ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
রাতের মধ্য প্রহর চলমান শিকদার বাড়ির কানায়-কানায় বাচ্চা, মহিলা, পুরুষ, যুবক-যুবতীর উপচে পড়া ভিড়। আর কেচোর মেচোরে বোঝার উপায় নেই,যে এখন মধ্যরাত! কিছু সময় পূর্বেই হলুদের প্রোগ্রাম বন্ধ হয়েছে, সবাই অনেক ক্লান্ত কিন্তু ঘুমানোর সময় একটা বিরাট বিপত্তি বেধে গেল ।
আগের , রাতে সবাই ঘর গুলিতে ঠেসে ঠুসে ফিট হয়ে গেলেও, আজকে তার দ্বিগুণ পরিমান মানুষ! প্রনয় কুঞ্জের প্রতি তালায় 24 টি করে মোট 96 টি রুম রয়েছে তাও আজকে আর জায়গা হলো না তাই ঠিক করা হলো—
ছাদে, ড্রয়িং রুমে, চিলে কোঠায়—সব জায়গায় ঘুমানো হবে। ঘরের বাইরের জায়গাগুলোতে পুরুষরা আর ঘরের ভেতরে মহিলারা ঘুমাবে।
কিন্তু যত যাই হোক পাঁচটি নির্দিষ্ট রুমে কোনো অতিথি অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারবে না। যথা—বাড়ির চার কর্তা এবং প্রণয় শিকদারের ঘর।
পরিণীতা, প্রিয়তা, ইনায়া, পূর্ণতা, চিত্রা, মিষ্টি, প্রেরণা—প্রিয়তার রুমে চলে এসেছে, যাতে তরা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে। তারা আবার এত মহিলার সঙ্গেও থাকতে পারবে না!
সব মেয়েরা মিলে প্রিয়তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো আজকে তারা রাত জেগে গল্প করবে!
কোথায় আছে মেয়েদের গল্পের শেষ? আর মেয়েগুলো যদি সমবয়সী হয়, তাহলে তো কথাই নেই!
প্রায় এক ঘণ্টা আগে প্রণয় খবর পেয়ে পুকুর পাড়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখে, তার গুণধর ভাইয়েরা একে অপরের ওপর চিটপটাং হয়ে পড়ে আছে আর বিড়বিড় করছে। দৃশ্যটা দেখে প্রণয় বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে রোহমান চাচাকে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “চাচা, পুকুর থেকে পানি তুলে এদের চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিন!”
রোহমান চাচা ও তাই করলেন। কিন্তু এতে তাদের নেশা কমলো না, বরং উল্টো!
অরন্য প্রণয় এর মাঝে কুহুকে দেখছে, কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
সে কোনো রকম টলতে-টলতে প্রণয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো।
প্রণয় শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, কোনো কথা বলছে না।
যারা স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের বড় দাদানের সামনে মেপে মেপে কথা বলে, নেশার ঘোরে তার তাকেই নিজের প্রেমিকা লাগছে!
ওরন্য প্রণয়ের গায়ে হাত দিয়ে বলল,
— “চিত্রা! তুমি এত শক্ত, লম্বা আর মোটা কেমন করে হলে?”
বলে গালে হাত দিতেই অনুভব করলো, হাতে খোঁচা লাগছে!
এটা দেখে ওরন্য কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
— “তোমার ওপর কি বেটা ভূত ভর করেছে?”
প্রণয় এই মাতলামি আর সহ্য করতে না পেরে বাঘের মতো গর্জন করে ধমক দিলো,
— “চুপ!”
ধমক খেয়ে সবাই কেপে উঠল একেবারে ভদ্র বাচ্চার মতো শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের ৩০% নেশা কাটেগেছে!
প্রণয় রোহমান চাচাকে বলল,
— “চাচা, এদেরকে লেবু পানি খাওয়ান!” নেশা না ছাড়া পর্যন্ত থামবেন না।
বলে সে চলে গেল।
রোহমান চাচা এতক্ষণ ভয়ে কাপছিলেন ধমক সুনে লাফিয়ে উঠলেন!
এই পুরো ঘটনা তিনতলায় প্রিয়তার রুমের ব্যালকনি থেকে মেয়েরা দেখছিল।
তারা হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপর গড়িয়ে পড়ছিল!
চিত্রা বলল,
— ” সেই ভয় পেয়েছে!”
এই কথা সুনেই মেয়েরা আবার ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো!
চৈত্র মাসের ব্যপসা গরমে প্রাণীকুল অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে যদিও প্রণয় কুঞ্জের ভেতরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আছে, তবু প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ বাতাসের কাছে এই কৃত্রিম বাতাস কিছুই না।
তাই মেয়েরা প্রিয়তার বেলকনিতে মাধুর বিছিয়ে গোল হয়ে বসলো।
ইনায়া পরিনীতার গায়ে হেলান দিয়ে বসে বলল,
— “পেয়ারেলাল! হায় মেরে পেয়ারেলাল!”
সবাই চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ইনায়া “ডোন্ট কেয়ার” ভাব নিয়ে বলল,
— “কি দেখছো বেবিরা?”
সবাই ইনায়াকে চেপে ধরলো ওর পেয়ারেলালের নাম জানার জন্য!
মূলত, ওরা কেউ কারো রিলেশনশিপের ব্যাপারে জানে না!
কারণ শিকদার বংশের প্রেম প্রীতির এলাও নেই কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এইসব নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে শিকদার বংশের একজন ও সিঙ্গেল নেই। কেবল সমুদ্র ছাড়া
তাদের সবার রিলেশনশিপ ওপেন সিক্রেট কেউ কারো রিলেশনশিপ নিয়ে ডিসকাস করে না
তাদের সম্পর্কের বেপারে শুধু শুধু তাদের বেস্টফ্রেন্ডরা জানে!
প্রিয়তা মিটিমিটি করে হাসছে।
সবাই হতাশ হয়ে বলল,
— “তোর পেয়ারেলাল কে কি আমরা নিয়ে যাব !”
এভাবেই তাদের গল্পের আসর জমে উঠলো
এইভাবেই গল্প আর আড্ডা চলতে থাকলো।
রাতের অন্ধকার সরে দিনের আলো এসে ধরনীরকে আলোকিত করলো
পাখির সুমিষ্ট কলতানে মুখর চারপাশ!
আজকের দিনটি বিশেষ— প্রিথার বিয়ে!
প্রণয় কুঞ্জ সরগরম!
শিকদার বাড়ির চার গিন্নি, প্রহেলিকা ও আরও এক ডজন মহিলা মিলে রান্নাঘরে সকালের নাস্তা
চিত্রা ও পরিণীতা টেবিল সেট করতে ব্যস্ত ।
ওরা দেখলো, এত বড় টেবিলে ও হবে না!
তাই স্টোর রুম থেকে একই ডিজাইনের আরও দুটো টেবিল এনে দুই পাশে লাগানো হলো।
শিকদার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ২২ জন, কিন্তু এখন ডাইনিং প্লেসে ৮০ জনের বেশি মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে!
প্রথমে পুরুষরা খাবেন— বাড়ির কর্তা সহ বিশিষ্ট অতিথিরা ও পরিবারের ছেলেরা।
তারপর বাড়ির অতিথি মহিলারা খাবেন।
এরপর বাড়ির মেয়েরা।
এইভাবেই সবর জন্য আয়োজন করা হয়েছে।
তনুশ্রী বেগম বাড়ির সব মেয়েদের ডাকতে লোক পাঠিয়েছেন।
১০ মিনিট পর প্রেরণা, মিষ্টি, কুহু, থিরা, সায়রা, প্রিথা সহ প্রিয়তা ছাড়া সবাই এসে হাজির হলো।
অর্থি বেগম মেয়েদের বললেন,
— “খাবারগুলো টেবিলে পরিবেশন করো।”
সব মেয়েরা মিলে ১৫ মিনিটের মধ্যেই সব খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিলো।
রুটি, লুচি, পরোটা, টোস্ট ব্রেড, খিচুড়ি, গরুর মাংস ভুনা, খাসির মাংস ভুনা, বাটার চিকেন, এগ স্যান্ডউইচ, পায়েস সহ ১০ রকমের ডেজার্ট আইটেম আর আরও অনেক কিছু!
খাবারের গন্ধে মুখর চারপাশ!
প্রথমে পুরুষরা, তারপর মহিলারা নাস্তা করে নিলেন।
এখন শুধু মেয়েরা বাকি।
প্রিয়তা এখনো আসেনি!
অনুজা বেগম তন্ময়কে বললেন,
— “তোর প্রিয় আপুকে ডেকে নিয়ে আয়।”
এই কথা শুনে তন্ময় একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
— “ঠিক আছে, আম্মু!”
প্রিয়তা মরার মতো ঘুমাচ্ছে!
কারণ সারারাতের আড্ডা দিয়ে শেষ রাতের দিকে তার ঘুম এসেছে!
লতানো চুলগুলো বিছানা ছাড়িয়ে, ফ্লোরে লুটোপুটি খাচ্ছে।
তন্ময় পা টিপে টিপে তার আপুর রুমে ঢুকলো।
গিয়ে দেখে, তার আপু গভীর ঘুমে ডুবে আছে !
এখন তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল সে বুঝবে না। তাই
একটা শয়তানি বুদ্ধি মাথায় এলো!
সে কানের পাশে মুখ এনে জোরে চিৎকার দিলো!
— “আপু!!!!”
এমন চিৎকার শুনে প্রিয়তার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হলো!
ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে!
একটুর জন্য সে পটল তুলে নাই।
রাগি দৃষ্টিতে সামনে তন্ময়কে হাসতে দেখে রাগটা জেনো মাথায় চড়ে গেলো !
সে তন্ময়ের চুল টেনে ধরে বলল, পেট মুটা
— “তুই কি আমার ভালো দেখতে পারিস না?!”
তন্ময় মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বললো, “আমার কী দোষ? আম্মু তো তোমাকে ডেকে আনতে বললো!”
প্রিয়তা ঝারি দিয়ে বললো, “দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে!”
কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় প্রিয়তার মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। নীলাভ চোখে অজস্র ঘুম, কিন্তু সেইসব পাত্তা না দিয়ে শরীরটা টেনে টুনে বিছানা থেকে তুলে ওয়াশরুমের দিকে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে ওড়নাটা নিয়ে ডুলু ডুলু চোখে চুল হাত দিয়ে খোঁপা করতে করতে বাইরে চলে গেল।
ডাইনিং টেবিলে শিকদার বংশের বংশধররা টেবিল আলো করে বসে আছে। তখন পুরুষরা খাওয়ার সময় অনেক ডেকে ও অর্থি বেগম জমিদারদের ঘুম থেকে তুলতে পারেননি। সবার খাওয়া শেষ, বাড়ির মেয়েরা খাবে। এমন সময় জমিদাররা ডুলতে ডুলতে এক এক জন ধপাশ ধপাশ করে চেয়ার টেনে বসল।
কাল রাতে এক এক জনকে রেহমান চাচা লিটার চারেক করে লেবুপানি খাইয়ে অনেক কষ্টে হুঁশ এনে সবার নিজ নিজ ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সারারাত প্রায় সবাই বেহুশ হয়ে ছিল, তাই তাদের এত দেরি হলো।
প্রেম রাজকে ফিসফিস করে বললো, “সেজো ভাইয়া, কালকে কী হয়েছিলো?”
রাজ বললো, “জানি না, মনে নেই!”
অরণ্য বললো, “আমাদের ঘরে এনেছিল কে?”
পৃথম বললো, “কপালে শনি নাচছে তোমাদের!”
সমুদ্র ভ্রু উঁচিয়ে বললো, “কেন? কেন?”
পৃথম কিছু বলবে, তখনই প্রিয়তা ডুলতে ডুলতে এসে পৃথমের পাশের চেয়ারে ধপাশ করে বসে ভাইয়ার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। পৃথম বোনকে আগলে নিয়ে বললো, “খুব ঘুম পাচ্ছে, বোনু?”
প্রিয়তা ভাইয়ের হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বললো, “হুম।”
প্রেম বললো, “সারা রাত কী চুরি করেছিস?”
রাজ বললো, “তোকে একদম চোরের মতো লাগছে, প্রিয়!”
প্রিয়তা পৃথমকে বললো, “এই টেপ রেকর্ডারগুলো বন্ধ করো, ভাইয়া!”
পৃথম ভাইদের চোখ রাঙালো। ইনায়া বললো, “কী হয়েছে, বেপি?”
প্রিয়তা ঝারি দিয়ে বললো, “চুপ কর, পাল্টিবাজ!”
পরিণীতা বললো, “এই ড্রামা বন্ধ কর! শুন, I have a plan !”
পৃথা বললো, “কী প্ল্যান?”
পরিণীতা বললো, “কালকে ভাইয়ারা সেম আউটফিট পরেছিল। আজ আমরা পরবো!”
চিত্রা বললো, “কী পরবো আমরা?”
পরিণীতা বললো, “আমি সবার জন্য একই ডিজাইনের ডিজাইনার শাড়ি এনেছি!”
প্রিয়তা বললো, “আমি পারবো না!”
তোরা পর!”
পরিণীতা বললো, “বোনু, প্লিজ! আপুর বিয়ের আনন্দ মাটি করবি না!”
তাদের এইসব কথার মাঝেই চার গিন্নি সবার প্লেটে খাবার তুলে দিলেন।
তনুশ্রী বেগম বড় ঝা কে বললেন, “ভাবি, দেখেন তো! কী সুন্দর লাগছে আমাদের ছেলে-মেয়েদের, মাশাআল্লাহ!”
অনুসূরী বেগম হেসে বললেন, “ঠিক বলেছ!”
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারজন মা তাদের সন্তানদের হাসি-খুশি মুখ দেখে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ।
অর্থি বেগম বললেন, “ভাবি…”এদেরকে চিনো না, এদের পেটে পেটে শয়তানি! এক একটা গোপি যন্ত্র! আর ওরা যদি একটু প্রণয় এর মতো হতো, তাহলে আমাদের আর কোনো চিন্তা থাকতো না!
এতক্ষণ প্রহেলিকা তাদের কথা শুনছিল। সে অনেকটা চুপচাপ প্রকৃতির মেয়ে, অনেকটা প্রণয়ের মতো। সে আর পৃথম পিঠাপিঠি, কিন্তু সে ভাইদের মতো প্রাণোচ্ছল আচরণ করতে পারে না। তবে, সবাই তাকে বড় আপু হিসেবে অনেক সম্মান করে।
প্রহেলিকা বলল, “এমন করছিস কেন, প্রিয়?”
সবাই এত করে বলছে রাজি হয়ে যা প্রিয়তা প্রহেলিকার দিকে তাকালো। প্রহেলিকাকে দেখলে তার ভিতরে এক কেমন অদ্ভুত যন্ত্রণা হয়, কিন্তু তা কোনোদিনই প্রকাশ করার মতো নয় ।
প্রিয়তা বলল, “সরি আপু, কালকে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে।”
সব শুনে পৃথম বলল, “তোদের যা ইচ্ছে হয় কর, আমার বোনকে জোর করবি না।”
সবাই পরোটা দিয়ে গরুর মাংসের ভুনা খাচ্ছে, শুধু প্রিয়তা প্লেট ভরে খিচুড়ি আর চার পিস ইলিশ মাছ ভাজা নিয়েছে। কারণ, এটা তার সব থেকে প্রিয় খাবার। খিচুড়ির প্লেট তুলার সময় সে ভাবে না খেতে পারবে কি না ।
সবাই খেয়ে চলে যাচ্ছে একে একে, শুধু প্রিয়তা এখনো খাচ্ছে। এর মানে এই নয় যে সে অনেক বেশি খায়, বরং একটু একটু করে খাচ্ছিল।
তখন থিরা দৌড়ে এসে বলল, “আপু, বড় আপু, ফুফিরা এসে গেছে!”
থিরার কথা শুনে প্রিয়তা লাফিয়ে উঠল। আধখাওয়া প্লেট ফেলে হাত ধুয়ে ছুটল ফুফির কাছে। সে চলে যেতেই কেউ এসে তার খিচুড়ির প্লেটটা সরিয়ে ফেলল।
প্রিয়তা দৌড়ে গিয়ে মেহেজাবিন চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরল।
মেহেজাবিন চৌধুরী—সাদমান শিকদার ও খালিদ শিকদারের ছোট চার ভাই এক বোনের মধ্যে একমাত্র বোন। তিনি কানাডায় থাকেন। ভাইঝির বিয়েতে এসেছেন।
মেহেজাবিন চৌধুরীর স্বামী ফাহাদ চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে। বড় ছেলে শুদ্ধ চৌধুরী কানাডার অন্যতম সেরা হার্ট সার্জন। সে প্রণয়ের সমবয়সী, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে প্রণয় ও শুদ্ধ একে অপরকে পছন্দ করে না।
ছোট মেয়ে স্বেতা চৌধুরী অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে।
এতক্ষণে সবাই চলে এসেছে, কারণ মেহেজাবিন চৌধুরী তার ছেলে-মেয়ের চেয়ে ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের প্রতি বেশি ভালোবাসা দেখান। তাই, তারা সবাই এ তাদের ফুপিকে অনেক ভালোবাসে।
প্রিয়তা অনেকক্ষণ ফুফির সাথে কথা বলছিল…
কিছুরির কথা মনে পড়তেই ডাইনিং প্লেসে ছুটে গেল। গিয়ে দেখল ওর প্লেটে হাওয়া! খিচুড়ির পাত্রে আর একটুও নেই, কারণ যা ছিল, সব সে আগেই প্লেট তুলে নিয়েছিল। প্রিয়তার মন খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল— ” কোন খাদক নিয়ে গেছে! তার যেন কখনো ভালো না হয়!”
কতো কিছু আছে, সেসব রেখে ওর খিচুড়ির দিকেই নজর পড়লো! মনে মনে বকতে বকতে চলে গেল নিজের ঘরে। কেউ একজন অনেক তৃপ্তি নিয়ে পুরো প্লেট খালি করে হাত ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
কালকের চেয়ে আজকের ব্যস্ততা আরও বেশি। মাগরিবের নামাজের পর বিয়ে হবে। সকাল ৯টা বাজতে পারল না, গরমের উত্তাপ ছড়ানো শুরু!
প্রণয় ঘুরে ঘুরে সব কিছুর তদারকি করছে। গরমের তাপে ছেলেটা লাল হয়ে গেছে।পরনের সাদা শার্টটা লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। হঠাৎ অনুভব করল, তার পিঠে কেউ হাত রাখলো!
প্রণয় শান্তভাবে পিছনে তাকালো। কাউকে দেখে ওর ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটলো। ছেলেটা প্রণয়কে জড়িয়ে ধরলো—
“কি ভাই! তুই তো বন্ধুকে ভুলেই গেছিস!”
সে মুচকি হেসে বলল—
“তাই বলে আমি তো আর ভুলে যেতে পারি না!”
মুখটা দুঃখী দুঃখী করলো ছেলেটা। প্রণয় ভ্রু কুঁচকে বলল—
“ড্রামাবাজ!”
আবার হাঁটা দিল। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা হেঁটে গিয়ে বলল—
“ভাই, তুই রাগ করেছিস! জানিসই তো, ফ্লাইট মিস করে ফেলেছিলাম!”
প্রণয় কিছু বলল না। ছেলেটা— সাদাফ সাখাওয়াত।
প্রণয়ের শৈশবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে বন্ধু-বান্ধব পাতানো পছন্দ করত না প্রণয়, কিন্তু এই ছেলেটা ছোট থেকেই ওর সব অভ্যাস মুখস্ত করে নিয়েছে। সবাই যখন প্রণয়ের সাথে ভাব জমাতে চাইতো, সে পাত্তা দিত না। কিন্তু এই ছেলেটাকে না বললেও সে বুঝে যেত।
তাই তো সে প্রনয় এর সব থেকে কাছের মানুষ। ছেলেটা প্রণয়ের কাছে ওর ভাইদের থেকেও বেশি আপন ।
সাদাফ সাখাওয়াত বর্তমানে UK-তে থাকে। সে একজন সায়েন্টিস্ট। কিন্তু এই কথা প্রণয় আর তার পরিবার ছাড়া অন্য কেউ জানে না। সবাই জানে, সে তার বাবার বিজনেস সামলায়। আসলেই, বিজনেস সামলায়।
দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিল। তখনই সাদাফ কিছু একটা দেখে থমকে গেল!
প্রণয়কে বলল—
“ভাই, তুই যা, আমি আসছি!”
প্রণয় একটু ভ্রু কুঁচকালো—
“তারাতারি আয়!”
প্রণয় ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিন তলায় পা রাখতেই কারও সাথে দেখা হয়ে গেল! দেখা হতেই দুজন দুজনের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল।
শুদ্ধ দাঁত কামড়ে হেসে বলল—
“কেমন আছিস, প্রণয়?”
প্রণয়ের চোখের সাদা অংশ লাল হতে লাগলো। কপালের রগগুলো ফুলে উঠছে! এই অবস্থা দেখে শুদ্ধ আবারও হেসে বলল—
“জানো, প্রণয়, তোমার এই অবস্থা দেখে বড় মায়া হয় আমার!”
প্রণয় দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
“আমি আজকে কোনো ঝামেলা চাই না!”
“তাই বলে এটা ‘ভাবিস না যে ঝামেলা হবে না!”
“নিজের চোখ সামলে রাখবি, না হলে আমার আসল রূপ দেখবি! যা তোকে কখনো দেখাতে চাই না!”
বলে প্রণয় চলে গেল।
শুদ্ধ আবারও হাসল। মনে মনে বলল—
“উপর থেকে দেখে বোঝা না গেলেও ও এখনো ছাই এর নিচে যা আগুন আছে, তা দাবানল লাগিয়ে সব কিছু জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে!”
তারপর সে কারও ফোন করলো
“একখুনি আমার সাথে দেখা করো, ওপাশ থেকে কী বললো শোনা গেল না, শুধু বললো— ‘কোথায় আসতে হবে, টেক্সট করে বলে দিচ্ছি।’
ফোন রেখে একটু বাঁকা হাসলো। পুকুর পাড়ে বসে আছে পূর্ণতা, রাজ তার পাশে বসতে বসতে বললো,
— “এখানে বসে কার সর্বনাশ করার মতলব করছেন, ম্যাডাম?”
পূর্ণতা বিরক্ত হলো, কিছু বললো না। রাজ আবার বললো,
— “এমনি-তেই তহ তোমার যা চেহারা, তাতে বেচারা চেহারা দেখেই পটল তুলবে!”
পূর্ণতা এবার দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
— “আমি যদি আপনাকে এখান থেকে ধাক্কা দিই, আপনি ওহ! পটল তুলবেন!”
রাজ ভাব নিয়ে বললো,
— “তুমি যদি হাত ধরে রাখো, আমি পটল তুলতে ও রাজি আছি!”
পূর্ণতা নরম সুরে বললো,
— “এখানে থেকে বিদায় হন, আপনার সাথে মুড খারাপ করার ইচ্ছে নেই আমার!”
রাজ চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— “ঠিক আছে!”
বলে চলে গেল। পূর্ণতার মন খারাপ হলো।
সাদাফ একটা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সামনের দৃশ্য দেখছে।
পরিণীতা নীয়ন পিংক রঙের লং গাউন পরে আছে, ফরসা গায়ের ওপর গোলাপি আভাটা ঝিলিক দিচ্ছে। কোমর পর্যন্ত রিবন্ডিং করা চুলগুলো হাওয়ার তালে দুলছে।
পরিণীতা গোলাপ গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়তে হাত বাড়াতেই পিছন থেকে একটা ভারী পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো,
— “ফুলপরী!”
পরিণীতা একটু চমকালো। পেছনে থাকা মানুষটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।সাদাফ!
ধীর পায়ে কাছে এসে গালে টিপ দিয়ে বললো,
— “কেমন আছো, ফুল পরী?”
পরিণীতা ভীষণ মিষ্টি করে হাসলো, সাথে সাথে এক গালে সুনিপুণভাবে গর্ত হলো।
যা দেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির হৃদযন্ত্রে চাপ অনুভব করলো ।
সাদাফ গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে সযত্নে তার চুলে গেঁথে দিলো।
পরিণীতা সামনে থাকা পুরুষটির দিকে চোখ তুলে তাকালো।
পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার এক সুদর্শন পুরুষ, ফরসা গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি যা তাকে ভীষণ মানিয়েছে।
সাদাফ বললো,
— “তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে, ফুলপরী!”
পরিণীতা আবারও হাসলো, আর সামনের পুরুষটি অনিমেষ মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো।
তার কাছে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হয়তো এটাই!
এইসব ঘটনা কিছু দূর থেকে কেউ একজন দেখলো। তার কলিজাটা মুচড়ে উঠলো।
সে কিছু না বলে নিঃশব্দে ধীর পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।
দুপুর ১২ টা
আজ পহেলা ফাল্গুন।
রায়পুরের সাধারণ মানুষ বিয়ের দাওয়াত খেতে শিকদার বাড়িতে ভিড় জমিয়েছে।
আজ পহেলা ফাল্গুন।
সাদমান শিকদার গোটা রায়পুরের মানুষকে মধ্যাহ্ন ভোজনের দাওয়াত দিয়েছেন।
শিকদারদের অতিথ্যপরায়ণতার রীতি অনুযায়ী, শিকদার বাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে কাজের লোক অতিথিদের খাবার পরিবেশন করে না, সেই দায়িত্ব শিকদাররা নিজে পালন করেন।
শিকদার বাড়ির পাশের মাঠে বিশাল প্যান্ডেল বানানো হয়েছে সবাইকে খাওয়ানোর জন্য।
প্রণয়, পৃথম, প্রেম, রাজ, সমুদ্র, অরণ্য, সাদাফ, শুদ্ধ— সবাই মিলে খাবার পরিবেশন করছে।
প্রথমে পুরুষরা, তারপর মহিলারা খাবে।
এই গরমে সবার বেহাল অবস্থা, কিন্তু দম ফেলার ফুরসত নেই।
প্রিয়তা গোসল সেরে একটা পাকিস্তানি ফুলস্লিভ হালকা গোলাপি রঙের ট্রিপিস পরে নিলো।
গলায় আর হাতে পানির দানাগুলো মুক্তোর মতো চকচক করছিল।
প্রিয়তার লম্বা চুল শুকাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।
হেয়ারড্রায়ার দিয়ে শুকাতে শুকাতে হঠাৎ কিছু মনে পড়লো তার।
প্রিয়তার বড় আব্বুকে কোনো এক মন্ত্রীর বাড়িতে বিশেষভাবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দাওয়াত করা হয়েছিল।
আব্বু-আম্মুরা সেদিন দাওয়াতে গিয়েছিলেন।
বাড়িতে সেদিন তেমন কেউ ছিল না।
ভাইয়া-আপুরা স্কুল-কলেজে, আট বছর বয়সী প্রিয়তা বাড়িতে একা ছিল, শুধু দুজন কাজের মহিলা ছাড়া।
প্রিয়তা গোসল সেরে হাঁটু অবধি ভেজা চুল নিয়ে ফেঁসে গিয়েছিল।
তার আম্মু তাকে বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র স্পর্শ করতে বারণ করেছিলেন।
প্রিয়তা কী করবে বুঝে পাচ্ছিল না।
চুলের পানিতে ফ্রক পুরো ভিজে চুপচুপে অবস্থা!
তখন প্রণয় ভার্সিটি থেকে ফিরে।
তখন ও গরমকাল, প্রচণ্ড গরম!
প্রণয় বাসায় ফিরে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু একটা ভেবে প্রিয়তার ঘরে উঁকি দিলো।
সামনের দৃশ্য দেখে সে একটু অবাক হলো।
হাঁটু অবধি ঘন কালো চুল থেকে চুইয়ে , পড়া পানিতে বিছানা ভিজে অবস্থা খারাপ!
প্রিয়তা তোয়ালে চেপে ধরে আছে চুলে।
প্রণয় একটু হেসে প্রিয়তাকে ডাক দিলো,
— “রক্তজবা!”
প্রিয়তা তড়িৎ গতিতে পিছন ফিরে তাকালো।
প্রণয়কে দেখে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
দৌড়ে এসে প্রণয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো!
তোয়ালাটা খুলে মাটিতে পড়ে গেল।
প্রিয়তার ভেজা চুল প্রণয়ের সফেদ রঙা শার্টটা ভিজিয়ে দিলো।
মিনিট পাঁচেক পর প্রণয় প্রিয়তাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে হেয়ারড্রায়ার দিয়ে আস্তে আস্তে করে চুল পার্ট পার্ট করে শুকিয়ে দিতে লাগলো।
আলতো হাতে!
প্রায় ৪৫ মিনিট নিয়ে অত্যন্ত যত্নে চুল শুকিয়ে দিয়ে বললো,
— “যাও, জামাটা পাল্টে আসো!”
প্রিয়তার খুশিতে নীলাভ চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো।
সে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই প্রণয়ের চোখ স্থির হয়ে গেল!
রেড ভেলভেট কালারের একটা লং ফ্রক পরে বেরিয়ে আসছে এক চটপটে লাল পরী!
দুধ-আলতা রঙা মুখে শিশুসুলভ আভা, জলজলে নীল সমুদ্রের মতো চোখ!
প্রিয়তাকে প্রণয় কাছে ডাকলো।
প্রিয়তা গিয়ে প্রণয়ের পাশে বসলো।
প্রণয় লম্বা চুলগুলো উপরে তুলে একটা সুন্দর ঝুঁটি বেঁধে দিলো।
প্রিয়তার গালে চুমু দিয়ে বললো,
— “প্রিন্সেস!”
তারস্বরে চিৎকারে প্রিয়তা ধড়ফড়িয়ে উঠলো!
পিছনে তাকিয়ে দেখলো মেয়েরা রাগি রাগি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে!
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বললো,
— “কি হয়েছে?”
পরিণীতা বললো,
— “কখন থেকে ডেকে চলেছি তোকে! তুই এখনো রেডি হোসনি! ফুপ্পি তোকে খুঁজছে!”
প্রিয়তা তাড়াতাড়ি করে একটা ফ্রেঞ্চ বেণী করলো, হাতে চুড়ি পরলো, নীল চোখে একটু কাজল দিলো, ঠোঁটে পিঙ্ক লিপগ্লস দিলো, কপালে একটা ছোট্ট টিপ পরলো।
বোনদের দিকে তাকাতেই সে বেবাচকা খেলো!
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে!
প্রিয়তা বললো,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪
— “কি দেখছো, গাইস?”
ইনায়া বললো,
— “প্রিয়ো! আমি কেন ছেলে হলাম না!”
প্রিয়তা লজ্জা পেল।
সবাই মিলে নিচে চলে গেল…