হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ১৫

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ১৫
সানা শেখ

আলভী মায়ার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে আসে।
অস্থিরতায় ঘামছে পুরো শরীর। রুমে এসেই টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। শাওয়ার না নেয়া পর্যন্ত আর ভালো লাগবে না।
গেস্টরা ফ্রেস হয়ে নীচে নেমে আসে। তাদের সকলের জন্য হালকা নাস্তা পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই।
সবাই কে খেতে দেওয়া হয়।

খাওয়া শেষ করে সবাই আবার সোফায় বসে। বাড়ির সবাই ড্রইং রুমে উপস্থিত থাকলেও মায়া আর আলভী নেই।
লিরা বসা থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে। দাঁড়ায় আলভীর রুমের সামনে এসে। ডোর ঠ্যালা দিয়ে বুঝতে পারে ভেতর থেকে লক করা।
মায়া আর আলভী রুমের ভেতরে একসাথে রয়েছে? লিরা যত টুকু শুনেছে আলভী এখনো মায়া কে সহ্য করতে পারে না। ডি ভোর্স দেওয়ার জন্যই দেশে এসেছে। তাহলে দুজন একসাথে বন্ধ রুমের ভেতর কি করছে?
মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল আলভী দেশে এসেছে মায়া কে ডি ভোর্স দেওয়ার জন্য। কিন্তু ডি ভোর্স হয়েছে নাকি হবে না সেটা আর পরে জানতে পারেনি। কয়েক বার জিজ্ঞেস করলেও ওর মা বলতে পারেনি কারণ ওর মা নিজেও জানে না পরে কি কি হয়েছে বা ঘটেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মায়া করিডোর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে সিঁড়ির দিকে।
মায়া লিরা কে আলভীর রুমের সামনে দেখেও পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
লিরা বুঝতে পারে আলভী রুমের ভেতরে একাই আছে।
ডোর নক করে কয়েক বার।
ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ আসে না। আবার নক করার জন্য হাত উচু করতেই ডোর খুলে দেয় আলভী। সামনে লিরা কে দেখে কপাল ভ্রু কুঁচকে যায়। এই মেয়ে এখানে কেন?
“একা একা রুমের ভেতর কি করছো?”
“বউ তো কথা শুনছে না তাই একা একাই শুয়ে আছি।”
“মানে?”

“কিছু না, কিসের জন্য এসেছো সেটা বলো?”
“তোমার সাথে গল্প করতে এলাম।”
“নিচে গিয়ে সকলের সাথে গল্প করো, আমি এখন বের হবো।”
“কোথায় যাবে?”
“ঘুরতে?”
“আমিও যাব তাহলে, ঢাকা শহর তো সেভাবে কখনো ঘুরে দেখা হয়নি আমার।”
“আমার ফিরতে অনেক লেট হয়ে যাবে। অন্য কোন দিন সকল কে নিয়ে ঘুরতে যাব। এখন তুমি নিচে যাও।”
বলে লিরার মুখের উপর ডোর বন্ধ করে দেয়। লিরা হা করে বন্ধ ডোরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এভাবে অপমান করল?

ঘণ্টা খানিক পর রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে আলভী। ড্রইং রুমে আসতেই সকলের সাথে দেখা হয়। কিন্তু মায়া কে দেখতে পেল না। মনে মনে একটু খুশি হয়। যাক ওর কথা শুনেছে তাহলে। কিন্তু নাঈমুর কোথায়? ওই বদ ছেলেও তো নেই এখানে। ধক করে ওঠে আলভীর বুকের ভেতর। আহা রে ওর বউ কোথায় গেল?
মাহিদ নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
সাজ্জাদ বলে,

“এভাবে তৈরি হয়ে কোথায় যাচ্ছো তোমরা দুজন?”
“বাইরে যাব একটু।”
“আমিও যাব তাহলে।”
সাজ্জাদের ছোট ভাই সাদাত বলে,
“আমিও যাব তোমাদের সাথে।”
এই সুযোগে আলভী বলে,
“তাহলে নাঈমুর কেও নিয়ে যাই। নাঈমুর কোথায়?”
নাঈমুর সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে,
“এই যে আমি, কোথায় যাওয়ার কথা হচ্ছে?”
সাজ্জাদ বলে,
“কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”
“অফিসে।”
আলভী বলে,
“অফিস কোথায় পেলি বাড়িতে?”
সাদাত বলে,

“এই অফিস সেই অফিস না ব্রো। এই অফিসে গিয়ে সবাই নিজেকে হালকা করে।”
সাদাতের কথা আলভীর বুঝতে একটু সময় লাগে।
“আচ্ছা চলো সবাই।”
সোফায় বসে থাকা আলভীর মামা বলে,
“যেখানেই যাও বেশি রাত করো না কেউ, দ্রুত ফিরে এসো।”
“আচ্ছা।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় পাঁচ জন।
সামসুন্নাহার বেগম মায়ার রুমে আসেন। মায়া তখন মানতাসা কে নিয়ে খেলছিল নিজের রুমে।
ওর বেশি মানুষ জন ভালো লাগে না এখন। তাই নিজের রুমে এসে বসে আছে।
“কি করছো মায়া?”

“এইতো বসে আছি নানু, বসুন।”
উপরে উপরে হেসে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে রাগ হয় মায়ার। এই বুড়ি কে ওর দুচোখে সহ্য হয় না।
সামসুন্নাহার বেগম বেডের উপর বসেন মায়ার পাশে।
মানতাসার সাথে একটু কথা বলে মায়ার দিকে তাকান।
“একা একা রুমে বসে আছো কেন?”
“মানতাসা নিচে থাকতে চাইছিল না তাই ওকে নিয়ে এখানে বসে আছি।”
“তা কি ভাবলে?”
“কি ভাববো?”

“তোমার আর আলভীর সম্পর্ক নিয়ে।”
“কি?”
“ওর সাথেই সংসার করবে নাকি অন্য ছেলে কে বিয়ে করবে? শুনলাম আলভী নাকি তোমাকে ডিভোর্স দিতে রাজি হচ্ছে না।”
“কেন নানু নাতি কে আবার বিয়ে করানোর জন্য মেয়ে দেখে রেখেছেন নাকি?”
সামসুন্নাহার বেগমের মুখ টা ছোট হয়ে যায়। মেয়েটা চেটাং চেটাং কথা শিখে গেছে এখন।
মায়া আর কিছু না বলে মানতাসার দিকে তাকিয়ে রইল। এই বুড়ি কম কথা শোনায়নি ওকে এত দিন ধরে। যখনই এই বাড়িতে এসেছে নানান ছলে বলে কৌশলে কথা শুনিয়েছে।
সামসুন্নাহার বেগম আরো কিছু হয়তো বলতেন কিন্তু মায়ার শক্ত চোখ মুখ দেখে আর কিছু বললেন না।
আলগোছে বসা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে জান।

মায়া ডোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখনো কি আগের সেই বোকা ভীতু মায়া নাকি যে চুপ চাপ সব শুনবে কিন্তু কিছু বলবে না? যদি তাই ভেবে থাকে তাহলে ভুল ধারণা। এই মায়া আর চুপ থাকবে না, নিজের উপর করা অন্যায় আর মেনে নেবে না। একটা কথা শোনাতে আসলে দশটা শুনতে হবে।
“ফুপ্পি?”
“বলো বেইবি।”
“ছোত আব্বু যাব।”
“কেন আমার কাছে থাকলে কি হবে?”
“চলো।”
“না।”
“পিলিচ ফুপ্পি।”
“তুমি একা যাও আমি যেতে পারব না।”
“কেন?”

“কারণ তোমার ছোট আব্বু খুবই বাজে একজন মানুষ।”
“না, ছোত আব্বু বালো মানুস। আমালে অনেক আদল কলে।”
“দুদিন ধরে আসেনি তার মধ্যেই ছোট আব্বু অনেক ভালো মানুষ হয়ে গেল?”
উপর নিচ মাথা নাড়ায় মানতাসা।
“চলো না।”
মায়া বির বির করে বলে,
“ওই অসভ্য অভদ্র শ/য়/তা/ন বদ লোকের সামনে যাব না আমি। এর পর আমার ধারে কাছে আসার চেষ্টাও করলে বারি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেব।”
“একা একা কি বলছো তুমি?”
“কিছু না, তুমি খেলো।”
“না ছোট আব্বুর কাছে যাব।”

“মহা মুশকিল তো, ছোট আব্বুর মধ্যে কি আছে যে তার কাছেই যেতে হবে?”
“আসো দেকাচ্ছি।”
“কি?”
“ছোট আব্বু।”
“ওই অসভ্য লোক কে দেখতে চাই না আমি।”
মানতাসা শোনে না মায়ার কোন কথা। ওর এখন আলভীর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।
সেই সকালে একটু কোলে নিয়েছিল তারপর আর কোলে নেয়নি। এখন আলভীর কাছে যাওয়ার জন্য মন ছুটে গেছে। মায়ার হাত টেনে ধরে করিডোরে এসে দাঁড়ায়। মায়া আর এক পা ও আগায় না। মায়া কে টেনে নিয়ে যেতে না পেরে ওকে ছেড়েই দৌড়ে এগিয়ে যায় আলভীর রুমের দিকে। ডোর ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। রুমের লাইট অফ করে জানালা দিয়ে আলো আসছে ভেতরে। রুমে কেউ নেই। আবার দৌড়ে মায়ার কাছে ফিরে আসে।

“ছোট আব্বু নেই তো।”
“রুমে নেই?”
“না।”
“তাহলে বোধহয় নিচে সকলের সাথে রয়েছে।”
“চলো।”
মায়া মানতাসার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। সোফায় আলভী কেন মাহির ছাড়া আর কোন যুবক ছেলেই নেই।
বড়রা সবাই গল্পে মশগুল হয়ে গেছে।
“তোমার ছোট আব্বু বাইরে গেছে মনে হচ্ছে। তুমি তোমার আব্বুর কাছে যাও এখন।”
মানতাসা গুটি গুটি পায়ে মাহিরের কাছে এগিয়ে যায়।
মায়া রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই লিরা পেছন থেকে ডেকে ওঠে।
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও দাঁড়ায় মায়া।
লিরা মায়ার কাছে এগিয়ে আসে।

“চলো উপরে গিয়ে কথা বলি।”
“হুম।”
মায়ার রুমে আসে দুজন। ওদের দুজনের পেছন পেছন আবার নাঈমুরের ছোট বোন নাদিরা আসে।
“কেমন কা/টছে তোমার দিন কাল?”
“আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো কা/ট/ছে আপু, তোমার কেমন কা/ট/ছে?
“ভালো, তা কি ভাবলে?”
“কোন বিষয়ে?”
“তোমাদের দুজনের।”
“আমি আর কে?”
“বুঝেও না বোঝার ভান করছো নাকি?”

“বুঝেও না বোঝার ভান করবো কেন? ক্লিয়ার করে বলো , না বললে বুঝবো কিভাবে?”
“তোমার আর আলভীর ডি ভো র্স কবে হচ্ছে?”
“নতুন ভাবী খুঁজে রেখেছো নাকি আপু?”
“মানে?”
“মানে হলো এটাই যে আমাদের দুজনের তা লাক হয়ে গেলে তোমাদের ভাইয়া কে তো আবার বিয়ে করাবে নিশ্চই। বিয়ে করানোর জন্য তো মেয়ে লাগবে, মেয়ে খুঁজে রেখেছো নাকি সেটাই জানতে চাইলাম।”
“আমি যেই প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দাও, তানা নিজেই উল্টো প্রশ্ন করছো।
“এই জন্মে তা লাক না হলে কি খুব বেশি অন্যায় বা গুনাহ হয়ে যাবে?”
“কি বলতে চাইছো?”

“আমি কিছু বলতে চাইছি না। আমি তো মুক্তি চাইছি কিন্তু তোমার ভাইয়া তো কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। এখন সুন্দরীবতী, মেকআপবতী, স্টাইলিশবতী, গোছালোবতী, শয় তানিবতী, ন্যাকাবতী, ছ্যাঁকাবতী ছ্যাচড়াবতী, কুটনিবতী, মেয়ে খুঁজে বের করে তোমার ভাইয়া কে দেখাও। তাকে পছন্দ করে যদি আমাকে একটু মুক্তি দেয় আমি তাহলে একটু খুশি হব।”
“পা গ লের মত কি সব বলছো!”
“এরকম গুণ ওয়ালা মেয়ে খুঁজে পেলে নিয়ে আসবে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার ভাইয়া কে বিয়ে করিয়ে দেব তার সাথে। এই গুণ গুলো না থাকলে কিন্তু বিয়ে ক্যানসেল।”
“সত্যি সত্যিই পা গ ল হয়েছো নাকি তুমি?”
“পা গ ল হতে যাব কেন? আজব। এই সব গুণ তো আমার মধ্যে নেই, ছিল না কখনো। তোমার ভাইয়ের বোধহয় এই সব গুণ ওয়ালা মেয়েই পছন্দ। এসব গুণ ওয়ালা মেয়ে দেখলেই তো দাঁত বের করে হাসে।”
“মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ তুমি, দ্রুত চিকিৎসা করাও নিজের। নাদিরা আয়।”
দুজন চলে যেতেই মায়া চিৎ হয়ে শুয়ে গা ঝাঁকিয়ে হেসে ওঠে।

সন্ধ্যার পর পর বাড়িতে ফিরে আসে পাঁচ জন।
বাকি চার জন স্বাভাবিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই আলভী। আলভীর হাতে পায়ে কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা।
সাদা শার্টের জায়গায় জায়গায় লাল ছোপ ছোপ দাগ হয়ে আছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসছে।
সোফায় বসে থাকা সকলেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
দ্রুত এগিয়ে আসে আলভীর কাছে।
ঐশী রহমান ছেলে কে ধরে উতলা হয়ে বলে,

” তোমার কি হয়েছে আলভী? এমন অবস্থা কিভাবে হলো? কোথায় গিয়েছিলে?”
“শান্ত হও আম্মু, সেরকম কিছু হয়নি। বাইক নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম হাত পা ছিলে গেছে একটু একটু।”
“কিভাবে পড়লে?”
“চালাতে গিয়ে।”
সাদাত বলে,
“ভাইয়া বাইক চালাতে পারে না। দুদিন শিখেছে। আজকে ভালোই চালাচ্ছিল। গিয়ার বাড়িয়ে টান দিতেই বাইক নিয়ে রাস্তায় চিৎপটাং হয়ে গিয়েছিল। আর এখন এই অবস্থা।”
“আলভী বাইক চালাতে পারে না?”
কয়েক জনের অবাক গলার স্বর।
আলভী বলে,

“বাইক চালাতে না পারা টা কি অনেক বড় পাপ?”
“না মানে এত বড় হয়েও বাইক চালাতে পারো না তাই আরকি।”
“আগে কোন দিন চালাইনি তাহলে শিখব কিভাবে?”
“জার্মানিতে বাইক নেই?”
নাঈমুরের ছোট ভাই বলে কথা গুলো।

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ১৪

“জার্মানিতে বাইক আছে কিন্তু আমার মু তা র সময় নেই। তাই চালানো শিখতে পারিনি।”
আলভীর কথা শুনে ছোট বড় সকলের অবস্থা দেখার মত। এমন ভাবে আলভীর দিকে তাকিয়ে আছে যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখে ফেলেছে বা শুনে ফেলেছে।
আশ্চর্য্য এই ছোট্ট একটা কথার জন্য এভাবে তাঁকিয়ে থাকার কি হয়েছে?

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ১৬