প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ২৬ (২)
Zannat Xhowdury
ঘরের ভেতর থমথমে নীরবতা। ঘুমন্ত রোজা নিঃশ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে। গুলি লাগা হাতে ব্যান্ডেজ জড়ানো—রক্ত শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে। স্যালাইনের ফোঁটা ফোঁটা শব্দ যেন সময়কে থামিয়ে রেখেছে।
তার পাশেই বসে আছে নির্ণয়। চোখজোড়া কুয়াশার মতো মায়া ঢাকা। চুলগুলো এলোমেলো, মুখে জেগে আছে কয়েক রাতের না ঘুমানোর ছাপ।
ঘরের বাতাস ভারী। একটানা স্যালাইনের টিকটিক শব্দ। নির্ণয় মাথা নিচু করে বসে আছে। হাতের আঙুল ধরা, কিন্তু মুখে কোন কথা নেই।
প্রায় শেষ প্রহরের আর কিছু বাকি , কিছুক্ষণ পরেই ভোর হলো বলে
হঠাৎ… রোজার বাঁ হাতটা একটু কেঁপে ওঠে। একটা অদ্ভুত স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে ঘরের ভেতর।
নির্ণয় চমকে তাকায়। রোজার চোখ এখনও বন্ধ। কিন্তু ঠোঁটটা একটু নড়ে।
তারপর… কোনো আওয়াজ না, শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
একটা ফিসফিসে স্বর ভেসে আসে ঘরের ভেতরেই কোথাও ”
ওদের বাঁচাতে হবে নির্ণয় ভাই ,
নির্ণয় দাঁড়িয়ে যায়, কিছুটা শব্দ করে সরে যায় পেছনে। কিন্তু রোজার চোখ এখনও বন্ধ। ঠোঁট নিস্পন্দ। সে কি বলেছিল?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বেশ কিছু সময় পেরিয়ে ,
রোজার চোখদুটো ধীরে ধীরে খুলে আসে। ঘরের আলো ঝাপসা, মাথা ভারী, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। প্রথমে কিছুই স্পষ্ট নয়… তারপর একটুখানি ফোকাসে আসে চারপাশ। একটা জানালার পাশে পর্দা হেলে পড়েছে, স্যালাইনের নল বেয়ে ফোঁটা পড়ছে এখনো।
সে নড়ার চেষ্টা করে, ব্যান্ডেজে মোড়া হাতে টান লাগে, মুখ কুঁচকে যায় ব্যথায়।
ঠিক তখন দরজাটা খুলে ভেতরে ঢোকে নির্ণয়— খাবার হাতে , চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে চাপা শান্তি।
রোজার জেগে থাকা দেখে থেমে যায় সে। তারপর একটু হাসে। ”
ঘুম ভাঙ্গলো তবে ”
রোজা আস্তে মাথা নাড়ে। কণ্ঠ ফাঁকা, একরকম ফিসফিসে।
আমি ঘুমাই নি, ঘুম পাড়ানো হয়েছিল
খাবার এনেছি, খেয়ে ঔষধ খেতেই হবে।”
নির্ণয় ধীরে ধীরে পাশে বসে, সুপের বাটি থেকে এক চামচ নিয়েই সামনে ধরে রোজার , খাবারের দিকে তাকিয়েই নাক কুঁচকে নেয় সে ।
হোয়াট’স ইয়োর প্রবলেম রোজ , নাক ছিটকাচ্ছিস কেন ?
ওয়াক ,
হোয়াট ,
I won’t eat this.
খেতে হবে ! সাথে মেডিসিন ও নিতে হবে
Not Interested
কি খাবি বল অর্ডার দিচ্ছি তবুও আমি না শুনছি না !
গরম ভাতে ঘি সাথে ঝাল ঝাল আলুর ভর্তা ! তবে ,
কপাল কুঁচকে তাকায় নির্ণয় , এক ভ্রু উচিয়ে বলে …
তবে কি ?
তবে , যদি আপনি রেঁধে খাওয়ান তবে মুখে তুলবো …
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ণয় , এই মেয়ে তাকা নাকানি চুবানি খাওয়াতে চায় তা আর বুঝাতে বাকি নেই তার
ওয়েট কর আনছি ,
বিছানা ছেড়ে উঠতে নিবে ঠিক এমন মূহুর্তেই নির্ণয়ের হাত ধরেই আটকে দেয় রোজা, ঠোট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো ভঙ্গিতে বলে
আমার ফোন টা দিন তো নির্ণয় ভাই ..!
কি দরকার আমাকে বল ।
দেন না ফোনটা ..!
নেই ! তোকে আনতে সময় জঙ্গলের হারিয়ে ফেলেছি ।
মুখে অন্ধকার নেমে আসে রোজার।তার এতো পছন্দের ফোন হারিয়ে গেছে ..
তাহলে আর কি ? আপনার টাই দিন বসে বসে গোপাল ভাঁড় দেখি .!
পকেট থেকে ফোন বের করে হাতে দেয় নির্ণয় , রোজা দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে , রুম থেকে বেড়িয়ে যায় সে !
ফোন হাতে পেয়েই , প্রেমের নাম্বারে ডায়েল করে রোজা , একবার , দুবার ,ঠিক তিনবারের মাথায় রিসিব হয় কল,
হ্যালো কে বলছেন
রোজা !
আরে মেহরিন কোথায় তুমি ? তুমি ঠিক আছো রাতে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে !
নিশ্চুপ রোজা কন্ঠে নেই সেই পুরনো তেজ , এই প্রথম তার হাতে আসা কোন অপারেশন মিস করছে ,
আসলে স্যার !
ওসব বাদ দেও আগে বলো ঠিক , ঠিক আছো ! তুমি তো ফ্ল্যাটে নেই , তাহলে কোথায় এখন
প্রেমের কন্ঠে অস্থিরতা ! এত সময় একটু কলের অপেক্ষা করছে সে
নো স্যার আমার ইনজুরি হয়েছে !
হোয়াট ! কোথায় আছো এখন , ডাক্তার দেখিয়েছো , ঠিকানা বলো এখনি আসছি আমি !
রিলেক্স! এখন ঠিক আছি !
নো , ঠিকানা দেও এখনি আসছি আমি !
প্রয়োজন নেই !
ওকে তুমি যখন চাইছো না তবে ,,
কি ?
কনগ্রাচুলেট , আজ তোমার জন্য আমরা শিশু পাচারে মুল মাথা ধরতে পেরেছি , সরকারের পক্ষে থেকে তোমাকে স্পেশাল পুরষ্কার দেওয়া হবে, সাথে প্রমোশন ।
মূল মাথা মানে ,
কেন তুমি তো ইমাম কে চেয়ারের সাথে বেধে রেখেছিলে তোমার মেসেজ পেয়ে তো আমরা টিকরুলে পৌঁছে ইমাম কে রেসকিউ করি তবে। তুমি সেখানে ছিলে না ..!
আমি !
হ্যাঁ তুমি,
ইমাম আসল মাথা নয় স্যার ও
ওনাকে কেউ নির্দেশ দেয় আর সে কাজ করে , তবে
দরজায় পায়ের শব্দ দ্রুত ফোন রেখে দেয় রোজা চোখে পলকে ডিলেট করে নাম্বার !
এক প্লেট ভাত হাতে দরজা দিয়ে ঢুকে নির্ণয়, এগিয়ে এসে আবারো বসে রোজার পাশে
ঘরের মধ্যে একটা হালকা ভাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
সে হাত বাড়ায় রোজার দিকে— “খাবি তো?”
রোজা কিছু বলে না। কেবল তাকিয়ে থাকে তার দিকে, অবাক সে চাহনি ….
কি হলো হাঁ কর!
কোনো তর্ক ছাড়াই , নির্ণয়ের হাতে খেতে লাগে রোজা , এই গরম ভাত সাথে ঘি । পৃথিবীর সব মজার খাবার কেও যেন হার মানিয়ে ছাড়ে …
খাওয়া শেষে করে এক গাদা মেডিসিন নিতে হয় রোজাকে , আজো সেই ভয় , গলায় আটকে যাবার ভয়, আজ আর কোনো কথা শুনেনি নির্ণয় জোর করেই খাইয়েছে সব ,
ভোরের আলো ধরণীতে আসছে। জানালার ফাঁক গলে একচিলতে হলদে আলো বিছানার সাদা চাদরে এসে পড়ছে। আলোটা কেমন নিঃশব্দ, ঠান্ডা… যেন কোনো মৃত আলো। চারপাশে একটা চাপা অস্থিরতা, পাখিরা ডেকেও থেমে যাচ্ছে হঠাৎ, যেন তারাও কিছু টের পায়।
মেডিসিন খেয়ে আর ঘুমোই নি রোজা ,কাঁধে সাদা চাদর জড়িয়ে একপাশে তাকিয়ে থাকে। চোখে ঘুমের ভাব নয়, বরং একটা দীর্ঘ বোঝা— যেন গতকাল থেকে অনেক কিছু কেবল মনের মধ্যে আটকে আছে।
নির্ণয় চুপচাপ জানালার পর্দা তুলে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে হালকা কুয়াশা, বাতাসে শীতের আগমনী খবর , আর দূরে বাঁশঝাড়ের মাথায় ধোঁয়া ধোঁয়া রোদ পড়ছে।
পাপ্পু কে এনে দিবেন নির্ণয় ভাই ..!
নিশ্চুপ নির্ণয় ! দৃষ্টি তার বাহিরের পানে , ঘোলাটে চোখে হারানো শখ । প্রিয় মানুষ হারানো শোক
ধীর পায়ে বেড ছেড়ে উঠে যায় রোজা , এক এক করে এগিয়ে যায় নির্ণয়ের , পিছন হতে এক হাতে জড়িয়ে নেয় নির্ণয়ের সুঠাম শরীল
রোজা ছোঁয়া পেতেই চোখ বুজে নেয় নির্ণয় প্রশান্তি ঢেউ খেলে যায় তার হৃদ মাঝারে , বুকের মাঝে জলন্ত আগ্নেয়গিরি মূহুর্তে শীতল হয়ে ওঠে
এনে দিবেন নির্ণয় ভাই !
হুঁ ম ।
রোজ !
জ্বী
তোর কাছে যদি কিছু চাই তবে তুই কি আমাকে ফেরারি ?
বুকের মাঝেই ধুক করে ওঠে রোজার , নির্ণয় দাঁড়িয়ে যায় ঠিক রোজার মুখ বরাবর ?
কি হলো বল দিবি ?
কি চাই আপনার!
ভীত পানসে মুখে উত্তর করে সে , মূহুর্তে হো হো করে পুরো রুম কাঁপিয়ে হেসে ওঠে নির্ণয় ।
রোজা কিছুটা ভরকে যায় ; কি হয়েছে বুঝতে না পেরেই চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রয় সে
আই নিড ফা*ক ইউ বেইবি !
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে নেয় রোজা! মাথায় ঘুরতে থাকা চিন্তা দে ঘুম পাড়িয়ে ঠোট বাঁকিয়ে হাসে।
বিলিভ মি বেইবি , এইবার হাড্ডি ভাঙ্গবেই তোর !
ওরে হারবাল নিয়েছেন বুঝি ?
নারে , হারবাল নয় হরলিক্স খেয়েছি ।
ওহ রিয়েলি !
এসো মনা তোমার যৌবনের পানি টুকু খেয়ে দেই ।
এগিয়ে আসে নির্ণয়। খোপ করে চুলের গোছা চেপে ধরে রোজার,চোখে চোখ রাখে , ঠোটে আজ অদ্ভুত রকমের এক অচেনা হাসি , মুখ ডুবিয়ে দেয় রোজার গলায় , ছোট একটা কামড় দিতেই চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় রোজা ।
মুখ উঠিয়ে রোজার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে নির্ণয় মুসটি হাসে , এবার নাক ঘসতে থাকে গলায়
“তুই তো জানিস, আমি কেমনে খাই… ধীরে, আদরে, কিন্তু শেষ করে দিই পুরোটা।”
রোজা ঠোঁট কামড়ে হাসে। “আপনার মুখের কথা দিন দিন বাজে হচ্ছে । লজ্জা শরম পানির সাথে গুলে খেয়েছেন বুঝি !
খেতে আর দিলি কই ?
আবার .!
নির্ণয় হেঁসে উঠে বলে, “আমি মুখে খাই না, চোখ দিয়ে, হাত দিয়ে, দাঁত দিয়ে খাই।”
আচমকাই বিছানায় ধপ করে ফেলে দেয় রোজাকে।
“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাক… আমি তোর প্রতিটা শ্বাস গুনব।”
নির্ণয় ওর গলা থেকে ঠোঁট বুলিয়ে নামতে থাকে… ধীরে, নিচে, আরো নিচে। রোজা নিশ্বাস আটকে ফেলে।ধরা গলায় ফিসফিস করে সে
“এটা… এটা ঠিক না…”
“ঠিক আর বেঠিকের বাইরে এই সময় । এখানে শুধু আমি আর তুই। এই সময়, এই বিছানা, আর এক চোট ক্ষুধা…”
থমকে যায় নির্ণয় , আবারো ঘ্রাণ নেয় রোজার শরীরে নেশা কন্ঠে বলে ,
তুই ফুল না কাঁটা…
যদিও আমি সইচ্ছেতেই আজ রক্ত দিতে রাজি ।
ঘন হয়ে আসছে রোজা নিঃশ্বাস নির্ণয়ের এলোমেলো ছোঁয়া যেন পাগল করে তুলছে তাকে ?
আজ থাক নির্ণয় ভাই !
হুঁসস …!
রোজার ঠোঁটে আঙুল রাখে নির্ণয় গলা থেকে মুখ তুলে এগিয়ে আসে ঠোটে কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে
আজ আমি ভালোবাসাতে চাই না”
আজ আমি তোর সবটুকু দখল করে নিতে চাই ,রোজ !
আজ তুই শুধু আমার হয়ে উঠবি, নিঃশব্দ , নিরাবরণ ।
আপনি একটু দূরে জান প্লিজ ;
বুক কাঁপছে রোজার , এই নির্ণয় আজ বেসামাল , আজ ভালোবাসা কম দখলের নেশা চড়ে আছে মনে ,
দূরে যাবো , কিন্তু তার আগে
তোর এই কম্পন , তোর নিঃশ্বাস
তোর এই হঠাৎ ভয়টা
এসব নেওয়া দরকার , জান ।
আজ আমি তোকে গিলে ফেলতে চাই ..!!
বিছানা ,বাতাস,চাদর ,আর কেবল নিঃশ্বাসে বাজতে থাকা কিছু অনুচ্চারিত কথা ….
ওদের শ্বাস আর ঘামের গন্ধে ঘরটা ভরে যায়। রোজার ঠোঁট ফেটে যায় কাঁপতে কাঁপতে, নির্ণয়ের নখ ওর পিঠে আঁচড় কাটে। রোজা চিৎকার করে না—ও নিঃশব্দে গলে যায়।
রোজার গলা শুকিয়ে গেছে , । ঠোঁট ফাঁক করে কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দ বেরোয় না। চোখ ভিজে আসে। একটুকরো আলো জানালার ফাঁক দিয়ে মুখে পড়েনির্ণয়ের চোখে ছায়া, আর সেই ছায়ার মধ্যে ভালোবাসার নামে লুকিয়ে থাকা এক ধ্বংস।রোজা কাঁপা গলায় বলে— ”
আপনি আমাকে…আজ এমন করে কেন চাচ্ছেন?”
নির্ণয়ের ঠোঁট একটুও নড়ে না, কেবল আঙুল রাখে রোজার কাঁধে, ধীরে ধীরে গলায় টেনে তোলে ,আর বলে—
“কারণ তুই আর আমি,
আমরা প্রেম করিনি, আমরা ছুঁয়েছি।
ভেতর দিয়ে, গলার নিচে, বুকের ভিতরে…
আর এখন আমি তোর সবটা চাই।
একটুও না কমিয়ে।”
রোজা চোখ বন্ধ করে ফেলে। একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। নির্ণয় সেই অশ্রু ঠোঁটে তুলে নেয়।রোজা ফিসফিস করে— ”
আমি… আর পেরে উঠছি না…”
প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ২৬
নির্ণয় ঠিক বুকের নরম জায়গায় মুখ রাখে। তার কণ্ঠে এবার আর আগুন নেই— একটা নরম বিষ, যা শরীর গলিয়ে ফেলে।
“তাহলে ভেঙে পড়,
আজ তোর উপর দাঁড়িয়ে থাকবে আমার সমস্ত দুঃস্বপ্ন, আর তুই— আমার স্বপ্ন হয়ে যাবি।”