প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১৫
শার্লিন হাসান
ওদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”
“আম্মা,মৈশানীকে ঠান্ডা পানি দ্যান। ও উল্টাপাল্টা কথা বলছে।”
সাজ্জাদ খানের কথায় জাইমা উঠে চলে আসে। কিচেনে গিয়ে নিজের পছন্দের বার্গার এবং মজো ট্রেতে নিয়ে রুমে আসে। সেগুলো টেবিলের উপর রেখে রুমে জুড়ে পায়চারি করা আরম্ভ করে। ইশরাক নিয়ে অনেক কিছুই চিন্তা করছে সে। সোফায় হেলান দিয়ে বসে মজোতে চুমুক দিচ্ছে। সামনে দু’টো বার্গার রাখা। জাইমা ঠান্ডা মাথায় খাচ্ছে আর চিন্তা করছে।
সে রাত টা জাইমার হতাশা,মন খারাপে কেটে গেছে। বিয়ের দিনে এসেপ তার মুড সুয়িং! স্ট্রেঞ্জ না? এক মিনিটের জন্যও বিছানায় গা লাগায়নি জাইমা। সারাটা রাত সোফায় বসা,আধশোয়া ছিলো। সারাবছর বিয়ের জন্য পাগলামি করলেও এই মূহুর্তে তাকে অদৃশ্য আড়ষ্টতা আটকে রাখছে। বুকটা জেনো হু হু করছে। সবকিছু খালি খালি লাগছে। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখা মেয়েটাও আগামী কালকে পরের ঘরে চলে যাবে। ইশশিরে! বাবার বাড়িতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকার নিয়ম নেই কেন? কেন সবসময় মেয়েদেরকেই বাপের ঘর ছেড়ে পরের ঘর আপন করে নিতে হয়? কেন বাবার বাড়ির রাজকন্যা একসময় বাড়ির অতিথি হয়ে যায়? এই জীবদ্দশায় কতশত অদ্ভূত নিয়ম। সেই নিয়মে গোটা একটা জীবন পার করতে হয়। একচুলও এফোঁড়ওফোঁড় করার সুযোগ নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফজরের নামাজ আদায় করে বিছানায় গা লাগাতে ঘুমের ঝংকার চলে আসে। জাইমা আর আপস করেনি। সারারাত নির্ঘুম কেটেছে তার। এই সাত সকালে ঘুমাবে সে।
বাড়ি জুড়ে হৈচৈ চলছে। সেই সাথে কাজ ও! খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডার করা হয়েছে। খুব একটা মানুষ হবেনা এ বিয়েতে। বিয়ে,বিয়ে আমেজ খুব একটা নেই, আবার আছেও।
সকাল বেলা দাদীকে কল দিয়েছে ইশরাক। রাহেলা খান ইশরাকের কল রিসিভ করেন। ইশরাক সালাম দেয় দাদীকে। সালামের জবাব পেতে ভালো মন্দ জিজ্ঞেসা করে। এক পর্যায়ে ইশরাক নিজপর মাঝের আড়ষ্টভাব নিয়ে বলে, “মৈশানী কী করে?”
রাহেলা খান খুশি হোন। চটজলদি জবাব দেন, “ঘুমাচ্ছে।”
“এতো বেলা অব্দি কেউ ঘুমায়?”
রাহেলা খান ঘড়িতে সময় দেখেন। ন’টা বেজে পনেরো মিনিট। সত্যি তো অনেক সময় কেটে গেছে। রাহেলা খান বলেন, “ছুটির দিনে ও দেরি করে ঘুম থেকে উঠে।”
“কয়টা বাজে?”
“এই এগারোটা বারোটা।”
“সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে ব্রেইন যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা কী জানে?”
“তুমি শিখিয়ে দিও।”
“তাই করতে হবে দেখছি।”
ইশরাকের কথায় রাহেলা খান মৃদু হাসেন। বাকীদের খোঁজ খবর জিজ্ঞেস করে কল রেখে জাইমার রুমে যান রাহেলা খান। রুমের প্রবেশ করতে,করতে জাইমার দিকে তাকান। সে বেঘোর ঘুমাচ্ছে। অথচ তার ঈদের খুশির মতো আনন্দ করার কথা ছিলো। ওই চাঁদ রাতে মেহেদী দিয়ে ঘুমালে, ঈদের দিন যত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে রেডি হওয়া যাবে সেরকম একটা আগ্রহ থাকার কথা ছিলো। কিন্তু না! সে ঘুমাচ্ছ।
রাহেলা খান জাইমাকে ডাকেন, “জাইমা উঠো,আজকে তোমার বিয়ে।”
জাইমা সারা শব্দ করেনা। রাহেলা খান বার কয়েক ডাকতে জাইমা বলে, “কী হয়েছে?”
“আজকে তোমার বিয়ে, আর তুমি এখন অব্দি ঘুমাচ্ছ?”
“আগামী কালকে বিয়ে করব। এখম ঘুমাতে দাও।”
কথাটা বলে জাইমা নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে যায়। রাহেলা খান ডাকতে থাকেন। কিন্তু মেয়েটা কোন রেসপন্স করেনা। রুম একটা অগোছালো পড়ে আছে। টেবিলের উপর, প্লেট,ট্রে,গ্লাস,সসের বোতল,মাম পট। বিছানা,ফ্লোর দুটোই অগোছালো।
রাহেলা খান রুপাকে ডেকে পাঠান। রুপা এসে জাইমার রুম গুছিয়ে দেয়।
ঠিক দশটায় ঘুম থেকে উঠে জাইমা। উঠেই সোজা শাওয়ারে ঢুকে যায়। আধঘন্টা নাগাদ বেরিয়ে আসে। একটু পর তার ফ্রেন্ডসরা আসবে। বাকী রিলেটিভ, অতিথিরাও আসবে। জাইমা ডালা থেকে শাড়ি গহনা বের করে। প্রথমত নিজের মেকআপ কমপ্লিট করে নেয়। খুব একটা সাজেনি। নো মেকআপ মেকআপ টাইপের লুক। চুলগুলো মাঝে সিঁথি করে টিকলি পরেছে। জামিলা এসে জাইমাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। পাশে বসা রুপা। সেও সেজেছে। জাইমার শাড়ি পরা হতে, দু-হাত ভরতি চুড়ি পরে নেয়। গলায় সিম্পলের মাঝে একটা নেকলেস। চুলগুলো খোঁপা করে গাজরা দিয়েছে। মাথার উপর দোপাট্টা পরে একবারে আস্ত বউ সেজে নিয়েছে। আজকে সে অফিশিয়াল ভাবে, ইশরাক খান মর্মের বউ হবে। সবকিছু গোঁজ গাঁজ করে উঠতে মেহের এবং তাসকিনের আগমন হয়। এসেছে জাইমার ফুফি এবং ফুফুর দুই ছেলে মেয়ে। তাদের একজন জাফরিন রহমান আরেকজন ইয়াশ রহমান। ইয়াশ আগামীতে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করবে। জাফরিন, অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। জাইমার সাথে কুশলাদি বিনিময় হতে,হতে বরপক্ষের আগমন হয়।
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পর দেবরের বাড়িতে এসেছে রাজিয়া রহমান। শুধু বিয়ের উসিলায়, নাহলে কখনোই তাঁদের সম্পর্ক ঠিক হতো না। সে কী রাগ দু-ভাইয়ের! অবশেষে সেটা সমাপ্তির পথে।
ইরা এসেই জাইমার পাশে বসে। সে আজকে সেজেছে বেবি পিংক কালার সারারা তে। মাথায় দু’টো জুটি। একহাতে গোল্ডের ব্রেসলেট পরা। একদম ছোট্ট পরী লাগছে তাকে। ইরাকে পেয়ে জাইমা খুশি হয়ে যায়। তবে মনে,মনে সে এক্সাইটেড। সত্যি বিয়েটা হচ্ছে? গতকাল রাতেই তো বিরহে ডুব দিয়েছিল। এখন আবার এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। ইরা জাইমার দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করে, “দুস্তু আন্নি তুমি চলে ইসেছো কিনু?”
“তোমার পাপা তাড়িয়ে দিয়েছে মা।”
“পাপা পঁচা?”
“অন্নেক বেশি।”
“আমি বুকা দিবু সুন্দর বুউ।”
জাইমা হেঁসে উঠে। ইরার গালে চুমু দিয়ে বলে, “তোমাকে তো পরী লাগছে, মা।”
“মাহিরা খান ইরা পরী।”
“হ্যাঁ, আমাকে কেমন লাগছে?”
“সুন্দর বউউ।”
রাজিয়া আহমেদ আনায়াকে নিয়ে জাইমার কাছে এসেছেন। উনার দুই বউ মাশাআল্লাহ ভীষণ মিষ্টি।
কিছুক্ষণ পর হুজুর আসে জাইমার রুমে। ইশরাকের বিয়ে পড়ানো শেষ। এখন জাইমার পালা। হুজুর যখন আসছিলো, জাইমার ধৈর্য কুলচ্ছিলো না। কখন বিয়ে হবে। ফাইনালি সে বিয়ে করবে।
হুজুর বসেই বিয়ে পড়ানো শুরু করে দেন। পাশে আছে, সাজ্জাদ খান। হুজুর জাইমাকে বলে, “বলো মা কবুল?”
জাইমা এক্সাইটেড হয়ে বলে, “মাশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, বিসমিল্লাহ কবুল,কবুল,কবুল।”
তখন জামিলা জাইমাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলেন, “এতো তাড়াহুড়োয় কেউ কবুল বলে? মেয়েরা তিনবারে তিনঘন্টা সময় নিয়ে কবুল বলে। আর তুমি? তিন সেকন্ডও দেরি করোনি।”
জাইমা মাথা নাড়ায়। বলে, “স্যরি।”
জাইমার উপরের দিকে তাকায়। অবশেষে তার বিয়েটা হয়েছে।
সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পিকচার্স তোলা হয়। ফ্যামিলি পিকচার্স, গ্রুপ পিকচার্স। ইশরাক এবং জাইমাকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। জাইমা মাথাটা নিচু করে রেখেছে। সত্যি বিয়েটা হয়ে গেলো? কেমন জেনো অনুভব হচ্ছে। কিছুটা ভয় এবং সংকোচ। ইশরাকের সাথে তার পরিচয় স্বল্প দিনের। তারউপর পোহা নামক মেয়েটা ঘাড়ের উপর। জাইমার টেনশন লাগছে কিছুটা। এতো সাধনা করে বিয়ে করলো, বর নিয়ে নিশ্চয়ই তামাশা দেখতে পারবে না।
ইশরাত আয়না এনে ইশরাকের হাতে দেয়। জাইমা আয়নাতে নিজেকে পরখ করছে। বউ সাজে সুন্দর লাগছে তাকে। ইশরাকের পাশে আরো বেশি দারুণ লাগছে নিজেকে। অন্যরকম অপরুপা, সুন্দরী নারী হিসেনে আবিষ্কার করল জাইমা। নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে। কারণ তার পাশে, নিজের কবুল বলা বর আছে।
ইশরাক আয়নাতে জাইমাকে দেখে। আনায়া এসে ইশরাককে জিজ্ঞেস করে, “আয়নাতে কী দেখো ভাইয়া?”
ইশরাক চুপ। কী বলবে? কী বলে উপমা দিবে? তার তো এসবে আইডিয়া শূন্য। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আমার বউ সে।”
সামান্য উত্তর! জাইমার সর্বাঙ্গে শীতলতা বইয়ে দিয়েছে। আমার বউ শব্দটায় আলাদা মাধুর্যতা ছিলো মানতে বারণ নেই। জাইমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, “আয়নাতে কী দেখো?”
জাইমা চটজলদি বলে, “ইশরাক খান মর্মকে দেখি।”
দু’টো নিরামিষ মানুষ! যা বলেছে তাতেই সবাই খুশি। জাইমা ইশরাকের একসাথে পিকচার তোলা হয়। এখানে কিছুক্ষণ থেকে জাইমা রুমে চলে আসে। তাদের রওনা হতে দেরি আছে। ইশরাক সবার সাথে কথা বলছে। জাইমার পেছন দিয়ে, আনায়া,ইশরাত এবং পোহা তিনজন আসে ।
সোফায় বসে কথা বলায় মত্ত ছিলো। পোহা সুযোগ খুঁজছিলো, কীভাবে জাই মাকে ছোট করা যায়। অনেকক্ষণ ভেবে বের করেছে। ইশরাতকে বলে, “শোন, তোর বিয়েতে তুই হুজুর কবুল বলতে বলার আগে আলহামদুলিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, মাশাআল্লাহ বলে কবুল বলে ফেলবি। খারাপ না ব্যপারটা।”
জাইমা বিরক্ত হয়। ইশরাত মৃদু হেঁসে বলে, “বাদ দে।”
“সিরিয়াসলি? একজন ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের বিহেভিয়ার এরকম?”
“সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১৪
আনায়ার কথায় পোহা বলে, “দেখব না! মর্মর যে রাগ, দ্বিতীয় দিনই থাপ্পড় দিয়ে রুম থেকে বের করে দিবে।”
জাইমা বিরক্ত হয়। কাট কাট গলায় বলে, “বিয়েতে এসেছ নাকী পাড়ার কাকীমাদের মতন আলোচনা বসাতে এসেছ?”
“ওমাহ্! তোমার দোষ গুণ বলছি। এরকম কয়জন বলে?’
জাইমা চটজলদি বলে, ” আমার বিয়েতে তোমায় দাওয়াত দিয়েছে কে?”
পোহা থতমত খেয়ে যায়। বলে, “মানে?”