চেকমেট পর্ব ৩৬

চেকমেট পর্ব ৩৬
সারিকা হোসাইন

ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ধারা আর কালো মেঘের আড়ালে সূর্য মামা কখন মধ্য গগনে গিয়ে ঠেকলো তার ঠাহর করা গেলো না।ঘড়ির কাটা টিকটিক করতে করতে বারোর ঘরে গিয়ে স্থির হলো।ঠান্ডা পরিবেশে সারফরাজ এর ঘুম আরেকটু গাঢ় হলো।বুকে একটা বালিশ জড়িয়ে কাঁথায় শরীর মুড়িয়ে গভীর ঘুমের দেশে নিজেকে সপে দিলো সে।হঠাৎ অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলো সারফরাজ।মায়া খুব করুন স্বরে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।ছোট সারফরাজ খেলা ফেলে দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।এরপর গোটা গোটা হাত দিয়ে মায়ের থুতনি আলতো করে ধরে অবোধ হয়ে শুধালো

“কাঁদছো কেনো মাম্মা?
মায়া আরোও করুন স্বরে বলে উঠলো
“তুই একা হয়ে যাবি সারফরাজ।কেউ থাকবে না তোর পাশে।আমি আর তোর আশেপাশে নেই বাবা।আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি।আর খোঁজে পাবি না আমায় তুই ।একা একা কি করে বাচবি তুই মানিক আমার?
মা কোথাও হারিয়ে যাবে শুনে মাকে শক্ত করে জাপ্টে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো সারফরাজ।
“আমি তোমাকে কোত্থাও যেতে দেবো না মাম্মা।এই যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছি।কেউ নিয়ে যেতে পারবে না আমার কাছ থেকে তোমাকে।কেউ না।আমায় ফেলে কোথাও যেও না মাম্মা।তোমাকে ছাড়া আমার খুব কষ্ট হয়।
আরো কিছু বলতে চাইলো সারফরাজ।কিন্তু হঠাৎ ভয়ংকর এক রাক্ষস এসে সারফরাজ কে ছিটকে ফেলে দিলো মাটিতে।এরপর মায়ার চুলের মুঠি ধরে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেলো অন্ধকার কালগ্রাসে।মায়া চিৎকার করে উঠলো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সারফরাজ!
সারফরাজ মাটিতে পরে গুঙিয়ে উঠলো
“মা!
মুহূর্তেই ঘুম ছুটে গেলো সারফরাজ এর।চট করে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার।কানে এখনো মায়ার স্পষ্ট চিৎকার বাড়ি খাচ্ছে।মায়ার সজল করুন চোখ গুলো সারফরাজ এর কঠিন হৃদয় নাড়িয়ে দিলো।বুক ভেঙে কান্না পেলো সারফরাজ এর।স্বচ্ছ চোখে টুপটুপ জলের আনাগোনা হলো।বুক চিনচিনে ব্যথায় ভার হলো।বিষিয়ে উঠলো কন্ঠনালী।নিজের জন্ত্রনা দমন করতে না পেরে একটা বালিশ টেনে মুখে গুঁজে ছোট বাচ্চার ন্যয় চিৎকার করে উঠলো সারফরাজ।কিন্তু বালিশ এর চাপ ভেদ করে সেই চিৎকার দেয়ালের বাইরে গেলো না।মুখে আরো খানিক বালিশ ঠুসে অনবরত মা সম্বোধনে চিৎকার করতে লাগলো সারফরাজ।কঠিন হৃদয়ের গহীনে যেই ব্যথা দগদগে হয়ে আছে তা সকলের অজানা।একাকী নিসঙ্গে যেই ব্যথা হৃদয় কাবু করে চূড়ান্ত কষ্ট দেয় তাও সকলের অজানা।সকলেই উপরের চাকচিক্য আর কাঠিন্য দেখে।কিন্তু চামড়ার ভেতরের বক্ষ ছাতি ভেদ করে কেউ দগদগে ঘা টা দেখে না।কি নিষ্ঠুর সেই জন্ত্রনা।কি অসহনীয় সেই ব্যথা।আহ!

কতক্ষন সময় এভাবে গড়ালো সারফরাজের তা অজানা।সে এক মনে ভেবে চললো তার মা এখনো বেঁচে আছে এবং তার আশেপাশেই আছে।কিন্তু কোথায়?মা কে ফিরে পাবার আশায় চঞ্চল হয়ে উঠলো সারফরাজ এর হৃদয়।মুখ থুবড়ে পরা আশা গুলো আবার প্রদীপ জ্বালালো।সারফরাজ সিদ্ধান্ত নিলো পুরো শহর চষে বেড়াবে।অবশ্যই কাছে কোথাও তার মা রয়েছে।
মনের কষ্ট গুলো পুনরায় বাক্সবন্দী করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ।ঘড়িতে সময় বুলালো।প্রায় একটা।সারাদিন রূপকথার খবর নেয়া হয়নি।মেয়েটা কোন তবিয়তে আছে তা অজানা।কিন্তু রূপকথার থেকে নিজের মায়ের জন্য মনটা ছটফট করে উঠলো সারফরাজ এর।রূপকথার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে নিজের মায়ের অস্তিত্বে প্রখর হলো।চোখ বুজে ভাবতে লাগলো
“কোথায় আছো তুমি মা?আমাকে কি আরেকবার এভাবে ডাকবে তুমি?একবার ডেকে দেখো ঠিক খোঁজে বের করে ফেলবো।একবার ডাকো না মা।

ওয়াশ রুমে ঢুকে শাওয়ার এর নব ঘুরিয়ে দেয়ালে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়ালো সারফরাজ।ঠান্ডা জলের ঝিরিঝিরি স্পর্শে শরীর শিউরে উঠলো তার।কিন্তু শরীরের চিন্তায় মনোনিবেশ করলো না আপাতত।সে দেয়ালে মাথা ঠুকে মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় মায়া কে খোঁজেছে আর কোথায় খুঁজেনি।চতুর মস্তিষ্ক কম্পিউটার এর স্মৃতির ন্যয় একে একে বের করে আনলো সকল তথ্য।সারফরাজ লম্বা শ্বাস টানলো।সামনের পথ ধূধূ মরুভূমি।বেদুইনের মতো ছুটতে হবে।কিন্তু মায়া কে ছাড়া খালি হাতে ফিরবে না সে।
বেশ কিছুক্ষণ পর কোমরে একটা সাদা টাওয়েল পেঁচিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সারফরাজ।সারা গায়ে বিন্দু বিন্দু জল।চুল গুলো কপাল লেপ্টে রয়েছে।ফর্সা মুখের খোচাখোঁচা দাড়ি গুলো চকচকে গ্লেস ছড়াচ্ছে।টকটকে ঠোঁট জলের স্পর্শে হয়েছে সিক্ত লোভনীয়।

বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে সিগারেট এর প্যাকেট আর একটা লাইটার নিয়ে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে এলো সারফরাজ।ড্রয়িং রুমে কাউকে নজরে এলো না।টেবিলের উপর খাবার সাজিয়ে ঢেকে রাখা।আজ কামালের ডক্টরের কাছে চেকআপ এর জন্য যাবার কথা।সাথে বোধ হয় নজরুল ও গিয়েছে।ইয়ং লুইস কাউকেই দেখা গেলো না।
সিগারেট ঠোঁটে চেপে আগুন ধরাতে ধরাতে সারফরাজ কপাল কুচকাল
“গেলো কোথায় এরা?নাকি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?

পরক্ষনেই মনে পড়লো স্বাস্থ্য সচেতন বডি বিল্ডার দের মতন দেখতে পুরুস দুটো কখনো বেলা করে ঘুম থেকে উঠেনা।তাছাড়া নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারেও তারা বেশ কঠোর।
নানাবিধ চিন্তায় সিগারেট এ টান দিয়ে চোখ বুজে ধোয়া উড়ালো সারফরাজ।হঠাৎ মেয়েলি হাসির শব্দ আর ইয়ং এর গম্ভীর কণ্ঠে চোখ মেলে তাকালো সারফরাজ।দুই হাত ভর্তি বাজার আর শপিং ব্যগ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ইয়ং ,লুইস।পেছনে এলো রূপকথা।

রূপকথাকে দেখে মাথা ঘুরে গেলো সারফরাজ এর।ডেনিম জাম্প স্যুট আর সারফরাজ এর দেয়া সেই স্নিকার্স পরেছে রূপকথা।ছোট চুল গুলো পনিটেল স্টাইলে বাধা।কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ প্যাক হাতে ফিতা ওয়ালা ঘড়ি।মুখে সিম্পল প্রসাধনী,হালকা লিপস্টিক আর মোটা করে টানা কাজল।রূপকথাকে ছোট বাচ্চার মতো লাগছে।আদুরে আর কিউট।সারফরাজ এর ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে কোলে তুলে ধুমধাম চুমু খেতে।সামনের মানুষ গুলোকে বিষাক্ত ঠেকলো।সব গুলোকে গুলি করে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো।

আশেপাশে বন্দুক খুঁজলো।কিন্তু পেলো না।পেলে নির্ঘাত এক কেলেঙ্কারি ঘটতো বটে।হেলেদুলে রূপকথা সারফরাজ এর সামনে এগিয়ে এলো।এরপর বড় বড় চোখ করে অমায়িক হাসলো।এক ধ্যানে তাকিয়ে সেই হাসি দেখলো সারফরাজ।মেয়েটির ছটফটে আচরণে সারফরাজ এর গলা শুকিয়ে কাঠ হলো।বার কয়েক ফাঁকা ঢোক গিললো সে।সারফরাজ এর গলার অ্যাডাম অ্যাপল ক্রমাগত উঠানামা করছে।শ্বাস ভারী হয়ে উঠছে।রূপকথাকে বুকে না জড়ালে নির্ঘাত মরন হবে তার।কঠিন ব্যধিতে আক্রান্ত মানুষের ন্যয় দাফরাতে লাগলো সারফরাজ।বুক চেপে ধরে চোখ মুখ কুঁচকালো।বুকে সূক্ষ জন্ত্রনা হচ্ছে।বেশ মিষ্টি যন্ত্রনা।বার বার পেতে ইচ্ছে করে এই যন্ত্রণা।কিন্তু প্রাণে কুলায় না।
সারফরাজ এর অবস্থা অস্বাভাবিক ঠেকলো ইয়ং এর কাছে।ব্যাগ ফেলে দৌড়ে এসে শুধালো

“আর ইউ ওকে?আর ইউ ফিলিং সিক?
রূপকথা ও ব্যস্ত হয়ে পড়লো সারফরাজ এর এহেন অবস্থায়।সে এসেছিলো সারফরাজ কে সারপ্রাইজ দিতে।কামালের থেকে শুনেছে আজ সারফরাজ এর বার্থডে।এজন্য সারফরাজ ঘুমিয়ে থাকতেই সকল কে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছিলো।ভেবে ছিলো নিজ হাতে রান্না করে খাইয়ে সারফরাজ কে চমকে দেবে।কিন্তু সারফরাজ এর হঠাৎ অসুস্থতা রূপকথার পুরো দুনিয়া এলোমেলো করে দিলো।রূপকথা হাটু মুড়ে সারফরাজ এর সামনে বসে ব্যস্ত গলায় ভয়ার্ত ভঙ্গিতে শুধালো

“কোথায় কষ্ট হচ্ছে সারফরাজ আমাকে বলো?হসপিটালে যাবে?
সারফরাজ রূপকথার সরু বাহু চেপে ধরে রূপকথার পুরো মুখমন্ডল এ আরেকবার নজর বুলালো।চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে বুকে জ্বালা ধরলো।মনে হচ্ছে বুক পুড়ে খাক হলো।ক্রমাগত শ্বাস টান উঠলো।এই সৌন্দর্যের ভার কুলাতে পারছে না সে।রূপকথার দিকে অল্প ঝুকে চোখ নামিয়ে নিলো সারফরাজ।এই সৌন্দর্য সহ্য করা দায়।চোখ অন্ধ হয়ে যেতে চায়।সারফরাজ গুঙিয়ে বলে উঠলো
“আম নট ওকেই বেইব।তোমার এই অপরাধ মূলক সৌন্দর্য আমার বুকের এই খানটায় তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে।ইট হার্টস বেবি।ইউ আর মেসিং উইথ মাই সেলফ কন্ট্রোল।

সারফরাজ এর কথার টোন বুঝতে পেরে লুইস ইয়ং ঠোঁট টিপে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।তাদের বস কঠিন ভাবে প্রেম লিলায় মজেছে এটা বুঝতে তাদের এক ন্যানো সেকেন্ড বিলম্ব হলো না।
সারফরাজ এর কথায় রূপকথা মেকি রাগ দেখালো।সে ঠোঁট টিপে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল
“সারাক্ষন ভণ্ডামি না করলে তোমার দিন শুভ হয় না?
রূপকথাকে এক ঝটকায় নিজের কোলে বসিয়ে রূপকথার গলার ভাঁজে বিড়াল ছানার ন্যয় নাক মুখ ঘষলো সারফরাজ।এরপর ঘোর লাগানো গলায় বলে উঠলো
“সৌন্দর্য যদি কোনো অস্ত্র হতো তবে নির্ঘাত তুমি ভয়ংকর খুনী হতে।তোমার ঐ সৌন্দর্যে কতবার আমার মৃত্যু হয় তুমি নিজেও জানো না মাই সুইট ম্যাডনেস।

সারফরাজ এর স্পর্শে রূপকথা চোখ বুজে ফেললো।সে সারফরাজ এর হাত খামচে ধরে বলে উঠলো
“তোমাকে দেখে ভয় করছে।আমি বাড়ি যাবো।
সারফরাজ বাঁকা হেসে ফিসফিস করে বলে উঠলো
ট্রাস্ট মি তোমাকে দেখলেই আমার মাথার সব logic crash করে যায়।all I want… is to take you inside that room,lock the door and kiss you till you forget your own name.”
রূপকথা বুঝলো সারফরাজ লাগাম হীন হয়ে যাচ্ছে।রূপকথা চট করে সারফরাজ এর হাতে কামড় বসালো।কিন্তু কোনো আওয়াজ করলো না সারফরাজ।শক্তি প্রয়োগ করে সারফরাজ এর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ধমকে উঠলো রূপকথা

“হুশে এসো।নয়তো এক্ষুনি চলে যাবো।কি করতে যাচ্ছিলে?
রূপকথার ধমকে নেশালো চোখে তাকালো সারফরাজ।এই মুহূর্তে ঠিক ভুল যাচাই করতে ইচ্ছে করছে না।আর চুমুই তো খেতে চেয়েছে।আর কিছু করেছে নাকি?
রূপকথার হম্বি তম্ভী তে টিকতে পারলো না সারফরাজ এর রোমান্স।সুড়সুড় করে কোথায় যেনো পালালো সেগুলো ।সারফরাজ মুখে বিরক্তি সূচক শব্দ করে ধমকে বলে উঠলো
“গেট আউট।

রূপকথার মন ভার হলো এমন অপমানে।সে টলমলে চোখে বলে উঠলো
“তুমি জানো তুমি কি বলছো?
সারফরাজ প্রতিউত্তর করলো না।রূপকথা একটা শপিং ব্যগে লাথি মেরে বলে উঠলো
“বা লের হ্যাপি ব্যার্থ ডে।ফা *ক ইউর জন্ম দিন।
বলেই মধ্যমা আঙ্গুলি দেখালো সারফরাজ কে।রূপকথার এমন আচরণে সারফরাজ তাজ্জ্বব বনে গেলো।তার জন্মদিন তারই মনে নেই।আর এই দিকে দেড় আঙুলে মেয়ে তাকে নোংরা ইঙ্গিত করছে?ছ্যাহ!
সারফরাজ এর টকটকে ঠোঁট জোড়া ফাঁকা হলো রূপকথার ঐদ্ধত্বে।সেখানে রাগের মাথায় একটা চকলেট ঠুসে রূপকথা দাঁত চিবিয়ে বলে উঠলো

“খা বেশি করে খা কুত্তা।আমাকে গেট আউট বলা নাহ?দেখাচ্চি তোকে শালা।
বলেই আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো রূপকথা।মেয়েটির আকস্মিক আচরণে সারফরাজ অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলো এরপর মুখের চকলেট সরিয়ে হুয়াটস এপ এ সুফিয়ান চৌধুরী কে মেসেজ পাঠালো
“আপনার মেয়ে আমাকে মিডল ফিঙ্গার দেখাচ্ছে।
তখনই মেসেজ সিন করলো সুফিয়ান সেই সাথে পাঠালো ফিরতি ইমেজ মেসেজ।

চেকমেট পর্ব ৩৫

ইমেজ ক্লিক করতেই সারফরাজ এর চোখ কপালে উঠলো।সুফিয়ান আরো একটা আঙ্গুল যোগ করেছেন।সারফরাজ ফোনে কপাল ঠুকে বলে উঠলো
“পুরা নিজের কপি বানিয়ে ছেড়েছে মেয়েকে।এসব শেখাতে দিয়ে গেছিলাম?আহ কপাল!

চেকমেট পর্ব ৩৭