মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩২

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩২
মুসতারিন মুসাররাত

নীরবের হাতের উপর আলতো করে ছুঁয়ে রাখা হাতটা প্রত্যাশা চটজলদি সরিয়ে নিল। ঘন সিক্ত পাপড়িগুলো তিরতির করে কাঁপছে। নীরবের শান্ত দৃষ্টিজোড়া প্রত্যাশার নিষ্পাপ ক্রন্দনরত ফোলা ফোলা চোখের দিকে। কিছু বলবে ভেবে প্রত্যাশা মুখ খুলতে গিয়ে…আবার কী ভেবে ঠোঁট দুটো এক করল।
নীরব মস্তিষ্কে প্রেশার দিয়ে একেএকে সবটা মনে করার চেষ্টা করল। অবশ্য এক্সিডেন্টের পরের মূহুর্তগুলো তার অজানা। নার্সের বলা কথা মনে হতেই তড়াক ওঠে দাঁড়াল প্রত্যাশা। নিভান ভাইয়াকেও বলতে হবে। দরজা টেনে করিডোরে গলা বের করতেই নিভানকে ওয়েটিং চেয়ারে পেল। ইচ্ছের সাথে গল্প করছে।

-” জিজু?”
-” সমস্যা প্রত্যাশা? কিছু কী হয়েছে?”
-” উঁহু। জিজু ওনার জ্ঞান ফিরেছে। নার্স এসে বলেছিলো জ্ঞান ফেরার পর ইনজেকশন আছে। একটু জা___”
কথা কেড়ে নিয়ে বলল নিভান,
-” যাক, আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা এক্ষুনি বলেই আসছি।”
ব্যালকনি থেকে কেবিনে আসতেই বেডে নীরবের দিকে চোখ পড়ল প্রীতির।‌ স্বস্তির নিঃশ্বাস আপনাআপনি বেরোল দুই ঠোঁট গলে। নীরব চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই প্রীতির দিকে নজর পরে। প্রীতি সাথে সাথে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। সহসাই বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” নীরব, হাও আর ইউ ফিলিং নাউ? ফিলিং এনি প্রব্লেমস?”
প্রত্যাশা এসে দাঁড়াল। নীরব চোখ ঘুরিয়ে নিল। নিরুত্তাপ থাকল। এরমধ্যে নিভান এসে জিজ্ঞেস করল,
-” নীরব ভাই আমার, কোনো সমস্যা হচ্ছে কী? খারাপ লাগছে?”
নীরব মাথাটা কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে ‘না’ বোঝাল। প্রীতি ভেতরে ভেতরে আহত হলো, অপমানিত বোধ করল। ইচ্ছে খানিকক্ষণ পটর পটর করল। নীরব মুখে হাসি নিয়ে আস্তে আস্তে দু-একটা কথা বলল। নিভান ফোন করে সবাইকে জানিয়ে দিলো। প্রত্যাশার মনে হচ্ছে এতক্ষণে বুকের উপর থেকে দুশ্চিন্তার পাথরটা নামল। তবে এ ক’দিনে দু’জনের মাঝে গড়ে ওঠা দেয়াল টপকে কথা বলতে পারল না।

হাসপাতালটা নামিদামি আভিজাত্যপূর্ণ। রোগীর বেডটা মাঝখানে, একপাশে একটা একক সোফা, তার সামনেই ছোট্ট একটা গোল টেবিল। অন্য পাশে অ্যাটেনডেন্টের জন্য আলাদা আরামদায়ক কাউচ। জানালার পাশে ঝুলানো সাদা দামি পর্দা, যেখান দিয়ে ব্যালকনির দিকের আলো এসে পড়ে। চারপাশটা ঝকঝকে, ছিমছাম। রাত বারোটা পনেরো বাজে। নীহারিকা ছেলের মাথার পাশে বসে চুলের ভাঁজে আস্তে আস্তে আঙুল চালাচ্ছেন। নীরব বলল মৃদুস্বরে,
-” মা ঘুমিয়ে পড়ো। বেশি রাত জাগলে তোমার বিপি বাড়বে।”
-” সমস্যা নেই আমি ঠিক ঘুমিয়ে পড়বো। তুই আগে ঘুম আয়। আমাকে নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না বাবা। আমি অসুস্থ না, তুই অসুস্থ। তাই যা বলছি শোন, কথা না বলে চোখ বন্ধ কর। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমানোর চেষ্টা কর বাবা।”

থেমে পরমূহুর্তেই শুধালেন,
-” আলো নিভিয়ে দিবো?”
-” না থাক।”
নীরবের চোখ ঘুরেফিরে বারবার সোফায় বসে ঝিমানো প্রত্যাশার দিকে যাচ্ছে। নীরব নড়াচড়া করে উঠে বলল,
-” মা আমার ফোন? ফোন কী আছে? নাকি..”
নীহারিকা জিভে বিরক্তি সূচক ‘চ’ শব্দ তুলে বললেন,
-” এতো নড়াচড়া, ছটফট করছিস কেনো বল তো? বারবার পা নড়াচ্ছিস। ডাক্তার রেস্টে থাকতে বলেছেন। পা-টা এক্ষুনি এতো মুভমেন্ট করতে বারণ করেছেন। কিন্তু তুই তো দেখছি বাচ্চা হয়েছিস। কোনো নিষেধ-বারণই শুনতে চাইছিস না।”

-” উফ্, মা। আমার মনে হচ্ছে তোমরা সবাই মিলে আমাকে বাচ্চা বানিয়ে রেখেছো। আর কিছুই হবে না, এত টেনশন করো না। ডক্টরের সাথে কথা বলে দ্রুত বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করো। বাসায় গেলেই একদম সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নীহারিকা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
-” ডাক্তারকে বলব তোকে যেনো তাড়াতাড়ি রিলিজ না দেয়। রিলিজ দিলেই তো ঠিক করে সুস্থ হওয়ার আগেই আবার অফিসে ছুটবি। শুরু হয়ে যাবে কাজ নিয়ে ব্যস্ততা, দৌড়াদৌড়ি। তারচেয়ে বরং এখানেই ক’দিন আরামে থাক।”
-” ব্যস্ততা দৌড়াদৌড়িও বেটার, হসটপিটালে শুয়ে থাকার চেয়ে। এখানে এভাবে শুয়ে সময় যেনো যেতেই চাচ্ছে না।”

দু-তিন সেকেন্ড পরেই নীরব মা’কে মনে করাতে আবার বলল,
-” মা ফোন কী পেয়েছিলে? যদিও পাওয়ার কথা নয়। তবে পকেটেই তো ছিলো।”
-” ও হ্যাঁ। ফোন আছে তো। প্রত্যাশার কাছে।”
এই বলে ঘাড় ফিরিয়ে ডাকলেন,
-” প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশা ঝিমুচ্ছিল। একটু ধড়ফড়িয়েই উঠে, অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
-” হু-হ্যা।”
-” নীরবের ফোন তোমার কাছে আছে না? রেখেছিলে কী?”
-” হুঁ।”
প্রত্যাশা উঠে সামনের টেবিলে রাখা টোট ব্যাগটার ভেতর থেকে ফোন বের করে বলল,
-” এইযে ফোন।”
-” নীরব চাইছে।”
প্রত্যাশা ত্রস্ত ওয়ালেটও বের করল। বেডের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবের দিকে বাড়িয়ে মিহিস্বরে বলল,
-” এইযে।”

নীরব মুখে কিছু না বলে নিল। ওয়ালেট মাথার পাশে নামাতে নামাতে বিড়বিড় করল—এটা চেয়েছিলাম নাকি? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ফোনে মেসেজ টাইপ করল। হাতে স্যালাইনের নল নেই, ক্যানোলা আছে ইনজেকশন দিতে হয় জন্য।
বাইরে ওয়েটিং চেয়ারে গা এলিয়ে নিভান। বউয়ের সাথে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। নীলার নাকি ভ’য় করছে। এই প্রথম ও বাড়িতে নিভানকে ছাড়া একলা রুমে আছে। তাই একটু কেমন কেমন ভয়-ভয় অনুভূতি হচ্ছে জন্য ঘুম আসছে না। নিভান রিপ্লাইয়ে লিখলো,

-” আইডিয়া! সমাধান পেয়েছি। তোমার ঘুমানোর দরকার নেই, মেসেজে কথা বলি। তোমার ভ’য়ও দূর হবে, এদিকে এভাবে বসে বসে ঘুমানোর চেয়ে আমার সময়টাও বেটার কা’টবে।”
নীলা তাতে অ্যাংরি রিঅ্যাক্ট দিলো। নিভান হেসে কিছু লিখবে তার আগেই নীরবের মেসেজ এলো। সীন করে নিভান আস্তে করে কেবিনে ঢুকে বলল প্রত্যাশাকে,
-” প্রত্যাশা চলো তোমাকে বাসায় রেখে আসি।”
হঠাৎ নিভানের কথায় প্রত্যাশা একটু অবাকই হলো। প্রত্যাশা মুখ খোলার আগেই নিভান বলল,

-” এখন তো নীরব বেটার আছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে টেনশনের কিছু নেই। আমি আছি, মা আছে। তুমি ছোট মানুষ কষ্ট করে এভাবে থাকবে, তারচেয়ে বরং তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
চোখে থাকা ঘুমের আবেশ, ঝিমানো মূহুর্তেই উড়ে গেল প্রত্যাশার। তড়িঘড়ি বলল,
-” জিজু , আমি ঠিক আছি। কোনো প্রব্লেম নেই।”
নিভান আর কিছু বলল না। নীরবের দিকে তাকাল। নীরব মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” মা এখানে এভাবে ঘুমানো অসুবিধে হবে। তোমরা বরং বাসায় যাও। ভাইয়া তোমাদের রেখে আসবে। এখনো বেশি রাত হয়নি।”
নীহারিকা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,
-” থাম তোরা। এক-আধদিন না ঘুমালে মানুষ ম*রে যায় না। বিপদের সময় একটু-আকটু কষ্ট সহ্য করতেই হয়। আমার বাচ্চাদের জন্য এটুকু কিছুই না। আমি ঠিক আছি।”
থেমে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-” প্রত্যাশা তুমি কাউচে শুয়ে পড়ো।”
প্রত্যাশা ইতস্তত বোধ করে বলল,
-” মা ওখানে আপনি শোবেন…আমি এখানে ঠিক আছি।”
নীহারিকা শাসিয়ে উঠলেন,
-” যা বলছি তাই করো।”
এবার নিভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ত্যাড়া সুরে বললেন,
-” আর নিভান তুই বাসায় যা। দ্যাখ তোর বউ বোধহয় ভ’য় পেয়ে এতক্ষণে জ্ঞান-ট্যান হারিয়ে ফেললো।”
এইরে মা ভেবেছে আমি বাসায় যাওয়ার জন্যেই বোধহয় প্রত্যাশাকে বাসায় যাওয়ার কথা বলতে এসেছি। নিভানের এটা ভেবে নীরবের উপর রাগ উঠল। বলল নীরব দোষ হচ্ছে তার, আর তার বউয়ের। নীরবের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকায় নিভান। নীরব অবশ্য নির্বিকার।

পুরো বাড়ি নিস্তেজ, নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়ানো। ড্রয়িংরুমের দেয়াল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ গা ছমছমে ভূতুড়ি আবহ দিচ্ছে। এরমধ্যে একটা ছায়ামূর্তি ধীরেধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। বিষন্ন মন নিয়ে ওয়াটার বোতলটা হাতে ধরে প্রীতি ডায়নিংয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে জগ থেকে বোতলে পানি ঢালছিলো। তন্মধ্যে হুইলচেয়ারের চাকায় আঙুল চালিয়ে তানিয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

-” রাতে ডিনার করেছো?”
-” না।”
-” আসার পর একবারো দেখা করলে না যে।”
-” এমনিই।”
-” নীরব কেমন আছে? কী অবস্থা?”
-” আছে মোটামুটি। মাথার ডান পাশের সাইড ঘেঁষে কপালে আঘাত লেগেছে আর পায়ে। ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী চললে দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”
-” ওহ্।”
কয়েক সেকেন্ড থেমে ফের কথা তুললেন,

-” তোমার মেয়ে তো রাতে কান্নাকাটি করে ঘুমিয়েছে। সে তো দু’দিন মিশেই এখন ও বাড়ির সকলের ন্যাওটা হয়ে গেছে। দাদু বাসায় যাবে, বড় পাপা, পাপা তাদের সাথেই থাকবে।”
-” নিভান উনি খুব মিশুকে। বিকেলে ওনার সাথে ঘুরেছে গল্প করেছে। তাই হয়তো।”
প্রীতি রোবটের মতো দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। তানিয়া আকস্মিক বলে উঠলেন,
-” র*ক্ত বলে কথা। র”ক্তের মানুষদের দু’দিন দেখেই, তাদের ছাড়া এখন কিচ্ছু বুঝছে না। কী করবে এখন?”
প্রীতি বুঝতে পারল না। তাই পাল্টা প্রশ্ন করল,

-” কী করব মানে?”
-” ক’দিন মেয়েকে কাঁদিয়ে জোর করে আটকে রাখবে? ও তো এই বাড়িটাকে জেলখানা মনে করে। ওখানে যাওয়ার জন্য যা শুরু করেছে কান্না। আমি বিরক্ত হচ্ছি।”
-” পাঠিয়ে দাও ওকে।”
-” আর তুমি?”
-” কেনো, আমাকেও কী এখন ওর সাথে ও বাড়ি যেতে বলছো?”
-” মনে পড়বে না?”
-” জানি না।”

-” প্রীতি শোনো আমি বলি, ওদের র*ক্ত, ওদের বংশের প্রথম সন্তান। ওরা নেওয়ার জন্য এক পায়ে রাজি হবে। তুমি চাইলে আমি পুরনো সবকিছু ভুলে ক্ষমা চাইব। তোমাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে নিতে বলব।”
প্রীতি সোফায় বসতে বসতে বলল,
-” প্লিজ মা এরকমটা করতে যেয়ো না। ভুলেও না। ও বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে আমার অসহ্য লাগে। বিশেষ করে…..”
কথার মাঝেই তানিয়া বলল,
-” আমি জানি, কারনও অবশ্য অজানা নয়। তাহলে বলো আজ কেনো নিজ থেকেই গেলে?”
-” সেটাও তোমার অজানা থাকার প্রশ্নই আসে না।”
এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রীতি দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে নিলো। তানিয়া মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম স্বরে বললেন,

-” একটু সহ্য করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর। আর একবার না হয়…”
মুখ থেকে হাত দু’টো সরিয়ে প্রীতি রুক্ষ গলায় বলল,
-” সেই তো মানিয়ে নেওয়া মানে অ্যাক্টিং করা। আমি আজ ছয়টা বছর অভিনয়ের মাঝে থেকে অতীষ্ঠ হয়ে গেছি। আমার নিজেকে খুব টায়ার্ড লাগছে। আমি ভীষণ টায়ার্ড মা। আমি সত্যিই ভীষণ টায়ার্ড।”
তানিয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” আমি জানি মা, তোর কষ্ট বুঝি না এমন নয়।”

প্রীতি এক ঝটকায় মাথা থেকে তানিয়ার হাত ফেলে দিল। রাগ-ক্ষোভ মিশিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
-” না তুমি বোঝো না, তুমি জানোও না। কিচ্ছু জানো না তুমি। যাকে কখনো ভালোবাসিনি, এক ফোঁটা ভালোবাসা জন্মায়নি তার স্পর্শ সহ্য করা কতটা কষ্টের তা তুমি জানো না। কেবল আমি জানি সেটা। দিনের পর দিন সেই মূহুর্তগুলো আমার কাছে মিনি দোজখ লেগেছে। একা একা নিঃশব্দে ভেতরে ভেতরে গুমরে ম”রেছি।”
প্রীতির গলা ধরে এল। কয়েক মূহুর্ত পর ধরা গলায় বলল,

-” জানো মা, ঘুম হলো মানুষের বড় শান্তি, প্রশান্তি। অথচ সিল্পিং পিল হলো আমার রোজকার সঙ্গী। আজকাল মেডিসিনও আমাকে প্রশান্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমি কতটা কষ্টে আছি, ডিপ্রেশনে আছি, এবার তুমি দেখতে পারছো? এখন অবধি যা যা ভাবা হয়েছে, সব উল্টো হয়েছে। কিচ্ছু চাওয়া মতো হয়নি। অথচ আমি কী পেলাম? ঘৃ’ণা ছাড়া কিছুই না, বাড়ছে বৈ কমছে না। মাঝে মাঝে আমার নিজেকেই শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।”

দুই হাতে মুখ চেপে ধরে প্রীতি ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। লাস্ট এভাবে কেঁদেছিল ক’বছর আগে। তারপর আর কান্না করেছে বলে মনে পড়ে না। সেই থেকেই অনুভূতিহীন, জড় মনে হয় নিজেকে। সেদিন মনে হয়েছিল প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সেই যেনো প্রতিশোধের বলি হয়ে যাচ্ছে। রাত তিনটে….ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে ঝর্না ছেড়ে ভিজতে থাকে প্রীতি। শরীরে পানির ছোঁয়া লাগতেই জ্বলছিলো। তবে সেই জ্বলন হৃদয় স্পর্শ করল কই? গায়ের ব্যথা মনের ব্যথার কাছে সেদিন অতি তুচ্ছ হয়েছিল। হৃদয়টা দা’বানলের মতো পুড়ছিলো। পুরুষের ফার্স্ট স্পর্শ, হওয়ার কথা ছিলো স্বর্গীয় সুখানুভূতি। কিন্তু যাকে ভালোবাসেনি, মেনে নিতে পারেনি তার স্পর্শ আ”গুনের মতো লাগছিলো। সেদিন তিন ঘন্টা পানিতে ভিজে নীরবে কাঁদতে থাকে। শাওয়ারের পানি, চোখের পানি এক হয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো।
প্রীতি ছোট থেকেই খুব দাম্ভিক, অহংকারী আর জিদি, বদমেজাজি ছিলো। কলেজ, ভার্সিটিতে কোনো ছেলে ফ্রেন্ড ওর হাত ভুল করেও স্পর্শ হলে ও ক্ষেপে যেতো। বান্ধবীদের কাছে ফলাও করে বলতো —- প্রীতিকে ছোঁয়ার রাইট শুধু তারই হবে। প্রীতি যাকে দেবে।

আর একটা কথাও বেশ কনফিডেন্ট নিয়ে বলতো— প্রীতির যাকে ভালোলাগবে, ভালোবাসবে তাকেই বিয়ে করবে। আর সেই পাবে সেই অধিকার।
সেদিন ছিলো মেঘমেদুর দিন। গোধূলি লগ্নে ভার্সিটির লাইব্রেরী থেকে একজন ফ্রেন্ডের সাথে বেড়িয়ে হাঁটছিলো। হঠাৎ একটা ফুটবল এসে পেছনে লাগে। প্রীতি ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলে ঘুরে দাঁড়াল আ’গুন চোখে। বলটা পা দিয়ে চেপে ধরল। প্রীতি ওভার স্মার্ট, আ”গুন সুন্দরী। চোখ ঝলসানো রুপ। হালকা বাদামি চোখের মণি বিদেশিদের মতো করে তোলে ওকে। চালচলনে অহমিকা, দাম্ভিকতা চুইয়ে চুঁইয়ে পরে। প্রথম বর্ষের হলেও মাত্র কমাসেই ওর রুপ আর এটিটিউডের কথা পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়ে পরে।
প্রীতি বলটা পা দিয়ে চেপে পা ঘুরাল। দাঁত কটমট করে ঠান্ডা গলায় বলল,
-” কে মে’রেছে বল? আনসার মি?”

বলটা নীবিড় মে*রেছিলো। ও বেচারা ভ’য় পেয়েছে। বন্ধুরা এটাসেটা বলে আরো ভীতু বানাল। মেয়েটা ওদের ব্যাচেরই। একজন বলল— বড় লোকের মেয়ে, খুব রাগি। সেদিন এক ক্লাস মেট প্রপোজ করায় ঠাস করে চ’ড় মে”রেছে। ভিসির নাকি আত্মীয় হয় কেউ সাহস পায়নি কিছু বলার।
সবার ভিড় ঠেলে সামনে দাঁড়াল লম্বা চওড়া তাগড়া যুবক। উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো। ঘাড় উঁচু করে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে দাঁড়াল। পরনে ফিটিং কালো টিশার্ট, হালকা ধূসর ট্রাউজার, কোমরের কাছে হাত গুঁজে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল প্রীতির দিকে। তেমনই ঠাণ্ডা শান্ত গলায় নির্ভীক চিত্তে বলল,
-” স্যরি, বলটা দাও।”

ছোট্ট বাক্যটা প্রীতির কাছে অদ্ভুত ঠেকল। ক্ষমা চাচ্ছে বটে, কিন্তু আদেশের সুরে। প্রীতির চোখ থমকে গেল ওর মুখে। এক মুহূর্তের জন্য শীতল রাগের ভাঁজে কাঁপন ধরল। যে অভ্যস্ত ছিল সবাইকে দমিয়ে দিতে সে নিজেই যেন আজ দমে গেল। ছেলেটার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিলো, যা প্রীতিকে ঘায়েল করে। প্রীতি কিছুই বলল না, তবে বলটা হাত দিয়েও দিলো না। ডপ করে পা দিয়ে কিক মে’রে দেয়। নীরব দক্ষ হাতে সেটা ধরে নেয়।
প্রীতি ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে শুনল ছেলেটিও তাদের ব্যাচের, কেমিস্ট্রি বিভাগের। প্রীতির অভার কনফিডেন্স ছিলো, কেউ তাকে রিজেক্ট করতে পারে এই ধারণা তার ছিলো না। রিজেক্ট হওয়ার পর প্রীতির ইগো হার্ট হয়।

দু’দিন পর….
বিকেলের নরম রোদ ব্যালকনি দিয়ে কেবিনে ঢুকে হুটোপুটি খাচ্ছে। প্রত্যাশা নিঃশব্দে পা টিপে টিপে হাঁটছে। গতকাল দুপুরে বাসায় গিয়েছিলো। আজকে মাত্র আসলো। সামনে ওর পরীক্ষা তাই সবাই বারণই করেছে আসতে। তবে মনটা আঁকুপাঁকু করছিল আসতে। আবার অধরাও বলেন—জামাই হসপিটালে মেয়ে এভাবে এ বাড়ি থাকলে কথা হবে। ওরা না বললেও আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর মুখ তো ধরে রাখা যাবে না। কখন আবার বলে ফেলে। আর ভালোও দেখায় না।

শফিক সাহেব মেয়েকে নিয়ে আসেন। প্রত্যাশার হাতে ব্যাগ ভর্তি মাল্টা, আপেল। সেগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখে। নীরব ঘুমিয়ে আছে। তাই আর শফিক সাহেব ডাকলেন না। আজ শুক্রবার বিধায় নিভান মা’কে বাসায় পাঠিয়ে এতক্ষণ ও ছিলো। প্রত্যাশা আসায় চলে গেল নিশ্চিন্তে। এমনিতেও কাল নীরবকে ছাড়বে। আজকের রাতটুকু শুধু।
দুপুরে খাওয়ার পর নিভানের সাথে গল্প করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙে গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছিলো। নীরব বেডের সাইডের টেবিল র‌্যাকের উপর মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাত বাড়িয়ে নিতে যায়। শুয়ে থাকায় নাগাল পাচ্ছিল না, আরেকটু সরে হাত বাড়াল। ঠিক তখনি প্রত্যাশা বোতলটা নিল। প্রত্যাশা এতক্ষণ ব্যালকনিতে ছিলো। প্রত্যাশা কিছুটা ঝুঁকে আছে, দু’জনের চোখে চোখ পড়ল। প্রত্যাশা চোখ নামিয়ে নিলেও নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল নীরব। প্রত্যাশা বোতলের ক্যাপ খুলে মৃদু কণ্ঠে বলল,

-” পানি…”
নীরব দৃষ্টি সরিয়ে পানির বোতল নিল। বেডের হেডে হেলান দিয়ে পানি পান করল। বোতল রাখতে যাবে তখন প্রত্যাশা হাত সামনে ধরল। প্রত্যাশার হাতে বোতলটা দিতে গিয়ে দু’জনের আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে যায়। প্রত্যাশা অপ্রস্তুত হয়ে বোতলটা রাখল।
নীরব ফোন স্ক্রল করছে। প্রত্যাশা আড়চোখে নীরবকে দেখে চুপচাপ সোফায় বসে ফোন অন করল। দু’জনের মধ্যে কোনো কথাই হচ্ছে না। যতটুকু প্রত্যাশা এই হেল্প করতে গিয়ে বলেছে, ব্যস! এতটুকুই। প্রত্যাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এরমধ্যে তানভীর দেখা করতে আসে। সেদিনও অবশ্য এসেছিল। আজকে নীরবই ডেকেছিল অফিসিয়াল কথাবার্তা বলতে। ওরা অফিশিয়াল কথাবার্তা বলছে দেখে প্রত্যাশা ব্যালকনিতে গেলো। তানভীর বিদায় নিবে সেই মূহূর্তে নীরব বলল,

-” তানভীর একটা হেল্প লাগবে?”
-” জ্বী, স্যার বলুন।”
নীরব টাকা বের করে বাড়িয়ে বললো,
-” দুইটা ভ্যানিলা আইসক্রিম আনবে। আর তুমি নিচ থেকে চা অর কফি খেয়ে নিও।”
তানভীর কিঞ্চিৎ মাথা নুইয়ে হাসল। বলল অমায়িক গলায়,
-” না না, স্যার। টাকা লাগবে না। আমি আইসক্রিম এনে দিচ্ছি।”
তবুও নীরব জোর করেই টাকা গুঁজে দিল।
প্রত্যাশা সোফায় বসে মুখভার করে ফোন টিপছে। তানভীর নক করে আসতেই নীরব বলল,
-” ওগুলো প্রত্যাশাকে দাও।”
প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে তাকাল। তানভীর হেসে ভ্যানিলা কোণ আইসক্রিম বাড়িয়ে বলল,

-” ভাবী নিন।”
স্যার আসি, ভাবী আসি— বলে পরপর সালাম দিয়ে প্রস্থান করে। প্রত্যাশা আইসক্রিমের দিকে একপল তো আবার নীরবের দিকে একপল তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,
-” যাক, আলহামদুলিল্লাহ। ওনার সব মনে-টনে আছে। নাম যেহেতু একবার বলেছে, তখন আমি যে উনার বউ সেটাও খেয়াল আছে। গত পরশু থেকে মাঝেমধ্যেই হুতুম পেঁচার মতো চোখ করে আমার দিকে তাকাতে দেখছি।”
ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে ব্যঙ্গ করে আওড়ায় মনেমনে,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩১

-” ওপার বাংলা সিরিয়ালে যেমন মাথায় বারি খেয়ে সব স্মৃতি থাকে, শুধু বিয়ে করেছে, বউ আছে সেই স্মৃতিটুকু মুছে যায়। ভাবলাম এরো আবার তাই হয়নি তো? ছোট থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত সব স্মৃতি বারি খেয়েও যায় না, শুধু যায় বিয়ে আর বিয়ের পরের সময়গুলো। চৌদ্দ গুষ্টি, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে চেনে। শুধু বউকে চেনে না। এনার হাবভাব দেখে আতংকে ছিলাম; উনি না আবার সিরিয়ালের মতন কখন যেনো অমন বলে বসে— আপনি কে? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৩