হামিংবার্ড পর্ব ৬৪
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
ঢাকা শহরের রত যেন এক গাঢ় ক্লান্তির পরও অদ্ভুতভাবে জেগে থাকা এক শহরের চেহারা। রাস্তা থেকে তখনও পুরোপুরি গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যায়নি– দূরে বাসের হেডলাইট গড়িয়ে যাচ্ছে, সিএনজির শব্দ মাঝে মাঝে কানে বাজে। কিছু রাইডার ধীরে ধীরে ছুটছে, কাঁধে ব্যাগ, পিঠে ক্লান্তি।
ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, মিরপুর কিংবা মোহাম্মলপুর– এমন কিছু জায়গা এখনো আলো ঝলমলে। ছোট ছোট চায়ের দোকানে বসে কেউ এখনো ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে আড্ডা দিচ্ছে, কেউবা ফোনে কথা বলছে নিচু গলায়। টং দোকানে বাজছে পুরোনো কোনো গান—রাত যত বাড়ে, ততই যেন করুণ হয়ে ওঠে সুরটা।
বেইলি রোড বা বনানীর কিছু রেস্টুরেন্ট তখনও খোলা, শহরের কিছু এলিট অংশ এখনো আলোর ঝলকে ভরা। আর পুরান ঢাকার অলিগলিতে তখনো হাঁটছেন কয়েকজন মানুষ—নীরব কিন্তু নিঃসঙ্গ না।
চন্দ্রিমা উদ্যান, হাতিরঝিল কিংবা গুলশান লেকের পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে– তাদের মুখে বাতাসের হালকা ছোঁয়া। আকাশে তখন অল্প মেঘ, চাঁদটা ঢেকে দিয়ে আবার বেরিয়ে আসছে। বাতাসে গরম আর স্নিগ্ধতার মিশেল– নিশ্বাসে যেন একটু হালকা ধুলো, একটু কাঁটাআলো, আর একটু হাফ-আলসেমি।
নিজের ঘরেই শুয়েছিল সাবিহা। সবাই খাওয়াদাওয়া করে নিলেও সাবিহা এখনও রাতের খাবার খায়নি। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজে সেদিকে তাকাল সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ভাবি! ভেতরে এসো। তোমার আবার নক করা লাগে! “
অরা মুচকি হেসে রুমে ঢুকল। সাবিহা শোয়া থেকে উঠে বসেছে।
“ রাতে কি না খেয়েই থাকবে, আপু? চলো খাবার খেয়ে নিবে। “
“ আমার ইচ্ছে করছে না, ভাবি। আজকের রাতটা না খেলে কিচ্ছু হবে না। “
বিরস মুখে বলল সাবিহা। অরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বললেও তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। সাবিহা সেটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে।
“ বেশ! তবুও একবার নিচে চলো, একজন তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। “
কিছুটা অবাক হলো সাবিহা। কৌতূহল মেটাতে শুধালো,
“ আমার সাথে আবার কে দেখা করতে এসেছে?”
“ সেটা তো ড্রইং রুমে গেলেই বুঝতে পারবে, ননদী। চলো…..”
অরা এবার সাবিহার হাত ধরেই বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে, ঘর থেকে বেরোলো। সাবিহা তো কিছুই বুঝতে পারছে না। কে এসেছে, আচমকা অরার এতটা খুশি হওয়ার কারণ – সবকিছুই সাবিহার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে যেন।
ড্রইংরুমে বসে আছে মেহরাব, পাশেই আরিশও বসা। মেহরাবের মুখোমুখি সোফায় বসে আছেন, তাসলিমা খাতুন । তামান্না আপ্যায়নে ব্যস্ত, তালহা মায়ের সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আরিশ যেহেতু আগেই বিয়ের বিষয় বাড়িতে জানিয়েছিল তাই নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে মেয়ের হবু বর কেমন বাজিয়ে দেখতে টুকটাক কথাবার্তা বলেছেন তাসলিমা। মেহরাব অবশ্য এতটুকু সময়ের মধ্যেই তাসলিমার মন জয় করে নিয়েছে।
“ তাহলে তো আর দেরি করার কারণ দেখছি,চাচি। তামান্না আর তালহার বিয়ের সাথে ওদের বিয়েটাও হোক। “
তালহা বেশ খুশি হলো। একসাথে বিয়ে হলে মন্দ হয় না। তাসলিমা মুচকি হাসলেন। আরিশের ওপর পূর্ণ ভরসা আছে তার।
“ তুমি যা বলবে তাই হবে, আরিশ। “
মুচকি হাসল আরিশ। মেহরাবের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ যা শ্লা সিঙ্গেল অবস্থায় আর মরা হবে না তোর, ভেবেছিলাম সিঙ্গেলই মরবি তুই…… “
আরিশের কথায় সবাই হেসে উঠল। এরমধ্যে অরা সাবিহাকে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এসেছে। মেহরাব যখন সবার সাথে হাসিতে মেতে ছিলো ঠিক তখনই সাবিহার দৃষ্টি আটকে যায় তার ওপরে। মুহুর্তেই চমকায় সে, বুকটা ধক করে ওঠে। মেহরাব এসেছে! না আসার তো কিছু নেই। আরিশের বন্ধু, সেই হিসেবে তো আসতেই পারে সে।
“ কী হলো? সারপ্রাইজ! “
অরার কথায় ভাবনার ছেদ ঘটলো সাবিহার। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ওদের দিকে তাকাল। সাবিহার মনে অভিমান জমেছে বেশ। সে ইচ্ছে করেই ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহরাব লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সাবিহার দিকে। অরা কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল এবার। আরিশ তাকে ইশারায় কাছে ডাকল। আরিশের পাশে গিয়েই দাঁড়াল অরা।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা ও মেহরাব। দুজনের বুক ধুকপুক করছে যেন, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সাবিহার চোখ ছলছল করছে। ইচ্ছে করছে মানুষটার বুকে একবার মুখ গুঁজে দিতে। মেহরাব সাবিহাকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। সাবিহা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। মেহরাব ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে, সাবিহার সামনে একটা বক্স ধরে সেটা খুলল। সহসাই সাবিহার সামনে একটা সুন্দর হীরার নেকলেস উন্মুক্ত হলো। বিস্ময় কাটে না সাবিহার। মেহরাব এবার মুখ খুলল,
“ আমাকে বিয়ে করবে, সাবিহা? “
সাবিহা থমকে গেলো। মনে হলো মেহরাব মজা করছে তার সাথে। কিন্তু পরক্ষণেই আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে মনে হলো, না এটা মজা না। কারণ বাড়ির সবাই উপস্থিত এখানে। সাবিহা মেহরাবের দিকে তাকায় এবার। মেহরাব উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সাবিহা বলে,
“ আপনি খুব খারাপ….. আপনি আমার কল রিসিভ করেননি, টেক্সটের রিপ্লাই করেননি। আর আর দেখাও করেননি। “
“ সব অভিযোগ শুনবো, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। “
সাবিহা চুপ করে রইলো তবুও। অরা বলল,
“ আগে উত্তরটা দিয়ে দাও ননদী। “
সাবিহা সবার দিকে একবার তাকাল। সবাই হাসি হাসি মুখে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তামান্নাও রান্নাঘর থেকে, খাবার-দাবার নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এসেছে।
“ হ্যাঁ, করবো। তবে কথা দিতে হবে, ভবিষ্যতে আর কখনো এমন করবেন না। “
মেহরাব মুচকি হাসল। একহাতে কান ধরে বলল,
“ কথা দিলাম, আর কখনো এমন করবো না। “
সাবিহা হেসে মেহরাবের হাত থেকে বক্সটা নিলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল মেহরাব। সবাই হাততালি দিচ্ছে। তামান্না অরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ ভাবি আপনার কাজ বেড়ে গেলো। এখন দু’জনকে বউ সাজাতে হবে। “
অরা হেসে বলল,
“ কোনো সমস্যা নেই। “
হাসি-আনন্দে দুই যুগলের বিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো সেই রাতে। মেহরাব, সাবিহার সাথে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলেছিল। দু’জনের মধ্যে জমে থাকা মান-অভিমান, তিক্ততা ধীরে ধীরে গলে গেল। চোখে চোখ রেখে যেন একটা নীরব বোঝাপড়া হয়ে গেল তাদের সব ভুলে, সব পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করার অপেক্ষায় তারা।
দু’দিন ধরে ঝুম বৃষ্টি। বাইরে বেরোনোর যেন উপায় নেই। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অরা। সময়টা বিকেলবেলা, আসরের আজান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে ওঠাতে নড়েচড়ে উঠল অরা। বিছানার কাছে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, মা কল করেছে।
“ আসসালামু আলাইকুম, মা! কেমন আছো?”
“ ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, তোরা কেমন আছিস সবাই? “
“ আমরাও আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। বাবার শরীর কেমন আর নয়না কী করছে?”
“ তোর বাবা ভালোই আছেন। নয়না ঘুমাচ্ছে। “
“ এখন? শরীর ঠিক আছে তো?”
“ হ্যাঁ, ঠিক আছে। আচ্ছা শোন, উর্মির বিয়ে চারদিন পর। তোর চাচ্চু খুব করে সবাইকে নিয়ে যেতে বলেছেন। তোর আর আরিশের কথাও বলেছেন খুব। তুই একটু আরিশকে বল, নিশ্চয়ই শুনবে। সবাই একসাথে গ্রামে যাবো। “
অরা ভাবনায় পড়লো কিছুটা। আরিশ রাজি হবে কি-না কে জানে।
“ ঠিক আছে, মা। আমি বলবো উনাকে। রাতে বাসায় ফিরুক তারপর। “
রোকসানা মল্লিক খুশি হলেন। হেসে বললেন,
“ ঠিক আছে। আগামীকাল সকালে বলিস, আরিশ কী বলে। “
“ আচ্ছা, মা। জানাবো। “
“ রাখছি তাহলে, ভালো থাকিস। “
“ তুমিও, ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ। “
“ আল্লাহ হাফেজ। “
“ আপু কী বলল, মা?”
হাই তুলতে তুলতে মায়ের ঘরে ঢুকল নয়না। রোকসানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ বলল রাতে আরিশ বাসায় ফিরলে, ওর সাথে কথা বলবে। আগামীকাল সকালে জানাবে। “
“ ওহ, আচ্ছা। “
নয়না তার খোলা চুলগুলো দু’হাতের সাহায্যে খোঁপা করে, বিছানার একপাশে বসলো। রোকসানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন একবার।
“ চোখমুখে পানির ছিটে দিয়ে আয়। আমি যাচ্ছি রান্নাঘরে, চা আর পকোড়া বানাবো। “
“ ঠিক আছে, মা। “
নয়না আগের মতোই ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রোকসানা মল্লিক রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।
অফিসের ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা । বাইরের আকাশে রোদ ফুরোবার প্রস্তুতি, জানালার কাঁচে আলোর ছায়া ঝিমিয়ে পড়ছে। কিন্তু খান ইন্ডাস্ট্রির কনফারেন্স রুমে তখন উত্তেজনার পারদ যেন হঠাৎ চড়তে শুরু করেছে।
আরিশ টেবিলের ওপাশে বসে, মুখ থমথমে। ফাইল হাতে নিয়ে এক পৃষ্ঠা পড়েই চেয়ারের পিছনে হেলে গিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“এই রিপোর্টটা কে বানিয়েছে?”
কেউ সরাসরি জবাব দিল না। কিন্তু মেহেদী নামের এক জুনিয়র স্টাফ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল,
“স্যার, আমি… মানে আমি ইমেইল করেছিলাম আপনাকে…”
আরিশ চোখ তুলে তাকাল। তার গলার স্বর তখনো নিচু, কিন্তু ভয়ংকরভাবে কড়া।
“তুমি বুঝতে পারো, একটা সংখ্যার ভুল মানে পুরো রিপোর্টের তথ্য ভেঙে পড়া? আমাদের ক্লায়েন্টকে তুমি ভুল ডেটা পাঠিয়েছো, আর সেটা আমি জানতে পারলাম বাইরের লোকের কাছ থেকে? হোয়াট দ্য হেল ইজ রং উইথ ইউ?”
মেহেদী ঘেমে উঠেছে। অফিস ঘরটা যেন হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল।
আরিশ দাঁড়িয়ে গেল এবার, টেবিলের উপর রিপোর্টটা ছুঁড়ে ফেলে বলল,
“আমি যখন বলি ‘ডাবল চেক করে জমা দিতে’, সেটা শুধু বলা কথা না। এটাই প্রফেশনালিজম। আমরা যদি নিজের কাজেই সিরিয়াস না হই, তাহলে এই চেয়ারগুলোতে বসে কী করো তোমরা? সময় কাটাতে আসো?”
তার কণ্ঠে রাগ না, হতাশাও না– একধরনের দৃঢ়তা, নেতৃত্বের স্পষ্ট নির্দেশ। অফিসের বাতাস ভারি হয়ে আছে। কেউ কফির কাপ তুলেও চুমুক দিচ্ছে না।
হামিংবার্ড পর্ব ৬৩
আরিশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“এটা আমার শেষ ওয়ার্নিং, মেহেদী। পরেরবার এমন হলে শুধু রিপোর্ট নয়, চাকরিটাও তোমার রিপোর্ট করবে।”
মেহেদী কেবল মাথা নাড়ল। সবাই চুপ করে রইলো।