মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৫

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৫
মির্জা সূচনা

একটা অন্ধকার আচ্ছন্ন ঘর।
ঠিকমতো নিঃশ্বাস না যাচ্ছে না। কেমন যেন একটা ধোয়া?
সেই ঘন ধোঁয়া যেনো বিষের মতো চারদিকে ছড়িয়ে আছে।শ্বাস নেওয়াটাও দুঃসহ।
দুই পাশে ছোট ছোট বাচ্চার কান্না।
সেই কান্না যেনো মেহরিনের বুক চিরে যাচ্ছে।
মেহরিন তার দুই সন্তানকে কোলের মধ্যে নিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল—
কে আছো? দরজা খুলো! আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না!
আমার বাচ্চারা কষ্ট পাচ্ছে… কে আছো, দরজা খুলো!
বাচ্চাদের কান্নার গতি বাড়তে থাকল।
মেহরিন কান্নায় ভেঙে পড়ল—

কেউ আসছে না কেন… কেউ সাহায্য করছে না কেন?
তাহলে কি আমি আমার বাচ্চারা আমরা মরে যাব? কেউ বাঁচাতে আসবে না?
মেহরিন কাঁদতে কাঁদতে কাতর কণ্ঠে বলে উঠল
— কে আছো দরজা খুলো…
আমার বাচ্চারা কষ্ট পাচ্ছে!
আমায় না নাও, ওদের নিয়ে যাও… ওদের বাঁচাও!
ওদের বাঁচতেই হবে! ওরা তো শিকদার বংশের প্রদীপ…এ প্রদীপ নিভে গেলে শিকদার বংশই নিঃশেষ হয়ে যাবে!
মেহরিন প্রাণপ্রণয়ে চিৎকার করে—
মা… মামণি… ফুপি… কই তোমরা?
দরজাটা খুলে দাও না গো!
চুমকি, তুই কোথায়? মেহের!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ও মেহবুবা, রাহি রে! লামিয়া কই?
কই তোমরা সবাই দরজাটা খোলো না!
লাবিব… তোমার আব্বাজানরা কষ্ট পাচ্ছে! দরজাটা খোলো!
কবি সাহেব… কবি সাহেব কই?
আপনার Moonbem?
আপনার অ্যারিওনা?
আপনার বউজান তো একেবারে অসহায় হয়ে গেল!বাঁচাবেন না তাদের?
আপনার বউজানের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে… শোনছেন আপনি?
কোথায় আপনি?
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে মেহরিন।

দরজার পিঠে ভর দিয়ে বসে পড়ে সে, দুই সন্তানকে কোলের মধ্যে চেপে ধরে।
কবি সাহেব… আপনি তো বলেছিলেন আমি বাঁচব আমার বাচ্চারা বাচবে!কই আপনি? আসছেন না কেন?
আমি আমরা এত বড় বিপদে, আপনি আসছেন না কেন?
সেই মুহূর্তে হঠাৎ…
দুই মুখোশধারী লোক এগিয়ে আসে মেহরিনের দিকে।তাদের হাতে বন্দুক।
মেহরিন গলা কাঁপিয়ে বলে—
কে… কে আপারা? এখানে কেন এসেছেন?
লোকদুটি ভয়ানক রকম হাসে।
সে হাসিতে এমন কিছু আছে, যা শরীরের ভেতর ঠাণ্ডা স্রোতের মতো বয়ে যায়। কি বিদগুটে সেই হাসি।
মেহরিন এবার গর্জে ওঠে—

বলুন, আপনারা কে? এখানে কেন এসেছেন?
এক মুখোশধারী লোক এগিয়ে এসে বলে—
আমরা কারা সেটা জানা লাগবে না।
তবে জেনে রাখো, আমরা এসেছি তোমার ছেলেদের আর তোমাকে মারতে।
এখন আর বাঁচার উপায় নেই তোমাদের।
বলেই…
তারা আবার সেই বিদগুটে হাসি হাসে।
মেহরিন দুই সন্তানকে বুকে চেপে ধরে।
আর…
ঠিক তখনই গুলি ছোঁড়ে তারা।
দুই রাজপুত্রের ছোট ছোট শরীর নিথর হয়ে যায়।যে ছোট হৃদয়দুটো ধুকধুক করত, তার শব্দ থেমে যায়…
আর মেহরিন?

তাকে গুলির পর আলাদা করে মারার দরকার ছিল না।এক মা তো সন্তানের সঙ্গেই মারা যায়।
তার চেতনা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
জীবনের ছন্দ থেমে যাচ্ছে।
মেহরিন টের পায়—
তার দেহ থেকে কেউ যেন রূহ টেনে বের করে নিচ্ছে।শরীরে আর কোনো জোর নেই।
মনে হচ্ছে—কেউ যেন তার ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে।
রূহ বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে…
মেহরিন চিৎকার করে উঠল—
আমার বাচ্চা…!

অন্ধকার ঘরে গুমিয়ে থাকা মেহরিন হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে উঠে পড়ে। রাজ, পাশেই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ওর চিৎকার শুনেই বুঝে যায়—নিশ্চয়ই খারাপ কিছু স্বপ্ন দেখেছে। রাজ তাড়াতাড়ি মেহরিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
এই বউজান, কী হয়েছে? খারাপ কিছু দেখেছো? ভয় পেয়েছো?
মেহরিন তখন পাগলের মতো একদম ছেলেমানুষের মতন বলতে থাকে,
আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চা! ওদের মেরে ফেলেছে! আমার বাচ্চা…!
বলতে বলতে ওর কান্না একদম জোয়ারের মতো এসতে থাকে।
রাজ মেহরিনকে শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলে,
কিছু হয়নি! আমাদের সন্তান ঠিক আছে! পাখি! কিছুই হয়নি! তুমি শান্ত হও… আমার জান… প্লিজ শান্ত হও, কিছুই হয়নি।

কিন্তু মেহরিন তখন নিজের মত করেই বলতে থাকে। একসময় ওর কান্নার গতি বেড়ে যায়। বুক ফেটে কান্না আসে, হাহাকার করে উঠে। ওর চিৎকার আর কান্নায় ঘুম ভেঙে যায় দুই সন্তানরই, ওরাও কান্না শুরু করে দেয়। শিশুদের কান্না কানে আসতেই মেহরিন উন্মাদিনীর মতো ছুটে যায় ওদের কাছে। একজনকে কোলে তুলে নেয়, আরেকজনকে নিতে চায়, কিন্তু পেরে ওঠে না।
রাজ তখন পাশে গিয়ে সাহায্য করে, দুজনকেই কোলে নিয়ে দেয় মেহরিনের।
মেহরিন সন্তানদের কোলে নিয়েই এলো পাথারি বাচ্চাদের গালে কপালে ও সারা মুখে চুমু খেতে থাকে, বলতে থাকে

আমার সোনা… আমার জান… আমার সাত রাজার ধন…আমার কলিজা।
রাজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, মেহরিনকে সময় দেয় নিজেকে সামলানোর। কারণ রাজ জানে—এই কষ্ট, এই ভয়, এই যন্ত্রণাগুলো প্রকাশ না করলে মেহরিনের শান্তি মিলবে না।
কিছুক্ষণ পর রাজ এক গ্লাস পানি এনে মেহরিনের সামনে ধরে বলে,
নাও, আগে এটা খাও।
মেহরিন কিছু না বলেই সেই পানি খেয়ে নেয়। রাজ অনুভব করে, মেহরিনের শরীরটা কাঁপছে। সে আবার বলে,
বাচ্চাদের আমাকে দাও, তুমি একটু বসো।
কিন্তু মেহরিন দেয় না। রাজ বুঝে—এই মুহূর্তে সে সন্তানদের ছাড়বে না। তাই রাজ নিজেই মেহরিনকে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দেয়।

ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ে। রাজ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সে জানে—সবার ঘুম ভেঙে গেছে, সবাই চলে এসেছে।
হয়ও তাই।
দরজা খুলতেই রাজ দেখে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন—
মালিহা মির্জা, রূপা বেগম, ফিরোজ মির্জা, ফাইজা চৌধুরী, আকরাম চৌধুরী, লাবিব, লামিয়া, মেহবুবা, মেহের, রিদ, চুমকি, শান্ত, আরোশ, আরফা, মাহির—সকলেই হাজির। কেউ বাদ যায়নি। এমনকি কুলসুমও।
ফিরোজ মির্জা জিজ্ঞেস করেন,
কি হয়েছে বাবা রাজ, মেহু মা এমন চিৎকার করলো কেন?
রাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
হয়তো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে বাবা। আপনারা আসুন।
রাজ দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়। সবাই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে।
আর ঘরে ঢুকেই দেখে—মেহরিন দুই সন্তানকে নিজের বুকের ভেতর জড়িয়ে রেখেছে। যেনো চাচ্ছে বাচ্চাদের নিজের শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলতে, যেনো কেউ কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
সে একটানা বলেই চলেছে,

—আমার বাচ্চা… আমার বাচ্চা…!
চুমকি এগিয়ে গিয়ে মেহরিনকে ধরে বলে,
—এই মেহু সোনা, কী হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?ভয় পেয়েছিস সোনা?
মেহরিন কিছু বলে না।
শুধু নিঃশব্দে, ব্যথা আর ভয়কে বুকে চেপে, নিজের সন্তানদের আঁকড়ে রাখে…
নিজের জীবনটাকে আঁকড়ে ধরে, যেনো তাতে মৃত্যুর ছায়া না পড়ে।
সবাই বেশ অস্থির হয়ে ওঠে মেহরিনের এমন অবস্থায়। রাজ শান্তভাবে বলে ওঠে,
আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি যতদূর বুঝতে পারছি, ও একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আর সেই স্বপ্নটা সম্ভবত আমাদের বাচ্চাদের নিয়েই ছিল। তাই এমন আচরণ করছে। আমাদের উচিত, ওকে একটু সময় দেওয়া। ও নিজেই সব কিছু বলবে।

সবাই মাথা নাড়ে। চুমকি একটা গ্লাস পানি এনে মেহরিনের মুখের কাছে ধরে বলে,
এটা খা। কিছু হয়নি তুই শুধু একটা স্বপ্ন দেখেছিস। জানি না কী দেখেছিস, কিন্তু আমি জানি আমার মেহু ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে না। ভয়ংকর কিছু না তুই এমন করতি না।
মেহরিন চুমকির চোখে তাকায়, চোখে জমে থাকা জল ঠেলে দেয়ার আগে একটুকরো আত্মবিশ্বাস খুঁজে নেয়। চুমকি চোখের ইশারায় পানি খাওয়ার জন্য বলে, মেহরিন চুপচাপ পানিটা খেয়ে নেয়।
চুমকি তখন বলে,

একটা কথা বলি? জানি না তুই কী স্বপ্ন দেখেছিস, তবে আন্দাজ করতে পারছি—তোর সন্তানদের নিয়ে ছিল। শুন, হায়াত-মউতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। উনি ছাড়া এই পৃথিবীতে কারও এত সাহস নেই যে আমার মেহু সোনা আর ভাইয়ার বাচ্চাদের কোন ক্ষতি করতে পারে। আর যদি কেউ করতে চায়ও, তোর মনে হয় এতো মানুষ পেরিয়ে সে আসতে পারবে? তোর বাচ্চাদের দুই দুটো মা হুম। আসুক না কে আসবে একদম লংকা গুরু লাগিয়ে দিবো।
তখন মেহের এগিয়ে এসে মেহরিনের অপর পাশে বসে বলে,
হুম, ঠিক তাই। আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে কেউ কিছু করতে পারবে না।
মেহবুবা আগিয়ে এসে বলে,

আসুক না কোন কুকুরের বাচ্চা আসে, আসুক দেখি। একদম মৃত্যুর দরজায় পাঠিয়ে দেব। আমার বোন আর ভাগ্নিদের ক্ষতি করবে, আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো—হুম। ওরা এখনো আমায় ‘ছোটো মা’ বলে ডাকে নি।
লামিয়া বলে,
হুম হুম, আসুক দেখি। একদম মেরে বঁড়তা করে দেব।
আরফা বলে,
আসুক না… আসুক। যে আসবে তাকে আমি বিচুটি পাতা লাগিয়ে দিব। এমন চুলকান চুলকাবে চুলকাবে, আর কোথাও ঘষাঘষি করার জায়গা পাবে না। মুখে এমদম ঝামা ঘষে দিবো হুম।
আরফার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। মেহরিন নিজেও একটু হেসে ফেলে।
আরশ এসে আরফার মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,

— ভেরি গুড!
আরফা মাথায় হাত দিয়ে বলে,
— ভাবি!
এমন সময় লামিয়া এসে আরোশের পায়ে একটা হালকা লাথি দিয়ে বলে,
—হুম, বলো ননদিনী!
আরশ আহ করে ওঠে। আর বাকিরা হেসে ফেলে।

রাত তখন প্রায় ৩ টা।
মেহরিনের সেই দুঃস্বপ্ন দেখার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা কেটে গেছে। সবাই এখনো রাজের ঘরেই। চুমকি আর মেহের দুই রাজপুত্রকে নিয়ে বসে আছে। মেহরিন শুয়ে আছে রূপা বেগমের কোলে। তিনি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
মালিহা মির্জা আর ফাইজা চৌধুরী ওর দু পাশে বসে আছে।
এই সময় মেহরিন তার স্বপ্নের সম্পূর্ণ বর্ণনা দিয়ে দেয়।
সবাই বোঝে, এমন পাগলের মতো আচরণ কেন করেছিল সে। একজন মা জানে সন্তানের শেষ নিঃশ্বাস চোখের সামনে দেখলে কেমন লাগে—বাস্তবে হোক কিংবা স্বপ্নে, যন্ত্রণা তো একই।
হঠাৎ মেহরিন বলে ওঠে,
মামণি… যদি ওরা সত্যিই আসে?

রূপা বেগমের বুক ধক করে ওঠে। কী করে বোঝাবে মেহরিনকে? আজ যেটা মেহরিন ভয় পাচ্ছে, সেই ভয় তো রূপা বেগমের জীবনেও এসেছিল সেই কালো রাতে, প্রায় বিশ বছর আগে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না তিনি। কদিন ধরে যে তার মন টাও কু গায়ছে।
কিন্তু এখন তো মেহরিন এমনিতেই আতঙ্কে আছে, তার ওপর আর টেনশন দিতে চান না। তাই হাসিমুখে বলেন,
না মা, এমন কথা বলো না। এমন কিছু হবে না।
মেহরিন তখন বলে,
কিন্তু যদি হয়?
রূপা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকান মেহরিনের দিকে।
তার চোখে ধরা পড়ে—মেহরিন কিছু বলতে চায়। সেটা শুধু রূপা বেগম নয়, মেহের আর রাজও বুঝে যায়।
রাজ আর মেহের একসাথে বলে ওঠে,

—প্ল্যান কি?
এক কথায় সবাই হাসে।
মেহরিন উঠে বসে। বলে,
প্ল্যান একটা আছে। আমার মন বলছে, কাল কিছু একটা হবেই।
রাজ বলে,
ওটা তুমি চিন্তা করো না। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি পাহারার..
মেহরিন রাজকে থামিয়ে বলে,
—আগে শুনুন।
রাজ মাথা নাড়ে।

আর শুধু রাজ না, সবাই আগায়। বোঝে, মেহরিন এবার তার প্ল্যান জানাবে।
মেহরিন নিজের প্ল্যানটা বলে। শুনে সবাই হেসে ওঠে।
লাবিব হাততালি দিয়ে বলে,
উফফ, কি প্ল্যান! একেবারে দারুণ! এমন প্ল্যান তো ভাইয়াও দিতে পারত না!
রাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
লাবিব আমতা আমতা করে বলে,
না মানে…
রাজ থামিয়ে দিয়ে বলে,
হাতি কাদায় পড়লে চামচিকিও লাথি মারে—সমস্যা নাই! যা করলা, জীবনে উপরে গেলে দিবে নে।
লাবিব মুখ ফুঁসে বলে ফেলে,

—সেম টু ইউ।
বলে নিজেই মুখ চেপে ধরে।
সবাই হেসে ওঠে।
রাজ মেহবুবার দিকে তাকিয়ে বলে,
—তোমাকে যা বলেছিলাম, মনে আছে তো? জায়গামতো দেবে।
মেহবুবা হাসে, মাথা নাড়ে।
লাবিব অসহায়ের মতো একবার মেহবুবার দিকে, আরেকবার রাজের দিকে তাকায়।
এমন সময় রিদ আর শান্ত এসে,
লাবিবের কাঁধে হাত রাখে তারা।
লাবিব দুঃখী মুখে বলে,

— সবই কপাল, বুঝলে!
সবাই আবার হেসে ওঠে।
কিন্তু হঠাৎ আকরাম চৌধুরী বলেন,
মেহু মা , প্ল্যান ঠিক আছে, কিন্তু যদি না হয়?
মেহরিন কিছু বলতে যাবে, তখনই রিদ এক ধরনের বিদ্রপি হাসি দিয়ে বলে,
চিন্তা করবেন না,ফুপা। আমি যতদূর ওদের চিনেছি, তারা ঠিক মেহুর প্ল্যানমাফিকই কাজ করবে।
মেহের বলে,
তাহলে একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।
মেহরিন হাসে।
রাজ বলে,

বাচ্চাদের কথা বলতে চাও, তাই না?
মেহের হাসে,
উফফ ভাইয়া, আপনি এত ইন্টেলিজেন্ট কেন বলুন তো!
রাজ হাসে।
মেহরিন বলে,
ওটা সমস্যা না। সেই দায়িত্ব পালন করবে—চুমকি মা, ফুপি আর আরফা।
সবাই মেহরিনের দিকে তাকায়।
মেহরিন সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
পারবে না?
সবাই একসাথে বলে,

—অবশ্যই!
চুমকি কোলের বাচ্চাটাকে একটা চুমু খেয়ে বলে,
বেসস পারবো, পারবো না কেন?
আরফা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
—আমিও পারবো!
মালিহা মির্জা মেহরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
পারবো মা, আমাদের যে পারতেই হবে।
ফাইজা চৌধুরী মেহরিনের চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলেন,
—পারবো আম্মাজান।
মেহরিন হাসে।
রাজ বলে,

আপনাদের চারজনের নেতা হচ্ছে মাহির।
মাহির এক লাফে সামনে আসে,
হেহে, বলো, কী করতে হবে আমাকে?
সবাই হেসে ফেলে।
মাহিরের কাঁধে রাজ হাত রেখে বলে,
চার নারীকে রক্ষা করতে হবে।সাথে দুই ভাগ্নে কে।
মাহির ভাব নিয়ে বলে,
—এটা কোনো ব্যাপার?
রাজ বলে,

যদি কাজটা ঠিক মতো করতে পারো, তো পাশের বাড়ির কাজের খালার একটা মেয়ে আছে—নাম ছকিনা। দেখতে ভালোই, শুধু গায়ের রংটা একটু কালো একদম তোমার বনের কাজলের মতো। চোখগুলো খুব সুন্দর, তবে একটু টেরা। ঠোঁটগুলো গোলাপি, তবে একটু মোটা। পুরো বুব্বাই মরিচের মতো। তার সাথে তোমার সেটিং করিয়ে দিবো।
রাজের কথা শেষ হতে না হতেই
মাহির বুক ধরে উঠে বলে,
— নাআআআআ!!
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।

সকাল ৭ টা।
শিকদার বাড়ির বাগানে মানুষজন ভিড় করে জমায়েত হয়েছে। কারণ, সেখানে লাইন ধরে বাঁধা আছে সাতটি গরু—প্রতিটাই মোটা, তাজা, সুস্থ। কোরবানির ঈদের সকালে যেভাবে হুজুর গরু জবাই করে, রাজেরও ইচ্ছে ঠিক তেমন ভাবেই এই গরু গুলো জবাই হবে। গরুগুলোকে একে একে ধুব্বা ঘাসের ওপর ফেলে ধরা হচ্ছে, জবাই চলছে। রাজ, লাবিব, রিদ, আরশ, শান্ত, রাকিব ও আরও কয়েকজন মিলে।
সবাই নিচে দাঁড়িয়ে দেখছে। তবে মেহরিন বারান্দা থেকে দেখছে। পাশে চুমকি আর কুলসুম। মেহরিন একনজরে তাকিয়ে আছে রক্তের দিকে—জবাই করার পর যখন গরুর গলা দিয়ে কোল কোল করে রক্ত বের হয়। মেহরিন ভাবে, গরুকে জবাই করলে গরু ব্যথা পায় না, এটা হাদিসে বলা আছে, আবার বিজ্ঞানীরাও এর যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন।
মেহরিন বাঁকা হেসে বলে,
গরুর কষ্ট না হলেও, তোদের হবে।
চুমকি বলে,
—কার কষ্ট হবে?
মেহরিন হাসিমুখেই বলে,
— বুঝলি তো জানু?
অনেক শকুন পাশে ঘুরঘুর করছে। চুমকি নিচে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখে বলে,
হ্যাঁ, রক্ত দেখেছে তাই হয়তো।
মেহরিন হেসে ঘরের ভিতরে চলে যায়।

সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। এখন বিকেল চারটা। শিকদার বাড়ির বাগানে বিশাল প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে। সেখানেই চলছে খাওয়াদাওয়া। দুপুর একটা থেকে খাওয়া শুরু হয়েছে, এখনো চলছে। রাজ পুরো এলাকাকে দাওয়াত করেছে, গরীব দুঃখীরাও এসেছে। শিকদার বাড়ি থেকে আজ খাবার গেছে পাঁচটা এতিমখানায়।
সবাই খাচ্ছে, আর দুহাত তুলে দোয়া করছে। কত বৃদ্ধ মানুষ রাজের মাথায় হাত দিয়ে বলছে,
আল্লাহ তোমার ভালো করুক।
রাজের মনে তখন অদ্ভুত এক শান্তি কাজ করে। সে যখন এমন অসহায়, দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করতে পারে, তখন যেনো নিজের অতীত মনে পড়ে। শুধু রাজ না, লাবিবও এমন করে। রাস্তার অসহায় মানুষ দেখলেই খাবার কিনে দেয়, সাহায্য করে। এটা যেনো এই দুই ভাইয়ের একটি মহৎ গুণ, যা সাধারণত সবার থাকে না।
রাজ দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সাব্বিরের সঙ্গে। এমন সময় একটি বৃদ্ধা মহিলা লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। বয়স অনেক, আশি পেরিয়েছে হয়তো। শরীর কেঁপে কেঁপে হাঁটে। রাজের সামনে এসে দাঁড়ায়।
রাজ সুন্দর করে হেসে বলে,

কিছু বলবেন দাদিমা?
বৃদ্ধা ইশারায় রাজকে নিচু হতে বলেন। রাজ নিচু হয়। বৃদ্ধা রাজের মাথায় হাত রেখে বলে,
— তকে অনেক ধন্যবাদ বাছা।
রাজ ইশারা করে একজনকে চেয়ার আনতে বলে। রাজ নিজে ধরে বৃদ্ধাকে চেয়ারে বসিয়ে দেয়, নিজে বসে পড়ে তার পায়ের কাছে।
আপনি কিছু বলবেন আমাকে, দাদিমা?
বৃদ্ধা চোখে জল নিয়ে তাকায় রাজের দিকে, কাপা কাপা হাতে রাজের মাথায় হাত রেখে বলে,
আমাকে একটু খাবার দিবি, বাছা?

রাজ ভাবে, হয়তো খাবার মজা লেগেছে, তাই আরেকবার চাইছে। হেসে বলে,
আচ্ছা, আমি কাউকে বলছি, আপনাকে দিয়ে দেবে।
বৃদ্ধার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তেই সেই হাসি মিলিয়ে যায়। মাথা নিচু করে বলেন,
আমি কারো অনুমতি ছাড়া এখানে এসেছি, বাছা। এখানকার কেউ আমায় দাওয়াত দেয়নি। শুধু দেখলাম সবাই আসছে, আর খাবারের গন্ধ আমায় টেনেই আনলো।
রাজ হাসে, বলে,

সমস্যা নেই দাদিমা। আল্লাহর রহমতে খাবার কম পড়বে না। আমি তো খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন।
আচ্ছা আপনার সঙ্গে কেউ এসেছে, না আপনি একাই এসেছেন? যদি একা এসে থাকেন, আপনার বাড়ি কোথায় বলুন, আমার লোক গিয়ে দিয়ে আসবে।
বৃদ্ধা কেঁদে ফেলেন।
রাজ অবাক হয়ে বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
কী হয়েছে দাদিমা? আপনি কাঁদছেন কেন?
বৃদ্ধা এবার রাজকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেন। রাজ কিছু বুঝতে পারে না।
বলুন না দাদিমা, না বললে বুঝব কীভাবে?
বৃদ্ধা বলে,

আমার কেউ নেই বাছা। আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। যখন যেখান পাই, শুয়ে পড়ি। কোনদিন খেতে পাই, কোনদিন খাই না। জানিস, আজ আমি প্রায় পাঁচদিন পর খাবার খেলাম।
রাজের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। মনে পড়ে যায় নিজের অতীতের কিছু স্মৃতি।
আপনার কোনো ছেলে-মেয়ে নেই?
বৃদ্ধার কান্নার গতি এবার কিছুটা বাড়ে।
রাজ চুপ থাকে, শোক সামলাতে সময় দেয়। বৃদ্ধা নিজেই বলে ওঠেন,

ছিল বাছা, এক ছেলে।সে বড় বাড়িতে থাকে। কিন্তু আমাকে বের করে দিয়েছে। কারণ, তার বউ চায় না আমি ওদের বাড়িতে থাকি। অথচ, স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি কাজ করে ছেলেকে বড় করেছি, পড়িয়েছি। কিন্তু যখন আমার ওকে দরকার হলো, তখন সে আর রাখলো না। আমি চাইলেি পারতাম নওজের জীবন গুছিয়ে নিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একা কাটালাম সারাজীবন। কিন্তু যার জন্য এত কিছু করলাম সে বিনিময়ে কি দিলো আমাকে।
রাজের চোখ-মুখ মুহূর্তেই কঠিন হয়ে ওঠে।
আপনার ছেলের নাম কী? বাড়ি কোথায়? বলুন, আমি ব্যবস্থা করব।
বৃদ্ধা না মাথা নাড়ে, জানায় পারবে না।
এই সময় সেখানে আসে মেহরিন, মেহের, চুমকি, মেহবুবা, লামিয়া, আরফা। বাচ্চারা, রূপা বেগম, আর মালিহা মির্জা কাছে। রাজকে বসে থাকতে দেখে ওর দিকে এগিয়ে আসে। এতক্ষণে রিদ, শান্ত, রাকিব, আরশ লাবিব—সবাই এসে রাজের পাশে দাঁড়িয়েছে।
মেহরিন কাছে যেতেই রাজ তাকায় তার দিকে। বৃদ্ধাও তাকায়।

বৃদ্ধা রাজকে বলে,
ওটা বুঝি তোর বউ?
রাজ হাসে, মাথা নাড়ে।
মেহরিন হাসিমুখে বলে,
কেমন আছেন, দাদিমা?
বৃদ্ধা চোখের পানি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। যেনো কিছু বলতে চায়। একসময় বলে ওঠে,
—সুখী হও বাছা। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকো। কারো কোন কু-দৃষ্টি যেন না পড়ে।
সবাই হাসে বৃদ্ধার কথা শুনে।
রাজ বৃদ্ধার হাতে নিজের হাত রেখে বলে,
আমি নাতি হিসেবে একটা আবদার করবো, আপনার কাছে আপনি রাখবেন?
বৃদ্ধা অবাক হয়। রাজের মতো এত বড়লোক মানুষ তার কাছে কী আবদার করবে? তবুও সে মাথা নাড়ে।
রাজ হাসে, বলে,

আজ থেকে আপনি আমাদের বাড়িতে, আমাদের সঙ্গে থাকবেন। রাখবেন তো আমার এই আবদারটা?
বৃদ্ধা আবার কেঁদে ফেলেন।
মেহরিন রাজের কথায় হাসে। সেও বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসে, বলে,
থেকে যান দাদিমা।
বৃদ্ধা বলে,
আমি থাকতে চাইলে কি তোমরা আমায় সত্যি থাকার জায়গা দেবে?
সবাই একসাথে হেসে ওঠে।
রাজ হাসতেই বলে,
দিবো না কেন? আমার একটা নানিমা আছেন, তবে দাদিমা নাই, আমি তাঁকে কখনো দেখিওনি। আপনি না হয় আজ থেকে আমার দাদিমা।
বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা হাতে হাত তুলেই দেয়—একটি রাজের মাথায়, আর একটি মেহরিনের মাথায়।

সন্ধ্যা ৭টা।
শিকদার বাড়ির বসার ঘরে সবাই বসে আছে। —সবার মুখে হাসির ছাপ। কথা হচ্ছে আজকের বিশেষ একটি বিষয়ে—রাজ-মেহরিনের দুই ছেলের নামকরণ।
হুজুর এসে আগেই নাম রেখে গেছেন। একজনের নাম মেহরাজ শিকদার মাহিন।আরেকজনের নাম মায়রান শিকদার মাহিম।
দুজনের নাম রাখা হয়েছে বাবা-মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো—এই দুই ভাই দেখতে এতটাই এক রকম, যে সবাই গুলিয়ে ফেলছে। কে মেহরাজ, কে মায়রান—বোঝা দায়! তবে মেহরিন, মেহের, চুমকি আর রাজ চিনতে পারে কে কোনটা।
তাই নিয়ে হাসি, ঠাট্টা আর মজার রোল উঠেছে।
মেহবুবা হাসতে হাসতে বলে,

আমি একবার গিয়ে মেহরাজকে আদর করতে চাইলাম, পরে দেখি সে মায়রান!
মেহের চোখ টিপে বলে,
আসলে ওরা তো যমজ, তাও আবার রাজ-মেহরিনের মতো একেকটা রূপের আগুন!কারো থেকে না কম না বেশি একটু ঝামেলা তো হবেই।দুই আগুনে যে ওরা পুরে যায়নি এটাই ওনেক।
আরশ হেসে বলে,
আমার তো এখন মেহুকেও ভুল লাগছে! ওই দুজনের মায়ের সঙ্গে এত মিল—যেনো তিনজনই যমজ!
সবার মধ্যে হাসির ঢেউ ওঠে।
শুধু মেহরিন, চুমকি আর মেহের ও রাজ ওদের চিনতে পারে। বাকি সবার কাজ শুধু আন্দাজ করা আর হাসাহাসি।
লামিয়া বলে,
ওদের গলায় নামের হার পরাও—না হলে ভুলেই যাবে কে কোনটা!
রাহি বলে,
না, আমি ওদের চোখ দেখে বুঝে ফেলতে পারি!
আরফা বলে,
তুই বুঝিস? ধুর! আমি তো মেহরাজকে মায়রান বলে ডাকছিলাম!
হাসির ফোয়ারা আর শেষ হয় না। ছোট্ট দুই রাজপুত্র যেন সবার চোখের মণি হয়ে উঠেছে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৪

রাত ১টা।
শিকদার বাড়ির চারদিকে নিস্তব্ধতা। হাওয়া বইছে ধীরে, আশপাশটা নিঃশব্দ। পুরো বাড়িটা ঘুমে বিভোর আলো নিভানো।
এই নিস্তব্ধতাকে চিরে হঠাৎ ছায়ার মতো ঢুকে পড়ে দু’জন মুখোশ পরা লোক।
ধীরে, নিঃশব্দে…
তাদের পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যায় বড় গেট পেরিয়ে বারান্দা… তারপর ঘরের ভেতরে…
তারা ঢুকতেই আচমকা…

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৬