ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫ (২)

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫ (২)
মিথুবুড়ি

‘লাড়া মারা গিয়েছে, আজ সতেরো দিন। হঠাৎ জেমস্ও কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে, ঠিক যেমন ভাবে হারিয়ে গিয়েছে এলিজাবেথ। রিচার্ড অকূল পাথারে পড়লেও নিজ স্তম্ভ থেকে সরেনি এক ইঞ্চি। রিচার্ড লাড়ার লাশটা পর্যন্ত জেমসকে নিতে দেয়নি। প্রেমের সমাধির পাশাপাশি লাড়ার কবর খোড়া হয়েছে। মেয়েটা চিরস্থায়ী ভাবে সমাধি হয়েছে সবথেকে বিশ্বস্ত মানুষটার পাশে। এই পৃথিবীতে সে-ই একমাত্র ছিল, যে নিঃস্বার্থভাবে তাকে চেয়েছিল।
‘ন্যাসো, লুকাস নিচে লনে দাঁড়িয়ে ছিল চিন্তিত মুখে। হঠাৎ পোড়া গন্ধে এদিক-সেদিক তাকাতেই দেখতে পেল রিচার্ডের ঘর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ছুটে গেল ভেতরে। দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো।

তারা ধাক্কাতে থাকে জোরে জোরে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। কণ্ঠস্বর ভেঙে যায় চিৎকার করতে করতে। উপায়ন্তর না পেয়ে লুকাস,ন্যাসো উদ্যত হয় দরজা ভাঙার। লুকাস চোখে ইশারা করতেই ন্যাসো দূরে সরে যায়। লুকাস যে-ই তার জলহস্তী পা দিয়ে দরজায় লাথি দিতে যাবে, তখনই দরজাটা খুলে যায়। রিচার্ড ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। রিচার্ড’কে সুস্থ, অক্ষত দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা। ছুটে গিয়ে জাপ্টে ধরল রিচার্ডকে। রিচার্ড ভুরু কুঁচকায়। তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ওদের। ডগডগে পায়ে নিচে চলে যায়। লুকাস, ন্যাসো সচকিত চোখের মনিযুগল ঘুরিয়ে ভেতরে তাকায়। ড্রাগস আর এলকোহলের বোতল গুলোতে আগুন জ্বলছে। পূর্ণরায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তারা নিচে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘লুকাস রিচার্ডের পাশে বসে বিরস মুখে বলল,”বস, আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
‘রিচার্ড নিকোটিনের ধোঁয়া শূন্যে ছেড়ে দিয়ে তেরছা নজরে লুকাসের দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে বলল,”কারণ?”
‘ন্যাসো বিরহবিধুর মনে একদৃষ্টিতে সামনের ধূমায়িত চায়ের কাপে তাকিয়ে ছিল। রিচার্ডের কণ্ঠে টনক নড়লো, ফিরে তাকাল তার দিকে। তার অতলস্পর্শী দৃষ্টি, তৃষিত চোখে দেখে নিরবে শুধু দেখে যায় রিচার্ডের সেই চওড়া, মোমঢালা লালিত চেহারা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে এইকয়দিনে। আটান্ন দিনের অনাহার, অনিদ্রা,নিঃস্ব শূন্যতা স্নান করে দিয়েছে, বলিষ্ঠ দেহের শক্ত কাঠামো। সমুদ্র নীল চোখে ঝলঝলে অন্তগর্ত ভয়। ন্যাসো গভীর নিঃশ্বাস টেনে বলল,
“আপনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বস। আই থিংক নিড টু চেক-আপ আ,,,,
“ফাক অফ ন্যাসো। পুরুষ মানুষের হাতে যেমন চুড়ি মানায় না, তেমনি রিচার্ড কায়নাতের ভাঙন মানায় না। আমি রিচার্ড কায়নাত—ভয়ংকর, নৃশংস, নিকৃষ্ট।”

“সবচে কঠিন জিনিস কিন্তু তাপে গলে বস। যেমন ভাবে আপনি গলে যাচ্ছেন, ম্যামের অনুপস্থিতিতে।”
‘রিচার্ড তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব দিতে পারল না। ক্লান্ত পথিকের মতো কাউচে গা এলিয়ে দিল। ন্যাসোর ফোন আসলে সে নতজানু হয়ে সাইডে চলে যায়। লুকাস কোমল হৃদয়ের একজন মানুষ। আর কোমল হৃদয়ের মানুষ সবসময় চায়, তারা যেমন সবসময় হাসিখুশি থাকে, তাদের আশেপাশের সবাইও যেন হাসিখুশি থাকে। তারা অন্যের মন খারাপ মেনে নিতে পারে না। লুকাস রিচার্ডের দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“মা ছোট বেলায় বলতেন, মন খারাপের সময়, সুন্দর মুহুর্তগুলোর কথা ভাবতে হয়। আপনার জীবনের সবথেকে সুন্দর মুহুর্ত কোনটা, বস?”

‘লুকাসের কথায় রিচার্ড তার মনোজগত থেকে বেরিয়ে আসে। সে সোজা হয়ে বসল। শ্যেনদৃষ্টিতে লুকাসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিরায়ত গম্ভীর গলায় বলল,
“আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্তে তিনভাগে বিভক্ত।”
‘লুকাস প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে এক টুকরো হাসি ফুটল রিচার্ডের ঠৌঁটে। অতীতের কথা মনে হতেই হৃদয় উথলে ওঠে উষ্ণ ভালোবাসার ঢেউে। মানসপটে, সেই সুখময় স্মৃতি তুলে ধরে ধরে স্বপ্নালু কণ্ঠে বলল শুরু করল,

“এক—যেদিন প্রথম ওকে দেখেছি, সেদিন ফাস্ট আমি অনুভব করলাম আমার ভেতর একটি কোমল হৃদয় আছে। ধুকপুক শব্দ আসছিল ভেতর থেকে;খুব সম্ভবত, তারই জন্য।”
“দুই—যেদিন ওর প্রেগ্যান্সির রিপোর্ট হাতে পেলাম। কয়েক মিনিট আমি শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না, রিচার্ড কায়নাতের অস্তিত্ব আসতে চলেছে। আমি যে বাপ হবো, সেটা তো আমি কখনো কল্পনাতেও আনিনি। সেই অবিস্মরণীয় দিনের মতো এতো বড় ধাক্কা আমি কখনো খাইনি।”
“তিন—যেদিন প্রথম ওর মুখ থেকে ভালোবাসা শব্দটা শুনেছিলাম। তখন মুখ ফুটে কিছু বলার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। শুধু, আমি আর খোদা জানতাম— কতটা খুশি হয়েছিল হৃদয়।”
‘লুকাস খেয়াল করল, কথাগুলো বলার সময় রিচার্ডের চোখমুখ জ্বলজ্বল করছিল। রিচার্ড, সে নিজেও অনুভব করে, ভেতরে হালকা লাগছে। লুকাস আবারও মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে, তখনই ন্যাসো আসে। বলল,
“বস, মিনিস্টারের জ্ঞান ফিরেছে। আবার পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। আমার বোধহয় এবার হসপিটালে যাওয়া উচিত।”

‘রিচার্ড তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তিনদিন ধরে হাসপাতাল থেকে ফোন আসছে। প্রতিবারই সে নম্রভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ মনের ভেতরে যেন লোহার পাত গলে পড়ছে। তাকবীরের পতন সে চেয়েছিল ঠিকই।কিন্তু ভাগ্যের হাতে নয়, নিজের হাতে নির্মিত এক পরিণতির মধ্য দিয়ে। অথচ, সব আয়োজন, সব প্রতিশোধের পরিকল্পনার পরও শেষরক্ষা আর হল না। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকবীরকে ইতালিতে নিয়ে এলেও, চিকিৎসকের কাঁচি থামেনি। একটি পায়ের গোড়ালি কেটে বাদ দিতে হয়েছে। রিচার্ড চুপচাপ। অথচ ভেতরে যেন কিছু চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

‘ভেতর থেকে ভেসে আসছে আতঙ্কজাগানিয়া চিৎকার, চেঁচামেচি, হাহাকার। তিনজন নার্স মিলে চেষ্টা করেও সামলাতে পারছে না তাকবীরকে। অনেকক্ষণ ধরেই তাকে ঘুম পাড়ানোর ইনজেকশন দিতে চাইছে তারা। কিন্তু ব্যর্থ।পাগলের মতো ছটফট করছে ছেলেটা। অস্থির শরীর, এলোমেলো চোখ, মুখে কেবল একটাই নাম”এলোকেশী… এলোকেশী!” পায়ের ব্যান্ডেজ ইতোমধ্যেই রক্তে ভিজে গেছে, তবুও তার হুঁশ নেই। করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা রিচার্ডের মুখ কঠিন হয়ে উঠল। চোয়ালে জমাট রাগ, পায়ের পদক্ষেপে গর্জন নিয়ে কেবিনের দিকে এগিয়ে যায় রিচার্ড। এক পলক আর না ভেবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

‘রিচার্ড কাছে যেতেই অর্ধপাগল তাকবীর তার দু-হাত ধরে আকুতি মিনতি করে বলতে থাকে,
“তুই লুকিসে ফেলেছিস আমার এলোকেশীকে, তাই নাহ? ভাই, কসম! সাত আসমানের ওপর যে মালিক আছে, তার কসম আমি সরে যাবো। আমি সরে যাবো তোদের মাঝ থেকে। আমি তাকবীর দেওয়ান নেই। নেই আমি তোদের মাঝে। শুধু একটাবার ওকে দেখতে দে আমায়। আমি ওকে সুস্থ অবস্থায় দেখতে চাই। এলোকেশী অনেক ছটফট করছিল। আমাকে ডেকেছিল। আমি ছুটে গেলাম, কিন্তু ধরতে পারলাম না। আমার চোখের সামনে ওরা ওকে তুলে নিয়ে গেলো।”

‘রিচার্ডের চিবুক ক্রমেই শক্ত হচ্ছে শুধু। সে ঝাড়ি মেরে তাকবীরের হাত সরিয়ে দেয়। তাকবীর চিৎকার করে কাঁদছে আর অঝোরে বলে যাচ্ছে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে,
“আমার কেউ নাই, আমার কেউ নাই গো,এলোকেশী। তুমি কোথায় গেলে এলোকেশী? ফিরে এসো না। আমাকে এভাবে মেরো না তুমি। ফিরে আসো তুমি,প্লিজ। একটুখানি কাছে আসো। একটুও ছুঁবো না আমি তোমায়। দূর থেকে শুধু বলে যাও—তুমি ভালো আছো। যতটা ভালো থাকলে মানুষ অতীত ভুলে যায়।”
‘ঝাপসা দৃষ্টিতে হঠাৎ ভেসে উঠল এলিজাবেথের পদ্মকমল হাসি। সেই হাসি যেন বিষ মাখানো তীরের মতো গিয়ে বিঁধল তাকবীরের বুকে। ক্ষতে নতুন আঘাত। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য শরীরও নেতিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে এলোকেশী বসে আছে। নির্লজ্জের মতো হেসে যাচ্ছে। রাগ হয় তাকবীরের। চোয়াল শক্ত হয়। এতো কষ্ট দিয়ে কেউ এভাবে হাসে? কিছুটা ঘৃণাও আসে ভেতর থেকে। এতোটা স্বার্থপর কি আদেরও হওয়া সম্ভব? তাকবীরের চোখ আবারও বন্যার জলে প্লাবিত হয়। সে তীব্র বিতৃষ্ণায় এলোকেশীর নির্লজ্জ, বেহায়াপনা হাসির দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে বলল,

“আজ আমি বলছি, সবার সামনে বলছি, তোমরা শুনে রাখো—প্রেম পাপ, প্রেম মানে স্বেচ্ছাকৃত মৃত, প্রেম ধ্বংস, এলোকেশী তুমি ধ্বংসবতী।”
‘এবার আর নিজেকে সংযমে রাখতে পারল না রিচার্ড। চোখে উল্কার মতো ঝলক দিয়ে উঠল পৈশাচিক হিংস্রতা। ক্ষুব্ধ বাঘের মতো চেপে ধরল তাকবীরের কণ্ঠনালি। এতোটাই শক্ত করে, যে তাকবীরের শরীর শূন্যে ওঠে। নরপশুর মতো গর্জন দিয়ে বলল,
“খবরদার, আমার বউয়ের নামে একটাও বাজে কথা বলবি না। জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।”
‘এই সুযোগে রিচার্ড নার্সদের চোখে ইশারা করলে, তারা মাপলা কৌশলে তাকবীরের শরীরে ইনজেকশন পুশ করে দেয়। সঙ্গে, সঙ্গে তীব্র এক ঝাঁকি খেল তাকবীরের শরীর। রিচার্ড ছেড়ে দিল তাকবীরের গলা। হঠাৎ তাকবীর জাপ্টে ধরল রিচার্ডকে। প্রথমবারের মতো ভাইকে জড়িয়ে ধরে অবুঝ আবদার করল,

“ভাই, এই জীবনটা আর ভালো লাগছে না। আমাকে মরতে দে তোরা। আমি মরতে চাই। খুব ক্লান্ত আমি।”
‘চমকে উঠল রিচার্ড। অজানা উদ্বেগ চেপে বসল ভিতরে। শরীরের রক্ত চলাচল তীব্র হয়ে উঠে। তার কম্পিত দৃষ্টি ফেলল দূর্বোধ্য তাকবীরের ওপর। পা যেন জমাট বাঁধা ভারি সীসার মতো। নড়ছে না। বাঁ হাতটা ছুটে যেতে চাইছে কোঁকড়া চুলের মসৃণ ভাঁজে। ক্রোধে রিচার্ডের চোয়াল কেঁপে ওঠে। তীব্র এক ধাক্কায় তাকবীরের মাথা বালিশের ওপর ফেলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। নার্স আশ্চর্য হয় রিচার্ডের এই আচরণে। মধ্যবয়স্ক লোকটার খুব মায়া হয় তাকবীরের মায়াভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে। তাকবীরের ইতিমধ্যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট স্বরে কি যেন গুনগুন করছে। লোকটা তাকবীরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইতালিয়ান ভাষায় বলল,
“কষ্ট পেয়ো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রে কর। তিনি নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবে। কারোর দোয়া ফিরিয়ে দেন না তিনি।”
‘তাকবীরের মানষিক অবস্থা ভালো না। সে নিজেও জানে না, কি আচরণ করছে সে। তাকবীর আধোঘুমে স্বগোতক্তিতে বিরবিড়ালো,

“দোয়া? ওদের জন্য? না, কখনো না। আমি কখনো ওদের মাফ করব না। আমার বদদোয়া ছায়ার মতো লেগে থাকবে এদের জীবনে। চিরদিন। এই দুইটা মানুষ—একজন আমার রক্তের ভাই, আরেকজন আমার ভালোবাসা। ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের কাঁটায় জড়িয়ে আমায় ছুঁড়েছে নরকে, আর সেই মেয়েটা? ভালোবাসার আগুনে ফেলে আমায় পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। যেভাবে ওরা আমার মন ভেঙেছে—আমিও খোদার কাছে চাই, খোদা যেন ওদের মনকেও সেই রকম ভেঙে দেন। ওরাও কাঁদবে, ওরাও ছটফট করবে। আমার মতো, ঠিক আমার মতো।”

‘এভাবেই কিছুক্ষণ গুনগুন করতে করতে অবশেষে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তাকবীর। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সটি এক দীর্ঘ ফোঁস নিশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। রিচার্ড তখনও দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে। সবটা শুনেছে সে। প্রতিটি কথার ভার তার ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে। হঠাৎ যেন মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ খেলে গেল। চোখদুটো লালচে হলো। কণ্ঠে ঝরে পড়ল শীতল দৃঢ়তা। রিচার্ড সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইল বের করে লুকাসকে ফোন করল। কল রিসিভ হতেই প্রশ্ন ছুড়ে
“জেমসকে শেষ কোথায় দেখা গেছে?”
“সিলিসি দ্বীপে বস।”
“আমি এক্ষুনি আসছি। গেট রেডি, বয়েজ।” রিচার্ডের পায়ের নিচে করিডোর কেঁপে উঠল৷ লম্বা, লম্বা কদম যেন আসন্ন ঝড়ের প্রথম ধাপ।

‘মেট্রো স্টেশন। চারপাশে মানুষের ভিড় আর মেট্রো চাকার ঝনঝন শব্দে মুখর চারদিক। তাকবীর লেংচে লেংচে, ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে বসল প্ল্যাটফর্মের নিচে। গা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে নামছে ঘাম। কাঁপা হাতে ধরে আছে এলিজাবেথের প্রিন্ট করা ছবি। আজ সাতদিন হলো হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে সে। বিকেলে যখন নার্স তাকে লনে হাঁটাতে বের করত, একদিন আচমকা তাকবীর তাকে আঘাত করে ছিনিয়ে নেয় নার্সের ফোন আর মানিব্যাগ। মানিব্যাগে ছিল সামান্য কিছু টাকা। সেই টাকা দিয়েই প্রথমেই এলিজাবেথের একটি ছবি সংগ্রহ করে তাকবীর।
তারপর তা প্রিন্ট করে শহরের অলিতে-গলিতে সেঁটে দিতে থাকে নিখোঁজের পোস্টার। দুইদিনের মাথায় সব টাকা ফুরিয়ে যায়। আর কিছু নেই তার—না মাথা গোঁজার ঠাঁই, না খাওয়ার ব্যবস্থা। তাকবীর তখন আশ্রয় নেয় মেট্রো স্টেশনে। রূপ নেয় এক আশাহত ভিক্ষুকের। দিনভর স্টেশনে বসে ভিক্ষা করে, আর রাতভর এলিজাবেথের পোস্টার ছাপায়।

সারাক্ষণ সে চোখ রেখে থাকে সেই নার্সের ফোনের পর্দায়—এ আশায় যদি কোথাও থেকে কোনো খবর আসে। যদি কেউ বলে,”তোমার এলোকেশীকে খুঁজে পাওয়া গেছে।” কিন্তু না। ফোন আসে না।এলোকেশীও ফিরে আসে না।
‘অবহেলায় দাড়িগুলো বেশ বেড়ে উঠেছে। স্বভাবের মতোই অবয়বটাও আজ পাগলের রূপ নিয়েছে। তাকবীর মেট্রোর একেবারে কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চোখে অনাহারের খচখচে ছাপ। একটা মেট্রো এগিয়ে আসছে দ্রুত গতিতে। হাওয়ায় তার কুঁকড়ে যাওয়া চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। চারপাশে চাকার ঝনঝন শব্দ। এই তো সুযোগ গলা ছেড়ে চিৎকার করার। তাকবীরও তাই করল। হঠাৎ দু’হাতে চুল খামচে ধরে অন্ধকারে গলা ছেড়ে চিৎকার করতে লাগল। আজও প্রতিদিনের মতোই কেউ শুনল না। তার চিৎকারটাও মিলিয়ে গেল মেট্রোর শব্দের ভেতরেই।

‘তাকবীর ক্লান্ত হয়ে নিচু হয়ে বসে পড়ল প্ল্যাটফর্মের একপাশে। হাঁপাচ্ছে। নিঃশ্বাসে বিষাদ আর ধোঁয়ার গন্ধ।
ঠিক তখনই, একজোড়া কাঁপা কাঁপা হাত টেনে রাখে তার কাঁধে। চমকে উঠে তাকায় তাকবীর। সে লোকটা।বয়োজ্যেষ্ঠ, নিঃসঙ্গ। প্রতিদিন ঠিক এই সময়েই স্টেশনে আসে। বসে থাকে অনর্থক। তাকবীর খেয়াল করেছে, লোকটা খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। এই ক’দিনেই সে শুনে নিয়েছে তাকবীরের সমস্ত না-বলা কষ্ট। আজও অমায়িক হাসি দিয়ে বললেনশ

“এক মেয়ের জন্য আর কত অপেক্ষা করবে, বাবা?
যে হারিয়ে গেছে, তাকে হারিয়ে যেতেই দাও। সেটাই উত্তম।”
‘তাকবীর কুয়াশাচ্ছন্ন চোখে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটার দিকে। দৃষ্টিতে বড্ড অবুঝপনা। শেষ টিকিট না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া মানুষ যেমন গা এলিয়ে দেয়, ঠিক তেমন করে তাকবীর মাথা রাখল পিতৃসম লোকটার উরুতে। নিদারুণ ভাঙা কণ্ঠে বলল,
“তার দেহে অন্যের স্পর্শের চিহ্ন দেখেও তাকে ছাড়তে পারিনি। আর আজ, যখন সে নেই আপনারা তাকে ভুলে যেতে বলছেন?যে ছিল আমার সব, তাকে ভুলে থাকা কি সম্ভব? কিভাবে বাঁচবো আমি, বাঁচার উৎস ছাড়া?”
‘ঠুকরে উঠল সে। নিপাট ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। আশ্বাসমাখা গলায় বললেন,
“পুরুষমানুষও কাঁদে?”

‘তাকবীর ক্লান্তির ভারে নুইয়ে পড়া মাথা তুলল। ছলছলে চোখে তাকাল লোকটার বিস্ময়ভরা মুখের দিকে। কান্নার তোড় বেড়ে গেল তার। ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, ছেলেরাও কাঁদে। ছেলেরা যখন সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা হারিয়ে ফেলে, তখন তারাও কাঁদে।
ভেঙে পড়ে। মরতে চায়। কিন্তু আমি মরতে চাই না।
আমি শুধু আমার এলোকেশীকে চাই। আর কিচ্ছু লাগবে না আমার।”
‘ভিন্ন সংস্কৃতির লোকটা তাকিয়ে রইল তাকবীরের দিকে।চোখে এক অদ্ভুত বিস্ময়। ছেলেটা এভাবে কাঁদে কীভাবে।নিঃশ্বাস জড়ানো কণ্ঠে লোকটা বললেন,
“সে তো তোমাকে ভালোবাসেনি,তবুও এতটা ভালোবাসো কেন?”
‘তাকবীর হালকা কাঁপা গলায় বলল,

“ভালোবাসা না পেয়েই আমার এই দশা,ভেবে দেখুন, পেলে কী হতো! মানবজীবন একটা সময় পর বুঝে নেয়—সৃষ্টিকর্তা যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। তার দৃষ্টির আলিঙ্গনেই যদি হৃদয়ে ঢেউ ওঠে, তাহলে তার স্পর্শ পেলে তো আমি গলেই যেতাম। তাই তো তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাকে দূরে রাখবেন।”
‘লোকটা চুপ করে গেল। কথাগুলোর ভারে বোধহয় শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। তিনি বেরিয়ে আসতে চাইল এই গভীর কথার ঘূর্ণি থেকে। হঠাৎ বলল,
“একটা গান হোক, ইয়ং ম্যান।”
‘তাকবীর চোখের জল ভেজা হাসিতে মাথা নেড়ে সায় দিল। প্রতিদিনের মতোই ভদ্রলোকের অনুরোধ—একটা গান। এই পৃথিবীতে যার আপন বলতে কেউ নেই,কেউ নেই যার কণ্ঠ শোনে, দুঃখ বোঝে। তাই তো তাকবীর কখনো ফেরায় না তাকে। গান ধরল সে। মন থেকে, ভেতরের তীব্র অনুভূতি থেকে,

❝এই অবেলায়, তোমারি আকাশে,
নিরব আপোষে ভেসে যায়।
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ,
কখনো দেখাইনি তোমায়।
কেউ কোথাও ভালো নেই,
যেন সেই কতকাল…
আর হাতে হাত অবেলায়?
কতকাল আর ভুল অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়…
সেই কবেকার ভায়োলিন,বেজে যায়—
কতদিন প্রানে চাপা ঢেউ,
দেখেনি আর কেউ…❞

‘ভদ্রলোক প্রতিদিনের মতোই মুগ্ধতায় তাকবীরের কাঁধ চাপড়িয়ে বলল,
“তোমার গানের লাইনগুলো দিয়ে একটা উপন্যাস লেখা যাবে ইয়ং ম্যান।”
‘তাকবীর হাসল। হেসে গা এলিয়ে দিল স্টিলের বেঞ্চিতে। ফাঁপা দৃষ্টিতে শূন্যে চেয়ে সে গান গাইতেই থাকল,
❝সেই দিনে এক গানে
এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে খুঁজে
পাবে না সেই গল্পকার
দিনগুলো খুঁজে পাবে
গানের প্রতিটা ছন্দে শুনতে পাবে
মৃত মানুষের চিৎকার
‘আমার দেহখান নিও না শ্মশান..
এমনিতেও পুড়ে গেছি
আমার সব স্মৃতি ভুলো না
তোমরা যা ফেলে গেছি,,,,,,❞

‘সমুদ্রতটে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো পোশাকপরিহিত একদল সশস্ত্র মানুষ। প্রত্যেকের চোখে-মুখে সতর্কতা, হাতে ঝলসানো অস্ত্র। উত্তাল সমুদ্রজলে ভাসছে অসংখ্য জাহাজ।দিগন্তরেখা ছুঁয়ে যেন এক অশান্ত যুদ্ধজাহাজবহর। জেমস্‌কে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল এই দ্বীপেই। রিচার্ড এখম নিশ্চিত, এলিজাবেথ কোথাও এখানেই বন্দি।হয় স্থলে, নয় জলে। শুরু হয়েছে চিরুনি তল্লাশি। জঙ্গলে নামানো হয়েছে বিশেষ বাহিনী আর সমুদ্রে নিখুঁত অনুসন্ধানে ডুবুরির দল। গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে কুকুরের চিৎকার, আকাশে চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার। বাতাসে ভেসে আছে আতঙ্ক আর আশঙ্কা।

‘সমুদ্রের মাঝখানে একটি জাহাজে দাঁড়িয়ে রিচার্ড। আটদিন ধরে রিচার্ড জলে এক মুহূর্তের জন্যও ডাঙায় পা রাখেনি। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। রিচার্ডের পাশে নিরব উদ্বেগে দাঁড়িয়ে আছে লুকাস। তার চোখে চিন্তার ছায়া। হঠাৎ একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন সমুদ্রপৃষ্ঠে ভেসে উঠল। রিচার্ডের ভ্রু কুঁচকে চোখ থেকে দুরবীক্ষণ সরিয়ে লুকাসের দিকে তাকাতেই লুকাস চোখ টিপল। বুকের ভেতর এক অজানা শঙ্কা দলা পাকিয়ে উঠল রিচার্ডের। লুকাস হেসে বলল,

“ভুল না হলে, ম্যাম এটার ভেতরেই আছে।”
‘কিছুদিন আগে সমুদ্রের গভীরে পাঠানো সাবমার্সিবল ক্যামেরাতেই প্রথম এই সাবমেরিনটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। প্রথমে কিছুটা সন্দেহ থাকলেও পরবর্তীতে আরেকটু গভীরে পাঠানো রেকর্ডিং-এ নিশ্চিত হওয়া যায়, সাবমেরিনটি কোনো দুর্ঘটনার কারণে নয়, ইচ্ছাকৃতভাবে জ্যাম করে আটকে রাখা হয়েছিল যেন সেটি উপরে উঠতে না পারে। আশ্চর্যজনকভাবে, ভিতরে কোনো পাইলটের অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি। লুকাস তখনই ধারণা করে—এলিজাবেথকে এটার মধ্যেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তবে খবরটা সে তখনই রিচার্ডকে জানায়নি। চেয়েছিল সারপ্রাইজ দিতে। পরে কৌশলে পাঠায় বিশেষ রিমোট-চালিত যান (ROV) এবং প্রশিক্ষিত ডুবুরি দল।যারা সাবমেরিনে অক্সিজেন পৌঁছায়, হ্যাচ খোলে এবং উদ্ধারপ্রক্রিয়া শুরু করে। সাবমেরিনটি যখন ভেসে ওঠে, তখনই পুরো ঘটনাটা স্পষ্ট হয়।
‘রিচার্ড অপেক্ষা করেনি এক মুহূর্তও। চোখমুখে অভিব্যক্তি ফুটে ওঠার এবং ভাবান্তরের সুযোগ না দিয়েই সে সোজা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতরে গিয়ে পৌঁছায় সাবমেরিনের কাছে। ভাগ্য সহায় ছিল, হ্যাচটি খোলা ছিল। লুকাসের কৌশলী পরিকল্পনায় বিস্মিত হয়ে রিচার্ড নিঃশ্বাস আটকে সাবমেরিনের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকেই সে ভেতর থেকে হ্যাচটি বন্ধ করে দেয়৷ বাকি পৃথিবী থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ছুটে যায় তার নিজের পৃথিবীর কাছে দুনির্বার এক আর্কষণে।

‘ন্যাসো সেদিন ঠিক বলেছিল—শি ইউ এনাফ স্ট্রং না। শি ক্যান সেভ হারসেল্ফ। এলিজাবেথ নিজেকে মুক্ত করতে না পারলেও পেরেছে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। শুধুমাত্র তার একটি কথার মাধ্যমে। জেমস্ কবেই এলিজাবেথকে মেরে ফেলত। কিন্তু সে পারেনি। সে তার অজান্তেই এলিজাবেথের বুদ্ধির ধোঁকায় পড়েছিল। এলিজাবেথের কথাটা ছিল এমন,

“তুই নিজেকে রাজা ভাবলেও এই রাজ্যের রাণী আমি। যদি নিজেকে সত্যিকারের রাজা প্রমাণ করতে চাস, তবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখ। আমার রাজা ঠিকই আমাকে বাচিঁয়ে নিয়ে যাবে। যদি সে না আসে তার রাণীর জন্য, তবে তোকে রাজা মেনে, সারাজীবন তোর বন্দিত্ব করব আমি।”
‘সে-ই থেকেই শুরু এলিজাবেথের কারাবাস। সে-ই দিন থেকে সূর্যের মুখ আর দেখা হয়নি। বাইরের জগৎ যেন এক বিস্মৃত স্মৃতি। বুকে চেপে বসা অস্থিরতা আর ছটফটে মনটা শুধু জানতে চায়—সে কেমন আছে? কিভাবে কাটছে তার দিন? নিজেকে কিভাবে সামলাচ্ছে?
‘হঠাৎ দপ করে কিছু পড়ার শব্দে চমকে ওঠে এলিজাবেথ। তাকিয়ে দেখে— রিচার্ড। চোখে বরাবরের মতো একরাশ কাতরতা। কণ্ঠটা কাঁপছে। সে তাকে ডাকে,

“রেড?”
‘এলিজাবেথ চুপ। আজ আর প্রতিক্রিয়া নেই। মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে আর কোনো ধোঁকার কাছে নতি স্বীকার করবে না। রিচার্ড আবার ডাকে, গলা ভেজা,
“জান।”
‘এবার অভিমান যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে। চোখে ছলছল জল। হৃদয়ের গভীর থেকে আহবান আসছে ছুটে যাওয়ার।, আজ যেন ভেঙেই পড়ছে মনটা। ইচ্ছে করছে ছুটে যায় তার কাছে। কিন্তু যদি, আবার হারিয়ে যায় বাতাসে? তলিয়ে সমুদ্রের অতল তলদেশে?
‘রিচার্ডের গলা এবার কাঁপে ভেতর থেকে,

“আমার হৃদয়ের রাণী?”
‘এলিজাবেথ নীরব। একটুও না নড়েই থাকে। রিচার্ড আবার,
“জান রে…
‘কোনো সাড়া নেই।
“মাই ফাকিং ডার্ক রেড!”
‘শব্দগুলো চিরচেনা, কোমল, আকুল, তবু এলিজাবেথের ঠোঁট নড়ে না।
“মাই গর্জিয়াস লেডি!”
“ওয়াইফি!”
“হানি!”
‘একটার পর একটা ডাক, একটার পর একটা নাম। তবুও নেই সাড়া। রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে এবার। গলার সুর বদলায়।
“হেই রাশিয়ান।”

‘তবুও এলিজাবেথ নিরুত্তর। মুখ ফেরানোই থাকে।
রিচার্ড এবার আর সহ্য করতে পারে না। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“এই আল্লাহর বান্দি এই,জবাব দে।”
‘নীরবতা। নিঃশব্দ কান্না।
‘শেষবারের মতো, রিচার্ড হাল ছেড়ে দেয় না। মৃদু গলায় যেন এক নিঃশেষ প্রার্থনায় ডাকে,
“এলিজান?”
‘চমকে উঠে বসে এলিজাবেথ। কয়েক সেকেন্ড নিঃশ্বাস আটকে থাকে তার। ধীরে মাথা ফেরায়। কাঁপতে থাকে চোখের পাতা। রিচার্ড দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকে। বুকটা ভারী হয়ে আসে এলিজাবেথের।
এটা কি সত্যি? নাকি স্বপ্ন? রিচার্ড মাথা নাড়ায় দুপাশে।
মানে এটা সত্যি? হঠাৎই ঝাঁপিয়ে উঠে দাঁড়ায় এলিজাবেথ। এক দৌড়ে ছুটে এসে সশব্দে আছড়ে পড়ে রিচার্ডের বুকে। তার শরীর যেন প্রাণ ফিরে পায় বহুদিন পর। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, সাপের মতো পেঁচিয়ে ওঠে রিচার্ডের গলায়।

‘রিচার্ডও ওকে জাপ্টে ধরে তুলে নেয় শূন্যে। দারুণ এক হাড়-মটমটান শব্দ ভেসে আসে। এ যেন মাঝনদী থেকে কেউ তাকে টেনে তোলে। আর এলিজাবেথ হু-হু করে কেঁদে ফেলে। তৃষার্ত দুটি বুক যেন উষ্ণতায় ভরে ওঠে। মেয়েটার চোখের জলে ভিজে যায় রিচার্ডের কাঁধ। রিচার্ড নিঃশ্বাস আঁটকে মুখ গুঁজে রাখে তার চুলে। হঠাৎ সে হাঁপাতে থাকে। এলিজাবেথকে নামিয়ে বুকে মাথা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল,
“এখানে মাথা রাখ, এলিজান, এখানে। এই জায়গাটা ব্যথায় মরে যাচ্ছে।”
‘এলিজাবেথ মাথা রাখে তার বুকের পটে। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে পিঠ। এই বিরহ, এই যন্ত্রণা সব যেন মিটে যায় এক নিমিষে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আপনি এতো দেরি করলেন কেন? আমি কিভাবে বাঁচতাম আপনাকে ছাড়া…?”
‘রিচার্ডের চোখ লাল টকটকে। এলিজাবেথের কাঁধে মুখ গুঁজে ফিসফিসিয়ে বলল,
“স্যরি, জান… খুব করে স্যরি।”

‘দুজনেরই নিঃশ্বাস তীব্র, গভীর। হঠাৎ রিচার্ড শক্ত করে ধরল এলিজাবেথের চোয়াল। কোনো অবকাশ না দিয়ে চুমু খেতে থাকে এলোমেলো, উন্মত্ত, উদ্ভ্রান্ত ভাবে। চিবুক থেকে গলা, গলা থেকে চোখের কোণ মুখজুড়ে এক চুমুর বৃষ্টি।এলিজাবেথ কিছু বলে না। চোখ বুজে, নিঃশব্দে, অগাধ ভালোবাসায় সয়ে নেয়। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে।ঠিক যেমন করে ধরা হয় প্রিয়জনকে এক চিরন্তন মুহূর্তে। আর তাতেই পেরিয়ে যায় কিছু অপার, অপূর্ব মুহূর্ত।
‘ক্লান্ত দুটি শরীর ভেঙে পড়ল। রিচার্ডের কোলে এলিজাবেথ। মাথাটা সুবিস্তৃত,শক্তপোক্ত সুঠোম বুকের ওপর রাখা। হঠাৎ এলিজাবেথ মাথা তুলল। রিচার্ডের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন তুলল,
“আপনার চোখগুলো তো একদম তাজা, তাজা। নিদ্রাহীন একটুও মনে হচ্ছে না। আপনি কি আমার জন্য একটুও কান্না করেননি?”

‘রিচার্ডের ভ্রু কুঁচকালো। পরক্ষণেই ক্রূর হেসে দু’হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
“কান্না করে শুধু, শুধু চোখের পানি নষ্ট করব কেন সুইটহার্ট। এগুলো তো তোমার জন্য রেখে দিয়েছি। এইযে তোমাকে ফিরে পেয়েছি, এখন ধীরে ধীরে সব সাপ্লাই দ,,,,,
‘মাঝপথে বিপত্তি ঘটালো নরম তুলতুলে দু’টো হাত। লজ্জায় আরক্ত রমণী চোখ রাঙিয়ে হতাশাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনি আর ভালো হলেন না রিচার্ড কায়নাত।”
‘রিচার্ড মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল। নির্বিক অবস্থানে থেকে বলল,
“রিচার্ড কায়নাত কখনো ভালো হবেও না।”
“সারা দুনিয়ার সামনে বেপরোয়া, নৃশংস গ্যাংস্টার সেজে ঘুরেন। অথচ, ঘরে এইসব চিপ, চিপ পিকআপ লাইন মারেন৷ ছিঃ! জাতি জানতে পারলে আমার ইজ্জত আর রক্ষে পাবে না।”
“কি? আমি পিকআপ লাইন মারি? তাও আবার চিপ, চিপ।”

“তা নয়তো কি?”
“আমি মুখ খুললে ঠিক থাকতে পারবে তো?”
‘মিইয়ে গেল এলিজাবেথ। সঙ্গে,সঙ্গে কথার স্রোত পালটে দিতে চাইল,
“সত্যিই পারব না। তারচে বরং আপনি চুপ থাকুন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখি আমরা।”
“পরিবেশ তো এখন আর শান্তিপূর্ণ থাকবে না মাই ফাকিং ডার্ক রেড। এখন তুমি কাঁপবে, কাঁদবে, আর ছটফট করবে আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু, আমি তোমার এক ইঞ্চি ছাড়ও দিবো না।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে পরিবর্তন। এলিজাবেথ তরতর করে কাঁপতে থাকে লোকটার বেসামাল স্পর্শে। এলিজাবেথের গলা কাঁপছে,

“কে-কেনো? আর-আপনি এমন করছেন কেন মি.কায়নাত।”
“ডুব দিবো জান।”
“কো-কোথায়?”
“তোমার মাঝে।”
‘রিচার্ডের ঠৌঁট ধীরে, ধীরে তার কণ্ঠার দিকে এগোতেই চোখবুঁজল এলিজাবেথ। তার ঠৌঁটের তুহিন-তুষার স্পর্শে ক্ষণে, ক্ষণে কেঁপে ওঠে কায়া। খুঁজে পাই, ফিরে পাওয়া মানুষটার গায়ের উষ্ণতা। শিহরিত ঘোরগ্রস্ত মুহুর্তে হঠাৎ ভেসে এলো রিচার্ডের খাদযুক্ত কণ্ঠস্বর,

“আমি চাইলেই তোমার শোকে, দুঃখের সাগরে ভেসে যেতে পারতাম মাই লাভ। ভেঙেচুরে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতাম, নিজেকে আহত করতে পারতাম। কিন্তু এতে করে কি হতো? কেউ কি আমার কষ্ট খানিকটা নিয়ে আমাকে হালকা করতে পারতো? আমি ভেতরে, ভেতরে ভেঙেছি, কিন্তু নিজেকে ঠিক রেখেছি। আমার কিছু হলে তোকে কে বাঁচাতো এলিজান? তোকে রক্ষা করার জন্য হলেও যে শেষপর্যন্ত আমাকে থাকতে হতো।”
‘এলিজাবেথের চোখ ভিজে আসে। শিরশিরে অনুভূতিতে নিভু চোখে চাইল সমুদ্র নীল চোখে। দুটো খাদযুক্ত দৃষ্টি মিলে গেল। তাদের ঠৌঁটের কোণে প্রশান্তিময় হাসির অস্পষ্ট ঝলকানি। এলিজাবেথ দুহাতের আজলায় চেপে ধরল রিচার্ডের দু’টি গাল। বলল,

“আপনি আমাকে এতোটা ভালোবাসেন মি.কায়নাত?”
‘রিচার্ড ওর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে চিরায়ত গম্ভীর গলায় বলল,
“তোকে আমি এতোটা ভালোবাসি যে, কখনো যদি এমন হয় যে—তোর রক্তের কেউ তোর জন্য বিপদজনক, আমি তাকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করব না এলিজান।”
“আই লাভ ইউ, রিচার্ড কায়নাত।”
“আই লাভ ইউ, রেড।”

‘গাড়িটা ছুটে চলেছে শহরের দিকে। এলিজাবেথ রিচার্ডের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে শুয়ে আছে। রিচার্ডের চোখ জানালার বাইরে অথচ মস্তিষ্কের ভেতরে একদম অন্যকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎই সে এলিজাবেথের মাথা দুহাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
“ওয়েট! জেমস্ তো পলাতক। তার পক্ষে বাংলাদেশ থেকে তোমাকে গোপনে ইতালি আনা একেবারেই অসম্ভব।”
‘এলিজাবেথ ধীরে একটা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আমাকে সরকারি জেটে করে আনা হয়েছিল।”
‘রিচার্ড চোখ কুঁচকে উঠে বলল, “কী বললে?”

“হ্যাঁ,” এলিজাবেথ চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “জ্ঞান ফেরার সময় কিছু কথোপকথন কানে আসে। যতটুকু বুঝেছি, সরকার ও প্রশাসন—সবাই আপনার উপর রীতিমতো ক্ষুব্ধ। সরাসরি কিছু না করে তারা জেমসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করায় আপনাকে দূর্বল করে দেওয়ার জন্য।”
‘রিচার্ডের চোয়াল টনটন করে ওঠে। রাগে তার চোখ গাঢ় হয়ে আসে। আরেকবার এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেয়েটা ভীষণ দুর্বল, ক্ষীণস্বরে কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। রিচার্ড নিঃশব্দে আবার এলিজাবেথের মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে। দীর্ঘদিন পর প্রকৃত আলো-হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে এলিজাবেথকে। রিচার্ড ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে দিকে তাকায়। তারপর নিজস্ব ভঙ্গিতে ডাকলো লুকাসকে,
“লোকা।”
‘লুকাসের মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। শুধু সামান্য গলা খাঁকারি দেয় শুধু। এলিজাবেথের ভেতরে অদ্ভুত এক অস্বস্তি জমতে থাকে। মনে হচ্ছে, ঝড় আসন্ন। তবু সে কিছু বলে না। সে শুধু চোখ বন্ধ করে থাকে। খুব, খুব ক্লান্ত।

রিচার্ড নিজ হাতে এলিজাবেথের সারা শরীর চেইক করেছে। কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তবুও মনটা কিছুতেই মানতে চায় না। এলিজাবেথ শত বারণ করেও তাকে থামাতে পারেনি। রিচার্ড জোর করেই নিয়ে গেল হসপিটালে। করাল ফুল বডি চেকআপ। ডাক্তার জানাল শারীরিকভাবে এলিজাবেথ দুর্বল, তবে বিপদের কিছু নেই। দরকার শুধু বিশ্রামের। রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে বারো ঘণ্টা। তাই রিচার্ড অপেক্ষা না করে এলিজাবেথকে নিয়ে ফিরে গেল নিজ ম্যানশনে।

‘গাড়ি থামল ম্যানশনের সামনে। জায়গাটা চেনা, তবুও আজ অচেনা লাগে এলিজাবেথের। সাজানো চারপাশ, আলোর ঝলকানি। হঠাৎ করেই মনে হলো সব যেন তার জন্যই। চোখে জল চলে আসে তার। ছলছল চোখে তাকায় রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড হালকা মাথা নাড়ল। স্বীকার করল কিছু না বলেই। একটা শিস বাজাল রিচার্ড। ম্যানশনের ওপর খাড়া ড্রাগনের দুর্গ থেকে উড়ে এলো এক বিশাল ঈগল—ব্ল্যাকহর্ক। রিচার্ডের পোষা ঈগল। ব্ল্যাকহর্ক উড়ে এসে বসলো রিচার্ডের কাঁধে। পাখার ঝাপটায় ভয়ে কেঁপে উঠলেও রিচার্ড শক্ত করে ধরে রাখল এলিজাবেথকে।
‘রাজা ও রানীর মতোই তারা প্রবেশ করল ম্যানশনে। প্রধান ফটকের সিঁড়িতে পা দিতে যাবে এলিজাবেথ, ঠিক তখনই রিচার্ড হঠাৎই হাঁটু গেঁড়ে বসে তার পায়ের নিচে হাত রাখল। এলিজাবেথ থমকে তাকাল। রিচার্ড হেসে বলল,
“আমি রাজা, তুমি রানী। রাজ্য আমার হলেও রাজত্ব তোমার।”

‘এলিজাবেথের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। কেঁপে কেঁপে পা রাখল রিচার্ডের হাতের তালুতে। এভাবেই সিঁড়ি পার হলো। লনে পৌঁছাতেই রিচার্ড কোলে তুলে নিল এলিজাবেথকে। দুপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজপ্রাসাদের গার্ডরা। সাধারণত, রাজা, রাণীর অভিষেকে ফুল দিয়ে বরন করা হয়। তবে তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন। ফুল নয়, তাদের উপর ছোঁড়া হচ্ছে নোটের বৃষ্টি। এলিজাবেথ হেসে ফেলল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“রিচ ম্যান!”
‘রিচার্ডের ঠোঁটে চেনা সেই বাঁকা হাসি। এগোতে এগোতেই বলল,”I’m rich like my name… Rich…ard!”

‘লম্বা এক শাওয়ার সেরে বেরিয়েছে এলিজাবেথ, ঠিক তখনই রিচার্ড ঝড়ের মতো ছুটে এসে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। লোকটার চোখে জ্বলজ্বল করছে এক অদম্য পুরুষালি কামনা। হতভম্ব এলিজাবেথ রিচার্ডের চোখে চেয়ে থমকালো। ও চোখের গভীর দৃষ্টিতে পুরো তলিয়ে গেল। রিচার্ড তৃষ্ণার্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“জান,তুমি ঠিক আছ তো? আজ একটু বেপরোয়া হলে সামলাতে পারবে আমায়? আমার একটা বাচ্চা চাই, এলিজান।”

‘এলিজাবেথ শুষ্ক গলায় ঢোক গিলল। সে এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। তবুও এই মুহূর্তে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না। লোকটার চোখে যে চাহনি, সেই চাহনির কাছে আত্মসমর্পণ না করে থাকা যায় না। এই দীর্ঘ শূন্যতার পর তারও যে খুব করে চাই লোকটাকে। সে মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই রিচার্ডের ফোন বেজে ওঠে। রিচার্ড বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটা কানে নেয়। ওপাশ থেকে ভেসে আসে ন্যাসোর গলা,
“বস, আপনার ওয়েডিং গিফট রেডি। শিকার নিজেই খাঁচায় ঢুকে পড়েছে।”
‘রিচার্ডের চোখ মুহূর্তেই বদলে যায়। কোমলতা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে জেগে ওঠে হিংস্র, পৈশাচিক এক আগুন। এক মুহূর্তও ব্যয় না করে এলিজাবেথের কপালে শব্দ করে একটা চুমু খায়। অতঃপর মৃদু হেসে, “রেস্ট করো, জান। আমি আসছি।” বলে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল। এলিজাবেথ হতবিহ্বল। ঠোঁট কাঁপে, কিছু বলতে চায়—কিন্তু গলায় যেন শব্দ জোটে না।

‘এলিজাবেথ স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের হাতে সদ্য তৈরি কাটা দাগটার দিকে। সেটা কিছুক্ষণ আগেও ছিল না।একদম নতুন, কাঁচা। চেকআপের সময় কিছু সময়ের জন্য হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল রিচার্ড। ফিরে এসেও কিছুই বলেনি। তবুও এলিজাবেথ জানে এই নিঃশব্দ ক্ষত কোনো সাধারণ কাহিনি নয়। এর পেছনে আছে রক্তমাখা এক অধ্যায়। কারোর গা শিউরে ওঠার মতো মৃত্যু।
*দৃশ্যপট: চিগি প্যালেস, রোম।
‘ইতালির ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল। নিরাপত্তায় সুরক্ষিত, অথচ নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে রিচার্ড। নির্মম এক পরিকল্পনা করে। অতঃপর? নিখুঁত প্রতিশোধ। নৃশংস প্রতিশোধ। প্রাইম মিনিস্টারের ঘরের দরজা বন্ধ। রিচার্ড সবিনয়ে চেয়ারে বসায় তাকে। তারপর উঠে গিয়ে লোকটার বুকের ওপর চেপে বসে অপলক তাকিয়ে থাকে। এরপর ধীরে ধীরে, ঠান্ডা মাথায় ছুরির একের পর এক কোপ চালায় বুকে। রক্ত ছিটকে এসে লাল করে দেয় দেয়াল, মেঝে, আর রিচার্ডের হাত।

‘এক কোপে ছুরি পিছলে গিয়ে হাত কেটে যায়।
তবুও থামে না রিচার্ড। চারপাশে র-ক্তের তপ্ত তরঙ্গ। তার মাঝেই ভেসে বেড়ায় রিচার্ডের জ্বালাময়ী, হিংস্র স্বর,
“স্যরি, প্রাইম মিনিস্টার। মাস্ট আই হ্যাভ টু কিল ইউ।
অনেকদিন ধরে তো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে শেষ করার। প্রতিবার টের পেয়েছি, আর প্রতিবারই অবুঝ বলে ছাড় দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু শালা তুই তো এবার সোজা আমার ‘জান’-এর দিকে হাত বাড়িয়েছিস। এখন তোকে বাঁচিয়ে রাখলে পাপ হবে আমার। ঘরের বউয়ের দিকে নজর দেওয়া পাপ না, মহাপাপ।”
‘থেমে,একটা তীব্র হাসি হেসে রিচার্ড ফিসফিস করে বলল,
“She is my lady. My wife, Gangster wife.
এতটা সাহস দেখানোও ঠিক হয়নি।”

‘এলিজাবেথ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। ধীরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মস্তিষ্কের ভেতর বারবার বাজছে রিচার্ডের বলা সেই কথা”আমার একটা বাচ্চা চাই, এলিজান।”অপ্রত্যাশিতভাবে ঠোঁটে ফুটে উঠল লাজুক একটা হাসি। সে আয়নার সামনে ঘুরে, ফিরে নিজের পেটটা দেখতে থাকল। কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি। অচেনা, অথচ নরম। ঠিক তখনই এক মেড এসে রিপোর্টের একটা খাম হাতে দিয়ে যায়। এলিজাবেথ চুপচাপ খুলে দেখে। প্রথম দুই লাইনে চোখ পড়তেই পায়ের নিচে মাটি যেন কেঁপে ওঠে।
রিপোর্টটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায়। ঠোঁট কেঁপে ওঠে। বুক চেপে ধরে মেঝেতে ভেঙে পড়ল এলিজাবেথ। চোখে জল জমে আসে।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫

‘ঠিক সেই মুহূর্তে বেজে ওঠে ল্যান্ডলাইন। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। হাত কাঁপতে কাঁপতে ফোনটা কানে তোলে এলিজাবেথ। ওপাশ থেকে ভেসে এলো চেনা স্বর,
“এলিজাবেথ, মাই প্রিন্সেস।”
‘এলিজাবেথ আঁতকে উঠল।চোখ বিস্ফারিত।
ঠোঁটের ফাঁক গলে ছিটকে বেরিয়ে এল চাপা এক ধ্বনি,
“মম!”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫ (৩)