়ে চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে মেহরিনের কপালে একখানা চুমু দেয়।
মেহরিন রাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর হঠাৎই বলে ওঠে,

— আপনি ওর হাত ধরলেন কেন?
রাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
— তোমাকে যে ওকে মারার সুযোগ করে দিলাম—তা দেখলে না? আমি না থাকলে তো চুল ছেঁড়াছিঁড়ির যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।
আর ভাবো তো— এটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেলে কেমন লাগত?
মি. শিকদারের বউ একজন মেয়ের সঙ্গে চুল ছেঁড়া ছিড়ি করছে… ভাবতেই তো খারাপ লাগছে।
তবে যা-ই বলো, তুমি কিন্তু একদম মারতে পারলে না আজ।
মেহরিন রাজের বুকে মাথা রেখে হালকা কণ্ঠে বলে,
— শরীর দুর্বল তো তাই…
রাজ হেসে বলে,

— বলে থাক কষ্ট পেয়েও না অন্য দিন পুষিয়ে নিও।
সে মেহরিনকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যায়।
তাকে শুইয়ে দেয় ধীরে ধীরে,
আর নিজেও পাশে শুয়ে পড়ে মেহরিন কে জড়িয়ে ধরে।
সেই মুহূর্তে সব উত্তাপ, সব ক্লান্তি, সব ভয়…
এক ঝটকায় যেনো মিলিয়ে যায়।
বিছানার এই নিরবতায় কেবল শোনা যায়—
একটা নিঃশ্বাস… আরেকটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

সকাল হয়েছে তখন সময় ৭টা।
রাজের ঘুম ভেঙে যায় হালকা আলো চোখে লাগায়। আর বারির থেকে ও অনেক মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
রাজ চোখ মেলে দেখে, মেহরিন ঠিক তার বুকের ওপর গা ঘেঁষে শুয়ে আছে, নিঃশ্বাস ফেলছে ধীরে ধীরে।
রাজ হেসে কপালে একটুকরো চুমু খেয়ে খুব সাবধানে মেহরিনকে বিছানায় শুইয়ে দেয়, তারপর নিজের শার্ট ঠিক করে বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে।
কেবিনের বাইরে এসেই দেখে—
মেহের, মালিহা মির্জা, ফিরোজ মির্জা, মাহির, ফাইজা চৌধুরী, আরশ, আরফা আর আকরাম চৌধুরী বসে আছেন।
রাজ এগিয়ে গিয়ে বলে,

— মামা, এত সকালে কেন চলে এলে?
আকরাম চৌধুরী হেসে বলেন,
— আমার এতগুলো কাছের মানুষ অসুস্থ, তার উপর আমার মেহু মা আর রাজের সন্তান হয়েছে আমি সময় দেখে আসবো বলছো? এটা কেমন কথা?
রাজ হেসে বলল,
— আচ্ছা, আপনার ইচ্ছা।
আরশ বলে ওঠে,
— ভাই, কংগ্র্যাচুলেশন!
রাজ হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানায়।
মালিহা মির্জা তখন বলেন,
— বাবা, মেহু উঠেছে?
রাজ মাথা নাড়িয়ে বলে,
— না মা, এখনও ওঠেনি।
ঠিক তখনই চুমকি এসে হাজির হয়।
সাথে শান্তও আসে।
দুজনের মুখে হাসির ঝলক, হাতে মোট চারটা টিফিন ক্যারি।
চুমকি এসেই বলে,

— ভাইয়া, মেহু উঠেছে।
রাজ চুমকির মাথায় হাত রেখে বলে,
— না বনু।
চুমকি মুখে বুজদারের ভঙ্গিতে বলে,
— “ওহ!”
তারপর মেহেরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
—মেহের, আমার সাথে আয়। মেহবুবা, রূপা আন্টি আর লামিয়াকে খাইয়ে আসি। পরে না হয় মেহুকে খাওয়াব।
মেহের মাথা নাড়িয়ে রাজি হয়।
মালিহা মির্জা অবাক হয় চুমকির এনন কাজে পর মূহুর্তেই হাসেন। এই এত এত টেনশনের মধ্যে খাওয়ার কথা কারো মাথায় ছিল না!
চুমকি হেসে মালিহা মির্জার কাছে গিয়ে বলে,
— চলো মামনি, তুমি তো বাইরের কিছু খাবে না। তাই আমি নিজে হাতে রান্না করেছি। চলে, দুই মুঠো মুখে দেবে।
মালিহা মির্জা হাসেন,

— আমার মেয়ে তো দেখি পুরো গিন্নি হয়ে গেছে!
চুমকি হেসে ফাইজা চৌধুরীকে বলে,
—ফুপ্পি, তুমিও চলো।
মালিহা মির্জা, ফাইজা চৌধুরী আর মেহের চলে যায় চুমকির সঙ্গে।
রাজ তখন আকরাম চৌধুরী আর ফিরোজ মির্জার মাঝে গিয়ে বসে।
বলে,
— বাবা, আপনি কি রাগে আছেন আমার উপর?
ফিরোজ মির্জা বলেন,
— রেগে থাকব কেন? আসলে আমি আমার খুশিটা প্রকাশ করতে পারছি না।
একদিকে মেয়ে অসুস্থ, অন্যদিকে নানা হওয়ার আনন্দ।
আমার ভিতরটা যেনো হাঁপিয়ে উঠছে।
আকরাম চৌধুরী হেসে বলেন,

— আল্লাহ আছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে ভাইজান চিন্তা করবেন না।
সবাই একসাথে বলে ওঠে,
— “আমিন।”
ঠিক তখনই রিদ আর কাসেম এসে হাজির হয়।
হাতে একটা ট্রে, তাতে অনেকগুলো কফির মগ।
আরশ আর মাহির সাহায্য করছে সবাইকে কফি দিতে।
এই সময় দৌড়ে আসে রাহি।
চোখমুখের অবস্থা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, কী এক আতঙ্ক তাকে তাড়িয়ে এনেছে।
তার পেছনে রাকিব, যে মূলত রাহিকে খবরটা দিয়েছিল। আর সেটা শুনেই রাহি পাগলের মতো ছুটে এসেছে।
রাহি এসে রাজের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রিদ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে—সে জানে, এখন রাহি শুরু করবে তার পাগলামো।
রাজ জড়িয়ে ধরে তার আদরের বোনটিকে।

যদিও রাহি জানে না—রাজই তার আপন ভাই।
কিন্তু কে বলে, আপন ভাই না হলে ভালোবাসা কম হয়? রাহি জানে রাজ তার আপন ভাই না তাও অনেক ভালোবাসে।
রাহি রাজকে যেনো প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।
আর মেহরিন?
তার নাম শুনলেই রাহির হৃদয় নেচে উঠে। এক কথায় মেহু বপু বলতে পাগল সে।
রাহি রাজকে এক নিশ্বাসে প্রশ্ন করতে থাকে,
— ভাইয়া, আমার মেহু আপু ঠিক আছে তো? আমার মামনি, লামু, আমার সই মেহবুবা, সবাই ঠিক আছে তো? ভাইয়া, ওদের কিছু হবে না তো?
রাজ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
— কাঁদিস না পুচকি, সব ঠিক আছে।
তোর মেহু আপু একদম ঠিক আছে।
জানিস, তোর দুই দুইটা ভাইপো হয়েছে।
রাহির কান্না একটু কমে আসে।
মুখ তুলে বলে,

— “সত্যি?”
রাজ হেসে বলে,
— একদম, তিন সত্যি।
রাহি দৌড়ে যায় রিদের কাছে,
রিদকে ঝাকিয়ে বলে,
— দাদাভাই, সত্যি আমার দুইটা ভাইপো হয়েছে?
রিদ বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— হ্যাঁ, একদম সত্যি।
জানিস ওরা যখন জানবে, তোর মতো চিৎকার করে কাঁদুনি ফুপ্পি আছে ওদের—তখন ওরা কী বলবে?
— কি বলবে?— রাহি কৌতুহলী চোখে তাকায়।
রিদ হাসি চেপে বলে,
— বলবে—ছিঃ! এমন ছিচকাঁদুনে ফুপ্পি, আমরা মানি না মানি না!
রাহি রিদের বুকে কিল মেরে বলে,

— মোটেও না! আমি ওদের একদম ‘বন্দাস ফুপ্পি’ বুঝলে!
সবাই হেসে ওঠে—রাহির কথায় যেনে গোটা পরিবেশটা হালকা, প্রাণবন্ত আর মায়ায় ভরে যায়।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে পাঁচটা দিন।
আজ মেহরিনকে অবশেষে বাড়ি ফেরার অনুমতি দিয়েছে হাসপাতাল থেকে।
যদিও চাইলে আগেই যাওয়া যেত,
কিন্তু রাজের জন্যই থেকে যাওয়া।
রাজই বারবার বলে এসেছে—
তুমি পুরোপুরি না সুস্থ হলে আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না।
তাই… থেকেছে মেহরিন।
রূপা বেগম, লামিয়া আর মেহবুবাও এখন অনেকটাই সুস্থ।
তাদেরও আজ ছাড়া হবে।
অর্থাৎ সবাই আজ একসাথেই বাড়ি ফিরবে।
এই ছয় দিনে…

চুমকি, শান্ত, রাহি আর রাকিব—এই চারজন যেনো হাসপাতালেরই বাসিন্দা হয়ে উঠেছিল।
বললে চলে, পুরোটা সময়ই তারা ছিল মেহরিনদের পাশে।
আসা-যাওয়ার কোনো বিরতি ছিল না।
কোনো ক্লান্তি ছিল না চোখেমুখে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬১

ছিল শুধু—ভালোবাসা, টান আর নিজেদের মানুষদের জন্য নিঃস্বার্থ উপস্থিতি।
মেহরিন জানে—এই সময়টাই জীবনের সবচেয়ে বেশি শেখার, বোঝার, অনুভব করার সময়।
মানুষের মুখ, মন আর মনোযোগ—সব কিছুই একেবারে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় এমন সময়েই।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৩