হামিংবার্ড পর্ব ৬৪ (২)
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে পা ফেলে নিজের কেবিনে ঢুকল আরিশ। তার মুখ থমথমে, ভ্রু কুঁচকে আছে এখনো। জানালার পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে গা এলিয়ে দিল। ঘরের বাতি জ্বলছে, কিন্তু ভেতরের আলো যেন নিঃশব্দ, ভারী। ডেস্কের উপরে রাখা রিপোর্টটা একবার দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল—“হামিংবার্ড কলিং…”
এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল স্ক্রিনে। ভেতরে জমে থাকা রাগ, বিরক্তি, হতাশার ভিড়ে হঠাৎ এক নরম স্পর্শের মতো মনে হলো নামটা।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠ–
“কী করছেন?”
আরিশ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিল,
“কিছু না।”
আরিশের কণ্ঠস্বর শুনেই অরার খটকা লাগলো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“অফিসে কিছু হয়েছে?”
“একটা রিপোর্টে মারাত্মক ভুল ছিল। রাগটা এখনো যাচ্ছে না।”
অরার গলা তখনও নরম, ঠাণ্ডা জলর মতো,
“ আপনি সবকিছু নিখুঁত চান… কিন্তু আপনিও যেমন মানুষ, বাকি সবাইও তাই। একটু ভুল হতেই পারে। জানি একটুখানি ভুলের জন্যও অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যায় কিন্তু রাগ করলে কী কিছু মেটে, রাগী ভূত? আপনি ভেঙে পড়বেন না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরিশ হেসে উঠল। অদ্ভুত এক ক্লান্ত, অস্ফুট হাসি।
“ভেঙে পড়িনি, শুধু… মাথার ভেতরটা কেমন জ্বালা করছে।”
“ তাহলে কথা বলুন আমার সাথে। রাগ গলে যাবে।”
অরা চোখ বন্ধ কথাটা বলল, পরে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলো। আরিশের ঠোঁটের কোণের হাসি আরো চওড়া হলো তার কথায়।
“ যাক এতদিনে বুঝতে পেরেছো, তুমি আমার কতটা জুড়ে আছো। “
আরিশ চেয়ারটা পিছনে হেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। অরা মুচকি মুচকি হাসছে।
“ আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবেন? “
ভ্রু কুঁচকে ফেলল আরিশ, ঠোঁটের কোণে অন্য রকম হাসির ঝিলিক। যেন একটু আগে কনফারেন্স রুমে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভুলে গেছে সে।
“ বউ বললে একটু তাড়াতাড়ি নয়, বলা মাত্রই হুকুম তামিল করতে হয়। আমি অফিস থেকে বের হচ্ছি, ডার্লিং। “
লজ্জায় চুপ করে রইলো অরা। আরিশ কেবল তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আরিশ ফিসফিস করে ফের বলল,
“ বি রেডি, বিকজ আই’ম কামিং ফর ইউ—অ্যান্ড দিস টাইম, আই ওউন্ট অ্যাস্ক ফর পারমিশন….”
অরা আরকিছুই না শুনে কল কেটে দিলো। লজ্জায় নিজের ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে মিটিমিটি হাসছে সে। ভদ্রলোক আর ভদ্র হলো না!
রাতের শহরে আজ হালকা বাতাস। মাথার উপর আধখানা চাঁদ, চারপাশে নরম আলো। ব্যস্ত ঢাকা শহর যেন আজ একটু ধীরে হাঁটছে– হয়তো মেহরাব আর সাবিহার জন্য। দীর্ঘ সময়ের মান-অভিমান, দূরত্ব আর ভুল বোঝাবুঝির পরে আজকের রাতটা যেন নতুন এক শুরু। একসাথে শহরে বের হয়েছে তারা হাত ধরে, না বলা শত আবেগ বুকের ভেতর জমিয়ে।
ধানমণ্ডি লেকের পাশে হাঁটছে দু’জনে। মেহরাব পরেছে হালকা নীল রঙের ক্যাজুয়াল শার্ট, হাতা একটু গুটানো, সাথে জিন্স প্যান্ট। সাবিহা পরেছে গোলাপি থ্রিপিস, চুল ঢিলে করে বেঁধে রেখেছে, একটু হালকা ওয়েভ –স্বাভাবিক, নরম একটি লুক। মেহরাবের হাতে সাবিহার হাত, কিন্তু চোখে চোখ না রেখেও সব কথা বলা হয়ে যাচ্ছে যেন। হঠাৎ এক সময় সাবিহা থেমে গেল।
“মেহরাব… মনে আছে, এই জায়গায় আগেও এসেছিলাম আমরা?”
মেহরাব হালকা হাসল,
“মনে থাকবে না? সেদিন তো তুমি রাস্তা পার হওয়ার সময় আমায় হাত ধরেছিলে। তখনও বলোনি এতটা ভালোবাসো!”
সাবিহা হেসে ফেলে, চোখ নামিয়ে বলে,
“তখন ভাবতাম, বললে হয়তো সব বদলে যাবে।”
“আর এখন?”
“এখন ভাবি… না বললেই হয়তো হারিয়ে ফেলতাম তোমাকে।”
মেহরাব তার দিকে একটু ঝুঁকে এসে কপালের ঠিক মাঝখানে চুমু দিল।
“তুমি আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। আমি তোমাকে কখনোই আবার দূরে যেতে দেব না।”
“ দূরে যেতে দিলে তো!”
মেহরাব খিলখিল করে হেসে উঠল। সাবিহা তার কাঁধে মাথা রাখল। চারপাশের নীরবতা যেন হঠাৎ তাদের হৃদস্পন্দনের সুরে ভরে উঠল। হাত ধরাধরি করে আবার হাঁটতে শুরু করল তারা।পেছনে পড়ে রইল অভিমান, কষ্ট, পুরোনো গ্লানির ছায়া। শহর আজ যেন আরও আলোকিত, শুধু তাদের জন্য।
“ কী গো? অরাকে কল করেছিলে তুমি? আগামীকাল বিকেলের মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। ভাইজান বড্ড রাগারাগি করছেন। “
অফিস থেকে ফিরে, ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রইংরুমে বসলেন সুলাইমান। রোকসানা স্বামীর জন্য চা নিয়ে এসেছেন। নয়না পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।
“ আজ বিকেলেই তো কথা বললাম, অরার সাথে। সকালে জানাবে। আরিশের সাথে রাতে কথা বলবে, বলল। “
সুলাইমান রোকসানার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলেন। ধীরেসুস্থে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“ বেশ। তবে তুমি গিয়ে আমাদের জামাকাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। পাঁচ দিন ছুটি নিয়েছি, তারমধ্য একদিন গেলো অফিসের ঝামেলায়! ছুটি নিয়েও শান্তি নেই। “
কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে বললেন কথাগুলো।
“ কী হয়েছিল অফিসে?”
“ একটা প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দেওয়ার ডেট ছিল ছুটির সময়েই। বলেছিলাম, মেহেদী যেন ঠিকমতো হ্যান্ডেল করে। কিন্তু কি আর বলব, রিপোর্টে এমন ভুল—শেষ পর্যন্ত নিজেই গিয়ে সংশোধন করে দিতে হলো। অফিস গিয়ে তিন ঘণ্টা বসে কফি আর টেনশনে কাটাতে হয়েছে!”
“ বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা শোনো, আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি। “
সুলাইমান মল্লিক আরকিছু বললেন না কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। রোকসানা নিজের ঘরের দিকে এগোলেন।
সন্ধ্যার আগে আগে আরিশ অফিস থেকে বের হলেও বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা বাজল। রাস্তায় যা জ্যাম, তাতে দুই ঘন্টার পথে যেন চার ঘন্টা লাগার উপক্রম!
বিছানায় চুপচাপ বসে আছে অরা। অনেক দিন হলো কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি অরার। তাই আজকে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজিনের বিয়েতে যাওয়ার প্ল্যান করছে অরা। এজন্যই আরিশকে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছিল সে। তবে এতো দেরি হওয়ার কারণে মনটা কেমন খচখচ করছে অরার।
“ কী খবর, পাখি?”
আচমকা আরিশের কণ্ঠস্বর শুনে সামনে তাকাল অরা। অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো বলেই, ভদ্রলোকের পায়ের শব্দ টের পায়নি।
“ ভালোই। এই বুঝি আপনি তাড়াতাড়ি ফিরলেন?!
প্রিয়তমার কণ্ঠে অভিমানের আভাস পেয়ে আরিশের মনটা যেনো নেচে উঠলো। অরার একটু ভালোবাসা পেলে আরিশের নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। সে অরার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, দুহাত বাড়িয়ে দিলো– ঠিক যেভাবে ছোটো বাচ্চাদের কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ানো হয় সেভাবে। অরা আরিশের কাছে এগিয়ে গেলো। ভদ্রলোক বরাবরের মতোই কোলে তুলে নিলো অরাকে।
“ রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো, হামিংবার্ড। “
“ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমার অনেক খিদে পেয়েছে। “
“ খিদে পেলে খাও… সামনেই তো দাঁড়িয়ে… “
আরিশ মিটিমিটি হাসে, কথা শেষ করলোনা। অরা তার দুষ্টমি বুঝে গেছে।
“ আগে খাবার তারপর… এসব…. “
অরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আরিশ হঠাৎ এগিয়ে এসে তার মুখ থামিয়ে দিল। চোখে চোখ রেখে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থাকল, তারপর অরার ঠোঁটে নিজের তীব্র উপস্থিতি ছাপ ফেলে গেল।
অরা প্রথমে একটু চমকে উঠলেও একটুও বাধা দিল না, বরং দু’হাতে আরিশের শার্ট শক্ত করে চেপে ধরল। আরিশ তার ঠোঁটে নরম আদরের ছাপ রেখে বলল,
“ওকে ডার্লিং। আগে না হয় খাবার খেয়ে আসি,তারপর…”
অরা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। কিন্তু ঠোঁটের কোণে তীব্র আবেগে লেগে রইল লালচে ছায়া,যেটা শুধু আরিশই রেখে যেতে পারে। অরাকে রেখে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল আরিশ।
নিশুতি রাত। চারপাশে গভীর নীরবতা, জানালার বাইরে কেবল পাখার ঘড়ঘড় শব্দ আর দূরের কোনো কুকুরের ডাকে মাঝেমধ্যে ছেদ পড়ছে।
নয়না বিছানায় শুয়ে আছে, চোখের পাতায় ক্লান্তি আছে, কিন্তু ঘুম নেই। বালিশে মাথা রাখলেই মনে পড়ে– পলাশের কথা। সেই সহজ হাসি, নিরব চোখের ভেতরে জমে থাকা অনুভব, আর নিঃশব্দে পাশে থাকার যে ক্ষমতা ছিল ওর।
পলাশ তাকে ভালোবাসত, নয়না সেটা টের পেয়েছিল, কিন্তু তখন বুঝতে পারেনি যে ও নিজেও ভালোবেসে ফেলেছে। তবে পলাশের অনুপস্থিতিতে সেটা বুঝতে পারছে। আজ যখন পলাশ নেই, ঘরজুড়ে তার অনুপস্থিতির নীরবতা, তখন প্রতিটি নিশ্বাসে শুধু তার ছায়া।
হামিংবার্ড পর্ব ৬৪
বালিশে মুখ গুঁজে নয়না চোখ বন্ধ করে। ঘুম আসছে না। পলাশ চলে যাওয়ার পর ঘুম যেন অভিমান করে সরে গেছে। তাকে ছুঁয়ে থাকা স্মৃতিগুলো এখন নয়নার নিঃশ্বাসে ছায়া হয়ে জড়িয়ে থাকে। তাদের শেষ দেখা, কথা, পলাশের হার্ট লক করা সবকিছুই নয়না বারবার মনে করে। চোখ ভিজে ওঠে জলে।
পলাশের সাথে কথা বলতে না পেরে প্রতিদিন একটু একটু করে পুড়ে যাচ্ছে নয়নার বুক—নিঃশব্দে, নিঃশ্বাসে, ঘুমহীন রাতের পর রাত।