যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৮

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৮
মম সাহা

আকাশে ঝলমলে আলো থাকলেও অন্ধকারে ছেয়ে আসে চিত্রার মুখটি। হাতের বাটিতে থাকা গরম গরম পকোড়াগুলো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে বহুক্ষণ। মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে ছাদের মাঝখানে।
বাহার ভাই কথা বললেন প্রথমে, “এমন চুপচাপ হয়ে আছো যে?”
চিত্রার ভেতর যেই ভয়ঙ্কর ভাঙাচোরা হচ্ছিল তা যেন তীব্রবেগে বেরিয়ে আসতে চাইলো। তবুও সে স্থির থাকলে। এতকিছু সহ্য করতে করতে তার সহ্য ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি হয়ে গিয়েছে বোধহয়। নয়তো এতক্ষণে চারপাশে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো।
চিত্রা চুপ থাকলেও চেরি চটপটে স্বরে বলল, “আপা তো ঘুমিয়ে ছিলো। ঘুম থেকে উঠে এলো। তাই কথা বলছে না। ঘুমটা কাটতে তো সময় লাগবে!”

“ঘুমিয়ে ছিলো? ভর সন্ধ্যে অব্দি কে ঘুমোয়? এগুলো অলসতার লক্ষ্মণ।”
বাহার ভাইয়ের কথায় জ্বলে গেলো চিত্রার শরীরটা। তাকালোও এমন ভাবে যেন ভস্ম করে ফেলবে। সে দৃষ্টি লোকটা বুঝলো কি-না কে জানে?
“ভাগ্যিস ঘুমিয়ে ছিলাম! এখন তো আফসোস হলো কেন আরেকটু ঘুমালাম না। ঘুমে থাকলে অন্তত চোখটা শান্তিতে থাকতো।”
কথার ইঙ্গিত বাহার ভাই বুঝলেন না হয়তো। আবার বুঝতেও পারেন। মানুষটা মুখ দেখে কি আর তা বুঝার উপায় আছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

টুইংকেল হাসিমুখে এসে চিত্রার বাহু জড়িয়ে ধরল, “ধূর, তুমি ঘুমিয়ে থাকলে বাড়িটাই মনমরা হয়ে যায়। এত বোরিং লাগে। আমি তো কথা বলার মানুষই খুঁজে পাচ্ছিলাম না!”
“মানুষ পাচ্ছিলে না? বাহার ভাই তো বাড়িতেই ছিলেন। এই যে কথাও বলছিলে। আবার পাচ্ছিলে না বলছো কেন?”
চিত্রার কথার ভঙ্গি অস্বাভাবিক। যেকেউই বুঝবে কথাটা কত তাচ্ছিল্যে বলেছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো টুইংকেল সেটা বুঝল না। সে চিত্রার কথাকে আনন্দমনে সায় দিয়ে বলল,
“তা ঠিক। বাহার ভাই চমৎকার কথা বলেন। এটা অস্বীকার করার সাধ্য নেই।”
চিত্রার শরীরে কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। টুইংকেল মেয়েটাকে মনে হচ্ছে যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। কবে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেন কি বলে দেবে!

চিত্রার ভেতরের ক্রোধ ভেতরেই চেপে হাসিমুখে বলল,
“চমৎকার বলেন না খারাপ বলেন কিছুই জানি না তো। আমাদের সাথে তো বলেন না তেমন কথা। তোমার সাথেই দেখেছি বলতে।”
বাহার ভাই এবার নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। দু-হাত গুঁজলেন বুকে। ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালেন চিত্রার দিকে। মেয়েটা কেমন যেন দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছে!
অবস্থা অন্যরকম দেখতেই বাহার ভাই পরিস্থিতি ঘুরালেন। টুইংকেলকে বললেন, “যান এখন বাড়িতে। গিয়ে আড্ডা দেন। ওদের বাড়িতে সন্ধ্যার আড্ডাটা দারুণ হয়।”

টুইংকেলও সহমত পোষণ করলো। বিদায় জানিয়ে হাঁটা আরম্ভ করল চেরির হাত ধরে। চিত্রা হাতের পকোড়াগুলো রাখলো ছাদের রেলিং এর উপর। এরপর কোনো কথা না বলেই গটগট পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। বাহার ভাই রাশভারি কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিলো তাকে।
“এগুলো এখানে রেখে যাচ্ছো কেন? কে খাবে?”
চিত্রা প্রথম অবস্থায় বুঝতে পারল না কীসের কথা বলছে। মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“কোনগুলো?”
“এই যে পকোড়া!”
“আপনি খাবেন। আপনার জন্য পাঠিয়েছে।”
বাহার ভাই এক পা এগিয়ে এলেন, “আমার জন্য পাঠিয়েছে না ভূতের জন্য কীভাবে বুঝবো যদি না-ই বলো? খাবার কখনো দেখেছো এভাবে দিতে কাউকে? এটা এক ধরনের অপমান এবং মূর্খতা। মনে হচ্ছে খাবার দিয়ে দয়া করছো।”

চিত্রা তাজ্জব বনে গেলো কথা শুনে। ও দয়া করছে খাবার দিয়ে? অপমান করছে? এমনটাও লোকটা বলতে পারলো? চিত্রা সম্পর্কে এমনই ধারণাই জন্মেছে তার মনে? চিত্রা বুঝি এত খারাপ?
চিত্রার ভেতর একটা রাগ চেপে উঠল। কস্মিনকালেও সে রাগ করতে পারেনি মানুষটার উপর। সবসময় করেছে অভিমান। কিন্তু আজ সেই অভিমানের দেয়াল টপকে হানা দিলো রাগ। রাগান্বিত স্বরে সে জবাব দিলে কাঠ কাঠ,
“আপনার যদি মনে হয় আমি দয়া করছি তবে তা-ই হলো। অবশ্য এর বেশি কিছু আপনি চোখেও দেখবেন না। তাই ধরে নিন আমার দয়া, মূর্খতাই আপনার প্রাপ্য।”

যদিও বাহার ভাই চিত্রাকে খ্যাপানোর জন্য কথাগুলো বলেছিলেন কিন্তু চিত্রা এতটা রেগে যাবে তিনি তা ভাবতেও পারেননি। তাই কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেলেন। তবে পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বললেন,
“এমন দয়া পেলে অবশ্য আমি ভিক্ষুক হতেও রাজি।”
কী মায়া কণ্ঠস্বর! কী আকুতি ভরা বাক্য! এরপরেও কি রাগ ধরে রাখা যায়? অভিমান করে সরে যাওয়া যায় দূরে?
চিত্রা তাও অভিমানটা টেনে টেনে লম্বা করলো। জোর করে ধরে রাখলো সেটা। বলল,
“দয়া, মায়া দেওয়ার জন্য অনেক মানুষ আছে আপনার, বাহার ভাই। একটা চিত্রা না থাকলে আপনার কিচ্ছুটি হবে না।”

কথাটি বলেই কৃত্রিম হাসলো চিত্রা।
বাহার ভাই এবার দু’পা এগুলেন। সরাসরি দাঁড়ালেন চিত্রার সামনে। একদম বরাবর। চোখে চোখ রাখলেন। জোছনায় এমন দৃশ্য ভীষণ সিনেম্যাটিক লাগলো। মনে হলো সাদা-কালো সিনেমার কোনো প্রেমময় দৃশ্য।
মৃদু বাতাসে দুলছিলো চিত্রার চুল। সেদিকটায় তাকিয়ে তিনি মনভুলোর মতন আবদার করলেন,
“চুলগুলো আমি একটু গুঁজে দিবো? অবাধ্য হচ্ছে ওরা।”
যেন ছোটো বাচ্চার চকোলেট চাওয়ার মতন আবদার। চিত্রার নাজুক মন কি এমন আবদারে প্রত্যাখ্যানের হুংকার তুলতে পারে? পারে না। আবার হ্যাঁ বলতে ভীষণ লজ্জা করছে বিধায় শক্ত মুখে ও তাকিয়ে থাকলো। বাহার ভাই সেই নীরবতাকে সম্মতি ভেবেই খুব আদুরেপনায় গুঁজে দিলেন চুলগুলো। এতটাই আলতো হাতে যেন ব্যথা পাবে তার সাধের চিত্রা।

বললেন, “আমাকে দয়া-মায়া তো অনেকেই করেছে কিন্তু রঙ্গনার মতন ভালোবাসতে তো কেউ পারেনি। পারবোও না। তাই তো সেই কত ঝড় সামলেও ছুটে এলাম এখানটায়। একটু ভালোবাসা পাওয়ার যে বড়ো লোভ!”
মানুষটা এমন করে যে মেয়েটাকে ভুলিয়ে দিতে জানে! চিত্রার মাঝে মাঝে মনে হয় তার সকল আত্মসম্মান বোধ এই জায়গাটায় এসে ফিঁকে হয়ে উঠে। কেন একটু নিজের অপমান হচ্ছে বলে দূরে সরতে পারে না মানুষটার থেকে? কেন মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে না?
রাগে-দুঃখে চিত্রার সরে যেতে ইচ্ছে হলো কিন্তু বাহার ভাই তা দিলেন না। এমন খোলামেলা ছাদে, কাম বিহীন আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিলো চিত্রার শরীরটা। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“কেন এত রাগ তোমার?”
“আপনার হাসি, গান আজকাল অন্য কারো জন্য উৎসর্গ হচ্ছে তাই!”
“এত অবুঝ হলে চলে?”
“কী বুঝবো? দেখেও সব না দেখার ভাণ করবো?”
বাহার ভাই হাসলেন। খালি গলায় গান ধরলেন,
“তুমি দেখছো তাকে, ভাবছো যাকে
সে আসল মানুষ নয় ।
সে বেঁচে আছে শহরের এক কোণে
সে মৃত মানুষের চিৎকার শোনে
প্রতিদিন…
তোমার চোখের ভেতর যাই
হাত দেখিয়ে ট্রেন থামাই ।
লুকোনো আঘাত, রক্তপাত
থামেনা কেন?”

মানুষটার গানের কণ্ঠ এত সুন্দর চিত্রার ঘোর লেগে আসে তবুও ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে বুক থেকে। ধমকে বলে, “হেঁয়ালিপনা ছাড়ুন। সিরিয়াস হোন।”
লোকটা আবারও হাসে। হেসে বলে, “এ জীবন বড়ো ছোটো রঙ্গনা, অত গম্ভীর হয়ে কী হবে? হাসতে হবে, গাইতে হবে।”
চিত্রা রাগ আটকে ধরে রাখতে পারে না বলে বেরিয়ে যাওয়ার তাড়া দেয়। মানুষটা ওড়নার কোণ চেপে ধরে। গেয়ে উঠে,

“তুমি জানো না,
তুমি জানো নারে প্রিয়
তুমি মোর জীবনের সাধনা।
তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি,
মনে আপন জেনেছি,
তুমি বন্ধু আমার মন মানো না।
তুমি জানো না..
তোমায় পাইলে দুঃখের কুঠিরে,
দেখাইতাম বক্ষ চিরে,
পাইলে দুঃখের কুঠিরে
দেখাইতাম বক্ষ চিরে,
মনের ব্যথা মুখে বলা চলে না
তুমি জানো না…”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৭

চিত্রা লজ্জায় থমকে গেলো। বাহার হেসে দিলেন সুপুরুষের মতন। হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন,
“আজকে সবকিছু বেশ নাটকীয়, রঙ্গনা। দেখো মাথার উপর চাঁদটাও তোমায় দেখে হিংসে করছে। কেন ও তোমার মতন হতে পারলো না তারই আফসোস করছে বোধহয়।”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৯