হামিংবার্ড পর্ব ৬৫

হামিংবার্ড পর্ব ৬৫
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

“ কাজিনের বিয়েতে যেতে চাচ্ছো?”
আরিশ কিছুটা গাম্ভীর্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো। অরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, আরিশ বিছানায় বসে আছে। মাত্র রাতের খাবার খেয়ে, রুমে ফিরলো দু’জন।
“ আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে যাবো। “
কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল অরা। আরিশ হাত বাড়াল, অরার ডান হাতটা ধরে আলতো করে টেনে নিজের পাশে বসালো তাকে। অরা কিঞ্চিৎ অবাক হলো তাতে। ভদ্রলোক কোলে না বসিয়ে পাশে কেন বসালেন আজ? তবে কি রেগে গেলেন?

“ ঠিক আছে। অনুমতি দিলাম। কবে যাবে?”
আরিশের মতিগতি বুঝতে পারছে না অরা। এতো সহজেই সে কীভাবে রাজি হলো! অরার কাছে সবটা স্বপ্নের মতো লাগলো।
“ আগামীকাল বিকেলে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?”
ভ্রু কুঁচকে ফেলল আরিশ, শুধালো –
“ আমার কীসের অসুবিধা? আমি তো অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করি না ডার্লিং। কোম্পানিই আমার। এজন্যই আঙ্কেল সেদিন ছুটি নিলেন, তাই না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ হ্যাঁ। “
“ হুম বুঝলাম। কাল যাবে, আজ বললে! তাড়াহুড়ো করে সকালবেলা শপিং করতে হবে। “
“ আমার কিছু লাগবে না। অনেক জামাকাপড় তো পরাই হয়নি৷ “
আরিশ অরার গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ সেগুলো থাক, নতুন কিনবে। তাছাড়া নতুন দম্পত্তির জন্যও তো উপহার কিনতে হবে। “
“ তা-ও কথা। “

আরিশ কথার ফাঁকে ফাঁকে ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে কেবল। বিষয়টা অরার নজর এড়ায়নি। ফোনে কী এমন আছে যার জন্য বউয়ের দিকে মন নেই? অভিমান হলো হামিংবার্ডের। তার রাগী ভূতকে কখনো এমনভাবে অন্যমনস্ক হতে দেখেনি সে। আজ যদি অরা এরকম অন্যমনস্ক থাকতো, তাহলে তো দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যেতো। মুখ গোমড়া করে মাথা নিচু করে ফেলল সে। আরিশ কাউকে কল করে কথা বলল কিছুক্ষণ। অরা সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনে যা বুঝলো, বিদেশি কোম্পানির সাথে বড়ো ডিলের জন্য আগামীকাল মিটিং ছিলো। কিন্তু এখন যেহেতু অরা গ্রামের বাড়িতে যেতে চেয়েছে সেজন্য আরিশ ব্যাপারটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। বেচারা আরিশ! বউয়ের হঠাৎ বিয়ে খেতে যাওয়ার জন্য বেশ বিপাকে পড়েছে। অরা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার করল।
“ কী হয়েছে, পাখি? কী ভাবছো? কোনো সমস্যা? “

অরা কোনো উত্তর দিলো না। নিজে থেকেই আরিশের কোলে চড়ে বসল। দু’হাতে গলা জড়িয়ে দৃষ্টিনত করে বলল,
“ আমাকে আজ কোলে তুলে বসালেন না কেন, রাগী ভূত? “
আরিশ যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার স্ত্রী নিজে থেকে কোলে বসেছে আজ এবং অভিযোগ তুলেছে। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। অরা চুপ করে আছে।
“ অরা?”
“ জি। “
“ তুমি কি আমাকে পুরোপুরি ভালোবেসে ফেলেছো?”

আরিশের প্রশ্ন বুঝতে পারলোনা সে। মাথা উঁচু করে, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আমি কি আপনাকে ভালোবাসি না? পুরোপুরি ভালোবেসে ফেলেছি মানে কী?”
আরিশ অরার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
“ ভালোবাসো না, সেটা বলিনি। তুমি আমাকে ভালোবাসলেও কখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারোনি। তোমার অবচেতন মন আমার পূর্বের আচরণগুলো ভুলতে পারে না। এজন্য মাঝে মধ্যে তুমি আমার ওপর বিরক্ত হও। তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি। “

অরা ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। আরিশের কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু এতে অরার কী দোষ? একটা পরিবারকে বাধ্য করে তাদের মেয়েকে বিয়ে করেছিল আরিশ, তারপর? তারপর দিনের পর দিন অস্বাভাবিক আচরণ করেছে সে, নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিয়েছে অরার ওপর। আজ অবধি অরার কোনো স্বাধীনতা নেই এখানে। ভালোবেসে বশ্যতা স্বীকার করা আর জোর করে বশ মানানোর মধ্যে পার্থক্য অনেক…..
“ হেই, হামিংবার্ড?”
অরার ভাবনার ছেদ ঘটলো আরিশের ডাকে।
“ আমি আপনাকে ভালোবাসি… পুরোপুরি ভালোবাসি। এর বাইরে কোনো সত্যি নেই আরিশ। “
মুচকি হাসল আরিশ।
“ এতটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। বিকেলে যেন কী বলেছিলাম?“
বিকেলের ফোনালাপের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় নুইয়ে গেলো অরা।

“ জানি না। “
“ আমি জানি, ডার্লিং। “
আরিশ অরাকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিল. তারপর কোনো শব্দ না করে পাশে শুয়ে পড়ল। একটা নিঃশব্দ মুহূর্ত কাটলো। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো নিঃশ্বাসের ওঠানামা, গায়ে লাগা উষ্ণতা, অজানা উত্তেজনার হালকা স্রোত।
আরিশ ধীরে ধীরে অরার দিকে ঘুরে তাকাল।
তার চোখে ছিল এক ধরনের না বলা আকুলতা।
“ সব ক্ষেত্রে নিজেকে সামলাতে পারলেও , তোমায় ছুঁতে গেলে আমি কেমন যেন হয়ে যাই। পাখি, তুমি কি….”
অরা চুপ করে শুনছিল। তবে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল অরা,
“ আপনার সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। ভালোবাসি আপানাকে, আপনি যেমন তেমনভাবেই। আপনি আমার, আরিশ।”

“ আই লাভ ইউ টু, হামিংবার্ড। “
আরিশের হৃদয়ে যেনো ভালোলাগার ঢেউ বইতে লাগল। সে আর দেরি করল না। তার ঠোঁট ছুঁলো অরার গাল… তারপর কান, ঘাড়… ধীরে ধীরে নামছিল নিচে। প্রতিটি চুমুতে ছিল নিঃশব্দে বলা ভালোবাসা, আর মিশে থাকা আগুন। অরার দেহ ঠাণ্ডা ছিল, কিন্তু আরিশের স্পর্শে যেন আগুন ধরে গেল ত্বকে। সে কেঁপে উঠল। হাত দিয়ে চেপে ধরল আরিশের কাঁধ। ঠোঁটের কোণে নরম শ্বাস পড়ে, আর আরিশ তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে দিল ধীর অথচ তীব্র কামনা।
জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়া চাঁদের আলো দুজনের মুখ ছুঁয়ে রইল। শব্দহীনভাবে মিলিয়ে গেলো ভয়, অভিমান।
পরেরদিন সকালে, অরা রোকসানাকে ফোন করে সবটা জানালো। ভীষণ খুশি হলেন রোকসানা। সোলাইমান, নয়নাও খুশি – আরিশের আচরণে। মায়ের সাথে কথা বলা শেষে আরিশের সাথে শপিং করার জন্য বেরুলো অরা। তবে মনে মনে ভয়ে ছিলো, হয়তো গতবারের মতো আজও শপিং না করেই বাসায় ফিরে আসবে আরিশ। তবে তেমন কিছু ঘটলো না আজ। কারণ আরিশ শপিংমলে ঢোকার আগেই অরাকে ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নিতে বলেছিল। ফলশ্রুতিতে অরাও তাই করেছিল। প্রায় দুই ঘন্টার শপিং শেষ করে দু’জনে বাড়ি ফিরছে এখন।

“ আইসক্রিম খাবে, হামিংবার্ড?”
পাশাপাশি বসে আছে দু’জন, গাড়ি চলছে । আইসক্রিমের কথা শুনতেই সেই প্রথমবারের কথা মনে পড়ে গেলো অরার। সেবার আইসক্রিমের বাহানা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে।
“ হ্যাঁ খাবো। “
আরিশ একটু সামনে গিয়েই গাড়ি দাঁড় করালো।
“ কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম ? “
আরিশের ঠোঁটের কোণে হাসি, তবে অরার মনে হচ্ছে অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে সে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই লজ্জায় অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
“ ভ্যানিলা, চকলেট আর…… না আরকিছু না।”
“ ওকে, বসো। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। “
আরিশ গাড়ি থেকে নেমে, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,
“ আগেরবারের মতো পালিয়ে গেলে কিন্তু আর খুঁজতে যাবো না। “
অরা শব্দ করে হেসে উঠল। আরিশ আবার খুঁজতে যাবে না তাকে, হাস্যকর কথা।
“ পালানোর আর দরকার নেই, জনাব। এই পাখিটা চিরকালের জন্য আপনার হৃদয়ের খাঁচায় বন্দী হয়ে গেছে। “
“তাই?”

আরিশ জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে, হঠাৎ করেই অরার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। অরার ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। মুখটা গরম হয়ে উঠল এক নিমিষে।
আরিশ হেঁসে দিলো। তার চেহারায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
“ভ্যানিলা, চকলেট আর আমার মতো হট কিছু আনব ?”
এই কথা শুনে অরা চমকে তাকালো। অরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরিশ হেঁটে চলে গেল পাশের দোকানের দিকে।
গাড়ির জানালার কাঁচে অরার মুখ ভেসে উঠছে। তার চোখে এখনো সেই হাসির রেশ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে চলছে হৃদয়ের ধুকপুক।
এই মানুষটা তার জীবনকে যতভাবে বদলে দিয়েছে, ততটা সে কোনোদিন কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না।
আরিশ ফিরে এলো হাতে আইসক্রিম নিয়ে। গাড়িতে উঠে বসলো।

” আমার মতো হট কিছু পেলাম না,ডার্লিং। ”
অরা আমতা আমতা করে বলল,
” পাবেন কীভাবে! আপনি তো এক পিসই৷ ”
আরিশ হাসল। আইসক্রিম এগিয়ে দিলো তার দিকে।
” নাও। ”
” আপনিও খান। আমি ভ্যানিলা নিচ্ছি। ”
আরিশ কাপ এগিয়ে দিলো।
“তোমার প্রিয় ভ্যানিলা, তোমার মতোই শান্ত আর ধরা না দেওয়া স্বাদ।”
অরা হাসল। “আর আপনারটা?”
“চকলেট। একটু বেশি তীব্র, কখনো কখনো তিক্ত তবে একবার অভ্যেস হয়ে গেলে ছাড়া যায় না।”
” একদম ঠিক বলেছেন। এখন চলুন, গোছগাছ বাকি অনেক। ”
” হ্যাঁ, চলো। ”

সকাল থেকেই গ্রামের আকাশটায় একটা মিষ্টি আমেজ। হালকা রোদ আর হাওয়ার মাঝে কোথাও যেন বাজছে ঢোলের ক্ষীণ শব্দ।
মল্লিকবাড়িতে আজ বিয়ের প্রস্তুতির আনুষ্ঠানিক শুরু। আগামীকাল গায়ে হলুদ, রাতে বিয়ে।
চারপাশে খুপরি ঘর, কাঁচা রাস্তা আর কাকডাকা ভোরে উঠানে চাল ধোয়ার শব্দ—সব মিলিয়ে সেই চিরচেনা গ্রামীণ বিয়ের গন্ধ। পুরো বাড়িটা রঙিন কাগজ আর ফুলের সাজে যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে।
সোলাইমান মল্লিক, তাঁর স্ত্রী রোকসানা বেগম, ছোটো মেয়ে নয়না আর বড়ো মেয়ে অরাকে নিয়ে সন্ধ্যা নামার আগমুহূর্তে চলে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। সঙ্গে এসেছে অরার বর—আরিশ।

ছোটো ভাইয়ের পুরো পরিবারকে পেয়ে আজমাইন মল্লিক যেন হাতে চাঁদ পেয়েছেন। সোলাইমানের মা আনজুম বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেছেন। অরাকেও অনেক আদর করেছেন তিনি। সেই নিয়ে নয়না আবার গাল ফুলিয়ে বসে ছিলো। অরাকে দাদি বেশি ভালোবাসে, তাকে নয়। উর্মি অরাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। অনেক বছর হয় দু’জনের দেখা হয়নি বলে কথা।
অন্যদিকে, আরিশকে ঘিরে কৌতূহলের শেষ নেই।
তাকে দেখতে অনেকেই ভিড় জমিয়েছে উঠানের একপাশে। শহুরে হালফ্যাশনের দামি শার্ট – সুট, পরিপাটি করে সেট করা চুল, হাতে ঘড়ি– যার দাম শুনে কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছে,
“ঐটা নাকি এক লক্ষ টাকার! মাথা খারাপ?”
অরাও কম যায় না। পরেছে রাউ ডিজাইনের জর্জেট শাড়ি, সঙ্গে হালকা হীরের ঝুমকা, আর হাতে চকচকে ঘড়ি। তার পায়ে এমনকি হিলজুতো।

চাচী, ফুপু, প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে বলছে,
“এই মেয়ে তো বিয়ের পর একদম বদলে গেছে রে!”
“জামাই তো দেখতে রাজপুত, আর গা-গতরে শহরের ছাপ! এমন জামাই পাইল কেমনে?”
“বুঝলি না? ওরা ধনী পরিবারের… শহরে অনেক সম্পদ।”
নয়না তখন এসব শুনে হেসে ফেলে। অরার কানে এসব শব্দ গিয়েই পৌঁছায়, কিন্তু সে কিছু বলে না।
শুধু একপাশে দাঁড়িয়ে আরিশের চোখে চোখ রাখে।
আরিশ তখন চারপাশের উৎসুক মুখগুলোর দিকে না তাকিয়ে, নিঃশব্দে বলে ওঠে,
“ গ্রামে এসে তো নিজেকে মহারাজা মনে হচ্ছে, পাখি। “

হামিংবার্ড পর্ব ৬৪ (২)

“ আপনি কি রাজার থেকে কম কিছু?
আরিশ কিছু বলার আগেই উঠানে তখন মেয়েরা গান ধরলো।
“সোনা জামাই আইসাছে রে… গায়ের রঙ তার জোছনার মতো ধইরা…”
অরা ইশারায় বোঝায়, গ্রামের বিয়ে বাড়ি মানেই এমন আনন্দ, গান।

হামিংবার্ড পর্ব ৬৬