অন্তঃদহন পর্ব ১৭
DRM Shohag
আকাশ হসপিটাল থেকে আসার সময় এক কেজি শিং মাছ কিনে এনেছে। বাসায় এসে কাজের খালা কে মাছগুলো কেটে সবকিছু রেডি করতে বলে দোতলায় তার রুমে আসে। সময় ন’ষ্ট না করে শাওয়ার নেয়। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে আসে। তার মা বাইরের কারোর হাতের রান্না খায় না। আকাশ নিজেই রান্না করবে। পাকা হাত নয়, তবে যা পারে খাওয়া যায়।
আসমানী নওয়ান এর শরীর ভালো যায় না ইদানিং। দু’দিন পর পর তাকে হসপিটাল নিয়ে ছুটতে হয়। আকাশ চুলায় প্যান বসিয়ে একে একে রান্নার সব উপকরণ দিতে থাকলো প্যানে।
পিছন থেকে আকাশের বাবা সাইফুদ্দীন নওয়ান বলে,
– তোমার মা এখন কেমন আছে?
আকাশ ছোট করে বলে,
– ভালো।
আকাশের বাবা আবার-ও বলে,
– তুমি বিশ্রাম কর। আমি রান্না করে দিচ্ছি।
বাবার কথায় আকাশের হাত থেমে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– যার জন্য রাঁধছি, সে-ই তো খাবে না। তোমার হাতের ছোঁয়া থাকলে।
একটু থেমে শ’ক্ত গলায় বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– তাছাড়া তোমার হাতের রান্না আমার মায়ের মুখে পড়ুক, সেটা আমি চাইছি না। সবচেয়ে বড় কথা তোমাকে আমি দেখতে চাইনা, তোমার কণ্ঠ-ও শুনতে চাই না। তুমি কি দয়া করে এই বাড়ি থেকে অন্যকোথাও যাবে? নয়তো আমি আমার মা কে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবো।
সাইফুদ্দীন নওয়ান ছেলের পানে চেয়ে অস্থির কণ্ঠে বলে,
– আমি যাচ্ছি বাবা। তোমরা কোথাও যে-ও না। আমি তোমাদের সামনে তেমন আসিনা তো। আর আসবো না।
কথাগুলো বলে ভদ্রলোক ধীরে পায়ে জায়গাটি প্রস্থান করে। চোখের কোণে পানি জমেছে। নিজের চেয়ে-ও বেশি ভালোবাসেন তার স্ত্রী-সন্তানকে। অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস! আজ তারা তার মুখ-ও দর্শন করতে চায়না। বিড়বিড় করে,
– আমি কি কখনো ক্ষমা পাবো না আসমানী?
রিয়া একটি ডায়রির পাতা সমানে উল্টায়। নাহ নেই। ডায়রির অর্ধেকের কম পৃষ্ঠা ফাঁকা পড়ে আছে। কলমের কালির ছিঁটেফোঁটা নেই। রিয়া চরম হতাশ হয়। দ্রুত তার পাশে বসা সোহার দিকে তাকিয়ে বলে,
– এই গল্প অর্ধেক লিখে রেখেছিস কেন? ধ্যাত বা’ল! তারপর কি হলো রে? সন্ধ্যা সত্যি সত্যি ধ’র্ষ’ণ হয়েছিল? আর ওই মেয়েটার ভাইয়ের কি হলো? তারপর ওই ইরাবতী? সেই আকাশ? আকাশ ব্যাটা ব’জ্জা’ত। গল্পের মধ্যে থেকে চরিত্র বের করা গেলে, ওকে টেনে বের করে আমার জুতা ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত ওই আকাশ বাতাসকে জুতার বারি দিতাম। ব্য’টা ব’জ্জা’ত বউকে ডিভোর্স দিতে চায়।
রিয়ার কথা শুনে সোহা হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে রিয়ার গায়ের উপর। রিয়ার চোখের কোণে যদি-ও পানি। কিন্তু হাইপার হয়ে গিয়েছে। তার রা’গটা আগে কাজ করে। তারপর অন্যকিছু। এই গল্পে যারা ভালো রোল প্লে করেনি, তাদের ইচ্ছে মতো আগে রিয়া ধুয়ে নিয়ে, তারপর চোখের জল ফেলবে। হলো-ও তাই। এতোক্ষণ এতো কথা বলে, ভাঙা গলায় বলে,
– সন্ধ্যা, সৌম্য’র জন্য সেই খারাপ লাগছে। কি যে হলো ওদের? তুই বাকিটা বল। এখানে তো আর লেখা নেই।
বাইরে থেকে সোহার ভাই ডাকে,
– বোনু তাড়াতাড়ি আয়। বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। বৃষ্টি নামলে কিন্তু আর যাওয়া হবে না।
ভাইয়ের কণ্ঠ পেয়ে সোহা রিয়াকে পাত্তা না দিয়ে বাইরে দৌড় লাগায়। পিছু পিছু রিয়া দৌড় লাগায় আর বলে,
– এই দাঁড়া। পুরো গল্প না বলে কোথাও যেতে পারবিনা।
একটি মাটির দোতলা বাড়িতে সোহা, সোহার ভাই সাধন, রিয়া, রিয়ার মা, আর রিয়ার নানি থাকে।
সাধন টিউশন থেকে ফিরে বাড়ির আঙিনায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোহা দৌড়ে এসে তার ভাইয়ের সামনে দাঁড়ায়। সাধন চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– আরে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি বলে দৌড়ে আসবি?
সোহা হেসে তার পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে সাধনের মুখে লেপ্টানো ঘাম মুছে দিতে থাকে। পিছন থেকে রিয়ার নানি বলে,
– ওরে আমার আদিখ্যেতা রে! দু’ভাইবোনের ঢং!
সাধন হেসে বলে,
– বুড়ি তোমার ভাই-বোন নেই বলে আমার বোনুকে নিয়ে হিংসা কর কেন? হিংসা কর, কিন্তু নজর দিও না খবরদার!
রিয়ার নানি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– বয়েই গেছে আমার নজর দিতে।
বুড়ির কান্ড দেখে সোহা, রিয়া, সাধন তিনজনেই হেসে ফেলে। সাধন তার হাতের দু’টো বই রিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– এটা রেখে দিও তো রিয়া।
রিয়া বিনা বাক্যে সাধনের হাত থেকে বই দু’টো নিল। হাতের ডাইরিটির দিকে চেয়ে আবার-ও সাধনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– সাধন ভাইয়া একটা কথা জানতে চাই। বলবেন?
সাধন দু’হাত সাইকেলের সামনে রেখে রিয়ার দিকে চেয়ে বলে,
– হ্যাঁ বলো।
রিয়া বলে,
– আচ্ছা সন্ধ্যা আর সৌম্য’র গল্প কি সত্যি ঘটনা না-কি গল্প?
রিয়ার প্রশ্ন শুনে সাধন অবাক হয়ে বলে,
– তুমি কিভাবে জানলে?
রিয়ার উত্তর,
– সোহার ডায়রি পড়েছি।
সাধন তার বোনের দিকে তাকায়। সোহা চোখ নামিয়ে নেয়। সাধন ছোট করে বলে,
– সত্য ঘটনা। আড়াই বছর আগের ঘটনা।
রিয়া উত্তর পেয়ে খুশি হয়। সাথে সাথে বলে,
– সাধন ভাইয়া, তাহলে এটা বলুন, সন্ধ্যা, সৌম্য, ইরা ওরা কি বেঁচে আছে?
সাধন ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিয়ার দিকে। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার বোনের দিকে তাকালে দেখল সোহা মলিন মুখে তার দিকে চেয়ে আছে। সাধন ঢোক গিলে বলে,
– সন্ধ্যা, সৌম্য মৃত।
সোহার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। সাধন সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ায়। এরপর সাইকেলের স্ট্যান্ডে ভর করে সাইকেল দাঁড় করিয়ে রিয়ার হাত থেকে ডাইরিটি কেড়ে নিয়ে একটু এগিয়ে যায় মাটি দিয়ে ঘেরাও করা ছোট রান্নাঘরে।
এখন বিকাল। রিয়ার মা রাতের খাবার রান্না করছে। সাধন হাঁটু সমান মাটির প্রাচীরের এইপাশে দাঁড়িয়ে ডাইরিটি রিয়ার মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিলে বলে,
– কাকিমা এটা তুমি রান্নার খড়ি হিসেবে ব্যবহার কর।
সোহা দৌড়ে গিয়ে তার ভাইয়ের দু’হাত টেনে ধরে। সাধন সোহার দিকে তাকালে সোহা মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে নিষেধ করে এমনটা করতে। সাধন শুনলো না বোনের কথা। রিয়ার মাকে তাড়া দেয়। ভদ্রমহিলা সোহার দিকে তাকায় একবার। এরপর সাধনের উদ্দেশ্যে বলে,
– ওর শখের ডায়রি মনে হয়। রেখে দাও।
সাধনের কণ্ঠে রা’গ। বলে,
– কাকিমা আপনি এটা চুলায় দিন।
সোহা সাধনকে বাঁধা দিতে চায়। কিন্তু পারছে না। তবুও জোর করে। সাধনের কি হলো কে জানে। হঠাৎ বোনের গালে ঠাস করে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। এরপর সে নিজেই চুলার মাঝে ডায়রিটি ঢুকিয়ে দেয়।
সোহা গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার ভাইয়ের পানে। দু’চোখের পাতা বেয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
রিয়া, রিয়ার মা, রিয়ার নানি বিস্ময় চোখে তাকায়। সাধন সোহার গায়ে হাত তোলা তো দূর, কখনো জোরে ধমক দিতে-ও দেখেনি কেউ। আর আজ? রিয়া দৌড়ে এসে সোহার পাশে দাঁড়ায়। সাধনের উদ্দেশ্যে বিস্ময় মাখা বাণী ছুড়ে,
– সাধন ভাইয়া তুমি সোহাকে মা’র’লে?
সাধন ঢোক গিলল। সোহা মাথা নিচু করে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ডান হাতে গাল মুছে নেয়। সাধন এগিয়ে এসে দাঁড়ায় সোহার সামনে। মৃদুস্বরে ডাকে,
– বোনু?
সোহা’র চোখ থেকে আবার-ও পানি গড়িয়ে পড়ে। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। সাধন সোহার মুখ দু’হাতের মাঝে নিয়ে অপরাধীর ন্যায় বলে,
– বোনু স্যরি!
সোহা চোখ নামিয়ে রেখেছে। তাকায় না ভাইয়ের দিকে। সাধন ঢোক গিলল। কি করে ফেলল এটা? সোহার গাল থেকে হাত সরিয়ে সাধন দু’হাতে তার দু’কান ধরে বলে,
– এই দেখ কান ধরেছি। স্যরি বোনু। আমার দিকে তাকা।
সোহা তবুও না তাকালে সাধন অসহায় কণ্ঠে বলে,
– বোনু স্যরি রে! তুই বললে কান ধরে উঠবস করব। তবুও তাকা।
সোহা দ্রুত মাথা তুলে তাকায় ভাইয়ের কাছে। দু’গাল ভেজা। তবে ভাইকে কান ধরে থাকতে দেখে একটু হেসে ফেলে। সাধন দু’হাতে সোহার দু’গাল মুছে দিয়ে বলে,
– আমার সব কথা শুনবি বোনু, কেমন? এই ডায়রিটা অনেক আগে ফেলে দিতে বলেছিলাম তোকে। তুই আমার কথা কেন শুনিস না?
সোহা মলিন মুখে চেয়ে রইল তার ভাইয়ের দিকে।
সাধনের কান্ড দেখে এবার সবাই স্বাভাবিক হয়েছে। বোনের জন্য এমন সাধনকেই এই গ্রামের সবাই চেনে। এখন দু’ভাইবোনকে স্বাভাবিক হতে দেখে স্বস্তি পায় সকলে। কিন্তু সাধন এই ডায়রিটা নিয়ে এতো রিয়েক্ট কেন করল? রিয়া সবচেয়ে বেশি অবাক হয়। তবে কারণ বুঝল না।
প্রতিদিন বিকালে ১০ মিনিট হলে-ও সাধন সোহাকে নিয়ে সাইকেলে করে গ্রামের এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে আনে। সোহার আবদার, সাধন ফেলে না ভুলে-ও।
সাধন সোহার মাথার ওড়না ভালোভাবে ঠিক করে দিয়ে সোহার হাত ধরে সাইকেলের কাছে গিয়ে সাইকেলে উঠে বসে। এরপর সোহা সাইকেলে সামনে বসলে রিয়া এগিয়ে এসে বলে,
– সাধন ভাইয়া আজকে আমাকে আপনার সাইকেলের পিছনে নিবেন প্লিজ?
সাধন ভ্রু কুঁচকে বলে,
– না।
রিয়া অসহায় মুখে বলে,
– আপনাকে ধরব না। সাইকেল ধরব। সত্যি।
সাধন শক্ত কণ্ঠে বলে,
– না মানে না।
রিয়া ভোতা মুখে তাকায়। সোহা রিয়ার দিকে চেয়ে হাসে। রিয়া দাঁত কটমট করে তাকায়। এই দুই ভাইবোন একজায়গায় হলে তাকে আর কেউ চেনে না। যখন একজন থাকে না, তখন অপরজন তার কাছে মৌমাছির মতো আসে আরেকজনের খোঁজে। স্বা’র্থ’প’র ভাইবোন দু’টো।
রিয়া ধুপধাপ পা ফেলে মাটির চুলার পাশে পাতা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে। রিয়ার মা দেখল মেয়েকে। মেয়ে মুখ ফুলিয়েছে। সে নিজে-ও সাধনকে বলেছিল, রিয়াকে নিয়ে-ও একটু ঘুরে আসতে। সাধন বলেছিল,
– কাকিমা আমি তোমার মেয়েকে নিতে পারবো না। তুমি চাইলে আমি লোক ভাড়া করে দিব।
রিয়ার মা কপাল চাপড়িয়েছে। সাইকেল করে গ্রাম ঘোরার জন্য কেউ লোক ভাড়া করে?
রিয়া হঠাৎ-ই ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে,
– আমার একটা বড় ভাই আনতে পারো না? ভাল্লাগেনা।
রিয়ার মা বিরক্ত চোখে তাকায়।
রিয়া বিড়বিড় করে,
– এর মধ্যে এক শ্বাসরুদ্ধকর গল্পের অর্ধেক শুনিয়ে হাওয়া হয়ে গেল দুইভাইবোন। পু’ড়ি’য়ে দিবি, আমি পড়ার আগে দিতে পারলি না? এখন বাকি কাহিনী জানতেই হবে। জেনেই ছাড়ব দাঁড়া। আমায় তো চেনে না!
রিয়ার মা এগিয়ে এসে বলে,
– কি বিড়বিড় করছিস?
রিয়া কথার তালে বলে,
– ওই তো গল্প!
রিয়ার মা রিয়ার পিঠে থা’প্প’ড় মে’রে বলে,
– গল্প পড়তে পড়তে পা’গ’ল হবি একদিন। আর যদি শুনেছি, গল্প পড়ছিস। সেদিন থেকে তোর ভাত বন্ধ।
রিয়া মায়ের কথা পাত্তা দিল না।
সাধন সাইকেলের প্যাডেল চালায়। সোহা দু’হাতে সাইকেলের সামনে ধরে আছে। ঘুরে ঘুরে দেখছে আশেপাশে। মেঘলা আকাশ, মিটিমিটি বাতাস, খুব সুন্দর পরিবেশ। সোহা একটুখানি মাথা উঁচু করে মেঘলা আকাশপানে চাইলো। সময়ের পাল্লার সাথে সাথে সোহার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করে। একসময় গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সোহার দৃষ্টি মেঘলা আকাশে ছোটাছুটি করছে। সাধন মৃদুস্বরে ডাকে,
– বোনু?
ভাইয়ের ডাকে সোহা ডান হাতে মুখ মুছে নেয়। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকায় সাধনের দিকে। সাধন সামনে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– বোকা আর দুর্বল মানুষেরা কাঁদে। তুই তো কোনোটাই নয় বোনু।
সোহা মৃদু হাসলো। সাধন বোনের মাথায় গাল ঠেকিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে বলে,
– সৌম্য, সন্ধ্যার কথা কখনো ভাববি না। মনে রাখবি ওরা মৃত।
আকাশের রান্না শেষ। শিং মাছের ঝোল সাথে সাদা ভাত রান্না করেছে। এরপর সে নিজের হাতে সব বাটিতে ভরে বাটি দু’টো ব্যাগে ভরল। ব্যাগটি ডায়নিং টেবিলের উপর রেখে সিঁড়ি বেয়ে তার ঘরে যায়। ঘরে গিয়ে আবার-ও শাওয়ার নেয়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গায়ে আরেকটা সাদা পাঞ্জাবি সাথে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরে নেয়। বা হাতে চেইন এর হাতঘড়ি পরে নেয়।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছে। আকাশ সময় ন’ষ্ট করল না। দ্রুত খাবার এর ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
হসপিটালে পৌঁছে মায়ের কেবিনে গিয়ে দেখল আসমানী নওয়ান দরজার দিকেই চেয়ে আছে। আকাশ ভেতরে গিয়ে মায়ের পাশে বসে। আসমানী নওয়ান ছেলেকে দেখে ধীরে ধীরে উঠে বসে। আকাশ হাতের ব্যাগ রেখে মাকে বসতে সাহায্য করে। আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– তুমি খাইছ আব্বা?
আকাশ খাবার বের করতে করতে বলে,
– তুমি আগে খাও মা। আমার ক্ষুধা নেই।
আসমানী নওয়ান আকাশের থেকে হাতের বাটি নেয়। আকাশ শিং মাছ খায় না। ভদ্রমহিলা জানেন ছেলে নিজের জন্য কিছু রাঁধে-ও নি। বেডের পাশে রাখা একটি বোলে হাত ধুয়ে নিয়ে আকাশের মা বলে,
– দুপুরে-ও খাও নাই। তুমি খাইয়া আসো আব্বা। আমি খাইতাছি।
আকাশ চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– তুমি খাও মা। আমি পরে খাবো।
আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– যাও আব্বা। তুমি না খাইলে আমার মুখ দিয়া খাবার যায় না।
আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নার্সকে বলে তার মাকে দেখে রাখতে। এরপর কেবিন থেকে বাইরে বেরোনোর জন্য দরজার কাছে গেলে আসমানী নওয়ান মলিন গলায় বলে,
– জান্নাতের কোনো খোঁজ পাও নাই তাই না আব্বা?
আকাশ পিছু ফিরে মায়ের দিকে তাকায়। গত আড়াই বছর যাবৎ আসমানী নওয়ান নিয়ম করে তাকে এই প্রশ্ন করে আসছে। আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট করে বলে,
– জানিনা সে কোথায়!
কথাটি বলে আর দাঁড়ালো না। দ্রুতপায়ে জায়গাটি প্রস্থান করে। আসমানি নওয়ান মলিন মুখে চেয়ে রইল। চোখের কোণে জলকণা চিকচিক করছে।
আকাশ হসপিটালের ক্যান্টিনের পাশে ছোটোখাটো রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটি টেবিল বুক করে বসে। দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা কনুই এর উপর পর্যন্ত গোটানো। টেবিলের উপর ডান হাতের কনুই রেখে, আঙুলগুলো ভাঁজ করে গাল আর কপালে ছুঁইয়ে রেখেছে।
টেবিলের অপর পাশে চেয়ার টেনে ডক্টর রিয়াজ বসে। গলা ঝেড়ে বলে,
– কি অবস্থা? কোথায় গিয়েছিলে?
রিয়াজের কণ্ঠে আকাশ চোখ মেলে তাকায়। সোজা হয়ে বসে বলে,
– বাসায় গিয়েছিলাম।
কথাটা বলে ওয়েটারকে ডেকে সাদা ভাত আর গরুর মাংস দিতে বলে আকাশ।
রিয়াজ বলে,
– বাকি গল্প আর বললে না যে!
আকাশ বলে,
– আর কি শুনবেন? সব বলেছি তো!
– ইরা মেয়েটার খোঁজ জানো? এটা অন্তত বলো?
আকাশের দৃষ্টি আবার-ও ঝাপসা হতে শুরু করে। ঢোক গিলে বলে,
– ইরাদের খোঁজ পাইনি আর। তারা এই শহরে থাকেনা। কোথায় গিয়েছে জানিনা। বেঁচে আছে কি-না তা-ও জানিনা।
এটুকু বলে আকাশ দু’হাতের তলায় নিজের মুখ রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শোকাতুর কণ্ঠে বলে,
– কেউ নেই। ইরা নেই, সৌম্য নেই, আমার সন্ধ্যামালতী নেই। সবাই আমায় একা করে দিয়ে হারিয়ে গিয়েছে। আমি ওদের কিছু জানাতেই পারলাম না।
আকাশের কণ্ঠে অসহায়ত্ব। রিয়াজ চুপচাপ আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আকাশ নিজেকে সামলে রিয়াজের দিকে তাকায়। নিষ্প্রাণ হাসে। রিয়াজ মৃদুস্বরে বলে,
– সৌম্য আর সন্ধ্যা মেয়েটি তার মানে মা’রা গিয়েছে?
কথাটি বলতে দেরি হলেও আকাশের ঝড়ের গতিতে রিয়াজের কলার ধরতে দেরি হয়নি। র’ক্তলাল চোখে চেয়ে বলে,
– কি বললে?
রিয়াজ চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ আর তার বয়স সমান হবে। এইতো ঠাণ্ডা ছিল। হঠাৎ এমন হলো কেন? রিয়াজ আমতা আমতা করে বলল,
– মানে আমি জানতে চাইছিলাম আর কি! ওরা বেঁচে আছে কি-না!
আকাশ সোজা হয়ে বসল। ঠাণ্ডা হয়েছে বোধয়। রিয়াজ শার্ট তুলে বুকে দু’বার থুতু দিল। কি রে বাবা! এ ছেলে মেয়েটির শোকে পা’গ’ল হয়নি তো! পকেট থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘাম মুছল। এরপর আকাশের দিকে তাকায়।
আকাশ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। দু’হাত আড়াআড়িভাবে রেখে চোখ বুজল। সামনে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, সাথে গরুরু মাংস। আকাশ সেদিকে তাকালো না। অতঃপর ভারী গলায় বলে,
অন্তঃদহন পর্ব ১৬
– স্যরি!
রিয়াজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– ইট’স ওকে।