প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ৩৩
Zannat Xhowdury
সকালের সেই মিষ্টি রোদ যেন বেলার তালে তালে আরও প্রখর হতে শুরু করেছে। বাতাসে তাপের ছোঁয়া, গায়ে লাগলেই যেন কেমন একটা জ্বালা জ্বালা ভাব। সময় গড়াচ্ছে, আর সূর্য মামা যেন নিজের রূপের তেজ বাড়িয়ে চলেছে অবিরত।
দুপুর গড়িয়ে এসেছে , সময় প্রায় ১২টা ৩০। চারদিক ঝিমিয়ে পড়েছে রোদের দাপটে। গাছের পাতাগুলোও যেন স্থির হয়ে গেছে ক্লান্তিতে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, জনমানবহীন। দূরে কোথাও একটা কাক ডাকছে বিরক্তি নিয়ে।
ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা নির্ণয় যেন নিজের মনের সঙ্গে এক নিরব যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে। স্টিয়ারিং-এর ওপর রাখা তার হাত দুটো একটু কেঁপে উঠছে, যদিও মুখে কোনো ভাব নেই।
পাশের সিটে বসা রূপসী ফর্সা বরণ, চোখে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত দীপ্তি, ঠোঁটের কোণে হালকা এক অচেনা অভিমান সব মিলিয়ে যেন এক ছায়াপথের মায়া।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নির্ণয়ের মাথায় সেই মায়ার নেশা ধীরে ধীরে জমে উঠছে।
শত চেষ্টা করেও সে তার নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না ।
উফফ নির্ণয় , ভাই সামলা নিজেকে এইটা মেয়ে নয় ,শাকচুন্নী । তাই তো তার পাশে এলেই বুকের ভেতর ঝড় ওঠে।মন অস্থির হয়ে ওঠে।
এই মেয়ে কি জাদু জানে?
হয়তো জানে…
নির্ণয় আড়চোখে বারংবার নজর বুলায় রোজার দিকে। এই যে কেমন দুই বেনুনি দুহাতে টেনে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে গোলাপি ঠোঁট দুটো থেকে থেকে কেমন নড়ছে। হয়তো গুনগুন করে গান করছে মেয়েটি।
হঠাৎ করেই নির্ণয় টেনে ব্রেক কষে। গাড়িটা এক ঝাঁকুনিতে থেমে যায়।সিটবেল্ট লাগানো থাকলেও রোজা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে চুলগুলো মুখে এসে পড়ে, দুই বেনির মাথা দুলে ওঠে।
তারপর আবার ধীরে ধীরে সিটে ঠেকে ফিরে আসে সে। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে নিজের পোশাকটা গুছিয়ে নেয়। চোখের পাতায় একটু বিরক্তি, কিন্তু ঠোঁটে কিছু না বলা অভিমান।
রোজা ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় নির্ণয়ের দিকে। নির্ণয় তখনো সামনের দিকে তাকিয়ে, এক হাত স্টিয়ারিংয়ে, আরেকটা ঠিক দরজার পাশে। চোখে চাপা উত্তেজনা, ভেতরে যেন কাঁপছে, কিন্তু মুখে একটা অদ্ভুত শান্ত ভাব ধরে রেখেছে।
রোজা বেশ কিছু তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নির্ণয়ের অবস্থা। বেশ অস্থির লাগছে তাকে। কিছু সময় চুপ থেকে থমথমে কন্ঠে বলে
— এইভাবে ব্রেক কষার মানে কী?
নির্ণয় কিছুক্ষণ চুপ মুখে নেই কোনো উত্তর। কেমন এক দৃষ্টিতে যেন তাকায় রোজা দিকে। কিছু সময় তাকিয়ে যেন মনে অবাধ্য ইচ্ছে ঘুম পাড়াতে চাইছে সে। হঠাৎ হালকা এক হাঁসি ঠোঁটে টেনে বলে,
এমন এক আইটেম পাশে থাকলে…গাড়ি চালানো যায়?
ভরকে যায় রোজা চোখে ধাঁধার মতো কিছু ঝলক দেয়। চোখে চোখ রাখে নির্ণয়ের , হালকা করে ঠোঁট জোড়া ডানে বামে ঘুড়িয়ে জানালার দিকে মুখ ফেরিয়ে নেয় । গলায় এক রকম চাপা গম্ভীরতা রেখে বলল,
ইচ্ছে তো করছে মেরে শরীরের প্রতিটি হাড় গুড়ো করে দেই।
দুষ্টু হাসে নির্ণয় হাসির মাঝেই গালে ফুটে ওঠে অসম্ভব সুন্দর এক টোল ফুটে উঠতে যেন বিন্দু ভুল হয় না। চোখ যেন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে সেই হাসি। মুখের সামনে তুড়ির শব্দ পড়তেই , ধ্যান ভাঙ্গে তার
হয়ে যাক তবে হাত পা ছাড়া মারপিট
দেখি কার হাড্ডি ভাঙ্গে।
নির্ণয়ের লাগাম ছাড়া কথায় যেন কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে রোজার। দুহাতে দু কান চেপে ধরে ,উপর পানে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে
আল্লাহ গো আমারে ওঠায় নেও। রেহাই দেও , এই ঠোঁটকাটা পুরুষের থেকে।
হাহ ! নির্লজ্জ আমি খোলা মেলা প্রাণ।
লজ্জা রেখে মনে তাতে কি কাম!
ভাই না বলে ডাকো আমায় জান
নির্লজ্জ হলো আদরের নাম
ভ্রু জোড়া কুঁচকে এত ক্ষণের পুরো ক ছাড়া কবিতা টা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো রোজা।রাগ করবে নাকি কান্না করবে এসব ভেবেও ভিষণ কান্না পাচ্ছে তার। বেক্কল এক হাসি দিয়ে তাকায় নির্ণয়ের দিকে চোখে চোখে ঘোর বিরক্তি নিয়ে বলে।
আজ বুঝি এখানেই সময় কাটাতে হবে। ঘুরা আর হবে না তার থেকে চলুন বাড়ি গিয়ে আলুর চিপস ভেজে খাই কাজে দিবে। পেটের ক্ষুধাও মিটবে , মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে বকবক করে কি লাভ বলুন।
রোমান্সের মুডে এক বালতিতে ঠান্ডা পানি পড়ায় নাক সিঁটকায় নির্ণয়। রাগে গজগজ করতে করতে স্টার্ট দেয় গাড়ি। ঝড়ের বেগে বাড়াতে থাকে গাড়ির গতি
পুরো পরিবেশ যেন স্তব্ধ কারো মুখে কথা নেই। কেবল অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস আর গাড়ির অডিও সিস্টেমে বাজছে এক মৃদু, মিষ্টি গান। নরম পিয়ানোর সুর, গায়িকার কোমল গলা…
তুমি যাকে ভালোবাসো ,
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো !!
তার জিবনে ঝড়!!
তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জিবনে ঝড়
তোমার কথার শব্দ দূষণ ,
তোমার গলার স্বর।
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুন জ্বর।
তুমি অন্য কারো
সঙ্গে বেঁধো ঘর।
তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর।
পরিবেশ কেমন ঠান্ডা, ভারী। সেই গান যেন তাদের দুজনের মাঝখানে জমে থাকা কথাগুলোকে স্পষ্ট করে তুলে ধরছে।
রোজা জানালার বাইরে তাকিয়ে , ঠোট মিলায় সেই স্বরে।
নির্ণয়, স্টিয়ারিং ধরা , এক হাতে চালিয়ে নিচ্ছে গাড়ি , চোখে অদ্ভুত এক স্থিরতা।
গাড়ির কাচের বাইরে গাছপালা, আর মাঝে মাঝে দূরে দেখা যায় ছোট গ্রাম-বাড়ির ছায়া। দুজনের মাঝে নেই কথা। দু’জনের মন যেন গানে সুরে আবদ্ধ।
গানের পরের লাইন বাজে:
তোমার নৌকোর মুখোমুখি,
আমার সৈন্য দল।
বাঁচার লড়াই।।
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে, একটা চালের ভুল।
কোথায় দাঁড়াই।
কথার উপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়
নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে অসহায়
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান।
তুমি অন্য কারো ছন্দে বেঁধো গান।।
গাড়ির চাকা ঘুরে চলেছে সিলেটের পথে। হাইওয়ে ধরে তীব্র গতিতে ছুটছে নির্ণয়ের গাড়ি। রোজা জানালার পাশে মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে চোখে বিস্ময় আর এক মৃদু প্রশান্তি।
রাস্তার দুপাশে ঝাঁকড়া আম গাছ, তালগাছ, নারকেল গাছ সব একসাথে ছায়া ফেলছে ধূসর পিচঢালা রাস্তায়। বাতাসে ঘুড়ছে ধুলা, কিন্তু সেই ধুলোও যেন এখানে মিষ্টি।
সামনের দিকে যতই এগোচ্ছে, ততই প্রকৃতি রঙ বদলাচ্ছে।
শহরের ভিড় পেরিয়ে এবার চারপাশ জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ।
গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে রোজার চুলগুলো উড়ে উড়ে পড়ছে গালে। তার নিজের অজান্তেই একফোঁটা হাসি গলিয়ে পড়ে ঠোট উপচে নির্ণয় তাকায় না, কিন্তু পাশের সিটে সে অনুভব করে সেই নরম হাসির তরঙ্গ।
দূরে পাহাড় দেখা যায়, ধূসর-নীল টোনে আবছা। তার গা বেয়ে নামে মেঘের দল, যেন তারা গা ঘেঁষে হেঁটে আসছে রোজাদের দিকে।পাহাড়ের পায়ে বিছানো চা-বাগানগুলো দেখতে দেখতে মনে হয়, সবুজ সিল্ক কাপড়ে ঢাকা যেন এক রাজকীয় আঙিনা।
পথে পড়ে মালনীছড়া চা-বাগান বাংলাদেশের প্রাচীনতম চা-বাগান। গাড়ির জানালা দিয়ে চোখে পড়ে সবুজ চায়ের গাছের সারি, মাঝে মাঝে গাঢ় সবুজ শাড়িতে মোড়া চা-তোলা নারীরা, যারা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে হেঁটে চলে সুরের মতো তাল মিলিয়ে।
একটু পরে দেখা মেলে ছোট ছোট টিলার শাহপরান পাহাড়, খাসিয়াপুঞ্জির গৃহ।
ঘরগুলোর চালা বাঁশের, আর দেয়াল মাটির, জানালায় বাঁশের খুপরি, সামনে ছোট টিনের হাঁসের খাঁচা।
রোজা কাঁচের ওপর আঙুল দিয়ে লেখে কিছু, মুছে যায়।
নির্ণয় প্রশ্ন করে না সে শুধু গাড়ি চালায়, আর বুঝে যায়, এই প্রকৃতি দুজনকে নিঃশব্দে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসছে।
রাস্তার পাশে হঠাৎ গাছের ফাঁকে দেখা যায় নীলচে জল পিয়াইন নদী। নদীর পাড়ে শিশুরা খেলছে, হাতে হাত ধরে নেমেছে জলে, আর দূরে একজন বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যাচ্ছে গামছা কাঁধে।
সব দৃশ্য যেন এক জীবন্ত পেইন্টিং, যা রোজা চোখের ভেতর রেখে দিতে চায় চিরদিনের জন্য।
মাঝে মাঝে গাড়ির ভেতরে বাজছে নরম সুরের গান।
রোজা মুখে কিছু না বললেও, তার চোখে অনুপম মুগ্ধতা।
নির্ণয় একবারও বিরক্ত হয় না। সে জানে, কিছু পথ শুধু দেখার জন্য, কিছু মুহূর্ত শুধু অনুভব করার জন্য।
রাস্তার বাকা মোড় ঘুরে স্পিড হালকা বাড়িয়ে গাড়ি টানে নির্ণয়। এবার যেন দৃষ্টি ঘোরায় দুচোখে , তার প্রাণের দিকে।
“প্রাণ ”
ঠিক এই মেয়ে যে তার বেচে থাকার অস্তিত্ব। তার স্বপ্ন তার ভবিষ্যৎ সবকিছু। এইযে এই মেয়ের দিকে তাকালেই কেমন নেশাই চড়ে যায় মনে ,শান্ত হয় হৃদয় । বুকে হার্টবিট ফাস্ট হয়। মনে বেজে ওঠে হাজারো সুরের তাল- ছন্দ ছাড়া কবিতার দল এসে ভির জামায় চারপাশে। এই মেয়ে যদি একটি বার বুঝতো তবে কি পালিয়ে যেতে চাইতো।
হঠাৎ সমানে থেকে নিকটে ছুটে আসছে অতি বেগ সম্পূর্ণ গাড়ি পুরো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া।এদিকে স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরার আগেই
ঠাসসসস!!
সেকেন্ডের ভেতর সবকিছু ছিঁড়ে-ফেটে এক অজানা অন্ধকারে ছিটকে যায়। ধোঁয়া, গাড়ির হর্নের বিকট আর্তনাদ, ব্রেকের হঠাৎ চিৎকার সব একসাথে মিলিয়ে যেন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দৃশ্য।
গাড়িটার সামনের অংশ সম্পূর্ণ ভেঙে চুরমার। ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে । কাঁচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে সবদিকে, সিটের চারপাশে ছিটকে আছে রক্তরঙা ছোপ।
নির্ণয় মুখ থুবড়ে পড়েছিল স্টিয়ারিংয়ের ওপর, কপাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কপোল বেয়ে। তার দৃষ্টি ঝাপসা, মাথা ঝিমঝিম করছে। একটু পরে ধীরে ধীরে উঠে বসে, বোঝার চেষ্টা করে
ওহ ফা * ক।
তার শরীর ছুটে আসা আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে, কিন্তু সমস্ত যন্ত্রণার মাঝেও চোখ ছুটে যায় পাশের সিটে।
রোজ
সে একদিকে কাত হয়ে পড়ে আছে। তার দেহ নিথর।
বাম কাঁধে বড় কাঁচ ঢুকে গেছে, রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে নিচে।
তার ঠোঁটের কোণ ফেটে গেছে, দুই চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস অদৃশ্য।
না… না না না না… নির্ণয় গলা দিয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে আসে কান্নার মতো ডাক।
সে সিটবেল্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে, কাঁচে পা কেটে যায়, কিন্তু সে টের পায় না। পাগলের মতো ঝুঁকে পড়ে রোজার দিকে, হাত বাড়িয়ে গালে হাত রাখে।
“রোজ! রোজ !”
রোজা নিস্তব্ধ। তার গায়ে চুল ছেয়ে গেছে ভাঙা কাঁচের ধুলা আর রক্তে। সে যেন কোনো এক অজানা ঘুমে ঢুকে পড়েছে, যার দরজায় কেউ কড়া নাড়লেও সে জেগে উঠবে না।
নির্ণয় কাঁপা হাতে বুকের ভেতর টেনে নেয় তাকে, মাথাটা নিজের কাঁধে রাখে। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠে ,
রোজ, রোজ! জান বাচ্চা, জান এইযে আমি প্লিজ চোখ খোল।
ইয়া রব, ইয়া আল্লাহ ফেরাও তাকে।
আমার অস্তিত্ব ফেরাও আমার ভালোবাসা ফেরাও।
নির্ণয় কাঁপা হাতে রোজার গাল ছুঁয়ে থাকে। রক্তে ভেজা ঠোঁট কেঁপে উঠছে, কিন্তু রোজার চোখ এখনো বন্ধ।
তার নিঃশ্বাস এতই ক্ষীণ, যেন কখন নিঃশেষ হয়ে যাবে বোঝা যায় না।নির্ণয়ের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে রক্তের ওপর ধরে রাখতে পারছে না নিজেকে। রোজাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে নির্ণয়ের শরীর ভালোবাসা হারানোর আতঙ্কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে ।
না চোখ খুলছে না রোজা। নিঃশ্বাস অতি ক্ষীণ । নির্ণয় বারবার ডেকে উঠছে
“রোজ! জান, প্লিজ চোখ খোল… দেখ আমি তোকে ছেড়ে আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
তার কণ্ঠ ফেটে যাচ্ছে। বুকে জড়িয়ে ধরা রোজার নিথর দেহটা একটু নড়েও না। একবারও দমকা নিঃশ্বাস, চোখের পাতায় কাঁপন, হাতের আঙুলে নড়াচড়া কিছুই নেই।
নির্ণয় ব্যস্ত হয়ে ওঠে আলতো হাতে সিটে হেলান দিয়ে রাখে রোজাকে দ্রুত পায়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে যায় সে। হাত কেটে রক্ত ঝড়ছে জোড় করে টেনে খোলে রোজার পাশের দরজা। কোলে তুলে নেয় তার হৃদপিন্ড কে। কেমন নেতিয়ে পড়ছে শ
ছোট শরীর টাহ ।
এদিকে রক্ত, কাঁচের টুকরো, তার হাত-পা কেটে গেছে, শরীর কাপছে তবুও কিন্তু সে কিচ্ছু টের পায় না নির্ণয়।
ফ্যালফ্যাল করে রোজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে
কণ্ঠে ফেটে পড়ে আর্তনাদ
-আল্লাহ গো শুনছো তুমি , আমার সব নাও তবুও রোজ রে ফেরাও। আমি ভিক্ষুক, ভিক্ষা চাইছি।
একটু দয়া করো মালিক সে ছাড়া আমি অপূর্ণ, অস্তিত্বহীন।
তার বুকের ভেতর হাহাকার উঠে আসে। চারপাশে নেই জনমানবের দেখা পুরো রাস্তা যেন খা খা করছে। ঝিম ধরছে নির্ণয়ের মাথা
— পাখি আমার প্লিজ গেট আপ। আমি তোকে ওর্য়ান করছি
এখনো যদি না ওঠিস…আমি সব ধ্বংস করে দিবো। সব জ্বালিয়ে দিব ।
একফোঁটা বাতাস নেই, কোনোদিকে , সব শান্ত । সব যেন এক অভিশাপ, যেন সময় থেমে আছে মৃত্যুর কোলে। নির্ণয়ের গলার আওয়াজ আকাশ ছুঁতে চায়, কিন্তু রোজার কানে পৌঁছায় কি না জানা নেই
বুঝেছি রেগে আছিস তাই না। অভিমান করে আছিস তাইতো আচ্ছা দেখ এই দেখ আমি প্রমিজ করছি একদম পিংকি প্রমিজ। তুই না চাইলে আমি তোকে আর ছুবো। তবুও চোখ খোল আমি ধৈর্য হারা হয়ে পড়ছি ।
সে কেঁপে ওঠে, দুই হাতে আবারো শক্ত করে বুকে মাঝে জড়িয়ে নেয় রোজাকে
“তুই তো বলতিস বৈধতা চাই… সংসার চাই… নাম চাই… তাই না? তাই হবে। তুই যা চাইবি, সব হবে। আমার নামের পাশে তোর নাম থাকবে, শুধু… শুধু চোখ দুটো খোল পাখি। এমন করে পড়ে থাকিস না… আমি মরছি রোজ… আমি সত্যিই মরছি।”
গগনবিদারী এক চিৎকার ফেটে পড়ে ফাঁকা রাস্তাটার বুক চিরে।
নির্জন দুপুর, ঝিম ধরা গাছেরা পর্যন্ত চমকে ওঠে।
কোনো বাতাস নেই, পাতা নড়ে না, কাক ডাকে না
প্রকৃতি থমকে দাঁড়ায় মুহূর্তে।
রোদ যেন জমে আছে চারদিকে,মাটিতে পড়া ছায়াগুলোও নিঃশব্দে কাঁদছে।
রাস্তার মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে আছে নির্ণয়। তার কোলে নিথর হয়ে পড়ে আছে রোজা নিঃশ্বাসহীন, চোখ আধখোলা, ঠোঁট ফ্যাকাশে।
নির্ণয়ের কণ্ঠ ফেটে যাচ্ছে, শরীর কাঁপছে, চোখে রক্তজল। জ্ঞান শূন্য মাথা কাজ করা বন্ধ করছ, চারপাশে কেউ নেই, নেই কোনো গাড়ির শব্দ, নেই কোনো মানুষ।
একটা রাস্তা আর দুইটা নিঃসঙ্গ শরীর—
একজন মৃত, আর একজন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ভিতর থেকে।
পাশের বিল থেকে হঠাৎ একটা পাখি উড়ে যায়,
আর সেই শূন্যতার বুক চিরে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে নির্ণয়ের কান্না—
প্রিয়জন হারানোর সেই আর্তনাদ,
যা কেবল প্রেমিকের বুকেই জন্মায়, আর আকাশে গিয়ে ফেটে পড়ে।
হঠাৎ ,
হঠাৎ… দূর থেকে ভেসে আসে একটা শব্দ। চাকা ঘোরার, ইঞ্জিনের একটানা গুঞ্জন। নির্ণয় এক ঝটকায় মুখ তোলে।
রোজার মুখের থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকায়।
ধুলা উড়িয়ে, রাস্তার বুকে এগিয়ে আসছে একটা কালো রঙের গাড়ি।
সূর্যের আলোতে গাড়ির গ্লাস ঝলসে উঠছে, তবুও…
তবুও যেন চেনা লাগে গাড়িটা।
চেনা নম্বর প্লেট?
চেনা স্টিকার?
নির্ণয়ের ঠোঁটে আচমকা এক হাসির রেখা ফুটে ওঠে। আশার আলো ছায়া ছুঁয়ে যায় মুখে।
রি রিয়ান ।
গাড়িটা আরও কাছে আসে,
আরও… আরও কাছে।
নির্ণয় উঠে দাঁড়াতে যায়, তবে হঠাৎ যেন সব কেমন ঝাপসা। চারপাশে পরিবেশ কেমন ধোঁয়াটে হয়ে। আলো কেমন অন্ধকারে রূপ নেয়
গাড়ি এগিয়ে আসছে, নিভু নিভু চোখ জোড়া গাড়ি অতি নিকটে আসার অপেক্ষা। ঠিক তাই হলো , দ্রুত বেগে ছুটে আসা গাড়ি গাড়ি এসে , থেমে যায় তাদের থেকে কিছুটা দুরে। গাড়ির দরজা খুলে এক এক করে বেড়োতে থাকে রিয়ান তৃধা।
হাত বাড়িয়ে ডাকতে নিয়েও যেন থেমে যায় নির্ণয়ের হাত ….
এক এক করে গাড়ি ছেড়ে নেমে ছুটে আসে সকলে , ততক্ষণে পুরো অবচেতন হয়ে পড়ে নির্ণয়।
রাস্তার মাঝে ধুলোর ঝড় আর রক্তমাখা গাড়ির পাশে নির্ণয় পড়ে আছে অবচেতন, রোজাকে বুকের মধ্যে আগলে ধরে।
তার চোখ বন্ধ, মুখ থমথমে। যেন বুকের সবটুকু আর্তনাদ ঝড়ের মতো উড়ে গিয়ে তাকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে।
রিয়ান দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাওয়া খেয়ে পড়ে পড়ে যায় পাশে।
ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে—চোখ বড় বড়, শরীর কাঁপছে।
“ব্রো… ব্রো প্লিজ গেট আপ!
রোজ… আমার বোন! ভাই কিছু বল, প্লিজ… একটা কথা বল!”
রিয়ান কাঁপা হাতে নির্ণয়ের গাল ছুঁয়ে দেখে গরম, কিন্তু নিস্পন্দ।
তার হাত রক্তমাখা, চোখের পানি শুকাতে শুরু করেছে।
পেছন থেকে আয়ান ছুটে এসে পাশে বসে পড়ে, গম্ভীর চোখে চেক করে রোজার হাতের নাড়ি।
কিছুটা সময় নেয় , সকলের মাঝে উত্তেজনা, জানার কৌতুহল নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখে সবাই।
ভাই… খুব স্লো, কিন্তু আছে , শ্বাস আছে।”
আয়ানের কথায় যেন আশার আলো ফোটে।রিয়ানের চোখ ছলছল করছে
“এখনি হাসপাতালে নিতে হবে, দেরি চলবে না।”
রিয়ান হাঁক ছাড়ে, জলদি গাড়ির ব্যবস্থা করো কেউ। ওদের হাসপাতালে নেও
এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে যায় আয়ান। তার মুখে কোনো কথা নেই, চোখ জ্বলছে আতঙ্কে। দৌঁড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে ইগনিশন ঘোরায়, ইঞ্জিন গর্জে ওঠে হঠাৎ।
গাড়ি সামনে আনতেই রিয়ানের দিকে এগিয়ে যায় অপূর্ব।
রিয়ান চিৎকার করে ওঠে
Please help
অচেতন নির্ণয় কে তুলতে দিয়ে দোল খায় রিয়ান অপূর্ব এগিয়ে গিয়ে ধরে নির্ণয় অপর হাত।
তারা একসাথে নির্ণয়কে তুলে গাড়ির পেছনের সিটে বসায়।
তার শরীর নিস্তেজ, মুখে বয়ে যাওয়া রক্ত মুছে যাচ্ছে না।
নির্ণয় কে রেখেই ছুটে গিয়ে আবারো রোজার কাছে গিয়ে দাড়ায় নির্ণয়। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে
“রোজ!” –
প্রনয়ের প্রথম পুরুষ পর্ব ৩২
একবার ডেকেই ঝুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় রোজাকে কেমন শীতল হয়ে আসছে রোজার শরীর রিয়ান গাড়ির কাছে এসে থেমে বসিয়ে দেয় রোজাকে
গাড়ির দরজা বন্ধ করার আগেই রিয়ান চড়ে বসে গাড়িতে আদেশ স্বরূপ রিধিমা,তৃধা অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বলে
তোরা অপেক্ষা কর এইখানে আমি গাড়ি পাঠাবো।
আয়ান গতি বাড়িয়ে দেয়। গাড়ি ছুটে চলে রাতের বুক চিরে—সাইরেন নেই, শুধু প্রার্থনা আর অশ্রুজলে ভেজা বুক।