একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৪২ (৬)

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৪২ (৬)
রনীতা তুশ্মি

আনায়া তড়িঘড়ি করে এদিক সেদিক ছুটছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মেহমান যাদের আসার কথা ছিল, তাদের কেউ আর আসছে না। লোকারন্যে পরিপূর্ণ হলরুমটাও ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে শুরু করে। আপাতত সবাই বাবুশকার জন্য অপেক্ষায়।সে চলে এলে আর একটুও সময় নষ্ট করবে না। নিজেরাই নিজেদের মতো করে বার্থডেটা সেলিব্রেট করে নেবে। কিন্তু সন্ধ্যায় আসার কথা সেই বাবুশকার আসতে এতো দেরি—যেন কোনোভাবেই তাদের বোধগম্য নয়। এতে তারা কিছুটা হতাশও হয়। এরইমধ্যে আবার আনায়া খেয়াল করে দেখে রেহানও আশেপাশে কোথাও নেই। প্রথমে বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, পরক্ষণেই রোজের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে—রেহান নাকি তাদের বলডান্স চলাকালীন সময়েই এখান থেকে তার নিজস্ব কাজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে তা রোজ ঠিক জানেনা।

এসব শুনে আনায়া কিছুটা অবাক হয়। এই মূহুর্তে রেহান আবার কোথায় চলে গেল? সে কিছুটা বিরক্ত হয়েই অনবরত কয়েকবার রেহানকে ফোন করে। কিন্তু প্রতিবারই ফোন সুইচঅফ দেখায়। এতে আনায়া নিত্যন্তই বিস্মিত। কাছেই হাস্যজ্জ্বল মুখে দাড়িয়ে থাকা কেনীথকে যেন, কথাটা বলতে চেয়েও বলল না। এদিকে কেনীথই শেষমেশ তাকে কিছুটা চিন্তিত দেখে তার দিকে আসে।
—“কি রে! এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেনো?”
আনায়া কিছু বলে না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, জায়গাটা কেমন যেন শুনশান লাগছে। সে কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,
❝অরিন কোথায়? জায়গাটা কেমন যেন নিমিষেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে,তাই না?❞
আনায়ার অভিব্যক্ততে কেনীথের কপাল কুঁচকে যায়। আশেপাশে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে, পুনোরায় তার দিকে তাকায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—“তারা! কিছু কি হয়েছে?…অরিন তো রোজের সাথে।”
আনায়া এবারও কোনো জবাব দেয় না। এরইমাঝে বাড়ির ভেতরে দুজন গার্ড প্রবেশ করে। একজনের হাতে বড়সড় আকৃতির এক গিফট বক্স। তাদের অভিব্যক্তিতে বোঝা যাচ্ছে, জিনিসটা নিত্যান্তই ভারী। কেনীথ-আনায়ার দিকে তারা দুজন এগিয়ে আসতেই, কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে বলে,
❝এটা কে পাঠিয়েছে?❞
কেনীথের কথা প্রতিত্তোরে দুজন আশ্চর্যজনক ভাবে কিছুটা ঘাবড়ে যায়। এতে কেনীথের কপালও খানিকটা কুঁচকে যায়। সে আবারও বলে,
❝ কি হলো?❞
কেনীথের কঢ়া কন্ঠে একজন বলে ওঠে,
❝ জানিনা বস।❞

—“জানিনা মানে? এই জায়গায় ভেতরে নাম ঠিকানাহীন জিনিস আসে কি করে?”
কেনীথের কথায় তারা দুজন কিছু না বলেই, জিনিসটা নিচে আলতোভাবে রেখে দেয়। অতঃপর কুর্নিশ জানিয়ে পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
এদিকে কেনীথ আর কথা না বাড়িয়ে বক্সটার রেপিং খুলে দেখে, একটা কাঠের বাক্স। এমন চকচকে কাঠের বক্স দেখে,তার কপাল আরো খানিকটা কুঁচকে যায়। রেপিং পেপারে কোনো কিছু লেখা না থাকলেও, বাক্সটার উপরে একটা ছোট্ট চিরকুট মেলে। যেখানে খুব স্পষ্ট ভাবে লেখা,
❝অপেন ইট—এন্ড ইনজয় দ্য সারপ্রাইজ।❞

কেনীথ ভালোমতো হাঁটু গেঁড়ে বসে, বক্সটা সাবধানের সাথে খোলে। চোখ-মুখে নিস্তব্ধতা। যে কোনো কিছুই ঠিক নেই।বক্সটা খোলার সাথে সাথেই যেন একটা অদৃশ্য বিস্ফো*রণ ঘটে চারপাশের নিস্তব্ধতায়। ভেতরে দেখা যায় একটা র’ক্তা”ক্ত কাঁ’টা মাথা। চোখ দুটো আধখোলা, ঠোঁটের কোণে কী যেন এক অদ্ভুত বাঁকা হাসি। চারপাশে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন গার্ড চমকে পেছিয়ে যায়। আনায়া এক ঝটকায় দু’পা পিছিয়ে গিয়ে মুখে হাত চেপে ধরে।
— “রেহান!”
কেনীথের কণ্ঠ ও চাহনিতে তীব্র বিস্ময়। এদিকে আনায়ার যেন হুঁশ উড়ে গিয়েছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে?কেনীথ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে মাথাটার দিকে। মুহূর্তেই তার নজরে কিছু একটা খটকা লাগে।—❝না… কিছু একটা ঠিক নেই…❞

সে মনে মনে কথাটা আওড়ায়। মাথাটাকে ধীরে ধীরে হাতে তোলে। গলার কাছ দিয়ে আঙুল চালিয়ে— কানের পেছনে একটা অস্বাভাবিক খাঁজ টের পায়। সন্দেহে আঙুল দিয়ে টান দিতেই, একটানে খুলে যায় মুখোশের ন্যায় একটা পাতলা আবরণ। মুহূর্তে বেরিয়ে আসে অন্য এক মুখ। চেহারাটা দেখে কেনীথ পুনোরায় অবাক চোখে তাকায়। এটাও এক ভিন্ন পুরুষের মুখমণ্ডল, তবে একে সে চেনে। কোথাও তো দেখেছে…কেনীথের ভাবনার মাঝেই পাশ থেকে আনায়া অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
— “রণক!”

কেনীথ চমকে পেছনে ফিরে আনায়ার দিকে তাকায়। আনায়ার শরীর মৃদু কাঁপছে।মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।তার সেই ছোট বেলার বন্ধু—রনক!যার সঙ্গে তো শেষ দেখা হয়েছিল সেই কতগুলো বছর পূর্বে। আর আজ এতে বছর পর… এইভাবে?
আনায়ার গলা শুকিয়ে চৌচির। এদিকে কেনীথের বিস্ময় কাটিয়ে চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে। তীব্র রাগে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠে।
—“বল কে পাঠিয়েছে এসব? তোদের সাহস কি করে হলো,বাহিরের কোনো কিছু না দেখেই বাড়ির ভেতর অব্দি নিয়ে এসেছিস! এসবের মানে কি বা”স্টা”র্ডস্!”
কেনীথের ধমকে আশেপাশে সবাই কেঁপে ওঠে। সেই দু গার্ড কাঁপা কাঁপা স্বরে আওড়ায়,
❝আমরা কিচ্ছু জানিনা বস। মাফ করুন আমাদের।❞

এ কথায় যেন কেনীথের রাগ, আরো কিছুটা বেড়ে যায়। সে তেড়ে সেই দুজন গার্ডকে ধরতে নিলে, আচমকা আনায়ার জন্য থেমে যেতে হয়। আনায়ার ফোন বাজছে। সে তা চেক করতে গিয়ে দেখে একটা অপরিচিত নাম্বার। আনায়া আরো কিছুটা ঘাবড়ে যায়। কেনীথের দিকে কাঁদো কাঁদো চাহনিতে তাকাতেই, কেনীথ চোখের ইশারায় আশ্বাস দিয়ে, কলটা রিসিভ করতে বলে। আনায়াও খুব একটা সময় না নিয়ে কলটা রিভিস করে কানে ধরে।
এদিকে বাক্স থেকে উঠে আসা রক্তের গন্ধ। মুখোশের রহস্য—সবকিছু যেন কোনো সুদূর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেনীথ এখনো বুঝতে পারছে না এসব কে করছে! এর মানে… রেহান কি তবে…?নাহ,রেহান হলেও এটা একা তার কাজ নয়। আর এরচেয়েও বড় কথা, রেহান এমন কিছু কেন করবে? আদোও একা ওকে দিয়ে এসব সম্ভব?
আনায়ার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়৷ একইসাথে কেনীথের ধ্যানও ভেঙে যায়।আনায়ার দিকে তাকাতেই দেখে, আনায়া অনবরত কাঁপছে।কেনীথের দিকে নিস্তেজ চাহনিতে তাকায়।তার ঠোঁটও কাঁপতে থাকে। কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। কেনীথ কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরেই বলে,

❝কি হয়েছে? কে ছিল ফোনে?❞
আনায়া শুরুতে কিছু না বললেও, পরক্ষণেই অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,
❝ইনায়াদের নাকি… এক্সিডেন্ট হয়েছে।❞
আনায়া কথাটা বলতেই ঠোঁট চেপে কেঁদে ওঠে। তার মাথায় কাজ করছে না এসব কি হচ্ছে। এদিকে বিস্ময়ে কেনীথ কি ছেড়ে কি করবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না। একসাথে এতোকিছু… সব সাজানো পরিকল্পনা! কিন্তু কে করছে এসব?

চিন্তিত, অস্থির—কেনীথ, আনায়াকে দূর হতে দেখছে শান্ত একজোড়া চোখ। হলরুমের সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে রোজ। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ। চোখেমুখে তীব্র অস্বস্তি ও ভয়। চোখজোড়া নিমিষেই অশ্রুতে ভিজে ওঠে। নাকের পাটা ফুলে যায় নিমিষেই। রোজ নিজেকে সামলাতে ঠোঁট চেপে ধরে। এরপর আর এক মূহুর্তও দেরি না করে, সবার চক্ষু আড়ালে দোতলায় ছুটে চলে যায়।
নিজের রুমে এসে দরজটা লাগিয়ে দেয়। চোখ বেঁয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে।হাত পা কাঁপছে তার। যেন জীবনের শেষ সময় ও সিদ্ধান্ত নেবার পালা চলে এসেছে। রোজ নিজের কাঁপতে থাকা অস্তিত্বকে স্থীর করে। দু’হাতে চোখের জল মুছে ভারী শ্বাস ফেলে। এরপর একটুও সময় নষ্ট না করে দৌড়ে ছুটে যায় নিজ বারান্দায়। উঠে পড়ে বারান্দার প্রশস্ত গ্রিলের উপর।

রাতের দমকা হাওয়ায় সোনালী লালচে চুলগুলো উড়ছে। রোজের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন থমকে গিয়েছে। সে নির্বিকারে নিজের দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দেয়। যেন রাতের বিভীষিকাময় হাওয়া নিজের সর্বস্ব দিয়ে শুষে নিয়ে চাইছে।তবুও যেন এই শহরের মানুষ গুলো বেঁচে যায়—এ প্রচেষ্টায়।
রোজের মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করছে। বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি জোগায় না।স্বেচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় — তাকে এখান থেকে একটা না একটা সময় নিচে পড়ে যেতেই হবে। সে আর একটুও সময় নেয় না। চোখজোড়া খুলে, আলতোভাবে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু একটা বলতে চায়। তবে তার পূর্বেই আবারও তার চোখজোড়া ভিজে ওঠে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। এবং একই সাথে আওড়ায়,
❝তোমরা আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি! তাই আমি কখনোই পারব না, নিজ স্বার্থের জন্য তোমাদের সাথে প্রতারণা করে বেঁচে থাকতে।❞

রোজ এইটুকু বলে থমকায়। নিজেকে খানিকটা দৃঢ় করে আবারও বলে,
❝ব্যর্থ আমি! এক জন নারী হিসেবে,একজন মেয়ে হিসেবে, একজন বোন, একজন নাতনী ও সর্বশেষে একজন মা হিসেবে— ব্যর্থ আমি। হে পৃথিবী! হে জগৎ স্রষ্টা! আমি জানি,আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবুও পারলে আমায় ক্ষমা করো।❞
এরপর নিমিষেই চোখের পলকে একটি প্রাণ নিজের গল্পের সমাপ্তিতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। রোজ একটুও সময় নিজের জন্য অবিশিষ্ট রাখেনা। যে উদ্দেশ্যে সে বারান্দায় ছুটে এসেছিল, তা সফলও হয়।

নিজেদের সামলে নেবার পূর্বেই আচমকা বাহিরে এক বিকট আওয়াজে সকলে আকস্মিক চমকে ওঠে। বাড়ির ভেতর হতে কেউই বুঝতে পারেনা, আচমকা একটা কিসের শব্দ হলো। কেনীথ আনায়া একে অপরের দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকায়। আনায়ার শরীর চলছে না। কিন্তু মন বলছে আরো অনেক খারাপ কিছু হতে চলেছে। চোখে মুখে অবাধ ভয়-শূন্যতা গ্রাস করেছে। তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে নেবার।
এবারও কেনীথ একটুও সময় নষ্ট করে না। সে ছুটে চলে যায় বাড়ির বাহিরে। তার পেছন পেছন ছুটে যায় আনায়াও। এরপর আবারও এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি।

অতল অন্ধকারে ভেজা উঠোনের শীতল ঘাসের ওপর, নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে রোজের দেহ। মাথার এক পাশ রক্তে সিক্ত—ছড়িয়ে পড়া লালচে তরল যেন , নিস্তব্ধতা ভেঙে, আলোচিহ্ন এঁকে দিয়েছে মৃত্যু ও জীবনের সীমারেখায়। তবে সেই নিঃসাড় দেহের পাশে দাঁড়িয়ে কেনীথ ঠিক মৃত্যু শব্দটিকে মেনে নিতে পারছে না। বুকের গভীরে যেন অজানা কোনো কিছু টনটন করে অনুভূত হচ্ছে—অস্ফুট, কিন্তু অপরিচিত নয়।
তার দৃষ্টি কঠিন,অভিব্যক্তি স্তব্ধ। বাহুতে মুঠিবদ্ধ শক্তি। কেনীথ নিঃশব্দে ঝুঁকে পড়ে। বা হাত দিয়ে রোজের মাথাটা তুলে নেয় আলগোছে। অন্য হাতের আঙুল স্থির হয় রোজের নাকের কাছে—শ্বাসের অস্তিত্ব খোঁজে। কিছু একটা হালকা প্রায় অশরীরী ন্যায় অনুভূত হয়। কেনীথ মলিন ভাবে তাচ্ছিল্যের সহিত তির্যক হাসে…।তবু স্পষ্টভাবে অনুভবযোগ্য—এক ক্ষীণ ধাক্কা বুকের মাঝখান দিয়ে বিদ্যুতের ন্যায় ছুটে চলছে।
❝এমনটা কেনো করলি, বোন আমার?❞

কেনীথ আলতোস্বরে এইটুকু আওড়িয়ে, মাথা উঁচিয়ে একপলক রোজের বারান্দার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, রোজের মুখমণ্ডলে দিকে নির্বিকারে চেয়ে থাকে। তার মাথায় নানানকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে। কিন্তু সে আজ নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছে না। ভেতরটায় অজানা ঝড়ে তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।
এরইমাঝে কেনীথ মনের অন্তরালে আওড়াতে থাকে,
❝তুই আমার রক্তসম্পর্কিত কিছু না।বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। এক অভ্যস্ত প্রহরের মতো, দিনের প্রতিটি গাঢ় ছায়ায় তাের অস্তিত্ব আমি অনুভব করতাম। ছোটবেলায়, যখন তুই অকারণেই আমার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াতিস, নিজের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় বারংবার আমার ছবি আঁকতে গিয়ে, নানান সব বিকৃত মুখাবয়ব এঁকে নিঃসংকোচে আমার ডেস্কে রেখে যেতিস…আমি বিরক্ত হতাম না।

আর না সেই— বিরক্ত না হওয়াকে কোনোদিন ভালোবাসা হিসেবে গণ্য করেছি আমি। হয়তো আমি ইচ্ছাকৃত ভাবেই তোকে এবং তোর কাজকর্ম, অভিব্যক্তিকে—ছেলেমানুষী বলে পাশ কাটাতাম। কারণ তোর চোখে যে অতল কোন সৌম্য দৃষ্টির পরশ ছিল, তা ছিল আমার জন্য বরাবরই অস্বস্তিকর । আমি জানতাম—তুই ভালোবাসসি, কিন্তু আমি বুঝেও কখনো তা বুঝতে চাইনি। সবকিছুর উর্ধ্বে সর্বদা আমি তোকে নিজের বোন হিসেবেই বিবেচনা করেছি।
আমার জন্য লেখা নানান কবিতা। তোর কিশোরী বয়সে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া সেই ডায়রির প্রত্যেক পাতায় আমাকে নিয়ে সাজানো, প্রত্যেকটা অক্ষর—সবটাই তো আমার জানা। আমাকে নিয়ে তোর কতশত ভাবনা, কল্পনায় সাজানো সে এক বিস্তৃত রাজকীয় দুনিয়া—এসব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নানান সব ভাষার ব্যবহার। অবশ্য আমি জানতাম তুই আমার জন্য পাগল, কিন্তু সেই ডায়রীটা পাওয়ার বুঝেছি, তুই আমার জন্য এক বিধ্বংসী ঝড়ের মতো উম্মাদ। কিন্তু তবুও যে আমি তোকে, আমার বোনের চেয়ে কখনোই বেশি কিছু ভাবতে পারিনি, রোজ!

এইজন্য মাফ চাই, তোর একতরফা ভালোবাসাকেও আমি সম্মান করি। কিন্তু এটা কি করলি তুই? কেনো করলি এটা? তোর মাঝেই কেনো এতো রহস্য জড়ালো? কোনোকিছুই তো স্পষ্ট নয়।এই নতুন খেলায় তুই-ও যে অংশীদার হবি তা আমার জন্য অকল্পনীয়,রোজ। শুধু এইটুকুই বলব, আজ যা ধোঁয়াশায় মোড়াতে তুই এই পদক্ষেপ নিয়েছিস, তা একদম অনুচিত। মোটেও ঠিক করিসনি তুই।এর জন্য অন্তত তোকে আমি কখনো ক্ষমা করব না। কখনোই না!❞
কেনীথের অভিব্যক্তি এই পর্যায়ে সম্পূর্ণ স্তব্ধ। চোখের কোণায় কিঞ্চিৎ জলের কণা। অথচ বাহ্যিক মুখের অভিব্যক্তিতে ভয়ংকর রাগের তীব্রতা। কেনীথের ঠোঁট ছোঁয়ায় না, এমন তার উচ্চারণ। অথচ তার ভেতরের কণ্ঠ নিঃসন্দেহ—অপরাজেয়। সে মাথা তোলে, চোখ দুটো স্থির হয়ে ওঠে।
এই সময়েই, হুমড়ি খেয়ে ছুটে আসে আনায়া। শোকে বিহ্বল, ভয়ে শ্বাসরুদ্ধ। তার হাঁপাতে থাকা দেহ ভেঙে পড়ে রোজের পাশে। রক্ত দেখে তার চিৎকার গলায় আটকে যায়। সে দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন ভাবে রোজের হাত চেপে ধরে, কান্নায় ভেঙে পড়ে—

❝এই কেনীথ! এটা কী হচ্ছে? কেন? ও কেনো এমন করলো?❞
কেনীথ কোনো জবাব দেয় না। অন্যদিকে আনায়া কান্নায় ভেঙে পড়ে। চোখে জল, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। যেন এ পৃথিবীর সকল প্রশ্ন সে এক মুহূর্তেই তুলে দিচ্ছে কেনীথের সামনে। কিন্তু কোনো যথাযথ উত্তর নেই। এখনো মস্তিষ্কের মাঝে চলছে রনকের বিচ্ছিন্ন র”ক্তা”ক্ত মাথার দৃশ্যপট ও ইনায়াদের ভয়ানক এক্সি”ডেন্টের সংবাদ। ফোনের ওপারের ব্যক্তিটি সাধারণ মানবের সুরে কথা বললেও, তা আনায়ার কাছে এখনো রহস্যময়। কিন্তু সে একসাথে এতোকিছু সহ্য করতে পারছে না। মস্তিষ্ক তার অচল হয়ে আসছে। প্রতিবার প্রেগন্যান্সিতেই তার অবস্থা শুরু থেকেই বাজে পর্যায়ে চলে যায়।কেনীথের বিশেষ পরিচর্যা ও দায়িত্বশীলতা ব্যতীত তার নিজেকে একা সামলানো নিত্যন্তই কষ্টসাধ্য। আনায়ার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসার পাশাপাশি, কেমন যেন গা গুলাতে শুরু করেছে।
তখনই কেনীথ চুপচাপ আনায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে—চোখে বজ্র কঠিন দৃষ্টি। কন্ঠস্বর গভীর, সংযত, অথচ অনড়।
❝শান্ত হো! ও এখনো শ্বাস নিচ্ছে,ঘাবড়ানোর কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু হবে না ওর, এতোসহজে ওর কিছু হতে দেব না আমি।বাবুশকাকে দেওয়া কথা আমায় রাখতে হবে। যেভাবেই হোক!❞

রোজ তখনো নিঃস্পন্দ। কিন্তু তার বুকে চলমান শ্বাসের ক্ষীণ ওঠানামা জানান দেয়—তার হৃদয়স্পন্দন থামেনি।এদিকে কেনীথ পাগলপ্রায় হয়ে, গার্ডদের উদ্দেশ্য চিৎকার করে দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,
❝হেই!তোরা গাড়ি বের কর! এখনই! ডাক্তারকে খবর দে! আমাদের পারসোনাল ডক্টর, হসপিটা— যা আছে সবাইকে খবর দে। ওদিকে পাভেলরা কোথায় কিভাবে রয়েছে তার সন্ধান কর। কারো যেন কিছু না হয়।নয়তো একটাও বাঁচতে দেব না আমি।এসব যেই করে থাকুক না কেনো,আমি তার পরিকল্পনা এতো সহজে সফল হতে দেব না। কখোনোই না! ❞

তবে আশ্চর্যের বিষয়,কেনীথ এতো তীব্র হুংকা”রের পরও আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেউই কোবো সাড়া দেয় বা। না কোনো গার্ড, না কোনো সহকর্মী। তারা স্থবির, নির্জন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। যেন কোনো অশরীরী ছায়ার অধীনে,মুখে কৃত্রিম ভয়ের মুখোশ পড়ে, চোখে নিরুত্তাপ নির্লিপ্তিতা নিয়ে সেজে রয়েছে।
কেনীথ স্থির হয়ে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার দেখে গার্ডদের দিকে। কেউ এক চুলও নড়ে না। আনায়ার চোখ ততক্ষণে বিস্ফারিত, দম আটকে আসা শ্বাসে সে অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে যেন বাতাস হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠেছে।শব্দহীন, চাপা অসহনীয়তায় তাকে মুড়িয়ে গিয়েছে।
❝তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আমি আদেশ দিয়েছি! শুনতে পাচ্ছিস না?❞
কেনীথের দৃষ্টি অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জলন্ত। কন্ঠস্বরের হুঙ্কারে যেন দেয়াল কেঁপে ওঠে। তবুও কারো চেহারায় ন্যূনতম উদ্বেগের ছায়া নেই। এই নিরবতা, এই উদাসীনতা যেন কোনো এক অজানা অন্ধকার ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

রাতের আকাশে চাঁদের আলো মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দূরে কোথাও অদৃশ্য কুকুরের ডাকে এক বিভীষিকাময় নিস্তব্ধতা চেপে বসছে চেতনার ওপর। আনায়া ফিসফিস করে বিস্ময়ের চাহনিতে একঝলক চারপাশটা দেখার পর, সংশয়ের স্বরে বলে ওঠে,
❝কেনীথ, এরা… এরা সবাই অস্বাভাবিক। এদের চোখ… এদের মুখ, এরা… আমার কোনোকিছুই ঠিক লাগছে না। এদেরকেও না৷❞

কেনীথের ধৈর্য চরমে পৌঁছে যায়। আনায়ার হাত একবার শক্ত করে চেপে, আশ্বস্ত করার পর সে পুনোরায় ক্ষি’প্ত হয়। প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে একপ্রকার তেড়ে গিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক গার্ডের দিকে। এটাই সেই বক্স নিয়ে আসা গার্ডের মাঝে একজন। একে তখন থেকেই তার গড়বড়ে লাগছে। কেনীথ তার স্যুটের কলার চেপে ধরে, দানবীয় শক্তিতে তাকে প্রায় মাটিতে আছড়ে ফেলতে চেয়েও,সামলে নেয়। যেন সম্পূর্ণ ক্ষো”ভের তীব্রতা একবারেই প্রকাশ পায়। একইসাথে উম্মাদের ন্যায় চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
❝তুই বোবা নাকি? তুই কানে শুনতে পাস না? ডাক্তার ডেকেছিস? বাবুশকাদের এক্সিডেন্ট হয়েছে,ওখানে লোক পাঠিয়েছিস? এরা সবাই একই বিহেভ কেনো করছে? বল এসব কে করাচ্ছে তোদের দিয়ে? ছাড়ব না আমি, বিশ্বাস কর! একেকটাকে জ্যান্ত মাটিতে গেঁড়ে রাখব।❞

সেই গার্ড একদম স্তব্ধ। ঠোঁট সামান্য কাঁপন, কিন্তু শব্দ করে না। সেই মুহূর্তেই হঠাৎ…এক বিকট ধাতব শব্দ। যেন অদৃশ্য কারো হাত হতে ছুটে আসা লোহার প্রহার—কেনীথের মাথায় কিছু একটা প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে।এতটাই শক্ত যে মুহূর্তেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়তে নিয়েও, নিজেকে সামলে নেয়। তার শক্ত হাতে ধরা গার্ড মাটিতে পড়ে যায়। কেনীথ চোখে অন্ধকার দেখে পেছনে ফিরতে গিয়ে… দেখা মাত্রই ই স্তব্ধ হয়ে যায়।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাভেল। পরনে পার্টি ড্রেসের আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। নেভী ব্লু কালারে হুডি আর কালো প্যান্ট। খুবই চিরচেনা তার পোশাকাশাক। তবুও যেন সব অচেনা। সবকিছুই নতুন। তার হাস্যজ্বল অভিব্যক্তি কেনীথকে অকল্পনীয় ভাবনার মাঝে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমাগত।
কেনীথের নজর গিয়ে ঠেকে তার হাতের দিকে। একটা শক্তপোক্ত মোটা রড বেয়ে কিঞ্চিৎ এক-দুই ফোটা র*ক্ত নিস্পৃহ ঘাসের উপর পরল। কেনীথ পুনোরায় নজর সরিয়ে পাভেলের দিকে তাকায়। তার চোখজোড়া হতে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এদিকে পাভেল যেন কেনীথের অভিব্যক্তিতে নিমিষেই প্রশান্তির হাসিতে মুচকি হেসে ফেলে। ডান হাতের সাহায্যে মাথার ওপর হতে, হুডির টুপিটা একটানে সরিয়ে নেয়। নিমিষেই দৃশ্যমান হয় একঝাক এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলের। সে বিস্তৃত মুচকি হেসে কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,

❝হ্যালো ব্রো! ওয়াটস্ আপ!❞
চারপাশে নির্জনতা, কেনীথ আনায়ার চোখেমুখে বিস্ময়ের তীব্র আভাস। যেন সবকিছুই আজ দুঃস্বপ্ন। এরইমাঝে পাভেল আবারও নাটুকে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
❝এত শোরগোল করছো কেন, বিগ ব্রো? তোমার আদেশ এখন আর কেউ শুনবে না। কারণ রাজ্যের মঞ্চে চরিত্রটা যে বদলেছে, ভাই। এবার থেকে খেলাটা আমার।❞

কেনীথের মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলছে দৃঢ়ভাবে। তার কঠোর দৃষ্টি ঠিকরে পড়ে পাভেলের মুখে।অবিশ্বাস, প্রতারিত হবার যন্ত্রণা, আর ভয়ানক ঝড়ের গর্জন একসাথে ফুটে ওঠে তার চাহনিতে।
এদিকে আনায়া সম্পূর্ণ স্তব্ধ। তার কণ্ঠে কোনো আর্তনাদ নেই।কেবল দৃষ্টিশূন্য স্তব্ধ হৃদপিণ্ডে জমে থাকা ভয় নিয়ে সে দাঁড়িয়ে সে। পাভেলের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁট ফিসফিস করে উঠলেও কোনো শব্দ বের হয় না। সবকিছুই যেন দুঃস্বপ্নের মতো লাগে। কেনীথের কাছে ছুটে যাবার মতোও শক্তি জোগায় না তার।
এদিকে পাভেল তার হাতের লোহার রডটাকে আঙুলে সুনিপুণ দক্ষতার সাহায্য ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত করে, ফিঁচকে হেসে ওঠে। চোখে প্রশস্ততা, অথচ তাতে উন্মত্ততা নেই—বরং তার চোখ দুটি যেন পুরাতন কোনো বিদ্বেষের জমাট অভিশাপে জ্বলে উঠেছে।

কেনীথ জোরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, দু-পা গিয়ে যায় পাভেলের দিকে। তার কপাল থেকে গড়িয়ে পড়ছে র*ক্তের ফোঁটা। তবুও তার দৃষ্টি কঠোর—অপরিবর্তনীয়। সে চিৎকার করে উঠতে পারত, গর্জে উঠতে পারত যেমন করে একদা বীরেরা করে, কিন্তু সে তা করেনি। কারণ পাভেলের চোখজোড়া, তির্যক হাসি কিংবা অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট বুঝে গিয়েছে—এ খেলাটা বহু আগেই শুরু হয়েছিল।
❝তুই… কবে থেকে?❞
কেনীথের কণ্ঠ থেমে থেমে আসে। পাভেল বিস্তৃত মুচকি হেসে কেনীথের দিকে এগিয়ে আসে। কেনীথের দৃঢ় রক্তিম চোখের দিকে চোখ রেখে আবারও রুক্ষ হেসে বলে,

❝তুই যখন থেকে আমাকে ভাই ভাবিস—তখন থেকেই।❞
এই কথাটা যেন হাজার তীক্ষ্ণ ছুরির ন্যায় কেনীথের ভেতর ছুরিকাঘা”ত করে। বুকের মধ্যে গর্জে ওঠে ঘৃ”ণা, আঘাত, আর অন্ধ বিস্ময়ের বিস্ফো”রণ। সে দাঁড়িয়ে রেগে পাভেলের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে।কিন্তু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরও দু’জন মুখোশধারী গার্ড এসে তার কাঁধে জোরে চাপ দেয়। তার প্রতিরোধ যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। রোজের নিথর দেহ তখনো মাটিতে পড়ে আছে। রাতের শিশির তার কপালে জমেছে।
পাভেল কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে একবার পাশে ফিরে তাকায়। রোজকে ওভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ফেলে৷ বিড়বিড় করে বিরক্ত নিয়ে আওড়ায়,

❝এই মেয়েটা না, সবসময় বেশি বোঝে। এতো কিসের ম”রার শখ তার, কে জানে!❞
এই বলেই সে, সে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের হাতের সাহায্য ইশারা করে। তৎক্ষনাৎ কয়েকজন এসে রোজকে মাটি থেকে তুলে নিতে শুরু করে। যা দেখামাত্রই কেনীথ ছটফটিয়ে, ক্ষ্যাপা স্বরে বলে ওঠে,
❝কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ওকে? ছাড় ওকে, খবরদার! ওর যেন কিচ্ছু না হয়৷ নয়তো একটাকেও জ্যান্ত রাখব না আমি৷❞

কেনীথের কথায় পাভেল তাচ্ছিল্যের সাথে তির্যক হাসে। খানিকটা গা দুলিয়ে বলে ওঠে,
❝রিয়েলি? উফ ব্রো! এই মূহুর্তে তোমার নিজের চিন্তা করার দরকার। তা না করে…রোজকে নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। তাকে ঠিকঠাক রাখার দায়িত্বের কিছুটা অংশ আমারও।
যাই হোক, বলো তোমার শেষ ইচ্ছে কি? তুমি আমার এতো খেদমত করেছো। ছোট ভাই ভেবে দাসের মতো সম্মোধন করেছো। আমারও তো উচিত, বড় ভাইকে জীবনের শেষ সময়ে স্পেশাল কিছু গিফট দেওয়া। বলো তোমার কি চাই? আজ আমি অনেক খুশি, তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।❞
—❝কেনো করছিস এসব? কি চাই তোর?কে কে আছে তোর সাথে? কবে থেকে এই খেলা শুরু করেছিস? ❞
❝আরেহ!আরেহ! একসাথে এতো প্রশ্ন? কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেই বলোতো?”
—❝পাভেল, আমার মেজাজ… ❞

কেনীথের কথা শেষ হবার পূর্বেই, পাভেল পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে থুথু ফেলে বলে ওঠে,
❝তোর মেজাজে আমি থুথু ফেলি। কি ভেবেছিস? সারাজীবন আমি তোর দাস হয়ে থাকব? এই, সব কিছুতে তোর মতো আমারও অধিকার ছিল, তবে আমি কেনো শুধু শুধু তোর দাস… ❞
কেনীথ পাভেলের ব্যবহারে আশ্চর্য। চোখ মুখ রাগের রক্তিম আভায় ঢেকে গিয়েছে। সে তীব্র কঠিন স্বরে বলে উঠল,
❝বা*স্টা*র্ড! এতো বড় স্পর্ধা হয় কি করে তোর? ভেবেছিস এসব করে তুই ছাড় পেয়ে যাবি? বিশ্বাস কর, তোকে আমি জ্যান্ত অবস্থাতেই কুকুর দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়াব।❞
কেনীথ একইসাথে তার সাথে আশেপাশের লোকজনদের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখার পর বলল,
❝তোদের সবাইকে আমি জ্যান্ত, মাটিতে গাঁড়ব।বিশ্বাসঘাতকতার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাবি তোরা।❞
কেনীথের হুঙ্কারে পাভেল গা দুলিয়ে হেসে ফেলল।

—❝উফ ব্রো! এই অবস্থাতেও তোমার এতো তেজ? এসব আসলে তোমাকে দিয়েই সম্ভব।❞
এরইমাঝে আনায়া এবার অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
❝পাভেল ভাই, আমার বোন কোথায়? বাবুশকা কোথায়? ওরা তো আপনার সাথে ছিল তাই না? বাবুশকাকে আনার জন্য তো আপনার সাথে ইরাও ছিল? ওরা কোথায়? কি করেছেন আপনি ওদের সাথে?❞
আনায়ার কথা শুনে পাভেল বিস্তৃত মুচকি হেসে বলে,
❝তাদের গন্তব্য যেখানে, তারা এখন সেখানে।❞
—❝মানে?❞
আনায়ার ঘাবড়ানো কন্ঠস্বরে পাভেল আবারও মুচকি হেসে বলে,
❝এতোক্ষণে তো ম”রে যাবার কথা। চিন্তা নেই, খোঁজ খবর নিয়ে আমি আপনাকে সঠিক আপডেটটা দিয়ে দেব,মাই ক্রিমসুইট ভাবি।❞

এই বলতে না বলতেই, সে গার্ডদের চোখের ইশারায় কোনোকিছুর ইঙ্গিত দেয়। এবং তৎক্ষনাৎ গার্ডগুলো আনায়াকে ধরতে আসে। আনায়া ঘাবড়ে গেলে, কেনীথ আরো ক্ষিপ্ত হয়। এতোক্ষণ পাভেলের হেলাফেলা কথাবার্তা সহ্য হলেও,এখন সবকিছুকে ধ্বং”স করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেনীথের উগ্রতায় আরো তিন-থেকে চারজন গার্ড এসে তাকে শক্তভাবে চেপে ধরলো। কেনীথ চোয়াল শক্ত করে, হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৪২ (৫)

❝পাভেলললল!❞
কেনীথের কথায় পাভেল খানিকটা মৃদু হেসে বলে,
❝নট যাস্ট পাভেল! আ’ম সের্গেই পাভেল হান্স অর এস.পি.হান্স—দ্য সিইও অব হান্স কাম্পানি।❞

একজোড়া আগুন পাখি শেষ পর্ব